সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০১:০৩ অপরাহ্ন

হাদীছ অস্বীকারের পরিণাম


ইসলামী শরী‘আতের প্রধান দু’টি উৎস হল, কুরআন এবং ছহীহ হাদীছ, যা মুসলিম মিল্লাতের মূল সম্পদ। কুরআন ইসলামের আলোকস্তম্ভ আর হাদীছ হল তাঁর বিচ্ছুরিত আলোকচ্ছটা। মূলত হাদীছ হল কুরআনের নির্ভুল ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং রাসূল (ﷺ)-এর আদর্শ, কর্মনীতি ও শরী‘আতের বিস্তৃত বিবরণ। এজন্য হাদীছ ছাড়া কুরআনের মর্ম বুঝা অসম্ভব। তাই যারা নিজেদেরকে ‘আহলে কুরআন’ দাবী করে, তারা মিথ্যুক, পথভ্রষ্ট ও ধোঁকাবাজ। এরাই প্রচার করছে যে, শুধু কুরআন মানতে হবে হাদীছ মানা যাবে না। কারণ হাদীছের মধ্যে ছহীহ, যঈফ, জাল ইত্যাদি ভাগ রয়েছে। এই অজ্ঞতাপূর্ণ যুক্তির কুপ্রভাব এখন সর্বত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা হাদীছ ও সুন্নাতের ব্যাপারে যুবকদের মধ্যে সন্দেহের তীর ছুড়ে মারছে। কূটকৌশলের মাধ্যমে তারা এই মিথ্যা দাবী প্রচার করছে। অথচ তারা অধিকাংশই অশিক্ষিত ও কুরআন-সুন্নাহর ইলম সম্পর্কে নিম্নশ্রেণীর জাহেল।

আর এদের ব্যাপারে রাসূল (ﷺ) নিজেই উম্মতকে হুঁশিয়ার করে গেছেন, ‘জেনে রাখ! আমাকে কুরআন এবং তার সঙ্গে অনুরূপ বিধান দেয়া হয়েছে। জেনে রাখ! এমন এক সময় আসবে যখন কোন প্রাচুর্যবান ব্যক্তি তার আসনে বসে বলবে, তোমরা শুধু এ কুরআনকেই আঁকড়ে ধর, তাতে যা হালাল পাবে তাকে হালাল হিসাবে এবং যা হারাম পাবে তাকে হারাম হিসাবে গ্রহণ কর। নবী করীম (ﷺ) বলেন, ‘জেনে রাখ! গৃহপালিত গাধা তোমাদের জন্য হালাল নয় এবং ছেদন দাঁতবিশিষ্ট হিংস্র পশুও নয়’ (আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৪-৪৬০৫; তিরমিযী, হা/২৬৬৩-২৬৬৪, সনদ হাসান)। অর্থাৎ এগুলোকে রাসূল (ﷺ) হারাম করেছেন। 

আরেক শ্রেণীর লোক মাযহাব বা তরীক্বার দোহাই দিয়ে হাদীছ অস্বীকার করে থাকে। যে সমস্ত হাদীছ মাযহাবী ফৎওয়ার বিরোধী, সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার অস্ত্র হিসাবে তারা অনেক মিথ্যা উছূল তৈরি করেছে (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৮৮)। এই মারণাস্ত্র দিয়ে বহু হাদীছকে পিষ্ট করেছে, হাদীছের আমলকে সমাজ থেকে উঠিয়ে দিয়েছে, হাদীছের উপর গবেষণা বন্ধ করে দিয়েছে। এরা মাযহাবী গোঁড়ামিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রাসূলের হাদীছের উপর ছুরি চালিয়েছে এবং ধর্মের আড়ালে রাসূল (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এদের সংখ্যাই বেশি।

প্রত্যেক মুসলিমের জানা আবশ্যক যে, কুরআনে কারীম ও ছহীহ হাদীছ দু’টিই আল্লাহ তা‘আলার অহী। উভয়ের উপর সমানভাবে ঈমান আনয়ন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। কুরআনকে বলা হয় অহিয়ে মাতলূ, যা পাঠ করা হয়। আর হাদীছকে বলা হয় অহিয়ে গায়রে মাতলূ। দু’টিই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া বিধান (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)। ছাহাবায়ে কেরাম হাদীছকে আল্লাহ প্রেরিত ‘অহী’ হিসাবেই বিশ্বাস করতেন (ছহীহ বুখারী, হা/৭৩১০; মিশকাত, হা/১৭৫৩)। তাই হাদীছের প্রতি আমল না করে কেউ মুমিন হতে পারে না। এজন্য প্রত্যেক মুসলিমকে হাদীছ ও তার সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়া অপরিহার্য (সূরা আলি ‘ইমরান : ৩১; সূরা আন-নিসা : ৬৫, ৮০; সূরা আল-হাশর : ৭)। 

আক্বীদা, আমল, হালাল-হারাম, মু‘আমলাত সকল বিষয়ে হাদীছের উপর নিঃশর্তভাবে আমল করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীছের অনুসরণকে ওয়াজিব করে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে অন্যূন ৪০ স্থানে বর্ণনা করেছেন (ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১৯তম খণ্ড, পৃ. ৮৩)। কারণ ঈমান ও কুফরীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হল, হাদীছের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা না করা (ছহীহ বুখারী, হা/৭২৮১; মিশকাত, হা/১৪৪)। হাদীছের বিরোধিতা করা, অমান্য করা সুস্পষ্ট কুফরী ও তার পরিণাম চিরস্থায়ী জাহান্নাম (সূরা আলি ‘ইমরান : ৩২; ছহীহ বুখারী, হা/৭২৮০)

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ)  বলেন, ‘হাদীছ অস্বীকারকারীদের ধ্বংস অনিবার্য’ (শারহু উছূলি ‘ইতিক্বাদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৭৮)। ইমাম ইসহাক্ব ইবনু রাহওয়াইহ (রাহিমাহুল্লাহ)  বলেন, কারো কাছে একটি ছহীহ হাদীছ পৌঁছার পর যদি সে অস্বীকার করে তবে সে নিশ্চিতরূপে কাফির’ (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১১৫১২৫)। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ)  বলেন, ‘যারা মনে করে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্য করা অপরিহার্য নয়, তারা কাফির, তাদের হত্যা করা অপরিহার্য’ (আল-ওয়াসিয়্যাতুল কুবরা লি ইবনি তাইমিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৫)। 

ইমাম সুয়ূত্বী বলেন, ‘যারা নবী করীম (ﷺ)-এর হাদীছকে অস্বীকার করে তারা কাফির। তারা ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান অথবা অন্য কোন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে’ (মিফতাহুল জান্নাহ ফিল ইহতিজাজি বিস সুন্নাহ, পৃ. ১৪)। ইমাম ইবনু দাক্বীক্বিল ঈদ বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীছ প্রমাণিত হওয়ার পরেও যারা তা প্রত্যাখ্যান করে তারা স্পষ্ট কাফির’ (শারহুল ইলমাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭৭-১৭৮)। ইমাম ইবনু হায্ম বলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তি বলে, আমরা শুধু কুরআনের বিধানই মানব, হাদীছ মানব না, তবে সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফির’ (আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮০)। শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ)  বলেন, ‘যারা সুন্নাতকে অস্বীকার করে তারা কাফির ও স্বধর্মত্যাগী। কেননা সুন্নাতকে অস্বীকার করা কুরআনকে অস্বীকার করার নামান্তর। যে কিতাব ও সুন্নাতকে অস্বীকার করে অথবা এর কোন একটিকে সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফির’ (ইবনু বায, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪০৩ ও ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৭৬-১৭৮)

সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘যারা সুন্নাত অনুযায়ী আমল করাকে অস্বীকার করে তারা কাফির’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৯৪ ও ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৯-২০)। ইবনুল আরাবী (রাহিমাহুল্লাহ)  বলেন, ‘কোন ব্যক্তি বা ইমামের কথায় একটি আয়াত কিংবা একটি ছহীহ হাদীছও বর্জন করা জায়েয নয়। যে বর্জন করবে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্ট হবে এবং আল্লাহর দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে’ (ফতূহাতে মাক্কিয়াহ-এর বরাতে হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ, পৃ. ১০২)। মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কেউ যদি একটি হাদীছও বর্জন করে তবে আমাদের শিক্ষকমণ্ডলী বলতেন, সে কাফের হয়ে যাবে’ (মুক্ষুল বারী তরজমা ছহীহ বুখারী, পৃ. ১২)

অতএব আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের সর্বসম্মত বক্তব্য হল, হাদীছ অস্বীকারকারী কাফির। তারা ইসলাম থেকে বহিস্কৃত। এরা কেউ মারা গেলে কোন মুসলিম তার জানাযা পড়বে না এবং মুসলিমের কবরস্থানে তাকে দাফনও করা যাবে না। তাই এদের ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করতে হবে, যেন কেউ এদের প্রতারণার জালে পা না দেয়।  আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহকে এদের ফেতনা থেকে হেফাযত করুন-আমীন!!

رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ





প্রসঙ্গসমূহ »: সম্পাদকীয়

ফেসবুক পেজ