শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২৩ অপরাহ্ন

ইত্তিবাউস সুন্নাহর প্রকৃতি ও স্বরূপ

- হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন*



খেলাফে সুন্নাত ও তার ভয়াবহতা

মুসলিম হওয়ার জন্য কুরআন মেনে চলা যেমন আবশ্যক, তেমনি সুন্নাহ মেনে চলাও অপরিহার্য। সুন্নাহকে বাদ দিয়ে কুরআন অনুসরণ করা অসম্ভব। তেমনিভাবে সুন্নাহর খেলাফ বা সুন্নাহকে উপেক্ষা করলে পরকালে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।  

১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্যের পরিপন্থী

পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ পাওয়ার পর তা উপেক্ষা করে যদি কেউ নিজের রায়কে প্রাধান্য দেয়, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণের পরিপন্থী হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহকে পিছনে ফেলে অসম্মান করা, আল্লাহর আদেশের খেলাফ করার নামান্তর, যা হারাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللّٰهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللّٰهَ إِنَّ اللّٰهَ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ - يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَرْفَعُوْا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوْا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُوْنَ.

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রবর্তী হয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর তোমাদের কণ্ঠস্বরকে উঁচু করো না এবং তোমরা পরস্পরে যেভাবে উঁচুস্বরে কথা বল, তার সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না। এতে তোমাদের কর্মফল সমূহ বিনষ্ট হবে। অথচ তোমরা বুঝতে পারবে না’ (সূরা আল-হুজরাত: ১-২)। ‘নবীর কণ্ঠস্বর’ হল তাঁর রেখে যাওয়া সুন্নাত। এই সুন্নাহকে অমান্য, অস্বীকার, পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের নিমিত্তে যে সকল অপচেষ্টা সব কিছুই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সুতরাং এই কণ্ঠরোধ করার অর্থ হল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা তথা আল্লাহর অহী দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার সুপ্ত ষড়যন্ত্র।

সর্বপ্রথম আল্লাহ ও তাঁর বিধান কুরআন এবং তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সুন্নাহর আনুগত্য করতে হবে। অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্য ব্যতীত আল্লাহর সান্নিধ্য অসম্ভব। আল্লাহ ও রাসূলের সম্পর্ক সম্পূরক। যেমন আল্লাহ বিধানদাতা ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিধানের ব্যাখ্যাদাতা ও পথপ্রদর্শক। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য মুমিন ব্যক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوْا اللّٰهَ وَأَطِيْعُوْا الرَّسُوْلَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের’ (সূরা আন-নিসা: ৫৯)। তিনি অন্যত্র বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ أَطَاعَ اللّٰهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে, সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল’ (সূরা আন-নিসা: ৮০)। তিনি আরো বলেন, وَأَطِيعُوا اللّٰهَ وَالرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ‘আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও’ (সূরা আলে-ইমরান : ১৩২)।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্য হল আল্লাহর আনুগত্য। হাদীছে এসেছে, জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا  ﷺ  فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا ﷺ فَقَدْ عَصَى اللهَ ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আনুগত্য করল, সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর অবাধ্যতা করল, সে যেন আল্লাহরই অবাধ্যতা করল’।[১] তিনি আরো বলেন, فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِىْ فَلَيْسَ مِنِّىْ ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নিল, সে আমার দলভুক্ত নয়’।[২]

হাদীছের তথা সুন্নাহর অনুসরণ ব্যতীত ইসলামের অনুসরণ কল্পনা করা যায় না। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের সম্মুখে যে সুন্নাত পেশ করেছেন, তা কোনরূপ বিকৃত ও বিরোধিতা না করে সঠিকভাবে গ্রহণ করা ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ‘আর রাসূল তোমাদের যা দেন তোমরা তা গ্রহণ কর এবং যা কিছু নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক’ (সূরা আল-হাশর: ৭)।

সুন্নাহর বিরোধিতা ও তা বিকৃত করা কুফরী। মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ أَطِيعُوا اللّٰهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللّٰهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ ‘আপনি বলুন! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। কিন্তু যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে (তারা জেনে রাখুখ যে) আল্লাহ কাফেরদের ভালোবাসেন না’ (সূরা আলে-ইমরান: ৩২)। তাছাড়া পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ পৃথিবীর সকল মুমিন বান্দার জন্য আমানত স্বরুপ। হাদীছে এসেছে, হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

أَنَّ الأَمَانَةَ نَزَلَتْ فِىْ جَذْرِ قُلُوْبِ الرِّجَالِ  ثُمَّ عَلِمُوْا مِنَ الْقُرْآنِ  ثُمَّ عَلِمُوْا مِنَ السُّنَّةِ.  

‘নিশ্চয়ই আমানতকে মানুষের মূল অন্তঃকরণে নাযিল করা হয়েছে। অতএব তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর কুরআন হতে। অতঃপর শিক্ষা গ্রহণ কর সুন্নাহ হতে’।[৩]

পার্থিব জীবনের সকল কর্মে কুরআন ও সুন্নাহর ফায়ছালা  মেনে চলা ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللّٰهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.  

‘মুমিনদের মধ্যে কোন ব্যাপারে ফায়ছালা করার জন্য যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের (কুরআন ও সুন্নাহর) দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। বস্তুতঃ তারাই হল সফলকাম’ (সূরা আন-নূর: ৫১)। ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহকে সসম্মানে মেনে চলতেন। তার প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ইয়ামানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠান, তখন মু‘আয বলেন, ‘আমি আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা ফায়ছালা করব’ (দারেমী)। যে কুরআন ও হাদীছের সিদ্ধান্ত মেনে না নেয়, সে মুনাফিক্ব। দুনিয়াতে তার উদাহরণ ছিদ্র হওয়া পাত্রের মত, যতই পানি ভরার চেষ্টা করে, তা পূর্ণ হয় না। অনুরূপভাবে তার আমলে ছালেহ বা সৎ আমল নষ্ট হয়ে যায়।

২. আমলে ছালেহ বা সৎ আমল বিনষ্ট হওয়া

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের পরিপন্থী আমল করলে অর্থাৎ পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহকে অবমাননা করার ফলে উত্তম আমলগুলো বিনষ্ট হয়ে যায়। যদিও মানুষ ভাবে যে, সে দুনিয়ার বুকে ভাল আমল করে চলছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللّٰهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং স্বীয় আমল বিনষ্ট কর না’ (সূরা মুহাম্মাদ : ৩৩)। তিনি আরো বলেন,

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا . الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا.  

‘আপনি বলুন! আমরা কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে খবর দিব? দুনিয়ার জীবনে যাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়েছে। অথচ তারা ভাবে যে, তারা সুন্দর আমল করে যাচ্ছে’ (সূরা আল-কাহফ: ১০৩-১০৪)। তিনি অন্যত্র বলেন, وَمَنْ يَكْفُرْ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের বিষয় (কুরআন-সুন্নাহ) অস্বীকার করে, তার সকল শ্রম বিফলে যাবে এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (সূরা আল-মায়েদাহ: ৫)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, إِنَّ اللّٰهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আমল সম্পর্কে অবগত আছেন’ (সূরা আন-নূর : ৫৩)। তিনি আরো বলেন, فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ   ‘সুতরাং আপনি সেভাবে আদিষ্ট হয়েছেন তাতে স্থির থাকুন আর আপনার সাথে যারা ঈমান এনেছে তারাও স্থির থাকুক; এবং সীমালঙ্ঘন করো না। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা’ (সূরা হূদ : ১১২)। বিশ্বাসের বিষয় হল পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত কিংবা ছহীহ সুন্নাহর একটি অংশও কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। আর যদি কেউ অস্বীকার করে কিংবা রদবদল করে পালন করে, তবে সে ব্যক্তি পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এখানে (اسْتَقِمْ)-এর ব্যাখ্যা হল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে সুষ্ঠু ও সঠিক মূলনীতি শিক্ষা দিয়েছেন, তার মধ্যে বিন্দুমাত্র হ্রাস-বৃদ্ধি বা পরিবর্ধন-পরিমার্জনকারী পথভ্রষ্ট হবে। তার নিয়ত যতই ভাল হোক না কেন। তাছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার লক্ষ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যে নির্দেশ দিয়েছেন, তার মধ্যে কোনরূপ কমতি বা গাফলতি মানুষকে যেমন ইস্তেকামাতের আদর্শ হতে বিচ্যুত করে। অনুরূপভাবে তার মধ্যে নিজের পক্ষ হতে বাড়াবাড়ি মানুষকে বিদ‘আতে লিপ্ত করে। যদিও সে মনে করে, আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি হাছিল করছি। অথচ ক্রমান্বয়ে সে আল্লাহর বিরাগভাজন হতে থাকে’।[৪]

৩. গোমরাহীর পথে পরিচালিত হওয়া

কোন ছহীহ সুন্নাহকে বিকৃত কিংবা সামান্যতম পরিবর্তন করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের পরিপন্থী। সেই সাথে ঐ সকল ব্যক্তির সৎ আমল বিনষ্ট হয় এবং ইস্তেকামাতের রাস্তাচ্যুত হয়ে গোমরাহীর পথে পরিচালিত হয়। অতঃপর তার শেষ পরিণতি হয় অত্যন্ত ভয়াবহ স্থান জাহান্নাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَعْصِ اللّٰهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করল, সে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে পতিত হল’ (সূরা আল-আহযাব: ৩৬)। যারা আল্লাহর বিধানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং আলোর বিনিময়ে অন্ধকার ও উত্তমের বিনিময়ে মন্দকে ক্রয় করে থাকে, তারাই অধিক পথভ্রষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اللّٰهَ نَزَّلَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِي الْكِتَابِ لَفِي شِقَاقٍ بَعِيدٍ

‘আল্লাহ নাযিল করেছেন সত্যপূর্ণ কিতাব। আর যারা কিতাবের মাঝে মতবিরোধ সৃষ্টি করেছে, নিশ্চয়ই তারা যিদের বশবর্তী হয়ে (ভ্রষ্টপথে) অনেক দূরে চলে গেছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৭৬)। এদের পরিচয় তুলে ধরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدَى وَالْعَذَابَ بِالْمَغْفِرَةِ ‘এরাই হল সে সমস্ত লোক যারা হেদায়াতের বিনিময়ে  গোমরাহী এবং ক্ষমা ও অনুগ্রহের বিনিময়ে আযাব ক্রয় করেছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৭৫)।

ঐ সকল ব্যক্তিকে সুন্নাহ বিকৃত করা থেকে নিবৃত্ত হতে বললে, তারা বাব-দাদার রায়কে সঠিক বলে মনে করে এবং তাদের পৈতৃক বিধানের উপর অবিচল থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللّٰهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُوا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا ‘যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং রাসূলের দিকে এসো, তখন তারা বলে, আমাদের জন্য তাই যথেষ্ট যার উপর আমরা আমাদের বাব-দাদাকে পেয়েছি’ (সূরা আল-মায়েদাহ: ১০৪)। আবার তাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি আকৃষ্ট হতে বললে, তারা নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে থাকে এবং অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলে।

পক্ষান্তরে আল্লাহর ভালোবাসা ও ক্ষমা লাভের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্যের কোন বিকল্প নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন ও তোমাদের গোনাসমূহ মাফ করে দিবেন। বস্তুতঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (সূরা আলে-ইমরান : ৩১)। তিনি অন্যত্র বলেন,

فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللَّهِ.

‘অতঃপর যদি তারা আপনার ডাকে সাড়া না দেয় তবে জেনে রাখুন যে, তারা কেবল তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হেদায়াতকে অগ্যাহ্য করে নিজের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে তার চাইতে বড় পথভ্রষ্ট আর কে আছে?’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৫০)। কোন কোন সময় মানুষ সংখ্যাধিক্যের দোহাই দিয়ে কুরআন সুন্নাহর শিক্ষা ও সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে। অথচ সংখ্যা কখনও হক্বের মানদণ্ড নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ   ‘অতএব যদি আপনি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চলেন, তাহলে ওরা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (সূরা আল-আন‘আম: ১১৬)। অথচ সত্যের মুকাবিলায় ধারণার কোন মূল্য নেই। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا ‘আর সত্যের মুকাবিলায় ধারণার কোন মূল্য নেই’ (সূরা আন-নাজম: ২৮)। হক্ব কথার পর সবই ভ্রান্ত। যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলে, সে সুন্নাহ থেকে বেরিয়ে পথভ্রষ্ট হয়। ইমাম আবূ হানীফা ঢ় বলেন, إِيَّاكُمْ وَالْقَوْلِ فِيْ دِيْنِ اللهِ تَعَالَىٰ بِالرَّأْيِ وَعَلَيْكُمْ بِاتِّبَاعِ السُّنَّةِ فَمَنْ خَرَجَ عَنْهَا ضَلَّ ‘তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে ‘রায়’ অনুযায়ী কোন কথা বল না। তোমাদের কর্তব্য হল সুন্নাহর অনুসরণ করা। যে ব্যক্তি সুন্নাহ থেকে বেরিয়ে গেল, সে পথভ্রষ্ট হল’।[৫]

দ্বীন আমাদের নিকট পৌঁছেছে পূর্ণাঙ্গরূপে। তাতে কোন কিছু  যোগ-বিয়োগ করার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম’ (সূরা আল-মায়েদাহ: ৩)। পূর্ণাঙ্গ বলতে কুরআন ও সুন্নাহর সকল ইলম। বিশিষ্ট তাবেঈ ইবনে সীরীন (৩৩-১১০ হি.) বলেছেন,إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ ‘নিশ্চয়ই কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানটাই হল দ্বীন। অতএব তোমরা দেখ, কার নিকট থেকে দ্বীন গ্রহণ করছ’।[৬]

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। তার প্রমাণ হল বিদায় হজ্জের ভাষণে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ভাষণ। তিনি বললেন,

وَأَنْتُمْ تُسْأَلُونَ عَنِّي فَمَا أَنْتُمْ قَائِلُونَ قَالُوا نَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ وَأَدَّيْتَ وَنَصَحْتَ فَقَالَ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ يَرْفَعُهَا إِلَى السَّمَاءِ وَيَنْكُتُهَا إِلَى النَّاسِ اللَّهُمَّ اشْهَدْ اللَّهُمَّ اشْهَدْ.

‘ক্বিয়ামতের দিন আমার সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে। সেই দিন কি জবাব দিবে? সকলে সমস্বরে বলল, আমরা স্বাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর আহকাম রিসালা ও নবুওয়াতের হক্ব আদায় করেছেন এবং সকল বিষয়ে উপদেশ দান করেছেন। নবী করীম (ﷺ) স্বীয় শাহাদাত আঙ্গুল আকাশের দিকে উঠিয়ে মানুষের দিকে ঝুকাতে ঝুকাতে বললেন, হে আল্লাহ! স্বাক্ষী থাকুন, স্বাক্ষী থাকুন, স্বাক্ষী থাকুন’।[৭] সুতরাং দ্বীনের মধ্যে কোন রকম সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন নেই।

এরপরেও যারা দ্বীন (কুরআন ও সুন্নাহ) নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হবে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে আযাবের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সতর্ক করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,

وَالَّذِينَ يُحَاجُّونَ فِي اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مَا اسْتُجِيبَ لَهُ حُجَّتُهُمْ دَاحِضَةٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ.

‘আর যারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে তাকে মেনে নেয়ার পরেও, তাদের বিতর্ক তাদের পালনকর্তার নিকট নিস্ফল। আর তাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ ও তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (সূরা আশ-শূরা : ১৬)।

সুন্নাহর তথা হাদীছের কিয়দংশও বিকৃত হলে কিংবা বিরোধিতা করলে ফিৎনায় পড়া অবশ্যম্ভবী। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلْيَحْذَرِالَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ   ‘অতএব যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধচারণ করে, তারা এ বিষয়ে সাবধান হৌক যে, ফিৎনা তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা মর্মন্তুদ শাস্তি তাদের উপর আপতিত হবে’ (সূরা আন-নূর : ৬৩)।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকটে পূর্ণাঙ্গ পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيَّةً ‘আমি তোমাদের নিকটে এসেছি, একটি স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে’।[৮] এ দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ ‘আর দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজনের ব্যাপারে সাবধান থাকবে। কারণ প্রতিটি নতুন সংযোজনই বিদ‘আত। আর প্রতিটি বিদ‘আতই গোমরাহী’।[৯]

দ্বীনের মধ্যে নতুন কোন কিছু সৃষ্টি করা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি মিথ্যারোপের শামিল। এর পরিণতি হল জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, مَنْ يَقُلْ عَلَيَّ مَا لَمْ أَقُلْ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি আমার নামে এমন কোন কথা বলে, যা আমি বলিনি, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে করে নেয়’।[১০]

ছাহাবীগণ জীবিত থাকা অবস্থায় দ্বীনের মধ্যে নতুন নতুন প্রথা চালু হয়েছিল। যেমন একদা আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে মসজিদে ডেকে দেখালেন কিছু লোক দলে দলে বসে কংকর নিয়ে ১০০ বার তাকবীর, তাসবীহ, তাহলীল গণনা করছে। তা দেখে তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদের উম্মত! ধিক, তোমাদের ধ্বংস আসন্ন। এখনও নবীর ছাহাবীগণ জীবিত। আল্লাহর কসম! আজ মনে হচ্ছে তোমরা মুহাম্মাদের দ্বীন (কুরআন ও সুন্নাহ) হতে আরও বেশী সঠিক পথে আছ কিংবা ভ্রষ্টতার দ্বার খুলে দিয়েছ। ঐ সকল ব্যক্তিরা বলল, আমরা এর মাধ্যমে উত্তম আমল করারই ইচ্ছা পোষণ করছি। তিনি বললেন, এমন কতক ব্যক্তি আছে, যারা কল্যাণ চায় বটে, কিন্তু কল্যাণ লাভ করতে পারে না’।[১১] অন্য হাদীছে এসেছে, মারওয়ান মদীনার গভর্ণর থাকাবস্থায় ঈদের ছালাতের পূর্বে মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুৎবা দেয়ার প্রচলন করেন। কিন্তু আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এই নিয়মের প্রতিবাদ করেছিলেন। কেননা এটা সুন্নাহ বিরোধী আমল এবং দ্বীন ইসলামে তা বিদ‘আত’।[১২] বিদ‘আত সম্পর্কে ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,

مَنْ أَحْدَثَ رَأْيًا لَيْسَ فِي كِتَابِ اللهِ وَلَمْ تَمْضِ بِهِ سُنَّةٌ مَنْ رَسُولِ اللهِ ﷺ لَمْ يَدْرِ عَلَى مَا هُوَ مِنْهُ إِذَا لَقِيَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ.

‘যে ব্যক্তি (দ্বীনের মধ্যে) এমন বিষয় উদ্ভবন করল, যা আল্লাহর কিতাবে নেই এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহয় পাওয়া যায় না, আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তার স্থান কোথায় হবে সে তা জানে না’।[১৩]

বিদ‘আতী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সতর্কবাণী

১. যে ব্যক্তি বিদ‘আতীকে সাহায্য করে, আল্লাহ তাকে লা‘নত করেন’।[১৪]

২. من وقر صاحب بدعة فقد أعان على هدم الإسلام  ‘যে বিদ‘আতীকে সম্মান করল, সে ইসলাম ধ্বংসে সাহায্য করল’।[১৫]

৩. ‘যে বিদ‘আতীকে আশ্রয় দিল, তার প্রতি আল্লাহর অভিশাপ’।[১৬]

৪. إن الله حجب التوبة عن كل صاحب بدعة حتى يدع بدعته ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বিদ‘আতী থেকে তাওবাকে আড়াল করে রাখেন, যতক্ষণ না সে বিদ‘আত পরিহার করে’।[১৭]

৫. إن الله احتجر التوبة على كل صاحب بدعة ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বিদ‘আতীর তাওবা প্রত্যাখ্যান করেন’।[১৮]

৬. أَبَى اللهُ أَنْ يَقْبَلَ عَمَلَ صَاحِبِ بِدْعَةٍ حَتَّى يَدَعَ بِدْعَتَهُ ‘আল্লাহ বিদ‘আতীর আমল প্রত্যাখ্যান করেন, যতক্ষণ না সে বিদ‘আত পরিহার করে’।[১৯]

সুন্নাত ও বিদ‘আত সম্পর্কে সালাফে ছলেহীনের উক্তি

(ক) খলীফা আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, ‘সুন্নাতই হল আল্লাহর মযবূত রজ্জু’।

(খ) ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সুন্নাত ত্যাগ করল, সে কুফরী করল। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যারা নিজ রায়ের ভিত্তিতে কথা বলে, তারা সুন্নাতের শত্রু।....তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যদেরও বিপথগামী করেছে’।

(গ) আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সুন্নাতের বিরোধিতা করে, সে নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, যদিও তার গলা কাটা যায়’।

(ঘ) ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘প্রতি বছরই লোকজন একটি বিদ‘আত চালু করছে এবং একটি সুন্নাতকে মেরে ফেলছে। শেষ পর্যন্ত বিদ‘আতই জীবিত হবে এবং সুন্নাত মৃত্যু বরণ করবে’।[২০] অতএব দ্বীনের মূলনীতির কোন বিকৃতি করা চলবে না। যদি কেউ তা করে, তবে সে স্পষ্ট কুফরী করবে। 

৪. জাহান্নামী হওয়া

যারা কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ মোতাবেক ফায়ছালা করে না, তারা আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি যুলুম করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللّٰهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ   ‘বস্তুতঃ যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করে না, তারাই কাফের’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৪৪), তারাই যালেম (সূরা আল-মায়েদাহ : ৪৫), তারাই ফাসেক (সূরা আল-মায়েদাহ : ৪৭)।

আল্লাহর বিধান অমান্যকারী কাফের, যালেম ব্যক্তির আবাসস্থল জাহান্নাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَعْصِ اللّٰهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا  ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানী করল, তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হল। সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে’ (সূরা আল-জিন : ২৩)। তিনি আরো বলেন, عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ ‘তাতে উনিশজন কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছে’ (সূরা আল-মুদ্দাছছির : ৩০)। তিনি আরো বলেন, قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا لَوْ كَانُوا يَفْقَهُونَ ‘তাদেরকে বলে দাও, গ্রীষ্মেরপ্রখর তাপ অপেক্ষা জাহান্নামের আগুন আরও কঠিন ও ভয়াবহ। যদি তারা বুঝত’ (সূরা আত-তাওবা : ৮১)। এটি অতীব নিকৃষ্ট আবাস্থল (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২০৬; আলে-ইমরান : ১৬২, ১৯৭)।

আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত্য হল-পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহতে যা কিছু আদেশ করা হয়েছে তা কোনরূপ বিকৃত না করে পালন করা এবং যা নিষেধ করা হয়েছে তা মেনে চলা। এমর্মে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, فَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ فَخُذُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْءٍ فَانْتَهُوا ‘যখন আমি তোমাদেরকে কোন কিছুর আদেশ করি, তখন সেটা যথাসাধ্য পালন কর, আর আমি যখন কোন কিছু নিষেধ করি, তখন তোমরা সেটা থেকে বিরত থাক’।[২১]

যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্য করল, সে জান্নাতে যাবে। আর যে অমান্য করল সে জাহান্নামের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হবে এবং আফসোস করে তারা বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি রাসূলের সাথে পথ অবলম্বন করতাম। হায় আমার দূর্ভাগ্য! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ২৭-২৮)। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ إِلَّا مَنْ أَبَى قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى ‘আমার প্রত্যেক উম্মত জান্নাতে যাবে। কেবল তারা ব্যতীত, যারা অসম্মত হবে। জিজ্ঞাসা করা হল অসম্মত কারা? তিনি বললেন, যারা আমার অবাধ্যতা করবে, তারাই হল অসম্মত’।[২২]

এই অবাধ্য ব্যক্তিরা রাসূলের সুন্নাতকে পরিবর্তন করে এবং তাতে নতুন নতুন কথা, কাজের উদ্ভাবন করে। অথচ এই নতুন সৃষ্টি থেকে বেঁচে থাকার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নির্দেশও দিয়েছেন। তিনি বলেন, وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ ‘আর দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজনের ব্যাপারে সাবধান থাকবে। কারণ প্রতিটি নতুন সংযোজনই বিদ‘আত। আর প্রতিটি বিদ‘আতই গোমরাহী’।[২৩]

দ্বীনের নামে ছওয়াবের আশায় কিংবা নিজের ইচ্ছামত আমলকারী বিদ‘আতী ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফা‘আত থেকে বঞ্চিত হবে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

‘সাবধান হয়ে যাও, আমার উম্মতের কিছু লোককে ধরে আনা হবে তাদেরকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমি বলব, হে আমার রব! এরা তো আমার উম্মত। জবাবে আমাকে বলা হবে, তুমি জান না তোমার (মৃত্যুর) পরে এরা কত নতুন (হাদীছ) কথা তৈরী করেছিল। আমি তখন আল্লাহর সৎ বান্দা (ঈসার) মত বলব, ‘যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন আমি ছিলাম তাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। কিন্তু আমার পরে তুমিই তাদের সাক্ষী। তখন বলা হবে, তুমি এদের কাছ থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর, এরা (তোমার দ্বীন তথা কুরআন-সুন্নাহ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ইল্টো পথে চলেছিল’।[২৪]

শুধু তাই নয়, ঐ সমস্ত বিদ‘আতী ব্যক্তিরা হাউযে কাউছারের পানি পান করতে পারবে না। তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘হাউযে কাউছারের অজস্র কল্যাণ আছে এবং হাউযে কাউছারে  আমার উম্মত পানি পান করতে যাবে। এর পান পাত্রের সংখ্যা আকাশের নক্ষত্রসম হবে। তখন কতক ব্যক্তিকে ফেরেশতাগণ হাউযে কাউছার থেকে সরিয়ে দিবেন। আমি বলব, হে আমার রব! তারা তো আমার উম্মত। আল্লাহ বলবেন, তুমি জান না তোমার পরে তারা কি নতুন মত ও পথ (বিদ‘আত) অনুসরণ করেছিল’।[২৫]

কুরআন ও সুন্নাহ উভয়ের বাহক ও প্রচারক হলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। অতএব সুন্নাহকে অস্বীকার করা কিংবা নতুন কিছু উদ্ভাবন করার উদ্দেশ্যই হল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পরোক্ষভাবে অস্বীকার করা (নাঊযুবিল্লাহ)। যার পরিণাম জাহান্নাম।

উপসংহার

পরিশেষে বলব, কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে সুন্নাহর গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক। ইসলামী শরী‘আতে নববী সুন্নাহর মর্যাদা মহান। কিতাব ও সুন্নাহ একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যা একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন ও আলাদা হওয়ার নয়। এ দু’টির যেকোন একটিই যথেষ্ট নয়; বরং একটি আরেকটির পরিপূরক। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহে অনেক দলীল রয়েছে, যা রাসূলের সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার সুমহান মর্যাদার বিষয়ে একাত্বতা পোষণ করেছে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে এর মহা পুরুস্কার ও ঈর্ষণীয় সুফল ঘোষণা করেছে। হক্ব মানহাজ ও ছিরাতে মুস্তাক্বীম তো সেটাই যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং এটা ব্যতীত কারো কোন কিছুই কবুল করেন না। তাহল, যা রাসূল (ﷺ) তাঁর রবের পক্ষ থেকে পৌঁছে দিয়েছেন। এতেই রয়েছে আলোকবর্তিকা ও হেদায়াত। এটা ব্যতীত সকল কিছুই অন্ধকার ও ভ্রষ্টতা। সুন্নাহ আঁকড়ে ধারার বিপরীতে যা কিছু রয়েছে সেগুলোর পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। তাহল, দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করা এবং সুস্পষ্ট এই মানহাজের বিপরীত কিছুর অনুসরণ করা। মুসলিমদের ঐক্য ও তাদের এক কাতারে আসা সম্ভব না সর্বশেষ নবী ও রাসূলের সুন্নাহের ইত্তেবা ব্যতীত। তাই তারা যখনই ঐক্যবদ্ধ ও এক হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, তারা যদি সুন্নাহ থেকে বিমুখ হয়, তাহলে নানা ফের্কায় বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং সুস্পষ্ট গোমরাহীতে পতিত হবে।

সুতরাং আমি প্রথমত নিজেকে, অতঃপর সকল মুসলিম ভ্রাতৃমণ্ডলিকে নবী করীম (ﷺ)-এর সুন্নাহের ইত্তেবা করার অছিয়ত করছি। কেননা এতেই রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ। সেই সাথে সাবধান বিদ‘আতীদের পথের অনুসরণ করা, তাদের সুন্দর কথা ও সৌন্দর্য দ্বারা ধোঁকায় পতিত হওয়া থেকে। তাই তার একমাত্র নির্ভযোগ্য বিষয় হল, নবী করীম (ﷺ) যা নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে যা সাব্যস্ত হয়েছে তার ইত্তেবা করা। কেননা হক্ব দ্বীন সুস্পষ্ট, তাতে কোন অন্ধত্ব ও গোলক ধাঁধা নেই। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ও আপনাদেরকে আহলে সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত করে নিন, যারা তা ভালোভাবে চিনতে পেরেছেন, তা আঁকড়ে ধরেছেন, তার দিকেই মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন। ফলে তারা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও সফলতা লাভে ধন্য হয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা যেন আমাদেরকেও দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও সফলতা লাভে ধন্য করেন-আমীন!!



* পরিচালক: দারুস সালাম ইসলামী কমপ্লেক্স, পিরুজালী ময়তাপাড়া, গাযীপুর।

[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৮১; মিশকাত, হা/১৪৪।

[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪০১।

[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৯৭।

[৪]. তাফসীরে মা‘আরেফুল কুরআন, পৃ. ৬৪৫।

[৫]. আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা, ১ম খণ্ড (দিল্লি : ১২৮৬ হি.), পৃ. ৬৩।

[৬]. মুকাদ্দামা ছহীহ মুসলিম, মিশকাত, হা/২৭৩।

[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮; আবূ দাঊদ, হা/১৯০৭; মিশকাত, হা/২৫৫৫।

[৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫১৫৬; বায়হাক্বী, হা/১৭৭; মিশকাত, হা/১৭৭। আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে হাসান বলেছেন।

[৯]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৯; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ, হা/৪২; মিশকাত, হা/১৬৫; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৭৩৫। আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।

[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/১০৯; মিশকাত, হা/৫৯৪০।

[১১]. সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২০০৫; দারেমী, হা/২০৪।

[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৫৬।

[১৩]. সুনানে দারেমী, হা/১৫৮, সনদ ছহীহ।

[১৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৬৬।

[১৫]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৯৪৬৪; আলবানী, তারাজু‘আত, হা/৫৯, সনদ হাসান।

[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৯৭৮; মিশকাত, হা/৪০৭০।

[১৭]. ত্বাবারাণী, হা/৪২০৫; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫৪, আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।

[১৮]. ছহীহুল জামে‘, হা/১৬৯৯, আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।

[১৯]. আলবানী, তারাজু‘আত, হা/২৫।

[২০]. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পরিচিতি, পৃ. ৪২-৫৫।

[২১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৩৭; ইবনু মাজাহ, হা/২, শব্দ বিন্যাস তাঁরই; মিশকাত, হা/২৫০৫।

[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৮০; মিশকাত, হা/১৪৩।  

[২৩]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৯; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ, হা/৪২; মিশকাত, হা/১৬৫; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৭৩৫, আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।  

[২৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫২৬।

[২৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৪৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৫৯। 




প্রসঙ্গসমূহ »: সুন্নাত
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৪র্থ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ - ড. মেসবাহুল ইসলাম
আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের স্বরূপ - ড. মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ (শেষ কিস্তি) - ড. মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
বিদ‘আত পরিচিতি (২৯তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সুন্নাহ বিরোধী ও সংশয় উত্থাপনকারীদের চক্রান্তসমূহ ও তার জবাব - হাসিবুর রহমান বুখারী
কুসংস্কার প্রতিরোধে সুন্নাহর ভূমিকা - ড. সাদীক মাহমূদ
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (২য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী

ফেসবুক পেজ