শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৩৪ অপরাহ্ন

মু‘তাযিলা মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ

- আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*


মু‘তাযিলা মতবাদ

ওয়াছিল বিন আতা (৮০-১৩১ হি.)-এর তত্ত্বাবধানে মু‘তাযিলা মতবাদের সূচনা হয়। মু‘তাযিলা (المعتزلة) শব্দটি ই‘তাযালা (اعتزل) থেকে গৃহীত। ই‘তিযাল (الاعتزال) অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া, নিংসঙ্গ হওয়া, একাকী হওয়া ইত্যাদি। প্রথম হিজরীর শেষভাগে এবং দ্বিতীয় হিজরীর প্রথমভাগে এই মতবাদের প্রকাশ ঘটে। এ মতের অনুসারীগণ গ্রীক, মিসরীয়, পারসীয় ও ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে লেখাপড়া করার ফলে ধর্মীয় অনেক বিষয়ে দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়ে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান মানুষদের আকর্ষিত করে। এই মতবাদের অনুসারীরা আল্লাহ তা‘আলাকে গুণহীন সত্তা মনে করে। আল্লাহ ইলম ছাড়াই আলীম (সর্বজ্ঞ)। কুদরত (শক্তি) ছাড়াই ক্বাদীর ইত্যাদি। এই ফের্কা বা মতবাদের অনুসারীরা বিশ্বাসের ব্যাপারে দার্শনিক বির্তকের মাধ্যমে সালাফে-ছলেহীনের পথ ছেড়ে নতুন দর্শনের জন্ম দিয়ে পথভ্রষ্ট হয়েছে। মু‘তাযিলারা মূলত জাহমিয়াদের অনুগামী। কেননা জাহমিয়ারা আল্লাহ্র নাম ও ছিফাতসমূহকে অস্বীকার করে। আর মু‘তাযিলারা নামসমূহ ছাড়া ছিফাতসমূহকে অস্বীকার করে। এ কারণে প্রত্যেক মু‘তাযিলা মতবাদের অনুসারীকে জাহমিয়া বলা হয়। ইবনু তাইমিয়্যা বলেছেন,فكل معتزلي جهمي وليس كل جهمي معتزليا  ‘প্রত্যেক মু‘তাযিলা জাহমী, তবে প্রত্যেক জাহমী মু‘তাযিলা নয়।[১]

ওয়াছিল বিন আতা (৮০-১৩১ হি.)-এর পরিচয়

ওয়াছিল বিন আতা (৮০-১৩১ হি.) ছিলেন হাসান বছরী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অন্যতম ছাত্র। তিনি হাসান বছরী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট শিক্ষাগ্রহন করেন। আর এই সময়টা ছিল ‘আব্দুল মালিক ইবনু মারওয়ান’ (খেলাফত : ৬৮৫-৭০৫ খৃ.) এবং ‘হিশাম ইবনু আব্দুল মালিক’ (খেলাফত : ৭২৪-৭৪৩ খৃ.)-এর খেলাফতের সময়। ওয়াছিল বিন আতার অন্যতম আক্বীদাহ হল (المنزلة بين المنزلتين) ‘আল-মানযিলাতু বায়নাল মানযিলাতাইন’।[২]

এই আক্বীদার কারণ হল, একদা এক ব্যক্তি হাসান বছরী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট আগমন করে বলে। ‘হে দ্বীনের ইমাম! আমাদের সময় বা যুগে একটি জামা‘আতের আবির্ভাব হয়েছে। যারা কবীরাগুনাহগার ব্যক্তিকে কাফির সাব্যস্ত করে এবং কবীরাগুনাহ তাদের নিকট কুফরি। যা মিল্লাত (ইসলাম) থেকে বের করে দেয়। তারা হল খারিজী। এবং একটি জামা‘আত আবির্ভাব হয়েছে, যারা কবীরাগুনাহকে মুলতবি রাখে। তাদের বিশ্বাস হল কবীরাগুনাহ ঈমানের কোন ক্ষতি করে না। তাদের নিকট আমল ঈমানের রুকন নয়। সীমালঙ্ঘন বা পাপ কাজও ঈমানের কোন ক্ষতি করে না। যেমনভাবে কুফরী আনুগত্যের কোন ক্ষতি করতে পারে না। আর তারা হল মুরজিয়া। আপনি এই সমস্ত আক্বীদার ব্যাপারে আমাদের জন্য কি ফায়সালা প্রদান করবেন’।[৩] তাদের এই আক্বীদার ব্যাপারে হাসান বছরী (রাহিমাহুল্লাহ) গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। আর তার জবাব দেয়ার পূর্বেই ওয়াছিল বিন আতা বললেন,

أنا لا أقول إن صاحب الكبيرة مؤمن مطلقا ولا كافر مطلقا بل هو في منزلة بين المنزلتين  لا مؤمن ولا كافر .

‘আমি কবীরাগুনাহকারীকে পূর্ণাঙ্গ মুমিন বলব না এবং পূর্ণাঙ্গ কাফিরও বলব না। বরং তার অবস্থান উভয়ের মাঝামাঝি। না মুমিন না কাফির’।[৪]

মু‘তাযিলা নামকরণের কারণ

ওয়াছিল বিন আতা (৮০-১৩১ হি.) ‘আল-মানযিলাতু বায়নাল মানযিলাতাইন’ (المنزلة بين المنزلتين)-এই আক্বীদা হাসান বছরী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দারসে ব্যক্ত করার পর দাঁড়িয়ে যান এবং মসজিদের স্তম্ভসমূহের মধ্য হতে একটি স্তম্ভের নিকট একান্তে অবস্থান করেন। সিন্ধান্ত নেন যে, তিনি একান্তে অবস্থান করে মানুষের প্রশ্নের জবাব প্রদান করবেন। তখন হাসান বছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, اعتزل عنا واصل ‘ওয়াছিল আমাদের নিকট হতে একান্তে অবস্থান করছে’।[৫] তখন থেকে তাকে এবং তার সাথীদেরকে মু‘তাযিলা (معتزلة) নামকরণ করা হয়।[৬]

মু‘তাযিলাদের উছূল বা মূলনীতিসমূহ

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সাথে মু‘তাযিলাদের মৌলিক নীতিগত পার্থক্য হল, বিশ্বাসের বিষয়ে মানবীয় জ্ঞান বা বুদ্ধি-বিবেক ও ওহী-এর পারস্পারিক সম্পর্ক ও অবস্থান। মু‘তাযিলা আক্বীদার মূল বিষয় হল মানবীয় আকল বা বুদ্ধি-বিবেক ও দর্শনকে অহীর উপরে প্রাধান্য দেয়া এবং মানবীয় জ্ঞান ও দর্শনকে গ্রহণ করা। তাদের মতে মানবীয় জ্ঞান অহীর চেয়েও অগ্রগণ্য। মানবীয় জ্ঞানের বিচারে অহীর মধ্যে অসঙ্গতি দেখা দিলে যুক্তি, বুদ্ধি ও দর্শনের মাধ্যমে অহীর ব্যাখ্যা ও বিচার করতে হবে। কুরআনের বক্তব্যকে তারা আল্লাহর সৃষ্ট, রূপক ও অস্পষ্ট ইত্যাদি যুক্তিতে বাতিল করে এবং হাদীছের বক্তব্যকে ‘খবরে ওয়াহিদ’ বা ‘মুতাওয়াতির নয়, কাজেই অর্থগত বর্ণনার সম্ভাবনা আছে যুক্তিতে বাতিল করে। আর এ কারণে তাদের মূলনীতিসমূহও বুদ্ধি-বিবেক, যুক্তি ও দর্শন ভিত্তিক; অহী ভিত্তিক নয়। শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি./ ১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) তাদের পাঁচটি মূলনীতির কথা উল্লেখ করেছেন । যথা-

১. তাওহীদ (اَلتَّوْحِيْدُ) বা একত্বের অনুসারী ২. আদল (اَلْعَدْلُ) বা ন্যায়বিচার ৩. মানযিলাতু বায়নাল মানযিলাতাইন (اَلْمَنْزِلَةَ بَيْنَ الْمَنْزِلَتَيْنِ) বা দুই অবস্থানের মধ্যবর্তী অবস্থান ৪. ইনফাযুল ওঈদ (وَإِنْفَاذُ الْوَعِيْدِ) বা শাস্তির অঙ্গিকার বাস্তবায়ন এবং ৫. আল-আমরু বিল মা‘রুফ ওয়ান নাহউ আনিল মুনকার (اَلْأَمْرُ بِالْمَعْرُوْفِ وَالنَّهْيُ عَنْ الْمُنْكَرِ) সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ।[৭]

১. তাওহীদ (اَلتَّوْحِيْدُ) বা একত্বের অনুসারী

তাদের তাওহীদ বা একত্বের দাবীর অর্থ হল আল্লাহর ছিফাতসমূহকে অস্বীকার করা। তারা আল্লাহর নামসমূহ ও আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে। শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) বলেছেন, مَعْنَى التَّوْحِيدِ عِنْدَهُمْ يَتَضَمَّنُ نَفْيَ الصِّفَاتِ ‘তাদের নিকট তাওহীদের অর্থ আল্লাহর ছিফাতসমূহকে অস্বীকার করাকেই অন্তর্ভুক্ত করে’।[৮] আর এ কারণেই ‘ইবনু তূমারতা’[৯] (ابْنُ تُوْمَرتَ) তার সাথীদেরকে ‘তাওহীদের অনুসারী’ নামকরণ করেছেন। আর তিনি ছিলেন আল্লাহর নাম ও আয়াতসমূহের অস্বীকারকারী।[১০]

আল্লাহ্র ছিফাসমূহের ব্যাপারে তাদের দার্শনিক ব্যাখ্যা হল আল্লাহ সত্তার বাইরে কোন ছিফাত বা গুন নেই। কারণ আল্লাহ্র গুণ স্বীকার করলে আল্লাহ্র গুণকেও আল্লাহর ন্যায় চিরন্তন সাব্যস্ত করতে হয়। এভাবে চিরন্তন সত্তার একাধিকত্ব অবধারিত হয়ে দাঁড়ায়। আর এটা তাওহীদ বা আল্লাহ্র একত্বের পরিপন্থী। তাছাড়া আল্লাহর বহু গুণাবলীর অর্থ হল তাঁর সত্তায় বহুত্ব পাওয়া। অথচ আল্লাহ সত্তার কোন প্রকারেই বহুত্ব পাওয়া যেতে পারে না। অতএব আল্লাহর সত্তা গুণাবলী হতে পবিত্র। এভাবে তাওহীদের নিজস্ব ব্যাখ্যার ফলে তারা আল্লাহর ছিফাতকে অস্বীকার করে।

২. আদল (اَلْعَدْلُ) বা ন্যায়বিচার

মু‘তাযিলাদের আদলের মূল বক্তব্যই হল তাক্বদীরকে অস্বীকার করা। যেমনটা শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) বলেছেন, وَمَعْنَى الْعَدْلِ عِنْدَهُمْ يَتَضَمَّنُ التَّكْذِيبَ بِالْقَدَرِ ‘তাদের নিকট আদল বা ন্যায়বিচারে অর্থ তাক্বদীর অস্বীকার করাকেই অন্তর্ভুক্ত করে’।[১১] আর সেটা হল বান্দা নিজেই তার কর্মের স্রষ্টা। সৃষ্টির ইচ্ছা ও সক্ষমতা বান্দার নিজেরই। মু‘তাযিলাদের আদল বা ন্যায়বিচারের দার্শনিক ব্যাখ্যা হল- যেহেতু আল্লাহ আদিল, তাই পাপীকে শাস্তি দেয়া আল্লাহর উপর ওয়াজিব এবং নেককারকে ছওয়াব দেয়াও তার উপর ওয়াজিব। নতুবা ইনসাফ পরিপন্থী কাজ হয়ে যাবে। তাদের আরও বক্তব্য হল- যেহেতু আল্লাহ আদিল বা ইনসাফকারী, তাই তিনি কোন অন্যায়ের ইচ্ছাও করেন না, আদেশও দেন না। আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির প্রতি কেবল সে নির্দেশই প্রদান করে থাকেন যা তার জন্য কল্যাণকর। এটাই ইনসাফ বা আদল। তাঁর জন্য বৈধ নয় যে, কোন অন্যায়ের নির্দেশ দিবেন। অতঃপর বান্দাগণকে উক্ত অন্যায়ের কারণে শাস্তি দিবেন। কেননা এরূপ করা ইনসাফ পরিপন্থী কাজ তথা জুলুম।

৩. মানযিলাতু বায়নাল মানযিলাতাইন (اَلْمَنْزِلَةَ بَيْنَ الْمَنْزِلَتَيْنِ) বা দুই অবস্থানের মধ্যবর্তী অবস্থান

মু‘তাযিলাদের নিকট ‘আল-মানযিলাতু বায়নাল মানযিলাতাইন’ (المنزلة بين المنزلتين)-এর অর্থ হল ফাসিক ব্যক্তি কাফিরও না মুমিনও না। বরং তারা ঈমান ও কুফরীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করবে।[১২] ওয়াছিল বিন আতা দাবি করেন যে, এরূপ ফাসিক বা পাপি ব্যক্তিকে মুমিনও বলা যাবে না এবং কাফিরও বলা যাবে না। আর এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে সে জাহান্নামী হবে, কারণ সে ঈমানহীনভাবে মৃত্যুবরণ করেছে।

৪. ইনফাযুল ওঈদ (وَإِنْفَاذُ الْوَعِيْدِ) বা শাস্তির অঙ্গিকার বাস্তবায়ন

মু‘তাযিলাদের নিকট ‘শাস্তির অঙ্গিকার বাস্তবায়ন (ইনফাযুল ওঈদ)’-এর অর্থ হল ফাসিক ব্যক্তি চিরস্থায়ী জাহান্নামী। শাফা‘আতের মাধ্যমেও তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা যাবে না। যেমনটা খারেজীগণ বলে থাকে।[১৩] মুমিন ব্যক্তি যদি দুনিয়া থেকে আনুগত্য এবং তওবাসহ বিদায় নেয় তাহলে সে নেকি এবং প্রতিদানের জন্য যোগ্য হবে। আর যখন কবীরাগুনাহ করার পর কবীরাগুনাহ থেকে তওবা ছাড়া দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে, তাহলে সে জাহান্নামের শাস্তির জন্য যোগ্য হবে। তবে তার শাস্তির পরিমাণটা কাফিরের শাস্তির চেয়ে হালকা হবে। আর এটাকেই তারা ওঈদ নামকরণ করেছে।[১৪] ‘ইনফাযুল ওঈদ (وَإِنْفَاذُ الْوَعِيْدِ) বা শাস্তির অঙ্গিকার বাস্তবায়ন’-এর ক্ষেত্রে তাদের দার্শনিক ব্যাখ্যা হল- আল্লাহ তা‘আলা ভাল কাজের জন্য নেকির যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তির যে ভীতি প্রদর্শন করেছেন তা অবশ্যই কার্যকর হবে। সৎ লোক অবশ্যই প্রতিদান পাবে এবং অসৎ লোক অবশ্যই শাস্তি পাবে। এ ব্যাপারে তাদের বাড়াবাড়ি হল-তারা বলে, সৎ ব্যক্তিকে নেকি দেয়া এবং কবীরা গুনাহকারীদেরকে শাস্তি দেয়া আল্লাহ্র উপর ওয়াজিব। ভাল কাজের ছওয়াব প্রদান এবং পাপ কাজের শাস্তি প্রদান এক প্রকার আইনগত বিষয় যা পালন করা আল্লাহ্র জন্য ওয়াজিব এবং অপরিহার্য। অতএব আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করতে পারবেন না। আর এ কারণেই ফাসিক বা পাপি ব্যক্তি চিরস্থায়ী জাহান্নামী।

৫. আল-আমরু বিল মা‘রুফ ওয়ান নাহউ আনিল মুনকার (اَلْأَمْرُ بِالْمَعْرُوْفِ وَالنَّهْيُ عَنْ الْمُنْكَرِ) বা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ

সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ (আল-আমরু বিল মা‘রুফ ওয়ান নাহউ আনিল মুনকার)-এ ব্যাপারে মু‘তাযিলাদের দার্শনিক ব্যাখ্যা হল-

অন্যদেরকে সৎকাজের আদেশ করা ও অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করা জরূরী এবং ফরযে আইন। রাষ্ট্রও অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সাথে তরবারীর যুদ্ধও বৈধ মনে করে।[১৫] তাদের বক্তব্য হল ভুল পথ প্রদর্শনকারীদেরকে বাধা প্রদানের জন্য এবং হক্ব বিরোধীদের হক্ব গ্রহণে বাধ্য করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করা আবশ্যক। আর এ কারণেই তারা আব্বাসী খলীফা মামুন (খেলাফত: ১৯৮-২১৮ হি./৮১৪-৮৩৩ খ্রি.) ও মু‘তাসিম (খেলাফত: ২১৮-২২৭ হি./৮৩৩-৮৪২ খ্রি.) এবং ওয়াছিক বিল্লাহ (খেলাফত: ২২৭-২৩২ হি./৮৪২-৮৪৭ খ্রি.)-এর শাসনামলে খালকে কুরআন বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় আলিম, মুহাদ্দিছ এবং ফকীহগণকে জোরপূর্বক তাদের মতানুসারী হওয়ার জন্য বাধ্য করেন। তবে মূলধারার আলিমগণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ক্রমান্বয়ে এ মতের অনুসারী কমতে থাকে। ক্রমান্বয়ে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

[১]. শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মিনহাজুস সুন্নাহ আন-নববিয়্যাহ (মুওয়াসসাসাতু কুরতুবাত, তাবি), ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৬৪।

[২]. ‘আল-মানযিলাতু বায়নাল মানযিলাতাইন’ (المنزلة بين المنزلتين)-এর অর্থ হল পাপী মুসলিম কাফিরও না মুমিনও না। তৎকালিন একটি বিশেষ বিতর্কিত বিষয় ছিল পাপী মুসলিমের বিষয়। খারিজীগণ পাপী মুসলিমকে কাফির বলে গণ্য করত এবং আখিরাতে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী বলে বিশ্বাস করত। মুরজিয়া সম্প্রদায় পাপি মুসলিমকে পরিপূর্ণ মুমিন এবং জান্নাতী বলে বিশ্বাস করত। ছাহাবীগণ এবং তাবেঈ-তাবেঈগণ অর্থাৎ সালাফে-ছালেহীন এরূপ মুসলিমকে পাপী মুমিন ও আখিরাতে শাস্তিভোগের পর মুক্তি লাভ করবে বলে বিশ্বাস করতেন। ওয়াছিল বিন আতা দাবি করেন যে, এরূপ ব্যক্তিকে মুমিনও বলা যাবে না এবং কাফিরও বলা যাবে না। বরং সে ঈমান ও কুফরীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করবে। এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে সে জাহান্নামী হবে, কারণ সে ঈমানহীনভাবে মৃত্যুবরণ করেছে।

[৩]. والسبب فيه أنه دخل واحد على الحسن البصري فقال  يا إمام الدين لقد ظهرت في زماننا جماعة يكفرون أصحاب الكبائر والكبيرة عندهم كفر يخرج به عن الملة وهم وعيدية الخوارج وجماعة يرجئون أصحاب الكبائر والكبيرة عندهم لا تضر مع الإيمان بل العمل على مذهبهم ليس ركنا من الإيمان ولا يضر مع الإيمان معصية كما لا ينفع مع الكفر طاعة وهم مرجئة الأمة فكيف تحكم لنا في ذلك اعتقادا ؟ ;মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল করীম ইবনু আবূ বকর আহমাদ শহরস্তানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল; তাহক্বীক : মুহাম্মাদ সায়্যিদ কীলানী (বৈরূত : দারুল মা‘রেফা, ১৪০৪ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫।

[৪]. আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫।

[৫]. আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫; মুছতফা ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু মুছতফা, উছূল ও তারীখুল ফিরাক্বিল ইসলামিয়্যা, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯৬।

[৬]. আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫; উছূল ও তারীখুল ফিরাক্বিল ইসলামিয়্যা, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯৬।

[৭]. أُصُولُهُمْ خَمْسَةٌ " يُسَمُّونَهَا التَّوْحِيدَ وَالْعَدْلَ وَالْمَنْزِلَةَ بَيْنَ الْمَنْزِلَتَيْنِ وَإِنْفَاذَ الْوَعِيدِ وَالْأَمْرَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْيَ عَنْ الْمُنْكَرِ ; তাক্বীউদ্দীন আবূল আব্বাস আহমাদ ইবনু আব্দুল হালীম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া; তাহক্বীক : আনওয়ারুল বায, ‘আমিরুজ জায্যার (দারুল ওফা, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬ হি./ ২০০৫ খ্রি.), ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৮৭।

[৮]. لَكِنَّ مَعْنَى " التَّوْحِيدِ " عِنْدَهُمْ يَتَضَمَّنُ نَفْيَ الصِّفَاتِ ؛ وَلِهَذَا سَمَّى ابْنُ التومرت أَصْحَابَهُ الْمُوَحِّدِينَ وَهَذَا إنَّمَا هُوَ إلْحَادٌ فِي أَسْمَاءِ اللَّهِ وَآيَاتِهِ . ;তাক্বীউদ্দীন আবূল আব্বাস আহমাদ ইবনু আব্দুল হালীম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া; তাহক্বীক : আনওয়ারুল বায, ‘আমিরুজ জায্যার (দারুল ওফা, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬ হি./ ২০০৫ খ্রি.), ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৮৭।

[৯]. ইবনু তূমারতা : আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু তুমারতা আল-বারবারী আল-মাছমূদী। তিনি নিজেকে আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বংশীয় দাবি করেন। তিনি নিজেকে ‘আল-ইমামুল মা‘ছূম আল-মাহদী’ মনে করেন। তিনি হলেন মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু হুদ ইবনু খলীদ ইবনু তাম্মাম ইবনু আদনান ইবনু ছাফওয়ান ইবনু জাবির ইনবু ইয়াহইয়া ইবনু রাবাহ ইবনু ইয়াসার ইবনুল আব্বাস ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ইবনুল ইমাম আলী ইবনু আবূ তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। ইবনু তুমারতা ছিলেন মরক্কো দেশের লোক এবং সেখানেই তিনি লালিত-পালিত হোন। এরপর জ্ঞান অন্বেষণের জন্য প্রাচ্যে গমন করেন। অতঃপর ইরাকে অবস্থান করেন এবং সেখানে আবূ হামিদ আল-গাযালী, কায়া আল-হিরাসী এবং ত্বরতূশীসহ অন্যান্যদের সাথে মিলিত হোন। তারপর তিনি হজ্জে গমন করেন এবং মক্কাতে দীর্ঘ দিন অবস্থান করেন। সেখানে তিনি শারঈ জ্ঞান, হাদীছ, উছূলুল ফিকহ এবং দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি আল্লাহ্র নাম ও ছিফাতসমূহ অস্বীকারকারী ছিলেন। তিনি নিজেকে আহলুত তাওহীদ দাবি করতেন এবং তার অনুসারীদেরকেও আহলুত তাওহীদ বলা হয়। - শাসসুদ্দীন আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু ওছমান আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামুলন নুবালা; তাহক্বীক : শু‘আইব আরনাউত (মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, তাবি), ১৯তম খণ্ড, পৃ. ৫৩৯; আবূল আব্বাস শামসুদ্দীন আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবূ বকর ইবনু খাল্লিকান; তাহক্বীক : ইহসান আব্বাস (বৈরূত : দারু ছদর, তাবি), ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৫; মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৮৭।

[১০]. মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৮৭।

[১১]. মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৮৮।

[১২]. মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৮৭।

[১৩]. প্রাগুক্ত।

[১৪]. واتفقوا على أن المؤمن إذا خرج من الدنيا على طاعة وتوبة استحق الثواب والعوض . والتفضل معنى آخر وراء الثواب وإذا خرج من غير توبة عن كبيرة ارتكبها استحق الخلود في النار لكن يكون عقابه أخف من عقاب الكفار وسموا هذا النمط : وعدا ووعيدا ; আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৩।

[১৫]. মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৮৮।




প্রসঙ্গসমূহ »: ভ্রান্ত মতবাদ
মসজিদ : ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
শারঈ মানদন্ডে শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
আল-কুরআন তেলাওয়াতের ফযীলত (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
বিদ‘আত পরিচিতি (২৫ তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আবূ সাঈদ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২১তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন : সংশয় নিরসন (৩য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
আশূরায়ে মুহাররম - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৩য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
জীবন ব্যবস্থা হিসাবে আল-কুরআনের মূল্যায়ন - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইবাদতের দাবী - হাসিবুর রহমান বুখারী

ফেসবুক পেজ