মহামারী থেকে বেঁচে থাকার দশটি উপদেশ
-মূল : শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল মুহসিন আল-বদর
-অনুবাদ : আজহারুল ইসলাম*
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি নিরুপায় ব্যক্তির ডাকে সাড়া দেন, যখন সে ডাকে। যিনি দুঃখে কাতর ব্যক্তিকে সাহায্য করেন, যখন সে তাঁকে আহ্বান করে। যিনি বিপদাপদ দূর করেন এবং কষ্ট লাঘব করেন। যার যিকির ছাড়া হৃদয়সমূহ প্রাণবন্ত হয়না এবং যার অনুমতি ছাড়া কোন প্রত্যাদেশও সংঘটিত হয় না। যার রহমত ছাড়া বিপদাপদ থেকে মুক্তি মেলে না। যার রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া কোন জিনিসই সংরক্ষিত থাকে না। যার সহজকরণ ছাড়া প্রত্যাশিত জিনিসের নাগাল পাওয়া যায় না। যার আনুগত্য ছাড়া কোন কল্যাণই অর্জন করা যায় না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন মা‘বুদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি জগতসমূহের প্রতিপালক, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলেরই মা‘বূদ। আকাশ ও যমীনের পরিচালক। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বান্দা ও রাসূল। যিনি সুস্পষ্ট কিতাব ও সরল সঠিক পথ নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন।
অতঃপর এগুলো কিছু উপকারী উপদেশমালা। এ যুগের মহামারী করোনা ভাইরাসকে নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তাসমূহের সাথে সঙ্গতি রেখেই আমি তা উল্লেখ করব।
আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের ও বিশ্বের মুসলিমদের থেকে সকল বালা-মুছীবত উঠিয়ে নেন। আমাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেন। আমাদেরকেও যেন সেভাবে রক্ষা করেন যেভাবে তিনি তার সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে রক্ষা করে থাকেন। তিনি এক্ষেত্রে অভিভাবক এবং তিনিই এর উপর ক্ষমতাবান।
উপদেশ-১ : বালা-মুছীবতের সময় কী বলতে হবে?
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَنْ قَالَ بِسْمِ اللهِ الَّذِيْ لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَىْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ لَمْ تُصِبْهُ فَجْأَةُ بَلَاءٍ حَتَّى يُصْبِحَ وَمَنْ قَالَهَا حِيْنَ يُصْبِحُ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ لَمْ تُصِبْهُ فَجْأَةُ بَلَاءٍ حَتَّى يُمْسِيَ قَالَ فَأَصَابَ أَبَانَ بْنَ عُثْمَانَ الْفَالِجُ فَجَعَلَ الرَّجُلُ الَّذِيْ سَمِعَ مِنْهُ الْحَدِيْثَ يَنْظُرُ إِلَيْهِ فَقَالَ لَهُ مَا لَكَ تَنْظُرُ إِلَىَّ فَوَاللهِ مَا كَذَبْتُ عَلَى عُثْمَانَ وَلَا كَذَبَ عُثْمَانُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَكِنَّ الْيَوْمَ الَّذِيْ أَصَابَنِيْ فِيْهِ مَا أَصَابَنِيْ غَضِبْتُ فَنَسِيتُ أَنْ أَقُولَهَا
‘যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তিনবার বলবে, بِسْمِ اللهِ الَّذِيْ لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَىْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘আল্লাহর নামে যাঁর নামের বরকতে আসমান ও যমীনের কোন বস্তুই ক্ষতি করতে পারে না, তিনি সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী’, তাহলে সকাল হওয়া পর্যন্ত তার প্রতি কোন হঠাৎ বিপদ আসবে না। আর যে তা সকালে তিনবার বলবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার উপর কোন হঠাৎ বিপদ আসবে না। আবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে যে লোকটি তার থেকে হাদীছ শুনছিল, তার দিকে তাকাচ্ছিল। তখন আবান তাকে বললেন, তোমার কী হয়েছে! তুমি আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছ কেন? বিশ্বাস কর, আল্লাহর কসম! আমি ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রতি মিথ্যা আরোপ করিনি আর ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-ও নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেননি। তবে যেদিন আমি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছি সেদিন আমি রাগের বশে তা বলতে ভুলে গিয়েছি’।[১]
উপদেশ-২ : অধিকহারে لَاۤ اِلٰہَ اِلَّاۤ اَنۡتَ سُبۡحٰنَکَ اِنِّیۡ کُنۡتُ مِنَ الظّٰلِمِین ‘আপনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, আপনি মহান! নিশ্চয় আমি যালেমদের দলভুক্ত’ মর্মে এই দু‘আটি পাঠ করা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ ذَاالنُّوۡنِ اِذۡ ذَّہَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ اَنۡ لَّنۡ نَّقۡدِرَ عَلَیۡہِ فَنَادٰی فِی الظُّلُمٰتِ اَنۡ لَّاۤ اِلٰہَ اِلَّاۤ اَنۡتَ سُبۡحٰنَکَۖ اِنِّیۡ کُنۡتُ مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ – فَاسۡتَجَبۡنَا لَہٗۙ وَ نَجَّیۡنٰہُ مِنَ الۡغَمِّ وَ کَذٰلِکَ نُــۨۡجِی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
আর ‘যুন-নূনের (ইউনুসের) কথা স্মরণ করুন, যখন তিনি (স্বীয় সম্প্রদায়ের ওপর) ক্রদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন আর মনে করেছিলেন, আমি তার ত্রুটি ধরব না (অথবা আমি তাকে বিপদে ফেলব না)। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মাঝে (আমাকে) ডাক দিয়ে বলেছিলেন, আপনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, আপনি মহান! নিশ্চয় আমি যালেমদের দলভুক্ত। অতঃপর আমরা তার ডাকে সাড়া দিলাম এবং তাকে কষ্ট থেকে রক্ষা করলাম। মুমিনদেরকে আমরা এভাবেই রক্ষা করি’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৮৭)।
ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার বাণী , وَ کَذٰلِکَ نُــۨۡجِی الۡمُؤۡمِنِیۡن ‘মুমিনদেরকে আমরা এভাবেই রক্ষা করি’-এর অর্থ হচ্ছে, ‘যখন তারা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থাকে এবং আমার দিকে প্রত্যাবর্তন করাবস্থায় আমাকে ডাকে। বিশেষ করে বালা মুছীবতের সময় যখন তারা এই দু‘আ দিয়ে ডাকে’। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিম্নোক্ত হাদীছটি উল্লেখ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
دَعْوَةُ ذِي النُّوْنِ إِذْ دَعَا وَهُوَ فِيْ بَطْنِ الْحُوْتِ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّيْ كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ . فَإِنَّهُ لَمْ يَدْعُ بِهَا رَجُلٌ مُسْلِمٌ فِيْ شَيْءٍ قَطُّ إِلَّا اسْتَجَابَ اللهُ لَهُ
‘আল্লাহ তা‘আলার নবী যুন-নূন [ইউনুস (আলাইহিস সালাম)] মাছের পেটে থাকাকালে যে দু‘আ করেছিলেন, তা হল- আপনি ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই, আপনি অতি পবিত্র। আমি নিশ্চয় যালিমদের দলভুক্ত’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৮৭)। যে কোন মুসলিম লোক কোন বিষয়ে কখনো এ দু‘আ করলে অবশ্যই আল্লাহ্ তা‘আলা তার দু‘আ কবুল করেন’।[২]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, তাওহীদের মত অন্য কোনো জিনিস দুনিয়ার বিপদ-আপদগুলো দূর করতে পারে না। এজন্যই বিপদ আপদের দু‘আ তাওহীদের বাক্য দিয়েই করতে হয়। তাই যুন-নূন তথা ইউনুস (আলাইহিস সালাম) -এর দু‘আটি কোন দুঃখ-কষ্টে পতিত ব্যক্তি করলে আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদের দ্বারাই সে ব্যক্তির দুঃখ-কষ্টকে দূর করে দেন। আর শিরক ব্যতীত অন্য কোন জিনিস মহা বালা-মুছীবতে ফেলতে পারে না এবং তাওহীদ ছাড়া অন্য কিছু তা থেকে মুক্তি দিতে পারে না। তাওহীদই তো সৃষ্টি জীবের আশ্রয়স্থল, তার দূর্গ এবং রক্ষাকবচ’।[৩]
উপদেশ-৩ : বালা-মুছীবতের কষ্ট থেকে আশ্রয় চাওয়া।
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত,
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَتَعَوَّذُ مِنْ جَهْدِ الْبَلَاءِِ وَدَرَكِ الشَّقَاءِ وْسُوْءِ الْقَضَاء وَشَمَاتَةِ الْأَعْدَاءِ
‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, ‘বালা-মুছীবতের কষ্ট থেকে, দুঃখ পাওয়া থেকে, অদৃষ্টের অনিষ্ট থেকে এবং শত্রুদের আনন্দ থেকে’।[৪] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
تعوذوْا بالله مِنْ جَهْدِ الْبَلَاءِِ وَْ دَرَكِ الشَّقَاءِ وْسُوْءِ الْقَضَاء وَشَمَاتَةِ الْأَعْدَاءِ
‘তোমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর বালা-মুছীবতের কষ্ট থেকে, দুঃখ পাওয়া থেকে, অদৃষ্টের অনিষ্ট থেকে এবং শত্রুদের বিদ্বেষ থেকে’।[৫]
উপদেশ-৪ : বাড়ী থেকে প্রস্থানের দু‘আর প্রতি যত্নবান হওয়া।
আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
إِذَا خَرَجَ الرَّجُلُ مِنْ بَيْتِهِ فَقَالَ بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ قَالَ يُقَالُ حِيْنَئِذٍ هُدِيْتَ وَكُفِيْتَ وَوُقِيْتَ فَتَتَنَحَّى لَهُ الشَّيَاطِيْنُ فَيَقُوْلُ لَهُ شَيْطَانٌ آخَرُ كَيْفَ لَكَ بِرَجُلٍ قَدْ هُدِيَ وَكُفِيَ وَوُقِيَ
‘যখন কোন ব্যক্তি তার ঘর হতে বের হওয়ার সময় বলবে, ‘বিসমিল্লা-হি তাওয়াক্কালতু ‘আলাল্লাহ, ওয়া লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’, তখন তাকে বলা হয়, তুমি হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছ, রক্ষা পেয়েছ ও নিরাপত্তা লাভ করেছ। সুতরাং শয়তানরা তার থেকে দূর হয়ে যায় এবং অন্য এক শয়তান বলে, তুমি ঐ ব্যক্তিকে কী করতে পারবে? যাকে, পথ দেখানো হয়েছে, নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে এবং রক্ষা করা হয়েছে’।[৬]
উপদেশ-৫ : সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর কাছে সুস্থতা কামনা করা।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকাল-সন্ধ্যায় দু‘আ পাঠকে কখনো পরিত্যাগ করতেন না। হাদীছে এসেছে,
اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِيْ دِيْنِيْ وَدُنْيَايَ وَأَهْلِي وَمَالِي اللَّهُمَّ استُرْ عَوْرَاتِيْ وآمِنْ رَوْعَاتي اللَّهمَّ احْفَظْنِيْ مِنْ بَينِ يَدَيَّ ومِنْ خَلْفي وَعن يَميْنِيْ وعن شِمَالِيْ ومِنْ فَوْقِيْ وأعُوْذُ بِعَظَمَتِكَ أنْ أُغْتَالَ مِنْ تَحتِ
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট চাই দুনিয়া ও আখেরাতে নিরাপত্তা; হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট চাই আমার দ্বীন, দুনিয়া, পরিজন ও মাল-সম্পদের নিরাপত্তা; হে আল্লাহ! আপনি আমার দোষসমূহ ঢেকে রাখুন এবং ভীতিপ্রদ বিষয়সমূহ হতে আমাকে নিরাপদে রাখুন; হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হেফাযত করুন আমার সম্মুখ হতে, আমার পিছন দিক হতে, আমার ডান দিকে হতে, আমার বাম দিক হতে এবং আমার উপর দিক হতে। আল্লাহ! আমি আপনার মর্যাদার নিকট পানাহ চাই মাটিতে ধসে যাওয়া হতে’।[৭]
উপদেশ-৬ : বেশী বেশী দু‘আ করা।
ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, إِنَّ الدُّعَاءَ يَنْفَعُ مِمَّا نَزَلَ وَمِمَّا لَمْ يَنْزِلْ فَعَلَيْكُمْ عِبَادَ اللهِ بِالدُّعَاءِ ‘যে বিপদ-আপদ এসেছে আর যা (এখনও) আসেনি তাতে দু‘আয় কল্যাণ হয়। অতএব হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা দু‘আকে আবশ্যিক করে নাও’।[৮] তবে দু‘আ করার প্রাকটিসটি বালা-মুছীবত ও ভাল সময়ে সর্বদা চালু রাখতে হবে। হাদীছে এসেছে, مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَسْتَجِيبَ اللهُ لَهُ عِنْدَ الشَّدَائِدِ وَالْكُرَبِ فَلْيُكْثِرِ الدُّعَاءَ فِى الرَّخَاءِ ‘যে ব্যক্তি বিপদ ও কষ্টের সময় দু‘আ কবুল হওয়ার দ্বারা আনন্দিত হতে চায়, সে যেন সচ্ছলতার সময় অধিক পরিমাণ দু‘আ করে’।[৯]
উপদেশ-৭ : মহামারীর স্থানসমূহ এড়িয়ে চলা।
আব্দুল্লাহ ইবনু আমির (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত,
أَنَّ عُمَرَ خَرَجَ إِلَى الشَّأْمِ فَلَمَّا كَانَ بِسَرْغَ بَلَغَه أَنَّ الْوَبَاءَ قَدْ وَقَعَ بِالشَّأْمِ فَأَخْبَرَ عَبْدُ الرَّحْمٰنِ بْنُ عَوْفٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِذَا سَمِعْتُمْ بِه بِأَرْضٍ فَلَا تَقْدَمُوْا عَلَيْهِ وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلَا تَخْرُجُوْا فِرَارًا مِنْهُ.
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সিরিয়া যাওয়ার জন্য বের হলেন। এরপর তিনি ‘সারগ’ নামক স্থানে পৌঁছলে তাঁর কাছে খবর এল যে সিরিয়া এলাকায় মহামারী দেখা দিয়েছে। তখন আব্দুর রহমান ইবনু ‘আওফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে জানালেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন তোমরা কোন স্থানে এর বিস্তারের কথা শোন, তখন সে এলাকায় প্রবেশ করো না; আর যখন এর বিস্তার ঘটে, আর তোমরা সেখানে অবস্থান কর, তাহলে তা থেকে পালিয়ে যাওয়ার নিয়তে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না’।[১০] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, لَا تُوْرِدُوا الْمُمْرِضَ عَلَى الْمُصِحِّ ‘রোগাক্রান্ত উট নীরোগ উটের সাথে মিশ্রিত করবে না’।[১১]
উপদেশ-৮ : ভালো আমল করা।
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
صَنَائِعُ الْـمَعْرُوْفِ تَقِي مَصَارِعَ السُّوْءِ وَالْآفَاتِ وَالْـهَلَكَاتِ وَأَهْلُ الْـمَعْرُوْفِ فِي الدُّنْيَا هُمْ أَهْلُ الْـمَعْرُوْفِ فِي الْآخِرَةِ
‘ভাল কাজ খারাপ মৃত্যু, বিপদ-আপদ ও ধ্বংস থেকে রক্ষা করে। আর দুনিয়াতে ভাল কাজকারীরাই আখেরাতে কল্যাণময়ী থাকবে’।[১২]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রোগের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা হচ্ছে, ভাল ও পরোপকার করা, আল্লাহর যিকির করা, দু‘আ করা, কাকুতি মিনতি করা, আল্লাহর কাছে অনুনয়-বিনয় করা, তাওবা করা। রোগ বালা দূরকরণ এবং আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ঔষধের চেয়েও এর ব্যাপকতা অনেক বেশি। কিন্তু তা হয়ে থাকে ব্যক্তির প্রস্তুতি, গ্রহণীয়তা এবং উপকারে ক্ষেত্রে তার বিশ্বাস অনুযায়ী’।[১৩]
উপদেশ-৯ : তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করা।
আবু উমামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللَّيْلِ فَإِنَّهُ دَأْبُ الصَّالِحِينَ قَبْلَكُمْ وَهُوَ قُرْبَةٌ إِلَى رَبِّكُمْ وَمَكْفَرَةٌ لِلسَّيِّئَاتِ وَمَنْهَاةٌ لِلإِثْمِ
‘তোমরা অবশ্যই রাতের ইবাদাত করবে। কেননা তা তোমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের নিত্য আচরণ ও প্রথা। রাতের ইবাদত আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্য অর্জনের উপায়, পাপকর্মের প্রতিবন্ধক, গুনাহসমূহের কাফফারা’।[১৪] তবে তাহজ্জুদ ছালাত وَمَطْرَدَةٌ لِلدَّاءِ عَنِ الْجَسَدِ ‘দেহের রোগ দূরকারী’ অংশটুকু যঈফ।[১৫]
উপদেশ-১০ : পানী ও খাবারের পাত্র ঢেকে রাখা।
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
غَطُّوا الإِنَاءَ وَأَوْكُوا السِّقَاءَ فَإِنَّ فِي السَّنَةِ لَيْلَةً يَنْزِلُ فِيْهَا وَبَاءٌ لَا يَمُرُّ بِإِنَاءٍ لَيْسَ عَلَيْهِ غِطَاءٌ أَوْ سِقَاءٍ لَيْسَ عَلَيْهِ وِكَاءٌ إِلَّا نَزَلَ فِيْهِ مِنْ ذَلِكَ الْوَبَاءِ.
‘তোমরা বাসনগুলো আবৃত রাখবে এবং মশকসমূহের মুখ বেঁধে রাখবে। কারণ বছরে একটি এমন রাত আছে, যে রাতে মহামারী অবতীর্ণ হয়। যে কোন খোলা পাত্র এবং বন্ধকহীন মশ্কের উপর দিয়ে তা অতিবাহিত হয়, তাতেই সে মহামারী নেমে আসে’।[১৬] ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, وَهَذَا مِمّا لَا تَنَالُهُ عُلُومُ الْأَطِبَّاءِ وَمَعَارِفُهُمْ ‘এটা এমন একটা বিষয়, যা ডাক্তারী বিদ্যাও অর্জন করতে পারে না’।[১৭]
সর্বোপরি প্রতিটি মুসলিমের উপর কর্তব্য হল- সে তার বিষয়াদিকে আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ ও দয়া লাভের প্রত্যাশায় তার দিকেই সোপর্দ করবে। মূলত সকল বিষয়াদি তো তাঁর হাতেই এবং তার ঐচ্ছিক পরিচালনায়। ধৈর্য ও ছওয়াবের প্রত্যাশা করার পাশাপাশি যে সকল বিষয় দ্বারা বিপদাপদ দূর হয় সেই মাধ্যমগুলো গ্রহণের প্রচেষ্টা করবে। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রী আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্লেগ রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তখন আল্লাহর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে জানান যে,
كَانَ عَذَابًا يَبْعَثُهُ اللهُ عَلٰى مَنْ يَشَاءُ فَجَعَلَهُ اللهُ رَحْمَةً لِلْمُؤْمِنِيْنَ فَلَيْسَ مِنْ عَبْدٍ يَقَعُ الطَّاعُوْنُ فَيَمْكُثُ فِيْ بَلَدِهِ صَابِرًا يَعْلَمُ أَنَّه لَنْ يُصِيْبَهُ إِلَّا مَا كَتَبَ اللهُ لَهُ إِلَّا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ الشَّهِيْدِ.
‘এটি হচ্ছে এক রকমের আযাব। আল্লাহ যার উপর তা পাঠাতে ইচ্ছে করেন, পাঠান। কিন্তু আল্লাহ এটিকে মুমিনদের জন্য রহমত বানিয়ে দিয়েছেন। অতএব প্লেগ রোগে কোন বান্দা যদি ধৈর্য ধরে, এ বিশ্বাস নিয়ে আপন শহরে অবস্থান করতে থাকে যে, আল্লাহ তার জন্য যা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন তা ছাড়া আর কোন বিপদ তার উপর আসবে না; তাহলে সেই বান্দার জন্য থাকবে শহীদের ছওয়াবের সমান ছওয়াব’।[১৮]
পরিশেষে আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সেইসব সৎ আমল ও উত্তম কথা বলার তাওফীক দান করেন, যা তিনি ভালবাসেন এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। নিশ্চয় তিনি সত্য বলেন এবং সঠিক পথের দিশা দেন।
والحمد لله وحده وصلي الله على نبينا محمد وآله و صحبه وسلم
* অধ্যয়নরত, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা মুনাওয়ারাহ, সঊদী আরব।
তথ্যসূত্র:-
[১]. আবূ দাঊদ, হা/৫০৮৮; মিশকাত, হা/২৩৯১, সনদ ছহীহ।
[২]. তিরমিযী, হা/৩৫০৫; মিশকাত, হা/২২৯২, সনদ ছহীহ।
[৩]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, আল-ফাওয়াইদ ( বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ ১৩৯৩ হি./১৯৭৩ খ্রি.), পৃ. ৫৩।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩৪৭।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬১৬; মিশকাত, হা/২৪৫৭।
[৬]. আবূ দাঊদ, হা/৫০৯৫; মিশকাত, হা/২৪৪৩, সনদ ছহীহ।
[৭]. আবূ দাঊদ, হা/৫১৭৬; মিশকাত, হা/২৩৯৭, সনদ ছহীহ।
[৮]. তিরমিযী, হা/৩৫৪৮; মিশকাত, হা/২২৩৪, সনদ ছহীহ।
[৯]. তিরমিযী হা/৩৩১৮২; হাকেম হা/১৯৯৭; মুসনাদে আবী ইয়ালা হা/৬৩৯৬-৯৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৯৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৬২৯০, সনদ হাসান।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৩০; ছহীহ মুসলিম, হা/২২১৮; মিশকাত, হা/১৫৪৮।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৭৪।
[১২]. বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৭৭০৪; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/৩৭৯৫।
[১৩]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খাইরিল ইবাদ (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ২৭তম সংস্করণ ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪৪।
[১৪]. তিরমিযী, হা/৩৫৪৯; সনদ হাসান।
[১৫]. যঈফ তিরমিযী, হা/৩৫৪৯; যঈফুল জামে‘, হা/৩৭৮৯।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০১৪; মিশকাত, হা/৪২৯৮।
[১৭]. যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খাইরিল ইবাদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২৩২।
[১৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৩৪।