ইখলাছই পরকালের জীবনতরী
-আব্দুল গাফফার মাদানী*
(৩য় কিস্তি)
ইখলাছের অফুরন্ত প্রতিদান
১. জান্নাতুন নাঈম লাভ
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মুখলিছ বান্দার জন্য অনেক পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তার মধ্যে সর্বোত্তম পুরস্কার হল জান্নাতুন নাঈম। মহান আল্লাহ বলেন,
اِلَّا عِبَادَ اللّٰہِ الۡمُخۡلَصِیۡنَ- اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ رِزۡقٌ مَّعۡلُوۡمٌ - فَوَاکِہُ ۚ وَ ہُمۡ مُّکۡرَمُوۡنَ - فِیۡ جَنّٰتِ النَّعِیۡمِ
‘তবে তারা নয়, যারা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা। তাদের জন্য আছে নির্ধারিত রিযিক। ফলমূল আর তারা হবে সম্মানিত। সুখ-কাননে’ (সূরা আছ-ছাফ্ফাত : ৪০-৪৩)।
২. আমলের গ্রহণযোগ্যতা
ইখলাছ হচ্ছে আমল কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত। ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেন, فَإنَّهُ تَعَالَى لَا يَتَقَبَّلُ الْعَمَلَ حَتَّى يَجْمَعِ هَذَيْنِ الرُّكْنَيْنِ أَنْ يَّكُوْنَ صَوَابًا مُوَافَقًا لِلشَّرِيْعَةِ وَأَنْ يَّكُوْنَ خَاِلصًا مِّنَ الشِّرْكِ ‘আল্লাহ তা‘আলা কোন আমল গ্রহণ করেন না, যতক্ষণ না এ দু’টি রুকন তাতে বিদ্যমান থাকে। (১) শরী‘আতের পদ্ধতি অনুযায়ী হওয়া এবং (২) শিরক মুক্ত হওয়া।[১]
সাঈদ ইবনু ইয়াযীদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইলম পূর্ণতা লাভ করে পাঁচটি বৈশিষ্ট্যর মাধ্যমে। (১) আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞান (২) প্রকৃত জ্ঞান (৩) একমাত্র আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ আমল (৪) সুন্নাতী পদ্ধতিতে আমল করা এবং (৫) হালাল রিযিক্ব ভক্ষণ করা। এগুলোর কোন একটির অনুপস্থিতিতে আমল কবুল হবে না।[২] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
إِنَّ اللهَ لَا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ
‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা শুধু সেই আমল গ্রহণ করেন, যা শিরক মুক্ত ও একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়’।[৩] অন্যত্র তিনি বলেন,
إِذَا جَمَعَ اللهُ الْأَوَّلِيْنَ وَالْآخِرِيْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيْهِ نَادَى مُنَادٍ مَنْ كَانَ أَشْرَكَ فِي عَمَلٍ عَمِلَهُ لِلهِ فَلْيَطْلُبْ ثَوَابَهُ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللهِ فَإِنَّ اللهَ أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ
‘আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন যখন পূর্বাপর সকলকে একত্র করবেন, যে দিনের আগমনে কোন সন্দেহ নেই, তখন একজন ঘোষক ঘোষণা দিবেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করতে গিয়ে এর মধ্যে কাউকে শরীক করেছে, সে যেন গায়রুল্লাহ্র নিকট নিজের ছওয়াব চেয়ে নেয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা শরীকদের শিরক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত’।[৪]
৩. রাসূল (ﷺ)-এর শাফা‘আত লাভ
বান্দার ইখলাছ যত বেশি হবে ক্বিয়ামতের দিন রাসূল (ﷺ)-এর শাফা‘আত লাভে সে ততবেশী সফলকাম হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ القِيَامَةِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ ‘ক্বিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত লাভে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান হবে সেই ব্যক্তি, যে একনিষ্ঠচিত্তে বলে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই’।[৫]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৯১-৭৫১ হি.) এ হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘তাওহীদের রহস্য হল- শুধু তাওহীদের মাধ্যমে শাফা‘আত লাভ করা যায়। অতএব যে ব্যক্তি তাওহীদের দিক থেকে বেশি পরিপূর্ণতা লাভ করবে সেই শাফা‘আতের অধিক উপযুক্ত হবে। এই কথাটিই নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খানের (১৮০৫-১৯০২ খ্রি.) কথাকে আরো গুরুত্বারোপ করে। অতঃপর তিনি বলেন, শাফা‘আত হল মুখলিছ বান্দাদের জন্য, আল্লাহর সাথে শিরককারীদের জন্য নয়’।[৬] অতএব বুঝা গেল যে, শাফা‘আত শুধু তাওহীদপন্থী ও মুখলিছদের জন্যই খাছ।
৪. অন্তর বিদ্বেষমুক্ত হয়
যখন কোন অন্তরে ইখলাছের আগমন ঘটে, তখন ইখলাছ তাকে পুনর্জ্জীবিত করে, বিপদ থেকে শিক্ষা দেয়, খারাপ গুণ ও অশ্লীলতা থেকে সুরক্ষিত রাখে। এ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন, ثَلَاثٌ لاَ يُغِلُّ عَلَيْهِنَّ قَلْبُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ إِخْلَاصُ الْعَمَلِ لِلهِ وَالنُّصْحُ لأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِيْنَ وَلُزُوْمُ جَمَاعَتِهِمْ ‘তিনটি বিষয়ে কোন মুসলিম ব্যক্তির অন্তর যেন প্রতারিত না হয়। নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমল করা, মুসলিম নেতৃবৃন্দকে সদুপদেশ দেয়া ও তাদের জামা‘আতকে আঁকড়ে রাখা’।[৭]
৫. পাপরাশি মার্জনা ও দ্বিগুণ প্রতিদান লাভ
যখন কোন ব্যক্তি ইখলাছের সাথে আমল করতে সক্ষম হবে, তখন এটি তার জন্য গুনাহ মাফ ও দ্বিগুণ প্রতিদান লাভের মাধ্যম হবে। যদিও তার ইবাদত পরিমাণে অল্পও হয়। এ বিষয়ে ইবনুল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, رُبَّ عَمَلٍ صَغِيْرٍ تُكَثِّرُهُ النِّيَّةُ وَرُبَّ عَمَلٍ كَثِيْرٍ تُصَغِّرُهُ النِّيَّةُ ‘অনেক ছোট আমল আছে, নিয়ত যাকে বৃদ্ধি করে দেয়। আর পরিমাণে বেশি এমন অনেক আমল আছে, নিয়ত তা কমিয়ে দেয়’।[৮]
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, ‘মানুষ মাঝে মাঝে এক ধরনের আমল করে। আর ঐ আমলটি শুধু আল্লাহর জন্য মুখলিছভাবে সম্পাদন করে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এর বিনিময়ে তাকে কাবীরা গুনাহ ক্ষমা করে দেন’। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
عن عَبْدِ اللهِ بْنَ عَمْرِو بْنِ العَاصِ ঃ يَقُوْلُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِنَّ اللهَ سَيُخَلِّصُ رَجُلًا مِّنْ أُمَّتِي عَلَى رُءُوْسِ الخَلَائِقِ يَوْمَ القِيَامَةِ فَيَنْشُرُ عَلَيْهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ سِجِلًّا كُلُّ سِجِلٍّ مِثْلُ مَدِّ البَصَرِ ثُمَّ يَقُوْلُ أَتُنْكِرُ مِنْ هَذَا شَيْئًا؟ أَظَلَمَكَ كَتَبَتِي الحَافِظُوْنَ؟ فَيَقُوْلُ لَا يَا رَبِّ فَيَقُوْلُ أَفَلَكَ عُذْرٌ؟ فَيَقُوْلُ لَا يَا رَبِّ فَيَقُوْلُ بَلَى إِنَّ لَكَ عِنْدَنَا حَسَنَةً فَإِنَّهُ لَا ظُلْمَ عَلَيْكَ اليَوْمَ فَتَخْرُجُ بِطَاقَةٌ فِيهَا أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ فَيَقُوْلُ احْضُرْ وَزْنَكَ فَيَقُوْلُ يَا رَبِّ مَا هَذِهِ البِطَاقَةُ مَعَ هَذِهِ السِّجِلَّاتِ فَقَالَ إِنَّكَ لَا تُظْلَمُ قَالَ فَتُوْضَعُ السِّجِلَّاتُ فِي كَفَّةٍ وَالبِطَاقَةُ فِي كَفَّةٍ فَطَاشَتِ السِّجِلَّاتُ
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন সকল সৃষ্টির সামনে আমার উম্মতের এক ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে। অতঃপর তার সামনে নিরানব্বইটি দফতর পেশ করা হবে। প্রতিটি দফতর দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত দীর্ঘ হবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি কি এর কোন কিছু অস্বীকার কর? তোমার উপর আমলনামা লেখক আমার ফেরেশতাগণ কি যুলুম করেছে? সে বলবে, না, হে আমার প্রভু! অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তোমার কোন অভিযোগ আছে? সে (ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে এবং) বলবে, না। তখন আল্লাহ বলবেন, হ্যাঁ, আমার নিকট তোমার কিছু/একটি নেকী জমা আছে। আজ তোমার উপর একটুও যুলুম করা হবে না। অতঃপর তার সামনে একটি চিরকুট তুলে ধরা হবে, যাতে লিপিবদ্ধ থাকবে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মা‘বূদ নেই। আর আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসূল’। আল্লাহ বলবেন, দাড়িপাল্লার সামনে উপস্থিত হও। সে বলবে, হে আমার রব! এত বৃহৎ দফতরসমূহের তুলনায় এই ক্ষুদ্র চিরকুট আর কী উপকারে আসবে! তিনি বলবেন, তোমার প্রতি অন্যায় করা হবে না। অতঃপর সেই বৃহদাকার দফতরসমূহ এক পাল্লায় এবং সেই ক্ষুদ্র চিরকুটটি অপর পাল্লায় রাখা হবে। এতে বৃহদাকার দফতরসমূহের পাল্লা হালকা হয়ে উপরে উঠে যাবে এবং ক্ষুদ্র চিরকুটের পাল্লা ভারী হয়ে যাবে।[৯]
এ হাদীছ উল্লেখ করে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এখানে কালেমা শাহাদত ইখলাছের সাথে বলাটাই শর্ত। কারণ কাবীরা গুনাহকারীদের মধ্যে যারা জাহান্নামে প্রবেশ করেছে তারাও তো لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ বলত। কিন্তু তাদের বলাটা তাদের গুনাহ্র চেয়ে ভারী হবে না। যেমনটি হাদীছে উল্লেখিত لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ -বলা ব্যক্তির কার্ডটি ভারী হয়েছিল। অতঃপর তিনি বনী ইসরাঈলের ঐ ব্যভিচারিণীর হাদীছটি উল্লেখ করেন, যে কুকুরকে পানি পান করিয়েছিল, অতঃপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।[১০] এরপর ঐ ব্যক্তির ঘটনা বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তিকে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানোর ফলে আল্লাহ ক্ষমা করেছিলেন।[১১]
অতঃপর তিনি বলেন যে, এই মহিলাটি কুকুরকে পানি পান করিয়েছিলেন। এর সাথে তার অন্তরে খালেছ ঈমান ছিল অতঃপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। নচেৎ আল্লাহ কি প্রত্যেক ব্যভিচারিণী যে কুকুরকে পানি পান করাবে তাকেই ক্ষমা করে দিবেন? অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়েছিল সেও খালেছ ঈমানের সাথে করেছিল, বিধায় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।
অতএব আমল শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে অন্তরের ঈমান ও ইখলাছের ভিত্তিতে। যেমনভাবে দু’জন ব্যক্তি একই কাতারে ছালাত আদায় করে কিন্তু তাদের ছওয়াবের ব্যবধান হল আসমান-যমীনের দূরত্বের ন্যায়। সুতরাং যারা রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরাবে তাদের প্রত্যেকেই ক্ষমা করা হবে না’।[১২]
পক্ষান্তরে ইখলাছবিহীন আমলকারীর অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। হাদীছে তাদের বিরূদ্ধে কঠোর শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। হাদীছে এসেছে,
إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا؟ قَالَ قَاتَلْتُ فِيْكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُّقَالَ جَرِيءٌ فَقَدْ قِيْلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا؟ قَالَ تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيْكَ الْقُرْآنَ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ فَقَدْ قِيْلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا؟ قَالَ مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيْلٍ تُحِبُّ أَنْ يُّنْفَقَ فِيْهَا إِلَّا أَنْفَقْتُ فِيْهَا لَكَ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ
‘ক্বিয়ামতের দিন প্রথমে এক শহীদ ব্যক্তির বিচার হবে। আল্লাহ তা‘আলার সামনে হাশরের ময়দানে তাকে উপস্থিত করা হবে এবং তাকে তার সকল নে‘মতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। অতঃপর নে‘মতের কথা তার স্মরণ হয়ে যাবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি এসব নে‘মত ভোগের পর দুনিয়াতে (তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকারে) কী কাজ করেছ? সে উত্তরে বলবে, আমি আপনার জন্য আপনার পথে জিহাদ করেছি, এমনকি শেষ পর্যন্ত আমাকে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তোমাকে বীর পুরুষ বলবে এজন্য তুমি লড়াই করেছ। আর তা বলাও হয়েছে। তখন তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর দ্বিতীয় ব্যক্তি যে নিজে জ্ঞানার্জন করেছে, অন্যকেও তা শিক্ষা দিয়েছে ও কুরআন পড়েছে, তাকে উপস্থিত করা হবে। তাকে দেয়া সব নে‘মত তাকে স্মরণ করিয়ে দিবেন। এসব নে‘মত তার স্মরণ হবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এসব নে‘মতের তুমি কি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছ? সে উত্তরে বলবে, আমি ইলম অর্জন করেছি এবং তা শিক্ষা দিয়েছি, আপনার জন্য কুরআন পড়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, তোমাকে আলেম বলা হবে, ক্বারী বলা হবে, তাই তুমি এসব কাজ করেছ। আর তোমাকে দুনিয়ায় এসব বলাও হয়েছে। তারপর তার ব্যাপারে হুকুম দেওয়া হবে এবং মুখের উপর উপুড় করে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তৃতীয় ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ সব ধরণের মাল দিয়ে সম্পদশালী করেছেন, তাকেও আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত করা হবে। আল্লাহ তাকে দেয়া সব নে‘মতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। এসব তার মনে পড়ে যাবে। আল্লাহ তাকে এবার জিজ্ঞেস করবেন, এসব নে‘মত পেয়ে তুমি কী আমল করেছ? সে উত্তরে বলবে, আপনি পছন্দ করেন এমন সকল খাতেই আমি তা খরচ করেছি। আল্লাহ তা‘আলা তাকে বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি খরচ করেছ, যাতে মানুষ তোমাকে দানবীর বলে। সে খেতাব তুমি দুনিয়ায় অর্জনও করেছ, তখন তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[১৩] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
لَا تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ لِتُبَاهُوْا بِهِ الْعُلَمَاءَ وَلَا لِتُمَارُوْا بِهِ السُّفَهَاءَ وَلَا تَخَيَّرُوْا بِهِ الْمَجَالِسَ فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَالنَّارُ النَّارُ
‘তোমরা আলেমদের উপর গৌরব-অহংকার প্রকাশের জন্য, নির্বোধদের সাথে ঝগড়া করার জন্য এবং জনসভার উপর বড়ত্ব প্রকাশের জন্য ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা কর না। যে ব্যক্তি এরূপ করবে, তার জন্য রয়েছে আগুন আর আগুন’।[১৪]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكَ الْأَصْغَرَ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ؟ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُوْلُ اللهُ لَهُمْ يَوْمَ يُجَازِي الْعِبَادَ بِأَعْمَالِهِمُ اذْهَبُوْا عَلَى الَّذِيْنَ كُنْتُم تُرَاءُوْنَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوْا هَلْ تَجِدُوْنَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً.
‘তোমাদের ব্যাপারে আমার সর্বাপেক্ষা ভয়ের বস্তু হচ্ছে ছোট শিরক। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ছোট শিরক কী? তিনি বললেন, তা হচ্ছে লোক দেখানো কাজ। আমল অনুযায়ী বান্দাদের প্রতিদান দেয়ার দিন আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, তোমরা চলে যাও তাদের কাছে, দুনিয়াতে যাদেরকে দেখিয়ে তোমরা আমল করতে। তোমরা দেখ, তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাও কি-না’?[১৫]
৬. সহায়তা ও দৃঢ়তা লাভ
ঈমানদারগণ তাদের আমলগুলো ইখলাছের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে থাকে। ফলে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য প্রাপ্ত হয়। নিম্নোক্ত হাদীছটি এদিকেই ইঙ্গিত বহন করে।
عَنْ أُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ عَنِ النَّبِىِّ ﷺ قَالَ بَشِّرْ هَذِهِ الْأُمَّةَ بِالنَّصْرِ وَالسَّنَاءِ وَالتَّمْكِيْنِ فَمَنْ عَمِلَ مِنْهُمْ عَمَلَ الْآخِرَةِ لِلدُّنْيَا لَمْ يَكُنْ لَهُ فِى الْآَخِرَةِ نَصِيْبٌ
উবায় ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ এই উম্মতকে সাহায্য, উচ্চ মর্যাদা ও শক্তি দিয়ে বিজয় দান করার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। তবে তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি দুনিয়ার জন্য আখেরাতের আমল করবে তার জন্য আখেরাতে কোন কল্যাণকর অংশ থাকবে না’।[১৬]
সুধী পাঠক! আমরা যদি সালাফে ছালেহীনের জীবনী একটু ভেবে দেখি তাহলে সহজেই বুঝতে পারব যে, তারা শুধু তাদের ঈমানী শক্তি, আত্মপরিশুদ্ধি ও অন্তরের ইখলাছের বিনিময়ে সাহায্য প্রাপ্ত হয়েছিলন। এ প্রসঙ্গে ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
فَمَنْ خَلُصَتْ نِيَّتُهُ فِي الْحَقِّ وَلَوْ كَانَ عَلَى نَفْسِهِ كَفَاهُ اللهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ النَّاس
‘যে ব্যক্তি হক্বের ক্ষেত্রে তার নিয়ত নির্ভেজাল হয়, যদিও তা স্বয়ং তার বিপক্ষে হয়, তাহলে তার এবং মানুষের মাঝের বিষয়াদির ক্ষেত্রে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হয়’।[১৭] ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৯১-৭৫১ হি.) উক্ত কথার সাথে সংযুক্ত করে বলেন, ‘প্রকৃত পক্ষে অন্তরটা কল্যাণের উৎস ও ঘাঁটি। কেননা বান্দা যখন একমাত্র আল্লাহর জন্য তার ইচ্ছা, সংকল্প ও উদ্দেশ্যকে একনিষ্ঠচিত্তে সমর্পণ করে, তখন তার সাথে আল্লাহ তা‘আলা সর্বদা থাকেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ اللّٰہَ مَعَ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا وَّ الَّذِیۡنَ ہُمۡ مُّحۡسِنُوۡنَ
‘আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন, যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মপরায়ণ’ (নাহল ১২৮)।
৭. ইহকালে মানুষের ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন
আল্লাহ তা‘আলা মুখলিছ ব্যক্তির জন্য সৃষ্টির অন্তরে ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা স্থাপন করে দিয়েছেন। অপরপক্ষে যে ব্যক্তি রিয়া প্রদর্শন করে প্রসিদ্ধি এবং মর্যাদা অর্জন করতে চায় আল্লাহ তার উদ্দেশ্যের বিপরীত ফলাফল প্রদান করেন। এ প্রসঙ্গে রাসূল (ﷺ) বলেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهِ وَمَنْ يُرَائِي يُرَائِي اللهُ بِهِ ‘যে ব্যক্তি লোক শোনানোর উদ্দেশ্যে ইবাদত করে আল্লাহ এর বিনিময়ে তার লোক শোনানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ইবাদত করবে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তার লোক দেখানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেন’।[১৮] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,
مَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ فَرَّقَ اللهُ عَلَيْهِ أَمْرَهُ وَجَعَلَ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ وَلَمْ يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إِلَّا مَا كُتِبَ لَهُ وَمَنْ كَانَتِ الْآخِرَةُ نِيَّتَهُ جَمَعَ اللهُ لَهُ أَمْرَهُ وَجَعَلَ غِنَاهُ فِي قَلْبِهِ وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِيَ رَاغِمَةٌ
‘পার্থিব চিন্তা যাকে মোহগ্রস্ত করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার কাজকর্মে অস্থিরতা সৃষ্টি করবেন, দারিদ্রতাকে তার নিত্য সঙ্গী করে দিবেন এবং পার্থিব স্বার্থ ততটুকুই লাভ করতে পারবে, যতটুকু তার তাক্বদীরে লিপিবদ্ধ আছে। পক্ষান্তরে যার উদ্দেশ্য হবে আখেরাত, আল্লাহ তার সব কিছু ঠিকঠাক করে দিবেন, তার অন্তরকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করবেন এবং দুনিয়া স্বয়ং তার সামনে এসে হাযির হবে’।[১৯]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* শিক্ষক, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০৩।
[২]. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু আবুবকর শামসুদ্দীন কুরতুবী, আল-জামিঊ লি আহকামিল কুরআন (রিয়ায : দারু আলিমিল কুতুব, ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৮।
[৩]. নাসাঈ ৩১৪০; সনদ ছহীহ, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১৩৩১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫২।
[৪]. ইবনু মাজাহ হা/৪২০৩, সনদ ছহীহ।
[৫]. ছহীহ বুখারী হা/৯৯।
[৬]. তা‘লিকাত ইবনুল ক্বাইয়িম- সুনান আবুদাঊদ ৭/১৩৪ পৃঃ।
[৭]. ইবনু মাজাহ হা/২৩০, সনদ ছহীহ।
[৮]. শামসুদ্দীন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ আয-যাহাবী, সিয়ারু ‘আলামুন নুবালা (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪২৭ হি./২০০৬ খ্রি.), ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪০০।
[৯]. তিরমিযী হা/২৬৩৯; ইবনু মাজাহ হা/৪৩০০; মিশকাত হা/৫৫৫৯, সনদ ছহীহ।
[১০]. ছহীহ বুখারী হা/২৪৬৬; ছহীহ মুসলিম হা/২২৪৪।
[১১]. ছহীহ বুখারী হা/৬৫২ ও ২৪৭২; ছহীহ মুসলিম হা/১৯১৪।
[১২]. তাক্বীউদ্দীন আহমাদ ইবনু আব্দুল হালীম ইবনু তায়মিয়া, মিনহাজুস সুন্নাহতিন নাবাবী ফী নাক্বযি কালামিশ শী‘আতিল ক্বাদারিয়া (জামে‘আতুল ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু সঊদ আল-ইসলামিইয়াহ, ১ম সংস্করণ ১৪০৬ হি./১৬৮৬ খ্রি.), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২১৮-২২২।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম হা/১৯০৫।
[১৪]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৪, সনদ ছহীহ।
[১৫]. শারহুস সুন্নাহ, হা/৪১৩৫, সনদ ছহীহ।
[১৬]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২১২৬১; ইবনু হিব্বান, হা/৪০৫, সনদ হাসান ছহীহ।
[১৭]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/২১০৪২।
[১৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৯৯।
[১৯]. ইবনু মাজাহ, হা/৪১০৫, সনদ সহীহ।
প্রসঙ্গসমূহ »:
আত্মশুদ্ধি