ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি
-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন*
(২য় কিস্তি)
মূলনীতি-২ : বিশুদ্ধ আক্বীদার উন্মেষ
মুসলিম জীবন আক্বীদার উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই বিশুদ্ধ আক্বীদা মুমিন জীবনের মূল চাবিকাঠি ও মুসলিম উম্মাহ্র সুদৃঢ় ভিত্তি। আর বিশ্বাসের আলোকেই মানুষ তার সকল কর্ম সম্পাদন করে থাকে। অথচ অধিকাংশ মানুষই আক্বীদার ব্যাপারে উদাসীন। তারা বিভ্রান্তিকর আক্বীদার মধ্যে নিমজ্জিত। আক্বীদায় শিরক, বিদ‘আত ও কুফর মিশ্রিত হওয়ার কারণে মনের অজান্তেই তাদের ঈমান ও আমল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَا یُؤۡمِنُ اَکۡثَرُہُمۡ بِاللّٰہِ اِلَّا وَ ہُمۡ مُّشۡرِکُوۡنَ ‘তাদের অধিকাংশই যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তারা মুশরিক’ (সূরা ইউসুফ : ১০৬)।
মোটকথা মুসলিমদের কাছে আক্বীদার কোন গুরুত্বই নেই। অথচ আক্বীদাগত উন্নয়ন ছাড়া কোন জাতির পক্ষে উন্নতির শিখরে আরোহণ করা সম্ভব নয়। তাই সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী বলেন, ‘কোন বিপ্লব, কোন বিদ্রোহের মূল্য নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত তার ভিত্তির মাঝে দৃঢ় আক্বীদা বিশ্বাস, বিশুদ্ধ চিন্তা-চেতনা এবং প্রশিক্ষিত ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা না থাকবে’।[১] তাই অজেয় সাহস ও উদ্দম চেতনা সৃষ্টির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন তাওহীদী চেতনা ও উদ্দীপ্ত ঈমান। এটা পি. কে. হিট্টি স্বীকার করে বলেন, “This by one stroke the most vital bond of Arab relationship, that of tribal, was replaced by new bond that of faith.” ‘আরব জাতির একমাত্র বন্ধন গোত্রীয় প্রীতি একটা মাত্র আঘাতেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল এবং ঈমান এর স্থান অধিকার করে নিল’।[২]
‘আল-আক্বীদাহ’ শব্দটি ‘উক্বদাতুন’ শব্দ থেকে উদ্গত। অর্থ- গিরা বা বাঁধন। যেমন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে ‘উক্বদাতুন নিকাহ’ বা বিবাহের বাঁধন (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩৫ ও ২৩৭)। বাঁধনের মাঝে কী আছে তা না দেখেই শুধু শুনে চূড়ান্ত বিশ্বাস করার নামই ‘আক্বীদা’। মূলত কর্ম ছাড়া কোন বিষয়ে সন্দেহাতীত চূড়ান্ত বিশ্বাসই ‘আক্বীদা’।[৩] তাই আল্লাহকে না দেখে, ফেরেশতা, জান্নাত, জাহান্নাম, হাশর, ক্বিয়ামত, কবরের আযাব প্রভৃতি অদৃশ্য বিষয় না দেখেই শুধু পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনায় সুদৃঢ় বিশ্বাস করার নাম ‘আক্বীদা’। সেজন্য পবিত্র কুরআনের শুরুতেই মুত্তাক্বীদের প্রথম গুণ হিসাবে ‘অদৃশ্যে বিশ্বাস করার’ দাবী উল্লেখ করা হয়েছে (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩)।
ইসলামের মূল রূহ হল ‘তাওহীদ’। এর মৌলিক দু’টি ধারা হল আক্বীদা ও আমল। তবে এর ফাউন্ডেশন হল ‘তাওহীদী আক্বীদা’ বা ‘ঈমান’। আভিধানিক অর্থে ‘ঈমান’ বলা হয় এমন বিশ্বাসকে, যা নিরাপত্তাপূর্ণ ও প্রশান্তিময়। অর্থাৎ ভীতিশূন্য দৃঢ় বিশ্বাসই ‘ঈমান’।[৪] শারঈ অর্থে- ‘অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কাজে বাস্তবায়নের নাম ঈমান, যা সৎ কাজে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং অসৎ কাজে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়’।[৫] এর রুকন বা স্তম্ভ ছয়টি। (ক) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, (খ) ফেরেশতামন্ডলী, (গ) কিতাবসমূহ, (ঘ) রাসূলগণ, (ঙ) বিচার দিবস এবং (চ) তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস করা।[৬] এই ঈমানী চেতনা যদি শিরকমুক্ত হয়, তবে আমলগুলো আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে।[৭] কারণ এই আক্বীদার উপরই যাবতীয় আমল নির্ভরশীল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[৮]
উক্ত ‘নিয়ত’ শব্দটি ‘নাওয়া’ (نواة , نوى) শব্দ থেকে উদ্ভূত। অর্থ- বিচি বা আঁঠি। অর্থাৎ মনের গহীনে যে আঁঠি লাগানো হবে, গাছ তারই হবে এবং ফলও সেই গাছেরই হবে। আক্বীদা বা নিয়ত যার যেমন হবে, তার আমল তেমনই হবে। তার বিপরীত কিছু হবে না। কারণ কাঁঠালের বিচি লাগালে আম হয় না। অনুরূপ আমের আঁঠি লাগালে কাঁঠাল হয় না। তাই ক্বলবের কল্পনার মূল ভিত্তি ‘আক্বীদা’কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, সবই বরবাদ হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক হাদীছে বলেন,
.أَلَا وَإِنَّ فِى الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ أَلَا وَهِىَ الْقَلْبُ
‘সাবধান! নিশ্চয় শরীরের মধ্যে একটি টুকরা আছে। যদি সেই টুকরা সুস্থ থাকে, তাহলে পুরো শরীরটাই সুস্থ থাকে। আর যদি ঐ টুকরা অসুস্থ থাকে, তাহলে পুরো শরীরটাই অসুস্থ থাকে। মনে রেখ, সেটাই হল ‘ক্বলব’ বা অন্তর’।[৯]
অতএব এই ক্বলব সঠিকভাবে পরিচালিত হলে শরীরের হাত-পা, চোখ-কান, কথা-বার্তা, চিন্তা-চেতনা, চলা-ফেরা সবই সঠিক পথে পরিচালিত হবে। অন্যথা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবই অসৎ পথে পরিচালিত হবে। অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوْبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে দেখবেন না; বরং তিনি দেখবেন তোমাদের অন্তর ও আমলসমূহের দিকে’।[১০]
ত্রুটিপূর্ণ আক্বীদার পরিণাম :
মুসলিম ব্যক্তির প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হল নিজের আক্বীদাকে পরিশুদ্ধ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ یَّکۡفُرۡ بِالۡاِیۡمَانِ فَقَدۡ حَبِطَ عَمَلُہٗ وَ ہُوَ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে কুফরী করবে, তার আমল নষ্ট হয়ে যাবে। সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৫)। তাই আমল যত সুন্দরই হোক, আক্বীদা ছহীহ না হলে তা আল্লাহ্র নিকট কখনই কবুল হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, إِنَّ اللهَ لَا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِىَ بِهِ وَجْهُهُ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কোন আমল কবুল করবেন না, যদি তাঁর জন্য তা খালেছ হৃদয়ে ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য করা না হয়’।[১১] অন্য হাদীছে তিনি বলেন, أَلَا إِنَّ الدُّنْيَا مَلْعُوْنَةٌ مَلْعُوْنٌ مَا فِيْهَا إِلَّا ذِكْرُ اللهِ وَمَا وَالَاهُ وَعَالِمٌ أَوْ مُتَعَلِّمٌ ‘নিশ্চয় পৃথিবীটা অভিশপ্ত এবং এর মাঝে যা কিছু আছে সেগুলোও অভিশপ্ত। তবে আল্লাহর যিকির ও তার বন্ধুত্ব, দ্বীনি আলেম ও দ্বীনের শিক্ষার্থী ছাড়া’।[১২] অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আক্বীদাভ্রষ্ট আমলকারীদের সম্পর্কে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ أَنَّهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ يَخْرُجُ فِيْكُمْ قَوْمٌ تَحْقِرُوْنَ صَلاَتَكُمْ مَعَ صَلاَتِهِمْ وَصِيَامَكُمْ مَعَ صِيَامِهِمْ وَعَمَلَكُمْ مَعَ عَمَلِهِمْ وَيَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَمْرُقُوْنَ مِنَ الدِّيْنَ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ يَنْظُرُ فِى النَّصْلِ فَلاَ يَرَى شَيْئًا وَيَنْظُرُ فِى الْقِدْحِ فَلاَ يَرَى شَيْئًا وَيَنْظُرُ فِى الرِّيْشِ فَلاَ يَرَى شَيْئًا وَيَتَمَارَى فِى الْفُوْقِ
‘আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, তোমাদের মধ্য হতে একটি সম্প্রদায় বের হবে, যাদের ছালাতের তুলনায় তোমাদের ছালাতকে, ছিয়ামের তুলনায় তোমাদের ছিয়ামকে এবং আমলের তুলনায় তোমাদের আমলকে তোমরা হালকা মনে করবে। তারা কুরআন তেলাওয়াত করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা দ্বীন ইসলাম থেকে অনুরূপ বেরিয়ে যাবে, যেভাবে শিকার ভেদ করে তীর বেরিয়ে যায়। শিকারী তখন তীরের ফলার দিকে তাকায়, কিন্তু তাতে শিকারের কোন অংশ দেখতে পায় না। সে তীরের পার্শ্ব ও পাতার দিকে তাকায়, কিন্তু সেখানেও কিছু দেখতে পায় না। অবশেষে সে তীরের ফলার মাথায় কিছু আছে কি-না সন্দেহ পোষণ করে’।[১৩]
উক্ত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আমল বিশুদ্ধ হলেই যে কবুল হবে, তা কিন্তু নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আমানতদারিতা সম্পর্কে কারো অন্তরে কুধারণা থাকলে তার ছালাত, ছিয়ামসহ যাবতীয় আমল সুন্দর হলেও গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং সে ইসলাম থেকে এমনভাবে বহিষ্কৃত হবে যে, তার সাথে ইসলামের কোন অংশই অবশিষ্ট থাকবে না। তাই উক্ত দলীল সমূহের আলোকে মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরাম বলেন,
.مَعْلُوْمٌ بِالْأَدِلَّةِ الشَّرْعِيَّةِ مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنّةِ أَنَّ الْأَعْمَالَ وَالْأَقْوَالَ إِنَّمَا تَصِحُّ وَتَقْبَلُ إِذَا صَدَرَتْ عَنْ عَقِيْدَةٍ صَحِيْحَةٍ فَإِنْ كَانَتِ الْعَقِيْدَةُ غَيْرَ صَحِيْحَةٍ بَطَلَ مَا يَتَفَرَّعُ عَنْهَا
‘শারঈ বিধি-বিধান তথা কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, যাবতীয় আমল ও কথা কেবল তখনই বিশুদ্ধ হবে এবং গৃহীত হবে, যখন তা বিশুদ্ধ আক্বীদার মাধ্যমে প্রকাশিত হবে। আর যদি আক্বীদা বিশুদ্ধ না হয়, তবে তার থেকে যা কিছু বের হবে, সবই বাতিল বলে গণ্য হবে’।[১৪] এজন্য বলা হয়, اَلْعَقِيْدَةُ الصَّحِيْحَةُ هِىَ أَصْلُ دِيْنِ الْإِسْلاَمِ وَأَسَاسُ الْمِلَّةِ ‘বিশুদ্ধ আক্বীদা দ্বীন ইসলামের শিকড় এবং মুসলিম মিল্লাতের সুদৃঢ় ভিত্তি’।[১৫]
পক্ষান্তরে আক্বীদায় যদি কোন ত্রুটি না থাকে, তবে স্বীকৃতির মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি মুক্তি পেতে পারে। বিশুদ্ধ আক্বীদার প্রতিদানের কোন শেষ নেই। যেমন-
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ أَعْرَابِيًّا أَتَى النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ دُلَّنِىْ عَلَى عَمَلٍ إِذَا عَمِلْتُهُ دَخَلْتُ الْجَنَّةَ قَالَ تَعْبُدُ اللهَ لاَ تُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا وَتُقِيْمُ الصَّلاَةَ الْمَكْتُوْبَةَ وَتُؤَدِّى الزَّكَاةَ الْمَفْرُوْضَةَ وَتَصُوْمُ رَمَضَانَ قَالَ وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ لاَ أَزِيْدُ عَلَى هَذَا فَلَمَّا وَلَّى قَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى هَذَا
‘আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, একদা একজন বেদুইন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে বলল, আমাকে এমন আমলের কথা বলে দিন, যে আমল করলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে- তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, ফরয ছালাত আদায় করবে, ফরয যাকাত আদায় করবে এবং রামাযানের ছিয়াম পালন করবে। তখন ঐ ব্যক্তি আল্লাহর শপথ করে বলল, আমি এর বেশী করব না। যখন লোকটি চলে গেল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যে ব্যক্তি একজন জান্নাতী ব্যক্তিকে দেখে আনন্দিত হতে চায়, সে যেন এই ব্যক্তির দিকে দেখে’।[১৬]
তাওহীদ ও তার প্রকার :
ইসলামের নামে যত ভ্রান্ত আক্বীদা প্রচলিত আছে, তার সিংহভাগই আল্লাহ তা‘আলার সাথে সম্পৃক্ত। তাওহীদের জ্ঞান না থাকার কারণে অশুদ্ধ আক্বীদার বিস্তার ঘটেছে। তাই আক্বীদা সংক্রান্ত আলোচনায় তাওহীদের আলোচনা পেশ করা যুক্তি সঙ্গত। তাওহীদ হল, ‘আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টিতে, পরিচালনায় এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করার জন্য তাঁকে একক গণ্য করা। এছাড়া অন্য কোন কিছুর ইবাদত না করা, তাঁর সুন্দর নামসমূহ ও তাঁর মহান গুণাবলীকে স্বীকার করা এবং তাঁকে ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত রাখা’।[১৭] এ সম্পর্কে ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, اَلتَّوْحِيْدُ أَنْ يُعْبَدَ اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ ‘তাওহীদ হল, একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত করা, যার কোন শরীক নেই’।[১৮] তাওহীদ তিন ভাগে বিভক্ত। (ক) তাওহীদে রুবূবিয়াহ (খ) তাওহীদে উলূহিয়াহ এবং (গ) তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত।[১৯] সূরা ফাতিহার শুরুতেই উক্ত তিনটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে (সূরা আল-ফাতিহা : ১-৪)।
তাওহীদে রুবূবিয়া : আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টি, রাজত্ব, পরিচালনায় একক গণ্য করা। অর্থাৎ স্রষ্টা হিসাবে, পরিচালক, রুযিদাতা, বিধানদাতা, আইনদাতা, রাজাধিরাজ হিসাবে একমাত্র আল্লাহকেই গ্রহণ করা।[২০] আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, اَلَا لَہُ الۡخَلۡقُ وَ الۡاَمۡرُ ‘জেনে রেখ, সৃষ্টির একমাত্র কর্তা তিনিই, আর আইনের মালিকও একমাত্র তিনিই’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৫৪)। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের কি এমন কিছু শরীক আছে, যারা তাদের জন্য আইন প্রণয়ন করে, যে বিষয়ে আল্লাহ অনুমতি দেননি? (ক্বিয়ামতের) ফায়ছালার ঘোষণা না থাকলে তাদের বিষয়ে ফায়ছালা হয়েই যেত। নিশ্চয় সীমালংঘনকারীদের জন্য কঠোর শাস্তি বিদ্যমান’ (সূরা আশ-শূরা : ২১)। অন্য আয়াতে এসেছে, اَللّٰہُ خَالِقُ کُلِّ شَیۡءٍ وَّ ہُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ وَّکِیۡلٌ ‘আল্লাহ সবকিছুরই স্রষ্টা এবং তিনিই সবকিছুর ব্যবস্থাপক’ (সূরা আয-যুমার : ৬২; সূরা আল-আন‘আম : ১০২; সূরা আর-রা‘দ : ১৬; সূরা আল-মু’মিন : ৬২)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলুন, তোমাদেরকে কে আসমান ও যমীন হতে রিযিক দিয়ে থাকেন? কে কর্ণ ও চক্ষুসমূহের উপর পূর্ণ অধিকার রাখেন? আর কে জীবন্তকে প্রাণহীন হতে বের করেন, আর প্রাণহীনকে জীবন থেকে বের করেন, আর কে সমস্ত কাজ পরিচালনা করেন? তখন অবশ্যই তারা বলবে, আল্লাহ। অতএব আপনি বলুন, তাহলে তোমরা কেন ভয় করা না’ (সূরা ইউনুস : ৩১)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَ لَئِنۡ سَاَلۡتَہُمۡ مَّنۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ لَیَقُوۡلُنَّ اللّٰہُ ‘আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন যে, আকাশম-লী ও পৃথিবীকে কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ’ (সূরা লুক্বমান : ২৫; সূরা আল-আনকাবূত : ৬১; সূরা আয-যুমার : ৩৮; সূরা আয-যুখরুফ : ৯)।
সমাজের অধিকাংশ রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী মানুষ মনে করে ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ধর্মীয় দিক সম্পর্কে আল্লাহ্র নিকট জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, চাকরি, কৃষি, ডাক্তারী ইত্যাদি বৈষয়িক ব্যাপারে আল্লাহ্র কাছে কোন জবাবদিহি করতে হবে না। অন্যায়, অত্যাচার, প্রতারণা, চুরি-ডাকাতি, আত্মসাৎ, হত্যা, গুম, যেনা-ব্যভিচার, সূদ-ঘুষ, জুয়া-লটারী, নেশা, মওজুদদারী, মোনাফাখরী প্রভৃতি সব দুনিয়াবী ব্যাপার। এতে কোন জবাবদিহিতা নেই। মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও যারা এই আক্বীদা পোষণ করে তারা মূলত ভ্রান্ত নীতির শিকার। কারণ ইসলামে যেমন ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাতের বিধান রয়েছে, তেমনি রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ব্যবসারও বিধান রয়েছে। মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক, সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। মূলত সবকিছুর বিধানদাতা একমাত্র আল্লাহ। বান্দা যখন যে ক্ষেত্রে অবস্থান করবে, সেক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত আইন ও বিধান মেনে চলবে। তাই দুনিয়াবী স্বার্থে ও বৈরীশক্তির অপপ্রচারের কারণে মুসলিম জীবনকে উক্ত দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যাবে না। আল্লাহ বলেন,
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡفُرُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ رُسُلِہٖ وَ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یُّفَرِّقُوۡا بَیۡنَ اللّٰہِ وَ رُسُلِہٖ وَ یَقُوۡلُوۡنَ نُؤۡمِنُ بِبَعۡضٍ وَّ نَکۡفُرُ بِبَعۡضٍ وَّ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یَّتَّخِذُوۡا بَیۡنَ ذٰلِکَ سَبِیۡلًا- اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ حَقًّا وَ اَعۡتَدۡنَا لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابًا مُّہِیۡنًا
‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও রাসূলগণের সাথে কুফরী করে, তাদের মাঝে পার্থক্য করার ইচ্ছা করে এবং যারা বলে, আমরা শরী‘আতের কিছু বিষয়ের প্রতি ঈমান আনব আর কিছু বিষয়কে অস্বীকার করব, এছাড়া যারা মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করতে চায়, তারাই প্রকৃত কাফের। আর আমরা কাফেরদের জন্য অপমানজনক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি’ (সূরা আন-নিসা : ১৫০ ও ১৫১)।
মূলত মানুষের জীবনে অনেকগুলো কর্মক্ষেত্র থাকলেও প্রত্যেকটিই পরিচালিত হবে আল্লাহ প্রদত্ত চূড়ান্ত সংবিধানের আলোকে। তাই মানুষের জীবনের কোন ক্ষেত্রকে আল্লাহর হুকুমের আওতামুক্ত করা যাবে না। সে যখন যে ক্ষেত্রে অবস্থান করবে, তখন সেই স্থানের শারঈ নীতি নিরঙ্কুশভাবে অনুসরণ করবে। একজন ব্যবসায়ী শরী‘আতের বিধান মেনেই ব্যবসা করবেন। অনুরূপভাবে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি শরী‘আতের অনুসরণ করেই রাজনীতির ময়দানে বিচরণ করবেন। রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের পদ্ধতি অনুসরণ করবেন। অন্যথা আল্লাহকে এক বলে স্বীকৃতি দেয়া সম্পন্ন হবে না। তাওহীদে রুবূবিয়ার তাৎপর্য এটাই।
উল্লেখ্য যে, মানুষ ইবাদত বলতে সাধারণত শুধু ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাতকে বুঝে থাকে। অবশিষ্ট বিষয়গুলোকে ইবাদত মনে করে না। এটা মারাত্মক ভুল ধারণা। কারণ মুমিন তার জীবনে যা কিছু সম্পাদন করে, সবই ইবাদত, যদি তা আল্লাহর বিধানের আওতায় থেকে পালন করে।
তাওহীদে উলূহিয়াহ : সার্বিক ইবাদতের জন্য একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকে একক গণ্য করা। দু‘আ করা, মানত করা, যবহ করা, প্রত্যাশা, ভীতি, ভরসা, ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত সবই একমাত্র তাঁর জন্য করা। আর মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করার মৌলিক উদ্দেশ্যই হল, তারা যেন তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব করে। আল্লাহ বলেন, وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ ‘আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি এই জন্য যে, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করবে’ (সূরা আল-যারিয়াত : ৫৬)। অর্থাৎ সকল কাজকর্মে আল্লাহ্র এককত্ব প্রমাণ করবে। অথচ আল্লাহর এই মৌলিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ উদাসীন। তারা তাদের দাসত্বকে কিছু আল্লাহর জন্য, আর কিছু সৃষ্টির জন্য নির্ধারণ করে থাকে। যেমন ছালাত আদায়ের সময় আল্লাহকে সিজদা করে, কিন্তু কোন কিছু চাওয়া ও প্রার্থনার জন্য মাযার, খানকা, মূর্তি, কবর, গাছ, পাথর ও তীর্থস্থানে যায়। অথচ ইবাদত করতে হবে একমাত্র আল্লাহর। বান্দার যাবতীয় সাধনা পেশ করতে হবে এক আল্লাহর শানে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡۤا اِلٰـہًا وَّاحِدًا لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ سُبۡحٰنَہٗ عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ‘তাদের প্রতি শুধু আদেশ করা হয়েছে, তারা একমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করবে, যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তারা যে অংশীদার স্থির করে, তা থেকে তিনি মহাপবিত্র’ (সূরা আত-তাওবাহ : ৩১)। অন্যত্র বলেন, وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ حُنَفَآءَ وَ یُقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوا الزَّکٰوۃَ وَ ذٰلِکَ دِیۡنُ الۡقَیِّمَۃِ ‘তাদেরকে কেবল আদেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে শুধু আল্লাহর ইবাদত করবে এবং ছালাত আদায় করবে ও যাকাত প্রদান করবে। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন’ (সূরা আল-বাইয়িনাহ : ৫)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা কর না, চন্দ্রকেও নয়; বরং সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করে থাক’ (হামীম আস-সাজদাহ : ৩৭)। ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) বিপদের মুহূর্তে তাঁর দৃঢ়তা প্রকাশ করছেন এভাবে-
الَّذِیۡ خَلَقَنِیۡ فَہُوَ یَہۡدِیۡنِ- وَ الَّذِیۡ ہُوَ یُطۡعِمُنِیۡ وَ یَسۡقِیۡنِ-وَ اِذَا مَرِضۡتُ فَہُوَ یَشۡفِیۡنِ – وَ الَّذِیۡ یُمِیۡتُنِیۡ ثُمَّ یُحۡیِیۡنِ- وَ الَّذِیۡۤ اَطۡمَعُ اَنۡ یَّغۡفِرَ لِیۡ خَطِیۡٓئَتِیۡ یَوۡمَ الدِّیۡنِ
‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন। তিনিই আমাকে খাওয়ান ও পান করান। আর আমি যখন রোগাক্রান্ত হই, তখন তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন। তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর আমাকে পুনর্জীবিত করবেন এবং আশা করি ক্বিয়ামতের দিন আমার অপরাধ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন’ (সূরা আশ-শু‘আরা : ৭৮-৮১)।
চন্দ্র, সূর্য ও তারকা পূজারীদের সামনে নিজের দৃঢ়তা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার মুখম-লকে আমি একনিষ্ঠভাবে সেই মহান সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি, যিনি আকাশমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর সাথে ঝগড়া করতে লাগলে তিনি বলেন, তোমরা কি আল্লাহর ব্যাপারে আমার সাথে ঝগড়া করছ। অথচ তিনি আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন। তোমরা আল্লাহর সাথে যা কিছু শরীক করছ, আমি ওটাকে ভয় করি না, তবে আল্লাহ যদি কিছু চান। প্রতিটি বস্তু সম্পর্কে আমার রবের জ্ঞান খুবই ব্যাপক। এরপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না’ (সূরা আল-আন‘আম : ৭৯-৮০)।
আক্বীদাকে বিশুদ্ধ করা এবং ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য খালেছ করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিম্নের হাদীছে তার বাস্তবতা ফুটে উঠেছে-
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كُنْتُ خَلْفَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا فَقَالَ يَا غُلَامُ احْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ احْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ وَإِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ وَاعْلَمْ أَنَّ الْأُمَّةَ لَوِ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوْكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ لَكَ وَلَوِ اجْتَمَعُوْا عَلَى أَنْ يَضُرُّوْكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوْكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ عَلَيْكَ رُفِعَتِ الْأَقْلاَمُ وَجُفَّتِ الصُّحُفُ
‘ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পিছনে ছিলাম। তিনি বললেন, ‘হে বৎস! আল্লাহর অধিকার সংরক্ষণ কর, আল্লাহ তোমাকে সংরক্ষণ করবেন। তুমি আল্লাহর উপর ভরসা কর, তোমার প্রয়োজনে তাঁকে পাবে। যখন তুমি চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন সাহায্য চাইবে, তখন আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। তুমি জেনে রাখ! সমস্ত মানুষ যদি তোমার উপকার করার চেষ্টা করে তারা সক্ষম হবে না, যদি আল্লাহ তা তোমার জন্য নির্ধারণ না করেন। আর যদি সকলে মিলে কোন বিষয়ে তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে, আর আল্লাহ যদি তা নির্ধারণ না করেন, তাহলে তারা তা করতে পারবে না। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং খাতা বন্ধ করা হয়েছে’।
যাবতীয় ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক গণ্য না করলে বান্দা আল্লাহর নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে যায়। মূলত এই দুর্বলতার কারণেই মুসলিম উম্মাহর মর্মান্তিক অধঃপতন।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
*পরিচালক, ইসলামিক রিসার্চ এ্যান্ড রিফরমেশন সেন্টার
তথ্যসূত্র :
[১] সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, অনুবাদ : আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী, মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারাল? (ঢাকা : মুহাম্মদ ব্রাদার্স, ৫ম মুদ্রণ : অক্টোবর ২০০৬ খৃ.), পৃ. ৩২৯।
[২] মুহাম্মদ গোলাম মুস্তাফা, বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা) (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, এপ্রিল ২০০৫ খৃ.), পৃ. ২৮৬।
[৩] ছালিহ ইবনু ফাওযান ইবনু আব্দুল্লাহ আল-ফাওযান, আক্বীদাতুত তাওহীদ (রিয়াদ : দারু ইবনিল জাওযী, ১৪৩৫ হি.), পৃ. ৮।
[৪] আল্লামা ওবাইদুল্লাহ রহমানী মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ শরহে মিশকাতুল মাছাবীহ, ১ম খণ্ড (বানারস : ইদারাতুল বুহূছ আল-ইসলামিয়্যাহ, ১৯৭৩ খৃ./১৩৯৪ হি.), পৃ. ১১৯, হা/১৩১০-এর আলোচনা দ্র.।
[৫] মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু মান্দাহ, আল-ঈমান, ১ম খণ্ড (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪০৬ হি.), পৃ. ৩৩১; মুহাম্মাদ ছিদ্দীক হাসান খান আল-কুনূজী, ক্বাৎফুছ ছামার ফী আক্বীদাতি আহলিল আছার (সঊদী আরব : ওযারাতুশ শুয়ূনিল ইসলামিয়্যাহ ওয়াল আওক্বাফ ওয়াদ দা‘ওয়াত ওয়াল ইরশাদ, ১৪২১ হি.), পৃ. ৬১।
[৬] ছহীহ মুসলিম, পৃ. ১৯, হা/১, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আল-খত্বীব আত-তিবরীযী, তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আল-আলবানী, মিশকাতুল মাছাবীহ, ১ম খণ্ড (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৯৮৫ খৃ./১৪০৫ হি.), পৃ. ৯, হা/২; সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৭৭ ও ২৮৫।
[৭] আব্দুর রহমান ইবনু আব্দুল কারীম আল-‘আবীদ, উছূলুল মানহাজিল ইসলামী (দাম্মাম : দারুল যুখাইর, ১৪১৪ হি.), পৃ. ২৫।
[৮] ছহীহ বুখারী, পৃ. ৯, হা/১; ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৫৯৪, হা/১৯০৭; মিশকাতুল মাছাবীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮, হা/১।
[৯] ছহীহ বুখারী, পৃ. ১৭, হা/৫২; ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৪৮১, হা/১৫৯৯, ‘মুসাক্বাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২০; মিশকাতুল মাছাবীহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৪৩, হা/২৭৬২।
[১০] ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৭৭৭, হা/২৫৬৪; মিশকাতুল মাছাবীহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৪৬২, হা/৫৩১৪।
[১১] আবু আব্দুর রহমান আহমাদ ইবনু শু‘আইব ইবনু আলী আন-নাসাঈ, সুনানুন নাসাঈ (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১৪২৯ হি./ ২০০৮ খৃ.), পৃ. ৪৮৪, হা/৩১৪০, সনদ ছহীহ।
[১২] হাফিয মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা ইবনু সাওরাহ আত-তিরমিযী, সুনানুত তিরমিযী (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ২০০৮ খৃ.), পৃ. ৫২৫, হাদীছ সংখ্যা-২৩২২, ‘যুহদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২; মিশকাতুল মাছাবীহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৪৩১, হা/৫১৭৬; সনদ হাসান, মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছ আছ-ছহীহাহ ওয়া শাইয়ুন মিন ফিক্বহিহা ওয়া ফাওয়াইদিহা, ৬ষ্ঠ খণ্ড (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, চতুর্থ প্রকাশ : ১৯৮৫ খৃ./১৪০৫ হি.), পৃ. ২৯৬, হা/২৭৯৭।
[১৩] ছহীহুল বুখারী, পৃ. ৬৪৬, হা/৫০৫৮; মিশকাতুল মাছাবীহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৬৫২, হা/৫৮৯৪।
[১৪] শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায, আল-আক্বীদাতুছ ছহীহাহ ওয়ামা ইউযাদ্দুহা (রিয়াদ : দারুল ক্বাসেম, ১৪১৫ হি.), পৃ. ৩, ভূমিকা দ্রঃ।
[১৫] তদেব, পৃ. ৩।
[১৬] ছহীহুল বুখারী, পৃ. ১৭৬, হা/১৩৯৭; ছহীহ মুসলিম, পৃ. ২১, হা/১৪; মিশকাতুল মাছাবীহ, পৃ. ১১, হা/১৪।
[১৭] আক্বীদাতুত তাওহীদ, পৃ. ৮- هو إفرادُ الله بالخلق والتدبر وإخلاصُ العبادة له وترك عبادة ما سواه وإثبات ما لَهُ من الأسماء الحسنى والصفات العليا وتنزيهه عن النقص والعيب
[১৮] শায়খুল ইসলাম তাক্বিউদ্দীন আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ আল-হাররানী, মাজমূ‘আতুল ফাতাওয়া, ২য় খণ্ড, তৃতীয় অংশ (বৈরূত : দারু ইবনে হাযম, ১৪৩২ হি./২০১১ খৃ.), পৃ. ৭০।
[১৯] মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছায়মীন, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, ১ম খণ্ড (রিয়াদ : দারুছ ছুরাইয়া, ১৪২৬ হি./২০০৫ খৃ.), পৃ. ৮৩- قد قسم العلماء التوحيد إلى أقسام ثلاثة : ربوبية وألوهية وأسماء وصفات، فتوحيد الربوبية هو إفراد الله سبحانه بالخلق والملك والتدبير وتوحيد الألوهية هو إفراد الله سبحانه بالعبادة، وتوحيد الأسماء والصفات هو إفراد الله بما يجب له من الأسماء والصفات بأن نثبتها لله تعالى على وجه الحقيقة من غير تحريف ولا تعطيل ولا تكييف ولا تمثيل.
[২০] তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনু আব্দুল হালীম ইবনু তায়মিয়াহ আল-হাররানী, আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা, ৫ম খণ্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৪০৮ হি./১৯৮৭ খৃ.), পৃ. ২৮৪- فَتَوْحِيدُ الرُّبُوبِيَّةِ أَنَّهُ لَا خَالِقَ إلَّا اللهُ فَلَا يَسْتَقِلُّ شَيْءٌ سِوَاهُ بِإِحْدَاثِ أَمْرٍ مِنْ الْأُمُورِ بَلْ مَا شَاءَ كَانَ وَمَا لَمْ يَشَأْ لَمْ يَكُنْ فَكُلُّ مَا سِوَاهُ
[২১] সুনানুত তিরমিযী, পৃ. ৫২৫, হাদীছ সংখ্যা-২৩২২, ‘যুহদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২; মিশকাতুল মাছাবীহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৪৩১, হা/৫১৭৬, সনদ হাসান।
[২২] আক্বীদাতুল তাওহীদ, পৃ. ২৪-إفرادُ الله تعالى بأفعال العباد التي يفعلونها على وجه التقرب المشروع، كالدعاء والنذر والنحر، والرجاء والخوف، والتوكل والرغبة والرهبة والإنابة،।
[২৩] সুনানুত তিরমিযী, পৃ. ৫৬৬-৫৬৭, হা/২৫১৬, ‘ক্বিয়ামতের বিবরণ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫৯।