ফিলিস্তীন, হে মুসলিম!
-শায়খ মতীউর রহমান মাদানী*
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর। ইসলামের দৃষ্টিতে ফিলিস্তীনের মর্যাদা অপরিসীম। আল্লাহ তা‘আলা এই স্থানকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। কেননা ফিলিস্তীনেই তিনটি মুবারক মসজিদের অন্যতম একটি মসজিদ ‘বায়তুল আক্বছা’ বা ‘বায়তুল মাক্বদিস’ স্থাপিত। এটিকে মসজিদুল আক্বছা, বাইতুল মুক্বাদ্দাছ বা বাইতুল মাক্বদিছ নামে পরিচিত। বাইতুল মুক্বাদ্দাছ অর্থাৎ পবিত্র মসজিদ, যাকে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র দান করেছেন এবং পবিত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই মসজিদের সাথে প্রতিটি মুসলিমের সম্পর্ক। ফিলিস্তীনের সাথে প্রতিটি মুসলিমের সম্পর্ক হচ্ছে ঈমানী সম্পর্ক, ইসলামী সম্পর্ক ও আক্বীদা-বিশ্বাসের সম্পর্ক। এককথায় ধর্মীয় বা দ্বীনি সম্পর্ক। ফিলিস্তীন শুধু ফিলিস্তীনী অধিবাসীদের জন্য নয় বা শুধু তাদের অধিকার নয়। আবার ফিলিস্তীন শুধু আরবদের অধিকার নয়। আবার সেখানকার বসবাসকারীদের মাতৃভাষা আরবী সেই জন্যও তার কোন বিশেষ মর্যাদা নেই। বরং এরকম জাতীয়তাবাদের অধিকার ইসালমে নেই। ফিলিস্তীন বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের জন্য এক গৌরবের জিনিস। ফিলিস্তীন ভূখণ্ড মুসলিমদের কোন কাফের বা বিজাতীয়দের নয়। ফিলিস্তীন এমন একটি জায়গা, যা মুসলিম বিশ্বের আক্বল বা হৃদয়ের মত।
উল্লেখ্য, ফিলিস্তীন সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলিম জানেন না। অথচ এ বিষয়টি জানা প্রত্যেক মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব ও ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাই এ সম্পর্কে যদি জ্ঞান না থাকে তাহলে জ্ঞান অর্জন করা উচিত। অনেকেই মনে করেন যে, ফিলিস্তীনের যে সমস্যা নিতান্তই কেবল তাদেরই সমস্যা। সেটা ভূমি নিয়ে সমস্যা কিংবা দুনিয়ার পার্থিব দন্দ্ব বা লড়াই। আর যদি সে সম্পর্কে বড়রাই না জানে, তাহলে কচিকাচা তথা আগামী প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা কী-বা জানবে! সুতরাং আপনারা জানুন এবং প্রত্যেক মুসলিম নিজ নিজ ছেলেমেয়েদেরকে এই শিক্ষা দিন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আলোচিত বিষয়গুলো জেনে নিয়ে আমল করার তাওফীক দান করেন এবং সত্যিকারের বিজয় কোন্ পথে হাছিল হবে সে বিষয়গুলো জেনে নিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সাহায্য-সহযোগিতায় যে বিজয় হাছিল হয়েছিল তার জন্য নিজেদেরকে সচেষ্ট হওয়ার তাওফীক দান করুন। মনে রাখতে হবে বিজয় শুধু মনের কামনা-বাসনায় আসে না। বিজয় শুধু এই মিছিল বা বিক্ষোপ আন্দোলন করেও আসে না। বরং এসব পশ্চিমা কাফেরদের শেখানো মাধ্যম ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং বিজয় লাভের জন্য যেসব শর্তগুলো রয়েছে, যে শর্তগুলো সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলিম ওদাসীন; সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসরণ করতে হবে। মুসলিমরা বিজয় চায় কিন্তু বিজয়ের পথে চলতে চায় না। এই হচ্ছে মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা। আল্লাহ রব্বুল আলামীন সঠিক বুঝ দান করুন ও সংশোধনের তাওফীক দান করুন। এ প্রবন্ধে আমরা ফিলিস্তীন সম্পর্কে স্বল্প পরিসরে ১৯টি পয়েন্ট আলোচনা করব। যা নিম্নরূপ:
১- উমর ফারুক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাসনামলে ফিলিস্তীন বিজয়
বাইতুল মুকাদ্দাছ বা ফিলিস্তীন মুসলিদের হাতে এসেছে। তার আগে তথা ইসলাম পূর্বে তা রোমানদের দখলে ছিল। রোমানরা ছিল তৎকালীন পৃথিবীর দুই পরাশক্তির একটি। অপরটি ছিল পারস্য শক্তি। রোমানদের দখলে থাকা ফিলিস্তীন উমর ফারুক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফাতের সময় মুসলিম জাতি বা মুসলিমগণ তথা ছাহাবায়ে কেরামগণ বিজয় লাভ করেন। এই ফিলিস্তীন বৃহত্তর শাম দেশের অন্তর্ভুক্ত। শামদেশ কয়েক ভাগে বিভক্ত। শাম দেশের একটি অংশ হচ্ছে সিরিয়া, একটি অংশ হচ্ছে জর্ডান, একটি অংশ হচ্ছে লেবানন। আর আরেকটি অংশ হচ্ছে প্যালেস্টাইন, যার একটি অংশ কাফেরগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াসে ইহুদীদেরকে প্রদান করেছে। যারা সেখানে অবৈধভাবে বসবাস করছে। মূলত ফিলিস্তীনে তাদের কোন অস্তিত্বই ছিল না। যাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার লাঞ্ছনা, যিল্লত ও দূরগতি অবধারিত করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ ضُرِبَتۡ عَلَیۡہِمُ الذِّلَّۃُ وَ الۡمَسۡکَنَۃُ ٭ وَ بَآءُوۡ بِغَضَبٍ مِّنَ اللّٰہِ ‘তাদের উপর লাঞ্ছনা ও দারিদ্র নিপতিত হল এবং তারা আল্লাহর ক্রোধে পতিত হল’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৬১)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ضُرِبَتۡ عَلَیۡہِمُ الذِّلَّۃُ اَیۡنَ مَا ثُقِفُوۡۤا اِلَّا بِحَبۡلٍ مِّنَ اللّٰہِ وَ حَبۡلٍ مِّنَ النَّاسِ وَ بَآءُوۡ بِغَضَبٍ مِّنَ اللّٰہِ وَ ضُرِبَتۡ عَلَیۡہِمُ الۡمَسۡکَنَۃُ
‘আল্লাহ ও মানুষের প্রতিশ্রুতি (তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে) ব্যতীত তারা যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, তারা লাঞ্ছনায় আক্রান্ত হবে, আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত হবে এবং দারিদ্রতায় আক্রান্ত হবে’ (সূরা আলে ইমরান: ১১২)। উক্ত লাঞ্ছনা, ক্রোধ ও দারিদ্রতা আল্লাহর পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু اِلَّا بِحَبۡلٍ مِّنَ اللّٰہِ অর্থাৎ ‘যদি তারা তওবা, ঈমান, আল্লাহর তাওহীদের উপর এবং শেষ রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এব উপর ঈমান নিয়ে আসে যেভাবে অন্য নবী-রাসূলগণের উপর ঈমান আনাকে ফরয করেছেন, তাহলে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সাহায্য নেমে আসবে। অতঃপর وَ حَبۡلٍ مِّنَ النَّاسِ অর্থাৎ মানুষের পৃষ্ঠপোষকতায় তথা কাফের শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এই ইহুদীগোষ্ঠী লাঞ্ছিত শক্তি মুসলিমদের হার্ট তথা কলিজার উপর বসে আছে। আর কেউ যদি কারো কলিজার বসে থাকে তাহলে তার অবস্থা কেমন হবে? বর্তমান মুসলিম জাতির অবস্থান ঠিক তেমনই। কেননা ফিলিস্তীন দখল করে আছে জালেম, কাফের, লাঞ্ছিত অভিশপ্ত ইহুদী শক্তি।
উমর ফারুখ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর যামানায় ১৫ হিজরীর শাওয়াল মোতাবেক ৬৩৬ ঈসায়ী নভেম্বর মাসে শাম দেশে জিহাদ শুরু হয়। উক্ত জিহাদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন আবূ উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। যিনি আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত ছাহাবী। ইসলামের এই বিজয়ের জিহাদ চলতে থাকে ১৬ হিজরীর বরীউল আওয়াল মাস মোতাবেক ৬৩৭ ঈসায়ী এপ্রিল মাস পর্যন্ত। উক্ত হিসাব মতে প্রায় ছয় বছর যাবৎ উক্ত জিহাদ চলে। তারপর আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে সাহায্য নেমে আসে। বিজয় লাভ করে মুসলিমরা। অতঃপর উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সেখানে উপস্থিত হয়ে কাফিরদের সাথে চুক্তি করেন।
স্মর্তব্য যে, নিজেরা সহ নিজেদের ছেলে-মেয়েদের জানার বিষয় হলো ফিলিস্তীন আমাদের ঈমানের অংশ। কেননা ফিলিস্তীনে মসজিদে আক্বছা রয়েছে। যে মুবারক মসজিদ হচ্ছে আমাদের ঈমানী সম্পর্কের মসজিদ। এটি মুসলিমদের সর্বপ্রথম সমস্যা, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং দ্বীনের মৌলিক বিষয়। আর ফিলিস্তীন সমস্ত আরযুল আম্বিয়া তথা আম্বিয়া-রাসূলের এলাক। বিষেষ করে ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আলাইহিস সালাম)-এর পর থেকে শুরু করে যত নবী-রাসূল এসেছেন সবগুলো প্রায় ইবাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর বংশদ্ভুত। যাদেরকে বানু ইসরাঈলের বলা হয়। অর্থাৎ ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ছেলে দু’জন। একজন ইসমাইল আরেকজন হচ্ছে ইসহাক। ইসহাকের ছেলের নাম ইয়াকূব। ইয়াকূবের অপর নাম হচ্ছে ইসরাঈল। সেখান থেকে বানী ইসরাঈল মানে ইসরাঈলের বংশধর। সুতরাং ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ইসহাক্ব (আলাইহিস সালাম)-এর বংশ থেকে অধিকাংশই আম্বিয়া-রাসূল এসেছেন। যেমন ইসহাক (আলাইহিস সালাম)-এর ছেলে ইয়াকূব (আলাইহিস সালাম), আর তার ছেলে নবী ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)। অতঃপর যাকারিয়া, ইয়াইয়া, মূসা, ঈসা সহ সমস্ত আম্বিয়া ও রাসূল এই বংশ থেকেই এসেছেন।
আর আম্বিয়াদের সাথে মুসলিম উম্মাহর সম্পর্ক। কারণ সমস্ত আম্বিয়া ও রাসূল মুমিন ও মুসলিম ছিলেন। আরেকটি যরূরী ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সেটা হচ্ছে- আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে শুরু করে প্রত্যেক নবী ও রাসূল এবং তাদের যারা সত্যিকারের অনুসারী তারা মুসলিম। আর যুগে যুগে যারা তাদের অনুসারী নয় তারা কাফের। যারা ঈমান নিয়ে এসেছে বা মেনে নিয়েছে তাদের নাম মুমিন বা বিশ্বাসী আর যারা ঈমান আনেনি তাদের নাম হচ্ছে কাফের বা অবিশ্বাসী। আল-কুরআনে এ দু’টি নামই দেয়া হয়েছে। মানবজাতিকে এ দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে কেউ সরাসরি কাফের বলতে চায় না নরম করে অমুসলিম বলা হচ্ছে। মনে করে কাফের হলে একটা গালি হয়ে যায়। অথচ কাফির বলাটা কুরআনের পরিভাষা। অমুসলিম বললে তাদের সাথে কিছু ছাড় দেয়া হয়। অথচ আল্লাহ কোনরূপ ছাড় দেননি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছাড় দেননি। কুরআনুল কারীমে কোন জায়গায় পাওয়া যাবে না যে, মুসলিম আর ননমুসলিম বলা হয়েছে। সুতরাং বলতে হবে কাফের ও মুসলিম তথা বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী। বিশ্বাস করেন কাফের কোন গালি নয়। একজন মুমিন ও মুসলিম আল্লাহর সামনে আত্মসর্মপন করেন। আপনি মুমিন আপনি বিশ্বাস করেন বলেই। আর আপনি কাফের আমান্য করেন বলেই। কেননা কাফের মানেই অমান্যকারী।
২- ফিলিস্তীন হচ্ছে আম্বিয়া ও রাসূলগণের দেশ। ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর আসল বাড়ি ছিল ইরাকে। ইরাকে যখন ছিলেন তখন বাবা ছিল সবচেয়ে বড় দুশমন, বংশের লোক ছিল দুশমন। মুর্তিপূজা কর নাহলে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। এই ইরাক থেকে হিজরত করে তিনি এই ফিলিস্তীনে এসেছিলেন। এভাবে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ফিলিস্তীনে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীতে পৃথিবীতে আগত সকল নবী ও রাসূল ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর বংশেই জন্মগ্রহণ করেন।
৩- লূত্ব (আলাইহিস সালাম)-কে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার আযাব থকে রক্ষা করেছেন। পক্ষান্তরে তার জাতি ছিল সমকামিতায় আসক্ত, নোংরামি ও অভিশপ্ত জাতি ছিল এবং আল্লাহর গজবপ্রাপ্ত জাতি ছিল। সমকামিতার বদঅভ্যাস, আল্লাহকে অমান্য করা, আল্লাহর দ্বীনকে অমান্য করা এবং নবীকে অস্বীকার করার কুফরীরর কারণে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কঠিন আযাব দিয়ে ধ্বংস করেন। এভাবেই ধ্বংস করে ঐ যমীনকে আল্লাহ তা‘আলা নাস্তানাবুদ করে দিয়েছেন, অবশিষ্ট রাখেননি। আল্লাহর এই আযাব লূত্ব (আলাইহিস সালাম)-এর স্ত্রীদেরকেও ছাড় দেয়নি। আল্লাহ আযাব দেয়ার ক্ষেত্রে কোন সম্ভ্রান্ত ও অসম্ভ্রান্ত লক্ষ্য করেন না। লূত্ব (আলাইহিস সালাম)-কে আযাব থেকে রক্ষা করা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ نَجَّیۡنٰہُ وَ لُوۡطًا اِلَی الۡاَرۡضِ الَّتِیۡ بٰرَکۡنَا فِیۡہَا لِلۡعٰلَمِیۡنَ ‘আর আমরা তাঁকে ও লূত্ব (আলাইহিস সালাম)-কে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই দেশে যেখানে আমরা বারাকাহ রেখেছি বিশ্ববাসীর জন্য’ (সূরা আল-আম্বিয়া: ৭১)। আর সেই বরকতমণ্ডিত দেশ হল ফিলিস্তীন।
৪- দাঊদ (আলাইহিস সালাম)-এর দেশ ছিল ফিলিস্তীন। বিশেষ করে তাঁর মিহরাব তথা যেখানে তিনি ইবাদত-বন্দেগী করতেন সেটা ছিল ফিলিস্তীনে।
৫- সুলাইমান (আলাইহিস সালাম)-এর রাজত্ব ছিল ফিলিস্তীন। তিনি তৎকালীন যুগে গোটা পৃথিবীর সম্রাট ছিলেন। শুধু মানুষের উপর তাঁর রাজত্ব ছিল না, বরং পশু-পাখির উপরও রাজত্ব ছিল। এমনকি জ্বিনরাও তাঁর অধিনস্ত ছিল। তাঁর রাজত্বের রাজধানী ছিল এই ফিলিস্তীন। এখান থেকেই তিনি গোটা পৃথিবী শাসন করতেন। আল-কুরআনে সূরা আন-নামলে হুদহুদ পাখি ও পিপড়ার যে ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে তাও ফিলিস্তীনের আসকালান নামক এলাকায় পাশে অবস্থিত। এই ফিলিস্তীনেই যাকারিয়া (আলাইহিস সালাম)-এর মেহরাব ছিল। যেখানে তিনি ইবাদত-বন্দেগী করতেন। আর সেখানেই নিঃসন্তান যাকারিয়া (আলাইহিস সালাম) সন্তানের জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করেছিলেন এবং তাঁর দু‘আ কবুল হয়েছিল (দ্র.: সূরা আলে ইমরান: ৩৭)।
৬- মূসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন মূলত ফিলিস্তীনের অধিবাসী। কিন্তু তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হয় মিশরে। যেখান থেকে ফেরআউনের ধ্বংসের পরে হিজরত করেন। পূর্বপুরুষ ফিলিস্তীনের হওয়া সত্ত্বেও মিশরী হওয়ার কারণ হলো, তিনি ছিলেন ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-এর বংশদ্ভূত। অতঃপর মিশরেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই তিনি বড় হতে থাকেন। একপর্যায়ে ফিরআউনের জ্যোতিষীরা বলল যে, বানু ইসরাঈলের এমন এক সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে, যার মাধ্যমে আপনার রাজত্বের পতন ঘটবে। ফলে হাজার হাজার ছেলে সন্তানকে ফেরআউন হত্যা করেছিল। তদুপরি শেষ পর্যন্ত ফেরআউন ধ্বংস হল। তারপর মূসা (আলাইহিস সালাম) সেখান থেকে বের হয়ে আসেন এবং তাঁর ক্বওম বানু ইসরাঈলকে লক্ষ্য করে বলেন, চল! আমাদের পূর্বপুরুষদের মুবারক ভূমি বা বরকতপূর্ণ ভূমি রয়েছে; সেখানে আমাদেরকে যেতে হবে এবং সেখানে বসবাস করতে হবে। কিন্তু সেখানে একটি শক্তিশালী জাতি রাজত্ব করছে। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। তখন বানু ইসরাঈল জাতি বলল, তাদের সাথে আমরা কিভাবে যুদ্ধ করব। তারা বারবার মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে খেয়ানত করেছে, নাফরমানী করেছে। তাওরাত কিতাব নিতে মাত্র ৪০ দিনের জন্য মূসা (আলাইহিস সালাম) চলে যাওয়ার পরে তার বাছুরকে পূজা করা শুরু করে দিয়েছিল। এরপরেও মূসা (আলাইহিস সালাম) তাদেরকে বললেন, চল যুদ্ধের জন্য আল্লাহর সাহায্য নেমে আসবে। তখনও তারা বলেছিল, না; আমরা যাব না। বরং আপনি ও আপনার রব গিয়ে যুদ্ধ করেন। যখন দেখব যে, তাদের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন এবং তারা বিতাড়িত হয়েছে তখন আমরা যাব। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতগুলো প্রাধান্যযোগ্য:
یٰقَوۡمِ ادۡخُلُوا الۡاَرۡضَ الۡمُقَدَّسَۃَ الَّتِیۡ کَتَبَ اللّٰہُ لَکُمۡ وَ لَا تَرۡتَدُّوۡا عَلٰۤی اَدۡبَارِکُمۡ فَتَنۡقَلِبُوۡا خٰسِرِیۡنَ -قَالُوۡا یٰمُوۡسٰۤی اِنَّ فِیۡہَا قَوۡمًا جَبَّارِیۡنَ ٭ۖ وَ اِنَّا لَنۡ نَّدۡخُلَہَا حَتّٰی یَخۡرُجُوۡا مِنۡہَا ۚ فَاِنۡ یَّخۡرُجُوۡا مِنۡہَا فَاِنَّا دٰخِلُوۡنَ- قَالَ رَجُلٰنِ مِنَ الَّذِیۡنَ یَخَافُوۡنَ اَنۡعَمَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمَا ادۡخُلُوۡا عَلَیۡہِمُ الۡبَابَ ۚ فَاِذَا دَخَلۡتُمُوۡہُ فَاِنَّکُمۡ غٰلِبُوۡنَ ۬ۚ وَ عَلَی اللّٰہِ فَتَوَکَّلُوۡۤا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ - قَالُوۡا یٰمُوۡسٰۤی اِنَّا لَنۡ نَّدۡخُلَہَاۤ اَبَدًا مَّا دَامُوۡا فِیۡہَا فَاذۡہَبۡ اَنۡتَ وَ رَبُّکَ فَقَاتِلَاۤ اِنَّا ہٰہُنَا قٰعِدُوۡنَ
‘হে আমার সম্প্রদায়! এ পুণ্য ভূমিতে প্রবেশ কর যা আল্লাহ তোমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন, আর পিছনে যেও না, তাহলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা বলল, হে মূসা (আলাইহিস সালাম)! সেখানে তো পরাক্রমশালী গোত্র রয়েছে; অতএব, তারা যে পর্যন্ত সেখান হতে বের হয়ে না যায় সে পর্যন্ত আমরা সেখানে কখনও প্রবেশ করব না। হ্যাঁ, যদি তারা সেখান হতে বেরিয়ে যায় তবে নিশ্চয় আমরা যেতে প্রস্তুত আছি। সে দু’ব্যক্তি যারা (আল্লাহকে) ভয়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন, বলল, তোমরা তাদের উপর (আক্রমণ চালিয়ে নগরের) দ্বারদেশ পর্যন্ত যাও, ফলে যখনই তোমরা দ্বারদেশে প্রবেশ করবে তখনই জয়লাভ করবে এবং তোমরা আল্লাহর উপরই নির্ভর কর, যদি তোমরা মুমিন হও। তারা বলল, হে মূসা (আলাইহিস সালাম)! নিশ্চয় আমরা কখনও সেখানে প্রবেশ করব না যে পর্যন্ত তারা সেখানে বিদ্যমান থাকে, অতএব, আপনি ও আপনার প্রভু (আল্লাহ) চলে যান এবং উভয়ে যুদ্ধ করুন, আমরা এখানেই বসে থাকব’ (সূরা আল-মায়েদাহ: ২১-২৪)। আর উক্ত নগরী হচ্ছে ফিলিস্তীন।
৭- মু‘জিযার স্থান : এই ফিলিস্তীনের ভূমিতে অসংখ্য মু‘জিযা বা অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। এখানে ঈসা (আলাইহিস সালাম) ভূমিষ্ট হয়েছেন। ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর মা ছিল কিন্তু কোন বাবা ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, পৃথিবীতে প্রতিটি জিনিসের জন্য মাধ্যম করেছেন। কিন্তু মাধ্যম ছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা যেকোন কিছু করতে পারেন। ‘কুন ফাইয়াকুন’ তথা হয়ে যাও বললেই হয়ে যাবে। প্রজন্ম বৃদ্ধির জন্য একটা স্বাভাবিক নিয়ম হল- নারী-পুরুষের সহবাস। অথচ নারী-পুরুষের মাধ্যমে ছাড়াও তিনি আদম (আলাইহিস সালাম)-কে সৃষ্টি করেছেন। আবার পুরুষ আছে কিন্তু নারী নেই। যেমন হাওয়া (আলাইহিস সালাম)-এর সৃষ্টি। অনুরূপভাবে নারী আছে কিন্তু নর নেই। যেমন ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর জন্ম। কেননা ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর মা মারিয়ামের স্বামী নেই। স্বামী ছাড়ায় তিনি গর্ভবতী হয়েছেন এবং সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এই মু‘জিযার স্থান ছিল ফিলিস্তীন। এই ফিলিস্তীন থেকেই মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইহুদীদের কবল থেকে মুক্তির জন্য ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নিয়েছিলেন।
৮- মারইয়াম (আলাইহিস সালাম) গর্ভ ধারণের পূর্বে গায়েব থেকে অমৌসুমী ফল আসত এবং তা খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। অতঃপর গর্ভের সন্তান যখন পূর্ণতা লাভ করল এবং বাচ্চা ভূমিষ্ট হল; অত্যন্ত ক্ষীণ ও প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় গায়েব থেকে খাবার না পাঠিয়ে খেজুর গাছ ধাক্কা দিয়ে খেজুর খাওয়ার কথা বললেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ ہُزِّیۡۤ اِلَیۡکِ بِجِذۡعِ النَّخۡلَۃِ تُسٰقِطۡ عَلَیۡکِ رُطَبًا جَنِیًّا
‘তুমি তোমার দিকে খেজুর বৃক্ষের কাণ্ড নাড়া দাও, তা থেকে তোমার উপর সুপক্ক তাজা খেজুর পতিত হবে’ (সূরা মারইয়াম: ২৫)। প্রশ্ন হলো- যে আল্লাহ মারইয়ামের গর্ভধারণের পূর্বে এমনিতেই খেতে দিতেন সেই আল্লাহ কি এখানে এমনিতেই খেতে দিতে পারতেন না? উত্তরে মুফাসসিগণ বলেছেন, মারইয়ামের গর্ভধারণের পূর্বে যখন গায়েব থেকে খাবার আসত তখন তাঁর ভালোবাসা শুধু ই ছিল আল্লাহর সঙ্গে। কিন্তু বাচ্চার হওয়ার পরে ভালোবাসার বড় একটা অংশ বাচ্চা পেয়ে গেছে। সুতরাং এখন একটু পরিশ্রম করে খাও। নাড়া দাও উপর থেকে পড়বে তারপর কুড়িয়ে খাও। মারিয়াম (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে উক্ত ঘটনাও ফিলিস্তীনের মাটিতেই সংঘটিত হয়েছে।
৯- শেষ যামানায় যখন ক্বিয়ামত কাছে আসবে তখন ঈসা (আলাইহিস সালাম) আসমান থেকে সাদা মিনারার পাশে নেমে আসবেন এবং সেখানে এসে দাজ্জালকে হত্যা করবেন সেটাও ফিলিস্তীনে অবস্থিত (বিস্তারিত দ্র. : ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৭)।
১০- আরযুল মাহশার ওয়াল মানশার : ফিলিস্তীন তথা শাম দেশে মানুষের হাশর-নাশর হবে। উক্ত হাশর পার্থিব জগতের হাশর, না-কি পরকালীন হাশর; এব্যাপারে আলেমগণের মাঝে ইখতিলাফ রয়েছে। গবেষকগণ বলেছেন, এটা পৃথিবীর হাশর। যা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার আগে সংঘটিত হবে। যখন পৃথিবী ফিতনায় ভর্তি হয়ে যাবে। তখন শামদেশ ফিতনামুক্ত ভূমি হিসাবে অবশিষ্ট থাকবে। নবী (ﷺ) এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এছাড়া ছাহাবায়ে কেরাম যখন রাসূল (ﷺ)-কে ফিতনার সময় কোথায় আশ্রয় নিব জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, ‘শাম দেশে তোমরা আশ্রয় নিবে’। আর শাম দেশ হলো ফিলিস্তীন।
১১- ইয়া’জূজ ও মা’জূজ : এটি শেষ যামানায় ক্বিয়ামতের বড় আলামতের অন্যতম একটি। তারা যখন গোটা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করবে; তাদেরকেও এই ফিলিস্তীনে ধ্বংস করা হবে। এতদ্ব্যতীত তালূত ও জালূতের যে ঘটনা সূরা বাক্বারায় বর্ণিত হয়েছে, তাও ফিলিস্তীনে হয়েছে।
১২- ফিলিস্তীনের বায়তুল আক্বছা মুসলিমদের প্রথম ক্বিবলা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় হিজরত করে ১৬-১৭ মাস পর্যন্ত বায়তুল আক্বছার দিকে ছালাত আদায় করতেন। আর হিজরতের পূর্বে ক্বিবলার দিক ছিল ভিন্ন। যেমন তিনি এমনভাবে ছালাত আদায় করতে দাঁড়াতেন, যাতে আল্লাহর ঘর কা‘বা ঘরও সামনে থাকে আর মসজিদে আক্বছাও সামনে থাকে। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস য এই ব্যাখ্যা করেছেন। যা সর্বাধিক বিশুদ্ধ। অতঃপর মদীনায় হিজরতের পরে বায়তুল আকছার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছালাত আদায় করতে আদেশ করলেন। পরবর্তীতে রাসূল (ﷺ)-এর আগ্রহের কারণে ক্বিবলা পরিবর্তন করে বায়তুল্লাহর দিকে কিবলা নির্ধারণ করেন (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৪৪-১৪৫)।
১৩- ইসরা ও মি‘রাজ : প্রিয় নবী (ﷺ)-এর ইমরা ও মি‘রাজ তথা নৈশ ভ্রমণ হয়েছে। তথা যমীনী সফর ও সাত আসমানের সফর শুরু হয়েছে মক্কাতুল মুকাররমা থেকে মুবারক ভূমি ফিলিস্তীনের মসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত। এ সময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কুদরতে মসজিদে আক্বছায় সকল নবী-রাসূলকে একত্রিত করেছেন। আর তাদের ইমামতি করেছেন মুহাম্মাদ (ﷺ)। এর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, পৃথিবীর ইমামত বা নেতৃত্ব শেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে দেয়া হয়েছে এবং তাঁর উম্মতকে দেয়া হয়েছে। পূর্ববর্তীরা অযোগ্য হওয়ায় নেতৃত্ব তাদের নিকট থেকে নিয়ে উম্মতে মুহাম্মাদীকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ উম্মতে মুহাম্মাদী তাদের মূল চেতনা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে আজকে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের নিকট মার খাচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
سُبۡحٰنَ الَّذِیۡۤ اَسۡرٰی بِعَبۡدِہٖ لَیۡلًا مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَی الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِیۡ بٰرَکۡنَا حَوۡلَہٗ لِنُرِیَہٗ مِنۡ اٰیٰتِنَا ؕ اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ
‘তিনি পবিত্র যিনি তাঁর বান্দাকে (রাসূল (ﷺ)-কে) এক রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আক্বছায়, (বায়তুল মাক্বদিছ) যার চতুষ্পার্শ্বকে আমরা করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা’ (সূরা বানী ইসরাঈল: ১)। এই যে মি‘রাজের সফরটাও ছিল ফিলিস্তীন হয়ে।
১৪- মসজিদে আক্বছায় সফর করা সুন্নাহ : মসজিদে আক্বছা এমন একটি মসজিদ, যে মসজিদের জন্য নেকির উদ্দেশ্যে স্থানকে কেন্দ্র করে সফর করা সুন্নাত এবং ফযীলতপূর্ণ। স্থান কেন্দ্রিক তিনটি মসজিদ ব্যতীত চতুর্থ কোন স্থানে যাওয়া জায়েয নয়। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لَا تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلَّا إِلَىْ ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ مَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَسْجِدِ الْأَقْصَى وَمَسْجِدِىْ هَذَا
আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন দিকে সফর করা যায় না; মসজিদে হারাম, মসজিদে আক্বছা ও আমার এ মসজিদ।[১]
১৫- মসজিদে আক্বছায় ছালাত আদায় করা অত্যন্ত ফযীলতের কাজ। মসজিদে আক্বছায় ছালাত আদায় করলে ৫০০ এবং ২৫০ রাক‘আত ছালাতের ফযীলত পাওয়া যাবে (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৪১৪৪)।
১৬- মসজিদে আক্বছা বা ফিলিস্তীন এমন একটি জায়গা ও এমন একটি মসজিদ, যার আশেপাশে তথা ফিলিস্তীনে বসবাসের জন্য নবী (ﷺ) ছাহাবীদেরকে উৎসাহিত করেছেন। এজন্য মদীনা থেকে হিজরতকারী অনেক ছাহাবী শাম দেশকে অন্য দেশের তুলনায় প্রাধান্য দিতেন। তবে জিহাদের জন্য বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছেন সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু অধিকাংশ ছাহাবায়ে কেরাম যারা মদীনায় বাহিরে গিয়েছেন তারা ফিলিস্তীনেই হিজরত করেছেন (মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৬৮৩)।
১৭- বায়তুল মাক্বদিস বা মসজিদুল আক্বছা কোনটি এটা নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় একপ্রকার ঝড় চলছে। এ প্রসঙ্গে গবেষকগণ বলেছেন যে, মসজিদে আক্বছার আয়তন হলো ১৪৪ হাজার বর্গ মিটার। যে চত্বরে একসাথে ৮ লক্ষ মানুষ ছালাত আদায় করতে পারবে। এই পুরো এলাকার নাম হচ্ছে মসজিদে আক্বছা। যেখানে চারটি আযান দেয়ার জায়গা রয়েছে।
১৮- পূর্বে যা বলেছি তা আবারো জোরালোভাবে বলছি তা হল- ফিলিস্তীন বা বায়তুল মাক্বদিসের বিষয়টি আমাদের মূল আক্বীদার বিষয়। সুতরাং এই যমীনকে কাফের ও যালেমদের থেকে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা ও সার্বিকভাবে সাহায্য করা।
১৯- বায়তুল মাক্বদিছ তথা ফিলিস্তীনের ভূমি সম্পর্কে ইহুদী ও খ্রিষ্টান সকলেই দাবী করে। অথচ এ ভূমির মূল মালিকানা মুসলিমদের। কেননা যুগের পরম্পরায় মুসলিমরাই এই ভূমিতে বসবাস করেছেন, পরিচালনা করেছেন। অসংখ্য নবীর জন্মস্থান ও বসবাসের স্থান হল এই ফিলিস্তীন। এই পবিত্র ভূমি ছিল ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর আবাসস্থল। সুতরাং ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের দাবী নিতান্তই ভুল। বরং তারা জোরজবরদখল করে অবৈধভাবে ভোগ করছে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝার তাওফীক্ব দান করুন।
আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নিকট দু‘আ করি, তিনি যেন মুসলিম জাতিকে ফিলিস্তীনে বিজয় দান করেন এবং এ বিজয় হাসীলের জন্য আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যে শর্তারোপ করেছেন সেগুলো মুসলিমদেরকে দ্রুত পূরণ করার তাওফীক্ব দান করুন। তাদেরকে তাওহীদ ও সুন্নাহ প্রতিষ্ঠার তাওফীক্ব দান করেন। শিরক-বিদ‘আত হতে মুক্ত হওয়ার তাওফীক্ব দান করেন। সুন্নাতের অনুসারী হওয়ার তাওফীক্ব দান করেন। নামকাওয়াস্তে মুসলিম যারা বেনামাজী ও যারা বেদ্বীন ও আল্লাহ থেকে গাফেল হয়ে রয়েছে, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা হেদায়াত নসীব করেন ও সংশোধন করার তাওফীক্ব দান করেন। মনে রাখবেন যে, শিরক-বিদ‘আতের সাথে সংশ্লিষ্ট রেখে, ছালাত পরিত্যাগ করে, নবী (ﷺ)-এর তরীকা বাদ দিয়ে মাজার পূজার তরীকাকে গ্রহণ করছে; আর মনে মনে ভাবছেন আল্লাহর সাহায্য নেমে আসবে!!! আর জগা খিচুড়ি হয়ে থাকবেন তথা শী‘আও থাকবেন, ছূফীও থাকবেন, তাহলে এরূপ আক্বীদার লোকদের জন্য কিভাবে আল্লাহর সাহায্য নেমে আসবে!?
আল্লাহ তা‘আলা সকলকে বুঝার তাওফীক্ব দান করেন এবং তার সাহায্য দ্রুত নাযিল করেন এবং মুসলিমদেরকে মসজিদে আক্বছাকে ফিরিয়ে দেন, মসজিদে আক্বছায় ছালাত আদায় নসীব করেন। এছাড়া আল্লাহ রব্বুল আলামীন যেন কাফির-যালিমদের লাঞ্ছিত করেন, নির্মূল করেন ও ধ্বংস করেন। আল্লাহ যেন তাঁর খাছ মদদ আসমান থেকে নাযিল করেন। ওয়া ছাল্লাল্লাহু ছাল্লি আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলিহি ওয়া ছহবিহি আজমাঈন।
* সম্মানিত দাঈ, দাম্মাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, বাংলা বিভাগ, সঊদী আরব।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৮৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৯৭; মিশকাত, হা/৬৯৩।
প্রসঙ্গসমূহ »:
মুসলিম জাহান