اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَا نَبِيَّ بَعْدَهُ
অবৈধ সম্পর্কের পরিণাম
চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, পরিবার ও সমাজকে কুলষিত করার সবচেয়ে নোংরা ও অসভ্য হাতিয়ার হল অবৈধ সম্পর্ক ও পরকীয়া। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এটা এখন ভয়াবহ মহামারির আকার ধারণ করেছে। পরকীয়া ভাইরাসের হিংস্র আগ্রাসনে পরিবার ও সমাজ বিধ্বস্ত-ক্ষতবিক্ষত। যৌন ক্ষুধায় বিকারগ্রস্ত কুরুচিপূর্ণ নারী-পুরুষ এই জঘন্য জগতের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে, যেন পশুত্বও পরাজিত হয়েছে। তারা আর মানুষ নেই, প্রতিবন্ধী রাক্ষসে পরিণত হয়েছে। তাদের কাছে আত্মমর্যাদা, সম্মানবোধ, লজ্জা, ইযযত-আবরুর কোন মূল্য নেই। কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় সবকিছুই বিকিয়ে দিয়েছে। এর সাথে কথিত অভিজাত শ্রেণীর হায়েনারাও জড়িত। প্রবাসীদের পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি এই নোংরামির শিকার হচ্ছে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। প্রবাসী স্বামীর নির্বুদ্ধিতার কারণে নিজের কষ্টার্জিত অর্থ স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেয়। আর তখনই টাকার গরমে বিলাশিতায় মত্ত হয়ে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। স্বামীকে দিনের পর দিন ধোঁকা দিতে থাকে এবং সমস্ত অর্থ-সম্পদ লুট করতে থাকে। বুকভরা আশা নিয়ে স্বামী যখন স্ত্রী-সন্তানের টানে ছুটিতে দেশে ফিরে আসে, তখনই কথিত প্রেমিকের সহযোগিতায় নিজের স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুন-গুম ও হত্যার শিকার হয়। অনেক নারী-পুরুষ দেশের বাইরে গিয়ে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে এবং পরিবারের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এভাবেই পারিবারিক কলহ-দ্বন্দ্বে শান্তি বিনষ্ট হয়, অহরহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। এই অবস্থার কারণে তাদের সন্তান-সন্ততি মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। অভিভাবকশূন্যতায় তারা মাদকসন্ত্রাসে আক্রান্ত হয় এবং বিভিন্ন অপকর্মে নেমে পড়ে।
প্রেমিক-প্রেমিকা বা গার্লফ্রেন্ড আর বয়ফ্রেন্ডের মত পাশ্চাত্যের যৌন সংস্কৃতির কুপ্রভাব প্রত্যেকটি পরিবারকে গ্রাস করেছে। ফলে একে অপরকে হত্যা করছে, প্রেমিক প্রেমিকার হাতে পাঁচ টুকরো লাশ হচ্ছে, প্রেমিকা প্রেমিকের প্রতারণায় পড়ে গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে, কখনো লাশ হচ্ছে, কেউ প্রেমিকার বিয়েতে বাধা দিতে নিহত হচ্ছে। কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ক্ষোভে-আক্রশে-অভিমানে ফাঁসিতে ঝুলছে, কখনোবা এক দড়িতে প্রেমিক-প্রেমিকা আত্মহত্যা করছে। একাধিক জুটির সাথে দৈহিক সম্পর্ক হওয়ার কারণে ছেলে-মেয়ে, ছাত্রছাত্রীরা এখন আর বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চায় না। পারিবারিক চাপে রাজী হলেও বিয়ে বেশীদিন টিকে না। কারণ পূর্বের আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, পূর্বের অবৈধ লালসা তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে। ফলে কোন মাধ্যম ছাড়াই সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং অন্যের সাথে যুক্ত হয়। ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু ঢাকাতেই দৈনিক ৩৯টি ত্বালাক্বের ঘটনা ঘটেছে, অর্থাৎ প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি ত্বালাক্বের ঘটনা ঘটেছে। সিনেমার নষ্ট জগতে যারা জড়িত তাদের কুপ্রভাবটা মিডিয়ার মাধ্যমে এখন সাধারণ মানুষের উপর পড়ছে। কারণ তারা একই সঙ্গে গোপনে-প্রকাশ্যে একাধিক নায়ক-নায়িকার সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত। পত্রিকার খবর অনুযায়ী ১৭ থেকে ২৯ জনের সাথে একই নায়িকা প্রহসনের ঘর বেঁধেছে। কেউ সিনেমা জগৎ থেকে দেহ ব্যবসায় নেমে ৩০০ ব্যক্তির যৌন লালসার শিকার হয়ে গর্বের স্বীকারোক্তি দিয়েছে (নাঊযুবিল্লাহ)। পাশের দেশ ইন্ডিয়ার সিনেমা জগতের নষ্টামি এবং মাদকের ব্যবহার বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রী ও তরুণ-তরুণীদের উপর মর্মান্তিক প্রভাব ফেলেছে।
এছাড়া নিয়ন্ত্রণহীন অনলাইনের ব্যবহারও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং প্রত্যেকটি পরিবার উক্ত কুপ্রভাবের শিকার হয়েছে। এর ফলে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, যৌন হয়রানি, অ্যাসিড সন্ত্রাস ও অপহরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটা যেন খুন, গুম, গণধর্ষণ, যেনা-ব্যভিচার, দুর্নীতি, মাদক ও সন্ত্রাসের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। অবৈধ সম্পর্ক ও পরকীয়ার ছড়াছড়িতে দেশটা পতিতাবৃত্তির আখড়ায় পরিণত হতে যাচ্ছে। এই অবস্থার কারণেই সিফিলিস, প্রমেহ, গনোরিয়া এবং এইডসসহ বিভিন্ন মহামারি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সাময়িক লালসা মিটাতে গিয়ে দীর্ঘদিনের ইলাহী গযবের শিকার হচ্ছে এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঐ অভিশাপ ভোগ করছে। অর্থ-সম্পদ, পরিবার-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে অসহনীয় যন্ত্রণায় ধুকে ধুকে মরছে।
অন্যদিকে এই অন্যায়ের জন্য ইসলাম যে বিধান দিয়েছে তা থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। কারণ এই অপরাধ প্রকাশিত হলে তা কার্যকর করা ছাড়া ক্ষমার কোন পথ নেই। আর তা হল, অবিবাহিত যিনাকারীদের জন্য একশ’ চাবুক ও এক বছরের জন্য নির্বাসন। আর বিবাহিত যিনাকারীদের জন্য রজম বা পাথর মেরে হত্যা করা (ছহীহ বুখারী, হা/৬৮৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৯০)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিবাহিত যিনাকারীদের রজম করে হত্যা করতেন (ছহীহ বুখারী, হা/৬৮৪১)। অন্য হাদীছে এসেছে, জাহান্নামে তাদেরকে উলঙ্গ করে শাস্তি প্রদান করা হবে (ছহীহ বুখারী, হা/১৩৮৬)। আর এই জাহেলিয়াতের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ছালাত, ছিয়ামসহ অন্যান্য কোন ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না; বরং তারা জাহান্নামীদের দলভুক্ত হবে (আহমাদ হা/১৭৮৩৩, সনদ ছহীহ)। শুধু তাই নয়, বৃদ্ধ যেনাকারীদের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেনও না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি (ছহীহ মুসলিম, হা/১০৭; মিশকাত, হা/৫১০৯)।
অতএব উক্ত ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদেরকে সর্বত্র আল্লাহভীতি অবলম্বন করতে হবে এবং আল্লাহর নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা নারীদেরকে বল্গাহীনভাবে চলতে নিষেধ করেছেন (সূরা আল-আহযাব : ৩৩)। দৃষ্টিকে অবনত রাখা, লজ্জাস্থানের হেফাযত করা, নিজের শরীর ও সৌন্দর্য প্রকাশ না করার এবং তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ চাদর দ্বারা ঢেকে রাখার জন্য শরী‘আত নির্দেশ দিয়েছে’ (সূরা আন-নূর : ৩১)। অর্থাৎ পর্দার বিধান অনুসরণ করা ফরয। ইসলাম নারীদেরকে একাকী রাস্তায় বের হতে নিষেধ করেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘নারী হচ্ছে আবৃত বস্তু। যখন সে বাড়ি থেকে বের হয়, তখন শয়তান তাকে প্রলুব্ধ করে’ (তিরমিযী, হা/১১৭৩, সনদ ছহীহ)। অনুরূপ ইসলাম পুরুষদেরকেও দৃষ্টি অবনত রাখতে বলেছে এবং মহিলাদের দিকে নযর দিতে নিষেধ করেছে (সূরা নূর ৩০; মুসলিম হা/২১৫৯)।
এছাড়া যে সমস্ত কারণে অশ্লীলতা, নগ্নতা ও নারী-পুরুষের অবাধ যৌনাচার ও বেহায়াপনায় ছড়ায় সেসমস্ত মাধ্যমগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন- যেন টিভি, ইন্টারনেট, বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড, ম্যাগাজিন, মুভি, মিউজিক, ফেইসবুক, ইউটিউব, আইটেম সং, কুরুচিপূর্ণ সাহিত্য, কবিতা, উপন্যাস, গান-বাজনার আসর, সিনেমা, মডেলিং, পর্নোগ্রাফি ও ব্লু ফিল্মে ইত্যাদি মাধ্যমগুলো যৌনবৃত্তি উস্কে দেয়। তাই মুমিন ব্যক্তির উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল, গোপন-প্রকাশ্য এসমস্ত হারাম কর্ম থাকা বিরত থাকা। সেই সাথে সর্বদা দ্বীনি পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করা এবং কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী দ্বীনের চর্চা অব্যাহত রাখা। তাক্বওয়া, ইখলাছ যেন বৃদ্ধি পায় সে জন্য বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ছাহাবীদের জীবনী অধ্যয়ন, বেশী বেশী নফল ছিয়াম ও নফল ছালাত করে পালন করা। এছাড়া ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যেন সুন্দরভাবে সজ্জিত হয়, সে জন্য পরিবারের অভিভাবক, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল এবং প্রশাসনকে যথাযথ ভূমিকা পালন করা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহকে অবৈধ সম্পর্ক ও পরকীয়ার মত নোংরা অভিশাপ থেকে রক্ষা করুন-আমীন!!
رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ