বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫১ অপরাহ্ন

ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ

-ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন*


(৮ম কিস্তি)

নেতৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিকে নিজের পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দেয়া ও জবাবদিহির জন্য জনসম্মুখে উপস্থাপন করা

নেতার জন্য দুনিয়া-আখেরাত উভয় জগতে পার পাওয়া ও জনসমাজে আস্থা বৃদ্ধির বড় উপায় হলো নিজে দায়মুক্ত থাকা, প্রয়োজনীয় বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া, সম্ভাব্য সন্দেহ নিরসন করা, পরিস্থিতির পরিচ্ছন্ন ব্যাখ্যা দেয়া এবং জনগণের স্বীকৃতি লাভ করা। জনগণের আস্থা ও স্বীকৃতি লাভ করা নেতৃত্বের জন্য এক বড় সম্পদ। শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিছ দেহলভীর ভাষায়, أنّ المُهِمَّ فِي الخِلافَةِ رِضا النَّاسِ بِه واجتِماعُهُم عَليه وتَوقِيرُهُم إيَّاه ‘খিলাফতের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তার প্রতি জনগণের সম্মতি ও সন্তুষ্টি এবং তাঁর সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও তাঁকে সম্মান করা’।[১]

আর এ কাজের একটি বড় ফায়দা হলো এই যে, তা সঙ্গীসাথী ও পরবর্তী নেতৃবৃন্দের জন্য স্বচ্ছ ও জওয়াবদিহিপূর্ণ নেতৃত্বের এক মাইলফলক হয়ে থাকে। তাঁরা শিক্ষা নিতে পারেন ও সাবধানতা অবলম্বন করতে পারেন। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জে সকল প্রান্তর থেকে আগত লক্ষাধিক[২] জনতার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।

عَنْ جَابِر بْنِ عَبْدِ للهِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ  فِيْ خُطْبَتِهِ بِحَجَّةِ الْوَدَاعِ : "وَأَنْتُمْ تُسْأَلُوْنَ عَنِّي فَمَا أَنْتُمْ قَائِلُوْنَ؟ قَالُوا نَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ وَأَدَّيْتَ وَنَصَحْتَ فَقَالَ بِأَصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ يَرْفَعُهَا إِلَى السَّمَاءِ وَيَنْكُتُهَا إِلَى النَّاسِ أَللَّهُمَّ اشْهَدْ أَللَّهُمَّ اشْهَدْ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ. وَفِيْ رِوَايَةِ أَحْمَدَ: أَلَا هَلْ بَلَّغْتُ؟ . . .

জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বিদায় হজ্জের খুত্বাহ্তে বলেছেন : ‘তোমাদেরকে (ক্বিয়ামতের দিন) আমার প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হবে, তখন তোমরা কী বলবে? তখন ছাহাবীগণ বললেন : আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি রিসালাতের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যথাযথ নছীহত করেছেন। তখন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর তর্জুনী অঙ্গুলি আকাশের দিকে তুলে এবং জনগণের দিকে ইশারা করে বললেন : হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী, হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী’। একথা তিনবার বললেন।[৩] মুসনাদে আহমাদে অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনগণকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাদের কাছে পৌঁছিয়েছি? তখন তাঁরা জবাব দিলেন- হ্যাঁ, আপনি পৌঁছিয়েছেন, (আমানত) আদায় করেছেন এবং নছীহত করেছেন’।[৪]

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেকে উপস্থাপন করেছেন মর্মে বর্ণনা এসেছে। রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যুর পাঁচ তিন আগে নিজেকে জনগণের সম্মুকে পেশ করলেন তাঁর কাছ থেকে শোধ (বদলা) নেয়ার জন্য এবং বললেন :

"ألا مَن كنتُ جَلدتُ له ظَهرا فهذا ظَهري فلْيَستَقِدْ منه، و مَن كنتُ أخَذت لَه مالا فهذا مالي فليَأخذْ منه، ومَن كنتُ شَتَمتُ له عِرضاً فهذا عِرضي فليَستقدْ منه، ولا يَقولَنّ قائلٌ أَخاف الشَحناء من قِبل رَسولِ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ".

‘শুন! আমি যদি কারো পিঠে মেরে থাকি তাহলে এই আমার পিঠ এখানে সে প্রতিশোধ নিয়ে নিক, আর যদি কারো মাল নিয়ে থাকি তাহলে এই আমার মাল তা থেকে সে নিয়ে নিক, আর যদি কাউকে গালি দিয়ে কারো ইয্যতহানী করে থাকি তাহলে আজকে সে তার প্রতিশোধ নিয়ে নিক। আর কখনো যেন কেউ বলতে না পারে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছ থেকে আমি প্রতিহিংসার ভয় করেছি’।[৫]

এমনকি দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে আখেরাতকে (অত্যাসন্ন মৃত্যুকেই) বেছে নিয়েছেন সেটাও জনসম্মুখে জীবনের শেষ মুহূর্তে জানিয়ে দিয়েছেন।

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ خَطَبَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ النَّاسَ وَقَالَ إِنَّ اللهَ خَيَّرَ عَبْدًا بَيْنَ الدُّنْيَا وَبَيْنَ مَا عِنْدَهُ فَاخْتَارَ ذَلِكَ الْعَبْدُ مَا عِنْدَ اللهِ. قَالَ فَبَكَى أَبُوْ بَكْرٍ... ".

আবূ সা’ঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনগণের সম্মুখে ভাষণ দিলেন এবং বললেন, ‘আল্লাহ তাঁর এক বান্দাকে (নবী মুহাম্মদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)) দুনিয়া এবং তাঁর (আল্লাহ’র) কাছে যা আছে এ দুটোর মধ্যে যেটি ইচ্ছা সেটি গ্রহণ করার এখতিয়ার দিয়েছেন। তখন সে বান্দা (নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)) তাঁর (আল্লাহ’র) কাছে যা আছে সেটাকেই পসন্দ করেছে’। বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শুনে আবূ বাকi (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কেঁদে ফেললেন...।[৬]

এমনকি কোনা কোনো সাধারণ স্পর্শকাতর বিষয়েও নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগেভাগেই নিজের অবস্থান ও বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারেÑ একবার  নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ই‘তিকাফ রত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী উম্মুল মু’মিনীন ছাফিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর যিয়ারতে আসলেন। রাত হয়ে গিয়েছিল; তাই নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে ’দারে উসামায়’ তাঁর ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য মসজিদ নববী থেকে বের হলেন। দরজার সামনে দু’জন আনছারী নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে দেখতে পেয়ে সালাম করলেন এবং অতিক্রম করলেন। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে ডেকে জানিয়ে দিলেন- ইনি ছাফিয়্যাহ্ বিন্ত হুয়াই (আমার স্বীয় গৃহিণী)। বিষয়টি তাদের কাছে খুব ভারী মনে হল; তারা বললেন, হে আল্লাহ’র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমরা আল্লাহ’র পবিত্রতা বর্ণনা করছি। (আমরা কি আপনার ব্যাপারে কোন ধরনের বিরূপ ধারণা পোষণ করতে পারি?) নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘শয়ত্বান মানুষের দেহের রক্ত চলাচলের পথে গমানাগমন করতে পারে। আমি আশঙ্কা করছি সে তোমাদের মনের মধ্যে কোন ধরনের কুধারণা নিক্ষেপ করে দিতে পারে’।[৭]

কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বেহুদা পরহেজগারীর প্রদর্শনী দেয়ার হাস্যকর অভিনয় করা, যে কোন ধরনের দায়িত্বশীলের জন্য অশোভনীয়। কদুর বোটা, কলার খোসা, আমের চোচা, কাঁঠালের কেইতা, বরুই-এর বিচি ইত্যাদি নিয়ে হালমাচিয়ে নিজের বুজুর্গী ও দুনিয়া বিমুখতার জানান দেয়া খুবই দৃষ্টিকটু ও অরুচিকর। কোনো কোনা ফিক্হে একটি মাস’আলাহ্ রয়েছে : يُعَزَّرُ الوَرِعُ البارِدُ ‘ঠা-া পরহেযগারকে তা’যীর (হালকা শাস্তি) করতে হবে’। অর্থাৎ হানাফী মাযহাব অনুযায়ী তাকে ৩ থেকে ৩৯ পর্যন্ত বেত্রাঘাত করে শাস্তি দেয়া যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ : কথিত পরহেযগার সাহেব বরুই-এর বিচি একটি কুড়িয়ে হাতে নিয়ে হাটে-হাটে ও পথেপথে ঘুরছেন ও চিৎকার করছেন কিংবা মাহফিলে জানান দিচ্ছেন - এ বিচিটি কার, মেহেরবানী করে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে আমার কাছ থেকে এটি নিয়ে যাবেন এবং আমাকে দায়মুক্ত করবেন! এমত পরিস্থিতিেিত যথাযথ কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হতে পারে এনাকে নিবৃত করা এবং প্রয়োজন হলে হালকা শাস্তির বিধান করা।   

কেউ কেউ তো ছেড়া জামা, ফাটা টুপি, পুরান সেন্ডেল ইত্যাদি দেখিয়ে বুজর্গির প্রদর্শনি দিয়ে থাকেন। বলাবাহুল্য, সাধারণ জনগণ তাতে যথেষ্টই বিভ্রান্ত, প্রভাবিত ও প্রতারিত হন। অথচ এ জাতীয় বুজর্গরা এহেন পদ্ধতিতে ভেতরে ভেতরে মালের পাহাড় গড়ে তুলেন। নিয়্যত ভাল থাকলে সাদামাঠা চলাফেরা নাজায়েয নয়, তবে স্বাভাবিক অবস্থা হল এই যে, যার যে ধরনের আয় তার সে হিসাবে ব্যয় করা ও চলাচলে যথাযথ স্বচ্ছলতা প্রকাশ পাওয়া। আর আল্লাহ্ তাঁর দেয়া নে‘মতের আছর তাঁর বান্দার কথাবার্তা ও চলাফেরার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পাওয়াটা পসন্দ করেন। বিস্তারিত দেখুন এই আয়াতের তাফসীরে : وَ اَمَّا بِنِعۡمَۃِ  رَبِّکَ  فَحَدِّثۡ ‘আর তুমি তোমার রব-এর অনুগ্রহের কথা জানিয়ে দাও!’ (সূরা আয্যোহা : ১১)।

ইয়াহুদী নাছারা ধর্ম যাজকরা বুজর্গির ভাব ধরেই সাধারণ জনগণকে প্রতারিত করে অঢেল ধন-সম্পদ অহরণ করতো এবং কায়দা করে বুজর্গির সাথে বাতিল পন্থায় তা কুক্ষিগত ও আত্মসাৎ করতো। আল্লাহ্ তা‘আলা মুমিনদেরকে সম্বোধন করে বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡاَحۡبَارِ وَ الرُّہۡبَانِ  لَیَاۡکُلُوۡنَ اَمۡوَالَ النَّاسِ بِالۡبَاطِلِ وَ یَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ 

‘হে যারা ঈমান এনেছ! নিশ্চয় অধিকাংশ আহবার (ইয়াহুদী ধর্মীয় প-িতবর্গ) ও রুহবান (খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা) জনগণের মাল-সম্পদ ভক্ষণ করে বাতিল পন্থায় এবং তারা আল্লাহ’র পথ থেকে বিরত রাখে . . .’ (সূরা আত-তাওবাহ : ৩৪)। এখানে খুবই গুরুত্বের সাথে একান্তভাবে বুঝার বিষয় যে, উপরিউক্ত আয়াতের বিষয় আহলে কিতাব কেন্দ্রিক হলেও সম্বোধন করা হচ্ছে মুমিন-মুসলিমদেরকে। এই ধর্মযাজক ও প্রচারকরা নিজেরা ধর্ম রক্ষা ও বিস্তারের দাবি করে, আর জনগণও তা বিশ্বাস করে এবং তাদেরকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে এবং মাল-সম্পদ তাদেরকে অকাতরে দান করে ও হাদিয়া দেয়; কিন্তু আল্লাহ্ স্বয়ং বলে দিচ্ছেন যে, এরা মানুষকে প্রতারণা করে বাতিল পথে তাদের মাল আহরণ ও ভক্ষণ করে এবং মূলত এরা ধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করে না বরং তাতে অন্তরায় সৃষ্টি করে।

বাহ্যিক দরবেশি ও বুজর্গির কৌশলে অপরের মাল হরণ, বাতিল পন্থায় তা সংরক্ষণ ও ভক্ষণ নতুন কিছু নয়। এক শ্রেণির ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সংগঠন হোক, নেতৃত্ব হোক, ট্রাষ্ট হোক, দাতব্য প্রতিষ্ঠান হোক, প্রচার কেন্দ্র হোক, মাদ্রাসা হোক, মসজিদ হোক, যাই হোক না কেন সেগুলো ছলে বলে কলে কৌশলে নিজের ও নিজ পরিবারের করায়ত্ব করে ফেলেন। এনারা মাত্রাতিরিক্ত বুজর্গির অবয়বে ভূষণে, অতি বিনয়ী চেহারার আকর্ষণে, দীন-হীন জীর্র্ণ পোশাকের আবরণে, শ্মশ্রুর মৃদু কম্পনে, কুম্ভিরাশ্রুরতে গ-ভাসী ও বক্ষভেজা প্লাবনে, কান্না বিজড়িত বিগলিত কন্ঠে হৃদয়স্পর্শি ভাষণে, দূরবর্তী অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যের মোহজাল বিস্তার করে জনগণকে বুঁদ করে ফেলতে খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। অথচ তারা সংশ্লিষ্ট অতি প্রয়োজনীয় আলোচনা ও মাল-সম্পদ সম্পৃক্ত জরুরী বিষয় থেকে সকলকে খুবই সাবধানে সন্তর্পণে যোজন যোজন দূরে রাখতে সমর্থ হন। নানা ধরনের ইজতিহাদাতে ফাসেদাহ্, তাভীলাতে বাতেলাহ, হিয়ালে মাকেরাহ এবং আহাদিছে মুযহিকাহ দিয়ে সে অপরিহার্য বিষয়াবলীকে দক্ষতার সাথে দস্তুর মত আড়াল করে চলেন। কিন্তু সালাফে ছালেহীনের মধ্যে যারা জন-সম্পৃক্ত কাজ-কর্মে যুক্ত ছিলেন তাঁরা মাল-সম্পদ প্রসঙ্গেই বেশি স্বচ্ছতা ও সতর্কতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু দীন লিখক কখনই এ কথা বলছে না যে, তাঁরা হালাল পন্থায় স্বচ্ছল জীবন যাপন করতে পারবেন না; বরং অবশ্যই তা পারবেন এবং করবেনÑ আল-হামদু লিল্লাহ। তদুপরি সাধারণ জনগণ যদি তাঁদের জীবন যাত্রার মানকে অধিকতর উন্নত করার জন্য পরিচ্ছন্নভাবে অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাহলে তা খুবই উত্তম, ছওয়াবের কাজ ও প্রয়েজনীয়ও বটে। তাঁদের যথাযথ মূল্যায়ন ও ভক্তি শ্রদ্ধা অবশ্যই করতে হবে।

আবূ বাক্র (রাযিয়াল্লাহু আনহু) খলীফাহ্ হওয়ার সাথে সাথে প্রথমেই নিজেকে জনসম্মুখে উপস্থাপন করেছেন এবং বলে দিয়েছেন,

قالَ أبو بَكر رَضي الله عنه في خطبَته "أيُّها الناسُ! إني قد وُلّيتُ عليكم ولَستُ بِخيرِكم، فإن أحسنتُ فأعينُوني وإن أسأتُ فقَوِّمُوني، الصدقُ أَمانة والكذبُ خِيانَة. والضَعيفُ فيكم قَويٌ عندي حَتى أرجعَ عليه حَقَّه-إن شاء الله، والقويُّ فيكم ضَعيفٌ عندي حتى آخذَ الحقَّ منه- إن شاء الله. لا يَدَع قومٌ الجهادَ في سبيلِ الله إلا ضَربَهم الله بالذُل،  و لا تَشيعُ الفاحشةُ في قومٍ إلا عمَّهُم الله بالبلاءِ، أطيعُوني ما أطعتُ اللهَ ورَسولَه، فإذا عَصيتُ اللهَ ورَسولَه فلا طاعةَ لي عليكم"

‘হে জনগণ! আমাকে আপনাদের দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে যদিও আমি আপনাদের মধ্যে উৎকৃষ্ট নই। আমি যদি ভাল কাজ করি তাহলে আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন আর যদি মন্দ কাজ করি তাহলে আমাকে সংশোধন করে দিবেন। সত্য হলো আমানত আর মিথ্যা হলো খিয়ানত। আর আপনাদের মধ্যে যে দুর্বল সেও আমার কাছে অতীব শক্তিশালী যতক্ষণ না তার হক্ তার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারি- ইন্শা-আল্লাহ্। আর আপনাদের মধ্যকার শক্তিশালীও আমার কাছে অতীব দুর্বল যতক্ষণ পর্যন্ত না অপরের হক্ তার কাছ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারি- ইন্শা-আল্লাহ্। যদি কোন জাতি জিহাদ পরিত্যাগ করে তাহলে আল্লাহ্ তাদেরকে অপদস্থতার মধ্যে নিপতিত করেন। আর যদি কোন জাতির মধ্যে ফাহেশা (নৈতিক ও চারিত্রিক গর্হিত যেমন : যেনা, বেহায়াপনা ইত্যাদি) কাজ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তাদের সবাইকে আল্লাহ্ সার্বিক বালা-মছীবতে ফেলেন। আমি যতক্ষণ আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করব ততক্ষণ আপনারা আমার আনুগত্য করবেন। আর যদি আমি আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করি তাহলে আমার প্রতি আপনাদের কোন আনুগত্য নেই (আমার আনুগত্য করার দরকার নেই)।[৮]

মৃত্যুর পূর্বে তিনি পরবর্তী ‘খলীফাহ্’ কে হবেন তা নিয়ে বিশিষ্টজনদের সাথে পরামর্শ করলেন এবং বললেন,

"أتَرْضَونَ بِمَن أَسْتخلِفُ عَليكم، فإني والله ما ألوتُ مِن جُهْدِ الرَأي، ولا وَلَّيْتُ ذا قَرابَة، وإنِّي قَد اسْتَخْلَفْتُ عُمرَ بنَ الخَطَّابِ فَاسْمَعُوا لَه وأطِيعُوا! قالُوا : سَمِعنا وَأطَعْنَا . ثمَّ اسْتَدعَى عُمرَ بنَ الخَطّاب ووَصّاه بتَقْوى اللهِ وَطاعَتِه"

‘জনগণের সামনে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, আমি আপনাদের জন্য যাকে খলীফাহ্ মনোনীত করতে চাচ্ছি তার ব্যাপারে কি আপনাদের সন্তোষচিত্তে সম্মতি আছে? আল্লাহ’র কসম, আমি (যোগ্যতমকে মনোনীত করার ক্ষেত্রে) চিন্তা-ভাবনা ও মতামত গ্রহণে কোন ধরনের ত্রুটি করিনি। আমি আমার কোন নিকট আত্মীয়কে খলীফাহ্ মনোনীত (স্থলাভিষিক্ত) করছি না। আমি আপনাদের জন্য ‘উমার ইবনুল খাত্তাবকে আমার পরবর্তী খলীফাহ্ হিসাবে মনোনীত করেছি। আপনারা তার কথা শুনবেন ও আনুগত্য করবেন। অতঃপর জনগণ বললেন, আমরা অবশ্যই শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম’।[৯]

অতঃপর তিনি ‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ডাকলেন এবং তাঁকে তাক্ওয়া অবলম্বন এবং আল্লাহ্কে মান্য করার ওছিয়ত করলেন।

কাপড়ের ব্যবসায়ী আবূ বাকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) খলীফাহ্ নির্বাচিত হওয়ার পরও বাজারে কাপড় বিক্রি করতে যাচ্ছিলেন। উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আপনি যে, সকল মুসলিমের দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েছেন? তিনি বললেন, কাপড় বিক্রি না করলে আমার পরিবার পরিজনকে খাওয়াবো কোথা থেকে?

অতঃপর সকল দিক বিবেচনা বিবেচনা করে তাঁর জন্য মাসিক ২,৫০০ (আড়াই হাজার) দিরহাম মাসিক ভাতা নির্ধারিত হল।[১০]

মুমূর্ষাবস্থায় খলীফাহ্ আবূ বাক্র (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর কন্যা উম্মুল মুমিনীন আয়েশাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে ডেকে বললেন, হে আমার কন্যা! আমার মৃত্যুর পর এই উটনীটি যার দুধ আমরা পান করতাম এবং চাদরটি যা পরিধান করতাম তা পরবর্তী খলীফাহ্ উমারের কাছে (বাইতুল মাল তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য) জমা দিয়ে দিও। আয়েশাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাই করলেন। দ্বিতীয় খলীফাহ্ উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বুঝতে দেরি হলো না যে, তাঁর পূর্ববর্তী খলীফাহ্ তাঁর জন্য কী বার্তা দিয়ে গেলেন। উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সশ্রদ্ধচিত্তে তা গ্রহণ করলেন এবং বললেন :

"رَحِمَكَ اللهُ يَا أبَا بَكْر! لَقدْ أَتعَبْتَ مَن جاءَ بَعدَكَ"

‘হে আবূ বাক্র! আল্লাহ্ আপনাকে রহম করুন! আপনার পরে যে (খিলাফতের) দায়িত্বে এসেছে তার কাজকে (সতর্ক বার্তা দিয়ে) কষ্টসাধ্য করে দিলেন’।[১১] অর্থাৎ এই দিকে কঠিনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেলেন যে, হে উমার! মালের বিষয়ে সাবধান থেকো তা যদি অতি ক্ষুদ্রও হয়।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)


* সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

তথ্যসূত্র :
[১]. শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ্, ‘খিলাফত’ অধ্যায়, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৭৫, (মূল আরবী সহ অন্যত্র উল্লেখ করা হয়েছে)।
[২]. উপস্থিত জনসংখ্যা এক লাখ চব্বিশ হাজার থেকে এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজারের মধ্যে ছিল। দেখুন : র্আ-রাহীক আল-মাখতুম, পৃ. ৬০৩।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮, ‘আল-হজ্জ’ অধ্যায়, ‘নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হজ্জ’ অনুচ্ছেদ।
[৪]. মুসনাদে আহমদ, আবূ র্হারাহ আর রিকাশী তাঁর চাচা থেকে বর্ণনা করেছেন।
[৫]. ইবনু কাছীর, বিদায়াহ্ নিহায়াহ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৪৩, (বায়হাক্বীর বরাতে, ফাযল বিন ’আব্বাস থেকে); র্আরাহীক  আল-মাখতুম, পৃ. ৬১২-৬১৩, সনদ যঈফ, সিলসিলা যঈফাহ হা/৬২৯৭।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৫৪, ‘ফাযাইল আছহাবিন্নাবী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৩৫, ‘ই‘তিকাফ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮।
[৮]. ইবনু হিশাম, আস্সীরাহ্, পৃ. ৯০১; বিদায়াহ্ নিহায়াহ্, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৬৯২-৬৯৩।
[৯]. বিস্তারিত দেখুন : ইমাম ইবনু জারীর ত্বাবারী, তারিখুল-উমাম ওয়াল-মুলূক, পৃ. ২য় খণ্ড, পৃ. ৬১৮; ইমাম সিউতী, তারিখুল খুলাফা, পৃ. ৮২-৮৩; তারিখ ইবন খালদূন, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫১৭, ড. আল-খাইয়াত, আন্-নিযাম অস্সিয়াসি ফিল-ইসলাম, পৃ. ১৭১;  দেখুন : পাকিস্তানের ইসলামী শাসন সংবিধান, আল্লামা আব্দুল্লাহিল কাফী, মাসিক তর্জুমানুল হাদীছ, ২য় বর্ষ, ১০ম সংখ্যা, ১৩৭০ হি., পৃ. ৪৪২-৪৪৩।
[১০]. ইমাম জালাল উদ্দীন সিউতী, তারিখুল খুলাফা, পৃ. ৭৮ (ইবনু সা’আদের বরাতে)।
[১১]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৮ (ত্বাবরানীর মুসনাদের বরাতে)।




ইখলাছ বিহীন আমল ও তার পরিণতি - আব্দুল গাফফার মাদানী
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২০তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১৩তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
উমরাহ ও হজ্জের সঠিক পদ্ধতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২২তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ঈদুল ফিতরে করণীয় ও বর্জনীয় - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
হজ্জ মুসলিম উম্মাহর বিশ্ব সম্মেলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
মূর্তিপূজার ইতিহাস - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
ক্যারিয়ার : শিক্ষক নিবন্ধনের প্রস্তুতির ধরন ও বিষয়াবলী - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৩য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ

ফেসবুক পেজ