সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০২:০৬ অপরাহ্ন

বিদ‘আত পরিচিতি

-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


(৪র্থ কিস্তি)

বিদ‘আতের উৎপত্তি

শিরকের ইতিহাস প্রাচীন হলেও বিদ‘আতের ইতিহাস ততটা প্রাচীন নয়। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা (৬৬১-৭২৭ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, إنَّمَا وَقَعَ فِي الْأُمَّةِ فِيْ أَوَاخِرِ خِلَافَةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ ‘খুলাফায়ে রাশেদার যুগের শেষের দিকে মুসলিম জাতির ঈমান ও ইবাদতের ক্ষেত্রে অধিকাংশ বিদ‘আতের উৎপত্তি ঘটেছে’।[১] এছাড়া মুসলিম সমাজে বিদ‘আতের অনুপ্রবেশ ঘটবে সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ইরবায ইবনু সারিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

صَلَّى بِنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيْغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُوْنُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوْبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا فَقَالَ أُوصِيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَّعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّيْنَ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ

‘একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে আমাদের উদ্দেশ্য জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। তাতে চক্ষুগুলো অশ্রুসিক্ত হল এবং অন্তরগুলো বিগলিত হল। তখন এক ব্যক্তি বলল, এ যেন বিদায়ী ভাষণ! অতএব আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ দিবেন? তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে তাক্বওয়া অবলম্বনের, শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে  একজন হাবশী গোলাম হয়। কারণ তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখতে পাবে। এমতাবস্থায় তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত ও আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাতকে অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে মযবুত করে আঁকড়ে থাকবে। সাবধান! নতুন সৃষ্টি বিষয় থেকে বিরত থাকবে। কারণ প্রতিটি নবাবিষ্কৃত বিষয়ই বিদ‘আত। আর প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’।[২] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيَأْتِيَنَّ عَلَىْ أُمَّتِيْ مَا أَتَىْ عَلَىْ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ حَتَّى إِنَّ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَى أُمَّهُ عَلَانِيَةً لَكَانَ فِىْ أُمَّتِي مَنْ يَّصْنَعُ ذَلِكَ وَإِنَّ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلَىْ ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِيْ عَلَىْ ثَلَاثٍ وَّسَبْعِيْنَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِىْ النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَّاحِدَةً قَالُوْا وَمن هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ

‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘অবশ্যই আমার উম্মতের উপর এমন একটি সময় আসবে যেমন বনী ইসরাঈলের উপর আগমন করেছিল, যেমন এক পায়ের জুতা অপর পায়ের জুতার ন্যায়। এমনকি তাদের মধ্যে যদি কেউ তাঁর মায়ের সাথে প্রকাশ্যে যেনা করে, তাহলে আমার উম্মতের মধ্যে এমনি লোক থাকবে, যারা এমন কাজ করবে। আর বাণী ইসরাঈল ৭২টি ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। সবাই জাহান্নামে যাবে, একটি দল ব্যতীত। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! সেটি কোন্ দল? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  বললেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি’।[৩] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘৭২ দল জাহান্নামে যাবে। আর একটি দল জান্নাতে যাবে। সে দলটি হচ্ছে জামা‘আত। আর আমার উম্মতের মধ্যে অনেক দলের উদ্ভব হবে, যাদের মাধ্যমে এমনভাবে অসংখ্য বিদ‘আত প্রবহমান হবে যেমনভাবে জলাতংক রোগ রোগীর সমগ্র শরীরে প্রবাহিত হয়। তাঁর কোন একটি শিরা বা জোড়া বাকী থাকে না, যাতে তা প্রবেশ করে না’।[৪]

উপরিউক্ত হাদীছগুলোতে বিদ‘আত সম্পাদনের কারণে ৭২ ফির্কাকে জাহান্নামী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও তারা মুসলিম।[৫] হাদীছে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বক্তব্য ثَلَاثُ وَّسَبْعِيْنَ مِلَّةً তথা ৭৩ ফির্কা বলতে কী বুঝানো হয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। এর সংখ্যা কি সীমায়িত, না-কি অগণিত? কেউ বলেছেন, এর সংখ্যা অগণিত। কেননা বিদ‘আতী দলসমূহ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এর সংখ্যা গণনা করা দুঃসাধ্য। কেউ বলেছেন, সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাক তা ৭৩-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। যদিও বিদ্বানগণ বিভিন্নভাবে ফির্কাগুলোর সংখ্যা গণনা করেছেন। যেমন আব্দুল করীম শাহরস্তানী (৪৭৯-৫৪৮ হি./১০৮৬-১১৫৩ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বড় ইসলামী ফির্কা মোট ৪টি। আল-ক্বাদারিয়্যা, আছ-ছিফাতিয়্যাহ, আল-খাওয়ারিজ, শী‘আ’।[৬] আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক (১১৮-১৮১ হি./৭২৬-৭৯৭ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) শী‘আ, খারিজী, মুরজিয়্যাহ, ক্বাদারিয়্যাহ নাম উল্লেখ করে বলেন, এ চারটিই হল মূল বিদ‘আতী ফির্কা। তবে জাহমিয়্যাহদের সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তারা উম্মতে মুহাম্মাদীর অন্তর্ভুক্ত নয়’।[৭] প্রত্যেকটি দল ১৮টি উপদলে বিভক্ত হয়ে মোট ৭২টি দল হয়েছে। বাকী ১টি দল হল ফির্কায়ে নাজিয়া তথা মুক্তিপ্রাপ্ত দল। তারা হল- ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত’। কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, উক্ত ৪টি দলের সাথে আরো ৪টি মূল দল রয়েছে। সেগুলো হল- মু‘তাযিলা, মুশাব্বিহা, জাবরিয়া, নাযযারিয়া। কেউ বলেছেন, মূল দল হল ৬টি। যথা : হারূরিয়্যাহ (খারিজী), ক্বাদারিয়্যাহ, জাহমিয়্যাহ, মুরজিয়্যাহ, রাফিযাহ (শী‘আ), জাবরিয়া। বদরুদ্দীন আঈনী আল-হানাফী (১৩৬১-১৪৫১ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) ৭৩টি দলের পরিচয় প্রদান করে বলেন,

افتراق الأمة أهل السنة والجماعة فرقة والخوارج خمس عشرة فرقة والشيعة ثلاث وثلاثون والمعتزلة ستة والمرجئة اثنا عشر والمشبهة ثلاثة والجهمية فرقة واحدة والضرارية واحدة والكلابية واحدة وأصول الْفرق عشرَة أهل السّنة والخوارج والشيعة والجهمية والضرارية والمرجئة والنجارية والكلابية والمعتزلة والمشبهة

‘উম্মতের ফির্কার মধ্যে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত একটি, খারিজীদের ১৫টি, শী‘আদের ৩৩টি, মু‘তাযিলাদের ৬টি, মুরজিয়্যাদের ১২টি, মুশাব্বিহাদের ৩টি, জাহমিয়্যাহ ১টি, জাররারিয়্যাহ ১টি, কাল্লাবিয়্যাহ ১টি। সর্বোমট ৭৩টি’।[৮] অতঃপর তিনি মৌলিক ১০টি ফির্কার নাম উল্লেখ করেছেন। সেটা হল- আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত, খারিজী, শী‘আ, জাহমিয়্যাহ, জাররারিয়্যাহ, মুরজিয়্যা, নাজজারিয়্যাহ, কাল্লাবিয়্যাহ, মু‘তাযিলা, মুশাব্বিহা’। অন্যদিকে আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (মৃ. ১৩৫৩ হি./১৯৩৪ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘জেনে রাখ! বিদ‘আতী ফিরকার মূল দল হল ৮টি। মু‘তাযিলা, যারা ২৩ দলে বিভক্ত; শী‘আ, যারা ২২ দলে বিভক্ত; খারেজী, যারা ২০ দলে বিভক্ত; মুরজিয়্যাহ, যারা ৫ দলে বিভক্ত; নাজ্জারিয়্যাহ, জাবরিয়্যাহ এবং মুশাববিহা। এ ফির্কাগুলো সবই জাহান্নামী। আর মুক্তিপ্রাপ্ত দল হল- আহলুস সুন্নাহ, যারা উজ্জ্বল প্রশংসিত এবং সেই পথ স্বচ্ছ ও প্রশংসিত’।[৯] অনুরূপভাবে ইবনুল জাওযী (৫১০-৫৯৭ হি./১১১৬-১২০০ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘তালবীসু ইবলীস’ গ্রন্থে ৭২টি দল নামসহ গণনা করে দেখিয়ে দিয়েছেন।[১০]

সঊদী ‘আরবের প্রখ্যাত বিদ্বান শাইখ ‘উছাইমীন (১৩৪৭-১৪২১ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, কোন কোন ‘আলিম এই জাহান্নামী ৭২-এর পরিচয় নির্ধারণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রথমতঃ বিদ‘আতীদেরকে পাঁচভাগে ভাগ করেছেন এবং প্রত্যেক ভাগ থেকে শাখা-প্রশাখা বের করে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক ঘোষিত ৭২টি ফির্কা নির্ধারণ করেছেন। কিছু কিছু ‘আলিম নির্ধারণ না করাই উত্তম মনে করেছেন। কারণ এই ফির্কা ৭২এ নির্ধারিত থাকার পরও আরো অসংখ্য মানুষ গোমরাহ হয়েছে। তারা আরো বলেন যে, এই সংখ্যা শেষ হবে না। শেষ যামানায় ক্বিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে এর সর্বশেষ সংখ্যা সম্পর্কে জানানো সম্ভব নয়। সুতরাং উত্তম হল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা সংক্ষেপ (অস্পষ্ট) রেখেছেন তা সংক্ষেপ (অস্পষ্ট) রাখা। আমরা এভাবে বলব যে, এই উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। ৭২ দল জাহান্নামে যাবে এবং মাত্র একটি দল জান্নাতে যাবে। অতঃপর বলব, যে দলটি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর ছাহাবীগণের সুন্নাতের বিরোধিতা করবে সে এই ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত হবে’।[১১]

বিদ‘আতী ফির্কাসমূহের মধ্যে খারিজী সম্প্রদায়ের বিদ‘আত সর্বপ্রথম প্রকাশ পায়। খারিজীদের আত্মপ্রকাশ ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর খিলাফতকালে ঘটলেও এদের চরমপন্থী মনোভাব রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগ থেকেই পরিলক্ষিত হয়। নিম্নের হাদীছটি তার জ্বাজল্য প্রমাণ। জাবির ইবনু ‘আব্দিল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَتَى رَجُلٌ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْجِعْرَانَةِ مُنْصَرَفَهُ مِنْ حُنَيْنٍ وَفِىْ ثَوْبِ بِلَالٍ فِضَّةٌ وَرَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْبِضُ مِنْهَا يُعْطِى النَّاسَ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ اعْدِلْ قَالَ وَيْلَكَ وَمَنْ يَعْدِلُ إِذَا لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ لَقَدْ خِبْتَ وَخَسِرْتَ إِنْ لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ. فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ دَعْنِى يَا رَسُوْلَ اللهِ فَأَقْتُلَ هَذَا الْمُنَافِقَ فَقَالَ مَعَاذَ اللهِ أَنْ يَتَحَدَّثَ النَّاسُ أَنِّىْ أَقْتُلُ أَصْحَابِىْ إِنَّ هَذَا وَأَصْحَابَهُ يَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَمْرُقُوْنَ مِنْهُ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ

‘হুনায়নের যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জি‘রানাহ নামক স্থানে অবস্থান করেছিলেন। বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাপড়ে কিছু রৌপ্য ছিল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুঠি ভরে তা লোকদেরকে দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! ইনছাফ কর’। তিনি বললেন, হতভাগা! আমিই যদি ইনছাফ না করি তাহলে কে ইনছাফ করবে? আর আমি যদি সুবিচার না করি তাহলে তো হতভাগ্য ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। এ কথা শুনে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে অনুমতি দিন আমি এ মুনাফিকটাকে হত্যা করি। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি। তাহলে লোক বলবে, আমি আমার সঙ্গী-সাথীদের হত্যা করি। আর এ ব্যক্তি ও তার সাথীরা কুরআন পাঠ করবে কিন্তু তাদের এ পাঠ তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না (অর্থাৎ অন্তরে কোন প্রকার আবেদন সৃষ্টি করবে না)। তারা কুরআন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়’।[১২] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে অনুরূপ ঘটনার আবারো অবতারণা হয়েছিল। নিম্নের হাদীছ তার বাস্তব প্রমাণ-

আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আলী ইবনু আবূ তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইয়ামান থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে এক প্রকার (রঙিন) চামড়ার থলে করে সামান্য কিছু স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেন। তখনও এগুলো থেকে সংযুক্ত মাটি পরিষ্কার করা হয়নি। আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চারজনের মাঝে স্বর্ণখণ্ডটি বণ্টন করে দিলেন। তারা হলেন, ‘উয়াইনাহ ইবনু বাদর, আকরা ইবনু হাবিস, যায়দ আল-খায়ল এবং চতুর্থ জন ‘আল্ক্বামাহ কিংবা ‘আমির ইবনু তুফায়ল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। তখন ছাহাবীগণের মধ্য থেকে একজন বললেন, এটা পাওয়ার ব্যাপারে তাঁদের অপেক্ষা আমরাই অধিক হক্বদার ছিলাম। (রাবী) বলেন, কথাটি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছল। তাই নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমরা কি আমার উপর আস্থা রাখ না, অথচ আমি আসমানের অধিবাসীদের আস্থাভাজন, সকাল-বিকাল আমার কাছে আসমানের সংবাদ আসছে। রাবী বলেন,

فَقَامَ رَجُلٌ غَائِرُ الْعَيْنَيْنِ مُشْرِفُ الْوَجْنَتَيْنِ نَاشِزُ الْجَبْهَةِ كَثُّ اللِّحْيَةِ  مَحْلُوْقُ الرَّأْسِ مُشَمَّرُ الْإِزَارِ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ اتَّقِ اللهَ قَالَ وَيْلَكَ أَوَلَسْتُ أَحَقَّ أَهْلِ الْأَرْضِ أَنْ يَتَّقِىَ اللهَ

‘এমন সময়ে এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়াল। লোকটির চোখ দু’টি ছিল কোটরাগত, চোয়ালের হাড় যেন বেরিয়ে পড়ছে, উঁচু কপাল বিশিষ্ট, দাড়ি অতি ঘন, মাথাটি ন্যাড়া, পরনের লুঙ্গী উপরে উত্থিত। সে বলল, হে আল্লাহ‌র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আল্লাহকে ভয় করুন। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমার জন্য আফসোস! আল্লাহকে ভয় করার ব্যাপারে দুনিয়াবাসীদের মধ্যে আমি কি অধিক হকদার নই?’ রাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, লোকটি চলে গেলে খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আল্লাহ‌র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি কি লোকটির গর্দান উড়িয়ে দেব না? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, না; হতে পারে সে ছালাত আদায় করে। খালিদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, অনেক ছালাত আদায়কারী এমন আছে যারা মুখে এমন এমন কথা উচ্চারণ করে, যা তাদের অন্তরে নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমাকে মানুষের দিল ছিদ্র করে, পেট ফেড়ে দেখার জন্য বলা হয়নি। তারপর তিনি লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তখন লোকটি পিঠ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে। তিনি বললেন, এ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন জাতির উদ্ভব হবে, যারা শ্রুতিমধুর কণ্ঠে আল্লাহ‌র কিতাব তিলাওয়াত করবে অথচ আল্লাহর বাণী তাদের গলদেশের নিচে নামবে না। তারা দ্বীন থকে এভাবে বেরিয়ে যাবে, যেভাবে লক্ষ্যবস্তুর দেহ ভেদ করে তীর বেরিয়ে যায়। (বর্ণনাকারী বলেন) আমার মনে হয় তিনি এ কথাও বলেছেন, আমি যদি তাদেরকে পাই, তাহলে অবশ্যই সামূদ জাতির মত হত্যা করব’।[১৩] সেই বিশ্বাসঘাতকের নাম ছিল হরকুস ইবনু যুহাইর যুল-খুওয়াইসিরাহ। যাকে খারিজী সম্প্রদায়ের উত্থানের মূল হোতা বলা হয়।[১৪]

বিদ‘আতী ফির্কাসমূহের মধ্যে ক্বাদারিয়্যাহ, মুরজিয়্যা, শী‘আ এবং খারিজী সম্প্রদায়ের বিদ‘আত সর্বপ্রথম হিজরী দ্বিতীয় শতকে প্রকাশ পায়। এসময় ছাহাবীদের অনেকেই জীবিত ছিলেন। তাঁরা এসমস্ত বিদ‘আতী মতবাদের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। অতঃপর মু‘তাযিলা সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। যার ফলে মুসলিমদের মাঝে অসংখ্য ফিতনা-ফাসাদের সৃষ্টি হয় এবং পরস্পরের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। মুসলিম জাতির বিরাট এক অংশ বিদ‘আতী মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অতঃপর সম্মানিত ছাহাবীদের যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর ছূফীবাদ নামে আর এক নতুন বিদ‘আতী মতবাদ দেখা দেয়। পর্যায়ক্রমে কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ, কবর পাকা করা ও কবরকে কেন্দ্র করে অসংখ্য বিদ‘আতের প্রকাশ ঘটে। এভাবে সময়ের ব্যবধানে সাথে সাথে বিদ‘আতের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বিভিন্ন আকার ধারণ করতে থাকে।[১৫]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

*পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

তথ্যসূত্র :
[১]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া, ১০তম খণ্ড (দারুল ওয়াফা, ৩য় সংস্করণ ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), পৃ. ৩৫৪।
[২]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৮৪; মিশকাত, হা/১৬৫, সনদ ছহীহ।
[৩]. তিরমিযী, হা/২৬৪১; আল-মুসতাদরাক ‘আলাছ ছহীহাইন, হা/৪৪৪; মিশকাত, হা/১৭১, সনদ হাসান।
[৪]. আবূ দাঊদ, হা/৪৫৯৭; আল-মুসতাদরাক ‘আলাছ ছহীহাইন, হা/৪৪৩; মিশকাত, হা/১৭২, সনদ ছহীহ।
[৫]. আব্দুর রহমান আল-মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী বিশারহি জামি‘ঈত তিরমিযী, ৭ম খণ্ড (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, তা.বি.), পৃ, ৩৩৪; ওবাইদুল্লাহ আল-মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাছাবীহ, ১ম খণ্ড (বানারাস, হিন্দ : ইদারাতুল বুহূছিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াদ দা‘ওয়াতি ওয়াল ইরশাদ, ৩য় সংস্করণ ১৪০৪ হি./১৯৮৪ খ্রি.), পৃ. ২৭০।
[৬]. আব্দুল করীম আশ-শাহরস্তানী, আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, ১৪০৪ হি.),  পৃ. ১৩-১৪।
[৭]. আহমাদ ইবনু তাইমিয়্যাহ, আন-নুবুওয়াত (কায়রো : আল-মাতবা‘আতুস সালাফিয়্যাহ, ১৩৮৬ হি.), পৃ. ১৪২-১৪৩; আহমাদ ইবনু তাইমিয়্যাহ, দারউ তা‘আরুজিল ‘আক্বলি ওয়ান নাক্বলি, ৩য় খণ্ড (রিয়াদ : দারুল কুনূযিল আদাবিয়্যাহ, ১৩৯১ হি.), পৃ. ৫৬; মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৫০ এবং ১৭তম খণ্ড, পৃ. ৪৪৭।
[৮]. বদরুদ্দীন আঈনী আল-হানাফী, ঊমদাতুল ক্বারী শারহু ছহীহিল বুখারী, ২৪ তম খণ্ড (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, তা.বি.),  পৃ. ১৯৫।
[৯]. তুহফাতুল আহওয়াযী বিশারহি জামি‘ঈত তিরমিযী, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৪।
[১০]. ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস (মিসর : দারুর রাইয়ান লিত তুরাছ, তা.বি.), পৃ. ২৮-৩২।
[১১]. মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-‘উছায়মীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১ম খণ্ড (দারুল ওয়াত্বান, ১৪১৩ হি.), পৃ. ৩৮।
[১২]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৬৩; আত-ত্বাবারানী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৯০৬০।  
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৩৫১; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৬৪; আবূ দাঊদ, হা/৪৭৬৪। 
[১৪]. আবূ বকর শামসুদ্দীন আল-কুরতূবী, আল-জামি‘ঊ লি আহকামিল কুরআন, ৮ম খণ্ড (রিয়াদ : দারু ‘আলিমিল কুতুব, ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি.), পৃ. ১৬৬। 
[১৫]. ছালিহ ইবনু ফাওযান আল-ফাওযান, আল-বিদ‘আতু : তা‘রীফুহা ওয়া আনওয়া‘উহা ওয়া আহকামুহা (রিয়াদ : আল-মাকতাবুত তা‘আউনি লিদ দা‘ওয়াতি ওয়াল ইরশাদ, ৩য় সংস্করণ ১৪২২ হি.), পৃ. ১৫-১৬। 




বিদায় হজ্জের ভাষণ : তাৎপর্য ও মূল্যায়ন - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
ব্যভিচার ও ধর্ষণ: সমাধান কোন্ পথে
রামাযানের শেষ দশকের গুরুত্ব ও করণীয় - মাইনুল ইসলাম মঈন
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
আশূরায়ে মুহাররম - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ১১ রাক‘আতের নির্দেশ দিয়েছিলেন - ব্রাদার রাহুল হোসেন (রুহুল আমিন)
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক
বিদায় হজ্জের ভাষণ : তাৎপর্য ও মূল্যায়ন (শেষ কিস্তি) - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
যিলহজ্জ মাসের আমল ও তার ফযীলত - মুহাম্মাদ জাহিদুল ইসলাম
আল-কুরআনে বর্ণিত জাহেলি সমাজের দশটি চিত্র - তানযীল আহমাদ
জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার আবশ্যকতা - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ