সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১৮ অপরাহ্ন

দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব

-আব্দুল গাফফার মাদানী*



ইসলামে দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। একজন মুসলিমের প্রতি ইসলামের প্রথম বার্তাই হলো  اِقْرَاْ তথা পড়, ইলম অর্জন কর। ইসলাম থেকে শিক্ষাকে আলাদা করা অসম্ভব। কারণ, ইসলামের প্রতিটি অংশের মধ্যেই শিক্ষা বিদ্যমান। জ্ঞান ছাড়া যথাযথভাবে ইসলাম পালন সম্ভব নয়। দ্বীনি শিক্ষা ছাড়া ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন কোন ক্ষেত্রেই সত্যিকার অর্থে ইসলাম পালন সম্ভব নয়। তাবেঈ উমার ইবনু আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, من عمل على غير علم كان ما يفسد أكثر مما يصلح ‘যে ব্যক্তি দ্বীনি শিক্ষা ছাড়া আমল করবে সে সঠিকভাবে যতটুকু করবে না করবে, বরবাদ করবে তার চেয়ে বেশি’।[১] ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

الناس إلى العلم أحوج منهم إلى الطعام والشراب، لأن الرجل يحتاج إلى الطعام والشراب في اليوم مرة أو مرتين وحاجته إلى العلم بعدد أنفاسه

‘মানুষ খাদ্য ও পানীয়ের তুলনায় ইলমের প্রতি অধিক মুখাপেক্ষী। কেননা একজন ব্যক্তির দিনে একবার বা দু’বার খাবারের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ইলমের প্রতি তার প্রয়োজনীয়তা তার নিঃশ্বাস পরিমাণ’।[২]

দ্বীনি ইলমের বিভিন্ন স্তর ও ভাগ রয়েছে। একটি ভাগ ফরযে আইন ও ফরযে কেফায়া হিসাবে। ফরযে আইন বলা হয়, যা শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। বিশেষভাবে এই প্রকারের ইলমের ব্যাপারেই হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর ইলম অর্জন করা ফরয’।[৩] অপর ভাগ হল ফরযে কিফায়া, যা কিনা কিছু মানুষ অর্জন করলেই যথেষ্ট হবে।

ইলমের মর্যাদা

(ক) কুরআনুল কারীম হতে:  সর্বপ্রথম কুরআনী ওহীতেই ইলমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ- خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ عَلَقٍ - اِقۡرَاۡ وَ رَبُّکَ الۡاَکۡرَمُ - الَّذِیۡ عَلَّمَ بِالۡقَلَمِ - عَلَّمَ الۡاِنۡسَانَ مَا لَمۡ  یَعۡلَمۡ

‘পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন- সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত হতে। পাঠ করুন, আর আপনার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না’ (সূরা আল-‘আলাক্ব: ১-৫)। জ্ঞানী ও অন্যদের মর্যাদার তারতম্য সম্পর্কে অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ ہَلۡ  یَسۡتَوِی الَّذِیۡنَ یَعۡلَمُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান?’ (সূরা আয-যুমার: ৯)। জ্ঞানীদের মর্যাদা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমের অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, یَرۡفَعِ اللّٰہُ  الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ ۙ وَ الَّذِیۡنَ  اُوۡتُوا  الۡعِلۡمَ دَرَجٰتٍ ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে ইলম দান করা হয়েছে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন’ (সূরা আল-মুজাদালাহ: ১১)।

(খ) হাদীছুন নববী হতে: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, مَنْ يُرِدِ الله بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّيْنِ ‘আল্লাহ পাক যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের ছহীহ জ্ঞান দান করেন’।[৪] জ্ঞানের ব্যাপারে হিংসার বৈধতা সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন,

لَا حَسَدَ إِلَّا فِي اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالًا فَسُلِّطَ عَلَى هَلَكَتِهِ فِي الحَقِّ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ الحِكْمَةَ فَهُوَ يَقْضِي بِهَا وَيُعَلِّمُهَا

‘দুই ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো ব্যাপারেই হিংসা হতে পারে না। প্রথমতঃ আল্লাহ পাক যাকে সম্পদ দান করেছেন আর সে ন্যায়ের পথে খরচ করতে থাকে। দ্বিতীয়তঃ যাকে দ্বীনি জ্ঞান দান করেছেন আর সে তা দিয়ে বিচার করে এবং তা মানুষকে শেখায়’।[৫] অন্য হাদীছে এসেছে, مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنّةِ ‘যেই ব্যক্তি ইলম তলবের জন্য কোন পথ অবলম্বন করবে আল্লাহ পাক এর বদৌলতে তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেবেন’।[৬]

ছাফওয়ান ইবনু আস্সাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-এর কাছে আসলাম। তখন তিনি মসজিদে বসে ছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি এসেছি ইলম শিক্ষা করার জন্য। তিনি বললেন, ‘তালেবে ইলমকে মারহাবা। নিশ্চয় তালেবে ইলমকে ফিরিশতাগণ বেষ্টন করে রাখে এবং তাঁদের ডানা দিয়ে তাকে ছাঁয়া দিতে থাকে। অতঃপর তাঁরা সারিবদ্ধভাবে প্রথম আসমান পর্যন্ত মিলে মিলে দাঁড়িয়ে যায়। এসব কিছু তাঁরা সে যা অন্বেষণ করছে তার ভালোবাসায় করে’।[৭] হাদীছে ইলম অন্বেষণের রাস্তাকেও আল্লাহর রাস্তা বলা হয়েছে। যেমন, مَنْ خَرَجَ فِيْ طَلَبِ العِلْمِ فَهُوَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ حَتَّى يَرْجِعَ. ‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের জন্য বের হল সে আল্লাহর রাস্তায় বের হল’।[৮] অন্য বর্ণনায় এসেছে,

مَنْ جَاءَ مَسْجِدِيْ هَذَا، لَمْ يَأْتِهِ إِلّا لِخَيْرٍ يَتَعَلّمُهُ أَوْ يُعَلِّمُهُ، فَهُوَ بِمَنْزِلَةِ الْمُجَاهِدِ فِي سَبِيْلِ اللهِ

‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদে আসল শুধু একারণে যে, সে কোন কল্যাণের বাণী শিখবে অথবা শেখাবে সেই ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর ন্যায়’।[৯] অপর এক হাদীছে আরো বর্ণিত হয়েছে,

إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ: إِلّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُوْ لَهُ

‘যখন মানুষ মারা যায় তার সকল আমলের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি রাস্তা খোলা থাকে। এক. ছদকায়ে জারিয়া। দুই. এমন ইলম, যা থেকে (মানুষ) উপকৃত হয়। তিন. নেক সন্তান, যে তার জন্য দু’আ করে’।[১০] আরো ইরশাদ হয়েছে, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি, যে কুরআন মাজীদ শিক্ষা করে এবং শিক্ষা দেয়’।[১১]

ইলমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

(১) মহান আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি কলম: কলম ইলম অর্জনের মাধ্যম। আল্লাহ তা‘আলা প্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। ওবাদাহ ইবনু ছামিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللهُ الْقَلَمَ فَقَالَ اكْتُبْ.‏ فَقَالَ مَا أَكْتُبُ قَالَ اكْتُبِ الْقَدَرَ مَا كَانَ وَمَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى الأَبَدِ

‘আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে আদেশ করেন, ‘লিখ’। কলম বলল, কী লিখব? তিনি বললেন, তাক্বদীর লিখ, যা হয়েছে এবং অনন্তকাল পর্যন্ত যা হবে সবকিছুই’।[১২]

কলম ও লেখালেখি সম্পর্কে কিছু কথা: সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টির কারণে ইলমের গুরুত্ব ও ফযীলত প্রমাণিত হয়। আর এই লেখনির মাধ্যমেই যুগ যুগ ধরে ইলম সংরক্ষিত হয়ে আসছে। কুরআন নাযিল হওয়ার পর ছাহাবীগণ সাথে সাথে কুরআন লিখে নিয়েছেন। এছাড়াও কুরআনুল কারীমের ২৯তম পারায় ৬৮তম সূরা হল ‘সূরা আল-ক্বলম’। উমার ইবনুল খাত্তাব ও আনাস ইবনু মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তারা বলেছেন, قيّدوا العلم بالكتابة ‘তোমরা ইলমকে লেখনীর দ্বারা বন্দী করে ফেল’।[১৩]

লিখে রাখার কারণে আমরা হাদীছ পেয়েছি। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) ব্যতীত আর কারো নিকট আমার চেয়ে অধিক হাদীছ নেই। কারণ তিনি লিখে রাখতেন আর আমি লিখতাম না।[১৪] আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, অতঃপর ইয়ামানবাসী জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, اُكْتُبْ لِيْ يَا رَسُوْلَ اللهِ‏.‏ فَقَالَ اكْتُبُوْا لِأَبِيْ فُلَانٍ ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! (এ কথাগুলো) আমাকে লিখে দিন। তিনি (ছাহাবীদের) বললেন, তোমরা অমুকের পিতাকে লিখে দাও’।[১৫]

(২) ইলমের কারণে আদম (আলাইহিস সালাম)-কে ফেরেশতাদের উপরে মর্যাদা দেয়া হয়: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে সৃষ্টি করে তার সম্মানার্থে ফেরেশতাদেরকে সিজদা করার আদেশ করলে ফেরেশতাগণ সিজদা করেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আলাইহিস সালাম)-কে সৃষ্টি করে ইলম শিক্ষা দিলেন এবং ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ عَلَّمَ اٰدَمَ الۡاَسۡمَآءَ کُلَّہَا ثُمَّ عَرَضَہُمۡ عَلَی الۡمَلٰٓئِکَۃِ ۙ فَقَالَ اَنۡۢبِـُٔوۡنِیۡ بِاَسۡمَآءِ ہٰۤؤُلَآءِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ- قَالُوۡا سُبۡحٰنَکَ لَا عِلۡمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَکِیۡمُ

‘অতঃপর আল্লাহ আদমকে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিলেন। অতঃপর সেগুলোকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন এবং বললেন, তোমরা আমাকে এগুলোর নাম বল, যদি তোমরা (তোমাদের কথায়) সত্যবাদী হও। তারা বলল, সকল পবিত্রতা আপনার জন্য। আমাদের কোন জ্ঞান নেই, যতটুকু আপনি আমাদের শিখিয়েছেন ততটুকু ব্যতীত। নিশ্চয় আপনি মহা বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩১-৩২)। অতঃপর তিনি আদমকে বললেন, ‘হে আদম! তুমি এদেরকে ঐসবের নামগুলো বলে দাও। অতঃপর যখন আদম তাদেরকে ঐসবের নামগুলো বলে দিল, তখন আল্লাহ ফেরেশতাদের বললেন, আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আসমান ও যমীনের অদৃশ্য বিষয় সমূহ আমি সর্বাধিক অবগত এবং তোমরা যেসব বিষয় প্রকাশ কর ও যেসব বিষয় গোপন কর, সকল বিষয়ে আমি সম্যক অবহিত?’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৩৩)। এরপর আল্লাহ আদমকে সম্মানসূচক সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদের আদেশ দিলেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৩৩-৩৪)।

(৩) জ্ঞানের কারণে দুনিয়ায় মানুষকে সম্মান প্রদান করা হয়েছে: পৃথিবীতে যাকেই আল্লাহ সম্মানিত করেছেন ও আদর্শ বানিয়েছেন, তা করেছেন জ্ঞানের কারণে। কুরআনে নবী-রাসূল নন এমন কতক মর্যাদাবান ব্যক্তির আলোচনা এসেছে। যেমন- ১. খিযির (সূরা আল-কাহফ: ৬৫)। ২. লুক্বমান (সূরা লুক্বমান: ১২) এবং ৩. ত্বালূত (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৪৭)।

(৪) দ্বীনি শিক্ষা সকল ইবাদতের মূল: যে কোন আমল আল্লাহর কাছে কবুলযোগ্য হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। আমল কবুলের শর্ত তিনটি। যথা: (১) আক্বীদা বিশুদ্ধ হওয়া (২) তরীকা সঠিক হওয়া এবং (৩) ইখলাছে আমল। অর্থাৎ কাজটি নিঃস্বার্থভাবে কেবল আল্লাহর ওয়াস্তে হওয়া।[১৬] আর এগুলো জানার জন্য ইলমের প্রয়োজন। এছাড়াও তাওহীদ, শিরক, সুন্নাত, বিদ‘আত জানার জন্যও ইলমের প্রয়োজন। ‘আল্লাহ দুনিয়াতে দু’টি রাস্তা দেখিয়েছেন’ (সূরা আল-বালাদ:১০), ‘একটি শুকরিয়ার অন্যটি কুফরীর’ (সূরা আদ-দাহর: ৩)। ‘একটি শয়তানের অন্যটি রহমানের’। এগুলো জানার জন্য যেমনভাবে ইলমের প্রয়োজন। অনুরূপভাবে হক-বাতিল বা সঠিক-বেঠিক জানার জন্য ইলমের প্রয়োজন। ছালেহ আল-উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,‘ ইলম অর্জন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ’। ... আল্লাহ তা‘আলা দ্বীনের বুঝকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের সমতুল্য করেছেন। বরং তদপেক্ষা বেশী। কারণ ইলম ছাড়া মুজাহিদ জিহাদ করতে পারে না; মুছল্লী ছালাত আদায় করতে পারে না; যাকাত আদায়কারী যাকাত দিতে পারে না; ছায়েম ছিয়াম পালন করতে পারে না; হাজী হজ্জ করতে পারে না; ওমরাহকারী ওমরাহ করতে পারে না; খাদ্য গ্রহণকারী খাদ্য খেতে পারে না; পানকারী পান করতে পারে না; ঘুমন্ত ব্যক্তি ঘুমাতে পারে না; জাগ্রত ব্যক্তি ঘুম থেকে জাগতে পারে না। তাই ইলম হল সবকিছুর মূল’।[১৭]

(৫) আক্বীদা ও আমল ছহীহ হওয়ার ভিত্তি ইলম: কথা ও কাজের পূর্বশর্ত হল ইলম। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

إن العلم إمام العمل، وقائد له، والعمل تابع له ومؤتم به، فكل عمل لايكون خلف العلم مقتديا به فهو غير نافع لصاحبه، بل مضر عليه، كما قال بعض السلف: من عبد الله بغير علم كان ما يفسد أكثر مما يصلح

‘নিশ্চয় ইলম আমলের নেতা ও তার পরিচালক। আর আমল ইলমের অনুগামী ও তার অনুসারী। আমল যদি ইলমের পিছনে না থাকে এবং তার অনুসারী না হয় তাহলে তা তার জন্য উপকারী হবে না। বরং তার জন্য ক্ষতিকর হবে। যেমন কোন একজন সালাফ বলেছেন, ‘ইলম ছাড়া যে আল্লাহর ইবাদত করে সে কল্যাণের চেয়ে বেশী ক্ষতি করে’।[১৮]

(৬) সম্পদের চেয়ে ইলম উত্তম: সকল মানুষই সম্পদের প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকে। অথচ দুনিয়া ও আখেরাতে তার সম্পদের তুলনায় ইলম অনেক বেশী উপকারী ও উত্তম। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

العلمُ خيرٌ مِن المالِ، العلمُ يحرُسُكَ، وأنتَ تحرُسُ المال، المالُ يُنقِصُه النفقةُ، والعلمُ يزكو على الإنفاقِ، ‘

‘সম্পদের চেয়ে জ্ঞান উত্তম। জ্ঞান আপনাকে রক্ষা করে আর আপনি সম্পদকে রক্ষা করেন। অর্থ ব্যয় করলে কমে যায় আর জ্ঞান ব্যয় করলে বৃদ্ধি পায়’।[১৯] ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অনেক দিক থেকে সম্পদের চেয়ে ইলমের মর্যাদা বেশী’।[২০] যেমন,

১.   ইলম হল নবীগণের মীরাছ আর সম্পদ হল ধনীদের মীরাছ।
২.  নিশ্চয় ইলম তার মালিককে পাহারা দেয়, কিন্তু সম্পদ মালিককে পাহারা দেয় না, বরং মালিককে তার সম্পদ পাহারা দিতে হয়।
৩.  সম্পদ খরচ করলে কমে যায়, আর ইলম খরচ করলে বৃদ্ধি পায়।
৪.   নিশ্চয় সম্পদের মালিক মারা গেলে তার থেকে সম্পদ পৃথক হয়ে যায়, আর ইলম তার মালিকের সাথে কবরে প্রবেশ করবে।
৫.  সম্পদের উপর ইলমের হুকুম প্রযোজ্য হয়, কিন্তু ইলমের উপর সম্পদের হুকুম প্রযোজ্য হয় না।
৬.  সম্পদ মুমিন-কাফের ও ভালো-মন্দ সকলে অর্জন করতে পারে। কিন্তু উপকারী ইলম মুমিন ছাড়া কেউ অর্জন করতে পারে না।
৭.   সম্পদ মানুষকে অবাধ্যতা, অহংকার ও হিংসার দিকে নিয়ে যায় আর ইলম মানুষকে বিনয় ও আল্লাহর ইবাদতের দিকে নিয়ে যায়।
৮.  সম্পদের মালিকের দরিদ্র হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিন্তু ইলমের মালিকের দরিদ্র হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
৯.  নিশ্চয় ইলম মানুষকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করে আর সম্পদ মানুষকে দুনিয়ার দিকে ধাবিত করে।
১০.  সম্পদশালী মৃত্যুকে অপসন্দ করে আর আলেম আল্লাহর সাক্ষাতের আশা করে।

(৭) দ্বীনি ক্ষতি থেকে বাঁচায়: দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতি থেকে বাচার জন্য সূরা আছরে আল্লাহ চারটি গুণের কথা বলেছেন। তন্মধ্যে ঈমান তথা ইলম হল প্রথম। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ الۡعَصۡرِ -اِنَّ  الۡاِنۡسَانَ لَفِیۡ خُسۡرٍ-اِلَّا  الَّذِیۡنَ  اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ تَوَاصَوۡا بِالۡحَقِّ ۬ۙ  وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ 

‘নিশ্চয় সকল মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তারা ব্যতীত যারা (জেনে-বুঝে) ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে এবং পরস্পরকে ‘হক’-এর উপদেশ দিয়েছে ও পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে’ (সূরা আল-আছর: ২-৩)। মূলত জানার নামই ঈমান। আর ঈমানের পূর্ব শর্ত হল ইলম (সূরা মুহাম্মাদ: ১৯)। তদুপরি দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের জন্য ইলমের প্রয়োজন। ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

من أراد الدنيا فعليه بالعلم ومن أراد الآخرة فعليه بالعلم ومن أرادهما معا فعليه بالعلم أيضا

‘যে দুনিয়া চায় তার জন্য ইলম অর্জন করা যরূরী, যে আখেরাত চায় তার জন্যও ইলম অর্জন করা যরূরী। আর যে (দুনিয়া ও আখিরাত) উভয়টিই চায় তার জন্যও ইলম অর্জন করা যরূরী’।[২১]

(৮) দ্বীনি শিক্ষার কারণে বান্দা রিযিক প্রাপ্ত হয়: আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ)-এর যুগে দুই ভাই ছিল। তাদের একজন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত থাকত এবং অন্যজন আয়-উপার্জনে লিপ্ত থাকত। একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট সেই উপার্জনকারী ভাই তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। তিনি তাকে বললেন,لَعَلَّكَ تُرْزَقُ بِهِ  ‘হয়তো তার অসীলায় তুমি রিযিকপ্রাপ্ত হচ্ছ’।[২২]

(৯) দ্বীনি শিক্ষা আল্লাহর পক্ষ থেকে নে‘মত: আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নে‘মত হল ইলম। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে লক্ষ্য করে বলেন,

وَ اَنۡزَلَ اللّٰہُ عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ عَلَّمَکَ مَا لَمۡ تَکُنۡ تَعۡلَمُ ؕ وَ کَانَ فَضۡلُ اللّٰہِ عَلَیۡکَ عَظِیۡمًا

‘আর আল্লাহ তোমার উপর কিতাব ও সুন্নাহ অবতীর্ণ করেছেন এবং তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন যা তুমি জানতে না। বস্তুত তোমার উপর আল্লাহর করুণা অসীম’ (সূরা আন-নিসা: ১১৩)।  আর যাকে এই ইলম দেয়া হয়েছে তাকেই মূলত কল্যাণ দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, یُّؤۡتِی الۡحِکۡمَۃَ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ مَنۡ یُّؤۡتَ الۡحِکۡمَۃَ فَقَدۡ اُوۡتِیَ خَیۡرًا کَثِیۡرًا  ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষ প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে উক্ত প্রজ্ঞা দান করা হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৬৯)। আল্লাহ ইলমের মত নে‘মত তাঁর প্রিয় বান্দা তথা নবী-রাসূলদেরকে দিয়েছেন। যেমন- ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) (সূরা ইউসুফ: ২২), মূসা (আলাইহিস সালাম) (সূরা আল-ক্বাছাছ: ১৪), ঈসা (আলাইহিস সালাম) (সূরা আল-মায়েদাহ: ১১০), দাঊদ (আলাইহিস সালাম) (সূরা ছোয়াদ: ২০), সুলায়মান (আলাইহিস সালাম) (সূরা আল-আম্বিয়া: ৭৯; সূরা নামল: ১৫)।

(১০) আলেমগণ হলেন নবীদের উত্তরসূরি: নবীগণ কোন স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রা উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে যাননি; তাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে গেছেন শুধু ইলম। নবী (ﷺ) বলেন,

وَإِنَّ العُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلَا دِرْهَمًا وَإِنَّمَا وَرَّثُوا العِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بحَظٍّ وَافِرٍ

‘উলামা সম্প্রদায় পয়গম্বরদের উত্তরাধিকারী। আর এ কথা সুনিশ্চিত যে, পয়গম্বরগণ কোন রৌপ্য বা স্বর্ণ মুদ্রার কাউকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে যাননি; বরং তাঁরা ইলমের (দ্বীনী জ্ঞানভাণ্ডারের) উত্তরাধিকারী বানিয়ে গেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা অর্জন করল, সে পর্যাপ্ত অংশ লাভ করল’।[২৩]

তাই আসুন! আমরা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য হাসিলের চেতনা নিয়ে দ্বীনী জ্ঞান নিজে অর্জন করি এবং আমাদের সন্তানদের দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করি। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে নেক তাওফীক দান করুন। আমীন!!


*  শিক্ষক, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. তারীখে তাবারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৫৭২।
[২]. ফাতাওয়াউল ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৪৭২৭৩।
[৩]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৪।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৩৭।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩; ছহীহ মুসলিম, হা/৮১৬।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৯।
[৭]. ত্ববারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৭৩৪৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হা/৫৫০।
[৮]. তিরিমিযী, হা/২৬৪৭।
[৯]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৪১৯।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৩১।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০২৭।
[১২]. তিরমিযী, হা/২১৫৫; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৩৩।
[১৩]. হাকেম, আল-মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন, হা/৩৬০; দারেমী, হা/৪৯৮।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৩।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/১১২।
[১৬]. সূরা আয-যুমার: ২; মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন, সূরা আছর ৩ নং আয়াতের তাফসীর দ্র.।
[১৭]. শারহু রিয়াযিছ ছালেহীন, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪১৩-৪১৪।
[১৮]. মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ, পৃ. ২।
[১৯]. ফাযলুল ইলম ওয়াল ওলামা, পৃ. ১৫৬; ইবনে আসাকির, তারীখে দিমাশক, ৫০শ খণ্ড, পৃ. ৫৭১; ইমাম গাযযালী, ইহইয়া উলূমুদ্দীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৭-১৮।
[২০]. ফাযলুল ইলম ওয়াল ওলামা, পৃ. ৯-২২৪।
[২১]. https://marj3y.com/صحة-من-أراد-الدنيا-فعليه-بالعلم-ومن-أرا/) ।
[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১।
[২৩]. আবূ দাঊদ, হা/৩৬৪৩; তিরমিযী, হা/২৬৮২; ইবনু মাজাহ, হা/২২৩।




প্রসঙ্গসমূহ »: শিক্ষা-সংস্কৃতি
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৮ম কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
পরনিন্দা চর্চা ও তার পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৪র্থ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সুন্নাতের রূপরেখা (শেষ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১২তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
সুন্নাতের রূপরেখা (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
অল্পে তুষ্ট (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মহামারী থেকে বেঁচে থাকার দশটি উপদেশ - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
বাউল মতবাদ (শেষ কিস্তি) - গোলাম রহমান
আশূরায়ে মুহাররম - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (২য় কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ

ফেসবুক পেজ