অল্পে তুষ্ট
-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*
ভূমিকা
অধিক সম্পদের লোভ মানুষকে হিংস্র পশুতে পরিণত করে। ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ বিচার করার প্রয়োজন মনে করে না। অর্থ উপার্জনের নেশায় মানুষ যেন আজ দিশেহারা। এটিই যেন তার জীবনের প্রধান উদ্দ্যেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিত্তশালীরা বিশাল বিশাল আবাসিক ভবন তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যয়ের ঘাটতি পূরণে এমন কোন অপরাধ নেই যা করছে না। ক্ষণস্থায়ী একটু সুখের আশায় অনৈতিক পথে ছুটে চলেছে। চিরস্থায়ী আখেরাতের জীবনকে ভুলে গিয়ে অস্থায়ী দুনিয়াবী জীবনকে আঁকড়ে ধরেছে। মৃত্যু নামক অনিবার্য পরিণতি আজ অহংকারের মরীচিকায় ঢাকা পড়েছে। অর্থের জন্যই পৃথিবী আজ অশান্ত। অথচ একজন প্রকৃত মুমিনের উচিত হল আল্লাহ তা‘আলা তার তাক্বদীরে যতটুকু লিখে রেখেছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা এবং আল্লাহর প্রশংসা করা। মূলত দারিদ্র্য বা দুঃখ-কষ্ট যাই থাকুক এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যতটুকু আল্লাহ দেন তার উপর সন্তুষ্ট থাকার নামই হল অল্পে তুষ্ট। এটি অনুপম চরিত্রর একটি মহৎ গুণও বটে।
অল্পে তুষ্ট পরিচিতি
‘অল্পে তুষ্ট’-কে আরবীতে قَنَاعَةٌ বলা হয়। অর্থ সন্তুষ্টি ও পরিতুষ্টি।[১] পরিভাষায় বলা হয়,
القناعة هي الاقتصار على ما سنح من العيش والرّضا بما تسهّل من المعاش وترك الحرص على اكتساب الأموال وطلب المراتب العالية مع الرّغبة في جميع ذلك وإيثاره والميل إليه وقهر النّفس على ذلك والتّقنّع باليسير منه
‘অল্পে তুষ্ট হল, জীবন ধারণের জন্য যতটুকুট প্রয়োজন তাতেই সীমাবদ্ধ থাকা এবং সহজসাধ্য জীবিকাতেই সন্তুষ্ট থাকা। সর্বস্ব বাজি রেখে বেশি বেশি সম্পদ ও মর্যাদা লাভের লোভকে বর্জন করা এবং এ লোভ-লালসার কাজে অন্তরকে বাধ্য না করা এবং সর্বোপরি অল্পে তুষ্ট থাকা’।[২]
মানুষের উচিত সে যতটুকু সম্পদ ও সুখ-শান্তি পেয়েছে তাতে সন্তুষ্ট থাকা। পরমুখাপেক্ষীহীন হয়ে বেঁচে থাকতে গেলে অল্পে তুষ্ট থাকা প্রয়োজন। কারণ সম্পদ প্রাপ্তির আকাক্সক্ষার কোন শেষ নেই। মহান আল্লাহ বলেন, وَ اَطۡعِمُوا الۡقَانِعَ وَ الۡمُعۡتَرَّ ‘আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে ও ভিাক্ষাকারী অভাবগ্রস্তকে’ (সূরা আল-হজ্জ : ৩৬)। এ আয়াতে ‘ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্ত’ বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা অভাবী হওয়া সত্ত্বেও মানুষের কাছে কিছু চায় না। আর তারাই অল্পে তুষ্ট ব্যক্তি’।[৩] অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
لِلۡفُقَرَآءِ الَّذِیۡنَ اُحۡصِرُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ لَا یَسۡتَطِیۡعُوۡنَ ضَرۡبًا فِی الۡاَرۡضِ یَحۡسَبُہُمُ الۡجَاہِلُ اَغۡنِیَآءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعۡرِفُہُمۡ بِسِیۡمٰہُمۡ لَا یَسۡـَٔلُوۡنَ النَّاسَ اِلۡحَافًا وَ مَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ فَاِنَّ اللّٰہَ بِہٖ عَلِیۡمٌ
‘যারা আল্লাহর পথে অবরুদ্ধ রয়েছে বলে ভূ-পৃষ্ঠে গমনাগমনে অপারগ সেই সব দরিদ্রের জন্য ব্যয় করা; (ভিক্ষা হতে) নিবৃত্ত থাকার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অবস্থা সম্পন্ন বলে মনে করে, তুমি তাদেরকে তাদের লক্ষণের দ্বারা চিনতে পার, তারা লোকের নিকট ব্যাকুলভাবে যাঞ্চা করে না এবং তোমরা শুদ্ধ সম্পদ হতে যা ব্যয় কর বস্তুত সে সমস্ত বিষয় আল্লাহ সম্যকরূপে অবগত’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭৩)। উক্ত আয়াতেও অন্যের নিকট না চেয়ে অল্পতে তুষ্ট থাকার কথা বলা হয়েছে।[৪] হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
(لَيْسَ الْمِسْكِيْنُ الَّذِىْ تَرُدُّهُ التَّمْرَةُ وَالتَّمْرَتَانِ وَلَا اللُّقْمَةُ وَلَا اللُّقْمَتَانِ إِنَّمَا الْمِسْكِيْنُ الَّذِىْ يَتَعَفَّفُ وَاقْرَءُوْا إِنْ شِئْتُمْ يَعْنِىْ قَوْلَهُ (لَا یَسۡـَٔلُوۡنَ النَّاسَ اِلۡحَافًا
‘সে মিসকীন নয়, যে একটি অথবা দু’টি খেজুর কিংবা এক অথবা দুই লুকমা খাবারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। বরং সেই প্রকৃত মিসকীন, যে ভিক্ষা করা থেকে বিরত থাকে অর্থাৎ অল্পে তুষ্টি থাকে। আর তোমরা যদি চাও আল্লাহর বাণী তেলাওয়াত করতে পার- ‘তারা লোকের নিকট ব্যাকুলভাবে যাঞ্চা করে না’।[৫] অন্য বর্ণনায় এসেছে, اَلْمِسْكِيْنَ الَّذِىْ لَا يَسْأَلُ النَّاسَ شَيْئًا وَلَا يَفْطِنُوْنَ بِهِ فَيُعْطُوْنَهُ ‘প্রকৃত মিসকীন ঐ ব্যক্তি, যে লোকদের নিকট চায় না এবং লোকেরাও তার অবস্থা অবহিত নয় যে, তাকে কিছু দান করবে’।[৬]
অল্পে তুষ্ট বিষয়টি হৃদয়ের সাথে সম্পর্কিত। যার হৃদয় অল্পতে তুষ্ট সেই প্রকৃত ধনী। আর যার হৃদয় দরিদ্র, অর্থ-সম্পদ তার কোন উপকারে আসে না। অল্পে তুষ্ট থাকলে প্রশান্তিময় জীবন-যাপন করা যায়। এর মধ্যেই প্রকৃত সুখ ও আনন্দ নিহিত।
মানুষের অন্তহীন চাহিদা
ইসলামে অর্থবিত্ত মহান আল্লাহর নে‘মত। এ নে‘মত অর্জনে ইসলাম সবল, সক্ষম প্রত্যেককে উৎসাহিত করেছে। তবু মানব জীবনে চাহিদার কোন শেষ নেই। মানুষের মুখে মাটি পড়া পর্যন্ত অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চাহিদা বাড়তেই থাকে। যে যতবেশী সম্পদের অধিকারী তার চাহিদাও ততবেশি। আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, يَكْبَرُ ابْنُ آدَمَ وَيَكْبَرُ مَعَهُ اثْنَانِ حُبُّ المَالِ وَطُوْلُ العُمُرِ ‘মানুষ যতই বৃদ্ধ হয়, তার মধ্যে দু’টি বস্তুর আকাক্সক্ষা প্রবল হয়। তাহল- সম্পদের প্রতি ভালবাসা এবং দীর্ঘায়ু’।[৭] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন,
لَوْ أَنَّ لِاِبْنِ آدَمَ مِلْءَ وَادٍ مَالًا لَأَحَبَّ أَنْ يَكُوْنَ إِلَيْهِ مِثْلُهُ وَلَا يَمْلأُ نَفْسَ ابْنِ آدَمَ إِلَّا التُّرَابُ وَاللهُ يَتُوْبُ عَلَى مَنْ تَابَ
‘যদি কোন আদম সন্তানের পূর্ণ এক উদ্যান সম্পদ থাকে, তাহলে সে অনুরূপ আরো সম্পদ পেতে চাইবে। মাটি ছাড়া কোন কিছুতেই আদম সন্তানের পেট ভরবে না। যে ব্যক্তি তওবাহ করে আল্লাহ তার তওবাহ কবুল করেন’।[৮]
অর্থের প্রতি চাহিদার এই প্রবণতা মানুষকে মহান আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। দুনিয়ার ভোগ বিলাসে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। সে শুধুই অন্যের সাথে নিজের বিলাসী আয়োজনকে তুলনা করে। যখন দেখে অমুকের এটা আছে, সেটা আছে, তখন ভাবে তাহলে আমার কেন এটা সেটা থাকবে না? ফলে সে সর্বদা আত্মপীড়ায় ভোগে। অথচ ইসলাম সর্বদা মানুষকে তার নীচু শ্রেণীর মানুষের দিকে লক্ষ্য করার প্রতি উৎসাহিত করেছে। যাতে করে সে অর্থপীড়ায় পতিত না হয়। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا نَظَرَ أَحَدُكُمْ إِلَى مَنْ فُضِّلَ عَلَيْهِ فِي الْمَالِ وَالْخَلْقِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْهُ مِمَّنْ فُضِّلَ عَلَيْهِ
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ এমন ব্যক্তিকে দেখে যাকে মালে-সম্পদে, স্বাস্থ্য-সামর্থ্যে অধিক দেয়া হয়েছে, তখন সে যেন নিজের চেয়ে নিম্ন মানের ব্যক্তির দিকে তাকায়।[৯] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, اُنْظُرُوْا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَا تَنْظُرُوْا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ فَإِنَّهُ أَجْدَرُ أَنْ لَا تَزْدَرُوْا نِعْمَةَ اللهِ ‘তোমরা নিজেদের অপেক্ষা নিম্ন অবস্থার লোকের প্রতি তাকাও। এমন ব্যক্তির দিকে তাকিয়েও না, যে তোমাদের চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের। যদি এই নীতি অবলম্বন কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে যে নে‘মত দান করেছেন, তাকে ক্ষুদ্র বা হীন মনে করবে না’।[১০]
সুধী পাঠক! ক্ষণস্থায়ী সুখের সন্ধানে মানুষ আজ ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। চারদিকে বিরাজ করছে হাহাকার। অপূর্ণাঙ্গতার মরণব্যাধিতে ভারাক্রান্ত হৃদয়। সুখের সন্ধানে মানুষ আজ ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। অথচ ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী অল্পতেই তুষ্ট থাকলে হৃদয়ভ্যান্তরে সুখের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হবে এবং জীবন হয়ে উঠবে আরো উপভোগ্য ও সৌন্দর্যম-িত।
ইসলামের দৃষ্টিতে অল্পে তুষ্ট
অল্পে তুষ্ট মুমিন চরিত্রের অন্যতম ভূষণ। কেননা সে সবসময় কৃতজ্ঞতা পরায়ণ হয়। সে যখন যা পায় তাকেই আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহ মনে করে। তাই সে না পাওয়ার মর্মপীড়ায় ভোগে না। এমনকি কোন কিছু যে কোন মূল্যে পেতেই হবে এরূপ চিন্তায় সে মরিয়াও হয় না। যেহেতু মানুষের চাহিদা কখনো শেষ হওয়ার নয়, তাই তা সীমিত রাখার মধ্যেই মানবজীবনে সুখ আসে।
ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যমপন্থা জীবন ব্যবস্থা। তাই ইসলামে কোনরকম বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ির অনুমোদন নেই। এক্ষেত্রে যেমন কৃপণতা করা যাবে না অনুরূপভাবে অপব্যয় থেকে বিরত থাকতে হবে। আর কার্পণ্য ও অপব্যয়ের মাঝখানে রয়েছে মিতব্যয়িতা। এটাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার চিরন্তন আদর্শ। অল্পে তুষ্ট থাকার ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান স্পষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা কৃপণকে সতর্ক করেছেন এভাবে,
وَ اَمَّا مَنۡۢ بَخِلَ وَ اسۡتَغۡنٰی -وَ کَذَّبَ بِالۡحُسۡنٰی- فَسَنُیَسِّرُہٗ لِلۡعُسۡرٰی-وَ مَا یُغۡنِیۡ عَنۡہُ مَا لُہٗۤ اِذَا تَرَدّٰی
‘কেউ কার্পণ্য করল ও বেপরোয়া হল। আর উত্তম জিনিসকে মিথ্যা মনে করল, অচিরেই তার জন্য আমরা সুগম করে দেব কঠোর পরিণামের পথ এবং তার সম্পদ তার কোন কাজে আসবে না, যখন সে পতিত হবে (জাহান্নামে)’ (সূরা আল-লাইল : ৮-১১)। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ أَسْلَمَ وَرُزِقَ كَفَافًا وَقَنَّعَهُ اللهُ بِمَا آتَاهُ ‘ঐ ব্যক্তি সফলকাম, যে ইসলাম গ্রহণ করল, প্রয়োজন মাফিক রিযিক পেল এবং এর উপরই আল্লাহ তাকে সন্তুষ্ট রাখল’।[১১] আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَيْسَ الغِنَى عَن كَثْرَةِ العَرَضِ وَلَكِنَّ الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ ‘সম্পদের আধিক্য ধনাঢ্যতা নয়, প্রকৃত ধনাঢ্যতা হল অন্তরের ধনাঢ্যতা’।[১২]
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অল্পে তুষ্ট থাকার নমুনা
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অল্পে তুষ্টির ব্যপারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও আল্লাহর প্রিয় হাবীব হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জীবনধারা ছিল অতি সাধারণ। প্রাচুর্যের মোহে পরিপুষ্ট হওয়ার অবারিত সুযোগ থাকার পরও আড়ম্বরহীন জীবনকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। জাগতিক উচ্চবিলাসের ভাবনা তাঁর মধ্যে ছিলই না। তাঁর দুনিয়াবিমুখতা ছিল বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ رَضىَ اللهُ عَنْهَا أَنَّهَا قَالَتْ لِعُرْوَةَ ابْنَ أُخْتِىْ إِنْ كُنَّا لَنَنْظُرُ إِلَى الْهِلَالِ ثُمَّ الْهِلَالِ ثَلَاثَةَ أَهِلَّةٍ فِىْ شَهْرَيْنِ وَمَا أُوْقِدَتْ فِىْ أَبْيَاتِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم نَارٌ فَقُلْتُ يَا خَالَةُ مَا كَانَ يُعِيْشُكُمْ قَالَتِ الْأَسْوَدَانِ التَّمْرُ وَالْمَاءُ إِلَّا أَنَّهُ قَدْ كَانَ لِرَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم جِيْرَانٌ مِنَ الْأَنْصَارِ كَانَتْ لَهُمْ مَنَائِحُ وَكَانُوْا يَمْنَحُوْنَ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ أَلْبَانِهِمْ فَيَسْقِيْنَا
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি ‘উরওয়াহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, ‘হে ভগিনীপুত্র! আমরা দু’মাসের মধ্যে তিনবার নতুন চাঁদ দেখতাম। কিন্তু এর মধ্যে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর গৃহসমূহে (রান্নার) জন্য আগুন জ্বালানো হত না। ‘উরওয়াহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, খালা! তাহলে আপনারা কী খেয়ে জীবন কাটাতেন? তিনি বললেন, কালো দু’টি জিনিস দিয়ে। অর্থাৎ শুকনো খেজুর আর পানি। অবশ্য রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতিবেশী কয়েকজন আনছারীর দুগ্ধবতী উটনী ও ছাগী ছিল। তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য দুধ পাঠাতেন, তখন তিনি আমাদেরকে তা পান করাতেন।[১৩] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আরো বলেন, تُوُفِّي رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَدِرْعُهُ مَرْهُوْنَةٌ عِنْدَ يَهُوْدِيٍّ فيْ ثَلَاثِيْنَ صَاعًا مِنْ شَعِيْر ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ইন্তিকাল করেন, তখন তাঁর বর্ম ত্রিশ ছা‘ যবের বিনিময়ে এক ইহুদীর নিকট বন্ধক ছিল।[১৪] অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিছানার বিবরণ দিয়ে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,كَانَ فِرَاشُ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ أُدْمٍ حَشْوُهُ لِيْفٌ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিছানা চামড়ার তৈরি ছিল এবং তার ভিতরে ছিল খেজুর গাছের ছোবড়া’।[১৫] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আরো বলেন,
مَا شَبِعَ آلُ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم مِنْ خُبْزِ شَعِيْرٍ يَوْمَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ حَتَّى قُبِضَ. وَفِيْ رِوَايَةٍ مَا شَبِعَ آلُ محَمّدٍ صلى الله عليه وسلم مُنْذُ قَدِمَ المَدِيْنَةَ مِنْ طَعَامِ البُرِّ ثَلَاثَ لَيَالٍ تِبَاعًا حَتَّى قُبِضَ
‘মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিজন তাঁর ইন্তিকাল পর্যন্ত ক্রমাগত দু’দিন যবের রুটি পরিতৃপ্ত হয়ে খেতে পাননি’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘এমনকি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিবার মদীনায় আগমনের পর থেকে তাঁর ইন্তিকাল পর্যন্ত টানা তিনদিন গমের রুটি পরিতৃপ্ত হয়ে খেতে পাননি’।[১৬] ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَبِيْتُ اللَّيَالِىَ الْمُتَتَابِعَةَ طَاوِيًا وَأَهْلُهُ لَا يَجِدُوْنَ عَشَاءً وَكَانَ أَكْثَرُ خُبْزِهِمْ خُبْزَ الشَّعِيْرِ
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাধারে কয়েক রাত অনাহারে কাটাতেন এবং পরিবার-পরিজনরা রাতের খাবার পেতেন না। আর তাদের অধিকাংশ রুটি হত যবের’।[১৭]
সুধী পাঠক! বিশ্ব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মহা মানব, যাকে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন প্রথম কবর থেকে উঠাবেন, যার সুপারিশ ছাড়া উম্মতের মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়, যার মাধ্যমে আল্লাহ জান্নাত উদ্বোধন করবেন সেই মহান ব্যক্তি বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দুনিয়াবী জীবনে অল্পে তুষ্ট থাকার নমুনা যদি এরূপ হয়, তাহলে বর্তমানে গুনাহগার ব্যক্তিদের অবস্থা কেমন হওয়া উচিত তা বিবেচনার বিষয়। অতএব হে দুনিয়া পূজারী অর্থলোভী মানুষ! সাবধান হও।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* পি-এইচ.ডি. গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[১]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৬৩।
[২]. নাযরাতুন নাঈম ফী মাকারিমি আখলাক্বির রাসূলিল কারীম, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৩২৬৮।
[৩]. আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী, তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিন মান্নান (মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি.), পৃ. ৫৩৮।
[৪]. তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিন মান্নান, পৃ. ১১৬, ৯৫৮; ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭০৫।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৫৩৯ ‘তাফসীর’ অধ্যায়-৬৫; নাসাঈ, হা/২৫৭১।
[৬]. আবূ দাঊদ, হা/১৬৩১ ‘যাকাত’ অধ্যায়-৩, অনুচ্ছেদ-২৪, সনদ ছহীহ।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪২১।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৫০১।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৯০; ছহীহ মুসলিম, হ/২৯৬৩।
[১০]. তিরমিযী, হা/২৫১৩; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৪২; মিশকাত, হা/৫২৪২, সনদ ছহীহ।
[১১]. তিরমিযী, হা/২৫১৩; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৪২; মিশকাত, হা/৫২৪২, সনদ ছহীহ।
[১২]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৫৪; তিরমিযী, হা/২৩৪৮; মিশকাত, হা/৫১৬৫।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫৬৭, ৬৪৫৮, ৬৪৫৯; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৭২।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯১৬, ৪৪৬৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০৩; নাসাঈ, হা/৪৬৫১; মিশকাত, হা/২৮৮৫।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৫৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২০৮২।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪১৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৭০; মিশকাত, হা/৫২৩৭।
[১৭]. তিরমিযী, হা/২৩৬০; ইবনু মাজাহ, হা/৩৩৪৭; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২১১৯।