বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২২ অপরাহ্ন

ইখলাছই পরকালের জীবনতরী 

-আব্দুল গাফফার মাদানী* 


(৬ষ্ঠ কিস্তি)  

মুখলিছ ব্যক্তির নিদর্শনাবলী

১. আল্লাহ্র সন্তুষ্টি কামনা

মুখলিছ ব্যক্তিদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল তারা তাদের আমলের বিনিময়ে শুধু আল্লাহ্র সন্তুষ্টি কামনা করে। পার্থিব জীবনের কোন সুযোগ, সম্মান, প্রশংসা ও সম্পদ কামনা করে না। আল্লাহ তা‘আলা তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন,

وَ اصۡبِرۡ نَفۡسَکَ مَعَ الَّذِیۡنَ یَدۡعُوۡنَ رَبَّہُمۡ بِالۡغَدٰوۃِ  وَ الۡعَشِیِّ یُرِیۡدُوۡنَ وَجۡہَہٗ.

‘তুমি নিজেকে ধৈর্যশীল রাখ তাদের সাথে, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে তাঁর সন্তষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে’ (সূরা আল-কাহ্ফ: ২৮)। এ প্রসঙ্গে আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত,

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ ﷺ فَقَالَ الرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِلْمَغْنَمِ وَالرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِلذِّكْرِ وَالرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِيُرَى مَكَانُهُ فَمَنْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ؟ قَالَ مَنْ قَاتَلَ لِتَكُوْنَ كَلِمَةُ اللهِ هِيَ العُلْيَا فَهُوَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ.

‘এক ব্যক্তি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট এসে বলল, এক ব্যক্তি গণীমতের জন্য, অপর ব্যক্তি প্রসিদ্ধ হওয়ার জন্য, আরেক ব্যক্তি বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য জিহাদে অংশগ্রহণ করল। তাদের মধ্যে কে আল্লাহর পথে জিহাদ করল? রাসূল (ﷺ) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র কালিমা বুলন্দ থাকার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করল, সে-ই আল্লাহ্র পথে জিহাদ করল’।[১]

অতএব মুখলিছগণ বিশুদ্ধ নিয়তের অধিকারী। তারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তাঁর দ্বীনের শ্রেষ্ঠত্ব চায়। বিশুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমে আমল গ্রহণযোগ্য হয়। পক্ষান্তরে নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে, সে আমলের কোন প্রভাব থাকে না।[২] তাই রাসূল (ﷺ) বলেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ ، وَإِنَّمَا لاِمْرِئٍ مَا نَوَى ‘প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী-ই প্রতিদান পায়’।[৩]

২. গোপন আমলে আসক্তি

আল্লাহ্র মুখলিছ বান্দাগণ তাদের সৎ আমলগুলো গোপন রাখতে অধিক লালায়িত। গোপনে আমল করে তারা সে কল্যাণ লাভের আশা করে, যে কল্যাণের কথা সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক মারফূ‘ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْعَبْدَ التَّقِيَّ الْغَنِيَّ الْخَفِيَّ ‘নিশ্চয় আল্লাহ ঐ বান্দাকে ভালোবাসেন যে বান্দা তাক্বওয়াশীল, মুখাপেক্ষিহীন ও আত্মগোপনকারী’।[৪]

এটিই ছিল সালাফে ছালেহীনদের বৈশিষ্ট্য। এই প্রসঙ্গে আব্দুর রহমান মাক্বদেসী (রাহিমাহুল্লাহ) (৫৯৭-৬৮৩ হিঃ) বলেন, ‘কল্যাণওয়ালারা/সৎ মানুষরা কখনো খ্যাতি লাভের আশা করেননি। এমনকি নিজেদেরকে খ্যাতি লাভ করার কোন পরিবেশ-পরিস্থিতির সম্মুখীনও করেননি। আর যদি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সুখ্যাতি লাভ করতেন, তখন তা থেকে তারা পলায়ন করতেন এবং তারা অখ্যাতিকে অগ্রাধিকার দিতেন। যেমন ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, একদা তিনি তার বাড়ি থেকে বের হলেন, তার পিছনে কিছু লোক তার অনুসরণ করল। অতঃপর তিনি তাদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা কেন আমার অনুসরণ করছো? আমি আল্লাহ্র শপথ করে বলছি, যে বস্তুর উপর আমার দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তা যদি তোমরা জানতে, তাহলে তোমাদের দু’জন ব্যক্তিও আমার অনুসরণ করত না’।[৫] নিম্নে এ ব্যাপারে সালাফদের কিছু উক্তি পেশ করা হল :

উক্তি নং-১ : আল্লামা শামসুদ্দীন আয-যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৭৩-৭৪৮ হি./১২৭৫-১৩৪৭ খ্রি.) খুরায়বী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলেন,

كَانُوا يَسْتَحِبُّوْنَ أَنْ يَكُوْنَ لِلرَّجُلِ خَبِيئَةٌ مِنْ عَمَلٍ صَالِحٍ لاَ تَعْلَمُ بِهِ زَوْجَتُهُ وَلاَ غَيْرُهَا.

‘(সালফে ছালেহীন) পসন্দ করতেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির একটি গোপনীয় সৎ আমল থাকবে, যা তার নিজের স্ত্রীসহ অন্য কেউ জানবে না’।[৬]

উক্তি নং-২ :  আইয়ূব সিখতিয়ানী (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৮৭-৭৪৯ খ্রি.) বলেন, واللهِ! مَا صَدَقَ عَبْدٌ إِلَّا سَرَّهُ أَنْ لَايُشْعَرَ بِمَكَانِهِ ‘আল্লাহ্র কসম! সত্যবাদী বান্দা মাত্রই পসন্দ করে যে, তার (আমলের) অবস্থান যেন কোনক্রমে উপলব্ধি না করা হয়’।

উক্তি নং-৩ : সালমাহ ইবনু দীনার (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃত ১৩৩ অথবা ১৩৫ হি.) বলেন,  اُكْتُمْ حَسَنَاتِكَ أَشَدَّ مِمَّا تَكْتُمُ سَيِّئَاتِكَ ‘তুমি তোমার খারাপ আমলগুলো থেকে সৎ আমলগুলোকে বেশি গোপনে রাখ’।[৭]

উক্তি নং-৪ : বিশরূল হাফী (১৭৯-২২৭ হি.) বলেন,

أَخْمِلْ ذِكْرَكَ وَطَيِّبْ مَطْعَمَكَ لَا يَجِدُ حُلْوَةَ الْأَخِرَةِ رَجُلٌ يُحِبُّ فِى الدُّنْيَا أَنْ يَّعْرِفَهُ النَّاسُ.

‘তুমি নিজেকে অখ্যাত কর ও হালাল খাবার খাও। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মানুষের মাঝে নিজের খ্যাতি কামনা করে, সে আখেরাতের স্বাদ পাবে না’।[৮]

উক্তি নং-৫ : মুহাম্মাদ বিন ‘আলা (১৬১-২৪৮ হি.) বলেন, مَنْ أَحَبَّ اللهَ أَحَبَّ أَنْ لَا يَعْرِفَهُ النَّاسُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালবাসে সে  পছন্দ করে মানুষ যেন তাকে না চিনে’।[৯]

উক্তি নং-৬ : ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) (১৫০-২০৪ হি.) বলেন, وَدِدْتُ أَنَّ الْخَلْقَ يَتَعَلَّمُوْنَ هَذَا الْعِلْمَ وَلَا يُنْسَبُ إِلَّي مِنْهُ شَيْئٌ ‘আমি চাই যে, মানুষ (আমার থেকে) এই ইলম শিক্ষা অর্জন করবে অতঃপর আমার দিকে তা থেকে কিছুই সম্বোধন করা হবে না’।[১০]

এ বিষয়টি শুধু সালাফদের উক্তি, দিক নির্দেশনা ও আশা-আকাক্সক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। যার কিছু প্রমাণ উল্লেখ করা হল-

(ক) উমার ইবনু খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাতের আধারে মদীনার এক প্রান্তে বসবাসকারিনী এক অন্ধ বৃদ্ধার দেখা শুনা করতেন। তার পানি সংগ্রহসহ অন্যান্য কাজগুলো করে দিতেন। এক সময় তিনি সে মহিলার বাড়িতে এসে দেখেন যে, কোন এক ব্যক্তি তার সব কাজ করে চলে গেছে। অতঃপর পরের দিন তিনি তার নিকট পুনরায় আসেন, যাতে তাঁর পূর্বে কেউ না আসতে পারে এবং তিনি তার প্রতীক্ষায় থাকেন যে, কে সেই ব্যক্তি? কিছুক্ষণ পর দেখেন তিনি ইসলামের প্রথম খলীফা আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। অতঃপর উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হায়! আমার আফসোস সেই ব্যক্তি আপনি! [১১]

(খ) মানছূর আস-সুলামী (রাহিমাহুল্লাহ) চল্লিশ বছর যাবৎ ছিয়াম ও ক্বিয়াম পালন করেছেন এবং তিনি আল্লাহ্র ভয়ে ক্রন্দন করতেন।[১২]

(গ) দাঊদ ইবনু হিন্দ (রাহিমাহুল্লাহ) চল্লিশ বছর যাবৎ ছিয়াম পালন করতেন, যা তার পরিবার জানত না। তিনি একজন বয়ান শিল্পী ছিলেন। সকাল বেলা তার বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে তার কর্মস্থলে রওয়ানা হতেন। পথিমধ্যে সে খাবার ছাদাক্বাহ করে দিতেন এবং সন্ধ্যা বেলা বাড়িতে এসে তাদের সাথে ইফতার করতেন।[১৩]

(ঘ) যয়নুল আবেদীন (আলী ইবনু হুসাইন) (রাহিমাহুল্লাহ) মদীনার একশ’ পরিবারের জন্য ব্যয় করতেন। তিনি রাতে তাদের বাড়িতে এসে খাবার পৌঁছে দিতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তারা জানত না যে, কে তাদেরকে খাবার দেয়। অতঃপর তাঁর মৃত্যুর পর তাদের খাবার আসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন তারা বুঝতে পারলেন তিনি হলেন সেই ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুর সময় তারা তাঁর পিঠে খাবার বহন করার দাগ দেখতে পেয়েছিল, যে খাবার তিনি বিধবাদের বাড়িতে পৌঁছে দিতেন।[১৪]

(ঙ) সুফিয়ান ছাওরী (রাহিমাহুল্লাহ) (৭১৬-৭৭৮ হি.) বলেন, আমি এমন ব্যক্তির সন্ধান লাভ করেছি, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে একই বালিশে ঘুমাত, সে আল্লাহ্র ভয়ে ক্রন্দন করত অথচ তার স্ত্রী টের পেত না। আর আমি এমন কিছু লোক পেয়েছি, যারা একই কাতারে ছালাত আদায় করত এবং তাদের  চোখের অশ্রু ঝরত অথচ তার পাশ্বের ব্যক্তি বুঝতে পারত না।[১৫]

(চ) হাসান ইবনু সিনান (রাহিমাহুল্লাহ) এর স্ত্রী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তিনি আমার বিছানায় আসতেন এবং আমার চাদরের ভিতরে প্রবেশ করতেন। অতঃপর তিনি আমাকে ধোঁকা দিতেন যেমনভাবে মহিলা তার বাচ্চাকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। যখন বুঝতেন যে, আমি ঘুমিয়ে গেছি, তখন তিনি গোপনে বের হয়ে ছালাত আদায় করতেন। অতঃপর আমি তাকে বললাম, হে আবূ আব্দুল্লাহ! আপনি আপনার আত্মাকে আর কত কষ্ট দিবেন, আপনি আপনার আত্মার প্রতি সদয় হন। তিনি বললেন, তোমার ধ্বংস হোক তুমি চুপ কর! হতে পারে ঘুমিয়ে গেলে আর সজাগ পাব না।[১৬]

(ছ) ইবনুল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) (১১৮-১৮১ হি.) যুদ্ধের ময়দানে তার আস্তিন মুখের উপর রাখতেন, যাতে তাঁকে কেউ চিনতে না পারে।[১৭]

সুধী পাঠক! উক্ত গোপনীয় আমলগুলো থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, নির্জনে ও গোপনে আমল করা শরী‘আত সম্মত কিন্তু এটা নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; জামা‘আতে ছালাত আদায়ের মত ফরয ইবাদতের ক্ষেত্রে নয়।

কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) (৬০০-৬৭১ হি.) বলেন, সমস্ত নফল ইবাদত গোপনে করাই উত্তম। কেননা এটি রিয়া থেকে মুক্ত রাখে। তবে ফরযের ক্ষেত্রে এমনটি নয়। ‘আলেমগণ ঐ ইবাদতের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছেন, যা দেখে মানুষ অনুসরণ করে; সে ক্ষেত্রে প্রকাশ করা ভালো। ইমাম ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) (২২৪-৩১০ হি.) বলেন, ইবনু মাসঊদ, ইবনু ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) সহ কতিপয় সালাফ তাদের মসজিদে তাহাজ্জুদের ছালাত আদায় করতেন। তারা তাদের আমলের সৌন্দর্য প্রকাশ করতেন, যাতে তাদের অনুসরণ করা হয়।[১৮]

৩. তাদের প্রকাশ্য আমলের চেয়ে গোপনীয় আমল অধিক সুন্দর

সে ব্যক্তি মুখলিছ নয়, যে মানুষের সামনে নিজের ইবাদত প্রকাশ করে। ইবনু আত্বা বলেন, সর্বত্তোম ইবাদত হল- যে ইবাদতে সদা-সর্বদা নিজের মনের তদারকি করা হয়।[১৯]  আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ الَّذِیۡنَ یَبِیۡتُوۡنَ لِرَبِّہِمۡ سُجَّدًا وَّ قِیَامًا ‘এবং তারা রাত্রি অতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদায় অবনত হয়ে ও দণ্ডায়মান হয়ে’ (সূরা আল-ফুরক্বান: ৬৪)।

যারা প্রকাশ্যে সৎ আমল করে ও গোপনে খারাপ আমল করে তাদের ব্যাপারে রাসূল (ﷺ) বলেন,

لَأَعْلَمَنَّ أَقْوَامًا مِنْ أُمَّتِي يَأْتُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِحَسَنَاتٍ أَمْثَالِ جِبَالِ تِهَامَةَ بِيْضًا فَيَجْعَلُهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ هَبَاءً مَنْثُوْرًا  قَالَ ثَوْبَانُ يَا رَسُوْلَ اللهِ صِفْهُمْ لَنَا جَلِّهِمْ لَنَا أَنْ لَا نَكُوْنَ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَا نَعْلَمُ قَالَ أَمَا إِنَّهُمْ إِخْوَانُكُمْ وَمِنْ جِلْدَتِكُمْ وَيَأْخُذُوْنَ مِنَ اللَّيْلِ كَمَا تَأْخُذُوْنَ وَلَكِنَّهُمْ أَقْوَامٌ إِذَا خَلَوْا بِمَحَارِمِ اللهِ انْتَهَكُوْهَا.

‘আমি আমার উম্মতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি, যারা ক্বিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালার সমতুল্য নেক আমল সহ উপস্থিত হবে। মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। ছাওবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ)! তাদের পরিচয় পরিষ্কার ভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই। তিনি বলেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলায় তোমাদের মতই ইবাদত করে কিন্তু তারা এমন লোক, যখন দৃষ্টির অগোচরে হয়, তখন আল্লাহ্র হারামকৃত বিষয়ে লিপ্ত হয়’।[২০]

অতএব গোপনে হারাম ও গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া অতিব জঘন্যতম কাজ, যা মুখলিছদের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য নয়। এজন্য রাবী ইবনু কুসাইম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, গোপন হল- যা মানুষের দৃষ্টির অগোচরে করা হয়। হামীদুত তাবীল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যখন তুমি নির্জনে আল্লাহ্র নাফরমানী করবে তখন তুমি এই বিশ্বাস রাখবে যে, তিনি তোমাকে প্রত্যক্ষ করছেন এবং তুমি বড় অপরাধ করে ফেলেছ। আর যদি তুমি এই বিশ্বাস কর যে, তিনি তোমাকে দেখেন না, তাহলে তুমি কাফের হয়ে যাবে। বেলাল ইবনু সাঈদ বলেন, যে গোপনে আল্লাহ্র শত্রুতা করে সে প্রকাশ্যে তার বন্ধু হতে পারে না।[২১]

ইবনুল আরাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সে ব্যক্তি বড় ক্ষতিগ্রস্ত, যে তার সৎ আমলগুলো মানুষের নিকট প্রকাশ করে এবং খারাপগুলো ঐ সত্তার নিকট প্রকাশ করে যিনি তার ঘাড়ের রগের চেয়েও অধিক নিকটে।[২২]

৪. আমল বর্জিত হওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত হওয়া

যখনই মুখলিছ বান্দার আমল বেশি হতে থাকে, তখনই সে তার আমল বর্জিত হওয়া ও কবুল না হওয়ার আশায় শঙ্কিত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের গুণ বর্ণনা করে বলেন, وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡتُوۡنَ مَاۤ  اٰتَوۡا وَّ قُلُوۡبُہُمۡ وَجِلَۃٌ  اَنَّہُمۡ   اِلٰی رَبِّہِمۡ  رٰجِعُوۡنَ ‘এবং যারা তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করার তা দান করে ভীতি-কম্পিত হৃদয়ে’ (সূরা আল-মুমিনূন: ৬০)। হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) (২১-১১০ হি.) তাদের সম্পর্কে বলেন, তাদেরকে ইখলাছ দেয়া হয়েছে অথচ তারা তাদের আমল কবুল হওয়ার ব্যাপারে ভয় করে।[২৩] হাদীসে এসেছে,

أَنَّ عَائِشَةَ زَوْجَ النَّبِيِّ ﷺ قَالَتْ سَأَلْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ عَنْ هَذِهِ الآيَةِ وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَا آتَوْا وَقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ قَالَتْ عَائِشَةُ أَهُمُ الَّذِيْنَ يَشْرَبُوْنَ الخَمْرَ وَيَسْرِقُوْنَ؟ قَالَ لَا يَا بِنْتَ الصِّدِّيْقِ وَلَكِنَّهُمُ الَّذِيْنَ يَصُوْمُوْنَ وَيُصَلُّوْنَ وَيَتَصَدَّقُوْنَ وَهُمْ يَخَافُوْنَ أَنْ لَا تُقْبَلَ مِنْهُمْ أُوْلَئِكَ يُسَارِعُوْنَ فِي الْخَيْرَاتِ.

‘নবী করীম (ﷺ)-এর স্ত্রী আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এবং তারা তো ঐ সকল লোক যারা দান করে তা হতে, যা তাদেরকে দেয়া হয়েছে আর তাদের অন্তর (আল্লাহ্র শাস্তির ভয়ে) ভীত’। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, তারা কি ঐ সব লোক, যারা মদপান করে ও চুরি করে? রাসূল (ﷺ) বললেন, হে ছিদ্দীকের কন্যা! না, তারা নয়। তবে তারা হচ্ছে ঐ সকল লোক, যারা ছিয়াম রাখে, ছালাত আদায় করে, ছাদাক্বাহ করে এবং তারা ভয় করে যে, তাদের পক্ষ হতে তা গ্রহণ করা হবে না। তারা কল্যাণের ব্যাপারে দ্রুত ধাবিত হয়।[২৪]

ইমাম মাওয়ার্দী (রাহিমাহুল্লাহ) বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য সমৃদ্ধ এবং গবেষণাধর্মী একজন লেখক। তিনি অসংখ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। যেমন- ফিক্বহ বিষয়ে আল-হাবীল কাবীর, তাফসীর বিষয়ে আন-নুকাত ওয়াল উয়ুন, আহকামুস সুলতানিয়াহ এবং আদাবুল দুনিয়া ওয়াদ্দীন। এই সমস্ত লেখনী তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ হয়নি। কারণ এগুলো তিনি একটি স্থানে একত্রিত করে রেখেছিলেন। যখন তাঁর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসল, তখন তিনি তাঁর এক বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বললেন, আমার কিছু লিখিত কিতাব অমুক জায়গাতে আছে। যেগুলো আমি প্রকাশ করিনি আমার বিশুদ্ধ নিয়তের আশায়।[২৫] সুবহানাল্লাহ!!

৫. মানুষের প্রশংসার আশা না করা

মুখলিছ ব্যক্তির অনন্য বৈশিষ্ট্য হল- তারা কারো প্রতি অনুগ্রহ করলে বা বিপদে সাহায্য করলে কোন মর্যাদার আশা করেন না। কেননা তারা একমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য আমল করে থাকেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَاۤ  اَسۡـَٔلُکُمۡ  عَلَیۡہِ مِنۡ اَجۡرٍ ۚ اِنۡ اَجۡرِیَ   اِلَّا  عَلٰی رَبِّ  الۡعٰلَمِیۡنَ

‘আমি তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না, আমার পুরস্কার তো জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকটেই আছে’ (সূরা আশ-শু‘আরা: ১০৯)।

তাদের প্রতি কেউ খারাপ আচরণ করলে তারা তাকে তিরষ্কার ও ভর্ৎসনা করেন না। কোন কিছু থেকে তাদের বাধা দিলে তারা তার প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ করেন না। আর কারো নিকট থেকে তারা প্রতিদান বা পুরস্কারের আশাও করে না। তাদের অবস্থা বর্ণনায় স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّمَا نُطۡعِمُکُمۡ لِوَجۡہِ اللّٰہِ لَا نُرِیۡدُ مِنۡکُمۡ جَزَآءً   وَّ  لَا  شُکُوۡرًا.

‘(এবং বলে) কেবল আল্লাহ্র সন্তষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি, আমরা তোমাদের নিকট প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও নয়’ (সূরা আদ-দাহর: ৯)। অর্থাৎ তোমাদের থেকে আমরা কোন প্রতিদান চাই না, যা তার সমতুল্য। মানুষের সামনে প্রশংসা করা হোক এটাও তারা চান না।

মুজাহিদ সাঈদ ইবনু জুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ্র শপথ! তারা তাদের ভাষায় যা বলেছে, আল্লাহ তাদের অন্তরের খবর জানেন তাদেরকে উৎসাহ প্রদানের জন্য তাদের প্রশংসা করেছেন।[২৬] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি কোন বাড়িওয়ালার নিকট ছাদাক্বাহ পাঠাতেন। অতঃপর তিনি প্রেরিত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করতেন, তারা কী বলেছে? যখন প্রেরিত ব্যক্তি তাদের দু‘আর কথা উল্লেখ করতেন তিনিও তখন তাদের জন্য অনুরূপ দু‘আ করতেন, যাতে করে ছাদাক্বার ছওয়াব তাঁর জন্য পরকালে আল্লাহ্র নিকট খালেছভাবে অবশিষ্ট থাকে।[২৭]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)



*  শিক্ষক, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।

[১]. ছহীহ বুখারী, হা/২৮১০।

[২]. ফাৎহুল বারী, ৬/২৯ পৃঃ।

[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪।

[৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৬৫।

[৫]. মুখতাছার মিনহাজুল ক্বাসিদীন, পৃ. ২০৯।

[৬]. সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৯২।

[৭]. হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৩৯।

[৮].  মিনহাজুল ক্বাসিদীন, পৃ. ২১০।

[৯]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩৪৩।

[১০]. হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১১৮।

[১১]. আব্দুর রহমান ইবনু আবুবকর জালালুদ্দীন আস-সুয়ূত্বী, তারীখুল খুলাফা (মাকতাবাতু নাযযার মুছত্বাফাউল বাযযার, ১ম সংস্করণ, ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি.), পৃ. ৭৫।

[১২]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪০৬।

[১৩]. হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৯৪।

[১৪]. সিরারু আ‘লামুন নুবালা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৯৩ ও ৯৪।

[১৫]. হিলইয়াতুল আওলিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৭।

[১৬]. হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৭।

[১৭]. সিয়ারু আ’লামুন নুবালা, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৩৯৪।

[১৮]. ফাৎহুল বারী, ১১শ খণ্ড, পৃ. ৩৪৫।

[১৯]. ইহইয়া ঊলূমুদ্দীন, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৯৭।

[২০]. ইবনু মাজাহ, হা/৪২৪৫; ছহীহুল জামে‘, হা/৫০২৮, সনদ ছহীহ।

[২১]. শিফাতুন নেফার লিল ফিরাযাযী, পৃ. ৯৭।

[২২]. বায়হাক্বী- শু‘আবুল ঈমান, হা/৬৯৮৭।

[২৩]. জামেঊ লি আহকামিল কুরআন, ১২শ খণ্ড, পৃ. ১৩২।

[২৪]. তিরমিযী, হা/৩১৭৫; মিশকাত, হা/৫৩৫০; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৬২।

[২৫]. সিরারু ‘আলামিন নুবালাহ, ১৮শ খণ্ড, পৃ. ৬৬-৬৭।

[২৬]. তাফসীরে আবু সাউদ, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৭২।

[২৭]. তারীখুল উমাম ওয়াল মুলুক ৪/১৯ পৃঃ।




প্রসঙ্গসমূহ »: আত্মশুদ্ধি
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৫ম কিস্তি)  - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) -এর আগমন সংশয় নিরসন (৬ষ্ঠ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার আবশ্যকতা - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৮ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (৮ম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
আশূরায়ে মুহাররম - ছাদীক মাহমূদ
ইসলামে পর্দার বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৭ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন

ফেসবুক পেজ