রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১০:০৮ পূর্বাহ্ন

 যাদুটোনার শারঈ সমাধান 

- মূল: ড. আব্দুল মুহসিন ইবনে মুহাম্মাদ আল-কাসিম; ইমাম ও খত্বীব, মসজিদ নববী 
- অনুবাদ: মাসঊদুর রহমান* 


(২য় কিস্তি) 

যাদুকরের চালাকি

যাদুকররা শয়তানের সেবক, আল্লাহর বান্দার মধ্য হতে যারা যাদুতে বিশ্বাসী হয়, শয়তান তাদেরকে  পথভ্রষ্ট করে। ফলে যাদুকররা যাদুতে বিশ্বাসি ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে পশু জবেহ করার আদেশ করে। কখনো তাবিজ ব্যবহারের আদেশ করে শরীরে বা বলিশের নিচে রাখে। এভাবেই যাদুকররা তাদের নিকট আগত ব্যক্তিদেরকে শিরকে নিমজ্জিত করে। নবী (ﷺ) বলেন, مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ ‘যে ব্যক্তি তাবিজ জাতীয় কোন কিছু ব্যবহার করলা সে শিরক করলো’।[১] এটা মানুষকে শিরকে নিমজ্জিত করার জন্য যাদুকরের চক্রান্ত বৈই কিছুই নয়।

যাদুকরদের একটি কৌশল হল, তাদের কাছে যারা আসে তাদের রোগ-ব্যাধি আছে এটা জেনে তাদের প্রতারিত করে, তাই তারা তাদেরকে এমন অসুস্থতার কথা বলে যা থেকে কেউ মুক্ত নয়। উদাহরণস্বরূপ: আপনার মাথা মাঝে মাঝে ব্যথা করে অথবা কখনও কখনও আপনার পিঠ ব্যথা করে বা  কখনও কখনও দুশ্চিন্তা ও দুঃখ আপনাকে পীড়া দেয় বা আপনার সাথে একটি সাধারণ সমস্যা ঘটবে যা থেকে আপনি  বেরিয়ে আসবেন। তবে আপনার সাথে এমন কিছু ঘটবে যা আপনাকে খুশি করবে, এমনিভাবে বিভিন্ন সাধারণ বাক্য উল্লেখ যা প্রতিটি মানুষের সাথে ঘটে। এর পিছনে তাদের উদ্দেশ্য হল, যারা তাদের কাছে আসে তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা, যাতে করে তারা তাদের ওপর ক্ষমতা-শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।

তাদের চালাকির মধ্যে আরো রয়েছে যে, তারা তাদের জাদুর কাগজে কুরআনের আয়াত লিখে মানুষকে বুঝায় যে, তারা জিনদের কাছে সাহায্য চায় না, বরং তারা আল্লাহর কাছে সাহায্য চায়। এমন করে সহজ-সরল মানুষদেরকে ধোঁকা দেয়।

যাদুকরের লক্ষণ বা নিদর্শন

প্রত্যেক যাদুকর বা গনকের কাছে এমন কিছু লক্ষণ রয়েছে যা সে নিজের জন্য গ্রহণ করে মানুষকে প্রতারিত করার জন্য। নিম্নে  যাদুকর ও গনকের কিছু   লক্ষণ ও নিদর্শন উল্লেখ করা হল। যেমন-

  1. যে ব্যক্তি তার কাছে এসেছিল তাকে তার নাম, তার মায়ের নাম এবং তার বয়স সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, যা একজন যাদুকরের সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষণ। কারণ সে শয়তানদের সাথে লেনদেন করে এবং জিনের বংশ পরম্পরা ফিরে যায় মায়ের দিকে বাবার দিকে না।
  2. সে যাকে যাদু করতে চায় তার কাছ থেকে কোন কিছু  চাওয়া;  যেমন অন্তর্বাস, কিছু চুল বা নখ।
  3. সে যাকে যাদু করতে চায় তার একটি ছবি চাওয়া, তাই কোনো চাকর বা অন্যকে আপনার ছবি তুলতে দেবেন না;  তারা আপনার এই ছবিটাকে যাদুর কাজে ব্যবহার করবে। এটি ফটোগ্রাফি বা ছবি উঠানো  হারাম করার একটি অন্যতম তাৎপর্য এবং ছবি না তুলে শরী‘আহ আইন মেনে চলার উপকারিতা। নবী (ﷺ) ছবি অংকনকারী চিত্রশিল্পীর ওপর অভিশাপ করেছেন।[২] সুতরাং যরূরী প্রয়োজন ছাড়া নিজের, স্ত্রীর বা আপনার সন্তানদের কোনো ছবি আপনার সাথে রাখবেন না। যাতে করে আপনি ছবি অংকনকারী চিত্রশিল্পীর শাস্তির হুকুমে পতিত না হন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, كُلُّ مُصَوِّرٍ فِى النَّارِ ‘যে কেউ ছবি-মূর্তি তৈরি করবে, সে জাহান্নামে থাকবে’। পাশাপাশি  যাতে করে যাদুকর ও কাল্পনিকদের ক্ষতি থেকে দূরে থাকা যায়।
  4. ধূপ এবং লোবান (এক প্রকারের সুগন্ধি বৃক্ষনির্যাস) ব্যবহার করা এবং ধূপকাঠিতে তা রাখা; কারণ এটি শয়তানকে তাদের নিকটে এনে দেয়, যেন তারা যাদুর কাজ করতে পারে।
  5. রাতে কাজ করা; তাদের অধিকাংশই রাতে কাজ করে। ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, سلطان السحر وعظم تأثيره إنما هو بالليل دون النهار فالسحر الليلي عندهم هو السحر القوي التأثير ‘যাদুর শক্তি এবং এর প্রভাবের মহত্ত্ব; এটি কেবল রাতেই হয় দিনের বেলায় নয়, তাই তাদের মতে রাতের যাদু হল এমন যাদু যা একটি শক্তিশালী প্রভাব রাখে’।[৩] যদি যাদুটি রাতে না করা হয়; তাহলে অন্ধকার জায়গার শরণাপন্ন হয়।
  6. যাদুকরের অস্পষ্ট কথা বলা- সে ঠোট নেড়ে নেড়ে  বিরবির করে কথা বলে যার অর্থ ও উদ্দেশ্য শ্রোতাদের বুঝতে অনেক কষ্ট হয়।
  7. সে চিকিৎসার মধ্যে কুরআনের আয়াতের সাথে হাদীছের শব্দ মিশ্রিত করে বিরবির করে কথা বলে। মানুষকে সে এই ভাবে ধোঁকা দেয় যে, সে যাদুকর নয়, বরং সে শুধু কুরআন মাজীদ ব্যবহার করে।
  8. নির্দিষ্ট কোন পশু-প্রাণী চাওয়া।
  9. যাদু সংক্রান্ত বইপুস্তক ব্যবহার করা এবং যাতে যাদুর ইঙ্গিত-সঙ্কেত ও তালিকা দেয়া আছে তা ব্যবহার করা, কখনও কখনও রোগীর পাশে নিরাপত্তা বসানো হয়।
  10. অন্ধকারে কোন কিছু লেখা, কোন সংকেত, অর্থহীন অক্ষর, কোন সংখ্যা, বর্গক্ষেত্র বৃত্ত আকানো বা কোন কিছুর সূচি-তালিকা তৈরি করা।
  11. রোগীকে পর্দা বা আড়াল করে দেয়। চামড়া, লোহা বা তামার মধ্যে একটি ত্রিভুজ বা বর্গক্ষেত্র তৈরী করে। অতঃপর রোগীর অভ্যন্তরে কিছু শিরকি দু‘আ, সংখ্যা ও অক্ষর লিপিবদ্ধ করে দেয়। অতঃপর যাদুকর রোগীকে তা গলায় অথবা বাহুতে ঝুলিয়ে রাখতে বা বালিশের নিচে রাখতে বলে। এমনকি কথিত তাবিজকে অবহেলা না করতে উৎসাহিত করে। যাদুকর রোগীকে তার রোগ বা অন্যান্য বিষয়ে ভয় দেখায় যেন সে এই তাবিজ পরিত্যাগ না করে।
  12. যাদুকর রোগীকে এমন কিছু কাগজ দেয় যাতে কিছু লেখা থাকে এবং ধুপ দেয়। অতঃপর উক্ত কাগজ পুড়িয়ে ফেলে তা থেকে ধোঁয়া বের করে।
  13. যাদুকর রোগীর জন্য কিছু অর্থহীন অক্ষর লিপিবদ্ধ করে যাতে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন ও সংখ্যা লেখা থাকে যাদুকর সেটা পানিতে ডুবিয়ে উক্ত পানি পান করার আদেশ করে অথবা উক্ত পানিতে গোসল করতে আদেশ করে।

এই হল যাদুকরের কতিপয় আলামত, যখন এগুলোর কোন একটি আপনার নিকট প্রকাশ পাবে, তখন আপনি আপনার আকিদা নষ্ট না হওয়ার ব্যাপারে নিজেকে সতর্ক রাখবেন  এবং তাদের থেকে দূরে থাকবেন। কেননা কেউ আল্লাহর জন্য কোন কিছু ছেড়ে দিলে আল্লাহ তাকে তার চাইতে উত্তম প্রতিদান দান করেন।

যাদু ও নারী

বুদ্ধিমান-জ্ঞানী ব্যক্তিরা মিথ্যুক প্রতারকের নিকট যাওয়া হতে বিরত থাকে এবং নারীদের মধ্যে এমন কিছু আছে যারা তাদের কাঙ্খিত ইচ্ছা পূরণ না হলে তাক্বদীর বা ভাগ্যের ওপর বিরক্ত হয়, তাই সে তা অর্জন করতে চেষ্টা করে যদিও তা আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে হয়। অতঃপর সে একজন যাদুকরের কাছে যায়, যে তার সাথে প্রতারণা করে এবং তাকে নিয়ে একাকী নিভৃতে যায়। এবং সে তার ইজ্জত সম্মান নষ্ট করে এবং তার ইচ্ছা পূরণের জন্য তাকে বারবার তার কাছে আসতে বলে। অতঃপর যাদুকর উক্ত মহিলাকে যাদু করে, ফলে ঐ মহিলা বারংবার তার নিকটে আসে আর যাদুকর তার ইজ্জত-সম্ভ্রম নষ্ট করে। ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, وَأَكْثَرُ مَا يَتَعَاطَاهُ مِنَ الْإِنْسِ النِّسَاءُ وَخَاصَّةً فِي حَالِ طَمْثِهِنَّ ‘যাদুকরের সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত বেশিরভাগ মানুষই হল  মহিলা, বিশেষত যখন তারা ঋতুস্রাব অবস্থায় থাকে। আর জাহান্নামীদের অধিকাংশই নারী’।[৪] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, أُرِيتُ النَّارَ فَإِذَا أَكْثَرُ أَهْلِهَا النِّسَاءُ ‘আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়। তার অধিবাসীদের বেশির ভাগই নারী’।[৫]

নারীদের উচিত আল্লাহকে ভয় করে চলা। কারণ আল্লাহর  ভয়ই সুখ ও আনন্দ নিয়ে আসে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  

وَ  مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰہَ  یَجۡعَلۡ لَّہٗ  مَخۡرَجًا ۙ . وَّ یَرۡزُقۡہُ  مِنۡ حَیۡثُ لَا یَحۡتَسِبُ

‘যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিষ্কৃতির ব্যবস্থা করে দেবেন। আর তাকে তার ধারনাতীত উৎস থেকে রিযিক দান করেন’ (সূরা আত-তালাক্ব : ২, ৩)।

তাদের উচিত তাক্বদীর বা ভাগ্যে যা লেখা আছে, তার ওপর  সন্তুষ্ট থাকা এবং ইচ্ছা ও কামনা পুরণের জন্য যাদুকর এবং কাল্পনিকদের নিকট তাদের দ্বীন বিক্রি না করা। যদি তারা কিছু অর্জন করতে চায়, তাহলে তাদের উচিত দু‘আ ও অনুরোধের সাথে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা। তিনি কল্যাণ দান করেন এবং ক্ষতি দূরীভূত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اِنۡ یَّمۡسَسۡکَ اللّٰہُ بِضُرٍّ فَلَا کَاشِفَ لَہٗۤ  اِلَّا ہُوَ ۚ وَ اِنۡ یُّرِدۡکَ بِخَیۡرٍ فَلَا رَآدَّ لِفَضۡلِہٖ ‘আল্লাহ যদি তোমাকে কোন কষ্টে নিপতিত করেন তাহলে তিনি ছাড়া কেহ তা মোচনকারী নেই, আর যদি তিনি তোমার প্রতি কোন কল্যাণ ও শান্তি পৌঁছাতে চান তাহলে তাঁর অনুগ্রহের কোন অপসারণকারী নেই’ (সূরা ইউনুছ: ১০৭)।

যাদুকরের যুলুম-নির্যাতন

যাদুকর তার যাদুর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার যুলুম ও সিমালংঘন করে। সে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে পশু জবেহ করার, তাবিজ ঝুলানোর এবং অদৃশ্যের কথা সত্য হিসাবে বিশ্বাস করার আদেশ করার মাধ্যমে সে অনেক মানুষকে শিরকে নিমজ্জিত করে।  যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। কিছু যাদু আছে যার মাধ্যমে অশ্লীল কাজ সম্পাদন করার চেষ্টা করা হয়। বিশেষ করে যখন তা নারীর ক্ষেত্রে হয়। যাদুকর অনেক ভালো পরিবারের মধ্যে পরস্পরের সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়। এমন অনেক দম্পতি আছে যাদের পরস্পরের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক, অথচ যাদুকর তাদের সেই সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়। পিতা-মাতার বিচ্ছেদের কারনে অনেক সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যায়। এই কারণে তারা জীবনে তিক্ততা আস্বাদন করে। যাদুকর অনেক সুখের ঘর তছনছ করেছে; দু’টি প্রেমময়, সামঞ্জস্যপূর্ণ দম্পতির মধ্যে কত মতবিরোধ  সৃষ্টি করেছে! বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের কারণে কত সন্তান জীবনের তিক্ততার স্বাদ গ্রহণ করেছে।

যাদুকর মানুষের জন্য কত উদ্বেগ নিয়ে এসেছে?! কত সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে?! কত সুখী পরিবার ভেঙ্গে গিয়েছে?! কত দরিদ্র মানুষ নিরাপত্তার জন্য ঋণ নিয়েছে এবং পরিণাম সহ্য করেছে যার সব কিছুই হয়েছে একটি দুষ্ট যাদুকরের কারণে। যাদুকর আরোগ্যের দাবি করে বা অদৃশ্য জ্ঞানের দাবি করে তাদের অর্থ অবৈধভাবে ভোগ করে অন্যদের ওপর কতটা অন্যায় করেছে? যাদুকর যে সিদ্ধান্তই নেয় তাতে সমাজের প্রতি বিদ্বেষপোষন এবং এটিকে কলুষিত করে। সে অন্যের সুখী জীবনে খুশি হয় না, ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধিতে সে আনন্দ পায় না এবং সে সম্মানি ব্যক্তিদের মর্যাদাকেও প্রাধান্য দেয় না।

যাদুকর সমাজের জন্য নিতান্তই ক্ষতিকর। কোন দিক থেকেই তাদের মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। সমাজ কি কখনো  যাদুকরকে ভালো কাজ করতে, গরীবদের উপকার করতে, এতিমদের দেখভাল করতে অথবা বিধবাদের যত্ন নিতে দেখেছেন? তার কর্মের উদ্দেশ্য হল সমাজের ক্ষতি করা, সমাজের মানুষদেরকে শিরকে নিমজ্জিত করা, তাদের উপর ব্যস্ততা, যন্ত্রণা, উদ্বেগ ও পরস্পরের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করা।

যাদুকরের বৈশিষ্ট্য

যাদুকর মনের দিক থেকে মানুষের মধ্য হতে খুবই খারাপ, তাদের স্বভাব নিকৃষ্টতর কর্মকাণ্ড হীনতর, তারা মানুষের ওপর অনেক যুলুম অত্যাচার করে। ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘খারাপ আত্মার সাথে মিলিত হওয়া ব্যতীত যাদু কোন কাজ করে না’।[৬] তিনি আরো বলেন, ‘অত্যাচারী অন্তরসমূহ  শয়তানের ঘর ও আশ্রয় স্থান।[৭]

যাদুকর মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নির্বোধ, বিবেকহীন, তাদের  চিন্তা-ভাবনা খুবই খারাপ। তারা দুনিয়াবি বিশ্বাস বাস্তবায়নের জন্য পরকালের ওপর ইহকালকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। যাদুকর যে কাজ করে এর পরিণাম জাহান্নাম এটা সে জানে। ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘শয়তানের আনুগত্য বা তার নৈকট্য অর্জন ছাড়া খুব কম যাদুই আছে যা কাজ করে। হয়তোবা শয়তানের নামে কোন কিছু জবেহ করতে হয়, অথবা উদ্দেশ্যেই। আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য যবেহ করাটাই শিরকের প্রকার  সমূহের মধ্য হতে একটি’।[৮] যাদুকর শয়তানের মতই, মানুষের ক্ষতি করার দিক থেকে সে শয়তানের সাদৃশ্য রাখে। ইমাম আলুসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘শয়তান শুধুমাত্র তাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নোংরা, অপবিত্র  ও অনিষ্টকর বিষয়ে সাহায্য করেও। হতে পারে তা কথা, কাজ ও আক্বীদাগত বিষয়ে’।[৯]

একজন সাধারণ মানুষ যেমন মিথ্যা সহ আরো বিভিন্ন তুচ্ছ গুনে গুনান্নিত, যাদুকরও ঠিক অনুরুপ। তার নিকট যে আসে তাকে সে মিথ্যা বানোয়াট তথ্য দেয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, فَيَكْذِبُ مَعَهَا مِائَةَ كَذْبَةٍ ‘এবং এর সাথে শত মিথ্যা মিশিয়ে বলে’।[১০] অহংকারের ক্ষেত্রে যাদুকর অন্যের চেয়ে অনেক উঁচুতে। আর এটা এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা ইবলীসকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  اِلَّاۤ  اِبۡلِیۡسَ ؕ اِسۡتَکۡبَرَ وَ کَانَ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ ‘শুধু ইবলীস ব্যতীত; সে অহংকার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হল’ (সূরা ছদ : ৭৪)। যাদুকর গর্ব-অহংকার করে মানুষদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথচ সে শয়তানের কাছে অনেক দুর্বল ও ভীতু। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَّ  اَنَّہٗ کَانَ رِجَالٌ مِّنَ الۡاِنۡسِ یَعُوۡذُوۡنَ بِرِجَالٍ  مِّنَ  الۡجِنِّ فَزَادُوۡہُمۡ  رَہَقًا ‘আর যে কতিপয় মানুষ কতক জিনের স্মরণ নিত, ফলে তারা জিনদের আত্মম্ভরিতা বাড়িয়ে দিত’ (সূরা জিন: ৬)। যখন কোন  ব্যক্তি শয়তানের নিকট দুর্বল হয় তখন তাকে দুর্বল ও তুচ্ছ করা শয়তানের জন্যও আবশ্যক হয়ে যায়।

যাদুকর কি সুখে বাস করে?

যাদুকর এই জীবনে দুঃখে-কষ্টে জীবন যাপন করে। সে দ্বীনের স্বাদ-মাধুর্য হারিয়ে ফেলে এবং কুরআন মাজীদ শ্রবন করাকে অপছন্দ করে, এমনকি ছালাতের আযানকেও ভয় পায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ اَعۡرَضَ عَنۡ ذِکۡرِیۡ فَاِنَّ لَہٗ مَعِیۡشَۃً ضَنۡکًا وَّ نَحۡشُرُہٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ  اَعۡمٰی ‘যে আমার স্মরণে বিমুখ তার জীবন যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে ক্বিয়ামাত দিবসে উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়’ (সূরা ত্ব-হা: ১২৪)।

যাদুকর লোকদের থেকে দূরে থাকে, সে তাদের সাথে যোগাযোগ করে না এবং  তাদের  সাথে মিশেও না যতক্ষণ না তাকে যাদু করতে এবং  মানুষের ক্ষতি করতে বলা হয়। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) এই বলে তার অবস্থা বর্ণনা করেন যে, ‘অপবিত্রতার সাথে মেশার জন্য, কুকুরের সঙ্গী হিসাবে, সে আবর্জনা, কবরস্থান এবং গোবরের স্থানে যায় এর গন্ধ এতই খারাপ যে, যা শারঈ কোন বিষয় কে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন করতে পারে না’।[১১]

যাদুকর নিঃস্ব অবস্থায় জীবন যাপন করে। সে রাতে ভালো ঘুমাতে পারে না এবং দিনেও সুখে থাকে না। বরং সে অন্ধকার জায়গায় বিভিন্ন শিরকি কর্মকাণ্ড, ধুপ জাতীয় জিনিস ও শয়তানি ঘ্রাণ গ্রহণ করার মাধ্যমে রাত উপভোগ করে। অতঃপর সে বিষন্ন-অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় দিনে ঘুমায়। এই হল অবাধ্য যাদুকরের অবস্থা। মহান আল্লাহ বলেন,وَ مَا رَبُّکَ بِظَلَّامٍ لِّلۡعَبِیۡدِ ‘তোমার রব বান্দাদের প্রতি কোন যুলম করেন না’ (সূরা ফুছ্ছিলাত: ৪৬)। তিনি আরো বলেন, فَاَمَّا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَاُعَذِّبُہُمۡ عَذَابًا شَدِیۡدًا فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ ۫ وَ مَا لَہُمۡ مِّنۡ نّٰصِرِیۡنَ ‘অনন্তর যারা কুফরী করেছে, বস্তুতঃ তাদেরকে ইহকাল ও আখিরাতে কঠোর শাস্তি প্রদান করব এবং তাদের জন্য কেহ সাহায্যকারী নেই’ (সূরা আলে ইমরান: ৫৬)।

যাদুকর যে কাজগুলো করে তার ক্ষতি বা খারাপ পরিনতি যাদুকর ও যাদুতে বিশ্বাসি, যারা যাদুকরের নিকট আসে তাদের সকলকেই ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا یَحِیۡقُ الۡمَکۡرُ السَّیِّیُٔ  اِلَّا بِاَہۡلِہٖ ‘কূট ষড়যন্ত্র ওর উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করে’ (সূরা ফাতির: ৪৩)। যাদুকর যেখানেই যাবে সেখানেই সে দুঃখ-কষ্টে থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَ لَا  یُفۡلِحُ  السَّاحِرُ  حَیۡثُ  اَتٰی ‘যাদুকরেরা যাই করুক কখনও সফল হবে না’ (সূরা ত্ব-হা: ৬৯)। ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অর্থাৎ যাদুকর পৃথিবীর যেখানেই থাকুক সফলতা অর্জন করতে ও ক্ষতি বা শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবে না’।[১২]

আল্লাহর সাথে কুফরী করার কারণে যাদুকরের সমস্ত আমল- ইবাদত বাতিল হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ لَقَدۡ  اُوۡحِیَ  اِلَیۡکَ وَ اِلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ لَئِنۡ  اَشۡرَکۡتَ لَیَحۡبَطَنَّ عَمَلُکَ وَ  لَتَکُوۡنَنَّ  مِنَ  الۡخٰسِرِیۡنَ 

‘আপনার প্রতি, আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই অহী হয়েছে; আপনি আল্লাহর শরীক স্থির করলে আপনার কাজ নিস্ফল হবে এবং আপনি হবেন ক্ষতিগ্রস্ত (সূরা আয-যুমার: ৬৫)।

যাদুকরের নিকট যে যাতায়াত করে সে তার নিকট হতে কি আশা করে? অথচ তার ব্যপারে জাহান্নামের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। সে যাদুকরের নিকট হতে তার মনের ইচ্ছা পূরণের কি আশা করতে পারে? যে পৃথিবীর সবচেয়ে অধম তুচ্ছ নিকৃষ্ট ব্যক্তি।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

*শিক্ষক, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা, হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র:
[১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৪২২, সনদ শক্তিশালী।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৮৬।
[৩]. ইবনুল কাইয়্যিম, বাদাইঊল ফাওয়াইদ, ২য় খণ্ড (বৈরূত: দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, তা.বি.), পৃ. ২১৯।
[৪]. শামসুদ্দীন কুরতুবী, আল-জামেঈ লি আহকামিল কুরআন, ২য় খণ্ড (কায়রো: দারুল কুতুবিল মিছরিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ, ১৩৮৪ হি.), পৃ. ৫০।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯।
[৬]. ই‘লামুল মুআক্কিআইন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৩৩।
[৭]. বাদাইঊল ফাওয়াইদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২১৯।
[৮]. প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬৪।
[৯]. রুহুল মায়ানি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৮।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৭০১।
[১১]. ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১১তম খণ্ড, পৃ. ২১৫।
[১২]. আল-জামেঈ লি আহকামিল কুরআন, ১১তম খণ্ড, পৃ. ১৪৯।




প্রসঙ্গসমূহ »: আক্বীদা বা বিশ্বাস
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা এবং মুসলিম জীবনে তার প্রভাব - আবূ মাহদী মামুন বিন আব্দুল্লাহ
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
আল-কুরআন তেলাওয়াতের ফযীলত (৮ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৯ম কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আশূরায়ে মুহাররম : করণীয় ও বর্জনীয় - ইউনুস বিন আহসান
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ - ড. মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
যাদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মুছীবতে ধৈর্যধারণ করার ফযীলত - শায়খ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম
সন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণ এবং তার প্রতিদান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

ফেসবুক পেজ