রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৫ পূর্বাহ্ন

জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ 

- মূল: ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহহাফ আল-ক্বাহতানী 
- অনুবাদ : মুহাম্মাদ ইমরান বিন ইদরিস* 


(৫ম কিস্তি) 

[ফেব্রুয়ারী’২৫-এর পর]


৫. শত্রুর সাক্ষাতে অবিচল থাকা

আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সাহায্য লাভের উত্তম উপকরণ হল শত্রুর সাক্ষাতের সময় অবিচল থাকা পশ্চাৎপদ মনোভাব ও পলায়ন না করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যতগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন প্রত্যেকটা যুদ্ধেই তিনি অবিচলতার সাথে থেকেছেন। যেমন বদর, উহুদ ও হুনাইন। হুনানের দিন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধের ময়দানে অটল অবিচল থেকে পশ্চাৎপদ মুসলিমদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন,أَنَا النَّبِيُّ لاَ كَذِبْ أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ اللَّهُمَّ نَزِّلْ نَصْرَكَ ‘আমি অবশ্যই আল্লাহর নবী, এ কথা মিথ্যে নয়। আমি ইবনু আবদুল মুত্তালিব। হে আল্লাহ! আপনার সাহায্য অবতীর্ণ করুন’।[১] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হলেন আমাদের উত্তম আদর্শ ও অনুকরণীয় নমুনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ  فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ  اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ  لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ  الۡاٰخِرَ  وَ ذَکَرَ  اللّٰہَ  کَثِیۡرًا ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (সূরা আল-আহযাব : ২১)।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে ছাহাবীগন যুদ্ধের ময়দানে অটল অবিচল থেকেছেন।

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ أَبِيْ أَوْفَى رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ يَا أَيُّهَا النَّاسُ لَا تَتَمَنَّوْا لِقَاءَ الْعَدُوِّ وَاسْأَلُوْا اللهَ الْعَافِيَةَ فَإِذَا لَقِيْتُمْ فَاصْبِرُوْا وَاعْلَمُوْا أَنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ ظِلَالِ السُّيُوْفِ

আব্দুল্লাহ ইবনু আবূ আওফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, হে লোকসকল! শত্রুর মোকাবিলার আকাঙ্খা কর না; বরং আল্লাহর কাছে নিরাপত্তার প্রার্থনা কর। তবে মোকাবিলা সংঘটিত হয়ে গেলে, তখন ধৈর্য্যধারণ কর এবং জেনে রাখ, তলোয়ারের ছায়ার নীচেই জান্নাত অবস্থিত।[২]

৬. বিরত্ব দেখানো, সাহসিকতা প্রকাশ করা, উৎসর্গ করা

আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সাহায্য লাভের উত্তম উপকরণ হল যুদ্ধের ময়দানে বিরত্ব গুনে গুনানিত হওয়া, সাহসিকতা প্রকাশ করা, আত্মোৎসর্গ করা। এবং জিহাদ কখনো কারো মৃত্যুকে এগিয়েও দিতে পারে না আবার পিছিয়েও দিতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَیۡنَ مَا تَکُوۡنُوۡا یُدۡرِکۡکُّمُ الۡمَوۡتُ وَ لَوۡ کُنۡتُمۡ  فِیۡ  بُرُوۡجٍ مُّشَیَّدَۃٍ ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদেরকে পেয়ে যাবে, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর’ (সূরা আন-নিসা : ৭৮)।

কবি বলেছেন,

من لم يمت بالسيف مات بغيره
تعددت الأسباب والموت واحد

‘যে তরবারির আঘাতে মরে না সে মরে অন্য ভাবে,
      মৃত্যু উপকরণ ভিন্ন হলেও মৃত্যু একই হবে।

এই কারণেই পরিপূর্ণ ইমানের অধিকারী ব্যক্তিরাই দলের ভিতরে সবচেয়ে বীরত্ব প্রদর্শনকারী ও সাহসী হয়। তাদের মাঝে আবার সবচেয়ে বেশি সাহসী ও বীরত্ব পূর্ন ব্যক্তি ছিলেন মুহাম্মাদ (ﷺ)। যার বীরত্ব বিভিন্ন বড় বড় যুদ্ধের ময়দানে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন-

(ক) বদর যুদ্ধের ময়দানে তার সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রকাশ।

عَنْ عَلِيٍّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ لَقَدْ رَأَيْتُنَا يَوْمَ بَدْرٍ وَنَحْنُ نَلُوذُ بِرَسُوْلِ اللهِ ﷺ وَهُوَ أَقْرَبُنَا إِلٰـى الْعَدُوِّ وَكَانَ مِنْ أَشَدِّ النَّاسِ يَوْمَئِذٍ بَأْسًا

আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, বদরের দিন আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিলাম। শত্রুর দিকে তিনিই ছিলেন আমাদের চাইতে বেশি নিকটবর্তী। সেদিন তিনিই ছিলেন বীর-বিক্রমশালীদের অন্যতম।[৩]

عَنْ عَلِيًّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنَّا إِذَا حَمِيَ الْبَأْسُ وَلَقِيَ الْقَومُ الْقَوْمَ اِتَّقَيْنَا بِرَسُوْلِ اللهِ ﷺ فَلَا يَكُوْنُ أَحَدٌ مِّنَّا أَدْنَى إِلَى الْقَوْمِ مِنْهُ

আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আরো বলেছেন, ‘যুদ্ধ যখন তীব্র হয়ে উঠত এবং উভয় পক্ষ লড়াইয়ে লিপ্ত হত, আমরা তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আড়ালে নিজেদেরকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম। ফলে তিনি ছাড়া আমাদের মধ্যে কেউ শত্রুর অধিক নিকটবর্তী থাকত না।[৪]

(খ) উহুদ যুদ্ধের ময়দানে তিনি এতো বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন যে, তার সাথে কেউ যুদ্ধ করতে সাহস পায়নি।

(গ) হুনাইন যুদ্ধেও তিনি খুব বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন।

قَالَ الْبَرَاءُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ كُنَّا وَاللهِ إِذَا احْمَرَّ الْبَأْسُ نَتَّقِي بِهِ وَإِنَّ الشُّجَاعَ مِنَّا لَلَّذِي يُحَاذِي بِهِ‏ يَعْنِي النَّبِيَّ ﷺ ‏.‏

বারা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আল্লাহর কসম যুদ্ধের উত্তেজনা যখন ঘোরতর হয়ে উঠত, তখন আমরা তার মাধ্যমে আত্মরক্ষা করতাম। নিশ্চয়ই আমাদের মাঝে বীরপুরুষ তিনিই যাকে যুদ্ধে তার সামনে রাখা হয় অর্থাৎ নবী (ﷺ)।[৫]

হুনাইনের যুদ্ধে তাঁর খচ্চরের উপর আরোহন এবং আরো অন্যান্য কার্যাবলী তার মহান সাহসিকতা ও বীরত্বের উপর প্রমান করে। এই কারণেই আলেমগন বলেছেন, ‘যুদ্ধের ময়দানে এবং প্রচন্ড ও তুমুল যুদ্ধের সময় খচ্চরের উপর আরোহন করা হল চূড়ান্ত পর্যায়ের সাহসিকতা ও বীরত্বের প্রকাশ। কেননা এই ভয়াবহ কঠিন পরিস্থিতিতে ঘোড়ার উপর আরোহন করা পলায়ন ও পশ্চাৎপদ মনোভাব তৈরি করে’।

অনুরূপভাবে যখন অমুসলিমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ঘিরে নিয়েছে তখন তার বাহন থেকে নিচে নেমে আসাটাও চূড়ান্ত পর্যায়ের ধৈর্য, অটল অবিচল, সাহসিকতা ও বীরত্বের প্রকাশ করে। ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ سَلَمَةَ بْنِ الْأَكْوَعِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قال وَمَرَرْتُ عَلَى رَسُولِ اللهِ ﷺ مُنْهَزِمًا وَهُوَ عَلَى بَغْلَتِهِ الشَّهْبَاءِ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ ‏"‏ لَقَدْ رَأَى ابْنُ الأَكْوَعِ فَزَعًا ‏"‏ ‏.‏ فَلَمَّا غَشُوا رَسُولَ اللهِ ﷺ نَزَلَ عَنِ الْبَغْلَةِ ثُمَّ قَبَضَ قَبْضَةً مِنْ تُرَابٍ مِنَ الأَرْضِ ثُمَّ اسْتَقْبَلَ بِهِ وُجُوهَهُمْ فَقَالَ ‏"‏ شَاهَتِ الْوُجُوهُ ‏"‏ ‏.‏ فَمَا خَلَقَ اللهُ مِنْهُمْ إِنْسَانًا إِلاَّ مَلأَ عَيْنَيْهِ تُرَابًا بِتِلْكَ الْقَبْضَةِ فَوَلَّوْا مُدْبِرِينَ فَهَزَمَهُمُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ وَقَسَمَ رَسُولُ اللهِ ﷺ غَنَائِمَهُمْ بَيْنَ الْمُسْلِمِينَ ‏.‏

সালামাহ ইবনুল আক্বওয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি পরাজিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছ দিয়ে গমন করলাম। আর তিনি তখন তার সাদা রং-এর খচ্চরের উপর আরোহিত অবস্থায় ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ইবনুল আক্বওয়া সন্ত্রস্ত অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করেছে। এরপর শত্রুরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ঘিরে ফেলল। তখন তিনি স্বীয় খচ্চর থেকে অবতরণ করলেন। তারপর এক মুষ্টি মাটি যমীন থেকে তুলে নিলেন। এরপর তাদের মুখমণ্ডলে তা নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন, তাদের মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে গেছে। এরপর তাদের সকল মানুষের দু’চোখ-ই সে এক মুষ্টি মাটির ধূলায় ভরে গেল। তারা পশ্চাৎ দিকে পলায়ন করল। আল্লাহ তা‘আলা এ দ্বারাই তাদেরকে পরাস্ত করলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গনীমাতের সম্পদ মুসলিমদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন।[৬]

বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মোট উনিশটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার মধ্যে আটটি যুদ্ধে তিনি সরাসরি যুদ্ধ করেন। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর জীবনে ৫৬টি ক্ষুদ্র সেনা দল প্রেরন করেন। আর তিনি ২৭টি যুদ্ধ নিজে পরিচালনা করেন। তার যুদ্ধসমুহের মধ্যে ৯টি যুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। এভাবেই তার ছাহাবীগন ও তাদের পরবর্তী মুমিন মুসলিমগন যুদ্ধ করেছেন । সুতরাং মুজাহিদের উপর আবশ্যক হল তাঁরা তাঁদের নবী (ﷺ)-কে পূর্নাঙ্গ অনুসরণ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ  فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ  اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ  لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ  الۡاٰخِرَ  وَ ذَکَرَ  اللّٰہَ  کَثِیۡرًا ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (সূরা আল-আহযাব : ২১)।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন সবার চেয়ে বেশি সাহসী এবং বীর।

عَنْ أَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ ﷺ أَحْسَنَ النَّاسِ وَأَشْجَعَ النَّاسِ وَأَجْوَدَ النَّاسِ وَلَقَدْ فَزِعَ أَهْلُ الْمَدِيْنَةِ فَكَانَ النَّبِيُّ ﷺ سَبَقَهُمْ عَلَى فَرَسٍ وَقَالَ وَجَدْنَاهُ بَحْرًا

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী (ﷺ) সর্বাপেক্ষা সুশ্রী, সাহসী ও দানশীল ছিলেন। মদিনাবাসীগণ একবার ভীত-শংকিত হয়ে পড়ল। নবী (ﷺ) ঘোড়ায় চড়ে সবার আগে এগিয়ে গিয়ে বললেন, আমরা এটিকে সমুদ্রের মত পেয়েছি।[৭]

৭. বেশি বেশি দু‘আ ও যিকির করা

আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সাহায্য লাভের উত্তম উপকরণ হল যুদ্ধের ময়দানে বেশি বেশি দু‘আ ও জিকির করা। আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তার শত্রুকে পরাস্ত করতে এবং তার অলী-আউলিয়া-কে সাহায্য সহযোগিতা করতে সক্ষম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اِذَا سَاَلَکَ عِبَادِیۡ عَنِّیۡ فَاِنِّیۡ قَرِیۡبٌ ؕ اُجِیۡبُ دَعۡوَۃَ الدَّاعِ  اِذَا دَعَانِ  ۙ فَلۡیَسۡتَجِیۡبُوۡا لِیۡ وَ لۡیُؤۡمِنُوۡا بِیۡ  لَعَلَّہُمۡ  یَرۡشُدُوۡنَ 

‘এবং যখন আমার সেবকবৃন্দ (বান্দা) আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞেস করে তখন তাদেরকে বলে দাওঃ নিশ্চয়ই আমি সন্নিকটবর্তী। কোন আহ্বানকারী যখনই আমাকে আহ্বান করে তখনই আমি তার আহ্বানে সাড়া দিই; সুতরাং তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমাকে বিশ্বাস করে- তাহলেই তারা সঠিক পথপ্রাপ্ত হতে পারবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৬)। তিনি আরো বলেন, وَ قَالَ رَبُّکُمُ  ادۡعُوۡنِیۡۤ   اَسۡتَجِبۡ لَکُمۡ ؕ اِنَّ  الَّذِیۡنَ یَسۡتَکۡبِرُوۡنَ عَنۡ عِبَادَتِیۡ سَیَدۡخُلُوۡنَ جَہَنَّمَ دٰخِرِیۡنَ ‘তোমাদের রব বললেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। কিন্তু যারা অহংকারে আমার ইবাদাতে বিমুখ তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে’ (সূরা আল-মুমিন : ৬০)। তিনি আরো বলেন,

اِذۡ تَسۡتَغِیۡثُوۡنَ رَبَّکُمۡ فَاسۡتَجَابَ لَکُمۡ اَنِّیۡ مُمِدُّکُمۡ بِاَلۡفٍ مِّنَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ  مُرۡدِفِیۡنَ

‘স্মরণ কর সেই সংকট মুহুর্তের কথা, যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট কাতর কন্ঠে প্রার্থনা করেছিলে, আর তিনি সেই প্রার্থনা কবূল করে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে এক হাজার মালাইকা/ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করব, যারা একের পর এক আসবে’ (সূরা আল-আনফাল : ৯)।

শত্রু সাক্ষাতে আল্লাহ তা‘আলা বেশি বেশি দু‘আ ও যিকির করাতে আদেশ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا لَقِیۡتُمۡ فِئَۃً فَاثۡبُتُوۡا وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ  تُفۡلِحُوۡنَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর এবং অবিচল থাকবে যখন কোন দলের সম্মুখীন হও, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে’ (সূরা আল-আনফাল : ৪৫)।

আল্লাহ তা‘আলা সাহায্যকারী। সাহায্যকারী ও বন্ধু হিসাবে তিনি কতই না উত্তম। মহান আল্লাহ বলেন, وَ مَا النَّصۡرُ اِلَّا  مِنۡ  عِنۡدِ اللّٰہِ الۡعَزِیۡزِ  الۡحَکِیۡمِ ‘আর সাহায্য শুধু আল্লাহর পক্ষ হতেই হয়ে থাকে, যিনি অতীব সম্মানী, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আলে ইমরান : ১২৬)।

এই কারণেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকতেন এবং তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে বিজয় দান করেন এবং তাঁকে অনেক সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন।

عُمَر بْن الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ  قَالَ نَظَرَ نَبِيُّ اللهِ ﷺ إِلَى الْمُشْرِكِينَ وَهُمْ أَلْفٌ وَأَصْحَابُهُ ثَلاَثُ ِائَةٍ وَبِضْعَةَ عَشَرَ رَجُلاً فَاسْتَقْبَلَ نَبِيُّ اللهِ ﷺ الْقِبْلَةَ ثُمَّ مَدَّ يَدَيْهِ وَجَعَلَ يَهْتِفُ بِرَبِّهِ ‏"‏ اللَّهُمَّ أَنْجِزْ لِي مَا وَعَدْتَنِي اللَّهُمَّ آتِنِي مَا وَعَدْتَنِي اللَّهُمَّ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَ مِنْ أَهْلِ الإِسْلاَمِ لاَ تُعْبَدُ فِي الأَرْضِ‏"‏ فَمَا زَالَ يَهْتِفُ بِرَبِّهِ مَادًّا يَدَيْهِ مُسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةِ حَتَّى سَقَطَ رِدَاؤُهُ مِنْ مَنْكِبَيْهِ فَأَتَاهُ أَبُو بَكْرٍ فَأَخَذَ رِدَاءَهُ فَأَلْقَاهُ عَلَى مَنْكِبَيْهِ ثُمَّ الْتَزَمَهُ مِنْ وَرَائِهِ فَقَالَ يَا نَبِيَّ اللهِ ﷺ كَفَاكَ مُنَاشَدَتُكَ رَبَّكَ فَإِنَّهُ سَيُنْجِزُ لَكَ مَا وَعَدَكَ فَأَنْزَلَ اللهُ ‏:‏ ‏( اِذۡ تَسۡتَغِیۡثُوۡنَ رَبَّکُمۡ فَاسۡتَجَابَ لَکُمۡ اَنِّیۡ مُمِدُّکُمۡ بِاَلۡفٍ مِّنَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ  مُرۡدِفِیۡنَ ‏)‏ فَأَمَدَّهُمُ اللهُ بِالْمَلاَئِكَةِ ‏.‏

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, (বদর যুদ্ধের দিন) মুশরিকদের উপর নবী (ﷺ) দৃষ্টিপাত করলেন। তারা (সংখ্যায়) ছিল এক হাজার। আর তার সাথীরা ছিলেন তিন শত দশজনের কিছু বেশি। আল্লাহর নবী (ﷺ) কিবলার দিকে মুখ করে দুই হাত তুলে তার প্রভুর নিকট দু‘আ করতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার সাথে যে অঙ্গিকার করেছিলে তা পূর্ণ কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তা দান কর, যার অঙ্গিকার তুমি করেছ। হে আল্লাহ! যদি কতিপয় মুসলিমের এ ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস করে দাও তাহলে যমিনে তোমার ইবাদাত অনুষ্ঠিত হবে না’। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিবলামুখী হয়ে দু’ হাত তুলে এমনভাবে তার প্রভুর নিকট দু‘আ করেন, তার উভয় কাঁধ হতে তার চাদর গড়িয়ে পড়ে গেল। তখন আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর কাছে এসে চাদরটি উঠিয়ে তাঁর কাধে তুলে দিলেন এবং তাঁর পেছন দিক হতে তাঁকে চেপে ধরে বললেন, হে আল্লাহর নবী (ﷺ)! আপনার প্রভুর সমীপে আপনার যথেষ্ট পরিমাণ দু‘আ করা হয়েছে। আপনার সাথে আল্লাহ তা‘আলা যে অঙ্গিকার করেছেন তা অবশ্যই তিনি পূর্ণ করবেন। এ প্রসঙ্গে বরকতময় আল্লাহ তা‘আলা নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন اِذۡ تَسۡتَغِیۡثُوۡنَ رَبَّکُمۡ فَاسۡتَجَابَ لَکُمۡ اَنِّیۡ مُمِدُّکُمۡ بِاَلۡفٍ مِّنَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ  مُرۡدِفِیۡنَ ‘স্মরণ কর সেই সংকট মুহুর্তের কথা, যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট কাতর কন্ঠে প্রার্থনা করেছিলে, আর তিনি সেই প্রার্থনা কবূল করে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে এক হাজার মালাইকা/ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করব, যারা একের পর এক আসবে’ (সূরা আল-আনফাল : ৯)। অতএব আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের পাঠিয়ে তাদেরকে সাহায্য করেন।

এভাবেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধের ময়দানে সর্বদায় আল্লাহ তা‘আলা কে ডাকতেন। এই দু‘আ থেকে তা বুঝা যায়,

اَللَّهُمَّ مُنْزِلَ الْكِتَابِ سَرِيْعُ الْحِسَابِ وَمُجْرِيَ السَّحَابِ وَهَازِمَ الأَحْزَابِ، اهْزِمْهُمْ وَانْصُرْنَا عَلَيْهِمْ ‏‏‏.‏

‘হে আল্লাহ! কুরআন নাযিলকারী, দ্রুত হিসাব গ্রহনকারী, মেঘমালা পরিচালনাকারী, সেনাদল পরাভূতকারী, আপনি কাফির সম্প্রদায়কে পরাজিত করুন এবং আমাদেরকে তাদের উপর বিজয় দান করুন’।[৮]

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللهِ ﷺ إِذَا غَزَا قَالَ: اللَّهُمَّ أَنْتَ عَضُدِي وَنَصِيرِي، بِكَ أَحُولُ، وَبِكَ أَصُولُ، وَبِكَ أُقَاتِلُ

আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধ আরম্ভের সময় বলতেন, হে আল্লাহ! আপনিই আমার শক্তির উৎস ও সাহায্যকারী, আপনার সাহায্যেই আমি কৌশল অবলম্বন করি, আপনার সাহায্যেই বিজয়ী হই এবং আপনার সাহায্যেই যুদ্ধ করি’।[৯]

عَنْ أَبِي بُرْدَةَ بْنِ عَبْدِ اللهِ، أَنَّ أَبَاهُ، حَدَّثَهُ أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ كَانَ إِذَا خَافَ قَوْمًا قَالَ ‏"‏اللَّهُمَّ إِنَّا نَجْعَلُكَ فِي نُحُورِهِمْ وَنَعُوذُ بِكَ مِنْ شُرُورِهِمْ"‏ ‏.‏

আবূ বুরদা ইবনু আব্দুল্লাহ (রাহিমাহুল্লাহ) সূত্রে বর্ণিত। তার পিতা তাকে বর্ণনা করেন যে, নবী (ﷺ) কোনো সম্প্রদায় দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা করলে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমরা তাদের মোকাবিলায় তোমাকে যথেষ্ট ভাবছি এবং তাদের অনিষ্ট হতে তোমার কাছে আশ্রয় চাইছি’।[১০]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ‏(‏حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ‏)‏ قَالَهَا إِبْرَاهِيمُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ حِينَ أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَقَالَهَا مُحَمَّدٌ ﷺ حِينَ قَالُوا ‏(‏إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ‏)‏

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ বাক্যটি ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) বলেছিলেন, যখন তিনি অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। আর মুহাম্মাদ (ﷺ) বলেছিলেন, যখন লোকেরা বলল,‏إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ‏‏ ‘তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জমায়েত হয়েছে, সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় কর কিন্তু এটি তাদের ঈমান দৃঢ়তর করেছিল এবং তারা বলেছিল ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্ম বিধায়ক’।[১১]

আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদকারীদের অবস্থা এ রকমই হওয়া যরূরী। কেননা আল্লাহ তা‘আলা দু‘আর মাধ্যমে এতো পরিমাণ বিপদ দূরীভূত করেন তা তিনিই ভালো জানেন।

عَنْ سَلْمَانَ الْفَا رِسِيِّرَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ لَا يَرُدُّ الْقَضَاءَ إِلَّا الدُّعَاءُ وَلَا يَزِيدُ فِي الْعُمْرِ إِلَّا الْبر

সালমান আল ফারিসী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, দু‘আ ছাড়া অন্য কিছুই তাক্বদীরের লিখনকে পরিবর্তন করতে পারে না এবং নেক আমল ছাড়া অন্য কিছু বয়স বাড়াতে পারে না।[১২]

৮. আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য করা

যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সাহায্য লাভের বড় ও মহান উপকরণ হল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য করা। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদকারীদের উপর আবশ্যক হল; বরং সকল মুসলিমের উপর আবশ্যক হল এক পলক সময় আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতায় এবং পাপে লিপ্ত না হওয়া। এবং আল্লাহ তা‘আলা যা করতে আদেশ করেছেন তা পালন করা এবং আল্লাহ তা‘আলা যা নিষেধ করেছেন তা থেকে অনেক দূরে থাকা ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ  وَ رَسُوۡلَہٗ  وَ لَا  تَنَازَعُوۡا فَتَفۡشَلُوۡا  وَ تَذۡہَبَ رِیۡحُکُمۡ وَ اصۡبِرُوۡا ؕ اِنَّ  اللّٰہَ  مَعَ  الصّٰبِرِیۡنَ ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হও। তোমরা সাহস ও ক্ষমতাহারা হয়ে যাবে যদি নিজেদের মধ্যে বিবাদ কর। তোমরা ধৈর্য ধারণ কর। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন’ (সূরা আল-আনফাল : ৪৬)। তিনি আরো বলেন, وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ  وَ یَخۡشَ اللّٰہَ  وَ یَتَّقۡہِ  فَاُولٰٓئِکَ  ہُمُ  الۡفَآئِزُوۡنَ ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হতে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম’ (সূরা আন-নূর : ৫২)। তিনি আরো বলেন, 

وَ مَا کَانَ  لِمُؤۡمِنٍ وَّ لَا مُؤۡمِنَۃٍ  اِذَا قَضَی اللّٰہُ  وَ رَسُوۡلُہٗۤ  اَمۡرًا اَنۡ  یَّکُوۡنَ  لَہُمُ الۡخِیَرَۃُ  مِنۡ اَمۡرِہِمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ  فَقَدۡ  ضَلَّ  ضَلٰلًا  مُّبِیۡنًا

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিনা নারীর সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেহ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সেতো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট’ (সূরা আল-আহযাব : ৩৬)। তিনি আরো বলেন, فَلۡیَحۡذَرِ الَّذِیۡنَ یُخَالِفُوۡنَ عَنۡ اَمۡرِہٖۤ  اَنۡ تُصِیۡبَہُمۡ فِتۡنَۃٌ  اَوۡ یُصِیۡبَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ‘সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর কঠিন শাস্তি’ (সূরা আন-নূর : ৬৩)। হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ بُعِثْتُ بِالسَّيْفِ حَتَّى يُعْبَدَ اللهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَجُعِلَ رِزْقِي تَحْتَ ظِلِّ رُمْحِي وَجُعِلَ الذِّلَّةُ وَالصَّغَارُ عَلَى مَنْ خَالَفَ أَمْرِي وَمَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

ইবনে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমি (ক্বিয়ামতের পূর্বে) তরবারি-সহ প্রেরিত হয়েছি, যাতে শরীকবিহীনভাবে আল্লাহর ইবাদত হয়। আমার জীবিকা রাখা হয়েছে আমার বর্শার ছায়াতলে। অপমান ও লাঞ্ছনা রাখা হয়েছে আমার আদেশের বিরোধীদের জন্য। আর যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদেরই দলভুক্ত।[১৩]

৯. ঐক্যবদ্ধ থাকা বিবাদ বিতর্ক না করা

মুজাহিদের উপর আবশ্যক হল যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য লাভের সমস্ত উপকরণগুলি বাস্তবায়ন করা। বিশেষ করে, আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা, একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করা, সম্মিলিতভাবে থাকা, বিবাদ বিতর্ক না করা, দলে দলে বিভক্ত না হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ  وَ رَسُوۡلَہٗ  وَ لَا  تَنَازَعُوۡا فَتَفۡشَلُوۡا  وَ تَذۡہَبَ رِیۡحُکُمۡ وَ اصۡبِرُوۡا ؕ اِنَّ  اللّٰہَ  مَعَ  الصّٰبِرِیۡنَ ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হও। তোমরা সাহস ও ক্ষমতাহারা হয়ে যাবে যদি নিজেদের মধ্যে বিবাদ কর। তোমরা ধৈর্য ধারণ কর। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন’ (সূরা আল-আনফাল : ৪৬)। তিনি আরো বলেন, وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ‘আর তোমরা একযোগে আল্লাহর রজ্জু সুদৃঢ় রূপে ধারণ কর ও বিভক্ত হয়ো না’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)। তিনি আরো বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡہُ اِلَی اللّٰہِ وَ الرَّسُوۡلِ  اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ  وَّ  اَحۡسَنُ  تَاۡوِیۡلًا

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর ও রাসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের জন্য যারা বিচারক তাদের; অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে কোন মতবিরোধ হয় তাহলে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তিত হও, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে থাক; এটাই কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতর পরিসমাপ্তি’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)।

১০. ধৈর্য ধারণ করা এবং ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করা

যুদ্ধের ময়দানে মুজাহিদদের ওপর গুরুত্বপূর্ণ একটা আবশ্যকীয় বিষয় হচ্ছে তারা সর্বদাই ধৈর্য ধারণ করবে। বিশেষ করে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার সময়ে আরো বেশি ধৈর্য ধারণ করবে।

ধৈর্যের প্রকার :  ধৈর্য তিন প্রকার। (ক) আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্যে ধৈর্য ধারণ করা (খ) আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত হারাম বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করা (গ) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اصۡبِرُوۡا وَ صَابِرُوۡا وَ رَابِطُوۡا ۟ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ لَعَلَّکُمۡ  تُفۡلِحُوۡنَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য অবলম্বন কর এবং সহিষ্ণু ও সুপ্রতিষ্ঠিত হও; এবং আল্লাহকে ভয় কর যেন তোমরা সুফল প্রাপ্ত হও’ (সূরা আলে ইমরান : ২০০)। তিনি আরো বলেন, وَ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ  وَ رَسُوۡلَہٗ  وَ لَا  تَنَازَعُوۡا فَتَفۡشَلُوۡا  وَ تَذۡہَبَ رِیۡحُکُمۡ وَ اصۡبِرُوۡا ؕ اِنَّ  اللّٰہَ  مَعَ  الصّٰبِرِیۡنَ ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হও। তোমরা সাহস ও ক্ষমতাহারা হয়ে যাবে যদি নিজেদের মধ্যে বিবাদ কর। তোমরা ধৈর্য ধারণ কর। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন’ (সূরা আল-আনফাল : ৪৬)। হাদীছে এসেছে,وَاعْلَمْ أَنَّ النَّصْرَ مَعَ الصَّبْرِ وَأَنْ الْفَرَجَ مَعَ الْكَرْبِ وَأَنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا ‘ধৈর্য্য ধারণের ফলে (আল্লাহর) সাহায্য লাভ করা যায়। কষ্টের পর স্বাচ্ছন্দ আসে। কঠিন অবস্থার পর স্বচ্ছলতা আসে’।[১৪] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ کَاَیِّنۡ مِّنۡ نَّبِیٍّ قٰتَلَ ۙ مَعَہٗ رِبِّیُّوۡنَ کَثِیۡرٌ ۚ فَمَا وَہَنُوۡا لِمَاۤ اَصَابَہُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ وَ مَا ضَعُفُوۡا وَ مَا اسۡتَکَانُوۡا ؕ وَ اللّٰہُ  یُحِبُّ الصّٰبِرِیۡنَ  . وَ مَا کَانَ قَوۡلَہُمۡ اِلَّاۤ اَنۡ قَالُوۡا رَبَّنَا اغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوۡبَنَا وَ اِسۡرَافَنَا فِیۡۤ  اَمۡرِنَا وَ ثَبِّتۡ اَقۡدَامَنَا وَ انۡصُرۡنَا عَلَی الۡقَوۡمِ الۡکٰفِرِیۡنَ  . فَاٰتٰىہُمُ اللّٰہُ ثَوَابَ الدُّنۡیَا وَ حُسۡنَ ثَوَابِ الۡاٰخِرَۃِ ؕ وَ اللّٰہُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ

‘আর এমন অনেক নবী ছিল যারা সঙ্গীসহযোগে অনুবর্তী হয়ে যুদ্ধ করেছিল; পরন্ত আল্লাহর পথে যা সংঘটিত হয়েছিল তাতে তারা নিরুৎসাহ হয়নি ও শক্তিহীন হয়নি এবং বিচলিত হয়নি এবং আল্লাহ ধৈর্যশীলগণকে ভালবাসেন। আর এতদ্ব্যতীত তাদের কথা ছিলনা যে, তারা বলতঃ হে আমাদের রব! আমাদের অপরাধ ও আমাদের কাজের বাড়াবাড়ি হেতু কৃত অন্যায়সমূহ ক্ষমা করুন, আমাদেরকে দৃঢ় রাখুন এবং অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন। অনন্তর আল্লাহ তাদেরকে পার্থিব পুরস্কার প্রদান করলেন এবং পরলোকের পুরস্কার শ্রেষ্ঠতর; এবং আল্লাহ সৎকর্মশীলগণকে ভালোবাসেন’ (সূরা আলে ইমরান : ১৪৬-১৪৮)।

(ইনশাআল্লাহ আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)


*শিক্ষক, মাদরাসাতুল হাদীছ আস-সালাফিয়া, সাবগ্রাম, বগুড়া।

তথ্যসূত্র:
[১]. ছহীহ বুখারী, কিতাবুল জিহাদ, বাবু মান ক্বদা দাব্বাতা গয়রিহি ফিল হারবি, হা/২৮৬৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৭৬।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯৬৬, ৩০২৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৪২।
[৩]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৫৪, সনদ ছহীহ।
[৪]. মুসতাদরাক হাকিম, হা/২৩৩৩, সনদ ছহীহ।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ, বাবু গাযওয়াতি হুনাইনিন, হা/১৭৭৬।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ, বাবু গাযওয়াতি হুনাইনিন, হা/১৭৭৭।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/২৮২০; ছহীহ মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ, বাবু গাযওয়াতি হুনাইনিন, হা/২৩০৭।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ, হা/১৭৪২।
[৯]. আবূ দাঊদ, হা/২৬৩২, সনদ ছহীহ।
[১০]. আবূ দাঊদ, হা/১৫৩৭, সনদ ছহীহ।
[১১]. ছহীহ বুখারী, কিতাবুত তাফসীর, হা/৪৫৬৩।
[১২]. তিরমিযী, হা/২১৩৯, সনদ হাসান।
[১৩]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৫১১৪; ছহীহ বুখারীতে তা‘লিক সুত্রে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে।
[১৪]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৮০৪, সনদ ছহীহ।




প্রসঙ্গসমূহ »: দাওয়াত ও জিহাদ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ফাযায়েলে কুরআন (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
তাক্বওয়া অর্জনে ছিয়াম - প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ১১ রাক‘আতের নির্দেশ দিয়েছিলেন - ব্রাদার রাহুল হোসেন (রুহুল আমিন)
উম্মাহর প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অধিকার : একটি বিশ্লেষণ (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
বিদ‘আত পরিচিতি (১৬তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
বিদ‘আত পরিচিতি (১৫তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী

ফেসবুক পেজ