মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১১:৫২ অপরাহ্ন

ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) -এর আগমন : সংশয় নিরসন

 -হাসিবুর রহমান বুখারী*


(৪র্থ কিস্তি) 

দাজ্জাল ও বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট

ইসলাম একটি বাস্তবধর্মী জীবন ব্যবস্থা। গুজব, অনুমান, জনশ্রুতি, আজগুবি গল্প ও মিথ্যা রটনার সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং মুসলিম জাতিকে বাস্তবতা উপলব্ধি করা উচিত। দুঃখজনক হল, আজ সিংহভাগ মানুষ গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলছে। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার প্রবণতা অত্যধিক ক্ষীণ। ‘আক্বীদা-ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় জ্ঞান এতটাই দুর্বল যে, যে কোন বক্তা অনায়াসেই আমাদেরকে ভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যেতে পারছে। দলীলবিহীন আলোচনা, ভ্রান্ত মতবাদ ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যাকেও দ্বিধাহীনভাবে শরী‘আতের মানদ- হিসাবে গ্রহণ করছি।

করোনা ভাইরাসের প্রাক্কালে নানাবিধ গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। লকডাউনের সময় মানুষের হাতে ছিল অফুরন্ত অবসর সময়। একশ্রেণির মানুষ ঐ অবসর সময়কে কল্যাণকর কাজে ব্যবহার না করে গুজব রটনায় লিপ্ত থেকেছে। আর সাধারণ মানুষেরা খুব সহজেই ঐ সমস্ত গুজব বিশ্বাস করেছে। তবে যারা এভাবে গুজব রটাচ্ছে তাদের মতলব মোটেও ভাল নয়। এ সব জনশ্রুতি ও গুজবের মধ্যে একটি হল, দাজ্জালের আবির্ভাব সংক্রান্ত বিষয়। ইসরাইলের কোন এক রাব্বি না-কি দাজ্জালের জন্মের সংবাদ দিয়েছে। অথচ ছহীহ হাদীছের মাধ্যমে বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বহু পূর্ব হতেই দাজ্জাল পৃথিবীর একটি দ্বীপে লোহার শিকলে বন্দী আছে। আল্লাহর আদেশ হলেই মুক্তি পেয়ে ভূপৃষ্ঠে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।[১]

উন্নত প্রযুক্তির এই যুগেই যে সমস্ত গুজবের সূত্রপাত হয়েছে তা নয়, বরং ছাহাবীদের যুগের পরই এ ধরনের নানা গুজব মুসলিম সমাজে চালু হয়েছে। উমাইয়াহ ও আব্বাসী যুগ এবং তার পরবর্তী যুগসমূহেও ইমাম মাহদী ও দাজ্জাল নিয়ে মুসলিম বিশ্বে নানাবিধ আজগুবি গল্প ও মিথ্যা রটনা ছড়ানো হয়েছে। তাই আমাদের প্রত্যেককেই দাজ্জাল, ইমাম মাহদী ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে একটু চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। কারণ বিষয়গুলো সম্পর্কে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সঠিক জ্ঞান থাকলে এ নিয়ে ছড়ানো গুজব ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্যগুলো আমাদের অস্থির করতে পারবে না। আমাদের অজ্ঞতার কারণেই কুচক্রি মহল এমন সব দলীলবিহীন কথা প্রচার করে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা ছড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে। অনেক আলিম-উলামাও এই চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। ‘দাজ্জাল তো চলে এসেছে’, এই গুজবের বশবর্তী হয়ে অনেকেই ঘর-সংসার পর্যন্ত ত্যাগ করেছে।

দাজ্জাল বলতে কী বুঝানো হয়েছে? সে সম্পর্কেও চক্রান্তকারীরা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। একজন আদর্শ মুমিনের দায়িত্ব কুরআন ও হাদীছের বক্তব্যগুলো সরল অর্থে বিশ্বাস করা। দাজ্জাল সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যতটুকু বর্ণনা দিয়েছেন, ঠিক ততটুকুই বিশ্বাস করা। এগুলোর ব্যাখ্যা ও প্রকৃতি জানা আমাদের দায়িত্ব নয়। কারণ এটা আক্বীদার বিষয়। অথচ এ ক্ষেত্রেও অনেকেই ভিত্তিহীন ও অন্তহীন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। যেমন,

মুহাম্মাদ আসাদ ও ভারতের মানাজির আহসান গিলানী বলেছিলেন, ‘পাশ্চাত্য সভ্যতাই হচ্ছে দাজ্জাল’। কেউ বলেছেন, ‘মোবাইল বা টিভিই হচ্ছে দাজ্জাল’। আসলে দাজ্জাল কে? ইসরাইলের রাষ্ট্র, না-কি আমেরিকা? দাজ্জাল কি আবির্ভূত হয়েছে, না-কি ভবিষ্যতে হবে? কখন তার আবির্ভাব ঘটবে? ইসরাইলের সঙ্গে দাজ্জালের কী সম্পর্ক? দাজ্জাল না-কি অনেক আগে থেকেই গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে? জনৈক বক্তা বলেছেন, দাজ্জাল না-কি জেরুজালেম থেকে আবির্ভূত হবে? জেরুজালেম থেকে বিশ্বকে শাসন করবে?

হাদীছে যে ভূমিধ্বসের কথা বলা হয়েছে তা কি তুরস্কের ভূমিকম্প? না-কি ইরানের ভূমিকম্প? না-কি জাপানের সুনামি? তা কি ভবিষ্যতে ঘটবে? কবে ঘটবে? ইয়াজূজ-মা’জূজ কারা, তারা কী তাতার? না-কি চেঙ্গিশ খানের বাহিনী? অথবা চীন জাতি? না অন্য কোনো জাতি? তারা কোথায় আছে? তারা কী বের হয়েছে, না-কি এখনো তাম্র  দ্বারা নির্মিত প্রাচীরের মধ্যে আবদ্ধ রয়েছে?

ক্বিয়ামতের আলামত বিষয়ক এ জাতীয় সহস্র প্রশ্ন আজ আমাদের সমাজে বিদ্যমান। অনেকেই এ সমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার নামে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। অথচ এ ধরনের গায়েবী বা অদৃশ্যের বিষয় নিয়ে গবেষণার নামে তর্ক-বিতর্ক করে কখনোই কোনো সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইয়াজূজ-মাজূজ বা দাজ্জাল বলতে কী বুঝিয়েছেন সে বিষয়ে হাজার বছর এভাবে গবেষণা নামের প্রলাপ-বিলাপ ও তর্ক-বিতর্ক করেও সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না।

আলেমগণ বলেন, ‘এ সকল বিষয়ে কেবল ছহীহ হাদীছের উপরই নির্ভর করতে হবে। এটিই আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি। শুধু ছহীহ হাদীছের উপর নির্ভর করা, দুর্বল ও জাল বর্ণনা বর্জন করা এবং ছহীহ হাদীছে বর্ণিত বিষয়গুলোকে অপব্যাখ্যা না করে সরল অর্থে বিশ্বাস করা। এ সব ফিতনা নিয়ে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করা মোটেও কাম্য নয়। এ সব ভবিষ্যদ্বাণীর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিমদের মন প্রস্তুত করা। পরিস্থিতি যতই মন্দ হোক না কেন সর্বাবস্থায় ঈমানের উপর সুদৃঢ়, সুপ্রতিষ্ঠিত ও অটল থাকার কথা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে চেয়েছেন। নাওওয়াস ইবনু সাম‘আন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

ذَكَرَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ الدَّجَّالَ ذَاتَ غَدَاةٍ فَخَفَّضَ فِيْهِ وَرَفَّعَ حَتَّى ظَنَنَّاهُ فِىْ طَائِفَةِ النَّخْلِ فَلَمَّا رُحْنَا إِلَيْهِ عَرَفَ ذَلِكَ فِيْنَا فَقَالَ مَا شَأْنُكُمْ؟ قُلْنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ ذَكَرْتَ الدَّجَّالَ غَدَاةً فَخَفَّضْتَ فِيْهِ وَرَفَّعْتَ حَتَّى ظَنَنَّاهُ فِىْ طَائِفَةِ النَّخْلِ. فَقَالَ غَيْرُ الدَّجَّالِ أَخْوَفُنِىْ عَلَيْكُمْ إِنْ يَخْرُجْ وَأَنَا فِيكُمْ فَأَنَا حَجِيْجُهُ دُوْنَكُمْ وَإِنْ يَخْرُجْ وَلَسْتُ فِيْكُمْ فَامْرُؤٌ حَجِيْجُ نَفْسِهِ وَاللهُ خَلِيْفَتِىْ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ.

‘একদা সকালে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করলেন। আলোচনার সময় তিনি তার ব্যক্তিত্বকে তুচ্ছ করে তুলে ধরেন। পরে অনেক গুরুত্ব সহকারে উপস্থিত করেন, যাতে আমরা ঐ বৃক্ষরাজির নির্দিষ্ট এলাকায় (তার অবস্থানস্থল সম্পর্কে) ধারণা করতে লাগলাম। এরপর আমরা সন্ধ্যায় আবার তার কাছে গেলাম। তিনি আমাদের মাঝে এর প্রভাব দেখতে পেয়ে বললেন, তোমাদের ব্যাপার কী? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি সকালে দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কখনো তার ব্যক্তিত্বকে তুচ্ছ করে তুলে ধরেছেন, আবার কখনো তার ব্যক্তিত্বকে বড় করে তুলে ধরেছেন। ফলে আমরা মনে করেছি যে, দাজ্জাল বুঝি এই বাগানের মধ্যেই বিদ্যমান। এ কথা শুনে তিনি বললেন, দাজ্জাল নয়, বরং আমি তোমাদের ব্যাপারে অন্য ফিতনার ভয় করছি। তবে শোন! আমি তোমাদের মধ্যে বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যদি দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ হয়, তবে আমি নিজেই তাকে প্রতিহত করব। তোমাদের প্রয়োজন হবে না। আর যদি আমি তোমাদের মাঝে না থাকাবস্থায় দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ হয়, তবে প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তি নিজের পক্ষ হতে তাকে প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট হবে। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই হলেন আমার পক্ষ হতে তত্ত্বাবধানকারী বা স্থলাভিষিক্ত’।[২]

দাজ্জালের পরিচয়

‘দাজ্জাল’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ভণ্ড, মিথ্যুক, প্রতারক, দুষ্ট। ইসলামী পরিভাষায় ক্বিয়ামতের পূর্বে যে মহা প্রতারকের আবির্ভাব হবে তাকে ‘মাসীহুদ দাজ্জাল’ বলা হয়। ওলামায়ে কেরাম বলেন, দাজ্জালকে মাসীহ এ জন্যই বলা হয় যে, তার এক চক্ষু সম্পূর্ণরূপে লেপা ও মাংস দ্বারা আবৃত। আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

‏اَلدَّجَّالُ مَمْسُوْحُ الْعَيْنِ مَكْتُوْبٌ بَيْنَ عَيْنَيْهِ كَافِرٌ ثُمَّ تَهَجَّاهَا ك ف ر  يَقْرَؤُهُ كُلُّ مُسْلِمٍ.

‘দাজ্জালের এক চক্ষু লেপা হবে। তার উভয় চোখের মধ্যস্থলে কাফির লেখা থাকবে। অতঃপর তিনি এক একটি অক্ষর পৃথক-পৃথকভাবে উচ্চারণ করে বললেন, ك, ف ,ر -কাফ, ফা, র। আর প্রত্যেক মুসলিম এ লেখা পড়তে পারবে’।[৩]

অতএব ‘দাজ্জাল’ শব্দের অর্থ হল- বিভ্রান্তি ও প্রতারণা। দাজ্জাল বলতে বুঝায় ছদ্মবেশী মিথ্যাবাদীকে, যে নিরন্তর মিথ্যা বলে মানুষকে ধোঁকা দেয়। এখন ‘দাজ্জাল’ শব্দটি একচক্ষু বিশিষ্ট মিথ্যাবাদীর চিহ্ন বা প্রতীক হিসাবে গৃহীত হয়েছে এবং দাজ্জালকে দাজ্জাল এ জন্যই বলা হয় যে, সে মানুষের সঙ্গে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করবে এবং সে তার কুফরী ও নিন্দনীয় বিষয়গুলো মিথ্যা দ্বারা আবৃত করে রাখে।[৪]

যে নিজেকে ‘ঈশ্বর’ বা ‘ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী ব্যক্তিত্ব’ বলে দাবি করবে এবং তার ঈশ্বরত্ব প্রমাণের জন্য বহু অলৌকিক কর্মকা- দেখাবে। অনেক মানুষ তাকে বিশ্বাস করে ঈমানহারা হবে। প্রকৃতপক্ষে তার সমস্ত কর্মকা-ই হবে ইন্দ্রজাল, ম্যাজিক ও জাদু কেন্দ্রিক। যার সবথেকে জোরালোতম প্রমাণ হল, ‘সে নিজেই নিজের চোখ ঠিক করতে পারবে না। যদি সত্যিই সে ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী হত, তাহলে অবশ্যই সে দোষত্রুটি থেকে মুক্ত হত’।

দাজ্জাল মানব জাতিরই একজন হবে। মুসলিমদের কাছে তার পরিচয় তুলে ধরার জন্য এবং তার ফিতনা থেকে তাদেরকে সতর্ক করার জন্য নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার পরিচয় বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। যাতে মুমিন বান্দাগণ তাকে দেখে সহজেই চিনতে পারে এবং তার ফিতনা থেকে নিরাপদে থাকতে পারে। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার যে সমস্ত পরিচয় উল্লেখ করেছেন মুমিনগণ তা পূর্ণ অবগত থাকবে। দাজ্জাল অন্যান্য মানুষের তুলনায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী হবে। জাহেল-মূর্খ ও হতভাগ্য ব্যতীত কেউ দাজ্জালের ধোঁকায় পড়বে না।

মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাজ্জালকে স্বপ্নে দেখে তার শারীরিক গঠনের বর্ণনা প্রদান করেছেন এভাবে,

ثُمَّ ذَهَبْتُ أَلْتَفِتُ فَإِذَا رَجُلٌ جَسِيْمٌ أَحْمَرُ جَعْدُ الرَّأْسِ أَعْوَرُ الْعَيْنِ كَأَنَّ عَيْنَهُ عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ قَالُوْا هَذَا الدَّجَّالُ 

‘অতঃপর আমি তাকাতে লাগলাম, হঠাৎ দেখতে পেলাম, এক ব্যক্তি স্থুলকায় লাল বর্ণের, কোঁকড়ানো চুল, এক চোখ কানা, চোখটি যেন ফোলা আঙ্গুরের মত। লোকেরা বলল, এ-হল দাজ্জাল’![৫]

দাজ্জাল নির্বংশ হবে। তার কোন সন্তান-সন্ততি থাকবে না। যেমন হাদীছে এসেছে, আবূ সাঈদ খুদ‌রী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

صَحِبْتُ ابْنَ صَائِدٍ إِلَى مَكَّةَ فَقَالَ لِىْ أَمَا قَدْ لَقِيْتُ مِنَ النَّاسِ يَزْعُمُوْنَ أَنِّى الدَّجَّالُ أَلَسْتَ سَمِعْتَ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ يَقُوْلُ إِنَّهُ لَا يُوْلَدُ لَهُ. قَالَ قُلْتُ بَلَى. قَالَ فَقَدْ وُلِدَ لِىْ. أَوَلَيْسَ سَمِعْتَ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ يَقُوْلُ لَا يَدْخُلُ الْمَدِيْنَةَ وَلَا مَكَّةَ. قُلْتُ بَلَى قَالَ فَقَدْ وُلِدْتُ بِالْمَدِيْنَةِ وَهَذَا أَنَا أُرِيْدُ مَكَّةَ

‘একদিন মক্কা যাওয়ার পথে ইবনু সাইয়্যাদ মক্কা পর্যন্ত আমার সফর সঙ্গী ছিল। পথে সে আমাকে বলল, এমন কতিপয় লোকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, যারা ধারণা করে যে, আমিই দাজ্জাল। আপনি কি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেননি যে, দাজ্জালের কোন সন্তান হবে না? আমি বললাম, হ্যাঁ, শুনেছি। তখন সে বলল, আমার তো সন্তানাদি রয়েছে। আপনি কি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেননি যে, দাজ্জাল মক্কা ও মদীনাতে ঢুকতে পারবে না? আমি বললাম, হ্যাঁ, শুনেছি। সে বলল, মনে রাখুন, আমি তো মাদীনায় জন্মগ্রহণ করেছি এবং এখন মক্কা যাওয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছি’।[৬]

দাজ্জালকে চেনার সবচেয়ে বড় নিদর্শন হল, তার কপালে কাফির (كافر) লেখা থাকবে।[৭] অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘অতঃপর তিনি এক একটি অক্ষর পৃথক-পৃথকভাবে উচ্চারণ করে বললেন, ك, ف ,ر - কাফ, ফা, র। আর মুসলিম মাত্রই প্রত্যেকে এ লেখা পাঠ করতে পারবে’।[৮] তিনি বলেন, ‘দাজ্জাল হবে বৃহদাকার একজন যুবক পুরুষ, শরীরের রং হবে লাল, বেঁটে, মাথার চুল হবে কোঁকড়া, কপাল হবে উঁচু, বক্ষ হবে প্রশস্ত, চক্ষু হবে টেরা এবং আঙ্গুর ফলের মত উঁচু’।[৯]

হুজায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

لَأَنَا أَعْلَمُ بِمَا مَعَ الدَّجَّالِ مِنْهُ مَعَهُ نَهْرَانِ يَجْرِيَانِ أَحَدُهُمَا رَأْىَ الْعَيْنِ مَاءٌ أَبْيَضُ وَالْآخَرُ رَأْىَ الْعَيْنِ نَارٌ تَأَجَّجُ فَإِمَّا أَدْرَكَنَّ أَحَدٌ فَلْيَأْتِ النَّهْرَ الَّذِىْ يَرَاهُ نَارًا وَلْيُغَمِّضْ ثُمَّ لْيُطَأْطِئْ رَأْسَهُ فَيَشْرَبَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مَاءٌ بَارِدٌ وَإِنَّ الدَّجَّالَ مَمْسُوْحُ الْعَيْنِ عَلَيْهَا ظَفَرَةٌ غَلِيْظَةٌ مَكْتُوْبٌ بَيْنَ عَيْنَيْهِ كَافِرٌ يَقْرَؤُهُ كُلُّ مُؤْمِنٍ كَاتِبٍ وَغَيْرِ كَاتِبٍ

‘দাজ্জালের সাথে কী থাকবে, এ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত অবগত আছি। তার সাথে প্রবহমান দু’টি নদী থাকবে। একটি দৃশ্যত ধবধবে সাদা পানি বিশিষ্ট এবং অপরটি দৃশ্যত লেলিহান অগ্নির মতো হবে। যদি কেউ সুযোগ পায় তবে সে যেন ঐ নহরে প্রবেশ করে যাকে দৃশ্যত অগ্নি মনে হবে এবং চক্ষু বন্ধ করত মাথা অবনমিত করে সে যেন সেটা থেকে পানি পান করে। সেটা হবে ঠা-া পানি। দাজ্জালের চক্ষু লেপা হবে এবং তার চোখের উপর নখের মতো পুরু চামড়া থাকবে এবং উভয় চোখের মাঝখানে পৃথক-পৃথকভাবে কাফির লেখা থাকবে। শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল মুমিন ব্যক্তি এ লেখা পড়তে পারবে’।[১০]

বিভিন্ন হাদীছে দাজ্জালের চোখ অন্ধ হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন হাদীছে বলা হয়েছে দাজ্জাল অন্ধ হবে। কোন হাদীছে আছে, তার ডান চোখ অন্ধ হবে। আবার কোন হাদীছে আছে তার বাম চোখ হবে অন্ধ।[১১] মোটকথা তার একটি চোখ দুষিত হবে। তবে ডান চোখ অন্ধ হওয়ার হাদীছগুলো বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে।[১২] সুতরাং দাজ্জালের অন্যান্য লক্ষণগুলো কারো কাছে অস্পষ্ট থেকে গেলেও অন্ধ হওয়ার বিষয়টি কারো কাছে অস্পষ্ট হবে না।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


*মুর্শিদাবাদ, ভারত।


তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৪২; আবূ দাঊদ, হা/৪৩২৫; তিরমিযী, হা/২২৫৩; ইবনু মাজাহ, হা/৪০৭৪।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৭; আবূ দাঊদ, হা/৪৩২১; তিরমিযী, হা/২২৪০; ইবনু মাজাহ, হা/৪০৭৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৬২৯।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৩, ২৯৩৪।
[৪]. ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৮৮০৬।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১২৮, ৩৪৪১, ৫৯০২, ৬৯৯৯, ৭০২৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৯, ১৭১।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯২৭; তিরমিযী, হা/২২৪৬।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৩।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৩, ২৯৩৪।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৭; তিরমিযী, হা/২২৪০; ইবনু মাজাহ, হা/৪০৭৫; ছহীহুল জামে‘, হা/২৪৫৫।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৫০, ৭১৩০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৪; আবূ দাঊদ, হা/৪৩১৫।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৪; ইবনু মাজাহ, হা/৪০৭১।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪০২-৪৪০৩, ৭১২৩, ৭৪০৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৩।




ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (শেষ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
বাউল মতবাদ (শেষ কিস্তি) - গোলাম রহমান
রামাযানের শেষ দশকের গুরুত্ব ও করণীয় - মাইনুল ইসলাম মঈন
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আলো ও অন্ধকার (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
ক্রোধের ভয়াবহতা ও তার শারঈ চিকিৎসা - হাসিবুর রহমান বুখারী
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২১তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
জীবন ব্যবস্থা হিসাবে আল-কুরআনের মূল্যায়ন - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ

ফেসবুক পেজ