সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৪:২৫ পূর্বাহ্ন

পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব

-মূল : ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ)
-অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান*


(৬ষ্ঠ কিস্তি)

অনুপকারী ইলমের আলামত

অনুপকারী জ্ঞানে জ্ঞানী ব্যক্তি গর্ব, অহংকার এবং বড়ত্ব অর্জন করবে, দুনিয়াতে  উচ্চ মর্যাদা ও গৌরব কামনা করবে, দুনিয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে, আলেমদের সাথে বাহাদুরি, মূর্খদের সাথে ঝগড়া এবং মানুষের দৃষ্টিকে তার দিকে ঘুরাতে চাইবে।

ঝগড়া-বিবাদের উদ্দেশ্যে ইলম অর্জনের হুকুম

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সেই (আলিমদের উপর বাহাদুরি, নির্বোধদের সাথে ঝগড়া এবং জনসভায় নিজের বড়ত্ব প্রকাশ করার) উদ্দেশ্যে ইলম অন্বেষণ করবে তার জন্য রয়েছে পরকালে আগুন আর আগুন’।[১]

এই সকল ইলম অর্জনকারীরা কখনো কখনো দাবি করে যে, তারা আল্লাহকে জানার জন্য, তাঁকে খোঁজার জন্য এবং তাঁকে ব্যতীত সবকিছুকে বর্জন করার জন্যই ইলম অর্জন করছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য এরূপ নয়; বরং তাদের উদ্দেশ্য হল রাজা-বাদশা এবং অন্যান্য মানুষের অন্তরে নিজেদের জন্য জায়গা করে নেয়া, তাদের কাছে নিজেদের ব্যাপারে ভাল ধারণা অর্জন করা এবং নিজেদের অনেক অনুসারী জোগাড় করা। সর্বোপরি এসব কিছুর মাধ্যমে তারা মানুষের নিকট মর্যাদাবান হতে চায়। এর মূল লক্ষণ হল- ক্ষমতার দাবি করা, যেমন দাবি করেছিল আহলে কিতাব, ক্বারামিত্বাহ্[২], বাতিনিয়্যা[৩] এবং তাদের অনুরূপ ব্যক্তিবর্গরা।

এটা সালাফদের মানহাজের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ তারা (সালাফগণ) গোপনে এবং প্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় নিজেদেরকে খুব ছোট এবং তুচ্ছ মনে করতেন। যেমন আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

مَنْ قَالَ إِنَّهُ عَالِمٌ فَهُوَ جَاهِلٌ وَمَنْ قَالَ إِنَّهُ مُؤْمِنٌ فَهُوَ كَافِرٌ وَمَنْ قَالَ هُوَ فِيْ الْجَنَّةِ فَهُوَ فِيْ النَّارِ

‘যে নিজেকে আলেম বলে দাবী করবে সে জাহেল, যে নিজেকে মুমিন বলে দাবী করবে সে কাফের, আর যে বলবে সে জান্নাতী সে জাহান্নামী’।[৪]

আরো কতিপয় লক্ষণ

সত্যকে গ্রহণ না করা এবং সত্যের অনুসরণ না করা, যে সত্য কথা বলে, তার উপর বড়ত্ব প্রকাশ করা; বিশেষ করে যখন তারা মানুষের সামনে থাকে। আর তারা এই ভয়ে বাতিলের উপর অটল থাকে যে, প্রকাশ্যে সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করলে মানুষ তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কখনো কখনো সভা-সমাবেশে তারা নিজেদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে প্রকাশ করে, যাতে করে মানুষ তাদের সম্পর্কে এই বিশ্বাস করে যে, তারা খুবই বিনয়ী। অতঃপর এর মাধ্যমে তারা মানুষের প্রশংসা কুড়াতে চায়। এটাই হল সূক্ষ্ম রিয়া বা লোক দেখানো স্বভাব, যা থেকে তাবেঈ ও তাদের পরবর্তী আলেমগণ সতর্ক করে গেছেন।

প্রশংসাকে সাদরে গ্রহণ এবং প্রশংসার প্রতি তাদের আকর্ষণবোধের বিষয়টাও তাদের থেকে প্রকাশ পায়। যা সত্যবাদিতা ও ইখলাছকে দূর করে দেয়। সত্যবাদী ব্যক্তি নিজের উপর মুনাফিকী এবং মন্দ পরিণতির ভয় করে, প্রশংসাকে  সাদরে গ্রহণ এবং তা উত্তম বিবেচনা করার প্রতি নযর না দিয়ে অন্য ভাল বিষয় নিয়ে সে ব্যস্ত থাকে।

উপকারী জ্ঞানে আলোকিত আলেমদের পরিচয়

তারা নিজেদের জন্য সুউচ্চ কোন অবস্থান কামনা করেন না। বরং মনে প্রাণে প্রশংসা ও স্তুতিকে অপসন্দ করেন। তারা কারো উপর বড়ত্বও প্রকাশ করেন না। হাসান (রাহিমাহুল্লাহ)  বলেন, إِنَّمَا الْفَقِيْهُ اَلزَّاهِدُ فِيْ الدُّنْيَا الرَّاغِفُ فِيْ الْآخِرَةِ الْبَصِيْرُ بِدِيْنِهِ الْمُوَاظِبُ عَلَى عِبَادَةِ رَبِّهِ. ‘নিশ্চয় ফক্বীহ হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে দুনিয়ার প্রতি বিমুখ এবং আখিরাতের প্রতি আগ্রহী; তার দ্বীনের ব্যাপারে দূরদর্শী এবং তার রবের ইবাদতের প্রতি যত্নবান’।[৫] অন্য আরেকটি বর্ণনায় তিনি বলেন, الَّذِيْ لَايَحْسُدُ مَنْ فَوْقَهُ وَلَا يَسْخَرُ مِمَّنْ دُوْنَهُ وَلَايَأْخُذُ عَلَى عِلْمٍ عَلَّمَهُ اللهُ أَجْراً. ‘ফক্বীহ হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে তার চেয়ে উপরের ব্যক্তির প্রতি হিংসা করে না, তার থেকে নীচু শ্রেণীর ব্যক্তিকে পরিহাস করে না এবং আল্লাহ তাকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তার বিনিময় হিসাবে কোন প্রতিদানও গ্রহণ করেন না’।[৬] দ্বিতীয় উক্তিটির অনুরূপ উক্তি ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকেও বর্ণিত হয়েছে।[৭] তাই উপকারী আলেমদের ইলম যত বৃদ্ধি পায়, আল্লাহর জন্য বিনয়াবনতা, ভয় এবং হীনতা ততই বৃদ্ধি পায়।

আলেমদেরকে বিনয়ী হওয়ার উপর সালাফদের উৎসাহ প্রদান

কোন কোন সালাফ বলেন, يَنْبَغِيْ لِلْعَالِمِ أَنْ يَّضَعَ التُّرَابَ عَلَى رَأْسِهِ تَوَاضُعًا لِرَبِّهِ ‘আলেমের উচিত হচ্ছে, সে তার পালনকর্তার প্রতি বিনয়ী হওয়ার জন্য তার মাথায় মাটি বয়ে বেড়াবে’।[৮]

স্বীয় রব সম্পর্কে একজন আলেমের ইলম যতই বৃদ্ধি পাবে, তার সম্পর্কে জানবে, ততই তার প্রতি ভয়, ভালোবাসা এবং বিনয়াবনতা বেড়ে যাবে।

উপকারী জ্ঞানের পরিচয়

উপকারী জ্ঞান তার ধারক-বাহককে দুনিয়া থেকে পশ্চাদপদতার পথ দেখায়। বিশেষত দুনিয়ার নেতৃত্ব, প্রসিদ্ধি এবং প্রশংসা কুড়ানো থেকে। সুতরাং এগুলো থেকে দূরে থাকার প্রচেষ্টা করাই উপকারী জ্ঞানের পরিচয়। আর যদি অনিচ্ছা সত্ত্বেও এমন কিছু ঘটে যায়, তাহলে আলেম সর্বদায় এর পরিণাম সম্পর্কে ভীষণ ভয়ের মধ্যে থাকে, কখন জানি সে পাকড়াওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। যেমন, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নাম যখন প্রসিদ্ধ হয়ে গেল এবং তার সুনাম-সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, তখন তিনি নিজের উপর খুব ভয় পেতেন।

উপকারী জ্ঞানের আরো পরিচয়

উপকারী জ্ঞানের আলোয় আলোকিত ব্যক্তি নিজেকে আলেম বলে দাবী করবে না, ইলম দ্বারা কারো উপর গর্ব করবে না এবং সুন্নাহ ও সুন্নাহ অনুসারীর বিরোধিতাকারী ছাড়া অন্য কাউকে জাহেল বলবে না। এক্ষেত্রে সে একমাত্র আল্লাহর জন্য রাগান্বিত হয়ে কথা বলে, নিজের জন্য রাগান্বিত হয়ে নয় এবং কারো উপর বড় হওয়ার আশায়ও নয়।

অনুপকারী জ্ঞানে জ্ঞানীর বৈশিষ্ট্য

যে ব্যক্তির ইলম অনুপকারী, তার কাজই হল ইলমের মাধ্যমে মানুষের উপর বড়ত্ব প্রকাশ করা, তাদের উপর নিজের জ্ঞানের গল্প বলে বেড়ানো এবং মানুষকে মূর্খতার দিকে সম্পৃক্ত করা, যাতে করে সে তাদের উপর মর্যাদাবান হতে পারে, আর এগুলোই হল সবচেয়ে নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য।

আবার কখনো সে তার পূর্ববর্তী আলেমদেরকে মূর্খতা, অন্যমনস্কতা ও ভুলের দিকে সম্পৃক্ত করে। আর এ কাজগুলোই নিজেকে ভালোবাসা, নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করা, নিজের ব্যাপারে ভাল ধারণা পোষণ করে সালাফদের ব্যাপারে খারপ ধারণা পোষণ করাকে আবশ্যক করে দেয়। তবে উপকারী জ্ঞানের ধারক-বাহকগণ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা নিজেদের ব্যাপারে সব সময় খারাপ ধারণাকরতঃ বিগত আলেমদের ব্যাপারে ভাল ধারণা পোষণ করে। তারা মূলত অন্তরের অন্তস্তল থেকেই সালাফদের মর্যাদা স্বীকার করেন এবং তাদের স্তরে বা তাদের নিকটে পৌঁছতে না পারার অক্ষমতাও অকপটে স্বীকার করেন। ইমাম আবু হানীফা কতইনা উত্তম কথা বলেছেন। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘আলক্বামাহ ও আল-আসওয়াদের মধ্যে কে বেশি উত্তম? উত্তরে তিনি বললেন, وَاللهِ مَا نَحْنُ بِأَهْلٍ أَنْ نَذْكُرَهُمْ فَكَيْفَ نُفَضِّلُ بَيْنَهُمْ. ‘আল্লাহর কসম, আমরা তো তাদের নাম নেয়ারই যোগ্য না, তাহলে কীভাবে আমরা তাদের মর্যাদার মধ্যে পার্থক্য করব?’

আল্লামা ইবনুল মুবারক সালাফদের চরিত্র উল্লেখ করে কবিতা আবৃতি করতেন,

لَا تَعْرِضَنَّ بِذِكْرِنَا مَعَ ذِكْرِهِمْ
لَيْسَ الصَّحِيْحُ إِذَا مَشَى كَالْمَقْعَدِ

‘তাদের সাথে আমাদের করিও না স্মরণ
সঠিক হবে না কভু বসে থাকার ন্যায় হাঁটার ধরন’।

অনুপকারী জ্ঞানের আরো পরিচয়

সে যখন বক্তব্যে বা কথার মধ্যে তার পূর্বের আলেমদের থেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, তখন সে ধারণা করে যে, ইলম ও আল্লাহর নিকট সম্মানের ক্ষেত্রেও সে তাদের থেকে বেশি মর্যাদাবান। তাই সে তখন পূর্ববর্তী আলেমদেরকে হেয়প্রতিপন্ন করতে শুরু করে। কিন্তু মিসকীন জানে না যে, সালাফদের স্বল্প আলোচনা করার কারণ হচ্ছে, তাদের ধার্মিকতা ও আল্লাহর ভয়। তবে তারা যদি দীর্ঘ আলোচনা করতে চাইতেন, তাহলে অবশ্যই তা পারতেন। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) একদল লোককে দ্বীনের ব্যাপারে ঝগড়া করতে শুনে বললেন, ‘তোমরা কি জান না যে, আল্লাহর এমন কিছু বান্দা আছেন, যারা কথা বলতে অক্ষম কিংবা নির্বাক নয়, কেবল আল্লাহর ভয় তাদেরকে নিশ্চুপ করে রেখেছে। অথচ তাদের মধ্যে রয়েছেন আলেম, বাগ্মী, অনর্গলভাষী, শ্রেষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং আল্লাহর নে‘মত ও বিপদাপদ সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তিরা। কিন্তু যখন তারা আল্লাহর মহত্ত্ব নিয়ে চিন্তা করে তখন তাদের বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়, অন্তর ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায়, ভাষাজ্ঞান হারিয়ে ফেলে; এমনকি যখন সম্বিৎ ফিরে পায় তখন তারা পবিত্র আমলের মাধ্যমে দ্রুতবেগে আবার আল্লাহর দিকে অগ্রসর হন। তারা নিজেদেরকে আমলের ক্ষেত্রে শৈথিল্যবাদী মনে করেন, কিন্তু যালেম ও পাপীদের বিবেচনায় তারাই অধিক জ্ঞানী ও শক্তিশালী, তারাই অধিক সত্যবাদী ও পাপমুক্ত। তবে তারা আল্লাহর জন্য কৃত নিজেদের আমলগুলোকে বেশি মনে করতেন না এবং কম আমল করেও তারা সন্তষ্ট থাকতেন না। আর তারা তাদের আমলগুলো দ্বারা আল্লাহর উপর কোন দাবি করতেন না। যেখানেই তুমি তাদের সাথে সাক্ষাৎ করবে, দেখবে তারা আমলের প্রতি খুবই মনোযোগী এবং আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। এই বক্তব্যটি আবূ নু‘আইম এবং অন্যরাও বর্ণনা করেছেন।[৯]

লজ্জা-সম্ভ্রম এবং অল্প কথা বলা ঈমানের অংশ

ইমাম আহমাদ[১০] ও ইমাম তিরমিযী[১১] আবূ উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, الْحَيَاءُ وَالْعِيُّ شُعْبَتَانِ مِنَ الْإِيْمَانِ وَالْبَذَاءُ وَالْبَيَانُ شُعْبَتَانِ مِنَ النِّفَاقِ ‘লজ্জা-সম্ভ্রম এবং স্বল্পবাক ঈমানের দু’টি শাখা। অশ্লীলতা ও বাকপটুতা নিফাক্বের (কপটতা) দু’টি শাখা’। ইমাম তিরমিযী হাদীছটিকে হাসান বলেছেন, হাকেমও হাদীছটি বর্ণনা করে ছহীহ বলেছেন।[১২]

ইবনু হিব্বান তার ‘আছ-ছহীহাহ’ গ্রন্থে আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

الْبَيَانُ مِنَ اللهِ وَالْعِيُّ مِنَ الشَّيْطَانِ وَلَيْسَ الْبَيَانُ كَثْرَةُ الْكَلَامِ وَلَكِنَّ الْبَيَانَ الْفَصْلُ فِيْ الْحَقِّ وَلَيْسَ الْعِيُّ قِلَّةَ الْكَلَامِ وَلَكِنْ مَنْ سَفِهَ الْحَقَّ

‘বাগ্মীতা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর কথা বলার অক্ষমতা শয়তানের পক্ষ থেকে। তবে বেশি বেশি বক্তৃতা দেয়া বাগ্মীতা নয়, বরং বাগ্মীতা হল- সত্য কথা বলা, আর কম কথা বলা অক্ষমতা নয়, কিন্তু অক্ষমতা হল- যে সত্যের ব্যাপারে নির্বোধ হয়’।[১৩]

মুহাম্মদ বিন কা‘ব আল-ক্বোরাযির মারাসীল গ্রন্থে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘তিনটি জিনিসের মাধ্যমে বান্দার দুনিয়ার অংশ কমে যায়, আবার এই তিনটি জিনিসের মাধ্যমে আখিরাতে সে যা পায় তা দুনিয়ার জিনিস থেকে উত্তম। তিনটি জিনিস হল- ১. দয়া-স্নেহ, ২. লজ্জা- সম্ভ্রম ও ৩. অল্প কথা বলা’।[১৪] আউন বিন আব্দুল্লাহ বলেন,

ثَلَاثٌ مِّنَ الْإِيْمَانِ الْحَيَاءُ وَالْعَفَافُ وَالْعِيُّ-عِيُّ اللِّسَانِ لَا عِيُّ الْقَلْبِ وَلَا عِيُّ الْعَمَلِ وَهُنَّ مِمَّا يَزِدْنَ فِيْ الْآخِرَةِ وَيْنقُصْنَ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا يَزِدْنَ فِيْ الْآخِرَةِ أَكْثَرُ مِمَّا يَنْقُصْنَ مِنَ الدُّنْيَا

‘তিনটি বিষয় ঈমানের অংশ। যথা : ১. লজ্জা-সম্ভ্রম, ২. চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ও ৩. যবান দিয়ে অল্প কথা বলা। তবে অন্তর দিয়ে অল্প চিন্তা এবং অল্প আমল করা নয়। এগুলো আখিরাতের অংশকে বৃদ্ধি করে দেয় এবং দুনিয়ার অংশকে কমিয়ে দেয়, আর আখিরাতে যা বৃদ্ধি করে তা দুনিয়ার হ্রাসকৃত অংশের চেয়ে অনেক বেশি’।[১৫] এটি মারফূ‘ হিসাবেও একটি যঈফ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।[১৬]

কোন কোন সালাফ বলেন, কেউ যদি কোন সম্প্রদায়ের নিকট বসে, আর তারা যদি তাকে কথা বলার ক্ষেত্রে অক্ষম মনে করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে কথা বলতে অক্ষম নয়; বরং সে হল ফক্বীহ মুসলিম’।[১৭] যে ব্যক্তি সালাফদের মর্যাদা বুঝে সে এটা জানে যে, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বক্তব্য, অধিক ঝগড়া-বিবাদ এবং অধিক কথা বলা থেকে নিশ্চুপ থাকাটা সালাফদের অক্ষমতা, মূর্খতা এবং তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে ছিল না; বরং তা ছিল তাদের ধার্মিকতা, আল্লাহভীরুতা এবং অনুপকারী বিষয় ছেড়ে উপকারী বিষয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে।

উছূলে দ্বীন ও তার শাখা-প্রশাখাগত বিষয়, কুরআন-হাদীছের তাফসীর, দুনিয়াবিমুখতা, অন্তর নরমকরণের আলোচনা, প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা, বিভিন্ন উপদেশ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে সালাফগণ অল্প আলোকপাত করেছেন। সুতরাং যে তাদের পথে চলবে, সে সঠিক পথের দিশা পাবে। আর যে তাদের পথ ছেড়ে অন্য পথ ধরে অধিক প্রশ্ন, অনুসন্ধান, তর্ক-বিতর্ক এবং অনর্থক কথা-বার্তার মধ্যে ঢুকে পড়বে সে-ই বিপদগামী হবে। তবে সে যদি সালাফদের মর্যাদা স্বীকার করে এবং নিজের জ্ঞানের স্বল্পতা মেনে নেয়, তাহলে তার অবস্থা তাদের নিকটবর্তী হলে হতেও পারে।

ইয়াস বিন মু‘আবিয়া বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের দোষ স্বীকার করে না সে একটা বোকা। তাকে বলা হল, আপনার কি দোষ রয়েছে? তিনি বললেন, অধিক কথা বলা’।[১৮]

যদি সে নিজের মর্যাদা এবং পূর্ববর্তীদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও মূর্খতার দাবি করে, তাহলে সে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতা ও মহা ক্ষতিগ্রস্ততার মধ্যে রয়েছে।

আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই ইলম অর্জনের প্রতি উৎসাহ

মোট কথা হল, ফিতনা ফ্যাসাদের এ যুগে মানুষ হয়তোবা আল্লাহর নিকট আলেম হয়ে সন্তুষ্ট থাকবে কিংবা তা না হয়ে মানুষের নিকট আলেম হয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। যদি সে প্রথমটিতে সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করাই সে যথেষ্ট মনে করবে। আর যার নিজের ও আল্লাহর মধ্যে ভাল পরিচিতি থাকবে, তার জন্য আল্লাহর পরিচিতিই যথেষ্ট হবে। আর যে ব্যক্তি মানুষের নিকট আলেম হিসাবে পরিচিত না হয়ে সন্তুষ্ট হতে পারে না, সে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিম্নোক্ত ভীতিপ্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। যেমন তিনি বলেন,

مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُبَاهِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ يُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوْهَ النَّاسِ إِلَيْهِ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

‘যে ব্যক্তি আলিমদের উপর বাহাদুরী প্রকাশের জন্য, নির্বোধদের সাথে ঝগড়া করার জন্য এবং মানুষের দৃষ্টিকে নিজেদের দিকে ফিরানোর জন্য ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা করে, সে যেন নিজের জায়গা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়’।[১৯] ওহাইব বিন ওয়ারদ বলেন, رُبَّ عَالِمٍ يَقُوْلُ لَهُ النَّاسُ عَالِمٌ وَهُوَ مَعْدُوْدٌ عِنْدَ اللهِ مِنَ الْجَاهِلِيْنَ ‘অনেক এমন আলেম আছে, যাকে মানুষ আলেম বলে থাকে, অথচ সে আল্লাহর নিকট জাহেল হিসাবে পরিচিত’।[২০] ছহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

 أَوَّلُ مَنْ تُسَعَّرُ بِهِمُ النَّارُ ثَلَاثَةٌ : مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ وَ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ : هُوَ قَارِئٌ هُوَ عَالِمٌ، وَيُقَالُ لَهُ : قَدْ قِيْلَ ذَلِكَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِيْ النَّارِ

‘নিশ্চয় জাহান্নামকে প্রজ্জ্বলিত করা হবে তিন প্রকার ব্যক্তিদের দ্বারা, যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে এবং ইলম শিক্ষা করে এজন্য যে, যাতে তাকে ক্বারী ও আলেম বলা হয় এবং তাকে বলা হবে, তোমাকে এগুলো বলা হয়েছে। অতঃপর তাকে চেহারার উপর উপুর করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার আদেশ দেয়া হবে’।[২১] সুতরাং সে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টিতে পরিতৃপ্ত না থাকে, এমনকি মনুষ্য বিচারের স্তরে পৌঁছে যায়, যেখানে বর্তমান যুগের লোকেরা এ রকম না হলে সম্মান করে না এবং তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করে না, তাহলে সে উত্তম জিনিসের পরিবর্তে নিম্নমানের জিনিসকেই বেছে নিল এবং আলেমের স্তর থেকে অন্ধকারের স্তরে চলে গেল।

এ জন্য কিছু কিছু সালাফকে বিচারকের দায়িত্ব দিতে চাওয়া হলে তারা অস্বীকার করে বলতেন,

إِنَّمَا تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ لِأُحْشَرَ بِهِ مَعَ الْأَنْبِيَاءِ لَا مَعَ الْمُلُوْكِ، فَإِنَّ الْعُلَمَاءَ يُحْشَرُوْنَ مَعَ الْأَنْبِيَاءِ، وَالْقُضَاةَ يُحْشَرُوْنَ مَعَ الْمُلُوْكِ

‘আমি ইলম শিখেছি ক্বিয়ামতের দিন নবীদের সাথে একত্রিত হওয়ার জন্য, রাজা-বাদশাহদের সাথে একত্রিত হওয়ার জন্য নয়। নিশ্চয় আলেমদের হাশর হবে নবীদের সাথে আর বিচারকদের হাশর হবে রাজা-বাদশাহদের সাথে’।

তাই একজন মুমিন ব্যক্তি যেন সামান্য সময় ধৈর্যধারণ করে, যাতে সে সুদীর্ঘ প্রশান্তির স্থানে পৌঁছতে পারে। যদি সে ধৈর্যধারণ না করে অস্থির হয়ে যায়, তাহলে তার অবস্থা তেমনি হবে, যেমনটি আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক বলেছেন, مَنْ صَبَرَ فَمَا أَقَلَّ مَا يَصْبِرُ, وَمَنْ جَزَعَ فَمَا أَقَلَّ مَا يَتَمَتَّعُ ‘যে ধৈর্য ধরল সে কতইনা কম সময় ধৈর্যধারণ করল, আর যে ধৈর্যহারা হল সে কতইনা কম উপভোগ করল’।[২২] ইমাম শাফেঈ একটি কবিতা আবৃতি করতেন,

يَا نَفْسُ مَا هِيَ إِلَّا صَبْرُ أَيَّامٍ ** كَأَنَّ مُدَّتَهَا أَضْغَاثُ أَحْلَامِ
يَا نَفْسُ جُوْزِىَ عَنِ الدُّنْيَا مُبَادِرَةً ** وَ خَلِّ عَنْهَا فَإِنَّ الْعَيْشَ قُدَّامِيْ

‘হে আত্মা! এটাত কিছুকাল ধৈর্য ছাড়া আর কিছুই নয়, যেন তার স্থিতিকাল দুঃস্বপ্নের ন্যায়’। ‘হে আত্মা! অচিরেই দুনিয়ার প্রতিদান দেয়া হবে, তাই দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হও, নিশ্চয় প্রকৃত জীবন তো সামনেই’।

হে আল্লাহ! আমরা আপনার নিকট উপকারী ইলম চাচ্ছি এবং আশ্রয় প্রার্থনা করছি অনুপকারী ইলম, নির্ভয় অন্তর, অতৃপ্ত প্রবৃত্তি এবং ঐ দু‘আ থেকে যা কবুল হয় না।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

*অধ্যয়নরত, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা মুনাওয়ারাহ, সঊদী আরব।

তথ্যসূত্র : 
[১]. ইবনু মাজাহ, হা/২৫৪; ইবনু হিব্বান, হা/৭৭; হাকেম, হা/২৯০; জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে নিম্নোক্ত শব্দে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

 لَا تَعَلَّمُوْا الْعِلْمَ لِتَبَاهَوْا بِهِ الْعُلَمَاءَ وَلَا لِتَمَارَوْا بِهِ السُّفَهَاءَ وَلَا تُخَيِّرُوْا بِهِ الْمَجَالِسَ . فَمَنْ فَعَلَ ذَلكَ فَالنَّارُ النَّارُ

‘তোমরা আলিমদের উপর বাহাদুরি প্রকাশের জন্য, নির্বোধদের সাথে ঝগড়া করার জন্য এবং জনসভার উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করার জন্য ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা কর না। যে ব্যক্তি এরূপ করবে তার জন্য রয়েছে আগুন আর আগুন’। সনদে ‘আন‘আনাহ বিন জুরাইজ নামক একজন রাবী আছেন যিনি তাদলীস ও ইরসালকারী হিসাবে পরিচিত। ইবনু হিব্বানও পাশাপাশি শব্দে ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণনা করেন, হা/২৫৩, সনদ যঈফ, হাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান যঈফ রাবী এবং আবু কারব আল-আযদী মাজহূল। তিনি হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকেও বর্ণনা করেন, হা/ ২৫৯, সনদ নিতান্তই দুর্বল, সনদে বিদ্যমান বুশাইর বিন মাইমুন রাবী মাতরূকুল হাদীছ।

তিরমিযী, হা/২৬৫৪, কা‘ব বিন মালেক থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوْهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ

‘যে ব্যক্তি আলিমের সাথে তর্ক-বাহাস করা অথবা জাহিল-মূর্খদের সাথে বাকবিতণ্ডা করার জন্য এবং মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন’। ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীছটি গরীব, হাদীছটিকে আমরা কেবল এই সনদেই জানি, আর ইসহাক বিন ইয়াহইয়া বিন তালহা হাদীছবিশারদদের নিকট শক্তিশালী নয়, তার হিফযের ব্যাপারে মন্তব্য করা হয়, হাদীছটির আরো সনদ আছে তবে কোন সনদই সমালোচনা থেকে মুক্ত নয়। (দ্র. শায়খ আলবানী হাদীছটিকে হাসান বলেছেন, ছহীহুল জামে‘, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৯১।)

[২]. ক্বারামিত্বাহ সম্প্রদায় : এরা হল শী‘আদের সীমালঙ্গনকারী একটি সম্প্রদায়। তাদেরকে ‘ক্বারমাত’ নামে পরিচিত হামদান আল-আশ‘আশের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। আব্বাসীয় খলীফা আল-মু‘তাযিদ আহমাদ বিন মুওয়াফ্ফিক্ব তালহার যুগে ২৭৮ হিজরীতে তাদের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং আহসা, বাহরাইন, ওমান এবং শাম এলাকা দখল করে নেয়। কিন্তু মিসর অধিকার করতে চাইলে তারা ব্যর্থ হয়। ৪৬৬ হিজরী পর্যন্ত তাদের শাসন চলে, ইতিহাসের পরস্পরায় তাদের অনেক অপরাধ ও খেয়ানতের উপমা বিদ্যমান। (দ্র. : গালিব আল ইওয়াজীর, ফিরাক্বুন মু‘আসারাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৯০।)

[৩]. বাত্বিনী সম্প্রদায় : এরাও শী‘আদের সীমালঙ্গনকারী একটি সম্প্রদায়, এই নামে তাদের নামকরণের কারণ হল যে, তাদের দাবি কুরআন এবং হাদীছসমূহের বাহ্যিক দিকের গোপন একটা দিক আছে, যা বাহ্যিকের মধ্যে খোসার নরম অংশের ন্যায় কার্যকরী হয়। তাদের মাযহাব হল সবচেয়ে নিকৃষ্ট মাযহাব। আর তার অনুসারীরা উদ্ধত, নির্দয় এবং সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। তারা বর্তমান ও অতীত সর্বকালেই মুসলিমদের শত্রু। (দ্র. : গালিব আল ইওয়াজী, ফিরাক্বুন মু‘আসারাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৭৩।)

[৪]. হারেছ ইবনু আবু উসামা, আল-মুসনাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬২; আবু বকর আল-খাল্লাল, আস-সুন্নাহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১০৮; ইবনু বাত্তাহ, আল-ইনাবাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৬৮; আল-লালকায়ী, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১০৪৭, সনদ মুনক্বাতে‘। ‘যে নিজেকে মুমিন বলবে সে কাফের’-এর অর্থ হল- ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পরিপূূর্ণ ঈমানদার দাবি করে। তবে মৌলিক ঈমান বিদ্যমান থাকার দাবির ভিত্তিতে মুসলিম নিজেকে মুমিন বলতে পারবে’। ‘যে বলবে সে জান্নাতী সে জাহান্নামী’ সম্ভবত এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল- যে ব্যক্তি দৃঢ়তার সাথে নিজেকে জান্নাতী বলবে সে জাহান্নামী। কেননা এগুলো অদৃশ্যের জ্ঞান, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। আর যে অদৃশ্যের জ্ঞানের দাবি করবে সে কাফের এবং কুফুরীর উপর কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার ঠিকানা জাহান্নাম।
[৫]. দারেমী, আস-সুনান, হা/৩০২; ইবনুল মুবারক, আয-যুহুদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৮৬; ইমাম আহমাদ, আয-যুহুদ, পৃ. ২২৬ এবং অন্যরাও, সনদ ছহীহ।
[৬]. ইবনু বাত্তাহ, ইবতালুল হিয়াল, পৃ. ২১; আবু হাযম সালামাহ বিন দিনারের উক্তি থেকে।
[৭]. দারেমী, আস-সুনান, হা/২৯৮; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, ৭য় খণ্ড, পৃ. ১১৭; আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩০৬, সনদ যঈফ। কেননা তাতে লাইছ বিন আবু সুলাইম আছেন, যিনি দুর্বল রাবী। তিনি মাজহূল রাবীর সূত্রে ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণনা করেছেন।
[৮]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৪০; আদ-দায়নুরী, আল-মাজালিসাহ ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৩৫; ইবনু আব্দিল বার্র, জামি‘ঊ বায়ানিল ইলম ও ফাযলিহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৬৬ এবং অন্যরাও আবূ আইয়ূব আস-সিখতিয়ানী এর উক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন, সনদ সহীহ।
[৯]. ইমাম আহমাদ, আয-যুহুদ, পৃ. ৩৮, সনদে ইদরীস বিন ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ নামক একজন রাবী আছেন, যিনি মাজহূলুল হাল। কেউ কেউ বলেন, ঐ রাবী হলেন ইদরীস বিন সিনান, তিনিও যঈফুল হাদীছ; ইবনুল মুবারক, আয-যুহুদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫২৬; ফা‘কিহী, আখবারু মাক্কাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৬; আল-আজরী, আশ-শারী‘আহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৮৬ এবং আখলাকুল ‘উলামা, পৃ. ৭৪; আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৫; ইবনু আসাকির, তারীখে দামেস্ক, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৭৯, সনদে মূসা বিন আবূ র্দাম অথবা ইবনু আবূ কারদাম আছেন, তিনি মামহূল রাবী।

[১০]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৩১২, হাস্সান বিন ‘আতিয়্যা সূত্রে আবূ উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনায়, তবে আবূ উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে হাস্সানের শ্রবণ নিয়ে মতানৈক্য আছে। আল-মাযী দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, তিনি তার থেকে শুনেননি। তুহফাতুল আশরাফ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৬২-এ তিনি বলেন, হাস্সান বিন ‘আতিয়্যা; আবূ বকর আশ-শামী আবূ উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে শুনেননি’। ইবনু মুফলিহ, আল-আদাবুশ শার‘ইয়্যাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯০-এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ইবনু আসাকিরের আত্বরাফ গ্রন্থে আছে যে, আবূ উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে হাস্সান হাদীছ শুনেননি’। মুসনাদের তাহক্বীক্ববিদগণ বলেন, হাস্সান বিন ‘আতিয়্যা এবং আবূ উমামার মধ্যে ইনক্বীতা‘ হওয়ার কারণে সনদটি যঈফ। কেননা তিনি তার থেকে শুনেননি, যেমনভাবে আল-মাযী এ ব্যাপারে দৃঢ় বক্তব্য পেশ করেছেন, তুহফাতুল আশরাফ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৬২; তাহযীবুল কামাল, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ১৫৯; আল-আলাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ‘জামেঊত তাহছীলে’ বলেন, ‘তিনি (হাস্সান) আবূ উমামা থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি আবূ উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে হাদীছ শুনেননি। আবূ যুর‘আ আল-ইরাক্বী, ‘তুহফাতুত তাহছীলে’ বলেন, ইবনু হিব্বান (রাহিমাহুল্লাহ) না শুনার ব্যাপারটি ‘ত্ববাক্বাতু আতবাঈত তাবিঈনে’ উল্লেখ করেছেন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২২৩। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, তার নিকট কোন ছাহাবী থেকে শ্রবণের বিষয়টি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমানিত নয়। আল্লাহই ভাল জানেন।

[১১]. তিরমিযী, হা/২০২৭; হাস্সান বিন ‘আতিয়্যা সূত্রে আবূ উমামার বর্ণনায় এবং তিনি বলেন, হাদীছটি হাসান গরীব। শায়খ আলবানী ছহীহ বলেছেন, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৬২৯।

[১২]. মুসতাদরাকু আলাছ ছহীহাইন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০; হাস্সান বিন ‘আতিয়্যা সূত্রে আবূ উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনায় এবং তিনি বলেন, বুখারী-মুসলিমের শর্ত সাপেক্ষে ছহীহ, তালখীছ গ্রন্থে ইমাম যাহাবীও তার সাথে একমত পোষণ করেছেন। اَلْعِيُّ অর্থ : স্বল্পবাক,  اَلْبَذَاءُ অর্থ : অশ্লীল ও নির্লজ্জবাক,  اَلْبَيَانُঅর্থ : বাকপটু, বাক্যবাগীশ। যেমন পেশাধারী বক্তারা লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়, কথার বন্যা ছুটিয়ে দেয় এবং বাকপটুতার আশ্রয় নিয়ে মানুষের এমন সব প্রশংসা করতে থাকে, যা আল্লাহ তা‘আলা মোটেই পসন্দ করেন না। তিরমিযী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৭৫।

[১৩]. ইবনু হিব্বান, আছ-ছহীহ, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ১১৩, হা/ ৫৭৯৬, সনদে উক্ববা বিন আস-সাকান নামক রাবী আছেন। ইমাম দারুকুতনী বলেন, ‘তিনি মাতরূকুল হাদীছ, মীযানুল ই‘তিদাল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৮; ইমাম বায়হাক্বী বলেন, সে দুর্বল, হাদীছ জাল করার সাথে সম্পৃক্ত, লিসানুল মীযান, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৬৮।

[১৪]. খাত্তাবী, গারীবুল হাদীছ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৭৯, এটি মুরসাল যঈফ।
[১৫]. মা‘মার বিন রশিদ, আল-জামি‘, ১১তম খণ্ড, পৃ. ১৪২, এটি মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাকের বর্ধিতাংশ, সনদ ছহীহ।

[১৬]. দারেমী (রাহিমাহুল্লাহ) আউন বিন আব্দুল্লাহর সূত্রে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এক ছাহাবী থেকে মারফূ‘ হিসাবে বর্ণনা করেন, হা/৫২৬, হুসাইন সালীম আসাদ সনদকে ছহীহ বলেছেন; ইমাম ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, ১৯তম খণ্ড, পৃ. ২৯; আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২৫; ইমাম বায়হাক্বী, আলÑআদাব, পৃ. ৬১ ও আরো অনেকেই র্ক্বোরাহ আল-মুযানী সূত্রে মারফূ হিসাবে বর্ণনা করেছেন, শায়খ আলবানী ছহীহ বলেছেন, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩৩৮১।

[১৭]. ওয়াকী‘, আয-যুহদ, পৃ. ৫৯৩; যুহাইর বিন হারব, আল-ইলম, পৃ. ১০। হাসান বাছরী এর উক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন, সনদ ছহীহ।

[১৮]. আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২৪; ইমাম বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৯৬; ইবনু আসাকির, তারীখে দামেস্ক, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৩৪, সনদে আবূ হেলাল আর-রাসেবী নামক একজন রাবী আছে, যার ব্যাপারে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, সে মুযতারিবুল হাদীছ। নাসাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সে শক্তিশালী নয়। ইবনু সা‘দ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, তার মাঝে দুর্বলতা আছে, তাহযীবুত তাহযীব, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৯৬; ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, সত্যবাদী তবে একটু দুর্বল, তাক্বরীব, পৃ. ৪৮১।

[১৯]. আবূ নু‘আইম, মা‘রিফাতুছ ছাহাবাহ, ১ম খণ্ড, ২৩৭, সনদ যঈফ। ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, হাদীছটি তার অনেক সনদ এবং শাহেদের কারণে হাসান।

[২০]. আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৮ম খণ্ড, পৃ. ১৫৭-এ আব্দুল ওয়াহাব বিন আল-ওয়ারদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। বলা হয় যে, তিনি ওহাইব বিন ওয়ারদ। আবার বলা হয়, তার ভাই। ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেন, আব্দুল ওয়াহহাব বিন আল-ওয়ারদ তিনিই বুহাইব বিন ওয়ারদ, তিনি ছিক্বাহ রাবী, ইকমালু তাহযীবুল কামাল, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৩৮১। আছারটি ওবাইদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন ইয়াযীদ বিন খুনাইস তার পিতা থেকে এককভাবে বর্ণনা করেন। এই ওবায়দুল্লাহ রাবীটি মাক্ববূল, তার পিতাকে আবূ হাতেম ও ইবনু হিব্বান ছিক্বাহ বলেছেন, আল-জারহু ওয়াদ-তা‘দীল, ৮ম খণ্ড, পৃ. ১২৭; আছ-ছিক্বাত, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৬১। মোটকথা এই সনদে কোন সমস্যা নেই।
[২১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৯০৫
[২২]. ইবনু আবুদ্দুনইয়া, আছ-ছাবরু ওয়াছ ছাওয়াব, পৃ. ১০১।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ জীবন কথা
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের স্বরূপ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (৮ম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
সুন্নাতের রূপরেখা - মাইনুল ইসলাম মঈন
আশূরায়ে মুহাররম - আল-ইখলাছ ডেস্ক
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
সমকামিতার ভয়াবহতা ও তার অপকার (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
যাকাত বণ্টনে সমস্যা ও সমাধান - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৯ম কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী উত্তরাধিকার আইন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ধারা (২য় কিস্তি) - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ

ফেসবুক পেজ