সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১৮ অপরাহ্ন

আল্লাহ তা‘আলাকে কি স্বপ্নযোগে দেখা সম্ভব?

-হাসীবুর রহমান বুখারী



ভূমিকা*

স্বপ্নযোগে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা সম্ভব কি-না? সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উম্মাতের মধ্যে মতপার্থক্য আদিকালের। ছূফীবাদের ভ্রান্ত আক্বীদায় বিশ্বাসীরা এবং তথাকথিত মাযহাবী ভাইয়েরা, যারা আক্বীদার ক্ষেত্রে বা বিশ্বাসগতভাবে শী‘আ, রাফিযী, মু‘তাযিলাহ, কাররামিয়্যাহ, ক্বাদারিয়্যাহ, মুরজি‘আহ, জাবারিয়্যাহ, জাহমিয়্যাহ সহ অসংখ্য ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী, তারা এই বিষয়টি খুবই ফলাও করে প্রচার করে থাকেন।

ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত বিষয়। স্বপ্নের অনেক প্রকার ও ধরণ থাকতে পারে। যেমন আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, এ কথা বলা হয় যে, স্বপ্ন তিন প্রকার। যথা:  (১) মনের কল্পনা (২) শয়তানের তরফ থেকে ভয় দেখানো এবং (৩) আল্লাহর তরফ হতে সুসংবাদ। তাই যদি কেউ অপসন্দনীয় কিছু দেখে তবে সে যেন তা কারো কাছে বর্ণনা না করে। বরং উঠে যেন (নফল) ছালাত আদায় করে নেয়’।[১] কিছু কিছু স্বপ্ন ভয়ঙ্কর ও অবর্ণনীয় হয়। আবার কিছু স্বপ্ন সারাটা দিন মনে গেঁথে থাকে। তাই সুযোগে-অবসরে মানুষ স্বপ্নের কথা কাউকে বলতে ভালোবাসে। কিন্তু অনেক সময় এমনও হয়, কিছু মানুষ স্বপ্ন সম্পর্কে অহেতুক ও মিথ্যা বর্ণনা দিয়ে গল্প জমায়। আবার অনেকে নিজের ঈমানদারী ও আল্লাহভীতি প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। অথচ স্বপ্নে যা দেখেনি তা বর্ণনা করা বা মিথ্যা বলা ইসলামে হারাম। আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) সূত্রে নবী (ﷺ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন,

مَنْ تَحَلَّمَ بِحُلْمٍ لَمْ يَرَهُ كُلِّفَ أَنْ يَعْقِدَ بَيْنَ شَعِيرَتَيْنِ وَلَنْ يَفْعَلَ...

‘যে লোক এমন স্বপ্ন দেখার ভান করল যা সে দেখেনি তাকে দু’টি যবের দানায় গিট দেয়ার জন্য বাধ্য করা হবে। অথচ সে তা কখনও পারবে না। যে কেউ কোন এক দলের কথার দিকে কান লাগাল। অথচ তারা এটা পসন্দ করে না অথবা বলেছেন, অথচ তারা তার থেকে পলায়নপর। ক্বিয়ামতের দিন তার উভয় কানে সীসা ঢেলে দেয়া হবে। আর যে কেউ প্রাণীর ছবি আঁকে তাকে শাস্তি দেয়া হবে এবং তাতে প্রাণ ফুঁকে দেয়ার জন্য বাধ্য করা হবে। কিন্তু সে প্রাণ ফুঁকতে পারবে না।[২] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ مِنْ أَفْرَى الْفِرَى أَنْ يُرِيَ عَيْنَيْهِ مَا لَمْ تَرَ ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট মিথ্যা হল আপন চক্ষু দিয়ে এমন কিছু দেখার দাবি করা, যা চক্ষুদ্বয় দেখতে পায়নি’।[৩]

উপরিউক্ত হাদীছে তিনটি হুকুম শামিল রয়েছে‌। তার মধ্যে একটি হল- ‘মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনা করা’। ইমাম ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনা সম্পর্কে বলেন, এ ব্যাপারে শাস্তি দেয়ার ওয়াদা তীব্র হয়েছে। কারণ স্বপ্নের ব্যাপারে মিথ্যারোপ যেন আল্লাহর উপরেই মিথ্যারোপ করা, যে আল্লাহ তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন অথচ তা সে দেখেনি। আর আল্লাহর উপর মিথ্যা বলা সৃষ্টিকুলের উপর মিথ্যা বলার চাইতে অধিকতর গুরুতর (সূরা হূদ: ১৮)। স্বপ্ন নবুয়তের একটি অংশ। আর নবুওয়তের অংশ আল্লাহর পক্ষ থেকেই। সর্বজনবিদিত যে, মানুষের ওপর মিথ্যা বলার চেয়ে আল্লাহর ওপর মিথ্যা বলার শাস্তি ভয়াবহ ও কঠিন।[৪] ইতিপূর্বে ছূফীবাদের অসংখ্য ভণ্ড সাধক নিজেদের কারামতী প্রকাশ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলাকে স্বপ্নে দেখার মিথ্যা দাবি করেছেন। তারা তাদের বিভিন্ন ইমামের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলাকে স্বপ্নে দেখার ব্যাপারে সীমাহীন অতিরঞ্জিত করেছেন। যা তাদের চিরাচরিত অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত। স্বয়ং ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি স্বপ্নে ৯৯ বার আল্লাহকে দেখেছেন। অথচ উক্ত কথার কোন সত্যতা পাওয়া যায় না। এই ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কোন স্বীকারোক্তি প্রমাণিত নয়। ঘটনাটি নাজমুদ্দীন গীত্বী নামক জনৈক ছূফী সনদবিহীনভাবে উল্লেখ করেছেন, যার কোন ভিত্তি নেই।[৫] আবার কেউ বলেছেন যে, আমাদের ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) স্বপ্নে একশ’বার আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন।[৬]

অথচ সালাফে ছালিহীনের অসংখ্য আলেম এই বিষয়ে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। তাঁরা মনে করেন যে, ‘বিষয়টি সর্বসাধারণের জন্য অনুমোদিত করে দিলে, তা আল্লাহ তা‘আলার শানে চরমতম বেয়াদবী হবে’। কারণ, এর ফলে ছূফীবাদের ভণ্ড পীর এবং অন্যান্যরা বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, তাদের মধ্য হতে কেউ বলতে পারে, ‘আমি গতকাল আমার প্রতিপালককে দেখেছি এবং তিনি আর  আমি একসঙ্গে বসেছিলাম এবং আমরা পরস্পরে তর্ক-বিতর্ক করেছি। নাউযুবিল্লাহ্! অতঃপর এমন এমন ভিত্তিহীন, অবিশ্বাস্য, মনগড়া ও অভুতপূর্ব কেচ্ছা-কাহিনী বলা হবে যার কোন বাস্তবতা নেয়। সুতরাং অসংখ্য আলিম এই প্রসঙ্গটা স্থগিত রাখাকেই কল্যাণকর মনে করেছেন।

আহলেসুন্নাহ ওয়া জামা‘আতের অভিমত

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সর্বসম্মত মত হল: দুনিয়াতে স্বচক্ষে সরাসরি আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। এমনকি নবী ও রাসূলগণও দেখেননি। তবে স্বপ্নে দেখার ব্যাপারে আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন। অনেকে দাবী করেছেন যে, তিনি স্বপ্নে আল্লাহকে দেখেছেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) একশ’ বার স্বপ্নে আল্লাহকে দেখেছেন। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।

প্রথমতঃ নিশ্চিতরূপে দুনিয়াতে জাগ্রতাবস্থায় স্বচক্ষে সরাসরিভাবে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা সম্ভব নয়। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘দুনিয়াতে জাগ্রতাবস্থায় স্বচক্ষে সরাসরিভাবে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা সম্ভব নয়। যেমন মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর আবেদন প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ لَمَّا جَآءَ مُوۡسٰی لِمِیۡقَاتِنَا وَ کَلَّمَہٗ رَبُّہٗ ۙ قَالَ رَبِّ اَرِنِیۡۤ   اَنۡظُرۡ   اِلَیۡکَ ؕ قَالَ لَنۡ تَرٰىنِیۡ  وَ لٰکِنِ  انۡظُرۡ  اِلَی  الۡجَبَلِ فَاِنِ اسۡتَقَرَّ مَکَانَہٗ فَسَوۡفَ تَرٰىنِیۡ ۚ فَلَمَّا تَجَلّٰی رَبُّہٗ  لِلۡجَبَلِ جَعَلَہٗ  دَکًّا وَّ خَرَّ مُوۡسٰی صَعِقًا ۚ فَلَمَّاۤ  اَفَاقَ قَالَ سُبۡحٰنَکَ تُبۡتُ  اِلَیۡکَ  وَ اَنَا  اَوَّلُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ.

‘আর মূসা যখন আমার নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হলেন এবং তাঁর প্রতিপালক তাঁর সঙ্গে কথা বললেন, তখন তিনি বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দর্শন দান করুন, আমি আপনাকে দেখব’। তিনি বললেন, ‘তুমি আমাকে দেখতে সক্ষম হবে না। তুমি বরং পাহাড়ের প্রতি লক্ষ্য কর, যদি তা স্ব-স্থানে স্থির থাকে, তাহলে তুমি আমাকে দেখবে’। সুতরাং যখন তাঁর প্রতিপালক পাহাড়ে জ্যোতিষ্মান হলেন, তখন তা পাহাড়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করল আর মূসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। অতঃপর যখন তিনি জ্ঞান ফিরে পেলেন, তখন বললেন, ‘মহিমাময় আপনি! আমি অনুতপ্ত হয়ে আপনার কাছে তাওবাহ করছি এবং বিশ্বাসীদের মধ্যে আমিই প্রথম’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৪৩)।

প্রকৃতপক্ষে পার্থিব জগতে কোন মানুষের পক্ষে আল্লাহ তা‘আলাকে স্বচক্ষে দেখা সম্ভব নয়। অথচ অভিশপ্ত দাজ্জাল পৃথিবীর বুকে জনসমক্ষে নিজেকে রব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে। সে যে দৃশ্যমান, এটিই সব থেকে বড় প্রমাণ যে সে রব নয়। অতএব দুনিয়াতে জাগ্রতাবস্থায় স্বচক্ষে আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। এমনকি নবী (ﷺ)ও মি‘রাজের রাত্রীতে তাঁর প্রতিপালককে সরাসরি দেখেননি। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম, শায়খ ইবনু বায, শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন, শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুমুল্লাহ), শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) ও সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘ইজমা অর্থাৎ ছাহাবীগণের ঐকমত্যানুযায়ী নবী (ﷺ) মি‘রাজের রাত্রীতে আল্লাহ তা‘আলাকে স্বচক্ষে দেখেননি। শুধু ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) ব্যতীত। প্রকৃতপক্ষে ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর মতটি কিন্তু অন্যান্য ছাহাবীর মতের বিরোধী নয়। কেননা তিনি এ কথা বলেননি যে, নবী (ﷺ) তাঁর মস্তিষ্কের চক্ষু দ্বারা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখেছেন। বরং তিনি এ কথা বলেছেন যে, তিনি আল্লাহ তা‘আলাকে তাঁর অন্তরের চক্ষু দ্বারা দেখেছেন। এর উপর ভিত্তি করেই ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (আলাইহিস সালাম) বলেন, নবী (ﷺ) সত্যিই তাঁর প্রভুকে স্বপ্নে দেখেছেন। আর নবীদের স্বপ্ন সত্য হয় এবং অবশ্যই তা বাস্তবে পরিণত হয়। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) এটি বলেননি যে, তিনি জাগ্রত অবস্থায় চর্মচক্ষু দিয়ে দেখেছেন। যারা তাঁর থেকে এটি বর্ণনা করেছেন, তারা ভুল করেছেন। কিন্তু তিনি একবার বলেছেন, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর প্রভুকে দেখেছেন। আরেকবার ব্যাখ্যা করে বলেছেন, অন্তরের চক্ষু দিয়ে দেখেছেন। বিশুদ্ধ মতানুযায়ী, রাসূল (ﷺ) মি‘রাজের রাত্রীতে জিবরীলকে দেখেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَقَدۡ رَاٰہُ  نَزۡلَۃً   اُخۡرٰی ‘নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল’ (সূরা আন-নাজম: ১৩)। এই আয়াতে যাকে দেখার কথা বলা হয়েছে তিনি হচ্ছেন জিবরীল’।[৭] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,

مَنْ حَدَّثَكَ أَنَّ مُحَمَّدًا ﷺ رَأَى رَبَّهُ فَقَدْ كَذَبَ وَهُوَ يَقُولُ (لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ) وَمَنْ حَدَّثَكَ أَنَّهُ يَعْلَمُ الْغَيْبَ فَقَدْ كَذَبَ وَهُوَ يَقُولُ لاَ يَعْلَمُ الْغَيْبَ إِلاَّ اللهُ.

‘যে ব্যক্তি তোমাকে বলে মুহাম্মাদ (ﷺ) স্বীয় রŸকে দেখেছেন, সে মিথ্যা বলল। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘চক্ষু তাঁকে দেখতে পায় না’। আর যে ব্যক্তি তোমাকে বলে মুহাম্মাদ (ﷺ) গায়িব জানেন, সেও মিথ্যা বলল। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘গায়িব জানেন একমাত্র আল্লাহ’।[৮] আবূ যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমি রাসূল (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কি আপনার প্রতিপালককে দেখেছেন? তিনি বলেন, نُوْرٌ أَنَّىْ أَرَاهُ ‘তিনি (আল্লাহ) তো নূর, তা আমি কি রূপে দেখবো?’ অন্য বর্ণনায় তিনি বলেছেন, رَأَيْتُ نُوْرًا ‘আমি নূর (জ্যোতি) দেখেছি’।[৯] অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা ও তাঁর মাঝে নূরের পর্দা ছিল। ছহীহ সূত্রে প্রমাণিত যে, আল্লাহ তা‘আলা নূর দ্বারা আবৃত। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেছেন, حِجَابُهُ النُّوْرُ لَوْ كَشَفَهُ لَأَحْرَقَتْ سُبُحَاتُ وَجْهِهِ مَا انْتَهَى إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ ‘তিনি নূরের পর্দায় আচ্ছাদিত। যদি সে আবরণ খুলে দেয়া হয়, তবে তাঁর নূরের আলোচ্ছটা সৃষ্টি জগতের দৃশ্যমান সব কিছু ভস্ম করে দিবে’।[১০] তিনি আরো বলেছেন, واعلموا أنَّكُم لن ترَوا ربَّكُم حتَّى تموتوا ‘জেনে রাখো! মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবে না’।[১১]

বাস্তবে যখন মূসা (আলাইহিস সালাম) এবং আমাদের নবী (ﷺ)-এর পক্ষে আল্লাহ তা‘আলাকে সরাসরি দেখা সম্ভব হয়নি, তখন অন্য কারো পক্ষে যে তা আদৌ সম্ভবপর হবে না, তা বলা-ই বাহুল্য। এর পরেও কেউ যদি এ দুনিয়ায় আল্লাহকে সরাসরি স্বচক্ষে দেখেছেন বলে দাবী করেন, তবে সে যে একজন মস্তবড় মিথ্যুক হবে, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আক্বীদাহ বিষয়ক কবিতায় জনৈক কবি বলেন,

و من قال في الدنيا يراه بعينهথ فذاك زنديق طغا و تمردا.

و خالف كتاب الله و الرسل كلها থ و زاغ عن الشرع الشريف و أبعدا.

‘যে বলে আল্লাহকে দুনিয়ায় স্বচক্ষে দেখা যায়, সে হলো যিন্দীক (কাফির), সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে। আল্লাহর কিতাব এবং সকল রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। আর শরী‘আত থেকে বিপথগামী হয়ে বহু দূরে চলে গেছে’।

দ্বিতীয়তঃ তবে আল্লাহ তা‘আলাকে স্বপ্নযোগে দেখা সম্ভব কী? রাসূল (ﷺ)-কে স্বপ্নে দেখার ব্যাপারটি জগদ্বিদিত এবং তা ছহীহ সুন্নাহর আলোকে প্রমাণিত। যেমন আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে লোক আমাকে স্বপ্নে দেখে সে শীঘ্রই জাগ্রত অবস্থাতেও আমাকে দেখবে। কেননা শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না’।[১২] অন্য বর্ণনায় এসেছে,

‏وَمَنْ رَآنِيْ فِي الْمَنَامِ فَقَدْ رَآنِيْ، فَإِنَّ الشَّيْطَانَ لَا يَتَمَثَّلُ صُوْرَتِيْ، وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.

‘আর যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখেছে সে অবশ্যই আমাকে দেখেছে। কারণ শয়তান আমার আকৃতির অনুরূপ আকৃতি ধারণ করতে পারে না। আর যে লোক ইচ্ছাপূর্বক আমার প্রতি মিথ্যারোপ করে, সে যেন জাহান্নামেই তার বাসস্থান বানিয়ে নেয়’।[১৩] রাসূল (ﷺ)-কে স্বপ্নে কেবল তারাই দেখতে পারেন যারা ঈমান ও আমালে ছাহিল এর গুণে গুণান্বিত। হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

ثم ذكر أنه عام في أهل التوفيق وأما غيرهم فعلى الاحتمال فان خرق العادة قد يقع للزنديق بطريق الإملاء والإغواء كما يقع للصديق تحصل التفرقة بينهما باتباع الكتاب والسنة انتهى.

‘যারা আহলুত তাওফীক্ব কেবল তাঁরাই রাসূল (ﷺ)-কে স্বপ্নে দেখতে পারে। কিন্তু যারা তাদের দলভুক্ত নয়, তাদের স্বপ্নে দেখার বিষয়টি সত্য হতেও পারে, আবার মিথ্যাও হতে পারে। কেননা, শয়তানের চক্রান্তের মাধ্যমে একজন যিন্দিক তথা কাফিরের দ্বারাও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে পারে, যেমন তা হয়ে থাকে একজন সত্যবাদীর ক্ষেত্রে। তবে উভয়ের মাঝে পার্থক্য অর্জিত হবে কিতাব ও সুন্নাতের অনুসরণের দিক বিবেচনা করে। যিনি কিতাব ও সুন্নাতের অনুসারী হবেন তাঁর স্বপ্ন সত্য হবে, আর যিনি কিতাব ও সুন্নাতের অনুসারী হবেন না, তার স্বপ্ন মিথ্যা হবে’।[১৪]

তবে এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, উক্ত হাদীছ দু’টিতে বলা হয়েছে ‘কারণ শয়তান আমার আকৃতির অনুরূপ আকৃতি ধারণ করতে পারে না’। প্রশ্ন হল- যদি শয়তান রাসূল (ﷺ) ছাড়া অন্য কারোর রূপ ধারণ করে ঁেধাকা দেয়ার জন্য বলে যে, ‘আমি মুহাম্মাদ’। এক্ষেত্রে যারা রাসূল (ﷺ)-কে দুনিয়ায় স্বচক্ষে দেখেনি, তারা কিভাবে নির্ণয় করবে? তারা তো শয়তানী কুমন্ত্রণা ও প্রতারণার শিকার হতে পারে!

(ইনশাআল্লাহ আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)



* মুর্শিদাবাদ, ভারত।

[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০১৭।

[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৪২।

[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৪৩।

[৪]. ফায়যুল ক্বাদীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৯৯।

[৫]. ইবনু আবেদীন, রাদ্দুল মুহতার, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১।

[৬]. আল-মুনতাকিদ, পৃ. ৬১-৬২; ইবনে আবেদীন, ফাতাওয়া শামী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৮।

[৭]. ইজতিমাউল জুয়ূশিল ইসলামিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২-৪; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯২; আল-ফাতাওয়া আল-ইমারাতিয়্যাহ, পৃ. ৪; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়া,ব ফৎওয়া নং- ১২৪২৩।

[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩৮০, ৪৮৫৬, ৩২৩৪।

[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৮; তিরমিযী, হা/৩২৮২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৩১৩, ২১৩৯২, ২১৪৯৮, ২১৫২৭।

[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৬২-১৬৩, ১৯৫-১৯৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৫৩০, ১৯৫৮৭, ১৯৬৩২।

[১১]. আলবানী, তাখরীজু কিতাবিস সুন্নাহ, হা/৪২৯; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামি‘, হা/২৯৬৩; ইবনে হাজার, আল-গুনইয়াতু ফী মাসআলাতির রু'ইয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪; ইবনে খুযাইমাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৫৯; লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪১৮; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০০।

[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৯৭, ৬৯৯৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৩৪, ২২৬৬; আবূ দাঊদ, হা/৫০২৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৫১৬।

[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১১০, ৩৫৩৯, ৬১৮৮, ৬১৯৭, ৬৯৯৩; ছহীহ মুসলিম, হা/৪, ২১৩৪; তিরমিযী, হা/২২৭৬; ইবনু মাজাহ, হা/৩৯০০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৫৫৯, ৩৭৯৮।

[১৪]. ফাৎহুল বারী, ১২শ খণ্ড, পৃ. ৩৮৫।




প্রসঙ্গসমূহ »: ঈমান-আক্বীদা
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (ত্রয়োদশ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
যাকাত বণ্টনে সমস্যা ও সমাধান - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
দলাদলির কুপ্রভাব : উত্তরণের উপায় - শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
বিদ‘আত পরিচিতি (৩০তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (১৭তম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
বিদ‘আত পরিচিতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৫ম কিস্তি)  - আব্দুল গাফফার মাদানী
সুন্নাতের রূপরেখা (৪র্থ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন

ফেসবুক পেজ