মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১০ অপরাহ্ন

সুন্নাহ বিরোধী ও সংশয় উত্থাপনকারীদের চক্রান্তসমূহ ও তার জবাব 

- হাসিবুর রহমান বুখারী* 


(২য় কিস্তি) 

পবিত্র কুরআনুল কারীমকে আমরা যেমন আল্লাহর কালাম বলে বিশ্বাস করি, অনুরূপভাবে হাদীছের ক্ষেত্রে আমাদের আক্বীদা কেমন হতে হবে?

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কুরআনের মত হাদীছও অহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে, হাদীছকে কুরআনের মত তিলাওয়াত করা হয় না’।[১] খাত্বীব আল-বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ), হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) ও শাইখ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহর আদেশে যেভাবে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) নবী (ﷺ)-এর নিকট কুরআন নিয়ে অবতরণ করতেন, ঠিক একইরকম ভাবে তাঁর উপর সুন্নাত নিয়েও অবতরণ করতেন’।[২]

দলীল

১- আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وَ مَا یَنۡطِقُ عَنِ  الۡہَوٰی -  اِنۡ  ہُوَ   اِلَّا  وَحۡیٌ   یُّوۡحٰی

‘আর তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না। তা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়’ (সূরা আন-নাজম: ৩-৪)।

২- আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওযূ করার সময় হাতে এক অঞ্জলি পানি নিতেন। অতঃপর ঐ পানি থুতনির নিচে প্রবেশ করাতেন এবং তার দ্বারা নিজের দাড়ি খিলাল করতেন এবং বলতেন, هَكَذَا أَمَرَنِي رَبِّيْ عَزَّ وَجَلَّ ‘আমার মহান প্রতিপালক আমাকে এরূপ করারই নির্দেশ দিয়েছেন’।[৩]

৩- রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,أَلَا إِنِّيْ أُوْتِيْتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ ‘জেনে রাখ! আমাকে কুরআন এবং তার সঙ্গে সমকক্ষ বা সমতুল্য কিছু দেয়া হয়েছে’।[৪] ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও অন্যান্য মুহাদ্দিছ বলেন, ‘সমতুল্য জিনিস’ বলতে হাদীছকেই বুঝানো হয়েছে’।[৫]

৪- আবূ মাসঊদ আল-আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) অবতরণ করে ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। আবার তিনি ছালাত আদায় করলেন, রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। পুনরায় তিনি ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। আবার তিনি ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। পুনরায় তিনি ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, ‘আমি এভাবে ছালাত শিখাতে আদিষ্ট হয়েছি’।[৬] উপরিউক্ত হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সুন্নাত শিখানোর জন্যই অবতরণ করেছিলেন। অতএব বুঝা গেল যে, সুন্নাত বা হাদীছও আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী।

৫- আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, مَا أُوْتِيْكُمْ مِنْ شَيْءٍ وَمَا أَمْنَعُكُمُوْهُ، إِنْ أَنَا إِلَّا خَازِنٌ أَضَعُ حَيْثُ أُمِرْتُ ‘আমি আমার ইচ্ছা মত তোমাদেরকে কোন জিনিস দিই না এবং আমার ইচ্ছা মত তোমাদেরকে কোন জিনিস থেকে বঞ্চিতও করি না। আমি তো কেবল কোষাধ্যক্ষ বা বণ্টনকারী। আমাকে যেখানে ব্যয়ের নির্দেশ দেয়া হয় সেখানেই ব্যয় করি’।[৭] উপরিউক্ত হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার আদেশ মুতাবিক রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোনরূপ কমবেশি ছাড়াই বণ্টন করতেন। অতএব প্রমাণিত হল যে, হাদীছও আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী।[৮]

৬- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اَنۡزَلَ اللّٰہُ عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ عَلَّمَکَ مَا لَمۡ تَکُنۡ تَعۡلَمُ ؕ وَ کَانَ فَضۡلُ اللّٰہِ عَلَیۡکَ عَظِیۡمًا.

‘আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমাত অবতীর্ণ করেছেন এবং তুমি যা জানতে না, তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। আর তোমার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে’ (সূরা আন-নিসা: ১১৩)। অন্যত্র তিনি বলেছেন,

لَقَدۡ مَنَّ اللّٰہُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡہِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِہِمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ۚ وَ  اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ.

‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের কাছে তিলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল’ (সূরা আলে ইমরান: ১৬৪)।

উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি কুরআনুল কারীমের অগণিত বিশেষজ্ঞের নিকটে শুনেছি, তাঁরা বলেছেন, ‘এখানে ‘কিতাব’ বলতে কুরআনুল কারীমকে বুঝানো হয়েছে আর ‘হিকমাত’ বলতে রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতকে বুঝানো হয়েছে।[৯]

আহলে কুরআন বা হাদীছ অস্বীকারকারীদের কিছু বিভ্রান্তিমূলক সংশয় ও তার নিরসন

‘আহলে কুরআন’ বা হাদীছ বিরোধীদের বিভ্রান্তিকর হাতিয়ারের নাম হল- অনৈতিক যুক্তি। তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সাধারণ মানুষকে আদর্শচ্যুত করার জন্য তাদের সামনে কিছু উদ্ভট প্রশ্ন ও নীতিহীন যুক্তি পেশ করে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা উম্মতে মুহাম্মাদীর হৃদয়ে স্বীয় নবীর প্রতি এমন নজীরবিহীন ভালোবাসা ও মমত্ববোধ সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, তার সামষ্টিক বিবেক সর্বদা সুন্নাহ বিরোধী ও হাদীছ সম্পর্কে চক্রান্তকারী শয়তানদের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার ও চুলচেরা তত্ত্বকথা দৃঢ়তার সাথে প্রতিরোধ করেছে এবং কখনো তাকে দীর্ঘস্থায়ী ও সর্বজনীন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে দেয়নি। গভীর নবীপ্রেমে উজ্জীবিত এই মুসলিম উম্মাহ স্বীয় নেতা ও পথপ্রদর্শক রাসূল (ﷺ)-এর প্রতিটি পদক্ষেপকে আপন জীবন পথের অভিযাত্রায় একমাত্র দিকনির্দেশক হিসাবে বহাল রেখেছেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যজনক উদাসীনতার কুফলস্বরূপ বিগত শতাব্দীতে হাদীছ অমান্য করার মত ধ্বংসাত্মক গোমরাহী সমাজে জন্ম নিয়েছে এবং আমাদের মধ্যে তার বিকাশ ও বিস্তার অব্যাহত রয়েছে। অন্যান্য ভ্রষ্টতার তুলনায় হাদীছ অমান্য করার ভ্রষ্টতা অনেক বেশি বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর। কারণ এই গোষ্ঠীর দাওয়াত আপাতদৃষ্টিতে খুবই নির্দোষ ও চমকপ্রদ মনে হয়। বাহ্যত এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এরা শুধু আল্লাহর কিতাবের দিকেই মানুষকে ডাকে এবং কুরআনকেই মানুষের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু বানাতে তৎপর। এজন্য একজন সাধারণ মুসলিমের পক্ষে সহজেই তাদের প্রতারণার ফাঁদে আটকে পড়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। সে এটি উপলব্ধি করতে-ই পারেনা যে, এই গোষ্ঠীর আসল লক্ষ্য হল- কুুরআন ও হাদীছের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করা এবং অবশেষে কুরআনকে তার বাহকের মৌখিক ও বাস্তব ব্যাখ্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের মনগড়া রকমারি ব্যাখ্যার খেলনা পুতুলে পরিণত করা!

হাদীছ অস্বীকারকারীরা যেহেতু ভালো করেই জানে যে, রাসূল (ﷺ)-এর সুমহান ব্যক্তিত্ব ও আদর্শের সাথে মুসলিমদের কি অটুট ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক এবং তাঁর প্রতি তাঁরা কতো প্রবলভাবে আকৃষ্ট ও নিবেদিত। তাই রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত ও হাদীছের মর্যাদা তাদের মন থেকে নিঃশেষ করতে এবং তাঁর প্রতি সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে বীতশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞার মনোভাব জন্মানোর জন্য তারা হাদীছের বিরুদ্ধে নানা রকমের সন্দেহ-সংশয়, আপত্তি, অভিযোগ ও কুপ্ররোচনা ছাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আলহামদুলিল্লাহ, এর মধ্যে যে সমস্ত অভিযোগ কিছুটা গুরুত্বের দাবিদার, তার অধিকাংশের-ই জবাব আলিম সমাজের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। তথাপি অভিযোগকারীরা সেগুলোকে বিভিন্নভাবে নতুন করে তুলেছে। তাই বিভিন্নভাবে সেগুলোর জবাব দেয়া এবং সেই সব অভিযোগের যৌক্তিক বিভ্রান্তিগুলোর প্রতিটি দিক স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়া অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। যাতে মুসলিম জনগণ এগুলোর অসারতা সম্পর্কে সচেতন হয় এবং চিন্তাভাবনা না করেই এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার খপ্পড়ে না পড়ে। সেই জন্য আগামী সংখ্যায় তাদের কিছু বিভ্রান্তিমূলক সংশয় ও তার মোক্ষম জবাব উপস্থাপন করা হবে ইনশাআল্লাহ।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)



* মুর্শিদাবাদ, ভারত।

[১]. মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ১৩শ খণ্ড, পৃ. ৩৬৩।

[২]. আল-কিফায়াহ, পৃ. ১২; ফাৎহুল বারী, ১৩শ খণ্ড, পৃ. ২৯১; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৭৭২৪৩।

[৩]. আবূ দাঊদ, হা/১৪৫; বাইহাক্বী, সুনানুল কুবরা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৪; হাকিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৯; ইরওয়াউল গালীল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩০।

[৪]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৪-৪৬০৫; তিরমিযী, হা/২৬৬৩-২৬৬৪; ইবনু মাজাহ, হা/১২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৭৪, ১৭১৯৪, সনদ হাসান।

[৫]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১৩শ খণ্ড, পৃ. ৩৬৪।

[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২১; ছহীহ মুসলিম, হা/৬১০।

[৭]. আবূ দাঊদ, হা/২৯৪৯।

[৮]. আল-মাদখাল ইলাস সুন্নাতিল নাবাবিয়্যাহ, পৃ. ৬১।

[৯]. আহকামুল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮; আর-রিসালাহ, পৃ. ৪৫; তাফসীরে ত্বাবারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৫৭-৫৫৮।




প্রসঙ্গসমূহ »: সুন্নাত
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
ফাযায়েলে কুরআন (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
যুলমের পরিচয় ও পরিণাম - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব - আব্দুল গাফফার মাদানী
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৪র্থ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আত্মসাতের পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
দু‘আ ও যিকর : আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (১২তম কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইসরাঈলি বর্বরতায় রক্তাক্ত মানবতা - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সালাফী জামা‘আত বনাম ভ্রান্তদল সমূহ (শেষ কিস্তি) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ