বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৭ অপরাহ্ন

গোপন পাপ : ভয়াবহতা ও পরিত্রাণের  উপায় অনুসন্ধান

-ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ*


মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতি হল মানুষ নিজের অপরাধ আড়াল করতে চায়। হাজারো মানুষের কোলাহলে নিজেকে সবাই ভালো বলুক, আভিজাত্যে, মর্যাদায় ও সুনামে ঝরঝরে দেখা যাক- এটাই সে প্রত্যাশা করে থাকে। কারো কারো পক্ষে ভিতরগত অন্যায় বা গোপন পাপ ঢেকে রাখা কখনো কখনো নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য সম্ভব হলেও সর্বদা তা লুকিয়ে রাখা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠে না। মানুষ যখন জেনেবুঝে ইচ্ছাকৃতভাবে গোপনে গুনাহ করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন অন্তর থেকে ধীরে ধীরে মহান আল্লাহর ভয় বিদায় নিতে থাকে। অন্তর যখন তাক্বওয়াশূন্য হয়ে যায়, তখন অন্তর পাথরের মত শক্ত হতে থাকে। তখন তার কাছে ইসলামী ধ্যান-ধারণা  মোহনীয় ও প্রেমপূর্ণ লাগে না। ধর্মীয় বিধানাবলী বিরক্তকর মনে হতে থাকে। অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হয় না। মুনাজাতে চোখের পানি আসে না। এক পর্যায়ে তার কোন আমলে আর মন বসে না। ইবাদত করতে ভালো লাগে না। কুরআন তিলাওয়াত আর আগের মত মধুর মনে হয় না। ক্রমান্বয়ে সে ধ্বংস ও অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। জাহিলিয়াতের অন্ধকার গলিপথ তার কাছে আপন মনে হয়। মাঝে মাঝে সে অন্ধকারের নিমজ্জিত অবস্থা থেকে মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, কিন্তু বাঁচতে পারে না, তার পক্ষে ইউটার্ণ নেয়া আর সম্ভব হয়ে উঠে না। অবস্থা তো কখনো এতটা ভয়ানক হয় যে, তার ঈমান পর্যন্ত বিনষ্ট হয়ে যায় এবং ঈমানহীন অবস্থায়ই তার মৃত্যু ঘটে।

আর কেউ কেউ আছেন পাপ করতে করতে এক সময় পাপকে আর পাপই মনে করে না! তার কাছে পাপ করা তুচ্ছ ও সামান্য ব্যাপার হয়ে যায়। তখন আল্লাহর ক্রোধ আর পরকালের ভয়াবহ আযাবকে সে পরোয়া করে না। ফলে, এক পর্যায়ে মহান আল্লাহ তার জন্য পাপের কাজকে তার প্রিয় করে দেন! আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَفَمَنۡ زُیِّنَ لَہٗ  سُوۡٓءُ عَمَلِہٖ  فَرَاٰہُ حَسَنًا ؕ فَاِنَّ اللّٰہَ یُضِلُّ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ ۫ۖ فَلَا تَذۡہَبۡ نَفۡسُکَ عَلَیۡہِمۡ حَسَرٰتٍ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌۢ  بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ

‘যাকে মন্দকর্ম শোভনীয় করে দেখানো হয়, সে তাকে উত্তম মনে করে, সে কি সমান যে মন্দকে মন্দ মনে করে। নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচছা সৎপথ প্রদর্শন করেন। সুতরাং আপনি তাদের জন্য অনুতাপ করে নিজেকে ধ্বংস করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ জানেন তারা যা করে’ (সূরা আল-ফাতির : ৮)।

পাপ কাজ শোভনীয় মনে হতে হতে এক সময়ে সে পাপ কাজকে তখন ভালোবাসতে শুরু করে; ফলে তার তাওবাহ করার নসিব হয় না। আর এই অবস্থায় সে আল্লাহর ক্রোধ এবং অসন্তুষ্টি নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। এমন অনেক মানুষ রয়েছে, যারা অন্যদের কাছে ভালো মানুষ হিসাবে পরিচিত। নিয়মিত ছালাত পড়ে, দ্বীনদার, ধার্মিক, আলেম কিংবা আল্লাহওয়ালা বা তথাকথিত ‘বুজুর্গ’ হিসাবে তার পরিচিতি রয়েছে। প্রকাশ্যে তাকে পাপ কাজ করতে দেখা যায় না। কিন্তু গোপনে গোপনে তিনি নানা ধরনের গোনাহের কাজে লিপ্ত (সাধারণত বাংলাদেশের কিছু মাযারের সেবক ও পীরদের ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে)। আবার অনেকে প্রকাশ্যে ভালো মানুষ হলেও গোপনে কাবীরা গোনাহ করে। এটি একদিকে মুনাফেকী ও শঠতা, অন্যদিকে ধীরে ধীরে তার আমল ও ইবাদত নষ্ট হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এজন্য মহান আল্লাহ বলেন, وَ ذَرُوۡا ظَاہِرَ الۡاِثۡمِ وَ بَاطِنَہٗ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡسِبُوۡنَ الۡاِثۡمَ  سَیُجۡزَوۡنَ بِمَا کَانُوۡا  یَقۡتَرِفُوۡنَ ‘তোমরা প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন গোনাহ পরিত্যাগ কর। নিশ্চয় যারা গোনাহ করেছে, তারা অতিসত্বর তাদের কৃতকর্মের শাস্তি পাবে’ (সূরা আল-আন‘আম : ১২০)।

এ ধরনের গোপন পাপ কথার দ্বারা হতে পারে, চিন্তা বা নিয়তের দ্বারাও হতে পারে, আবার কর্মের দ্বারাও হতে পারে। যেমন, গোপনে ‘গাইরুল্লাহ’র নাম নিয়ে পশু যব্হ করা গোপন পাপ। রিয়া বা অন্যকে দেখানোর জন্য ইবাদত করার নিয়ত বা চিন্তা করা গোপন পাপ। আর অপ্রকাশ্য ব্যভিচার (পরকীয়া) বা গোপন যিনা (প্রেম) হল কর্মগত গোপন পাপ। মহান আল্লাহ বলেন,

قُلۡ  اِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّیَ الۡفَوَاحِشَ مَا ظَہَرَ  مِنۡہَا وَ  مَا بَطَنَ وَ الۡاِثۡمَ وَ الۡبَغۡیَ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ وَ اَنۡ تُشۡرِکُوۡا بِاللّٰہِ مَا لَمۡ یُنَزِّلۡ بِہٖ سُلۡطٰنًا وَّ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا عَلَی  اللّٰہِ  مَا لَا  تَعۡلَمُوۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা  কেবল অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য এবং হারাম করেছেন গোনাহ, অন্যায়-অত্যাচার আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার কোন, সনদ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জান না’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩৩)।

প্রকাশ্য গোনাহের চেয়ে গোপনে করা গোনাহ বেশি ভয়াবহ। কেননা যখন কেউ গোপনে গোনাহ করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন অন্তর থেকে আল্লাহর ভয় বিদায় নিয়ে নেয়। ক্রমাগত সে ধ্বংস ও অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। অবস্থা কখনো এত ভয়ানক হয় যে, তার ঈমান পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায় এবং ঈমানহীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বর্তমান সময়ে গোপন গোনাহের সরঞ্জাম অনেক বেশি, আর উপকরণগুলোও সহজলভ্য। আগের দিনে সিনেমা দেখতে অনেক দূর যেতে হত, অনেক টাকা খরচ হত, আর এখন মোবাইলে মোবাইলে সেকেন্ডে সেকেন্ড সিনেমা আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। ডেটা অন করে মোবাইল ওপেন করলেই হলো। তাই সমাজের মানুষ দিন দিন গোপন গোনাহে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া দ্বীনদার শ্রেণির মানুষ থেকে শুরু করে আলেমরাও বাদ পড়ছেন না। তীব্র ঈমানী শক্তি ছাড়া এ জাহিলিয়াত থেকে বাঁচা কোনভাবেই সম্ভব নয়।

বর্তমানে গোপন গুনাহের আসবাব অনেক বেশি। উপকরণগুলো অত্যন্ত সহজলভ্য। তাই আমাদের যুবসমাজ দিন দিন গোপন গুনাহে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া দ্বীনদার শ্রেণিও বাদ পড়ছে না। এর ভয়াবহ ফলাফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রচুর মানুষ এখন সংশয়ের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। দু’চারজন এটা নিয়ে চিন্তিত ও চিকিৎসা করার ব্যাপারে উদ্যোগী হলেও অধিকাংশ মানুষ এ ব্যাপারে উদাসীনই থেকে যাচ্ছে। শেষ যমানায় যে মানুষ ব্যাপকহারে ঈমানহারা হতে থাকবে, তার বাস্তবায়ন বোধহয় শুরু হয়ে গেছে। বর্তমানের ভয়ংকর এ সময়ে কতজন যে মুক্তি পাবে, তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন! ইমাম ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‎

والحذر الحذر من الذنوب، خصوصًا ذنوب الخلوات، فإن المبارزة لله تعالى تسقط العبد من عينه. وأصلح ما بينك وبينه في السر، وقد أصلح لك أحوال العلانية

‘গুনাহ থেকে পরিপূর্ণরূপে বেঁচে থাকা; বিশেষত গোপন গুনাহ থেকে। কেননা, আল্লাহর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বান্দাকে তাঁর নজর থেকে ফেলে দেয়। আল্লাহ ও তোমার মাঝে গোপনীয় বিষয় সংশোধন কর; তাহলে তিনি তোমার বহিরাগত বিষয় সংশোধন করে দেবেন’।[১] ইমাম ইবনুল আরাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

أخسر الخاسرين من أبدى لِلنَّاسِ صَالِح أعماله، وبارز بالقبيح من هُوَ أقرب إِلَيْهِ من حبل الوريد

‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ক্ষতিগস্ত সে-ই, যে মানুষের সামনে ভালো আমল করে, কিন্তু যে মহান সত্তা তার শাহরগ থেকেও অধিক নিকটবর্তী, তাঁর সামনে বদ আমল করে।[২] হাফিয ইবনু রজব হাম্বলী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

أَنَّ خَاتِمَةَ السُّوءِ تَكُونُ بِسَبَبِ دَسِيسَةٍ بَاطِنَةٍ لِلْعَبْدِ لَا يَطَّلِعُ عَلَيْهَا النَّاسُ، إِمَّا مِنْ جِهَةِ عَمَلٍ سَيِّئٍ وَنَحْوِ ذَلِكَ، فَتِلْكَ الْخَصْلَةُ الْخَفِيَّةُ تُوجِبُ سُوءَ الْخَاتِمَةِ عِنْدَ الْمَوْتِ

‘বান্দার গোপন গুনাহ ও অবাধ্যতার কারণে মন্দ মৃত্যু হয়ে থাকে, যা মানুষ জানে না; চাই তা খারাপ কোন আমল হোক বা অন্য কিছু। তার এ গোপন চরিত্রই তার মন্দ মৃত্যুর কারণ হয়’।[৩] আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, أجمع العارفون بالله أن ذنوب الخلوات هي أصل الانتكاسات ‘সব আল্লাহওয়ালা এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, গোপন গুনাহ-ই অধঃপতন ও অবনতির প্রধান কারণ’।[৪]

গোপন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার উপায়সমূহ

১. ভিতরগত অনুশোচনা ও পাপের জন্য কান্নাকাটি করা ও আল্লাহর কাছে দু‘আ করা; যেন তিনি তাঁর নাফরমানি ও সকল গুনাহ থেকে হিফাযত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اِذَا سَاَلَکَ عِبَادِیۡ عَنِّیۡ فَاِنِّیۡ قَرِیۡبٌ ؕ اُجِیۡبُ دَعۡوَۃَ الدَّاعِ  اِذَا دَعَانِ  ۙ فَلۡیَسۡتَجِیۡبُوۡا لِیۡ وَ لۡیُؤۡمِنُوۡا بِیۡ  لَعَلَّہُمۡ  یَرۡشُدُوۡنَ

‘আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে; বস্তুত আমি তো রয়েছি সন্নিকটেই। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রর্থনা কবুল করি, যখন তারা আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য, যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৬)।

২. নিজের ভিতরগত সত্তার সাথে যুদ্ধ করা, তার কুমন্ত্রণা দূর করা এবং আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَ نَفۡسٍ وَّ مَا سَوّٰىہَا - فَاَلۡہَمَہَا فُجُوۡرَہَا وَ تَقۡوٰىہَا- قَدۡ  اَفۡلَحَ  مَنۡ  زَکّٰىہَا- وَ  قَدۡ خَابَ مَنۡ  دَسّٰىہَا

‘শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, তাঁর। অতঃপর তাকে অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়। আর যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়’ (সূরা আশ-শামস : ৭-১০)। তিনি আরও বলেন,

وَ الَّذِیۡنَ جَاہَدُوۡا فِیۡنَا لَنَہۡدِیَنَّہُمۡ سُبُلَنَا ؕ وَ اِنَّ اللّٰہَ  لَمَعَ الۡمُحۡسِنِیۡنَ

‘যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথসমূহে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন’ (সূরা আল-আনকাবূত : ৬৯)।

৩. ক্বিয়ামতের দিন গোপন গুনাহকারীদের আমলসমূহ ধূলিকণার ন্যায় উড়িয়ে দেয়ার কথা মনের ভাবনায় চিরজাগরুক করে রাখা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

لَأَعْلَمَنَّ أَقْوَامًا مِنْ أُمَّتِيْ يَأْتُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِحَسَنَاتٍ أَمْثَالِ جِبَالِ تِهَامَةَ بِيْضًا، فَيَجْعَلُهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ هَبَاءً مَنْثُوْرًاগ্ধ، قَالَ ثَوْبَانُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ صِفْهُمْ لَنَا، جَلِّهِمْ لَنَا أَنْ لَا نَكُوْنَ مِنْهُمْ، وَنَحْنُ لَا نَعْلَمُ، قَالَ: ্রأَمَا إِنَّهُمْ إِخْوَانُكُمْ، وَمِنْ جِلْدَتِكُمْ، وَيَأْخُذُوْنَ مِنَ اللَّيْلِ كَمَا تَأْخُذُوْنَ، وَلَكِنَّهُمْ أَقْوَامٌ إِذَا خَلَوْا بِمَحَارِمِ اللهِ انْتَهَكُوْهَا

‘আমি আমার উম্মতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি, যারা ক্বিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালা সমতুল্য নেক আমল নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। ছাওবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)!, তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই। তিনি বললেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতই ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক, যারা একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত কর্মে লিপ্ত হবে’।[৫]

৪. আল্লাহ তা‘আলার পর্যবেক্ষণের কথা চিন্তা ও ক্ষমতা অবলোকন করা যে, তিনি আমাকে সর্বদাই দেখছেন এবং এ ব্যাপারে তাঁকে ভয় করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّ خَلَقَ مِنۡہَا زَوۡجَہَا وَ بَثَّ مِنۡہُمَا رِجَالًا کَثِیۡرًا وَّ نِسَآءً ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ الَّذِیۡ تَسَآءَلُوۡنَ بِہٖ وَ الۡاَرۡحَامَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلَیۡکُمۡ  رَقِیۡبًا

‘হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচ্ঞা করে থাক এবং আত্মীয় জ্ঞাতিদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন’ (সূরা আন-নিসা : ১)।

৫. পাপ, অন্যায় বা গুনাহ করার সময় এ চিন্তা করা যে, আমার শ্রদ্ধেয় বড় কেউ দেখলে কি আমি এমন গুনাহ করতে পারতাম? এভাবে নিজের লজ্জাবোধ জাগ্রত করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, وَاسْتَحِ اللهَ اسْتِحْيَاءَ رَجُلٍ ذِي هَيْبَةٍ مِنْ أَهْلِكِ ‘তুমি তোমার পরিবারের কোন প্রভাবশালী সদস্যকে যেমন লজ্জা পাও, আল্লাহকে (কমপক্ষে) তেমন লজ্জা কর’। [৬]

৬. নিজে মনে মনে এ চিন্তা করা যে, গুনাহরত অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হয়ে যায় তাহলে কিভাবে আমি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব। রাসূল (ﷺ) বলেন, يُبْعَثُ كُلُّ عَبْدٍ عَلَى مَا مَاتَ عَلَيْهِ ‘প্রত্যেক ব্যক্তিকে (ক্বিয়ামতের দিন) ঐ অবস্থায় উঠানো হবে, যে অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করেছে’।[৭]

৭. আল্লাহর নে‘মত ও জান্নাতের সুখ-শান্তির কথা স্মরণ করা এবং জাহান্নামের আযাব ও ভয়ানক শাস্তি কল্পনা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّ  الَّذِیۡنَ یُلۡحِدُوۡنَ فِیۡۤ  اٰیٰتِنَا لَا یَخۡفَوۡنَ عَلَیۡنَا ؕ اَفَمَنۡ یُّلۡقٰی فِی النَّارِ خَیۡرٌ  اَمۡ مَّنۡ یَّاۡتِیۡۤ  اٰمِنًا یَّوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ اِعۡمَلُوۡا مَا شِئۡتُمۡ ۙ اِنَّہٗ  بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ

‘নিশ্চয় যারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে বক্রতা অবলম্বন করে, তারা আমার কাছে গোপন নয়। যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে সে শ্রেষ্ঠ, না-কি যে ক্বিয়ামতের দিন নিরাপদে আসবে, সে? তোমরা যা ইচ্ছা কর। নিশ্চয় তিনি দেখেন, যা তোমরা করো’ (সূরা হামীম সিজদাহ : ৪০)।

৮. ব্যক্তিগত জীবনের অবসরে যিকির ও ফিকিরে থাকার চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ বলেন, اِنَّ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّہَارِ لَاٰیٰتٍ  لِّاُولِی الۡاَلۡبَابِ ‘নিশ্চয় আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধ সম্পন্ন লোকদের জন্য’ (সূলা আলে ইমরান : ১৯০)।  তিনি আরও বলেন,

الَّذِیۡنَ یَذۡکُرُوۡنَ اللّٰہَ  قِیٰمًا وَّ قُعُوۡدًا وَّ عَلٰی جُنُوۡبِہِمۡ وَ یَتَفَکَّرُوۡنَ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ رَبَّنَا مَا خَلَقۡتَ ہٰذَا بَاطِلًا ۚ سُبۡحٰنَکَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

‘যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও যমীন সৃষ্টির বিষযে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব আপনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি। সকল পবিত্রতা আপনারই, আমাদেরকে আপনি জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচান’ (সূরা আলে ইমরান : ১৯১)।

পরিশেষে বলব যে, আল্লাহ তা‘আলার কাছে আমরা ঈমানের জন্য নিয়মিত দু‘আ করতে থাকি। গোপন গুনাহ থেকে সর্বাত্মকভাবে বেঁচে থাকি। মোবাইল ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার থেকে দূরে থাকি। দ্বীনদার আলিমদের সোহবত বেশি বেশি ইখতিয়ার করি এবং কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার ও ইসলামী বই অধিকহারে অধ্যয়ন করতে শুরু করি। সুতরাং পাপ হয়ে গেলে দ্রুতই ফিরে আসতে হবে এবং তাওবাহ করতে হবে। পাপের মধ্য অটল থাকা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের হিফাযত করুন। শিরকমুক্ত ঈমান ও বিদ‘আতমুক্ত আমল করার তাওফীক দান করুন। ঈমানের হালতে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!!

 

* সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা), সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।

তথ্যসূত্র :
[১] ইবনুল জাওযী, সাইদুল খাতির (দামেস্ক : দারুল কলাম, তাবি), পৃ. ২০৭।
[২].‎ ইমাম ইবনুল আরাবী, তারিখু দিমাশক, ৫ম খণ্ড (বৈরূত : দারুল ফিকর, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৬।
[৩] হাফিয ইবনু রজব হাম্বলী জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম, ১ম খণ্ড (বৈরূত  মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, তাবি), পৃ. ১৭২-১৭৩।
[৪].‎ মাউক্বিউ দুরারিস সান্নিয়্যা, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪৩।
[৫]. ‎ইবনে মাজাহ, হা/৪২৪৫, সনদ ছহীহ।
[৬]. ‎ মুসনাদুল বযযার (মদীনা : মাকতাবাতুল উলুম ওয়াল হিকাম, তাবি), ৭ম খণ্ড, পৃ. ৮৯, হা/২৬৪২।
[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৭৮।




প্রসঙ্গসমূহ »: পাপ তারবিয়াত
মীলাদুন্নবী ও আমাদের অবস্থান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইসলামে ব্যবসায়িক মূলনীতি - ছাদীক মাহমূদ
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ (৩য় কিস্তি) - ড. মেসবাহুল ইসলাম
বিদ‘আত পরিচিতি (১৩তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৯তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আত্মহত্যাকারীর শারঈ বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন - মাইনুল ইসলাম মঈন
তাক্বওয়া অর্জনে ছিয়াম - প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৫তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ