বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৮ অপরাহ্ন

বিদায় হজ্জের ভাষণ : তাৎপর্য ও মূল্যায়ন

-অধ্যাপক মুহা. আকবার হোসাইন*


উপস্থাপনা 

ইসলামের ইতিহাসে বিদায় হজ্জ ও বিদায় হজ্জের ভাষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন ধর্ম প্রচারকের এরূপ ভাষণের দৃষ্টান্ত জানা যায় না। মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর ভাষণে মানব জীবন পরিচালনার জন্য পাথেয় হিসাবে রেখে গেছেন ‘আল-কুরআন’ ও ‘ছহীহ হাদীছ’, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাঁর উম্মতের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। নিম্নে বিদায় হজ্জের ভাষণের তাৎপর্য ও মূল্যায়ন উপস্থাপন করা হল।

হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা

২৪ শে যুলক্বা‘দাহ শনিবার যোহরের ছালাত আদায়ের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ), তাঁর স্ত্রীগণ এবং ছাহাবায়ে কেরাম হজ্জ সম্পাদনের লক্ষ্যে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন।[১] অতঃপর মদীনা থেকে ১০ কি. মি. দক্ষিণে মদীনাবাসীদের মীক্বাত ‘যুল-হুলায়ফা’ গিয়ে আছরের পূর্বে যাত্রা বিরতি করেন। এখানে তিনি রাত্রি যাপন করেন। পরদিন দুপুরের পূর্বে ইহরামের জন্য গোসল করেন এবং গোসল শেষে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) নিজ হাতে তাঁর সারা দেহে ও পোশাকে সুগন্ধি মাখিয়ে দেন। অতঃপর তিনি যোহরের দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন এবং মুছাল্লায় থাকা অবস্থাতেই হজ্জ ও ওমরাহ্র জন্য একত্রে ইহরাম বাঁধেন ও তালবিয়া পাঠ শুরু করেন।[২] মধ্যম গতিতে সাত দিন চলে ৩রা যিলহজ্জ শনিবার সন্ধ্যার প্রাক্কালে মক্কার নিকটবর্তী ‘যূ-তুওয়া’-তে অবতরণ করে রাত্রি যাপন করেন। অতঃপর পরের দিন দিনের বেলায় মক্কায় প্রবেশ করেন।[৩]

বিদায় হজ্জের সময় ও স্থান

আল্লাহ তা‘আলার বাণী, وَ لِلّٰہِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡہِ سَبِیۡلًا ‘আল্লাহর জন্য লোকদের উপর বায়তুল্লাহর হজ্জ ফরয করা হল, যারা সে পর্যন্ত যাওয়ার সামর্থ্য রাখে’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৭)। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা হিজরতের পর তাঁর নবী ও নবীর উম্মতের উপর হজ্জ ফরয করে দেন। কিন্তু নবী করীম (ﷺ) তাৎক্ষণিকভাবে হজ্জ পালনের সুযোগ পাননি। অতঃপর যখন যুদ্ধের ঝামেলা থেকে তিনি নিষ্কৃতি পেলেন এবং তার ওফাত নিকটবর্তী হল, তখন তিনি তাঁর ছাহাবী ও স্ত্রীদেরকে সাথে নিয়ে জীবনের সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ হজ্জ পালনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেন। অতঃপর যিলক্বদ মাসের পাঁচ দিন বাকী থাকতেই তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে কা‘বার পথে বেরিয়ে পড়েন। সর্বশ্রেষ্ঠ মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ) দশম হিজরীতে যিলহজ্জ মাসে ৬৬২ খ্রিষ্টাব্দে বিদায় হজ্জ সম্পন্ন করেন।

মহানবী (ﷺ) যিলহজ্জ মাসের ৯ম তারিখে আরাফার মাঠে প্রবেশ করেন এবং ‘ওয়াদিয়ে নামিরায়’ অবতরণ করেন। যার একপাশে আরাফা, অন্যপাশে মুযদালিফা অবস্থিত। অতঃপর তিনি সেখানে উটনীর পিঠে সওয়ার অবস্থায় মুসলিমদের উদ্দেশ্যে সারগর্ভ ভাষণ দেন।[৪] এ সময় সেখানে এক লক্ষ চব্বিশ হাযার বা ত্রিশ হাযার মুসলিম উপস্থিত ছিলেন।[৫]

বিদায় হজ্জের ভাষণ

বিদায় হজ্জের ভাষণ সম্পর্কে মোট ৬ টি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে মোট ১৬টি বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্তব্য পাওয়া যায়, যা সমগ্র মানব জাতির ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন,

জীবন ও সম্পদের পবিত্রতা ঘোষণা

বিদায় হজ্জে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সমগ্র মানব জাতিকে লক্ষ্য করে মহানবী (ﷺ) বিশ্ব মানবতার পরস্পর জীবন ও সম্পদ পবিত্র বলে ঘোষণা প্রদান করেন। সেদিন থেকে অন্যায়ভাবে কোন মানুষের জীবন ও সম্পদ হরণ করা হারাম হিসাবে সাব্যস্ত হয়। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন,

إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِىْ شَهْرِكُمْ هَذَا فِىْ بَلَدِكُمْ هَذَا أَلَا كُلُّ شَىْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَىَّ مَوْضُوْعٌ وَدِمَاءُ الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعَةٌ وَإِنَّ أَوَّلَ دَمٍ أَضَعُ مِنْ دِمَائِنَا دَمُ ابْنِ رَبِيْعَةَ بْنِ الْحَارِثِ كَانَ مُسْتَرْضِعًا فِىْ بَنِى سَعْدٍ فَقَتَلَتْهُ هُذَيْلٌ

‘তোমাদের রক্ত ও সম্পদ তোমাদের জন্য হারাম, যেমন তা হারাম তোমাদের এ দিনে, তোমাদের এ মাসে এবং এ শহরে। সাবধান! জাহেলী যুগের যাবতীয় অপকর্ম (অপসংস্কৃতি) আমি আমার উভয় পায়ের নিচে প্রোথিত করলাম। জাহেলী যুগের রক্তের দাবীও বাতিল হল। আমি সর্বপ্রথম যে রক্তপণ বাতিল করছি তা হল আমাদের বংশের রবী‘আহ ইবনু হারিছের রক্তপণ। সে শিশু অবস্থায় বনু সা‘দ-এ দুগ্ধপোষ্য ছিল, তখন হুযায়ল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করে’।[৬]

সূদ প্রথা বিলোপ

সূদ প্রথা জাহেলী সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছিল। সাধারণ মানুষ পাহাড়সম অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হত। তাই বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, আজ হতে জাহেলী যুগের যাবতীয় সূদপ্রথা বাতিল করা হল। তিনি বলেন, وَرِبَا الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعٌ وَأَوَّلُ رِبًا أَضَعُ رِبَانَا رِبَا عَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَإِنَّهُ مَوْضُوْعٌ كُلُّهُ ‘জাহেলী যুগের সূদপ্রথাকেও বাতিল করা হল। আমি প্রথম যে সূদ বাতিল করছি, তা হল আমাদের বংশের আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবের সূদ। তার সমস্ত সূদ বাতিল হল’।[৭]

নারী-পুরুষের পারস্পরিক অধিকার সংরক্ষণ

নারীর উপর যেভাবে পুরুষের অধিকার আছে, তেমনিভাবে পুরুষের উপরও নারীর অধিকার আছে। কাজেই নারীর সাথে উত্তম ব্যবহার করা সকলের দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,   

فَاتَّقُوا اللهَ فِى النِّسَاءِ فَإِنَّكُمْ أَخَذْتُمُوْهُنَّ بِأَمَانِ اللهِ وَاسْتَحْلَلْتُمْ فُرُوْجَهُنَّ بِكَلِمَةِ اللهِ وَلَكُمْ عَلَيْهِنَّ أَنْ لَا يُوْطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُوْنَهُ. فَإِنْ فَعَلْنَ ذَلِكَ فَاضْرِبُوْهُنَّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرِّحٍ وَلَهُنَّ عَلَيْكُمْ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ

‘তোমরা স্ত্রী লোকের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসাবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কালিমার মাধ্যমে তাদের লজ্জাস্থান নিজেদের জন্য হালাল করেছ। তাদের উপরে তোমাদের অধিকার এই যে, তারা যেন তোমাদের শয্যায় এমন কোন লোককে আশ্রয় না দেয়, যাকে তোমরা অপসন্দ কর। যদি তারা এরূপ করে তবে হালকাভাবে তাদেরকে প্রহার কর। আর তোমাদের উপর তাদের ন্যায়সঙ্গত ভরণ পোষণের ও পোশাক-পরিচ্ছদের হক্ব রয়েছে’।[৮]

জীবন বিধান আঁকড়ে ধরা

মানবতার জীবন চলার পাথেয় হিসাবে প্রয়োজন একটি উৎকৃষ্ট জীবন বিধান। যেখানে থাকবে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের সহজ-সরল ও সুদৃঢ় দিক-নির্দেশনা। এরূপ দু’টি সংবিধান রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিশ্ববাসীর নিকট রেখে যান। তার একটি হল- আল্লাহর কিতাব এবং অন্যটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ছহীহ সুন্নাহ। যতদিন মানুষ এ দু’টি জীবন বিধান মযবুত সহকারে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তারা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করে বলেন, وَقَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا لَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ كِتَابَ اللهِ ‘আমি তোমাদের মাঝে এমন এক জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব’।[৯] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا إِنْ تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّتيِْ وَلنْ يَّتَفَرَّقَا حَتَّى يَرُدَّا عَلٰى الْحَوْضِ ‘আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি বস্তু রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা তা শক্তভাবে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তাহল- আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাত’। হাউযের নিকট প্রত্যাবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত কখনও এ বস্তুদ্বয়কে পরিত্যাগ করবে না।[১০]

ভ্রাতৃত্ব বন্ধন

প্রত্যেক মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই এবং একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ  اِخۡوَۃٌ ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১০)। সমগ্র দুনিয়ার মুসলিম এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ। বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন,

أَيّهَا النّاسُ اسْمَعُوْا قَوْلِيْ وَاعْقِلُوْهُ تَعَلَّمْنَّ أَنّ كُلِّ مُسْلِمٍ أَخٌ لِلْمُسْلِمِ وَأَنَّ الْمُسْلِمِيْنَ إخْوَةٌ فَلَا يَحِلَّ لِاِمْرِئِ مِنْ أَخِيْهِ إِلَّا مَا أَعْطَاهُ عَنْ طِيْبِ نَفْسٍ مِنْهُ فَلَا تَظْلِمُنَّ أَنَفْسَكُمْ

‘হে মানুষ সকল! তোমরা আমার কথা শুন ও বুঝার চেষ্টা কর। জেনে রাখ, প্রত্যেক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। মুসলিমরা ভাই-ভাই। কাজেই নিজের ভাইয়ের কোন জিনিস তার খুশি মনে দান করা ছাড়া নেয়া অবৈধ। তোমরা নিজেদের উপর কখনোও অত্যাচার করবে না’।[১১]

আল্লাহর একত্ব ও আল্লাহভীতি

আল্লাহর রাজত্ব ব্যতীত পৃথিবীতে কোন রাজত্ব নেই। তেমনিভাবে আল্লাহভীতি ছাড়া মানব জাতির পরস্পরের মধ্যে মর্যাদার কোন পার্থক্য নেই। সবাই আদম (আলাইহিস সালাম) হতে সৃষ্টি। আর আদম (আলাইহিস সালাম) মাটি হতে সৃষ্টি। আল্লাহর একত্বের ব্যাপারে যেমন কোন অংশীদারিত্ব নেই, তেমনি আল্লাহভীতি ছাড়া মানব মর্যাদার কোন মানদ- নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَلَا إِنَّ رَبَّكُمْ وَاحِدٌ وَإِنَّ أَبَاكُمْ وَاحِدٌ أَلَا لَا فَضْلَ لِعَرَبِىٍّ عَلٰى أَعْجَمِىٍّ وَلَا لِعَجَمِىٍّ عَلٰى عَرَبِىٍّ وَلَا لِأَحْمَرَ عَلٰى أَسْوَدَ وَلَا أَسْوَدَ عَلٰى أَحْمَرَ إِلَّا بِالتَّقْوَى

‘হে মানব সকল! সাবধান! নিশ্চয় তোমাদের প্রভু এক। তোমাদের পিতা এক। আল্লাহভীতি ব্যতীত অনারবদের উপর আরবদের কোন মর্যাদা নেই। আরবদের উপর অনারবদের কোন মর্যাদা নেই। কালোর উপর লালের কোন মর্যাদা নেই এবং লালের উপর কালোর কোন মর্যাদা নেই।[১২]

অহির বিধান প্রচারের নির্দেশ

আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলগণকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন তাওহীদকে প্রচার ও প্রসার করার জন্য এবং আদম সন্তান যেন একমাত্র তারই তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করে সেই জন্য। নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর জীবদ্দশায় সেই কাজটিই সম্পাদনা করেছেন। তাঁর জীবনের শেষ ভাষণেও উপস্থিত ব্যক্তিদেরকে অনুপস্থিত ব্যক্তিদের নিকট দাওয়াত পৌঁছানোর নির্দেশ প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

وَأَنْتُمْ تُسْأَلُوْنَ عَنِّىْ فَمَا أَنْتُمْ قَائِلُوْنَ قَالُوْا نَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ وَأَدَّيْتَ وَنَصَحْتَ فَقَالَ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ يَرْفَعُهَا إِلَى السَّمَاءِ وَيَنْكُتُهَا إِلَى النَّاسِ اَللَّهُمَّ اشْهَدْ اَللَّهُمَّ اشْهَدْ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ

‘আমার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হলে, তখন তোমরা কী বলবে? তারা বলল, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি (আল্লাহর বাণী) পৌঁছিয়েছেন, আপনার হক্ব আদায় করেছেন এবং সদুপদেশ দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তাঁর অঙ্গুলী আকাশের দিকে তুলে লোকদের ইশারা করে বললেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। তিনি তিনবার এরূপ বললেন’।[১৩] অন্যত্র এভাবে বর্ণিত হয়েছে, أَلَا هَلْ بَلَّغْتَ؟ قَالُوْا نَعَمْ قَالَ اَللهم اشْهَدْ فَلِيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ فَرُبَّ مُبَلَّغٍ أَوْعَي مِنْ سَامِعٍ ‘সাবধান! আমি কি আমার (রিসালাত) পৌঁছাতে পেরেছি? ছাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। অতএব হে উপস্থিত ব্যক্তিগণ! তোমরা অনুপস্থিত ব্যক্তিদের নিকট (আমার এই বাণী) পৌঁছে দিবে। কেননা উপস্থিত ব্যক্তির চেয়ে অনুপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে এমন কেউ রয়েছে, যে তার চেয়ে বেশি সংরক্ষণকারী হবে’।[১৪]

ইসলামের পূর্ণতা ঘোষণা

জুম‘আর দিন সন্ধ্যায় আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিল হয় এক অনন্য দলীল। ইসলামের পরিপূর্ণতার সনদ, যা ইতিপূর্বে কোন এলাহী ধর্মের জন্য নাযিল হয়নি। এ সময় অহী নাযিলের গুরুভার বহনে অপারগ হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাহন অথবা ‘আযবা’ (العضباء) আস্তে করে বসে পড়ে। অতঃপর অহী নাযিল হল, اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপরে আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৩)।[১৫]

ভাষণের তাৎপর্য

ইসলামের ইতিহাসে বিদায় হজ্জের ভাষণের তাৎপর্য অপরিসীম। এ ভাষণের মাধ্যমে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সমাজে নারীর মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। যেমন-

(ক) মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর শেষ ভাষণ : বিদায় হজ্জের ভাষণ ছিল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জীবনের শেষ ভাষণ। এ ভাষণের মাধ্যমে মুহাম্মাদ (ﷺ) আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিমদের নিকট থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ ভাষণের পরই তিনি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর কিছু দিনের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর মৃত্যু হয়।

(খ) পরিপূর্ণ ভাষণ : বিদায় হজ্জের ভাষণ ছিল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পরিপূর্ণ ভাষণ। এ ভাষণে মুহাম্মাদ (ﷺ) মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি যাবতীয় পাপাচার, সূদ, দাস-দাসীর অবস্থান, নারীর অবস্থান, অন্যায় হত্যা, মানুষের অধিকারসহ মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগের নির্দেশনা প্রদান করেন।

(গ) সূদমুক্ত অর্থনীতি পেশ : বিদায় হজ্জের ভাষণের বিশেষ তাৎপর্য হল, সূদমুক্ত অর্থনীতির ঘোষণা। মুহাম্মাদ (ﷺ) সূদ খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ঘাতকের কাছ থেকে শুধুমাত্র আসল ফেরত নেয়ার কথা বলেন। সূদমুক্ত অর্থনীতি হল সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থব্যবস্থা। সূদ হল এক ভয়ংকর অক্টোপাস। তাই সূদমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিদায় হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ وَ ذَرُوۡا مَا بَقِیَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ -فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا فَاۡذَنُوۡا بِحَرۡبٍ مِّنَ اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ ۚ وَ  اِنۡ تُبۡتُمۡ  فَلَکُمۡ رُءُوۡسُ اَمۡوَالِکُمۡ ۚ لَا تَظۡلِمُوۡنَ وَ لَا تُظۡلَمُوۡنَ

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সূদের যে অংশ বাকী আছে তা ছেড়ে দাও। যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হও। যদি তোমরা তা না কর, তাহলে আল্লাহ ও তার রাসূল (ﷺ)-এর পক্ষ হতে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে রাখ। আর যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন ফিরিয়ে নিতে পারবে। তোমরা যুলুম করবে না, তাহলে তোমাদের প্রতিও যুলুম করা হবে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭৮-৭৯)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

اَلَّذِیۡنَ یَاۡکُلُوۡنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوۡمُوۡنَ اِلَّا کَمَا یَقُوۡمُ الَّذِیۡ یَتَخَبَّطُہُ الشَّیۡطٰنُ مِنَ الۡمَسِّ ؕ ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ قَالُوۡۤا اِنَّمَا الۡبَیۡعُ مِثۡلُ الرِّبٰوا

‘যারা সূদ খায় তারা ক্বিয়ামতে দণ্ডায়মান হবে যেভাবে দণ্ডায়মান হবে ঐ ব্যক্তি যার উপর শয়তান আছর করে। তাদের এ অবস্থার কারণ, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয়ও তো সূদের ন্যায়’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭৫)।

সূদের লেনদেন ও সূদের সাথে সংশ্রব রাখা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ছাহাবী জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ آكِلَ الرِّبَا وَمُوكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ ‘যারা সূদ খায়, সূদ দেয়, সূদের হিসাব লিখে এবং সূদের সাক্ষ্য দেয়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের উপর লা‘নত করেছেন এবং এরা অপরাধের ক্ষেত্রে সকলেই সমান’।[১৬] অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَحَلَّ اللّٰہُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا ‘আল্লাহ তা‘আলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন ও সূদকে হারাম করেছেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭৫)। পৃথিবীতে ইসলামই একমাত্র এমন একটি জীবন বিধান, যেখানে সূদের মত জঘন্য প্রথাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।

(ঘ) বংশগত কৌলীন্য বিলুপ্ত : মুহাম্মাদ (ﷺ) বিদায় হজ্জের মাধ্যমে বংশগত কৌলীন্য প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। তিনি বংশগত কৌলীন্যের পরিবর্তে তাক্বওয়া অর্জনের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের কথা বলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ  اِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ  مِّنۡ ذَکَرٍ وَّ اُنۡثٰی وَ جَعَلۡنٰکُمۡ شُعُوۡبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوۡا ؕ اِنَّ  اَکۡرَمَکُمۡ  عِنۡدَ اللّٰہِ  اَتۡقٰکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ

‘হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে এক প্রুুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয় আল্লাহর নিকট সেই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, মহাজ্ঞানী’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১৩)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, اِنَّ  لِلۡمُتَّقِیۡنَ مَفَازًا ‘নিশ্চয় মুত্তাক্বীদের জন্য সাফল্য রয়েছে’ (সূরা আন-নাবা : ৩১)। অন্যত্র তিনি বলেন, اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ  الۡمُتَّقِیۡنَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাক্বীদের ভালবাসেন’ (সূরা আত-তওবাহ : ৪)।

(ঙ) নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা : যে নারীকে শয়তানের দোসর বলা হত, সমাজে তাদের ইচ্ছার এবং পরামর্শের কোন মূল্যই ছিল না, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হত, পিতৃসম্পত্তিতে তারা কোন প্রকার অধিকার দাবী করতে পারত না, মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাদেরকে মর্যাদার উচ্চ শিখরে টেনে আনেন। বিবাহে মোহরানা, সম্পত্তিতে অধিকার, মাতা হিসাবে মর্যাদা, পতœী হিসাবে স্বাধীকার, কন্যাসন্তান হত্যা নিষিদ্ধসহ তাদেরকে সব ধরনের মর্যাদা প্রদান করেন। আল্লাহ তা‘অলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّ خَلَقَ مِنۡہَا زَوۡجَہَا وَ بَثَّ مِنۡہُمَا رِجَالًا کَثِیۡرًا وَّ نِسَآءً

‘হে মানব জাতি! তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদের এক নফস্ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের উভয় থেকে বহু পুরুষ ও নারীর বিস্তার ঘটিয়েছেন’ (সূরা আন-নিসা : ১)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, وَ مِنۡ اٰیٰتِہٖۤ  اَنۡ خَلَقَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡہَا وَ جَعَلَ بَیۡنَکُمۡ  مَّوَدَّۃً  وَّ رَحۡمَۃً আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম নিদর্শন হল, তিনি তোমাদের থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ করতে পার এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে হৃদ্যতা ও মমতা স্থাপন করে দিয়েছেন’ (সূরা আর-রূম : ২১)। অন্যত্র তিনি বলেন, ہُنَّ لِبَاسٌ لَّکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لِبَاسٌ لَّہُنَّ ‘স্ত্রীরা তোমাদের ভূষণ, আর তোমরা তাদের ভূষণ’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৭)।

ইসলাম পূর্ব যুগে মৃত আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত ধন-সম্পদে মেয়েদের কোন অধিকার ছিল না। ইসলামে এ বিধান বাতিল ঘোষণা করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لِکُلٍّ جَعَلۡنَا مَوَالِیَ  مِمَّا تَرَکَ الۡوَالِدٰنِ وَ الۡاَقۡرَبُوۡنَ ‘পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে আমি প্রত্যেকের জন্যই উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করে দিয়েছি’ (সূরা আন-নিসা : ৩৩)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, لِلرِّجَالِ نَصِیۡبٌ مِّمَّا اکۡتَسَبُوۡا ؕ وَ لِلنِّسَآءِ نَصِیۡبٌ مِّمَّا اکۡتَسَبۡنَ ‘পুরুষেরা যা উপার্জন করে, তাতে তাদের (স্ত্রীদের) পূর্ণ অধিকার রয়েছে। আর নারীরা যা উপার্জন করে তাতেও রয়েছে তাদের (পুরুষদের) পূর্ণ অধিকার’ (সূরা আন-নিসা : ৩২)।

আল্লাহ তা‘আলা নারীদের মর্যাদা প্রদানে মোহরানা আদায়ের উপর আয়াত অবতীর্ণ করেন, وَ اٰتُوا النِّسَآءَ صَدُقٰتِہِنَّ نِحۡلَۃً ‘তোমরা স্ত্রীদেরকে খুশি মনে তাদের মোহর দিয়ে দাও’ (সূরা আন-নিসা : ৪)। একজন নারী কতটুকু সম্মানের অধিকারী তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্পষ্ট করে ঘোষণা করে দিয়েছেন। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللهِ ﷺ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ ﷺ مَنْ أَحَقُّ بِحُسْنِ صَحَابَتِىْ قَالَ أُمُّكَ قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ أُمُّكَ قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ أُمُّكَ قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ ثُمَّ أَبُوْكَ.

‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমার সাহচর্যে আমার সদাচার পাওয়ার সবচেয়ে অগ্রাধিকারী কে? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল তারপর কে? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমার মা। লোকটি আবারও জিজ্ঞেস করল তারপর কে? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমার মা, তারপর তোমার বাবা’।[১৭] অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, أُمَّكَ ثُمَّ أُمَّكَ ثُمَّ أُمَّكَ ثُمَّ أَبَاكَ ثمَّ أَدْنَاكَ أَدْنَاكَ ‘তোমার মা, অতঃপর তোমার মা, অতঃপর তোমার মা। অতঃপর তোমার বাবা। তারপর তোমার নিকট আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব’।[১৮]

(চ) তাওহীদের প্রতি আহ্বান : বিদায় হজ্জের ভাষণে মুহাম্মাদ (ﷺ) তাওহীদের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। আল্লাহ এক। তিনি ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই, তার কোন অংশীদার নেই। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন। মূলত মুহাম্মাদ (ﷺ) রিসালাতের দায়িত্ব পেয়েছিলেন পৃথিবীতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য। আর বিদায় হজ্জের ভাষণের মাধ্যমে এ বাণীই প্রতিভাত হয়েছে। পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসেছেন, প্রত্যেকের দাওয়াত ছিল তাওহীদের প্রতি আহ্বান করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
 وَ لَقَدۡ بَعَثۡنَا فِیۡ کُلِّ اُمَّۃٍ  رَّسُوۡلًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ  وَ اجۡتَنِبُواالطَّاغُوۡتَ ‘আমরা প্রত্যেক উম্মতের মাঝে রাসূল প্রেরণ করেছি এই জন্য যে, তোমরা আল্লাহর একত্ববাদকে মেনে নিবে এবং ত্বাগূত থেকে বিরত থাকবে’ (সূরা আন-নাহল : ৩৬)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরও বলেন, مَنْ شَهِدَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ النَّارَ  ‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দিবেন’।[১৯]

(ছ) মুসলিমদের পথ নির্দেশনা : বিদায় হজ্জের ভাষণে মু‏হাম্মাদ (ﷺ) মুসলিমদের জন্য পথ নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি মুসলিমদের জন্য দু’টি পথ নির্দেশের কথা বলেছেন। একটি কিতাবুল্লাহ তথা কুরআন। অন্যটি হল রাসূল (ﷺ)-এর হাদীছ।[২০] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلٰى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا لاَ يَزِيْغُ عَنْهَا بَعْدِىْ إِلَّا هَالِكٌ ‘আমি তোমাদেরকে একটি উজ্জ্বল পরিষ্কার দ্বীনের উপর ছেড়ে গেলাম। যার রাতটাও দিনের মত (উজ্জ্বল)। ধ্বংসশীল ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই তা থেকে সরে আসতে পারে না’।[২১]

অন্য হাদীছে এসেছে, ইরবায ইবনু সারিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফজরের ছালাতের শেষে অত্যন্ত অর্থবহ এক বক্তব্য রাখেন। বক্তব্য শুনে চক্ষুসমূহ হতে অশ্রু প্রবাহিত হয় এবং অন্তর সমূহ প্রকম্পিত হয়ে উঠে। জনৈক ছাহাবী বললেন, এটাতো বিদায়ী বক্তব্য মনে হচ্ছে। অতএব আপনি আমাদেরকে কী অছিয়ত করছেন? তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে অছিয়ত করছি, আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করার এবং আমীরের কথা শুনা ও আনুগত্য করার, যদিও সে হাবশী গোলাম হয়। কারণ তোমাদের মধ্যে যারা দীর্ঘ জীবন পাবে, তারা বহু ধরণের মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন তোমরা সাবধান থাকবে শরী‘আতের ভিতর নবাবিষ্কৃত কাজ থেকে, যা ভ্রষ্টতা ছাড়া কিছু নয়। অতএব তোমাদের যে ব্যক্তি সে সময় পেয়ে যাবে, তার অবশ্যই কর্তব্য হবে আমার সুন্নাত ও আমার সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে মাড়ির দাঁত দ্বারা মযবুতভাবে আঁকড়ে ধরা। অতএব সাবধান, তোমরা (দ্বীনের ব্যাপারে) নতুন কাজ হতে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেক বিদ‘আতই গোমরাহী’।[২২]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

*সহকারী অধ্যাপক, আরবী বিভাগ, হামিদপুর আলহেরা ডিগ্রী কলেজ, যশোর।

তথ্যসূত্র :
[১]. মুহাম্মাদ ইবনু আবুবকর ইবনু আইয়ূব ইবনু সা‘দ শামসুদ্দীন ইবনু ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়া, যাদুল মা‘আদ ফী হাদয়ি খায়রিল ইবাদ (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ২৭ তম সংস্করণ ১৪১৫ হিঃ/১৯৯৪ খ্রিঃ), ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৮-৯৯।
[২]. ছহীহ মুসলিম হা/১২৩২ ও ১২৫১; মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশ বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ ২০১৫ খ্রিঃ), পৃঃ ৭০২।
[৩]. মুহাম্মাদ ছফীউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম (বৈরূত : দারুল হেলাল, তাবি), পৃঃ ৪৫৮-৪৫৯; যাদুল মা‘আদ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২০৬-০৭।
[৪]. যাদুল মা‘আদ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২১৫।
[৫]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ শারহ মিশকাতুল মাছাবীহ হা/২৫৬৯-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[৬]. ছহীহ মুসলিম হা/১২১৮; ইবনু মাজাহ হা/৩০৭৪; মিশকাত হা/২৫৫৫।
[৭]. ছহীহ মুসলিম হা/১২১৮; ইবনু মাজাহ হা/৩০৭৪; মিশকাত হা/২৫৫৫।
[৮]. প্রাগুক্ত।
[৯]. প্রাগুক্ত।
[১০]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, মানযিলাতুস সুন্নাহ ফিল ইসলাম, পৃঃ ১৮; ইমাম যাহাবী, মুখতাছারুল ঊলূ লিল আলীইল আযীম, তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, (মাকতাবাতুল ইসলামী, ২য় সংস্করণ ১৪১২ হিঃ/১৯৯২ খ্রিঃ), পৃঃ ৬২, সনদ হাসান।
[১১]. আবু মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক ইবনু হিশাম আল-বাছরী, আস-সীরাতুন নাবাবিয়াহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০৩; ফিক্বহুস সীরাহ, পৃ. ৪৫৬।
[১২]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৩৫৩৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০০; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৯৬৩, সনদ হাসান।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম হা/১২১৮; ইবনু মাজাহ হা/৩০৭৪; মিশকাত হা/২৫৫৫।
[১৪]. ছহীহ বুখারী হা/১৭৩৯; ছহীহ মুসলিম হা/১৬৭৯।
[১৫]. ছহীহ বুখারী হা/৪৫; ছহীহ মুসলিম হা/৩০১৭।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম হা/১৫৯৮; আবুদাঊদ হা/৩৩৩৩; মিশকাত হা/২৮০৭।
[১৭]. ছহীহ বুখারী হা/৫৯৭১; ছহীহ মুসলিম হা/২৫৪৮; মিশকাত হা/৪৯১১।
[১৮]. ছহীহ মুসলিম হা/২৫৪; মিশকাত হা/৪৯১১।
[১৯]. ছহীহ মুসলিম হা/২৯; তিরমিযী হা/২৬৮৩; মিশকাত হা/৩৬।
[২০]. মানযিলাতুস সুন্নাহ ফিল ইসলাম, পৃঃ ১৮; মুখতাছারুল ঊলূ লিল আলীইল আযীম, পৃঃ ৬২, সনদ হাসান।
[২১]. ইবনু মাজাহ হা/৪৩; হাকেম হা/৩৩১; মুসনাদে আহমাদ হা/১৭১৮২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৩৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৩৬৯, সনদ ছহীহ।
[২২]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৭; তিরমিযী হা/২৬৭৬; মুসনাদে আহমাদ হা/১৭১৮৫; মিশকাত হা/১৬৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৩৭, সনদ ছহীহ।




প্রসঙ্গসমূহ »: হজ্জ ও ওমরাহ
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১৩তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের ঈমান বনাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ঈমান : একটি পর্যালোচনা - ড. আব্দুল্লাহিল কাফী বিন লুৎফর রহমান মাদানী
শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (১০ম কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৯ম কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
বিদ‘আত পরিচিতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ক্রোধের ভয়াবহতা ও তার শারঈ চিকিৎসা - হাসিবুর রহমান বুখারী

ফেসবুক পেজ