আশ‘আরী ও মাতুরীদী মতবাদের কুপ্রভাব
আশ‘আরী ও মাতুরীদী পথভ্রষ্ট দু’টি ফের্কা। তাদের মধ্যে সামান্য কিছু তফাৎ রয়েছে। আশ‘আরী মতবাদটি আবুল হাসান আল-আশ‘আরী (২৫০-৩৩০ হি.)-এর নামে পরিচিত। আর মাতুরীদী মতবাদটি আবূ মানছূর আল-মাতুরীদী (২৮৫-৩৩৩ হি.)-এর নামে পরিচিত। চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর নিন্দিত যুগে এই মতবাদ দু’টির জন্ম। আরব দেশগুলোতে এই মতবাদের অস্তিত্ব না থাকলেও ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে এর কুপ্রভাব খুবই বেশি। উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলিম আশ‘আরী ও মাতুরীদী মতবাদে বিশ্বাসী। কওমী ও আলিয়া মাদরাসাগুলোতে এই আক্বীদাই শিক্ষা দেয়া হয়। দেওবন্দী, তাবলীগ জামা‘আত, বেরীলভী, কাওছারী, ফানাজফীরীদের মধ্যে এর প্রভাব বেশি (আল-মাতুরীদীয়া ওয়া মাওক্বিফুহুম মিন তাওহীদিল আসমা’ই ওয়াছ ছিফাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৭-২৯১ ও ২২৮)। তারা স্পষ্টভাবে দাবী করে থাকে যে, আমরা আশ‘আরী ও মাতুরীদী আক্বীদায় বিশ্বাসী, আমরা সালাফদের আক্বীদা গ্রহণ করি না। এভাবে তারা সালাফদের আক্বীদাকে গ্রহণ করতে পারেনি। অর্থাৎ তারা রাসূল (ﷺ), ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের আক্বীদা-মানহাজে বিশ্বাসী নয়। তাই আশ‘আরী ও মাতুরীদী আক্বীদার সাথে সালাফদের আক্বীদার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের অধিকাংশ আক্বীদাই কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী।
যারা আশ‘আরী ও মাতুরীদী মতবাদে বিশ্বাসী তারা আল্লাহর অহীকে যুক্তি, বুদ্ধি ও দর্শনের মানদণ্ডে তুলনা করে আল্লাহর ছিফাতকে অস্বীকার করে। তাদের আক্বীদার মূল বিষয় হল, তারা মানবীয় আকল বা বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে অহীকে বিচার করে এবং যুক্তি-বুদ্ধিকে অহীর উপর প্রাধান্য দেয়। নিজেদের স্বল্প জ্ঞান দিয়ে আল্লাহর জ্ঞানকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। তারা আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী কথা বলাকে অস্বীকার করে বলে, আল্লাহর কথা তাঁর নফসের সাথে স্থায়ী এবং তিনি তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কথা বলেন না। বরং তাঁর কথা সৃষ্ট (আল-কওলুল মুফীদ ‘আলা কিতাবিত তাওহীদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩০৯)। আখেরাতে আল্লাহর সাক্ষাৎ অস্বীকার করে তারা বলে, আল্লাহর দর্শন হল জ্ঞানসম্বন্ধীয়, দৃষ্টিসম্বন্ধীয় নয় (ই‘তিক্বাদু আহলিস সুন্নাহ শারহি আছহাবিল হাদীছ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৪)।
আল্লাহর আরশে উঠাকে অস্বীকার করে তারা বলে, তিনি আরশ এবং সৃষ্টিজগতের উপর কর্তৃত্ব লাভকারী। আল্লাহর প্রকৃত দু’হাতকে অপব্যাখ্যা করে বলে, হাত দ্বারা কুদরত ও নে‘মত বা রাজত্ব উদ্দেশ্য (আল-মাতুরীদীয়া ওয়া মাওক্বিফুহুম মিন তাওহীদিল আসমা’ই ওয়াছ ছিফাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১৫, ৫১৭)। এছাড়াও তারা আরো অনেক ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করে থাকে। যেমন, চার ইমামের যে কোন একজনের তাক্বলীদ ওয়াজিব। নবী ও অলীদের মাধ্যমে অসীলা নেয়া ও সুপারিশ করা জায়েয। কেননা তারা ইলমুল গায়েবের জ্ঞান রাখে এবং তাদের রূহগুলো কবর থেকে আবির্ভূত হয়ে পৃথিবীর যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করে (আল-মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ, পৃ. ৫০ ও ৫৮; আল-মাতুরীদীয়া ওয়া মাওক্বিফুহুম মিন তাওহীদিল আসমা’ই ওয়াছ ছিফাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৮, ২৯০, ২৯১, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩১১-৩১৫)। মৃতের জন্য কবরে কুরআন খতম করা বৈধ। মুরশিদুল কামেল বা পরিপূর্ণ গুরুর হাতে বাই‘আত করা ছাড়া কেউ মুক্তি পাবে না (ফাতাওয়া ক্বীত্বাঊল ইফতা বিল কুয়েত, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১১-১২)। তারা মুক্তিপ্রাপ্ত দল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের বিরোধিতা করে, ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় গালমন্দ করে এবং যখন তখন কাফের ফৎওয়া দেয়।
কথিত মাযহাবী গোঁড়ামিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা অসংখ্য ছহীহ হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করে থাকে। কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে খণ্ডন করার জন্য যঈফ ও জাল হাদীছ এবং মিথ্যা ব্যাখ্যাকে দলীল হিসাবে উপস্থাপন করে। এতে নিজেরাই ঈমানশূন্য হয়েছে এবং দ্বীনকে ব্যঙ্গ করার কারণে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে (তাতহীরুল জিনান ওয়াল আরকান, পৃ. ৮৪)। তাদের মধ্যে ছূফীদের কুফরী আক্বীদা ওয়াহদাতুল ওজূদ প্রবেশ করেছে। তাই তারা সবকিছুর মাঝে আল্লাহর উপস্থিতি সাব্যস্ত করে। আল্লাহ নিরাকার এবং সর্বত্র বিরাজমান এই কুফরী আক্বীদাও তারা পোষণ করে থাকে। রাসূল (ﷺ) কবরে জীবিত থেকে মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণ করেন এই ধারণা করে তারা তাঁর কাছে সন্তান চায়, কল্যাণ চায়, রোগমুক্তি কামনা করে। এমনকি মৃত পীরের কাছেও চায়। পীর-ফকীরের নামে কবরে-মাযারে-খানকায় গরু ও ছাগল, টাকা-পয়সা মানত করা, কুরবানী করা জায়েয মনে করে। মৃতের রূহের সম্মান জানানোর জন্য কবরের উপর মোমবাতি ও বাতি প্রজ্জ্বলন করে।
তাদের এসব আক্বীদা কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফী মানহাজের সম্পূর্ণ বিরোধী। আল্লাহর ছিফাতকে অস্বীকার করার অর্থই হল কুরআনের বহু আয়াত ও হাদীছকে অস্বীকার করা, যা প্রকাশ্য কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। কারণ যে আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকার করে, সে কাফির। ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহর রয়েছে অনেক নাম ও গুণাবলী। দলীল দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় কারো সুযোগ নেই তা প্রত্যাখ্যান করা। দলীল দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার পরে কেউ তার বিরোধিতা করলে সে কাফির’ (শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, আল-‘আরশ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৯৩)। এছাড়া তারা যে সমস্ত শিরকের সাথে জড়িত সেগুলো প্রায় সবই শিরকে আকবার। এর পরিণাম ইসলাম থেকে বহিষ্কার এবং তওবা বিহীন মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নাম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাথে শিরক করার পাপ ক্ষমা করবেন না’ (সূরা আন-নিসা : ৪৮)। তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। অত্যাচারীদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৭২)। মহান আল্লাহ আশ‘আরী ও মাতুরীদীদের ঈমান বিধ্বংসী আক্বীদা থেকে মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন-আমীন!
رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ