সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৫:১৫ পূর্বাহ্ন

 প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান

 -মূল : আব্দুল আযীয ইবনু রাইস আল-রাইস
-অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক্ব বিন আব্দুল ক্বাদির*


(৫ম কিস্তি)

৬). প্রখ্যাত হাদীছ বিশারদ আল্লামা শায়খ হাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-আনছারী (রাহিমাহুল্লাহ) : তিনি বলেন,

جماعة التبليغ فيها خير وشر، وهم مبتدعة ماتريدية في العقيدة أحناف متعصبون. وقال إن هؤلاء الجماعة لا يريدون العلم ولا يطلبونه فبهذه الطريقة يفسدون أكثر مما يصلحون، وجماعة التبليغ أعرفها جيدا، هم في العقيدة ماتريدية جشتية وفي المذهب أحناف متعصبة. وقال السلفية هي السنة والجماعة، لأن معنى السلفية التمسك بما كان عليه السلف الصالح في الماضي. ثم قال كل من كان على فكر مخالف لأهل السنة فليس منهم، فجماعة الإخوان والتبليغ ليسوا من أهل السنة، لأنهم على أفكار تخالفهم.

‘তাবলীগ জামা‘আতের মাঝে ভালো ও মন্দ উভয়টিই আছে। তারা আক্বীদার ক্ষেত্রে বিদ‘আতপন্থী মাতুরীদী এবং গোড়া হানাফী’। তিনি আরো বলেন, ‘এই দলটি ইলম অর্জন করার ইচ্ছা করে না ও তালাশও করে না। সুতরাং তারা এই পদ্ধতির মাধ্যমে যতটা সংশোধন করে তার চাইতে নষ্ট করে বেশি। আমি ‘তাবলীগ জামা‘আত’ কে ভালো করেই চিনি। তারা আক্বীদার ক্ষেত্রে মাতুরীদী চিশতিয়া এবং মাযহাবের ক্ষেত্রে গোড়া হানাফী’। তিনি আরো বলেন, সালাফিয়্যা, তারা হল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত। কারণ সালাফিয়্যার অর্থই হল- অতীতে সৎ ব্যক্তিগণ যে নীতির উপর ছিলেন সেটাকে আঁকড়ে ধরা। অতঃপর তিনি বলেন, যে কেউ আহলুস সুন্নাহ বিরোধী মতবাদের উপর থাকবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং জামা‘আতুল ইখওয়ান ও জামা‘আতুত তাবলীগ ‘আহলুস সুন্নাহ’-এর অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ তারা তাদের বিরোধী মতবাদের উপর বিদ্যমান’।[১]

৭). বিজ্ঞ ওলামা পরিষদ ও ফাতাওয়া লাজনাহ আদ দায়েমার অন্যতম সদস্য আল্লামা শায়খ ছালেহ ইবনু ফাওযান আল-ফাওযান (রাহিমাহুল্লাহ) : তিনি জামা‘আতুত তাবলীগ ফী শিবহি... এবং হাক্বীক্বাতুদ দা‘ওয়াত.... (পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে) বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন,

فقد حاول أعداء هذه الدعوة أى دعوة التوحيد أن يقضوا عليها بالقوة فلم ينجحوا وحاولوا أن يقاوموها بالتشكيك والتضليل والشبهات ووصفها بالأوصاف المنفرة، فما زادها إلا تألقا ووضوحا وقبولا وإقبالا. ومن اخر ذلك ما نعايشه الان من وفود أفكار غريبة مشبوهة إلى بلادنا باسم الدعوة على أيدي جماعات تتسمي بأسماء مختلفة مثل جماعة الإخوان المسلمين، وجماعة التبليغ وجماعة كذا وكذا، وهدفها واحد وهو أن تزيح دعوة التوحيد وتحل محلها، وفي الواقع أن مقصود هذه الجماعات لا يختلف عن مقصود من سبقهم من أعداء هذه الدعوة المباركة، كلهم يريدون القضاء عليها- لكن الاختلاف اختلاف خطط فقط- وإلا لو كانت هذه الجماعات حقا تريد الدعوة إلى الله فلماذا تتعدي بلادها التي وفدت إلينا منها، وهي أحوج ما تكون إلى الدعوة والإصلاح؟ تتعداها وتغزو بلاد التوحيد تريد تغيير مسارها الإصلاحي الصحيح إلى مسار معوج، وتريد التغزير بشبابها وإيقاع الفتنة والعداوة بينهم.

‘তাওহীদের দা‘ওয়াতের শত্রুরা (তাওহীদের) দা‘ওয়াতকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শেষ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। তারা সন্দেহ, বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সংশয় তৈরি করে দেয়ার মাধ্যমেও তার বিরোধিতা করার চেষ্টা করেছিল। এই দা‘ওয়াতকে কিছু বিরক্তিকর গুণে গুণান্বিত করেছিল। তবে এই অপচেষ্টা উক্ত দা‘ওয়াতের উজ্জ্বলতা, স্পষ্টতা, গ্রহণীয়তা ও তার প্রতি আগ্রহকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে’। এবং তার শেষ পর্যায়ে বর্তমান আমরা যে সময়ে বসবাস করছি সেখানে কিছু দল দা‘ওয়াতের নামে বিভিন্ন নাম গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেশে সন্দেহজন অদ্ভুত কিছু চিন্তাধারা নিয়ে আগমন করছে। যেমন জামা‘আতুল ইখওয়ানিল মুসলিমীন, জামা‘আতুত তাবলীগ ও এরকম অনেক জামা‘আত। তাদের উদ্দেশ্য একটি। আর তাহল, তাওহীদের দা‘ওয়াতকে অপসারিত করা এবং এগুলো তার স্থলাভিষিক্ত হওয়া। এই বরকতময় দা‘ওয়াতের যে সকল শত্রু পূর্বে ছিল তাদের উদ্দেশ্য এবং এই সমস্ত জামা‘আতগুলোর উদ্দেশ্যের মাঝে বাস্তবতায় কোন পার্থক্য নেই। তারা সকলেই এই দা‘ওয়াতকে নিঃশেষ করে দিতে চায়। তবে শুধু তাদের পরিকল্পনার ভিন্নতার পার্থক্য রয়েছে। এই দলগুলো আল্লাহর দিকে আহ্বান করার ইচ্ছায় বাস্তবেই যদি সত্য হত। তাহলে কেন এই দলগুলো ঐ সব দেশকে ডিংঙ্গিয়ে অন্যত্র যায়? অথচ সেই সব দেশ দা‘ওয়াত ও সংস্কারের বেশী প্রয়োজনবোধ করে এবং সেখান থেকে আমাদের নিকট প্রতিনিধি দল আগমন করে তাকে ডিংঙ্গিয়ে তাওহীদের দেশে যাওয়ার মনস্থ করে। উদ্দেশ্য হল তার সঠিক সংস্কারমূলক পথকে পরিবর্তন করে বক্র পথে রূপান্তর করা এবং সেখানকার যুবকদরকে বিপথগামী করা ও তাদের মাঝে ফেতনা ও শত্রুতা তৈরি করা।

অতঃপর তিনি বলেন, ‘যখন এই দলগুলো আমাদের কিছু যুবকদের সাথে প্রতারণা করছে, তখনি তারা তাদের মতাদর্শের মাধ্যমে অবজ্ঞা করছে, তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও আলেমগণের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছে এবং তাদের মাঝে আক্বীদার প্রতি আগ্রহ নিভিয়ে দিচ্ছে। ফলে তারা আক্বীদার প্রতি গুরুত্ব বর্জন করছে এবং না জেনেই বকবক করা ও শুনা ইলম দ্বারা দা‘ওয়াত দেয়া শুরু করছে। আল্লাহর অসংখ্য প্রশংসা যে, এই দেশগুলোতে বেশ কিছু লোক বিদ্যমান আছেন যারা তাদের দ্বীনের জন্য আত্মসম্মানবোধ ও আক্বীদার ব্যাপারে প্রতিরোধ করেন এবং শত্রুদের চক্রান্তকে কঠিনভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তারা চকচকে আকর্ষণীয় নাম দ্বারা ধোঁকা খায় না এবং অসত্য আগ্রহ দ্বারাও প্রভাবিত হয় না।[২]  

৮). বিজ্ঞ ওলামা পরিষদ ও ফাতাওয়া লাজনাহ আদ দায়েমার অন্যতম সদস্য আল্লামা শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রহমান আল-গাদয়ান (হাফিযাহুল্লাহ) : যখন তাকে তাবলীগ জামা‘আতের সাথে সঙ্গ দেয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তখন তিনি তার থেকে নিষেধ করেছিলেন।[৩]

৯). বিজ্ঞ ওলামা পরিষদ ও ফাতাওয়া বোর্ডের সদস্য আল্লামা শায়খ ছালেহ আল-আত্বরাম (হাফিযাহুল্লাহ) : তিনি তাবলীগ অনুসারীদেরকে নিন্দা করেছেন, তাদের থেকে সতর্ক করেছেন এবং তাদের অনেক দোষ ত্রুটি বর্ণনা করেছেন।[৪]

১০). সম্মানিত শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ (হাফিযাহুল্লাহ) : তাকে তাবলীগ জামা‘আত ও ইখওয়ানুল মুসলিমীন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, أنها جماعات محدثة وأن عندهم خطأ وصوابا لكن الخطأ أكبر فليحذرها الإنسان ‘এটা নতুনভাবে সৃষ্ট দল। তাদের কাছে ভুল ও সঠিক দু’টিই আছে। তবে ভুলের সংখ্যাই বেশী। সুতরাং মানুষ যেন তা থেকে সাবধান থাকে’।[৫]

১১). ‘আল-জামি‘আহ ইসলামিয়া মদীনা নাবূবিয়্যাহ’ এর সম্মানিত (সাবেক) অধ্যক্ষ শায়খ ছালেহ ইবনু আব্দুল্লাহ আল-‘আবূদ (হাফিযাহুল্লাহ) : তিনি (হাক্বীক্বাতুদ দা‘ওয়াহ ইলাল্লাহ) কিতাবের ভূমিকায় বলেছেন যে,

وإن في كل من منهجي جماعة التبليغ والإخوان المسلمين من المخالفات لمنهج رسول الله أمورا خطيرة واضحة لمن تدبر وأنصف و سبر عن علم وبصيرة، سواء في العقيدة والتوحيد، أو في السلوك والهدي وقد أوضحت هذه الرسالة المفيدة جانبا مهما من هذا، كما قد بذل فضيلة الشيخ سعد جهدا مشكورا مفيدا في النصيحة لله ولكتابه ولرسوله ولأئمة المسلمين وعامتهم، واحتج على المخالفين بأقوال شيوخهم وعلمائهم التي ميز زيفها بفرقان الوحى النبوى، فلم يعد الصواب في النقد، بل وفق بحمد الله أيما توفيق فجزاه الله خير الجزاء وتقبل منا ومنه.

‘তাবলীগ জামা‘আত এবং ইখওয়ানুল মুসলিমীনের কর্মপন্থার মাঝে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কর্মপন্থা বিরোধী বেশ কিছু মারাত্মক বিষয় বিদ্যমান আছে, যা ঐ ব্যক্তির জন্য স্পষ্ট হয়ে যাবে যে ব্যক্তি ইনছাফের সাথে গভীরভাবে চিন্তা করবে এবং জেনে বুঝে বুদ্ধিমত্তার সাথে পরীক্ষা করবে। হতে পারে তা আক্বীদা ও তাওহীদ বিষয়ে অথবা চাল-চলন ও চারিত্রিক বিষয়ে। এই উপকারী পুস্তিকাটি এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছে। তেমনিভাবে সম্মানিত শাইখ সা‘দ তিনি আল্লাহ, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও মুসলিম জনসাধারণের কল্যাণ কামনায় একটি উপকারী প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা করেছেন এবং বিরোধীদের বিপক্ষে যুক্তি পেশ করেছেন তাদেরই মুরব্বী ও আলেমদের কথার দ্বারা। অহিয়ে নববীর প্রমাণের মাধ্যমে যার মিথ্যাকে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। তবে তিনি সমালোচনার ক্ষেত্রে সত্য সঠিককে অতিক্রম করেননি। বরং আল্লাহর প্রশংসা করি যে, তাকে যথাযথভাবে তাওফীক্ব দেয়া হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন এবং আমাদের ও তার পক্ষ থেকে কবুল করুন’।[৬]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

* মুহাদ্দিছ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র : 
[১]. আল-মাজমূঊ ফী তারজমাতিল আল্লামা আল-মুহাদ্দিছ আশ-শায়খ হাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-আনছারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৮১, ৫৮৭, ৭৬২, ৭৬৩।
[২]. হাক্বীক্বাতুদ দা‘ওয়া ইলাল্লাহ, পৃ. ৩-৪।
[৩]. আল-ক্বওলুল বালীগ ফী যাম্মি জামা‘আতিত তাবলীগ।
[৪]. আল-ক্বওলুল বালীগ ফী যাম্মি জামা‘আতিত তাবলীগ।
[৫]. আল-ক্বওলুল বালীগ ফী যাম্মি জামা‘আতিত তাবলীগ।
[৬]. হাক্বীক্বাতুদ দা‘ওয়া ইলাল্লাহ, পৃ. ১৮।




মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ (শেষ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) -এর আগমন সংশয় নিরসন (৭ম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
বিদ‘আত পরিচিত (২১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (৮ম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
রামাযানে দাওয়াতী কাজের গুরুত্ব ও প্রভাব - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
রামাযান মাসে প্রচলিত বিদ‘আত সমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন : সংশয় নিরসন (৩য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
কর্যে হাসানাহ প্রদানের গুরুত্ব ও ফযীলত - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
বিদ‘আত পরিচিতি (৯ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
পরনিন্দা চর্চা ও তার পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

ফেসবুক পেজ