সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৪:১৬ পূর্বাহ্ন

প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে  শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান

মূল : আব্দুল আযীয ইবনু রাইস আল-রাইস
অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক্ব বিন আব্দুল ক্বাদির*


(৮ম কিস্তি)

আল্লাহ তা‘আলা আগ্রহ সহকারে কুরআন শ্রবণকারীদের প্রশংসা করেছেন এবং কুরআন থেকে  যারা বিমুখ তাদেরকে নিন্দা করেছেন। তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, কুরআন শ্রবণ করা রহমতের কারণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ اِذَا قُرِیَٔ الۡقُرۡاٰنُ فَاسۡتَمِعُوۡا لَہٗ وَ اَنۡصِتُوۡا  لَعَلَّکُمۡ  تُرۡحَمُوۡنَ ‘যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগের সাথে তা শ্রবণ করবে এবং নীরব-নিশ্চুপ হয়ে থাকবে, হয়তো তোমাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা হবে’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ২০৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ الَّذِیۡنَ  اِذَا ذُکِّرُوۡا بِاٰیٰتِ رَبِّہِمۡ لَمۡ یَخِرُّوۡا عَلَیۡہَا صُمًّا وَّ عُمۡیَانًا ‘এবং যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াত দ্বারা উপদেশ প্রদান করলে অন্ধ ও বধির সদৃশ আচরণ করে না’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৭৩)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اَلَمۡ یَاۡنِ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا  اَنۡ  تَخۡشَعَ قُلُوۡبُہُمۡ  لِذِکۡرِ اللّٰہِ  وَ مَا  نَزَلَ مِنَ الۡحَقِّ ‘মুমিন লোকদের জন্য এখনও কি সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণ এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার সম্মুখে অবনত হবে?’ (সূরা আল-হাদীদ : ১৬)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَوۡ عَلِمَ اللّٰہُ  فِیۡہِمۡ خَیۡرًا لَّاَسۡمَعَہُمۡ وَلَوۡ اَسۡمَعَہُمۡ لَتَوَلَّوۡا وَّہُمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ ‘আল্লাহ যদি জানতেন যে, তাদের মধ্যে কল্যাণকর কিছু নিহিত আছে তবে অবশ্যই তিনি তাদেরকে শুনবার তাওফীক্ব দিতেন, তিনি যদি তাদেরকে শুনাতেনও তবুও তারা উপেক্ষা করত এবং মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে চলে যেতো’ (সূরা আল-আনফাল : ২৩)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَمَا لَہُمۡ عَنِ التَّذۡکِرَۃِ  مُعۡرِضِیۡنَ  - کَاَنَّہُمۡ حُمُرٌ مُّسۡتَنۡفِرَۃٌ  - فَرَّتۡ مِنۡ قَسۡوَرَۃٍ

‘তাদের কী হল যে, উপদেশবাণী (কুরআন) হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়? তারা যেন ছুটাছুটিকারী গাধা। যা সিংহের সম্মুখ হতে পলায়নপর’ (সূরা আল-মুদ্দাছছির : ৪৯-৫১)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ ذُکِّرَ بِاٰیٰتِ رَبِّہٖ فَاَعۡرَضَ عَنۡہَا وَ نَسِیَ مَا قَدَّمَتۡ یَدٰہُ ‘কোন ব্যক্তিকে তার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর সে তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায়, তবে তার অপেক্ষা অধিক অত্যাচারী আর কে?’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ৫৭)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَاِمَّا یَاۡتِیَنَّکُمۡ مِّنِّیۡ ہُدًی ۬ۙ فَمَنِ اتَّبَعَ ہُدَایَ  فَلَا  یَضِلُّ  وَ لَا  یَشۡقٰی  - وَ مَنۡ اَعۡرَضَ عَنۡ ذِکۡرِیۡ فَاِنَّ لَہٗ مَعِیۡشَۃً ضَنۡکًا وَّ نَحۡشُرُہٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ  اَعۡمٰی - قَالَ رَبِّ  لِمَ حَشَرۡتَنِیۡۤ  اَعۡمٰی وَ قَدۡ کُنۡتُ  بَصِیۡرًا  - قَالَ  کَذٰلِکَ اَتَتۡکَ اٰیٰتُنَا فَنَسِیۡتَہَا ۚ  وَکَذٰلِکَ  الۡیَوۡمَ  تُنۡسٰی

‘পরে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সৎপথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না। যে আমার স্মরণে বিমুখ তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান! তিনি বলবেন, এই রূপই আমার নিদর্শনাবলী তোমার নিকট এসেছিল; কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং যেভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হলে’ (সূরা ত্বো-হা : ১২৩-১২৬)।

এরূপ বাণী কুরআনের মাঝে বহু রয়েছে, যা মানুষকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আল্লাহর অনুসরণের এবং তা শ্রবণেরও নির্দেশ দেয়।

আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের জন্য মাগরিব, এশা ও ফজর ছালাতে কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করা শারঈ নিয়ম করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ফজরের কুরআন পড়ার সময় (ফেরেশতাদের) উপস্থিতির সময়’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৭৮)। আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তেলাওয়াতের প্রশংসা করে বলেন,

وَفِيْنَا رَسُوْلُ اللهِ يَتْلُوْ كِتَابَهُ... إِذَا انْشَقَّ مَعْرُوْفٌ مِنَ الْفَجْرِ سَاطِعُ
أَرَانَا الْهُدَى بَعْدَ الْعَمَى فَقُلُوْبُنَا .. بِهِ مُوْقِنَاتٌ أَنَّ مَا قَالَ وَاقِعُ
يَبِيْتُ يُجَافِىْ جَنْبَهُ عَنْ فِرَاشِهِ..  إِذَا اسْتَثْقَلَتْ بِالْمُشْرِكِيْنَ الْمَضَاجِعُ

‘আর আমাদের মাঝে রয়েছেন আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যিনি তাঁর কিতাব পাঠ করেন; যখন ফজরের আলো উদ্ভাসিত হয়।

তিনি আমাদেরকে গোমরাহীর পর হেদায়াতের পথ দেখিয়েছেন, তাই আমাদের অন্তরগুলো তাঁর প্রতি বিশ্বাস করে যে, তিনি যা বলেছেন তা অবশ্যই সত্য।

তিনি তাঁর পার্শ্বদেশকে শয্যা হতে দূরে সরিয়ে রেখে রাত যাপন করেন, যখন মুশরিকরা শয্যাসমূহে নিদ্রামগ্ন থাকে’।[১]

এই শ্রবণকারীদের অবস্থা আল্লাহর কিতাবে এইভাবে উল্লেখ আছে যে, তাদের অন্তরগুলো ভীত হয়, চোখগুলো অশ্রুপূর্ণ হয় এবং চামড়াগুলো কেঁপে উঠে। তবে ছন্দ বা শ্লোক শ্রবণের ব্যাপারটি এই সকল যুগের পরেই নতুনভাবে চালু হয়েছে। অতঃপর ইমামগণ এটাকে ঘৃণা করেছেন। এমনকি ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

خلفت ببغداد شيئا إحدثته الزنادقة يسمونه التغبير بزعمون أنه يرقف القلوب يصدون به الناس عن القران

‘আমি বাগদাদে পরবর্তীতে এমন কিছু পেয়েছি যাকে অবিশ্বাসী নাস্তিকরা তৈরি করেছে। যাকে তারা (تغبير) তথা এক ধরনের বাদ্যসহ গান বলাকে বুঝায়। তাদের ধারণা যে, তা অন্তরসমূহকে নরম করে দুনিয়ার প্রতি বিমুখতা ও আখেরাতের প্রতি আগ্রহ বাড়াই। তবে সত্য ব্যাপার হল যে, এর মাধ্যমে তারা মানুষকে কুরআন থেকে দূরে সরাতে চায়’।

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা একটি নতুন বিদ‘আত। অতঃপর তাকে বলা হল, আমরা কি তাদের সাথে সেখানে বসতে পারি? তখন তিনি বললেন, না; তাদের সাথে বসবেন না।

বড় বড় শায়খ ও ইমামগণ এই বিদ‘আতী শ্রবণ বৈঠকে উপস্থিত হতেন না। তাদের মধ্য হতে যেমন, ফুযাইল ইবনু ঈয়ায, ইবরাহীম ইবনু আদহাম, আবূ সুলাইমান আদ-দারানী, মারূফ আল-কারখী, সারী আস-স্বাকতী এবং তাঁদের মত আরো অনেকেই।

পরবর্তী বড় বড় শায়খগণও এরূপ বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন না। যেমন শায়খ আব্দুল কাদের, শায়খ আদী, শায়খ আবূ মাদয়ান, শায়খ আবূ বায়ান, শায়খ আবুল কাসেম আল-হাউফী, শায়খ আলী ইবনু ওহাব এবং শায়খ হায়াত আরো অনেকেই। এতদ্বাতীত কিছু সংখ্যক শায়খ সেখানে উপস্থিত হয়ে আবার ফিরে আসেন।

জুনাইদ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি এটা শ্রবণ করার চেষ্টা করবে সে ফেতনাগ্রস্ত হবে এবং যার কানে এর আওয়াজ আকস্মিকভাবে এসে পড়বে সে শান্তি পাবে। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, এটা ইচ্ছা করে শ্রবণকারীর জন্য সমস্যা। তবে যে অনিচ্ছায় শ্রবণ করে তাহলে তাতে কোন সমস্যা নেই। কেননা মনোযোগের সাথে শ্রবণ করার প্রতি নিষেধ আরোপিত হবে; (অনিচ্ছায়) শ্রবণের প্রতি নয়। এই কারণে যদি কোন ব্যক্তি এমন কিছু লোকের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করে, যারা হারাম কথার আলাপ করছে; সে ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির উপর কান বন্ধ করা ওয়াজিব নয়। কিন্তু অপ্রয়োজনে তার প্রতি মনোযোগী হওয়াও উচিত নয়। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে রাখালের বাশীর আওয়াজ শোনার সময় কান বন্ধ করার আদেশ দেননি। কারণ তার কানে আওয়াজ আসলেও তিনি তাতে মনোযোগী ছিলেন না।

প্রশ্নকারী ও অন্যান্যের কথা হল যে, এটা হালাল না-কি হারাম? সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, এই ব্যাপারে আলোচিত শব্দটির অর্থ যেমন অস্পষ্ট। তেমনি তার হুকুমও অস্পষ্ট। তাই অনেক মুফতী সুন্দরভাবে এর জবাব লিখতে পারেননি। এই প্রকার শ্রবণ ও অন্যান্য কাজের ব্যাপারে আলোচনা দুই প্রকার হতে পারে। যেমন, প্রথমত ঃ এটা কি হারাম না-কি হারাম নয়? বরং এটা করা হয় যেমনভাবে অন্যান্য কাজ করা হয়, যার মাধ্যমে আত্মাসমূহ আনন্দ উপভোগ করে। যদিও তার মাঝে এক প্রকার খেল-তামাশা থাকে। যেমন বিবাহ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের শ্রবণ। যা মানুষ আনন্দ-বিনোদনের জন্য করে থাকে; ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য নয়।

দ্বিতীয়তঃ এটা করা হয় দ্বীন হিসাবে, ইবাদত আকারে, আত্মার সংস্কার, পবিত্রকরণে এবং কমলতার জন্য যাতে অন্তরের মাঝে ভয়, আল্লাহমুখিতা এবং রবের জন্য বান্দার খাঁটি ভালোবাসা তৈরি হয় ইত্যাদি উদ্দেশ্যে, যা ইবাদত ও আনুগত্য বলে গণ্য। খেলাধুলা ও বিনোদন জাতীয় কোন বিষয় নয়।

সুতরাং নৈকট্য অর্জনকারীর শ্রবণ ও খেলাকারীর শ্রবণের মাঝে পার্থক্য করা যরূরী এবং বিয়ে অনুষ্ঠান বা আনন্দ বিনোদনের জন্য অভ্যাসগতভাবে মানুষ যা শ্রবণ করে ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন বা আত্মশুদ্ধির জন্য শ্রবণ করে তার মাঝেও পার্থক্য করা উচিত।

কেননা এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয় যে, এটা কি নৈকট্য লাভ ও আনুগত্যের কাজ? এটা কি আল্লাহকে পাওয়ার পথ? এটা কি তাদের জন্য করা যরূরী? কারণ তার মাধ্যমে অন্তরের কঠোরতা দূর করা, অন্তরকে পবিত্র করা ও কোমল করার মত আরো অনেক কিছু এইরূপ শ্রবণের মাধ্যমে উদ্দেশ্যে করা হয়। যেমন গির্জায় খ্রিষ্টানরা ইবাদতের উদ্দেশ্যে এইরূপ শ্রবণ করে থাকে। খেলতামাশার উদ্দেশ্যে নয়।

যখন বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জানা গেল। তখন প্রকৃত প্রশ্ন হল যে, পূর্ব থেকে আলোচিত বিদ্বান কি এই কাজগুলো আল্লাহর ইবাদত, আনুগত্য ও তার নৈকট্য লাভের আশায় করতে পারেন? যে কাজগুলোর অবস্থাভেদে হুকুম হতে পারে হারাম, মাকরূহ বা হালাল? যাকে মাধ্যম করে তিনি আল্লাহর দিকে আহ্বান করবেন, পাপীদেরকে তওবাহ করাবেন, বিপথগামী ও পথভ্রষ্টদেরকে সঠিক পথের দিক-নির্দেশনা দিবেন?

জবাবে বলা যায়, সকলেই অবগত আছেন যে, ইসলামী শরী‘আতের দু’টি মূলনীতি আছে। তাহল, আল্লাহ তা‘আলা যা কিছু শরী‘আত সম্মত করেছেন শুধু সেটাই দ্বীন বা ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে (অর্থাৎ দ্বীন বা ইবাদত কুরআন ও সুন্নাহের দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হবে)। আর আল্লাহ তা‘আলা যা কিছু হারাম করেছেন শুধু সেগুলোই হারাম বলে গণ্য হবে (অর্থাৎ বস্তুর ক্ষেত্রে সবই হালাল। তবে হারাম হতে হলে তা কুরআন ও সুন্নাহের দলীল দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে)। এই মূলনীতির আলোকে আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদেরকে নিন্দা করেছেন। কারণ তারা আল্লাহ যা হারাম করেননি তা হারাম করেছিল এবং আল্লাহর অনুমতি বা অনুমোদন ছাড়াই তারা দ্বীন বা ইবাদত বানিয়েছিল।

অতএব একজন ব্যক্তির দুই পাহাড়ের মাঝে দৌড়াদৌড়ি করা সম্পর্কে আলেমকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, এই কাজটি কি তার জন্য জায়েয? তাহলে তিনি উত্তরে বলবেন, হ্যাঁ। কিন্তু যখন তাকে প্রশ্ন করা হবে যে, ঐ লোকটি ছাফা-মারওয়া এর মাঝে দৌড়ানোর মত করে ইবাদতের উদ্দেশ্যে দৌড়াদৌড়ি করে। তখন তিনি উত্তরে বলবেন যে, এই উদ্দেশ্যে তার করা কাজটি জঘন্যতম হারাম। তাকে তওবাহ করতে বলা হবে। তওবাহ না করলে তাকে হত্যা করা হবে।

আবার যদি আলেমকে প্রশ্ন করা হয়, মাথা খুলা রেখে লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করা সম্পর্কে। তাহলে তিনি ফৎওয়া দিবেন যে, তা জায়েয। আর যদি বলা হয় যে, হাজী যেভাবে ইহরাম বাধে সেই পদ্ধতিতে সে এইরূপ করে। তাহলে তিনি উত্তরে বলবেন যে, তা একটি জঘন্যতম হারাম।

কোন ব্যক্তির রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা সম্পর্কে আলেমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলবেন, তা জায়েয। কিন্তু যখন বলা হবে যে, সে তা ইবাদতের উদ্দেশ্য করে। তখন তিনি বলবেন, তা একটি জঘন্য কাজ।

ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে একটি হাদীছ বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় লক্ষ্য করলেন, এক ব্যক্তি  রৌদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিজ্ঞেস করলেন, সে কে? তারা বলল, আবূ ইসরাঈল। সে মানত করেছে যে, সে দাঁড়িয়ে থাকবে, বসবে না, ছায়া গ্রহণ করবে না, কথাবার্তা বলবে না এবং ছিয়াম অবস্থায় থাকবে। নবী কারীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,مُرُوْهُ فَلْيَتَكَلَّمْ وَلْيَسْتَظِلَّ وَلْيَقْعُدْ وَلْيُتِمَّ صَوْمَهُ ‘তোমরা তাকে বলে দাও, সে যেন অবশ্যই কথাবার্তা বলে, ছায়া গ্রহণ করে এবং বসে। আর ছিয়ামটি পুরা করে’।[২] লোকটি যদি কাজগুলো কোন বৈধ উদ্দেশ্যে করত তাহলে তাকে নিষেধ করতেন না। কিন্তু লোকটি সেটা ইবাদতের উদ্দেশ্যে করেছে, তাই তাকে নিষেধ করা হয়েছে।

এমনিভাবে কোন লোক যদি বাড়ীর পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে, তাহলে সেটা তার উপর হারাম নয়। কিন্তু যদি সে তা ইবাদতের উদ্দেশ্যে করে। যেমন, জাহিলীযুগের লোকেরা করত। তাদের কেউ হজ্জের ইহরাম বাধলে ছাদের নীচে প্রবেশ করত না। সে কারণে তাদেরকে এর থেকে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ لَیۡسَ الۡبِرُّ بِاَنۡ تَاۡتُوا الۡبُیُوۡتَ مِنۡ ظُہُوۡرِہَا وَ لٰکِنَّ الۡبِرَّ مَنِ اتَّقٰیۚ وَ اۡتُوا الۡبُیُوۡتَ مِنۡ اَبۡوَابِہَا ۪ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ

‘তোমরা যে পশ্চাৎদিক দিয়ে গৃহে সমাগত হও, এটা পুণ্য কর্ম নয়, বরং পুণ্যের কাজ হল যে, কোন ব্যক্তি মুত্তাক্বী হয় এবং তোমরা গৃহসমূহের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৯)।

আল্লাহ তা‘আলা উক্ত আয়াতের মাঝে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, উক্ত কাজটি হারাম না হলেও কোন ভালো কাজ নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি ঐ কাজটি সৎকাজ বলে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় করবে, সে অবাধ্য, নিন্দনীয় এবং বিদ‘আতী বলে গণ্য হবে। ইবলীসের নিকট বিদ‘আত অন্য সকল পাপাচার থেকে প্রিয়। কেননা পাপী কোন এক সময় নিজেকে পাপী বলে বুঝতে পারবে। অতঃপর পাপ থেক তওবা করবে। পক্ষান্তরে বিদ‘আতকারী বিদ‘আতকে ভালো কাজ মনে করে সম্পাদন করে। তাই সে তওবাহ করবে না।

অতএব যে ব্যক্তি খেল-তামাশার উদ্দেশ্যে এইরূপ শ্রবণস্থলে উপস্থিত হবে, সে তাকে সৎ আমল বলে গণ্য করবে না এবং তার মাধ্যমে সে নেকির আশাও করবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি উক্ত মজলিসে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় উপস্থিত হবে। সে এই কাজটিকে দ্বীন হিসাবে গণ্য করবে। তাকে যদি এই কাজ থেকে নিষেধ করা হয়, তাহলে তাকে যেন তার দ্বীন থেকে নিষেধ করা হল। তা যদি সে ছেড়ে দেয় তাহলে সে মনে করবে যে, আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হল এবং আল্লাহর নিকট থেকে পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রেও বঞ্চিত হল। সকল মুসলিম আলেমদের ঐকমত্যে এরা পথভ্রষ্ট। কোন মুসলিম আলেম উক্ত কাজটিকে দ্বীনের কাজ বা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কাজ হিসাবে গণ্য করা জায়েয বলেননি। বরং যে ব্যক্তি এটাকে দ্বীন বা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ হিসাবে গণ্য করবে সে পথভ্রষ্ট, মিথ্যাবাদী ও মুসলিমদের ইজমা বিরোধী। আর যে তার নিয়তের দিকে না তাকিয়ে তার বাহ্যিক আমল দেখে ফৎওয়া দেয়, সে একজন জাহেল। বিদ্যা ছাড়াই দ্বীনের ব্যাপারে উক্তিকারক হিসাবে গণ্য।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)  

* মুহাদ্দিছ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৭৭৫।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৭০৪; আবূ দাঊদ, হা/৩৩০০; মিশকাত, হা/৩৪৩০।




প্রসঙ্গসমূহ »: মুসলিম জাহান
তওবার গুরুত্ব ও ফযীলত (২য় কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
সমকামীতার ভয়াবহতা ও তার অপকার - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামী সংগঠন ও তরুণ-যুবক-ছাত্র (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
বিদ‘আত পরিচিতি (৩২তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
বিদ‘আত পরিচিতি (১৬তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
বিদ‘আত পরিচিতি (১০ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
শারঈ মানদন্ডে শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক

ফেসবুক পেজ