সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৩:৩২ পূর্বাহ্ন

বিদ‘আত পরিচিতি

-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


(১১তম কিস্তি)

মূলনীতি-৯ : শরী‘আত প্রণেতা ইবাদতের ক্ষেত্রে যেগুলো ছেড়ে দিয়েছেন, সেগুলোর ব্যাপারে সময়, স্থান, গুণ ও সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ না করা

ইবাদত কবুলের মৌলিক দু’টি শর্ত রয়েছে। প্রথমতঃ ইবাদত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হতে হবে।[১] দ্বিতীয়তঃ একমাত্র রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর পদ্ধতি মোতাবেক হতে হবে।[২] এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

الَّذِیۡ  خَلَقَ الۡمَوۡتَ وَ الۡحَیٰوۃَ لِیَبۡلُوَکُمۡ  اَیُّکُمۡ  اَحۡسَنُ عَمَلًا

‘তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে সর্বোত্তম’ (সূরা আল-মুলক : ২)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেন,

(اَیُّکُمۡ  اَحۡسَنُ عَمَلًا) وَلَمْ يَقُلْ أَكْثَرُ عَمَلًا بَلْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَلَا يَكُوْنُ الْعَمَلُ حَسَنًا حَتَّى يَكُوْنَ خَالِصًا لِلهِ عَزَّ وَجَلًّ عَلَى شَرِيْعَةِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ فَمَتَى فَقَدْ الْعَمَلُ وَاحِدًا مِنْ هَذَيْنِ الشَّرْطَيْنِ بَطَلَ وَحَبِطَ

‘(তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম আমলকরী কে?) তথা এখানে বলা হয়নি ‘সর্বাধিক আমলকারী’, বরং ‘সর্বোত্তম আমল’ বলা হয়েছে। আর আমল ততক্ষণ পর্যন্ত সর্বোত্তম হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা আল্লাহর জন্য খালেছ বা একনিষ্ঠ না হবে এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শরী‘আত মোতাবেক না হবে। অতঃপর কোন আমলের মধ্যে যদি উক্ত শর্তদ্বয়ের কোন একটি শর্ত না থাকে, তাহলে সে আমল বাতিল ও নষ্ট হিসাবে গণ্য হবে’।[৩]

সুধী পাঠক! উক্ত শর্ত দু’টির কোন একটি ছাড়া পড়লে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে না। প্রথম শর্তে চুল পরিমাণ ব্যতিক্রম হলে ঐ ইবাদত শিরকে পরিণত হবে। অনুরূপ দ্বিতীয় শর্তে কোন রকম ব্যতিক্রম হলে বিদ‘আতে পরিণত হবে। উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় শর্ত বা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণে ইবাদত করার সময় কয়েকটি বিষয় অবশ্যই লক্ষ্যণীয়- (এক) ঐ ইবাদত রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন্ স্থানে করেছেন (দুই) কোন্ সময়ে করেছেন (তিন) কোন্ পদ্ধতিতে করেছেন (চার) কী পরিমাণ করেছেন (পাঁচ) কোন্ কারণে করেছেন। এগুলোর প্রত্যেকটিই থাকতে হবে অন্যথা শর্ত পূরণ হবে না।

উপরিউক্ত আলোচনায় ইবাদত কবুলের শর্তগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিদ‘আতের মূলনীতি হল- শরী‘আত প্রণেতা ইবাদতের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো ছেড়ে দিয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে সময়, স্থান, গুণ কিংবা সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ করা যাবে না। যদি সীমাবদ্ধ করা হয়, তাহলে তা বিদ‘আত হিসাবে পরিগণিত হবে। যেমন, নির্দিষ্ট করে জুমু‘আর রাত্রিতে ক্বিয়াম করা এবং নির্দিষ্ট করে জুমু‘আর দিনে ছিয়াম রাখা। কেননা শরী‘আতে নির্দিষ্ট করে জুমু‘আর রাত্রিতে ক্বিয়াম করা ও দিনে ছিয়াম রাখা নিষেধ করা হয়েছে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لَا تَخْتَصُّوْا لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ بِقِيَامٍ مِّنْ بَيْنِ اللَّيَالِيْ وَلَا تَخْتَصُّوْا يَوْمَ الْجُمُعَةِ بِصِيَامٍ مِّنْ بَيْنِ الْأَيَّامِ إِلَّا أَنْ يَّكُوْنَ فِيْ صَوْمٍ يَصُوْمُهُ أَحَدُكُمْ

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, রাত্রিসমূহের মধ্যে শুধু জুমু‘আর রাত্রিকে ছালাত আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট করো না এবং দিনসমূহের মধ্যে কেবল জুমু‘আর দিনকেই ছিয়ামের জন্য নির্দিষ্ট করো না, যদি তা তোমাদের কারও ছিয়াম রাখার তারিখে না পড়ে।[৪]

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, জুওয়াইরিয়া বিনতে হারিছ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ دَخَلَ عَلَيْهَا يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَهْىَ صَائِمَةٌ فَقَالَ أَصُمْتِ أَمْسِ قَالَتْ لَا قَالَ تُرِيْدِيْنَ أَنْ تَصُوْمِىْ غَدًا قَالَتْ لَا قَالَ فَأَفْطِرِىْ

‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর দিনে তাঁর নিকট প্রবেশ করেন তখন তিনি ছিয়াম পালনরত ছিলেন। আল্লাহ‌র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি গতকাল ছিয়াম পালন করেছিলে? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আগামীকাল ছিয়াম পালনের ইচ্ছা রাখো? তিনি বললেন, না। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাহলে ছিয়াম ভেঙ্গে ফেল’।[৫]

সুধী পাঠক! উক্ত হাদীছদ্বয় থেকে প্রমাণিত হয় যে, শুধু জুমু‘আর দিনে ও রাতে নির্দিষ্ট করে ছিয়াম ও ক্বিয়াম করা যাবে না। সুতরাং আরবী রজব মাসের প্রথম জুমু‘আতে ‘ছালাতুল রাগাইব’ নামে প্রচলিত যে ছালাত রয়েছে তা বিদ‘আত হিসাবে পরিগণিত হবে।[৬] শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইমাম মালেক, শাফেঈ, আবূ হানীফা, ছাওরী, আওযাঈ, লাইছ (রাহিমাহুমুল্লাহ)সহ সকল আলেমের ঐকমত্যে ছালাতুর রাগায়েব বিদ‘আত। আর হাদীছ বিশারদগণের মতে এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীছ মিথ্যা।[৭]

অনুরূপভাবে ‘নিছফে শা‘বান’ তথা আরবী শা‘বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত্রিতে নির্দিষ্ট কোন ইবাদত করা ও পরের দিন ছিয়াম রাখা উক্ত মূলনীতর আলোকে বিদ‘আত। যা বিদ‘আত নামে পরিচিত। কেননা ‘নিছফে শা‘বান’-এ নির্দিষ্ট করে কোন ইবাদতের কথা শরী‘আত প্রণেতা বিধিবদ্ধ করেননি। বরং এ মর্মে যা বর্ণিত হয়েছে তার সবই কোনটা যঈফ ও জাল বর্ণনা।[৮] এমনিভাবে ১২ই রবীউল আউয়াল রাসূলূল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্ম দিবস হিসাবে যে ‘মীলাদুন্নবী’ উদযাপিত হয়ে থাকে, সেটাও ভিত্তিহীন বিদ‘আতী আমল। কেননা তা শরী‘আত কর্তৃক নির্দেশিত বা অনুমোদিত কোন বিধান নয়। সুতরাং ‘মীলাদুন্নবী’ পালন করাও ভ্রষ্ট বিদ‘আত হিসাবে গণ্য হবে।

অতএব সমাজে প্রচলিত কোন আমলের ক্ষেত্রে শরী‘আত কর্তৃক কোন স্থান, সময়, গুণ ও সংখ্যা দ্বারা সীমায়িত কোন নির্দেশনা না থাকলে এবং মানুষ কর্তৃক স্থান, সময়, গুণ, সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ হলে সেই আমল বিদ‘আতী আমল হিসাবে গণ্য হবে।

শরী‘আত প্রণেতা ইবাদতের ক্ষেত্রে যেগুলো ছেড়ে দিয়েছেন, সেগুলোর ব্যাপারে সময়, স্থান, গুণ ও সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ না করা প্রসঙ্গে আবূ শামা আল-মাক্বদিসী (৫৯৯-৬৬৫ হি./১২০৩-১২৬৭ খ্রি.) চমৎকার বলেছেন,

وَلَا يَنْبَغِيْ تَخْصِيْصَ الْعِبَادَاتِ بِأَوْقَاتٍ لَمْ يُخَصِّصْهَا بِهَا الشَّرْعُ بَلْ تَكُوْنُ جَمِيْعُ أَفْعَالِ الْبِرِّ مُرْسَلَةٌ فِيْ جَمِيْعِ الْأَزْمَانِ لَيْسَ لِبَعْضِهَا عَلَى بَعْضٍ فَضْلٌ إٍلَّا مَا فَضَّلَهُ الشَّرْعُ وَخَصَّهُ بِنَوْعِ الْعِبَادَةِ فَإِنْ كَانَ ذَلِكَ اخْتَصَّ بِتِلْكَ الْفَضِيْلَةِ تِلْكَ الْعِبَادَةِ دُوْنَ غَيْرِهَا كَصَوْمِ يَوْمِ عَرَفَةَ وَعَاشُوْرَاءَ وَالصَّلَاةِ فِيْ جَوْفِ اللَّيْلِ وَالْعُمْرَةِ فِيْ رَمَضَانَ وَمِنْ الْأَزْمَانِ مَا جَعَلَهُ الشَّرْعُ فَضْلًا فِيْهِ جَمِيْعِ أَعْمَالِ الْبِرِّ كَعَشْرَةِ ذِي الْحِجَّةِ وَلَيْلَةِ الْقَدْرِ الَّتِيْ هِيَ خَيْرُ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ. وَالْحَاصِلُ أَنَّ الْمُكَلَّفُ لَيْسَ لَهُ مَنْصَبُ التَّخْصِيْصِ بَلْ ذَلِكَ إِلَى الشَّارِعِ وَهِذِهِ كَانَتْ صِفَةُ عِبَادَةِ رَسْوُلِ اللهِ ﷺ

‘কোন ইবাদতকে কোন সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করা উচিত নয়, যে ইবাদতকে শরী‘আত কোন সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করেনি। বরং সকল কল্যাণকর কাজসমূহ সর্বদা আমলযোগ্য। তবে শরী‘আত বিশেষ করে ইবাদতের প্রকারসমূহের মধ্যে যাকে প্রাধান্য দিয়েছে তা ব্যতীত অন্য কোন কাজ একটি অপরটির উপর মর্যাদাশীল নয় এবং যদি ঐ ইবাদত অন্য কিছু ব্যতীত ঐ ফযীলতের সাথে নির্দিষ্ট হয়। যেমন, ‘আরাফার দিনের ছিয়াম, ‘আশূরার ছিয়াম, মধ্যরাত্রির ছালাত, রামাযানে ওমরাহ করা। আর সময়ের সাথে সম্পর্কিত কল্যাণকর কাজগুলো হল, শরী‘আত তাতে যা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ কাজ হিসাবে গণ্য করেছে। যেমন, যিলহজ্জের ১০ দিন, লাইলাতুল ক্বদর যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। মোদ্দা কথা এই যে, মুকাল্লাফ বা প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির জন্য শরী‘আতে বিশেষ করে কোন কিছু নির্দিষ্ট নেই, বরং যা রয়েছে শরী‘আত প্রণেতার নিকটেই রয়েছে। আর এটিই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইবাদতের একটি অন্যতম গুণ’।[৯]

আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠতম মুহাক্কিক্ব ও মুহাদ্দিছ ইমাম মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) (১৩৩২-১৪২০ হি./১৯১৪-১৯৯৯ খ্রি.) তাঁর ‘আহকামুল জানাইয’ গ্রন্থে ‘বিদ‘আতের প্রকারসমূহে’র আলোচনায় উল্লেখ করেছেন যে,

كُلُّ عِبَادَةٍ أَطْلَقَهَا الشَّارِعُ وَقَيَّدَهَا النَّاسُ بِبَعْض الْقُيُوْدِ مِثْلَ الْمَكَانِ أَوِ الزَّماَنِ أَوْ صِفَةٍ أَوْ عَدَدٍ

‘(বিদ‘আত যে ভ্রষ্ট তার কারণ হল) শরী‘আত প্রণেতা ইবাদতের ক্ষেত্রে যেগুলো ছেড়ে দিয়েছেন (অর্থাৎ শরী‘আত প্রণেতা যেগুলো অনুমোদন করেননি)। অথচ মানুষেরা এক্ষেত্রে স্থান, সময়, গুণ ও সংখ্যা ইত্যাদির দ্বারা সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে’।[১০] ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৯১-৭৫১ হি./১২৯২-১৩৫০ খি.) বলেন,

وَمَعْلُوْمٌ أَنَّهُ لَا حَرَامَ إِلَّا مَا حَرَّمَهُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَلَا تَأْثِيْمَ إِلَّا مَا أَثَّمَ اللهُ وَرَسُوْلُهًُ بِهِ فَاعِلَهُ كَمَا أَّنَّهُ لَا وَاجِبٌ إِلَّا مَا أَوْجَبَهُ اللهُ وَلَا حَرَامَ إِلَّا مَا حَرَّمَهُ اللهُ وَلَا دِيْنًا إِلَّا مَا شَرَعَهُ اللهُ. فَالْأَصْلُ فِي الْعِبَادَاتِ الْبُطْلَانُ حَتَّى يَقُوْمَ دَلِيْلٌ عَلَى الْأَمْرِ وَالْأَصْلُ فِي الْعُقُوْدِ وَالْمُعَامَلَاِت الصِّحَّةِ حَتَّى يَقُوْمَ دَلِيْلٌ عَلَى الْبُطْلَانِ وَالتَّحْرِيْمِ. وَالْفَرَقُ بَيْنَهُمَا أَنَّ اللهَ سُبْحَانَهُ لَا يُعْبَدُ إِلَّا بِمَا شَرَعَهُ عَلَى أَلْسِنَةِ رُسْلِهِ فَإِنَّ الْعِبَادَةَ حَقَّهُ عَلَى عِبَادِهِ

‘সুবিদিত বিষয় হল- আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা হারাম করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু হারাম নয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা পাপ বলে ঘোষণা করেছেন তা ব্যতীত কোন কাজ পাপ নয়। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা যা ওয়াজিব করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু ওয়াজিব নয়। আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু হারাম নয়। আল্লাহ তা‘আলা যা শরী‘আত হিসাবে বিধিবদ্ধ করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দ্বীন নয়। ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হল- যতক্ষণ তার দলীল পাওয়া না যায়, ততক্ষণ তা বাতিল। আর চুক্তি ও লেনদেনের বিষয়ে মূলনীতি হল- তা বৈধ, যতক্ষণ না তার বাতিল ও হারাম বিষয়ে কোন দলীল পাওয়া যায়। আর এদের মাঝে পার্থক্য হল- আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাধ্যম যে পদ্ধতি দিয়েছেন সেই পদ্ধতিতে তার ইবাদত করা। কেননা বান্দার প্রতি আল্লাহর অধিকার হল তার ইবাদত করা’।[১১]

মূলনীতি-১০ : যে সকল ইবাদতের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও পদ্ধতি প্রমাণিত, তা পূর্ণাঙ্গরূপে পালন না করে আংশিক পালন করলে তা বিদ‘আত হিসাবে গণ্য হবে

শরী‘আতে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং শরী‘আতে বর্ণিত ইবাদতের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও পদ্ধতি অনুযায়ী ইবাদত সম্পাদন করা আবশ্যক। আর যদি বৈশিষ্ট্য ও পদ্ধতি পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ না করে আংশিক পালন করা হয়, তাহলে তা দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যা শরী‘আত হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন তা এর বিপরীত হিসাবে বিবেচনা করা হয়।[১২] এ প্রসঙ্গে আবূ শামা আল-মাক্বদিসী (৫৯৯-৬৬৫ হি./১২০৩-১২৬৭ খ্রি.) বলেন,

لم ترد الشريعة بالتقرب إلى الله تعالى بسجدة منفردة ولا سبب لها، فإن القرب لها أسباب وشرائط وأوقات وأركان لا تصح بدونها فكلما لا يقترب إلى الله تعالى بالوقوف بعرفة، ومزدلفة، ورمي الجمار، والسعي بين الصفا والمروة من غير نسك واقع في وقته بأسبابه وشرائطه، فكذلك لا يقترب إلى الله تعالى بسجدة منفردة، وإن كانت قربة إذا لم يكن لها سبب صحيح

‘শরী‘আত বর্ণনা করেনি যে, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য শুধু একটি সেজদা দিলেই যথেষ্ট। আর এর কোন কারণও নেই। কেননা নৈকট্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন হল তার কারণসমূহ, শর্তসমূহ, সময়সমূহ ও রুকনসমূহ। এগুলো ছাড়া (নৈকট্য অর্জনের পদ্ধতি) বিশুদ্ধ হবে না। সুতরাং মুযদালিফা ও ‘আরাফার ময়দানে অবস্থান, কংকর নিক্ষেপ এবং ছাফা-মারওয়ায় সাঈ এগুলো সময়মত শর্ত ও কারণ ঠিক থাকলেও এগুলোর দ্বারা নৈকট্য অর্জন হবে না। কেননা এখানে কুরবানী নেই। অনুরূপভাবে কোন বিশুদ্ধ কারণ ছাড়া শুধু পৃথক একটা সেজদার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সম্ভব নয়। যদিও সেজদা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়’।[১৩]

সাধারণত অন্য কারো নৈকট্যের আশায় কৃত ইবাদতের মধ্যে আল্লাহর কোন নৈকট্য নেই। যেমন, একদা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক ব্যক্তিকে রোদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তাঁকে বলা হল- এই ব্যক্তিটি মানত করেছে যে, সে দাঁড়িয়ে থাকবে বসবে না, ছায়াও গ্রহণ করবে না এবং সে ছিয়াম রেখেছে। তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বসতে, ছায়া গ্রহণ করতে বললেন এবং ছিয়াম পরিপূর্ণ করতে বললেন।[১৪] কিন্তু সে তা না করে নৈকট্য লাভের আশায় তার মানত পূরণ করে। অর্থাৎ সে রোদ্রে দাঁড়িয়ে থাকাকে ইবাদত মনে করেই তা পালন করেছিল। অথচ শরী‘আতে বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ইবাদত হিসাবে গণ্য হয়। যেমন ছালাত, আযান, ‘আরাফায় দু‘আ করার সময় দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদি। সুতরাং যে কোন স্থানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন হয় না। বরং ইসলামী শরী‘আত নির্দেশিত স্থানের অনুসরণ করতে হবে।[১৫]

অতএব ইসলামী শরী‘আতে ইবাদতের যে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও পদ্ধতি রয়েছে তা পূর্ণাঙ্গরূপে পালন করতে হবে। কিছু কবর আর কিছু ছেড়ে দিব এরূপ করা যাবে না। বরং তা বিদ‘আত হিসাবে গণ্য হবে। ফলে শয়তান তাকে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বে। এছাড়া শরী‘আতের কিছু অংশ গ্রহণ করা আর কিছু অংশ ছেড়ে দেয়ার ভয়াবহতা অত্যন্ত মারাত্মক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَفَتُؤۡمِنُوۡنَ بِبَعۡضِ الۡکِتٰبِ وَ تَکۡفُرُوۡنَ بِبَعۡضٍ ۚ فَمَا جَزَآءُ  مَنۡ یَّفۡعَلُ ذٰلِکَ مِنۡکُمۡ اِلَّا خِزۡیٌ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ یُرَدُّوۡنَ اِلٰۤی اَشَدِّ الۡعَذَابِ ؕ وَ مَا اللّٰہُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ

‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু বিশ্বাস কর ও কিছু অবিশ্বাস কর? অতএব তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের পার্থিব জীবনে দুর্গতি ব্যতীত কিছুই নেই এবং ক্বিয়ামত দিবসে তারা কঠোর শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে এবং তোমরা যা করছো আল্লাহ তদ্বিষয়ে অমনোযোগী নন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৮৫)। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণ দাখিল হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। যাতে করে শয়তান তাকে পথভ্রষ্ট করতে না পারে (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২০৮)।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. সূরা আল-কাহ্ফ : ১১০; সূরা আল-বাইয়েনাহ : ৫; নাসাঈ, হা/৩১৪০; সনদ ছহীহ, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৮।
[২]. বুখারী, মুসলিম হা/৪৪৬৮, ‘মীমাংসা’ অধ্যায় ২/৭৭।
[৩]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৩০৮।
[৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৪৪; মিশকাত, হা/২০৫২।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৮৬; আবূ দাঊদ, হা/২৪২২।
[৬]. ইমাম শিহাবুদ্দী আবূ শামাহ আব্দুর রহমান ইবনু ইসমাঈল ইবনু ইবরাহীম আল-মাক্বদিসী, আল-বা‘ইছু ‘আলা ইনকারিল বিদাঈ ওয়াল হাওয়াদিছ (কায়রো : মাকতাবাতু মাজদিল ইসলাম, ১ম সংস্করণ, তাবি), পৃ. ১৪৫।
[৭]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২৩তম খণ্ড, পৃ. ১৩৪।
[৮]. বিস্তারিত দ্র. : আল-বা‘ইছু ‘আলা ইনকারিল বিদাঈ ওয়াল হাওয়াদিছ, পৃ. ১১৬-১২৮।
[৯]. আল-বা‘ইছু ‘আলা ইনকারিল বিদাঈ ওয়াল হাওয়াদিছ, পৃ. ১৪৯।
[১০]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবীন, আহকামুল জানাইয ওয়া বিদাঊহা (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১ম সংস্করণ, ১৪১২ হি./১৯৯২ খ্রি.), পৃ. ৩০৬।
[১১]. মুহাম্মাদ ইবনু আবী বকর আইয়ূব আয-যারঈ আবূ আব্দিল্লাহ ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, ‘ইলামুল মুওয়াক্কিঈন ‘আন রব্বিল ‘আলামীন (বৈরূত : দারুল জাইল, ১৯৭৩ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৪।
[১২]. যাকারিয়া ইবনু গোলাম কাদির আল-পাকিস্তানী, মিন উছূলিল ফিক্বহ ‘আলা মানহাজিল আহলিল হাদীছ (দারুল খারায, ১ম সংস্করণ, ১৪২৩ হি./২০০২ খ্রি.), পৃ. ২০৬।
[১৩]. আল-বা‘ইছু ‘আলা ইনকারিল বিদাঈ ওয়াল হাওয়াদিছ, পৃ. ১৬৭-১৬৮।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৭০৪; আবূ দাঊদ, হা/৩৩০০; ইবনু মাজাহ, হা/২১৩৬।
[১৫]. আবুল ফরজ আব্দুর রহমান ইবনু আহমাদ ইবনু রজব আল-হাম্বালী, জামিঊল উলূম ওয়াল হিকাম (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফা, ১ম সংস্করণ, ১৪০৮ হি.), পৃ. ৬০।




শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি (৫ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
আল-কুরআনে বর্ণিত জাহেলি সমাজের দশটি চিত্র - তানযীল আহমাদ
গাযওয়াতুল হিন্দ : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ - হাসিবুর রহমান বুখারী
সুন্নাতের রূপরেখা (শেষ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ (২য় কিস্তি) - ড. মেসবাহুল ইসলাম
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী শিষ্টাচার (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
বিদ‘আত পরিচিতি (১৬তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৯ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আল-কুরআন সম্পর্কে অমুসলিম মনীষীদের মূল্যায়ন - রাফিউল ইসলাম
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ