ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি
-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
(৩য় কিস্তি)
তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত
এর অর্থ- আল্লাহর নামসমূহ ও তাঁর গুণাবলী এককভাবে তাঁর সাথেই সম্পৃক্ত করা, অন্য কারো সাথে তুলনীয় নয়। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, ঐভাবেই বিশ্বাস করা। কোন রূপক বা বিকৃত অর্থ না করা, কোন কল্পিত ব্যাখ্যা না দেয়া।[১] তাঁর সাথে সৃষ্টির কোন কিছুই তুলনীয় নয়। আল্লাহ বলেন, لَیۡسَ کَمِثۡلِہٖ شَیۡءٌ وَ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (সূরা আশ-শূরা : ১১)। সুতরাং তাঁর আকারের সাথে কোন কিছুর তুলনা করা যাবে না। আল্লাহ নিজেই বলেছেন, فَلَا تَضۡرِبُوۡا لِلّٰہِ الۡاَمۡثَالَ ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর কোন সাদৃশ্য বর্ণনা করো না’ (সূরা আন-নাহল : ৭৪)।
অতএব কুরআন ও ছহীহ হাদীছে তাঁর আকৃতি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তার কোন রূপক বা বিকৃত অর্থ করা যাবে না। বরং বলতে হবে তিনি তাঁর মত। ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
وَلَهُ يَدٌ وَوَجْهٌ وَنَفْسٌ كَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِى الْقُرْآنِ فَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِى الْقُرْآنِ مِنْ ذِكْرِ الْوَجْهِ وَالْيَدِ وَالنَّفْسِ فَهُوَ لَهُ صِفَاتٌ بِلاَ كَيْفٍ وَلاَ يُقَالُ إِنَّ يَدَهُ قُدْرَتُهْ أَوْ نِعْمَتُهُ لِأَنَّ فِيْهِ إِبْطَالُ الصِّفَةِ وَهُوَ قَوْلُ أَهْلِ الْقَدْرِ وَالْاِعْتِزَالِ وَلَكِنَّ يَدَهُ صِفَتُهُ بِلاَ كَيْفٍ وَغَضَبَهُ وَرِضَاهُ صِفَتَانِ مِنْ صِفَاتِ اللهِ تَعَالَى بِلاَ كَيْفٍ
‘তাঁর (আল্লাহর) হাত, মুখম-ল এবং নফস রয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন। আর মহান আল্লাহ কুরআনে তাঁর মুখমণ্ডল, হাত ও নফস সম্পর্কে যে কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলো তাঁর গুণ। কিন্তু সেগুলো কারো সাথে তুলনীয় নয়। আর একথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর ‘কুদরত’ বা ‘নে‘মত’। কারণ এতে আল্লাহর গুণ বাতিল সাব্যস্ত হয়। আর এটা ক্বাদারিয়া ও মু‘তাযিলাদের বক্তব্য। বরং কারো হাতের সাথে তুলনা ছাড়াই তাঁর হাত তাঁর গুণ। আর আল্লাহ্র রাগ ও সন্তুষ্টি কারো রাগ ও সন্তুষ্টির সাথে তুলনা ছাড়াই তাঁর দু’টি ছিফাত বা গুণ’।[২] অন্যত্র তিনি বলেন,
قَالَ أَبُوْ حَنيفَةَ عَمَّنْ قَالَ لَا أَعْرِفُ رَبِّىْ فِي السَّمَاءِ أَمْ فِي الْأَرْضِ فَقَدْ كَفَرَ لِأَنَّ اللهَ يَقُوْلُ الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى وَعَرْشُهُ فَوْقَ سَبْعِ سَمَوَاتٍ
‘আবু হানীফা (রহিমাহুল্লাহ) ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, যে বলে আল্লাহ আসমানে আছেন, না যমীনে আছেন আমি তা জানি না, সে কুফরী করবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘রহমান আরশের উপর সমুন্নত’ (সূরা ত্ব-হা : ৫)। আর তাঁর আরশ সপ্তম আসমানের উপরে’।[৩]
কালেমায়ে শাহাদাতের তাৎপর্য
আমরা তাওহীদের বাণী মুখে উচ্চারণ করি, কিন্তু এর মর্ম উপলব্ধি করি না। এটা মুখে উচ্চারণ করার পর যদি তাকে মূল্যায়ন না করতে পারি, তবে তা নষ্ট হয়ে যায়। গাছের শিকড় কেটে দিয়ে পানি ঢেলে যেমন গাছকে বাঁচানো যায় না, তেমনি আক্বীদার মূল ভিত্তি এই কালেমার মর্যাদা বিনষ্ট হলে ঈমান থাকবে না এবং আমল করে কোন লাভ হবে না। ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু’ এর অর্থ হল, لَا مَعْبُوْدَ بِحَقٍّ إِلَّا اللهُ ‘আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন মা‘বূদ নেই’।[৪] যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ذٰلِکَ بِاَنَّ اللّٰہَ ہُوَ الۡحَقُّ وَ اَنَّ مَا یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِہِ الۡبَاطِلُ ‘এ জন্যই আল্লাহই সত্য, আল্লাহকে ছাড়া তারা যাকে আহ্বান করে তা বাতিল’।[৫] অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ہُوَ الۡحَیُّ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ فَادۡعُوۡہُ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ‘তিনিই চিরঞ্জীব। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। সুতরাং একনিষ্ঠচিত্তে তোমরা তাকেই ডাক। যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ্রই প্রাপ্য’ (সূরা আল-মু’মিন : ৬৫)। ইমাম ত্বাবারী (২২৪-৩১০ হি.) বলেন,
لا معبود بحق تجوز عبادته وتصلح الألوهة له إلا الله الذي هذه الصفات صفاته فادعوه أيها الناس مخلصين له الدين مخلصين له الطاعة مفردين له الألوهة لا تشركوا في عبادته شيئا سواه من وثن وصنم ولا تجعلوا له ندا ولا عدلا
‘এমন কোন মা‘বূদ নেই যার জন্য ইবাদত বৈধ হবে এবং আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নির্ধারণ করা সঠিক হবে। আর এই গুণাবলী কেবল তাঁর সাথেই নির্দিষ্ট। সুতরাং হে মানবম-লী! তোমরা একনিষ্ঠচিত্তে কেবল তাঁরই ইবাদত কর, তাঁরই জন্য আনুগত্যকে খাছ কর, সমস্ত ইলাহকে পরিত্যাগ করে তাঁকেই একক ইলাহ হিসাবে নির্ধারণ কর। আর তাঁকে ছাড়া অন্য কোনকিছুকে তাঁর ইবাদতে শরীক কর না, তা মূর্তি হোক, কবর হোক। তোমরা তাঁর জন্য কোন শরীক ও সমকক্ষ নির্ধারণ কর না’।[৬]
প্রচলিত ইলাহ অনেক রয়েছে। আল্লাহ নিজেকে এগুলো থেকে মুক্ত করে কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করার নির্দেশ দান করেছেন।[৭] উক্ত আয়াতের আলোকে ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ অর্থ ‘কোন মা‘বূদ নেই আল্লাহ ছাড়া’।[৮]
কোন হক্ব মা‘বূদ নেই বলতে কোন ইবাদতের যোগ্য, সাহায্য চাওয়ার যোগ্য, আশ্রয় দাতা, আইন দাতা, বিধান দাতা ও রূযী দাতা কেউ নেই। অনুরূপ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম, দর্শন, মতবাদ, থিওরি ও ইজমকে স্থান না দেয়া। কারণ এগুলো সব ত্বাগূতী বিধান। এক কথায় মানব রচিত যাবতীয় মা‘বূদ ও বিধানকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা, ঘৃণা করা। কারণ এক আল্লাহ এবং তাঁর বিধান ব্যতীত বাকী সবই ত্বাগূত। সবকিছুকে নাকচ করার পর পবিত্র হৃদয়ে একমাত্র মা‘বূদ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে স্থান দেয়া হল, ‘ইল্লাল্লাহু’ বলে সুদৃঢ় সাক্ষ্য প্রদান করা। আল্লাহ বলেন,
لَاۤ اِکۡرَاہَ فِی الدِّیۡنِ قَدۡ تَّبَیَّنَ الرُّشۡدُ مِنَ الۡغَیِّ فَمَنۡ یَّکۡفُرۡ بِالطَّاغُوۡتِ وَ یُؤۡمِنۡۢ بِاللّٰہِ فَقَدِ اسۡتَمۡسَکَ بِالۡعُرۡوَۃِ الۡوُثۡقٰی لَا انۡفِصَامَ لَہَا وَ اللّٰہُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ
‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় ভ্রষ্টতা হতে হেদায়াত স্পষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি ত্বাগূতকে অস্বীকার করল এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করল, সে সুদৃঢ় হাতলকে শক্ত করে ধারণ করল, যা কখনো বিচ্ছিন্ন হবার নয়। আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞানী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫৬)।
উক্ত আয়াতে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু’-এর দাবী পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। এর মূল দাবী হল, ত্বাগূতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা এবং কেবলমাত্র ইসলামকে স্বীকার করা। তাই পৃথিবীর সকল নবী-রাসূলকে আল্লাহ পাঠিয়েছিলেন বিশ্ব মানবতাকে ত্বাগূতমুক্ত করার জন্য। শুধু আল্লাহর ইবাদত করানোই তাদের উদ্দেশ্য ছিল না; বরং মূল উদ্দেশ্য ছিল সকল মিথ্যা মা‘বূদের ইবাদত বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করানো। আল্লাহ বলেন, وَ لَقَدۡ بَعَثۡنَا فِیۡ کُلِّ اُمَّۃٍ رَّسُوۡلًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ وَ اجۡتَنِبُواالطَّاغُوۡتَ ‘আমরা প্রত্যেক উম্মতের মাঝে রাসূল পাঠিয়েছি এই জন্য যে, তারা যেন নির্দেশ দেন- তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূতকে বর্জন কর’ (সূরা আন-নাহল : ৩৬)। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, মূসা (আলাইহিস সালাম) -এর অনুসারী হিসাবে ইহুদীরা পরিচিত। তারা তাওরাতের দাবীদার। অনুরূপ ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর অনুসারী হিসাবে খ্রীস্টানরা পরিচিত। তারা ইঞ্জীলের দাবীদার। তাদের কিতাব আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত হলেও রহিত হওয়ার কারণে আমরা তাদেরকেও অস্বীকার করি, তাদের ধর্মকেও অস্বীকার করি। অথচ কাফের, মুশরিকদের তৈরি করা আধুনিক মতবাদ ও থিওরিগুলোকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না; রবং সেগুলোকে বিশ্বাস করছি।
আর কালেমায়ে শাহাদাতের দ্বিতীয় অংশ ‘ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু’-এর অর্থ হল, এই পৃথিবীতে অনুসরণীয় ব্যক্তি হিসাবে একমাত্র মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কেই স্বীকার করা। তাঁর আনীত বিধানকে সত্যায়ন করা এবং তাঁরই দেখানো পদ্ধতিতে ইবাদত করা।[৯]
মূলনীতি-৩ : ইসলামের আধ্যাত্মিকতা ও মৌলিক তত্ত্বের প্রতি আস্থা পোষণ
ইসলাম যে আল্লাহ প্রদত্ত পরম সত্য জীবন বিধান এবং এর বার্তা যে হেদায়াতপূর্ণ অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন, তার যৌক্তিকতা সর্বাগ্রে অনুধাবন করতে হবে। কারণ এই স্বাতন্ত্র্য কেবল ইসলামের সাথেই সংশ্লিষ্ট। অন্য কোন ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণ নেই। আল্লাহর অহি তত্ত্বসমৃদ্ধ, তাৎপর্যমণ্ডিত এবং চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণপূর্ণ। এটা উপলব্ধি না করলে শরী‘আতের গূঢ়রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয়। আর যখন আধ্যাত্মিকতার মূল্যায়ন করা হবে, তখন শরী‘আতের প্রতি আস্থা তৈরি হবে। কারণ ধর্মীয় চেতনাহীন কোন জাতি উন্নতি ও অগ্রগতির শীর্ষে আরোহণ করতে পারবে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হলেও কোন লাভ হবে না। মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫২৬ খৃ.) ইউরোপের বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে-
“The decline in the authority of religion, the indispensable guide of man, the one source which can give more purpose and nobility and meaning to life of man, explains, at least in part, why the Western World has given its allegiance in the recent decades to new political gospels based on race or class, or has pinned its faith on a form of science which admittedly is almost wholly concerned with advance in the material plane, with making life more rather than less expensive and complicated.”
‘ধর্ম হল মানুষের অনিবার্য ও অপরিহার্য পথ-প্রদর্শক; নৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল, মানুষের জীবনের ইযযত-সম্মান ও মৌলিকত্ব লাভের একক উপায় ও মাধ্যম। এর শক্তি খর্ব হওয়ার ফল দাঁড়াল এই যে, পাশ্চাত্য জগৎ এমন সব রাজনৈতিক ধর্ম ও ধ্যান-ধারণার প্রতি ঝুঁকে পড়ল, যার ভিত্তি হল বংশ ও শ্রেণী-বৈষম্যের উপর। প্রাকৃতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাবে একথা মেনে নিল যে, বস্তুগত উন্নতি-অগ্রগতিই হল উচ্চতর ও মহত্ত্বের লক্ষ্য। আর এ কারণেই জীবন ব্যবস্থার জটিলতা ও সমস্যা-সংকটগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে’।[১০]
এজন্য মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে যরূরী প্রয়োজন হল, হৃদয়ের গহীনে সঠিক ও শুদ্ধ চেতনাবোধ সৃষ্টি করা, যা কোন রকমের যুলুম ও বেইনছাফী বরদাশত করে না এবং ধর্ম ও নৈতিকতার বিকৃতি সহ্য করে না। অপরাধী ও অন্যায়কারী যেন অসন্তোষ ও ক্রোধের হাত থেকে বাঁচতে না পারে। অনুরূপ অকপট ও নিষ্ঠাবান মানুষ যেন উপযুক্ত কদর ও স্বীকৃতি পাওয়া থেকে মাহরূম না হয়। সে যেন তার সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যা-সংকট নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে এবং ফায়ছালা করার সামর্থ্য রাখে। যতদিন এই আধ্যাত্মিক চেতনাবোধের উন্মেষ না ঘটবে, ততদিন কোন মুসলিম দেশ ও জাতির কর্ম-প্রেরণা, কাজের সামর্থ্য ও যোগ্যতা, ধর্মীয় আবেগ কোন গুরুত্ব বহন করবে না।
শরী‘আতে আধ্যাত্মিকতার মূল্যায়ন
ইসলামে আধ্যাত্মিকতার গুরুত্ব সর্বাধিক। আধ্যাত্মিক চেতনা মানুষের মাঝে বিদ্যমান না থাকলে বা হ্রাস পেলে নৈতিক মূল্যবোধ বলতে কিছু থাকে না। তার মাঝে চূড়ান্ত বিশ্বাস থাকতে হবে যে, ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হওয়া মহা পবিত্র বার্তা। যদি এটা মানবরচিত কোন মতবাদ বা দর্শন হত, তবে সেখানে ত্রুটি-বিচ্যুতির আশংকা থাকত। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের শুরুতেই চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, এই কিতাবের মধ্যে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আল্লাহ বলেন, ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ فِیۡہِ ہُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ‘এটা ঐ গ্রন্থ, যার মধ্যে কোনরূপ সন্দেহ নেই। আল্লাহভীরুদের জন্য এ গ্রন্থ মুক্তির দিশারী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَا یَنۡطِقُ عَنِ الۡہَوٰی- اِنۡ ہُوَ اِلَّا وَحۡیٌ یُّوۡحٰی ‘তিনি (মুহাম্মাদ) প্রবৃত্তির তাড়নায় কোন কথা বলেন না। যতক্ষণ না তাঁর প্রতি অহী করা হয়’ (সূরা আন-নাজম ৩ ও ৪)। বরং তিনি যদি নিজের পক্ষ থেকে কোন বিধান রচনা করেন তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে হত্যা করারও হুমকি দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
وَ لَوۡ تَقَوَّلَ عَلَیۡنَا بَعۡضَ الۡاَقَاوِیۡلِ- لَاَخَذۡنَا مِنۡہُ بِالۡیَمِیۡنِ- ثُمَّ لَقَطَعۡنَا مِنۡہُ الۡوَتِیۡنَ
‘তিনি যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করতেন, তবে আমি তাঁর ডান হাত ধরে নিতাম। অতঃপর তাঁর গলা কেটে ফেলতাম’ (সূরা আল-হা-ক্কাহ : ৪৪-৪৬)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, لَّا یَاۡتِیۡہِ الۡبَاطِلُ مِنۡۢ بَیۡنِ یَدَیۡہِ وَ لَا مِنۡ خَلۡفِہٖ تَنۡزِیۡلٌ مِّنۡ حَکِیۡمٍ حَمِیۡدٍ ‘অহীর সামনের দিক থেকেও মিথ্যা আসতে পারে না, পিছন দিক থেকেও আসতে পারে না। এটা মহা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত’ (সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ : ৪২)।
ইসলামী শরী‘আত যে আল্লাহ প্রদত্ত এবং এখানে যে কোন মানুষের কল্পনাপ্রসূত কোনকিছুর সংমিশ্রণ নেই, তা উক্ত আয়াতগুলোতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এ ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে আল্লাহ তা‘আলা চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন (আল-বাক্বারাহ : ২৩-২৪)। এরূপ নিশ্চয়তা অন্য কোন গ্রন্থের জন্য দেয়া হয়নি। তাই আল্লাহ প্রদত্ত অহির বিধান যে এক ভারসাম্যপূর্ণ হেদায়াত, তা স্বীকার করা ছাড়া কোন পথ নেই। আল্লাহর বাণী এত শক্তিশালী তা পৃথিবীর মানুষ কখনো কল্পনা করেনি। এর ভার যে কেউ গ্রহণ করতে সক্ষম নয়, তা পূর্বে কেউ উপলব্ধি করতে পারেনি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لَوۡ اَنۡزَلۡنَا ہٰذَا الۡقُرۡاٰنَ عَلٰی جَبَلٍ لَّرَاَیۡتَہٗ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنۡ خَشۡیَۃِ اللّٰہِ وَ تِلۡکَ الۡاَمۡثَالُ نَضۡرِبُہَا لِلنَّاسِ لَعَلَّہُمۡ یَتَفَکَّرُوۡنَ
‘যদি আমি এই কুরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম, তবে আপনি দেখতেন যে, ওটা আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে। আমি এসব দৃষ্টান্ত বর্ণনা করি মানুষের জন্য, যাতে তারা চিন্তা করে’ (সূরা আল-হাশর : ২১)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
اِنَّا عَرَضۡنَا الۡاَمَانَۃَ عَلَی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ الۡجِبَالِ فَاَبَیۡنَ اَنۡ یَّحۡمِلۡنَہَا وَ اَشۡفَقۡنَ مِنۡہَا وَ حَمَلَہَا الۡاِنۡسَانُ ؕ اِنَّہٗ کَانَ ظَلُوۡمًا جَہُوۡلًا
‘আমি আকাশম-লী, পৃথিবী ও পাহাড়সমূহের প্রতি এই আমানত পেশ করেছিলাম। অতঃপর তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং এতে শঙ্কিত হল। কিন্তু মানুষ তা বহন করল, সে তো অতিশয় যালেম, অতিশয় অজ্ঞ’ (সূরা আল-আহযাব : ৭২)।
মহা গ্রন্থ আল-কুরআন নিছক কোন বাণী নয়, এটা প্রজ্ঞাময় বিশাল আলোকস্তম্ভ। নিম্নের হাদীছে এর গুরুত্ব আরো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে-
عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِيْنَ رضى الله عنها أَنَّ الْحَارِثَ بْنَ هِشَامٍ سَأَلَ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ كَيْفَ يَأْتِيْكَ الْوَحْىُ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَحْيَانًا يَأْتِيْنِىْ مِثْلَ صَلْصَلَةِ الْجَرَسِ وَهُوَ أَشَدُّهُ عَلَىَّ فَيُفْصَمُ عَنِّىْ وَقَدْ وَعَيْتُ عَنْهُ مَا قَالَ وَأَحْيَانًا يَتَمَثَّلُ لِىَ الْمَلَكُ رَجُلاً فَيُكَلِّمُنِىْ فَأَعِىْ مَا يَقُوْلُ قَالَتْ عَائِشَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا وَلَقَدْ رَأَيْتُهُ يَنْزِلُ عَلَيْهِ الْوَحْىُ فِى الْيَوْمِ الشَّدِيْدِ الْبَرْدِ فَيَفْصِمُ عَنْهُ وَإِنَّ جَبِيْنَهُ لَيَتَفَصَّدُ عَرَقًا
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, হারেছ বিন হিশাম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একদা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে জিজ্ঞেস করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার উপর কিভাবে অহি আসে? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, কোন কোন সময় তা ঘণ্টা বাজার মত আসে। এটি আমার নিকট খুব বেদনাদায়ক মনে হয়। তা শেষ হতেই ফেরেশতা যা বলেন, আমি তা মুখস্থ করে নিই। আবার ফেরেশতা কখনো মানুষের রূপ ধারণ করে এসে আমার সাথে কথা বলেন। তিনি যা বলেন আমি তা মুখস্থ করে নিই। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, তীব্র শীতে অহি নাযিলের সময় আমি তাঁকে দেখেছি, অহি শেষ হলেই তাঁর কপাল থেকে ঘাম ঝরে পড়ত।[১১]
আল্লাহ তা‘আলা অন্য এক আয়াতে বলেন, وَ تَمَّتۡ کَلِمَتُ رَبِّکَ صِدۡقًا وَّ عَدۡلًا لَا مُبَدِّلَ لِکَلِمٰتِہٖ ‘আপনার রবের কথা সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ। তাঁর কথার পরিবর্তনকারী কেউ নেই’ (সূরা আল-আন‘আম : ১১৬)। একটি হাদীছে পবিত্র কুরআনের সাথে অন্যান্য গ্রন্থের তুলনা বর্ণিত হয়েছে। একদা ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করেন,
إِنَّا نَسْمَعُ أَحَادِيْثَ مِنْ يَهُوْدَ تُعْجِبُنَا أَفْتَرَى أَنْ نَكْتُبَ بَعْضَهَا؟ فَقَالَ أَمُتَهَوِّكُوْنَ أَنْتُمْ كَمَا تَهَوَّكَتِ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارَى؟ لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيَّةً وَلَوْ كَانَ مُوْسَى حَيًّا مَا وَسِعَهُ إِلَّا اتِّبَاعِىْ
‘আমরা ইহুদীদের নিকটে অনেক কাহিনী শুনি, যা আমাদেরকে মুগ্ধ করে। আমরা কি সেগুলোর কিছু অংশ লিখে রাখব? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ইহুদী-খ্রীস্টানরা যেভাবে দিশেহারা হয়েছে, তোমরা কি সেভাবে দিশেহারা হয়ে যাবে? অথচ আমি তোমাদের কাছে উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে এসেছি। শুনে রাখ, আজ যদি মূসা (আলাইহিস সালাম) বেঁচে থাকতেন, আমার আনুগত্য ছাড়া তাঁরও কোন গত্যন্তর থাকত না’।[১২] অন্যত্র এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বারীরার ব্যাপারে ফায়ছালা দেয়ার সময় দৃঢ়তার সাথে বলেন,
فَمَا بَالُ رِجَالٍ يَشْتَرِطُوْنَ شُرُوْطًا لَيْسَتْ فِىْ كِتَابِ اللهِ مَاكَانَ مِنْ شَرْطٍ لَيْسَ فِىْ كِتَابِ اللهِ فَهُوَ بَاطِلٌ وَإِنْ كَانَ مِائَةَ شَرْطٍ فَقَضَاءُ اللهِ أَحَقُّ وَشَرْطُ اللهِ أوْثَقُ
‘মানুষের কী হল যে, তারা অধিক শর্তারোপ করছে, অথচ তা আল্লাহ্র বিধানে নেই। মনে রেখ, যে শর্ত আল্লাহ্র সংবিধানে নেই তা বাতিলযোগ্য, যদিও তা একশ’ শর্ত হয়। আল্লাহ্র সিদ্ধান্তই সর্বাধিক অভ্রান্ত এবং তাঁর শর্তই চূড়ান্ত’।[১৩]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
১. মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছায়মীন, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৩- وتوحيد الأسماء والصفات هو إفراد الله بما يجب له من الأسماء والصفات بأن نثبتها لله – تعالى – على وجه الحقيقة من غير تحريف ولا تعطيل ولا تكييف ولا تمثيل।
২. ইমাম আবু হানীফাহ আন-নু‘মান ইবনু ছাবিত আল-কূফী, আল-ফিক্বহুল আকবার (বৈরুত : দারুল কিতাব আল-ইলমিয়াহ, ২০১১ খৃ.), পৃ. ৬৬-৬৭।
৩. মাজমূ‘আতুল ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড, ৫ম অংশ, পৃ. ৩৩ ও ৯০।
৪. আক্বীদাতুত তাওহীদ, পৃ. ২৬; মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছায়মীন, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১ম খ-, পৃ. ৮৩; আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু বায, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, ৪র্থ খণ্ড (রিয়ায : ইদারাতুল বুহূছিল ইলমিয়াহ ওয়াল ইফতা, ১৪৩৫ হি.), পৃ. ১৬।
৫. সূরা লুক্বমান : ৩০; ফাতাওয়া উছায়মীন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৬৬-৬৭।
৬. মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আবু জা‘ফর আত-ত্বাবারী, জামি‘উল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ৯ম খণ্ড (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪৩১ হি./২০১০ খৃ.), পৃ. ৭৭০।
৭. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫।
৮. মাজমূ‘আতুল ফাতাওয়া, ১ম খণ্ড, ১ম অংশ, পৃ. ৬৯ – فَهَذَا يَدُلُّ عَلَى أَنَّهُ لَا مَعْبُوْدَ إِلَّا اللهُ।
৯. ফাতাওয়া উছায়মীন, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৭।
১০. মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারাল?, পৃ. ২৩৬, গৃহীত : Convocation Address, Aligarh Muslim University, p. 29-38.
১১. ছহীহুল বুখারী, পৃ. ৯, হা/২, ‘অহী’ অধ্যায়।
১২. আহমাদ ইবনু হাম্বল, মুসনাদুল ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল, ৩য় খণ্ড (কায়রো : মুওয়াসসাসাহ কুরতুবাহ, তা.বি.), পৃ. ৩৮৭, হা/১৫১৯৫; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ১ম খণ্ড (রিয়াদ : মাকতাবাতুর রুশদ, ১৪২৩ হি./২০০৩ খৃ.), পৃ. ৩৪৭, হা/১৭৪; মিশকাতুল মাছাবীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩০, হা/১৭৭; সনদ হাসান, আলবানী, যিলালুল জান্নাহ ফী তাখরীজিস সুন্নাহ লি ইবনে আবী আছিম, ১ম খণ্ড (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪১৩ হি./১৯৯৩ খৃ.), পৃ. ২১, হা/৫০।
১৩. ছহীহ বুখারী, পৃ. ৩৪২, হা/২৭২৯, ‘গোলাম আযাদ’ অধ্যায়; মিশকাত, ২য় খ-, পৃ. ৮৭০-৮৭১, হা/২৮৭৭, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়।