মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১০:৪৪ অপরাহ্ন

ফাযায়েলে কুরআন

-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*


(৫ম কিস্তি)

আল-কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলন


আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّ عَلَیۡنَا جَمۡعَہٗ وَ قُرۡاٰنَہٗ ‘নিশ্চয় তা (কুরআন) সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমাদেরই’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ১৭)। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন অবতরণ করেছেন এবং তা সংরক্ষণের দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন। সকল আসমানী গ্রন্থ একসাথে এবং লিপিবদ্ধ অবস্থায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু আল-কুরআন একসাথে এবং লিপিবদ্ধ অবস্থায় অবতীর্ণ হয়নি। বরং ‘সম্পূর্ণ কুরআন এক সাথে লাইলাতুল ক্বদরে দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ করা হয়েছে। এরপর মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নববী জীবনে তা ধীরে ধীরে খণ্ড খণ্ডভাবে এবং একটি অংশ অপর অংশের পর জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর মাধ্যমে অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল-কুরআন অবতরণের সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্তরে কুরআনকে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করে দিতেন এবং নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে তা লিপিবদ্ধ করাতেন। তাই বলা যায় যে, আল-কুরআন দু’টি পদ্ধতিতে সংরক্ষিত হয়েছে। ১. মুখস্ত ও কণ্ঠস্থ করা, ২. লিপিবদ্ধ করা।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময় কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলন


রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র অন্তর কুরআন মাজীদের সর্বপ্রথম সংরক্ষণকারী ও জমাকারী। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অন্তরে আল-কুরআনকে জমা করেছেন। আল-কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা আয়ত্ত করার জন্য তাঁর জিহ্বা সঞ্চালন করতেন এবং মুখস্ত করার জন্য খুবই তাড়াহুড়া করতেন। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) যখন তাঁর নিকট কুরআন পাঠ করতেন তখন তিনিও তাঁর সাথে মুখস্ত করতে চেষ্টা করতেন। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে নির্দেশ দেন,

لَا تُحَرِّکۡ بِہٖ لِسَانَکَ لِتَعۡجَلَ بِہٖ   - اِنَّ عَلَیۡنَا جَمۡعَہٗ  وَ  قُرۡاٰنَہٗ   - فَاِذَا قَرَاۡنٰہُ  فَاتَّبِعۡ  قُرۡاٰنَہٗ  - ثُمَّ  اِنَّ عَلَیۡنَا بَیَانَہٗ

‘তাড়াতাড়ি অহী আয়ত্ত করার জন্য আপনি আপনার জিহ্বা ওর সাথে দ্রুত সঞ্চালন করবেন না। নিশ্চয় তা সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমাদেরই। সুতরাং যখন আমরা তা (জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর মাধ্যমে) পাঠ করি আপনিও তখন সেই পাঠের অনুসরণ করুন। অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমাদেরই’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ১৬-১৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا تَعۡجَلۡ بِالۡقُرۡاٰنِ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ یُّقۡضٰۤی اِلَیۡکَ وَحۡیُہٗ  وَ  قُلۡ  رَّبِّ  زِدۡنِیۡ  عِلۡمًا ‘আপনার প্রতি আল্লাহর অহী সম্পূর্ণ হবার পূর্বে আপনি তাড়াতাড়ি করবেন না এবং বলুন, হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন!’ (সূরা ত্বা-হা : ১১৪)।

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। মহান আল্লাহর বাণী : ‘তাড়াতাড়ি অহী আয়ত্ত করার জন্য আপনি আপনার জিহ্বা ওর সাথে দ্রুত সঞ্চালন করবেন না’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ১৬)-এর ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অহী অবতরণের সময় তা আয়ত্ত করতে বেশ কষ্ট করতেন এবং প্রায়ই তিনি তাঁর উভয় ঠোঁট নাড়াতেন। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)  বলেন, ‘আমি তোমাকে দেখানোর জন্য ঠোঁট দু’টি নাড়ছি যেভাবে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা নাড়াতেন। সাঈদ (রাহিমাহুল্লাহ) (তার শিষ্যদের) বলেন, আমি ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে যেরূপে তাঁর ঠোঁট দু’টি নাড়াতে দেখেছি, সেভাবেই আমার ঠোঁট দু’টি নাড়াচ্ছি। এই বলে তিনি তাঁর ঠোঁট দু’টি নাড়ালেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করলেন, ‘অহী দ্রুত আয়ত্ত করার জন্য আপনি অহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় আপনার জিহ্বা নাড়াবেন না, এর সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমাদেরই’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ১৬)।

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, এর অর্থ হল, আপনার অন্তরে তা হেফাযত করা এবং আপনার দ্বারা তা পাঠ করানো। ‘সুতরাং আমরা যখন তা পাঠ করি, তখন আপনি সেই পাঠের অনুসরণ করুন’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ১৮)। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)  বলেন, অর্থাৎ মনোযোগ সহকারে শুনুন এবং চুপ থাকুন। ‘তারপর এর বিশদ বর্ণনার দায়িত্ব তো আমাদেরই’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ১৯)। অর্থাৎ আপনি তা পাঠ করুন, এটাও আমাদের দায়িত্ব। তারপর যখন আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আসতেন, তখন তিনি মনোযোগ দিয়ে কেবল শুনতেন। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) চলে যাবার পর তিনি যেমন পাঠ করেছিলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও তদ্রুপ পাঠ করতেন।[১]

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,وَكَانَ يَلْقَاهُ فِىْ كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ ‘জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রামাযানের প্রতি রাতেই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে দেখা করতেন এবং তাঁরা একে অপরকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন’।[২]

মাসরূক্ব (রাহিমাহুল্লাহ) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর মাধ্যমে ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে গোপনে বলেছেন,أَنَّ جِبْرِيْلَ كَانَ يُعَارِضُنِىْ بِالْقُرْآنِ كُلَّ سَنَةٍ وَإِنَّهُ عَارَضَنِى الْعَامَ مَرَّتَيْنِ ‘প্রতি বছর জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আমার সঙ্গে একবার কুরআন শুনান এবং শুনেন; কিন্তু এ বছর তিনি আমার সঙ্গে দু’বার এ কাজ করেন’।[৩]

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, كَانَ يَعْرِضُ عَلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْقُرْآنَ كُلَّ عَامٍ مَرَّةً  فَعَرَضَ عَلَيْهِ مَرَّتَيْنِ فِى الْعَامِ الَّذِى قُبِضَ ‘প্রতি বছর জিবরীল (আলাইহিস সালাম) নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে একবার কুরআন মাজীদ শোনাতেন ও শুনতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর মৃত্যু হয় সে বছর তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দু’বার শুনিয়েছেন’।[৪]

যায়দ ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অহি লেখক। কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হলে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশে তিনি তা কাষ্ঠখণ্ড ও  কাঁধের হাড়ে লিখে রাখতেন। হাদীছে এসেছে, বারাআ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ... لَا یَسۡتَوِی الۡقٰعِدُوۡنَ  আয়াতটি অবতীর্ণ হলে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,

اُدْعُ لِىْ زَيْدًا وَلْيَجِئْ بِاللَّوْحِ وَالدَّوَاةِ وَالْكَتِفِ أَوِ الْكَتِفِ وَالدَّوَاةِ ثُمَّ قَالَ اكْتُبْ ) لَا یَسۡتَوِی الۡقٰعِدُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ غَیۡرُ اُولِی الضَّرَرِ وَ الۡمُجٰہِدُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ

‘যায়দকে আমার কাছে ডেকে আন এবং তাকে বল সে যেন কাষ্ঠখণ্ড, দোয়াত এবং কাঁধের হাড় (রাবী বলেন, অথবা তিনি বলেছেন, কাঁধের হাড় এবং দোয়াত) নিয়ে আসে। এরপর তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, (.....لَا یَسۡتَوِی الۡقٰعِدُوۡنَ  ) লিখ’।[৫]

ছাহাবীগণ কর্তৃক আল-কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলন


ছাহাবীগণও আল-কুরআনকে মুখস্ত ও লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ ও সংকলন করেছেন। তাঁরা সরাসরি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট থেকে কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং তা সংরক্ষণ করেছেন। যেমন- হাদীছে এসেছে,

শাক্বীক্ব ইবনু সালামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আমাদের সামনে ভাষণ দিলেন এবং বললেন,وَاللهِ لَقَدْ أَخَذْتُ مِنْ فِىْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِضْعًا وَسَبْعِيْنَ سُوْرَةً ‘আল্লাহর শপথ! সত্তরেরও কিছু অধিক সূরা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মুখ থেকে হাসিল করেছি’।[৬] আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আরো বলেন, ‘আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া কোন সত্য মা‘বূদ নেই, আল্লাহর কিতাবের অবতীর্ণ প্রতিটি সূরা সম্পর্কে আমি জানি যে, তা কোথায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং প্রতিটি আয়াত সম্পর্কে আমি জানি যে, তা কোন্ ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। আমি যদি জানতাম যে, কোন ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে আমার চেয়ে অধিক জ্ঞাত এবং সেখানে উট পৌঁছতে পারে, তাহলে সওয়ার হয়ে সেখানে পৌঁছে যেতাম’।[৭]

আলক্বামা (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা হিম্স শহরে ছিলাম। এ সময় ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) সূরা ইউসুফ তেলাওয়াত করলেন। তখন এক ব্যক্তি বললেন, এটা এভাবে অবতীর্ণ হয়নি। এ কথা শুনে ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে এ সূরা তেলাওয়াত করেছি। তিনি বলেছেন, তুমি সুন্দর পড়েছ’।[৮]

ছাহাবীদের মধ্যে অনেকেই ক্বারী ছিলেন। যারা কুরআন মুখস্ত ও কণ্ঠস্থ করতেন। যে ক্বারীদের নিকট হতে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যান্য ছাহাবীদেরকে কুরআন শিক্ষার নির্দেশ দিতেন। যেমন- আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর কথা উল্লেখ পূর্বক বলেছেন, ‘আমি তাঁকে ঐ সময় থেকে ভালবাসি, যখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আমি বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন,خُذُوا الْقُرْآنَ مِنْ أَرْبَعَةٍ مِنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ وَسَالِمٍ وَمُعَاذٍ وَأُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ ‘তোমরা চার ব্যক্তি থেকে কুরআন শিক্ষা কর- ১. আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, ২. সালিম, ৩. মু‘আয এবং উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)’।[৯]

তাছাড়া কাফির-মুশরিক কর্তৃক নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময় অনেক ক্বারীকে হত্যাও করা হয়েছিল। যেমন ‘রিল ও যাকওয়ান বি‘রে মাউনা’ নামক একটি কূপের নিকট ৭০ (সত্তর) জন ক্বারীর শহীদি মৃত্যু।[১০]

মুখস্ত ও কণ্ঠস্থ করার পাশাপাশি ছাহাবীগণ নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট থেকে কুরআন সংগ্রহ করতেন এবং তা সংরক্ষণ ও সংকলন করতেন। ক্বাতাদা (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করলাম,

مَنْ جَمَعَ الْقُرْآنَ عَلَى عَهْدِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أَرْبَعَةٌ كُلُّهُمْ مِنَ الْأَنْصَارِ أُبَىُّ بْنُ كَعْبٍ وَمُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ وَزَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ وَأَبُو زَيْدٍ

‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময় কোন্ কোন্ ব্যক্তি কুরআন সংগ্রহ করেছেন? তিনি বললেন, ‘চারজন এবং তাঁরা চারজনই ছিলেন আনছারী ছাহাবী। তাঁরা হলেন, উবাই ইবনু কা‘ব, মু‘আয ইবনু জাবাল, যায়দ ইবনু ছাবিত এবং আবূ যায়দ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)’।[১১]

ইউসুফ ইবনু মাহিক (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর কাছে ছিলাম। এমন সময় এক ইরাকী ব্যক্তি এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কোন্ ধরনের কাফন শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন, আফসোস তোমার প্রতি! এতে তোমার কী ক্ষতি? তারপর লোকটি বলল, হে উম্মুল মুমিনীন! আমাকে আপনি আপনার কুরআনের কপি দেখান। তিনি বললেন, কেন? লোকটি বলল, এ তারতীবে কুরআনকে বিন্যস্ত করার জন্য। কারণ লোকেরা তাকে অবিন্যস্তভাবে পাঠ করে। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন,

وَمَا يَضُرُّكَ أَيَّهُ قَرَأْتَ قَبْلُ إِنَّمَا نَزَلَ أَوَّلَ مَا نَزَلَ مِنْهُ سُوْرَةٌ مِنَ الْمُفَصَّلِ فِيْهَا ذِكْرُ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ حَتَّى إِذَا ثَابَ النَّاسُ إِلَى الإِسْلَامِ نَزَلَ الْحَلَالُ وَالْحَرَامُ وَلَوْ نَزَلَ أَوَّلَ شَىْءٍ لَا تَشْرَبُوا الْخَمْرَ لَقَالُوْا لَا نَدَعُ الْخَمْرَ أَبَدًا وَلَوْ نَزَلَ لَا تَزْنُوْا  لَقَالُوْا لَا نَدَعُ الزِّنَا أَبَدًا لَقَدْ نَزَلَ بِمَكَّةَ عَلَى مُحَمَّدٍ وَإِنِّىْ لَجَارِيَةٌ أَلْعَبُ (بَلِ السَّاعَۃُ  مَوۡعِدُہُمۡ وَ السَّاعَۃُ اَدۡہٰی  وَ  اَمَرُّ) وَمَا نَزَلَتْ سُوْرَةُ الْبَقَرَةِ وَالنِّسَاءِ إِلَّا وَأَنَا عِنْدَهُ

‘তোমরা এর যে অংশই আগে পাঠ কর না কেন, এতে তোমাদের কোন ক্ষতি নেই। (اَلْمُفَصَّلُ) মুফাছছাল সূরা সমূহের মাঝে প্রথমত ঐ সূরাগুলো অবতীর্ণ হয়েছে যার মধ্যে জান্নাত ও জাহান্নামের উল্লেখ রয়েছে। তারপর যখন লোকেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল তখন হালাল-হারামের বিধান সম্বলিত সূরাগুলো অবতীর্ণ হয়েছে। যদি প্রথমেই এ আয়াত অবতীর্ণ হত যে, তোমরা মদ পান কর না, তাহলে লোকেরা বলত, আমরা কখনো মদপান ত্যাগ করব না। যদি শুরুতে অবতীর্ণ হত তোমরা ব্যভিচার কর না, তাহলে তারা বলত আমরা কখনো অবৈধ যৌনাচার ত্যাগ করব না। আমি যখন খেলাধূলার বষয়সী একজন বালিকা তখন মক্কায় মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি নিম্নলিখিত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়, بَلِ السَّاعَۃُ  مَوۡعِدُہُمۡ وَ السَّاعَۃُ اَدۡہٰی  وَ  اَمَرُّ ‘অধিকন্তু ক্বিয়ামত তাদের শাস্তির নির্ধারিত কাল এবং ক্বিয়ামত হবে কঠিনতর ও তিক্ততর’ (সূরা আল-ক্বামার : ৪৬)। (বিধান সম্বলিত) সূরা আল-বাক্বারাহ ও সূরা আন-নিসা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে থাকাকালীন অবস্থায় অবতীর্ণ হয়। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তার কাছে সংরক্ষিত কুরআনের কপি বের করলেন এবং সূরাসমূহ লেখালেন’।[১২]

ইবনু মাস‘ঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি সূরা বানী ইসরাঈল, সূরা আল-কাহফ, সূরা মারইয়াম, সূরা ত্ব-হা, সূরা আল-আম্বিয়া সম্পর্কে বলতেন যে, إِنَّهُنَّ مِنَ الْعِتَاقِ الْأُوَلِ وَهُنَّ مِنْ تِلَادِىْ ‘এগুলো হচ্ছে আমার সর্বপ্রথম সম্পদ এবং এগুলো আমার পুরাতন সম্পত্তি’।[১৩]

ইবনু মাস‘ঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘সমপর্যায়ের ঐ সূরাগুলো সম্পর্কে আমি খুব অবগত আছি, যা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি রাক‘আতে জোড়া জোড়া পাঠ করতেন। তারপর আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) দাঁড়ালেন এবং ‘আলক্বামা তাঁকে অনুসরণ করলেন। যখন ‘আলক্বামা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন তখন আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, এগুলো হচ্ছে মোট বিশটি সূরা, ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর সংকলন মুতাবিক মুফাছছাল থেকে যার শুরু এবং শেষ হচ্ছে ‘হা-মীম’, ‘আদ-দুখান’ এবং ‘আম্মা ইয়াতাসা আলুন’।[১৪]

গ্রন্থাবদ্ধ করে আল-কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলন


ইসলামের প্রথম খলীফা আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সময়কালে সর্বপ্রথম কুরআন মাজীদ গ্রন্থাবদ্ধ করা হয়। তিনিই প্রথমে কুরআনকে গ্রন্থাবদ্ধ করেন। নবুওতের সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-খিলাফত লাভ করেন। তাঁর খিলাফত লাভ করার পর পরই তিনি কয়েকটি সমস্যার সম্মুখীন হন। তার মধ্যে অন্যতম হল মুরতাদ সমস্যা। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তেকালের পর অনেক লোক মুরতাদ হয়ে যায়। তাদেরকে দমন করার জন্য আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কয়েকটি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হিজরী দ্বাদশ সালে ইয়ামামার প্রান্তরে ‘ইয়ামামার যুদ্ধ’। তাতে বহু ছাহাবী শাহাদত লাভ করেন। শাহাদত লাভকারী ছাহাবীদের মধ্যে অনেকেই ছিল কুরআনের হাফেয। যুদ্ধে কুরআনের হাফেযদের মৃত্যুতে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অন্তরে আল-কুরআন গ্রন্থাবদ্ধ করে সংরক্ষণ ও সংকলনের চিন্তা হয়। যেমন হাদীছে এসেছে,

যায়দ ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়ামামার যুদ্ধের পর পরই খলীফা আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি গিয়ে দেখি ওমর ইবনু খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর নিকট বসা। আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমার নিকট এসে বলছেন, ইয়ামামা যুদ্ধে বহু কুরআনের হাফেয শহীদ হয়েছেন, আমার আশঙ্কা হয়, যদি বিভিন্ন স্থানে এভাবে কুরআনের হাফেয শহীদ হতে থাকেন, তাহলে কুরআনের অনেকাংশ লোপ পাবে। অতএব আমি সঙ্গত মনে করি যে, আপনি কুরআনকে একত্র করতে নির্দেশ দিবেন। আমি ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) -কে বললাম, আপনি এমন কাজ কেমন করে করবেন, যা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) করেননি?  ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আল্লাহর কসম, এটা অতি উত্তম হবে। এরূপে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আমাকে এটা বারবার বলতে লাগলেন। অবশেষে এটার জন্য আল্লাহ আমার অন্তরকে প্রশস্ত করে দিলেন এবং আমিও সঙ্গত মনে করলাম, যা ওমর সঙ্গত মনে করেছেন।

যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাকে বললেন,  তুমি একজন বুদ্ধিমান ও বিশ্বাসী জোয়ান, যার প্রতি আমরা কোন সন্দেহ পোষণ করি না, আর তুমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অহিও লিখতে। সুতরাং তুমি কুরআনের আয়াতসমূহ অনুসন্ধান কর এবং তা একত্র কর। যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, যদি তাঁরা আমাকে পাহাড়সমূহের একটি পাহাড় স্থানান্তরিত করার দায়িত্ব অর্পণ করতেন, তবে তা আমার পক্ষে কুরআন একত্র করার যে গুরুদায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করলেন, তা অপেক্ষা অধিকতর দুঃসাধ্য হত না। যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি বললাম, আপনারা কেমন করে এমন কাজ করবেন, যা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) করেননি? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, এটা বড় উত্তম কাজ। মোটকথা আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এভাবে আমাকে পুনঃপুনঃ বলতে লাগলেন, অবশেষে আল্লাহ আমার অন্তরকেও প্রশস্ত করে দিলেন, যার জন্য আবূ বকর ও ওমরের অন্তরকে প্রশস্ত করে দিয়েছেন। সুতরাং আমি তা সংগ্রহ করলাম খেজুরের ডাল, সাদা পাথর, পশুর হাড় ও মানুষের অন্তর বা স্মৃতি হতে। অবশেষে সূরা তাওবাহর শেষ দু’টি আয়াত শুধু আবূ খুযায়মা আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট পেলাম। তা তিনি ছাড়া আমি অপর কারও নিকট পাইনি। আয়াতগুলো হচ্ছে,

لَقَدۡ جَآءَکُمۡ رَسُوۡلٌ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ عَزِیۡزٌ عَلَیۡہِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِیۡصٌ عَلَیۡکُمۡ بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ  - فَاِنۡ تَوَلَّوۡا فَقُلۡ حَسۡبِیَ اللّٰہُ  لَاۤ  اِلٰہَ  اِلَّا ہُوَ  عَلَیۡہِ  تَوَکَّلۡتُ وَ ہُوَ رَبُّ الۡعَرۡشِ  الۡعَظِیۡمِ

‘তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের কাছে এক রাসূল এসেছে। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তাঁর জন্য তা কষ্টদায়ক। সে তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি সে দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। এরপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আপনি বলুন, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি এবং তিনি মহা আরশের অধিপতি’ (সূরা আত-তাওবাহ : ১২৮-১২৯)। যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এই লিখিত ছহীফাগুলো খলীফা আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট ছিল, যতদিন না আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে উঠিয়ে নেন। অতঃপর খলীফা ওমর ফারূক (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর নিকট তাঁর জীবন থাকা পর্যন্ত ছিল, অতঃপর তাঁর কন্যা উম্মুল মুমিনীন হাফছা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট ছিল।[১৫]

যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি কুরআনের আয়াতসমূহ একত্রিত করে একটি মাছহাফে লিপিবদ্ধ করলাম, তখন সূরা আহযাবের একটি আয়াত আমি পেলাম না, যা আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পড়তে শুনেছি। একমাত্র খুযাইমা ইবনু ছাবিত আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট পেলাম। যার সাক্ষ্যকে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু‘ব্যক্তির সাক্ষ্যের সমান গণ্য করেছিলেন। সে আয়াতটি হল,

مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ رِجَالٌ صَدَقُوۡا مَا عَاہَدُوا اللّٰہَ عَلَیۡہِ  فَمِنۡہُمۡ مَّنۡ قَضٰی نَحۡبَہٗ  وَ مِنۡہُمۡ مَّنۡ یَّنۡتَظِرُ  وَ مَا بَدَّلُوۡا تَبۡدِیۡلًا

‘মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি’ (সূরা আল-আহযাব : ২৩)। এরপর এ আয়াতটিকে আমরা কুরআন মাজীদের ঐ সূরাতে যুক্ত করে দিলাম।[১৬] আনাস  ইবনু  মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ حُذَيْفَةَ بْنَ الْيَمَانِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَدِمَ عَلَى عُثْمَانَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ وَكَانَ يُغَازِيْ أَهْلَ الشَّامِ فِي فَتْحِ أَرْمِيْنِيَّةَ وَأَذَرْبَيْجَانَ مَعَ أَهْلِ الْعِرَاقِ فَأَفْزَعَ حُذَيْفَةَ اخْتِلَافُهُمْ فِي الْقِرَاءَةِ فَقَالَ حُذَيْفَةُ لِعُثْمَانَ يَا أَمِيْرَ الْمُؤْمِنِيْنَ أَدْرِكْ هَذِهِ الْأُمَّةَ قَبْلَ أَنْ يَخْتَلِفُوْا فِي الْكِتَابِ اخْتِلَافَ الْيَهُوْدِ وَالنَّصَارَى فَأَرْسَلَ عُثْمَانُ إِلَى  حَفْصَةَ أَنْ أَرْسِلِيْ إِلَيْنَا بِالصُّحُفِ نَنْسَخُهَا فِي الْمَصَاحِفِ ثُمَّ نَرُدُّهَا إِلَيْكِ فَأَرْسَلَتْ بِهَا حَفْصَةُ إِلَى عُثْمَانَ فَأَمَرَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ وَعَبْدَ اللهِ بْنَ الزُّبَيْرِ وَسَعِيْدَ بْنَ الْعَاصِ وَعَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ الْحَارِثِ بْنِ هِشَامٍ فَنَسَخُوْهَا فِي الْمَصَاحِفِ وَقَالَ عُثْمَانُ لِلرَّهْطِ الْقُرَشِيِّيْنَ الثَّلَاثِ إِذَا اخْتَلَفْتُمْ فِيْ شَيْءٍ مِنَ الْقُرْآنِ فَاكْتُبُوْهُ بِلِسَانِ قُرَيْشٍ فَإِنَّمَا نَزَلَ بِلِسَانِهِمْ فَفَعَلُوْا حَتَّى إِذَا نَسَخُوا الصُّحُفَ فِي الْمَصَاحِفِ رَدَّ عُثْمَانُ الصُّحُفَ إِلَى حَفْصَةَ وَأَرْسَلَ إِلَى كُلِّ أُفُقٍ بِمُصْحَفٍ مِمَّا نَسَخُوْا وَأَمَرَ بِمَا سِوَاهُ مِنَ الْقُرْآنِ فِيْ كُلِّ صَحِيْفَةٍ أَوْ مُصْحَفٍ أَنْ يُحْرَقَ

‘হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) খলীফা ওছমান গনী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট মদীনায় আগমন করলেন, আর তখন হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইরাক্বীদের সাথে থেকে আর্মেনিয়া ও আযারবাইজান জয় করার জন্য শামবাসীদের সাথে যুদ্ধ করছিলেন। (সেখানকার) লোকজনের বিভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠ হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে উদ্বিগ্ন করে তুলল। হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! ইহুদী ও নাছারাদের ন্যায় আল্লাহর কিতাবে বিভিন্নতা সৃষ্টির পূর্বে আপনি এই জাতিকে রক্ষা করুন। সুতরাং ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উম্মুল মুমিনীন হাফছা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট বলে পাঠালেন, আপনার নিকট রক্ষিত কুরআনের ছহীফাসমূহ আমাদের নিকট পাঠিয়ে দিন। আমরা তা বিভিন্ন মাছহাফে অনুলিপি করে অতঃপর তা আপনাকে ফিরিয়ে দিব। হাফছা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তা ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যায়েদ  ইবনু  ছাবেত, আব্দুল্লাহ  ইবনু  যুবায়র, সাঈদ  ইবনুল  ‘আছ, আব্দুর রহমান ইবনু  হারেছ  ইবনু হিশাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-কে তা লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। তাঁরা মাছহাফে তা লিপিবদ্ধ করলেন। সে সময় ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তিন সদস্যের কুরাইশদলকে বললেন, যখন কুরআনের কোন স্থানে আপনাদের মতভেদ হবে, তখন আপনারা তা কুরাইশদের রীতিতেই লিপিবদ্ধ করবেন। কেননা কুরআন তাদের রীতিতেই অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁরা সে মতে কাজ করলেন। অবশেষে যখন তাঁরা সমস্ত ছহীফা বিভিন্ন মাছহাফে লিপিবদ্ধ করলেন, ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উক্ত ছহীফাসমূহ হাফছা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট ফেরত পাঠালেন এবং তাঁরা যা লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার এক এক কপি রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দিলেন, আর এটা ছাড়া যে কোন ছহীফায় বা মাছহাফে লেখা কুরআনকে জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন’।[১৭]

ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাজ অর্থাৎ কুরআনকে গ্রন্থাবদ্ধ করা এবং কুরাইশদের ভাষায় লিখিত ছহীফা ছাড়া বাকীগুলো জ্বালিয়ে দেয়ার উপর সকল ছাহাবী ইজমা‘ বা ঐকমত্য হয়েছেন। যেমনটা আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,لَوْ لَمْ يَفْعَلْ ذَلِكَ عُثْمَانَ لَفَعَلْتُهُ أَنَا ‘যদি ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ওই কাজ না করতেন, তাহলে আমি অবশ্যই তা করতাম’।[১৮] তাছাড়া আল-কুরআনকে গ্রন্থাবদ্ধ করার ব্যাপারে চার ইমাম আবূ বকর, ওমর, ওছমান এবং আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) ঐকমত্য হয়েছেন। আর তাঁরা হলেন ঐ সকল খলীফা, যাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّينَ ‘তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে’।[১৯]

 (ইনশাআল্লাহ চলবে)

* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র : 
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫, ‘অহির সূচনা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৪৮; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩৯।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬, ‘অহির সূচনা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫; নাসাঈ, হা/২০৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬১৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬৩৭০।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬২৪, ৪৯৯৭, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬; সিলসিলা ছহীহা, হা/৩৫২৪।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৯৮, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৯৪; মিশকাত, হা/২০৯৯।
[৫]. সূরা আন-নিসা : ৯৫; ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৯০, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪০।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০০০, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০০২, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৬২।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০০১, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬; মিশকাত, হা/২২১৯।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৯৯, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৬৪; তিরমিযী, হা/৩৮১০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৭৮৬; সিলসিলা ছহীহা, হা/১৮২৭।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৪০৮৮, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৪।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০০৩, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৬৫।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৯৩, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, ‘তা’লীফুল কুরআন’ অনুচ্ছেদ।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৯৪, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, ‘তা’লীফুল কুরআন’ অনুচ্ছেদ।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৯৬, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, ‘তা’লীফুল কুরআন’ অনুচ্ছেদ।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৮৬, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, ‘জাম‘উল কুরআন’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত, হা/২২২০।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৮৮, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, ‘জাম‘উল কুরআন’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত, হা/২২২১।
[১৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৮৭, ‘ফাযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়, ‘জাম‘উল কুরআন’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত, হা/২২২১।
[১৮]. ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম (দারুত ত্বায়্যেবা, ২য় সংস্করণ ১৪২০ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮; ইবনু কাছীর, ফাযায়েলে কুরআন (মাকতাবাতু ইবনু তাইমিয়াহ, ১৪১৬ হি.), পৃ. ৬৮।
[১৯]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭, ‘সুন্নাহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ, হা/৪২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৮২; মিশকাত, হা/১২৬।  




প্রসঙ্গসমূহ »: আমল কুরআনুল কারীম
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী - আব্দুল গাফফার মাদানী
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
আল-কুরআন সম্পর্কে অমুসলিম মনীষীদের মূল্যায়ন - রাফিউল ইসলাম
মুছীবতে ধৈর্যধারণ করার ফযীলত - শায়খ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
কুরবানীর মাসায়েল - ইবাদুল্লাহ বিন আব্বাস
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ - ড. মেসবাহুল ইসলাম
সর্বশ্রেষ্ঠ আমল - হাফেয আবূ তাহের বিন মজিবুর রহমান
কুরআনী প্রবাদ সংকলন : তাৎপর্য ও শিক্ষা - প্রফেসর ড. লোকমান হোসেন
বিদ‘আত পরিচিতি (২৭তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ