মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৬:৫৪ অপরাহ্ন

আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের স্বরূপ

-মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী*


নবী-রাসূলগণের প্রতি অবতীর্ণ হওয়া সকল আসমানী গ্রন্থের উপর ঈমান আনয়ন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর আবশ্যক। এটি ঈমানের রুকনসমূহের অন্যতম এবং দ্বীনের মূলনীতিসমূহের একটি বড় মূলনীতি। এছাড়া ঈমান বাস্তবায়নের জন্য আসমানী গ্রন্থসমূহের প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান আনয়ন করা অপরিহার্য। সকল আসমানী গ্রন্থের উপর ঈমান আনয়ন করতে হবে কিন্তু অনুসরণীয় একমাত্র গ্রন্থ হল আল-কুরআন। এ ব্যাপারে আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছে ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে। নিম্নে আলোচনা করা হল : 

আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের স্বরূপ

কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের বিভিন্ন দিক রয়েছে। ঈমান বাস্তবায়নের জন্য সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করা ওয়াজিব। সেই দিকগুলো নিম্নরূপ :

১. এ মর্মে সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল-কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اللّٰہُ  لَاۤ اِلٰہَ  اِلَّا ہُوَ ۙ الۡحَیُّ الۡقَیُّوۡمُ -  نَزَّلَ عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ وَ اَنۡزَلَ التَّوۡرٰىۃَ وَ الۡاِنۡجِیۡلَ - مِنۡ قَبۡلُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ اَنۡزَلَ الۡفُرۡقَانَ ۬ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِ اللّٰہِ لَہُمۡ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ؕ وَ اللّٰہُ عَزِیۡزٌ ذُو انۡتِقَامٍ

‘আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা‘বূদ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, স্বয়ং সম্পূর্ণ ও সকল সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণকারী। তিনি হক সহ আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যা পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী এবং তিনি তাওরাত ও ইঞ্জিল অবতীর্ণ করেছিলেন। মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্য ইতিপূর্বে (তিনি আরো কিতাব নাযিল করেছেন) আর ফুরক্বান অবতীর্ণ করেছেন। নিশ্চয় যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি অবিশ্বাস করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি, আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী’ (সূরা আলে ইমরান : ২-৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, الٓرٰ ۟  کِتٰبٌ اُحۡکِمَتۡ اٰیٰتُہٗ ثُمَّ  فُصِّلَتۡ مِنۡ  لَّدُنۡ  حَکِیۡمٍ  خَبِیۡرٍ ‘আলিফ-লাম-রা। এটা (কুরআন) এমন কিতাব যার আয়াতগুলো সুস্পষ্ট হয়েছে, অতঃপর তা বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের পক্ষ হতে’ (সূরা হূদ : ১)। আল্লাহ আরো বলেন, وَ اِنَّکَ لَتُلَقَّی الۡقُرۡاٰنَ مِنۡ لَّدُنۡ حَکِیۡمٍ عَلِیۡمٍ ‘নিশ্চয় আপনাকে আল-কুরআন দেয়া হচ্ছে প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের নিকট হতে’ (সূরা আন-নামল : ৬)।

আল-কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম বা বাণী। এগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তিনি বাস্তবই কথা বলেছেন, তিনি ইচ্ছা করেছেন এবং যে পদ্ধতিতে তিনি চেয়েছেন সেই পদ্ধতিতেই কথা বলেছেন। এ বাণীসমূহের মধ্যে কোনটি ফেরেশতার মাধ্যম ছাড়া পর্দার আড়াল থেকে সরাসরি আল্লাহর নিকট হতে শ্রবণীয়। কোন আয়াত ফেরেশতার মাধ্যমে রাসূল (ﷺ)-এর নিকট পৌঁছেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

مَا کَانَ  لِبَشَرٍ اَنۡ یُّکَلِّمَہُ اللّٰہُ  اِلَّا وَحۡیًا اَوۡ مِنۡ وَّرَآیِٔ حِجَابٍ اَوۡ یُرۡسِلَ رَسُوۡلًا فَیُوۡحِیَ بِاِذۡنِہٖ مَا یَشَآءُ ؕ اِنَّہٗ عَلِیٌّ  حَکِیۡمٌ

‘আল্লাহ কোন মানুষের সাথে কথা বললে ওহীর মাধ্যমে বলেন অথবা পর্দার আড়াল থেকে অথবা কোন দূত পাঠানোর মাধ্যমে; যে দূত আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে তিনি যা চান সে অহী পৌঁছে দেন। নিশ্চয় তিনি মহীয়ান, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আশ-শূরা : ৫১)।

২. আল-কুরআনের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা যে কিতাবগুলোর বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করেছেন সেগুলোর প্রতি বিস্তারিতভাবে ঈমান আনয়ন করা। আর যেগুলোর কথা এজমালিভাবে উল্লেখ করেছেন আমরা সেগুলোর প্রতি এজমালিভাবে ঈমান আনব। ঠিক যেইভাবে আল্লাহ আমাদেরকে ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, وَ قُلۡ اٰمَنۡتُ بِمَاۤ  اَنۡزَلَ اللّٰہُ  مِنۡ  کِتٰبٍ ‘আর (হে নবী!) আপনি বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি’ (সূরা আশ-শূরা : ১৫)। যেমন তাওরাত, ইনজীল, যাবূর, ইবরাহীম ও মূসার ছহীফাসমূহ এবং আল-কুরআন ইত্যাদি।

৩. আল-কুরআনে উল্লেখিত সংবাদগুলোর প্রতি পূর্ণ ঈমান আনা। অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের যে সংবাদগুলোতে পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটেনি সে সংবাদসমূহের প্রতি ঈমান আনা।

৪. এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনকে অন্য আসমানী কিতাবসমূহের উপর ফয়সালাকারী ও সত্যায়নকারীরূপে প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ مُہَیۡمِنًا ‘আর আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যথাযথভাবে, এর পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সত্যায়নকারী ও তদারককারীরূপে’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৪৮)। তিনি আরো বলেন,

اَلَّذِیۡنَ اٰتَیۡنٰہُمُ الۡکِتٰبَ مِنۡ قَبۡلِہٖ ہُمۡ بِہٖ یُؤۡمِنُوۡنَ- وَ  اِذَا یُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ  قَالُوۡۤا اٰمَنَّا بِہٖۤ  اِنَّہُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّنَاۤ  اِنَّا کُنَّا مِنۡ قَبۡلِہٖ مُسۡلِمِیۡنَ

‘ঐসব ব্যক্তি যাদেরকে আমরা এর পূর্বে কিতাব দিয়েছিলাম, তারা এর প্রতিও ঈমান রাখে এবং যখন তাদের নিকট এই কিতাব তিলাওয়াত করা হয় তখন তারা বলে, ‘আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, নিশ্চয় এটা আমাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য। নিশ্চয় আমরা এর পূর্বেও মুসলিম ছিলাম’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৫২-৫৩)।

অতএব উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রতিটি সদস্যের কর্তব্য হচ্ছে- প্রকাশ্যে ও গোপনে এই কুরআনের অনুসরণ করা, কুরআনকে আঁকড়ে ধরা, কুরআনের হক আদায় করা। ঠিক যেভাবে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন, وَ ہٰذَا کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰہُ مُبٰرَکٌ فَاتَّبِعُوۡہُ وَ اتَّقُوۡا لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ ‘এটি এমন একটি গ্রন্থ, যা আমি অবতীর্ণ করেছি, খুব মঙ্গলময়। অতএব এর অনুসরণ কর এবং ভয় কর-যাতে তোমরা করুণাপ্রাপ্ত হও’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫৫)।

৫. আল-কুরআন কেবলই আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের দিকে আহ্বান করে এবং যাবতীয় কল্যাণ, হেদায়াত, আলো নিয়ে এসেছে : এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

مَا کَانَ لِبَشَرٍ اَنۡ یُّؤۡتِیَہُ اللّٰہُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحُکۡمَ وَ النُّبُوَّۃَ ثُمَّ یَقُوۡلَ لِلنَّاسِ کُوۡنُوۡا عِبَادًا لِّیۡ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ

‘এটা কোন মানুষের পক্ষে শোভনীয় নয় যে, আল্লাহ যাকে গ্রন্থ, প্রজ্ঞা ও নবুওয়াত দান করেন, তৎপরে সে মানবম-লীর মধ্যে বলে, তোমরা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে আমার বান্দায় পরিণত হও’ (সূরা আলে ইমরান : ৭৯)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তিনি হক সহ আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যা পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী এবং তিনি তাওরাত ও ইঞ্জিল অবতীর্ণ করেছিলেন। মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্য ইতিপূর্বে (তিনি আরো কিতাব নাযিল করেছেন) আর ফুরক্বান অবতীর্ণ করেছেন। নিশ্চয় যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি অবিশ্বাস করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি, আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী’ (সূরা আলে ইমরান : ৩-৪)।

৬. কুরআনুল কারীমকে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত পর্যন্ত সর্বযুগের সর্বস্থানের সমগ্র জাতির জন্য নাযিল করেছেন। তিনি নিজেই এটাকে সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। কেননা পৃথিবীতে মানব জাতির অস্তিত্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত  কুরআনের দায়-দায়িত্ব শেষ হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا الذِّکۡرَ  وَ  اِنَّا  لَہٗ  لَحٰفِظُوۡنَ ‘নিশ্চয় আমি এ উপদেশ নাযিল করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক’ (সূরা আল-হিজর : ৯)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, لَّا یَاۡتِیۡہِ  الۡبَاطِلُ مِنۡۢ بَیۡنِ یَدَیۡہِ وَ لَا مِنۡ خَلۡفِہٖ ؕ تَنۡزِیۡلٌ مِّنۡ حَکِیۡمٍ حَمِیۡدٍ  ‘সম্মুখ অথবা পশ্চাৎ হতে মিথ্যা এতে প্রবেশ করতে পারে না। এটি প্রজ্ঞাময় প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ’ (সূরা আল-ফুছছিলাত : ৪২)।

৭. কুরআনুল কারীম পূর্ববর্তী সকল আসমানী গ্রন্থের রহিতকারী : কুরআন অবতীর্ণের পর পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব তথা তাওরাত, ইনজীল ও যাবূর সহ প্রভৃতি কিতাবের বিধানবলী রহিত হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, تَبٰرَکَ الَّذِیۡ نَزَّلَ الۡفُرۡقَانَ عَلٰی عَبۡدِہٖ لِیَکُوۡنَ  لِلۡعٰلَمِیۡنَ  نَذِیۡرَا ‘কত মহান তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ‘ফুরক্বান’ (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন যাতে তিনি বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারেন’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ১)। অন্যত্র তিনি বলেন,

یٰۤاَہۡلَ الۡکِتٰبِ قَدۡ جَآءَکُمۡ  رَسُوۡلُنَا یُبَیِّنُ لَکُمۡ کَثِیۡرًا مِّمَّا کُنۡتُمۡ تُخۡفُوۡنَ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ یَعۡفُوۡا عَنۡ کَثِیۡرٍ ۬ؕ قَدۡ جَآءَکُمۡ  مِّنَ اللّٰہِ  نُوۡرٌ وَّ کِتٰبٌ مُّبِیۡنٌ- یَّہۡدِیۡ بِہِ اللّٰہُ مَنِ اتَّبَعَ رِضۡوَانَہٗ سُبُلَ السَّلٰمِ  وَ یُخۡرِجُہُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ بِاِذۡنِہٖ وَ یَہۡدِیۡہِمۡ  اِلٰی  صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ

‘হে আহলে কিতাবগণ! তোমাদের কাছে আমার রাসূল এসেছেন, তোমরা কিতাবের যেসব বিষয় গোপন কর তন্মধ্য হতে বহু বিষয় তিনি তোমাদের সামনে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেন, আর বহু বিষয় থেকে এড়িয়ে যান। তোমাদের কাছে আল্লাহর নিকট থেকে এক আলোকময় জ্যোতি এবং একটি সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। তা দ্বারা আল্লাহ এরূপ লোকদেরকে শান্তির পন্থাসমূহ বলে দেন যারা তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় এবং তিনি তাদেরকে নিজ তাওফীক ও করুণায় (কুফরীর) অন্ধকার থেকে বের করে (ঈমানের) আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং তাদেরকে সরল-সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত করেন’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ১৫-১৬)। হাদীছে এসেছে,

عَنْ جَابِرٍ ঃ قَالَ أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَتَى رَسُوْلَ اللهِ  ﷺ بِنُسْخَةٍ مِنَ التَّوْرَاةِ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ هَذِهِ نُسْخَةٌ مِنَ التَّوْرَاةِ فَسَكَتَ فَجَعَلَ يقْرَأ وَوَجْهُ رَسُوْلِ اللهِ يَتَغَيَّرُ فَقَالَ أَبُوْ بَكْرٍ ثَكِلَتْكَ الثَّوَاكِلُ مَا تَرَى مَا بِوَجْهِ رَسُوْلِ اللهِ  ﷺ فَنَظَرَ عُمَرُ إِلَى وَجْهِ رَسُوْلِ اللهِ  ﷺ فَقَالَ أَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ غَضَبِ اللهِ وَغَضَبِ رَسُوْلِهِ رَضِيْنَا بِاللهِ رَبًّا وَبِالْإِسْلَامِ دِيْنًا وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ  ﷺ وَالَّذِىْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَوْ بَدَا لَكُمْ مُوْسَى فَاتَّبَعْتُمُوْهُ وَتَرَكْتُمُوْنِىْ لَضَلَلْتُمْ عَنْ سَوَاءِ السَّبِيْلِ وَلَوْ كَانَ حَيًّا وَأَدْرَكَ نُبُوَّتِىْ لَاتَّبَعَنِىْ

জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একদা তাওরাতের একটি কপি নিয়ে এসে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ)! এটি তাওরাতের কপি। একথা শুনে তিনি চুপ থাকলেন। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) পড়তে শুরু করলেন। রাসূল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল। তখন আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ওমরকে বললেন, তোমার ধ্বংস হৌক! তুমি কি রাসূল (ﷺ)-এর চেহারার দিকে দেখছ না? তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূল (ﷺ)-এর মুখের দিকে তাকালেন। অতঃপর বললেন, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ক্রোধ হতে আল্লাহ্র কাছে পরিত্রাণ চাচ্ছি। আমরা আল্লাহকে রব হিসাবে, ইসলামকে দ্বীন হিসাবে এবং মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে নবী হিসাবে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছি। অতঃপর রাসূল (ﷺ) বললেন, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ রয়েছে, তার কসম করে বলছি, যদি আজ মূসা (আলাইহিস সালাম) তোমাদের মাঝে আবির্ভূত হন আর তোমরা তার অনুসরণ কর এবং আমাকে পরিত্যাগ কর, তবুও তোমরা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। আজ মূসা (আলাইহিস সালাম) যদি বেঁচে থাকতেন আর আমার নবুওঅত পেতেন, তবে তিনিও আমার অনুসরণ করতেন।[১]

৮. আল-কুরআনের দাওয়াত বিশ্বব্যাপী, যা মানব ও জিন উভয় জাতির জন্য প্রযোজ্য : আল-কুরআন কোন নির্দিষ্ট গোত্র কিংবা সম্প্রদায়ের জন্য নয়, বরং তা সর্বজনীন এবং বিশ্বব্যাপী। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমনের পর থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানুষ ও জিন জাতির জন্য কুরআন চূড়ান্ত দিকনির্দেশক হিসাবে বিবেচিত। এর প্রতি ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اُوۡحِیَ   اِلَیَّ  ہٰذَا الۡقُرۡاٰنُ لِاُنۡذِرَکُمۡ بِہٖ وَ مَنۡۢ بَلَغَ

‘আর এ কুরআন আমার নিকট অহীর মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে, যেন আমি তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট এটা পৌঁছবে তাদের সকলকে এর দ্বারা সতর্ক ও সাবধান করি’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

اِنَّا سَمِعۡنَا قُرۡاٰنًا عَجَبًا - یَّہۡدِیۡۤ  اِلَی الرُّشۡدِ فَاٰمَنَّا بِہٖ

‘আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি। যা সঠিক পথ-নির্দেশ করে; সে কারণে আমরা এতে ঈমান আনয়ন করেছি’ (সূরা আল-জিন : ১-২)।

৯. আল-কুরআনে বর্ণিত শরী‘আত উদার ও সহজ : পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের শরী‘আত ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلَّذِیۡنَ یَتَّبِعُوۡنَ الرَّسُوۡلَ النَّبِیَّ الۡاُمِّیَّ الَّذِیۡ یَجِدُوۡنَہٗ مَکۡتُوۡبًا عِنۡدَہُمۡ فِی التَّوۡرٰىۃِ وَ الۡاِنۡجِیۡلِ ۫ یَاۡمُرُہُمۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡہٰہُمۡ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ یُحِلُّ لَہُمُ الطَّیِّبٰتِ وَ یُحَرِّمُ عَلَیۡہِمُ الۡخَبٰٓئِثَ وَ یَضَعُ عَنۡہُمۡ اِصۡرَہُمۡ وَ الۡاَغۡلٰلَ الَّتِیۡ کَانَتۡ عَلَیۡہِمۡ ؕ فَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِہٖ  وَ عَزَّرُوۡہُ وَ نَصَرُوۡہُ  وَ اتَّبَعُوا النُّوۡرَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ مَعَہٗۤ ۙ اُولٰٓئِکَ  ہُمُ  الۡمُفۡلِحُوۡنَ

‘(এই কল্যাণ তাদেরই প্রাপ্য) যারা সেই নিরক্ষর রাসূল নবী (ﷺ)-এর অনুসরণ করে চলে, যার কথা তাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত ও ইনজীল কিতাবে লিখিত পায় (সেই নিরক্ষর নবী (ﷺ) মানুষকে সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অন্যায় কাজ করতে নিষেধ করে, আর তিনি তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ বৈধ করে দেন এবং অপবিত্র ও খারাপ বস্তুকে তাদের প্রতি অবৈধ করেন, আর তাদের উপর চাপানো বোঝা ও বন্ধন হতে তাদেরকে মুক্ত করেন। সুতরাং তাঁর প্রতি যারা ঈমান রখে, তাকে সম্মান করে ও সাহায্য সহানুভূতি করে, আর সেই আলোকে (কুরআনকে) অনুসরণ করে চলে যা তার সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে, তারাই (ইহকাল ও পরকাল) সাফল্য লাভ করবে’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৫৭)।

১০. মানব সমাজের সমস্ত বিবাদ-বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কুরআনকে ফায়ছালাকারী বানানো আবশ্যক এবং সকল মতভেদের ক্ষেত্রে কুরআনের দিকে ফিরে আসা আবশ্যক : আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাব ব্যতীত অন্যের নিকট বিচার-ফায়ছালা নিয়ে যাওয়াকে ত্বাগূতের নিকট বিচার-ফায়ছালা চাওয়া বলে উল্লেখ করেছেন।  আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلَمۡ تَرَ  اِلَی الَّذِیۡنَ یَزۡعُمُوۡنَ اَنَّہُمۡ اٰمَنُوۡا بِمَاۤ  اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ  اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یَّتَحَاکَمُوۡۤا اِلَی الطَّاغُوۡتِ وَ قَدۡ اُمِرُوۡۤا اَنۡ یَّکۡفُرُوۡا بِہٖ

‘আপনি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করেননি, যারা ধারণা করে যে, আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছিল তৎপ্রতি তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা নিজেদের বিচার শয়তানের নিকট নিয়ে যেতে চায়, যদিও তাদেরকে আদেশ করা হয়েছিল, তা অবিশ্বাস করতে’ (সূরা আন-নিসা : ৬০)। উল্লেখ্য, যারা সকল আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনয়নের দাবি করে, অথচ কুরআন ও সুন্নাহর বিচার-ফায়ছালা বাদ দিয়ে কতিপয় ত্বাগূতের বিচার-ফায়ছালা মেনে নেয়, আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিন্দা করেছেন (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫৬)।

যে জাতি আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ কিতাব বাদ দিয়ে অন্য কিছু দিয়ে বিচার-ফায়ছালা করবে, তাদের পরস্পরের মধ্যেই যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে যাবে। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অবস্থা পরিবর্তন হওয়া, তাদের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হওয়া এবং তাদের মধ্যে মারামারি শুরু হওয়ার এটিই সবচেয়ে বড় কারণ। কেননা আল-কুরআনের প্রতি ঈমানের দাবিই হল- এর বিচার-ফায়ছালা মেনে নেয়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের দাবি করে, অথচ সে কুরআন বাদ দিয়ে অন্য কিছুর নিকট বিচার-ফায়ছালা নিয়ে যায়, সে তার ঈমানের সাথে কুফরী করে এবং সে মিথ্যাবাদী। মূলত আল্লাহর কিতাব অবিভাজ্য। জীবনে সকল ক্ষেত্রেই আল-কুরআনের সব হুকুম বাস্তবায়ন করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক। আক্বীদা, আমল ও জাগতিক লেনদেন, ব্যক্তিগত কাজ-কর্ম, অপরাধ ও দ-বিধি, শিষ্টাচার এবং আচার-আচরণের ক্ষেত্রেও আল-কুরআনের দাবি বাস্তবায়ন করা এবং তার হুকুম মেনে নেয়া আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা কাফের’। তিনি আরো বলেন, وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা যালেম’। অন্যত্র বলেছেন, وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ  الۡفٰسِقُوۡنَ ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা ফাসেক’ (সূরা আল-মায়েদাহ :৪৪, ৪৫, ৪৭)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی  یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ  بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ  لَا  یَجِدُوۡا فِیۡۤ  اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا  مِّمَّا قَضَیۡتَ  وَ یُسَلِّمُوۡا  تَسۡلِیۡمًا

‘অতএব আপনার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ন্যায়বিচারক মনে করবে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্টচিত্তে কবুল করে নিবে’ (সূরা আন-নিসা : ৬৫)।

সুধী পাঠক! এখানে কসমের মাধ্যমে জোর দিয়ে ঐসব লোক থেকে ঈমান নাকোচ করা হয়েছে যে, যারা ঝগড়া-বিবাদ নিষ্পত্তির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ফায়ছালাকারী হিসাবে মেনে নেয় না। সেই সঙ্গে বক্ষ প্রশস্ত করে এবং নত হয়ে আল্লাহর হুকুম কবুল করে নেয়া আবশ্যক। অনুরূপ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অবতীর্ণ কিতাব দ্বারা ফায়ছালা করে না, তিনি তাকে কাফের, যালেম ও ফাসেক বলেছেন। যদিও সে নিজেকে মুমিন ও ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী বলে দাবি করে। অতএব ধ্বংস হোক ঐসব লোক, যারা ত্বাগূতের তৈরি আইন-কানুন দ্বারা আল্লাহর কিতাব পরিবর্তন করেছে, অথচ তারা ঈমানের দাবি করে। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সৎকাজের তাওফীক পাওয়া যায় না এবং সুমহান আল্লাহর শক্তি ছাড়া অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকার কোনো শক্তি নেই।

১১. কুরআনের সকল বিধানের উপর পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ঈমান আনয়ন করা এবং যথাযথভাবে অনুসরণ করা আবশ্যক। তবে আল-কুরআনের কিছু অংশ অনুসরণ করা আর কিছু অংশকে অস্বীকার করা বা পরিত্যাগ করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَفَتُؤۡمِنُوۡنَ بِبَعۡضِ الۡکِتٰبِ وَ تَکۡفُرُوۡنَ بِبَعۡضٍ ۚ فَمَا جَزَآءُ  مَنۡ یَّفۡعَلُ ذٰلِکَ مِنۡکُمۡ اِلَّا خِزۡیٌ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ یُرَدُّوۡنَ اِلٰۤی اَشَدِّ الۡعَذَابِ ؕ وَ مَا اللّٰہُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ

‘তোমরা কি কিতাবের এক অংশের উপর ঈমান আনছ এবং অন্য অংশের সাথে কুফুরী করছ? অতএব তোমাদের যারাই এমনটি করে তাদের প্রতিফল দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ভোগ ছাড়া আর কী হতে পারে? ক্বিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে। তোমাদের কর্মকা- সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর নন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৮৫)।

আল-কুরআনের এক অংশের প্রতি ঈমান আনয়ন করা অথবা আসমানী কিতাবসমূহের কোনটির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং আল-কুরআনের কোন অংশ অথবা কোন আসমানী কিতাবকে অস্বীকার করা সমস্ত আসমানী কিতাবকে অস্বীকার করার মতই কুফুরী। কেননা সমস্ত আসমানী কিতাব এবং সকল নবী-রসূলের উপর ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। সেই সঙ্গে ঈমানের বিষয়গুলোর প্রতি একসাথে এমনভাবে বিশ্বাস করা আবশ্যক, যাতে কোন পার্থক্য ও বিভক্তিকরণ এবং মতভেদ পরিলক্ষিত না হয়। যারা কিতাবের ব্যাপারে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে এবং মতভেদ করেছে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দোষারোপ করেছেন। যেমন তিনি বলেন,

ذٰلِکَ بِاَنَّ اللّٰہَ نَزَّلَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ ؕ وَ اِنَّ الَّذِیۡنَ اخۡتَلَفُوۡا فِی الۡکِتٰبِ لَفِیۡ شِقَاقٍۭ بَعِیۡدٍ

‘আল্লাহ তো যথার্থ সত্য অনুযায়ী কিতাব নাযিল করেছেন। কিন্তু যারা কিতাবের ব্যাপারে মতভেদ করেছে, তারা নিজেদের বিরোধের ক্ষেত্রে সত্য থেকে অনেক দূরে চলে গেছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৭৬)।

তাইতো দেখা যায় যে, প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং বাতিল ধারণার বশবর্তী হয়ে বনী আদমের বিরাট অংশ আসমানী কিতাবগুলো কিংবা কতিপয় কিতাব অস্বীকার অথবা একই কিতাবের কিয়দাংশ অস্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে তাদের ধারণা, বিবেক-বুদ্ধি, রায় এবং মস্তিষ্কপ্রসূত কিয়াসই সর্বোচ্চ দলীল। তারা নিজেদেরকে মহাজ্ঞানী এবং দার্শনিক হিসাবে নামকরণ করে থাকে। রাসূল ও তাদের অনুসারীদেরকে নিয়ে তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করে এবং তাদেরকে মূর্খ বলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَلَمَّا جَآءَتۡہُمۡ  رُسُلُہُمۡ  بِالۡبَیِّنٰتِ فَرِحُوۡا بِمَا عِنۡدَہُمۡ مِّنَ الۡعِلۡمِ  وَ  حَاقَ بِہِمۡ مَّا کَانُوۡا بِہٖ یَسۡتَہۡزِءُوۡنَ

‘তাদের নিকট যখন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে তাদের রাসূলগণ এসেছিলেন তখন তারা নিজের কাছে বিদ্যমান জ্ঞানের দম্ভ করত এবং তারা যা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত তাই তাদেরকে বেষ্টন করল’ (সূরা আল-মুমিন : ৮৩)।

সুধী পাঠক! একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে যে, ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে আসমানী কিতাবসমূহের মাঝে কোন পার্থক্য করা যাবে না। তবে পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর প্রতি ঈমান আনতে হবে সংক্ষিপ্তভাবে। অন্তর ও জবানের মাধ্যমে এগুলোর স্বীকৃতি দেয়া আবশ্যক। আর আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনতে হবে বিস্তারিতভাবে। আল-কুরআনের প্রতি অন্তর ও জবান দিয়ে স্বীকৃতি প্রদান করা আবশ্যক, সেটাতে যা আছে তার অনুসরণ করা যরূরী এবং ছোট-বড় সব বিষয়েই আল-কুরআনের অনুশাসন মেনে চলা ফরয। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا ادۡخُلُوۡا فِی السِّلۡمِ  کَآفَّۃً  ۪ وَ لَا تَتَّبِعُوۡا خُطُوٰتِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّہٗ لَکُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২০৮)।

১২. এই বিশ্বাস করাও আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের মধ্যে শামিল যে, সেটা কালামুল্লাহ। তথা আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিল হওয়া আল্লাহর কথা। সেটা সৃষ্ট নয়; বরং তাঁর ছিফাত। সালাফগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, أَنَّ الْقُرْاَنَ كَلَامُ اللهِ ‘কুরআন আল্লাহর কথা’।[২] আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, إِذَا تَكَلَّمَ اللهُ بِالْوَحْىِ سَمِعَ أَهْلُ السَّمَوَاتِ شَيْئًا فَإِذَا فُزِّعَ عَنْ قُلُوْبِهِمْ وَسَكَنَ الصَّوْتُ عَرَفُوْا أَنَّهُ الْحَقُّ وَنَادَوْا مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ قَالُوْا الْحَقَّ ‘আল্লাহ যখন অহীর মাধ্যমে কথা বলেন, তখন আসমানের অধিবাসীরা কিছু শুনতে পায়। আর তাদের অন্তর থেকে যখন ভয় দূর করে দেয়া হয় এবং শব্দ স্তিমিত হয়ে যায়, তখন তারা বুঝতে পারে যে, যা ঘটেছে তা অবশ্যই একটা বাস্তব সত্য। তারা পরস্পরকে জিজ্ঞেস করতে থাকে তোমাদের প্রতিপালক কী বলেছেন? তারা বলে, তিনি সত্য বলেছেন’।[৩]

১৩. এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, কুরআন মানে হাদীছও। আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর যেমন কুরআন নাযিল করেছেন, তেমনি হাদীছও নাযিল করেছেন। অন্যদিকে হাদীছ ব্যতীত কুরআন বুঝা অসম্ভব। কেননা হাদীছ হল কুরআনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাকারী। যে দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নিয়েছেন। তিনি বলেন, ثُمَّ  اِنَّ عَلَیۡنَا بَیَانَہٗ ‘অতঃপর কুরআনের ব্যাখ্যা বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের উপর’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ১৯)। কুরআনের ব্যাখ্যা আল্লাহ রাসূল ফ কে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, وَ اَنۡزَلۡنَاۤ  اِلَیۡکَ الذِّکۡرَ  لِتُبَیِّنَ  لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ  اِلَیۡہِمۡ وَ لَعَلَّہُمۡ  یَتَفَکَّرُوۡنَ ‘আর আমরা আপনার প্রকি যিকর নাযিল করেছি। যাতে করে আপনি তা মানুষদেরকে তাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেন। এবং যাতে করে তারা চিন্তা করে’ (সূরা আন-নাহল : ৪৪)। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তো বলেছেন, أَلَا إِنِّىْ أُوتِيْتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ ‘সাবধান! নিশ্চয় আমাকে কুরআন এবং কুরআনের ন্যায় আরেকটা বস্তু দেয়া হয়েছে’।[৪]

আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের ফলাফল

১. বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার অত্যধিক গুরুত্বের বিষয়টি অবহিত হওয়া।

২. শরী‘আত বা আইন আরোপের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার হেকমত সম্পর্ক জানা। তাইতো তিনি প্রত্যেক কওমের পরিবেশ-পরিস্থিতির উপযোগী শরী‘আত প্রদান করেছেন (সূরা আল-মায়েদাহ : ৪৮)।

৩. আল্লাহ তা‘আলার এই মহান নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করা।

৪. আল-কুরআন তেলাওয়াত, গবেষণা, কুরআনের অর্থ বুঝা ও সে অনুযায়ী আমল করার মাধ্যমে কুরআনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা।

পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুসলিমকে আল-কুরআনের প্রতি ঈমানকে সচ্ছ করা ও সে অনুযায়ী বাস্তব জীবন ঢেলে সাজানোর তাওফীক দান করুন।

* প্রিন্সিপ্যাল, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. দারেমী হা/৪৪৩; সনদ হাসান, মিশকাত হা/১৯৪, পৃঃ ৩২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৮৪, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৩৫।  
[২]. আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০৬।
[৩]. ছহীহ বুখারী, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়-৯৭, অনুচ্ছেদ-৩২; আবূ দাঊদ, হা/৪৭৩৮।
[৪]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৪, সনদ ছহীহ।




প্রসঙ্গসমূহ »: কুরআনুল কারীম
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ (শেষ কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
বিদ‘আত পরিচিতি (১৪তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সমকামীতার ভয়াবহতা ও তার অপকার - হাসিবুর রহমান বুখারী
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রেম ও ভালোবাসা - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য (২য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
আল্লাহ তা‘আলাকে কি স্বপ্নযোগে দেখা সম্ভব? - হাসিবুর রহমান বুখারী
সচ্চরিত্রই মানব উন্নতির চাবিকাঠি - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

ফেসবুক পেজ