মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৩:৫৯ অপরাহ্ন

সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা

-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর*


(৬ষ্ঠ কিস্তি)

৮). সূদখোর জাহেলী রীতির অনুসারী

জাহেলী যুগের চলমান বিষয়, যা ইসলাম হারাম করেছে এবং বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছে তাই জাহেলী রীতি। সূদপ্রথা জালেহী যুগে চালু ছিল, ইসলাম তা হারাম করেছে। তা পুনরায় চালু করা জাহেলী রীতি চালু করার শামিল। সূদপ্রথা জাহেলিয়াত এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সূদী কারবার জাহেলিয়াত তার সুস্পষ্ট বর্ণনা হাদীছে পাওয়া যায়। যেমনটি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের পড়ন্ত বেলায় বিদায় হজ্জের হৃদয়গ্রাহী ভাষণে বলেছিলেন,

أَلَا كُلُّ شَيْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَيَّ مَوْضُوْعٌ .. وَرِبَا الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعٌ وَأَوَّلُ رِبًا أَضَعُ مِنْ رِبَانَا رِبَا عَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ فَإِنَّهُ مَوْضُوْعٌ كُلُّهُ

‘সাবধান! জাহেলী যুগের সকল অপকর্ম আমার দু’পায়ের নিচে রহিত হল এবং  জাহেলী যুগের সূদ রহিত করা হল। আর আমাদের সূদসমূহের যে সূদ আমি প্রথমে রহিত করলাম, তাহল আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবের সূদ। সূদের সমস্ত কিছুই রহিত করা হল’।[১]

অত্র হাদীছে দু’টি বিষয় ফুটে উঠেছে। প্রথমত : সূদপ্রথা জাহেলিয়াত। সূদী কারবার জাহেলিয়াত এতে কোনই সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়ত : সূদপ্রথাকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বহু পূর্বেই স্বীয় পদতলে কবর দিয়েছেন। তবে সকল জাহেলী কর্ম বলার পর, আবার সূদের নাম উল্লেখ করে বলেছেন। যদিও সকল কর্মের মধ্যে সূদও অন্তর্ভুক্ত। এভাবে বলার মধ্যে সূদের জঘন্যতা ও ভয়াবহতাই ফুটে উঠে। একজন ব্যক্তি সূদী কারবারে জড়িত হওয়া মানে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পায়ের নীচে পুঁতে দেয়া জিনিস উত্তলন করা ও ভক্ষণ করা। এমন নিন্দনীয় কর্মে প্রকৃত মুসলিম জড়িত হতে পারে না। সূদপ্রথা জাহেলিয়াত তাতো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। জাহেলী নীতি বা আদর্শ কোনভাবেই মুসলিম ব্যক্তির জন্য পালনীয় নয়। জাহেলিয়াতের ঘোর অন্ধকার দূর করার জন্যই ইসলামের সুভাগমন হয়েছে। আর কোন ব্যক্তি জাহেলী রীতি চালু করলে, সে আল্লাহর নিকট অতিশয় ঘৃণিত। হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَبْغَضُ النَّاسِ إِلَىْ اللهِ ثَلَاثَةٌ مُلْحِدٌ فِىْ الْحَرَمِ وَمُبْتَغٍ فِىْ الْإِسْلَامِ سُنَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ وَمُطَّلِبُ دَمِ امْرِئٍ بِغَيْرِ حَقٍّ لِيُهَرِيْقَ دَمَهُ

আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশী ঘৃণিত। (১) যে ব্যক্তি পবিত্র হারামে নিষিদ্ধ কাজ করে (২) যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে জাহেলী যুগের রীতি চালু করার আকাক্সক্ষা করে এবং (৩) যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কারু রক্ত কামনা করে স্রেফ রক্তপাতের উদ্দেশ্যে।[২]

সমাজে জাহেলী সুন্নাত চালুকারী ব্যক্তি আল্লাহর নিকট খুবই জঘন্য। সূদপ্রথা যেহেতু জাহেলী রীতি বিধায় এরূপ ব্যক্তিও রবের নিকট নিন্দনীয়। যারা সূদী কারবারের সাথে নানাভাবে জড়িত, তারা সকলেই জাহেলী রীতি প্রসারকারীর অন্তর্ভুক্ত। ফলে তারা সকলে স্বীয় প্রভুর নিকট জঘন্য মানুষ হিসাবে বিবেচিত হবে। সূদ খাওয়া এমনি এক নোংরা কাজ যাকে স্রষ্টাও ঘৃণা করেন। এরূপ কাজ কোন ভদ্র মানুষের জন্য শোভনীয় হতে পারে না। আর যারা সূদী কারবারের প্রচার-প্রসারের কাজে নিয়োজিত তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। যারা সূদী প্রতিষ্ঠানের কর্মী তাদেরকেও ইসলাম সাবধান করেছে।

عَنِ الْحَارِثِ الْأَشْعَرِيِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ .. وَمَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَى جَهَنَّمَ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ

হারেছ আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ... ‘আর যে ব্যক্তি মানুষদেরকে জাহেলী যুগের দিকে আহ্বান করে, সে জাহান্নামীদের দলভুক্ত, যদিও সে ছিয়াম পালন করে, ছালাত আদায় করে এবং নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করে’।[৩]  

কোন ব্যক্তি যদি মানুষকে জাহেলী নীতি দ্বারা বা জাহেলিয়াতের দিকে আহ্বান জানায়, তাহলে সে তার বাসস্থান জাহান্নামে করে নিবে। সূদপ্রথা নিশ্চিত জাহেলী পন্থা। এক্ষণে যারা সূদী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, তাদের এ বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। আর যারা এরূপ প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মী তাদের বিষয়টি আরো জটিল। কেননা এরূপ ব্যক্তিরা সরাসরি মানুষকে জাহেলিয়াতের দিকে আহ্বান জানাচ্ছে। অবশ্য এক্ষেত্রে সূদখোরের অপরাধও কম নয়। দুনিয়াবী জীবনের সফলতায় কি চূড়ান্ত? না, পরকালীন সফলতা চূড়ান্ত তা এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা। সামান্য ক’টা টাকার কারণে যদি পরকাল হারাতে হয়, তাহলে কী হবে এসব দিয়ে। পরকালীন সফলতায় মুমিন জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত। কেননা মুমিনের জন্য দুনিয়ার চাকচিক্য নয়; বরং তারা পরকালকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

৯). সূদ দুনিয়াতে গযব আসার কারণ

সূদ এমন এক জঘন্য পাপ, যার কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়াতে আযাব আসার কারণ হতে পারে। যখন সমাজে সূদ ও ব্যভিচার ছড়িয়ে যায়, তখন তাদের উপর আযাব পতিত হওয়া সহজ হয়ে যায়।

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ  صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا ظَهَرَ الزِّنَا وَالرِّبَا فِيْ قَرْيَةٍ فَقَدْ أَحَلُّوْا بِأَنْفُسِهِمْ عَذَابَ اللهِ

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যখন কোন জনপদে ব্যভিচার ও সূদ প্রকাশ লাভ করে, তখন তার বাসিন্দারা নিজেদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার আযাব বৈধ করে নেয়’।[৪]

কোন জনপদে সূদ প্রসারিত হওয়ায় তারা আল্লাহর আযাবকে বৈধ করে নেই। সমাজে ব্যাপকভাবে সূদী কারবার প্রচলিত থাকলে, সেখানে এলাহী গযব অবতীর্ণ হওয়াতে আর কোন বাধা থাকে না। সূদী সমাজে যে কোন সময় এলাহী গযব এসে পড়তে পারে। আর গযব আসলে শুধু বদ মানুষগুলো ধ্বংস হবে এ কথা নয়। বরং সমাজের ভাল-মন্দ সকল মানুষই ধ্বংস হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যখন কোন মানুষ কোন সম্প্রদায়ের মাঝে পাপের কাজ করে। এ সময় তারা (অন্যরা) বাধা প্রদান না করে, তাহলে আল্লাহ তাদের মরণের পূর্বে তাদের সকলের উপর বিপদ চাপিয়ে দিবেন’।[৫]

ব্যভিচার ও সূদ বিশ্বব্যাপী ভয়ঙ্কর রূপে বিস্তার লাভ করেছে। যেন গোটা দুনিয়া ছেয়ে গেছে। বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন প্রকার বালা-মুছীবত, মহামারী বা এলাহী গযব হয়তবা তারই নির্মম ফল। কখনো ডেঙ্গু, কখনো চিকন গুনিয়া, কখনো সুনামি বা জলোচ্ছ্বাস, কখনো বন্যা বা খরা, কখনো ঘুর্ণিঝড়, কখনো ভূমিকম্পসহ অজানা কত বিপদ। আবার নতুন করে শুরু হয়েছে করোনা ভাইরাস। যার ব্যাপক প্রভাবের নির্মম পরিণতি বিশ্ববাসী ভোগ করছে। এক করোনায় কার্যত গোটা পৃথিবী অচল। বিনা অবরোধে গোটা পৃথিবীর মানুষ গৃহবন্দী। নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রত্যেকে ব্যতিব্যস্ত। মানুষ প্রতিটি মুহূর্ত মহা অতংকে দিন অতিবাহিত করছে। এত সাবধানতার পরেও  কোটির অধিক মানুষ করোনায় আক্রান্ত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মহাসাফল্যের যুগেও স্বয়ং চিকিৎসকও ভীত সন্ত্রস্ত। লাখো লাখো মানুষ করোনার জীবানু নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিনাতিপাত করছে। ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের লক্ষ লক্ষ জনতা মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছেন। যা গোটা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। কোন কোন এলাকা মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। স্বজন হারাদের বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হচ্ছে। সংক্রমণের অজানা ভয়ে রোগাক্রান্ত স্বজনও এখন যেন অনেক দূরের এক অপরিচিত মানুষ!

এসব আমাদের কৃত সূদী কারবার, ব্যভিচারসহ নানা অপকর্মের নির্মম পরিণতি নয় তো! আমাদের ঘৃণ্য অপরাধের করুণ পরিণতি নয় তো!! আমাদের পাপের কিঞ্চিৎ প্রাশ্চিত্য কি-না তার কোন সঠিক জবাব কি কেউ দিতে পারবে? সময় এসেছে গভীরভাবে চিন্তা করার। স্ব স্ব জীবনের কৃত কর্মের হিসাব মিলিয়ে নেয়ার। সূদসহ যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা বর্জন করে জীবন শুধরিয়ে নেয়ার। সৃষ্টি হিসাবে মহান আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীনের দিকে ফিরে যাওয়ার। প্রিয় পাঠক! এই কথাগুলো কি আপনার কর্ণ-কুহুরের গহীনে পৌঁছেছে? আপনার ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করতে কোন খোরাক যুগিয়েছে? সূদী কারবারকে সর্বস্তরে বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে প্রেরণা ও সাহস সঞ্চার করেছে? জবাবদিহিতা মহান প্রভু আল্লাহর কাছে! সূদ পরিহার করে এখন তওবা করাই বাকী রইল!  

১০). সূদখোরের চূড়ান্ত পরিণতি জাহান্নাম

সূদখোর মহাজনের শেষ পরিণতি জাহান্নাম। সূদের টাকায় পাহাড় গড়েছে। বিলাসিতায় বিভোর হয়ে জীবন যাপন করেছে। আরাম-আয়েশে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে। সুস্থ বিবেক হারিয়ে বহু মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ সূদের টোপে শিকার করেছে। হত দরিদ্রের শ্রমের মূল্যকে রক্তচোষা জোঁকের মত শোষণ করেছে। দুনিয়ার মায়াবী জীবন নিয়ে উন্মাদ থেকেছে। চাকচিক্য পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে ঐ আয়েশী সূদখোর বরণ করবে জাহান্নামের অবর্ণনীয় অগ্নি স্বাদ। যারা সূদী কারবার থেকে তওবা করে পুনরায় সূদে জড়িয়ে যায় তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,  وَ مَنۡ عَادَ فَاُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ ‘আর যারা পুনরায় সূদ নেয়া আরম্ভ করবে, তারাই জাহান্নামের বাসিন্দা। তারা তাতে চিরকাল থাকবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭৫)। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَّ اَخۡذِہِمُ الرِّبٰوا وَ قَدۡ نُہُوۡا عَنۡہُ وَ اَکۡلِہِمۡ اَمۡوَالَ النَّاسِ بِالۡبَاطِلِ  وَ اَعۡتَدۡنَا لِلۡکٰفِرِیۡنَ مِنۡہُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا

‘আর তাদের (ইহুদীদের) সূদ গ্রহণের কারণে যদিও তাত্থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল এবং তাদের অন্যায়ভাবে লোকদের ধন-সম্পদ গ্রাস করার কারণে এবং আমি তাদের মাঝে যারা অবিশ্বাসী তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি’ (সূরা আন-নিসা, ১৬১)। এ মর্মে হাদীছে বিঘোষিত হয়েছে-

সামুরা ইবনু জুনদুব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অভ্যাস ছিল, তিনি ফজরের ছালাত শেষে প্রায়শ আমাদের দিকে মুখ করে বসতেন এবং জিজ্ঞেস করতেন, তোমাদের কেউ আজ রাত্রে কোন স্বপ্ন দেখেছ কি? বর্ণনাকারী বললেন, আমাদের কেউ কোন স্বপ্ন দেখে থাকলে সে তার নিকট বলত। আর তিনি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক তার তা‘বীর বয়ান করতেন। যথারীতি একদিন সকলে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কেউ (আজ রাত্রে) কোন স্বপ্ন দেখেছ কি? আমরা আরয করলাম, না। তখন তিনি  বললেন, কিন্তু আমি দেখেছি, অদ্য রাত্রে দুই ব্যক্তি আমার নিকট আসল এবং তারা উভয়ে আমার হাত ধরে একটি পবিত্র ভূমির দিকে (সম্ভবত তা শাম বা সিরিয়ার দিকে) নিয়ে গেল। দেখলাম এক ব্যক্তি বসে আছে, আর অপর এক ব্যক্তি লোহার সাড়াশি হাতে দাঁড়ানো। সে তা উক্ত বসা ব্যক্তির গালের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয় এবং অনুরূপ ব্যবহার করে। ইত্যবসরে প্রথম গালটি ভাল হয়ে যায়। আবার সে (প্রথমে যেভাবে চিরে ছিল,) পুনরায় তাই করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী? তারা উভয়ে বলল, সামনে চলুন। সম্মুখের দিকে চললাম।
অবশেষে আমরা এমন এক ব্যক্তির নিকট এসে পৌঁছলাম, যে ঘাড়ের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে, আর এক ব্যক্তি একখানা ভারী পাথর নিয়ে তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার আঘাতে শায়িত ব্যক্তির মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করছে। যখনই সে পাথরটি নিক্ষেপ করে (মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে) তা গড়িয়ে দূরে চলে যায়। তখন সেই লোকটি পুনরায় পাথরটি তুলে আনতে যায়, সে ফিরে আসার পূর্বে ঐ ব্যক্তির মাথাটি পূর্বের ন্যায় ঠিক হয়ে যায় এবং পুনরায় সে তা দ্বারা তাকে আঘাত করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী? তারা উভয়ে বলল, সামনে চলুন। আমরা সম্মুখের দিকে অগ্রসর হলাম। অবশেষে একটি গর্তের নিকট এসে পৌঁছলাম, যা তন্দুরের মত ছিল। তার উপরের অংশ ছিল সংকীর্ণ এবং ভিতরের অংশটি ছিল প্রশস্ত। তার তলদেশে আগুন প্রজ্বলিত ছিল। আগুনের লেলিহান শিখা যখন তার উপরের দিকে উঠত, তখন তার ভিতরে যারা রয়েছে তারাও উপরে উঠে আসত এবং উক্ত গর্ত হতে বাইরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হত। আর যখন অগ্নিশিখা কিছুটা স্তিমিত হত তখন তারাও পুনরায় ভিতরের দিকে চলে যেত। তার মধ্যে রয়েছে কতিপয় উলঙ্গ নারী ও পুরুষ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী? তারা উভয়ে বলল, সামনে চলুন।
সুতরাং আমরা সম্মুখের দিকে অগ্রসর হলাম এবং একটি রক্তের নহরের দিকে এসে পৌঁছলাম। দেখলাম, তার মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং নহরের তীরে এক লোক দণ্ডায়মান। আর তার সম্মুখে রয়েছে প্রস্তরখণ্ড। নহরের ভিতরের লোকটি যখন তা হতে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে কিনারার দিকে অগ্রসর হতে চায়, তখন তীরে দাঁড়ানো লোকটি ঐ লোকটির মুখের উপর লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করে  এবং সেই লোকটিকে ঐ স্থানে ফিরিয়ে দেয় যেখানে সে ছিল। মোটকথা, লোকটি যখনই বের হয়ে আসার চেষ্টা করে, তখনই তার মুখের উপর পাথর মেরে সে যেখানে ছিল পুনরায় সেখানে ফিরিয়ে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী? সঙ্গীদ্বয় বললেন, সামনে চলুন। আমরা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে শ্যামল সুশোভিত একটি বাগানে পৌঁছলাম। বাগানে ছিল একটি বিরাট বৃক্ষ। আর উক্ত বৃক্ষটির গোড়ায় উপবিষ্ট ছিলেন একজন বৃদ্ধ লোক এবং বিপুল সংখ্যক বালক। ঐ বৃক্ষটির সন্নিকটে আরেক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, যার সম্মুখে রয়েছে আগুন, যাকে সে প্রজ্বলিত করছে। এরপর আমার সঙ্গীদ্বয় আমাকে ঐ বৃক্ষের উপরে আরোহণ করালেন এবং সেখানে তারা আমাকে বৃক্ষরাজির মাঝখানে এমন একখানা গৃহে প্রবেশ করালেন যে, এইরূপ সুন্দর ও মনোরম ঘর আমি আর কখনো দেখিনি। তার মধ্যে ছিল কতিপয় বৃদ্ধ, যুবক নারী ও বালক। অনন্তর তারা উভয়ে আমাকে সেই ঘর হতে বের করে বৃক্ষের আরও উপরে চড়ালেন এবং এমন  একটি গৃহে প্রবেশ করালেন, যা প্রথমটি হতে সমধিক সুন্দর ও উত্তম। এতেও দেখলাম, কতিপয় বৃদ্ধ ও যুবক। অনন্তর আমি উক্ত সঙ্গীদ্বয়কে বললাম, আপনারা উভয়েই তো আমাকে আজ সারা রাত্রে অনেক কিছু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন। এখন বলুন, আমি যা কিছু দেখেছি তার তাৎপর্য কি? তারা উভয়ে বলল, হ্যাঁ, (আমরা তা জানাব।)

أَمَّا الرَّجُلُ الَّذِيْ رَأَيْتَهُ يُشَقُّ شِدْقُهُ فَكَذَّابٌ يُحَدِّثُ بِالْكَذْبَةِ فَتُحْمَلُ عَنْهُ حَتَّى تَبْلُغَ الْآفَاقَ فَيُصْنَعُ بِهِ مَا تَرَى إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَالَّذِيْ رَأَيْتَهُ يُشْدَخُ رَأْسُهُ فَرَجُلٌ عَلَّمَهُ اللهُ الْقُرْآنَ فَنَامَ عَنْهُ بِاللَّيْلِ وَلَمْ يَعْمَلْ بِمَا فِيْهِ بِالنَّهَارِ يُفْعَلُ بِهِ مَا رَأَيْتَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَالَّذِيْ رَأَيْتَهُ فِي الثَّقْبِ فَهُمُ الزُّنَاةُ وَالَّذِيْ رَأَيْتَهُ فِي النَّهَرِ آكِلُ الرِّبَا وَالشَّيْخُ الَّذِيْ رَأَيْتَهُ فِيْ أَصْلِ الشَّجَرَةِ إِبْرَاهِيْمُ وَالصِّبْيَانُ حَوْلَهُ فَأَوْلَادُ النَّاسِ وَالَّذِيْ يُوْقِدُ النَّارَ مَالِكٌ خَازِنُ النَّارِ وَالدَّارُ الْأُوْلَى الَّتِيْ دَخَلْتَ دَارُ عَامَّةِ الْمُؤْمِنِيْنَ وَأَمَّا هَذِهِ الدَّارُ فَدَارُ الشُّهَدَاءِ وَأَنَا جِبْرِيْلُ وَهَذَا مِيْكَائِيْلُ فَارْفَعْ رَأْسَكَ فَرَفَعْتُ رَأْسِيْ فَإِذَا فَوْقِيْ مِثْلُ السَّحَابِ. وَفِيْ رِوَايَةٍ مِثْلُ الرَّبَابَةِ الْبَيْضَاءِ قَالَا ذَلِكَ مَنْزِلُكَ قُلْتُ دَعَانِيْ أَدْخُلْ مَنْزِلِيْ قَالَا إِنَّهُ بَقِيَ لَكَ عُمُرٌ لَمْ تَسْتَكْمِلْهُ فَلَوِ اسْتَكْمَلْتَهُ أَتَيْتَ مَنْزِلَكَ

‘ঐ যে এক ব্যক্তিকে দেখেছেন সাড়াশি দ্বারা যার গাল চিরা হচ্ছিল, সে মিথ্যাবাদী, সে মিথ্যা বলত এবং তার নিকট হতে মিথ্যা রটান হত। এমনকি, তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত। অতএব, তার সাথে ক্বিয়ামত পর্যন্ত ঐ আচরণ করা হতে থাকবে, যা করতে আপনি দেখেছেন। আর যে ব্যক্তির মস্তক পাথর মেরে ঘায়েল করতে দেখছেন, সে ঐ ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা যাকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু সে কুরআন হতে গাফেল হয়ে রাত্রে ঘুমাত এবং দিনেও তার নির্দেশ মোতাবেক আমল করত না। সুতরাং তার সাথে ক্বিয়ামত পর্যন্ত ঐ আচরণই করা হবে, যা আপনি দেখেছেন।

আর (আগুনের) তন্দুরে যাদেরকে দেখেছেন তারা হল যেনাকারী (নারী-পুরুষ)। আর ঐ ব্যক্তি যাকে (রক্তের) নহরে দেখেছেন, সে হল সূদখোর। আর ঐ বৃদ্ধ ব্যক্তি যাকে একটি বৃক্ষের গোড়ায় উপবিষ্ট দেখেছেন, তিনি হলেন ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)। তাঁর চতুস্পার্শ্বে শিশুরা হল মানুষের সন্তানাদি। আর যে লোকটিকে অগ্নিকু-ে প্রজ্জ্বলিত করতে দেখছেন, সে হল জাহান্নামের প্রহরী। আর প্রথম যে ঘরটিতে আপনি প্রথম প্রবেশ করেছিলেন, তা (জান্নাতের মধ্যে) সর্বসাধারণ মুমিনদের গৃহ। আর এই ঘর যা পরে দেখেছেন, সেটা শহীদের ঘর। আর আমি হলাম জিবরীল এবং ইনি হলেন মিকাঈল। এবার আপনি মাথাটি উপরের দিকে তুলে দেখুন। তখন আমি মাথাটি উপরের দিকে তুলে দেখলাম, যেন আমার মাথার উপরের দিকে মেঘের মত একটা জিনিস রয়েছে। অপর এক রেওয়াতে আছে, ‘একের পর এক স্তবকবিশিষ্ট সাদা মেঘের মত কোন জিনিস দেখলাম। তারা বললেন, উহা আপনার বাসস্থান। আমি বললাম, আমাকে সুযোগ দিন আমি আমার ঘরে প্রবেশ করি। তারা বললেন, এখনও আপনার হায়াত বাকী আছে, যা আপনি এখনও পূর্ণ করেননি। আপনার যখন নির্দিষ্ট হায়াত পূর্ণ হবে, তখন আপনি আপনার বাসস্থানে প্রবেশ করবেন’।[৬]

সুধী পাঠক! সূদখোরের জঘন্য শাস্তির একটি বিবৃতি উক্ত হাদীছে ফুটে উঠেছে। তাদের শাস্তি কত নোংরা তা যে কেউ ভাবলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। সূদখোরকে রক্তের নদীর মাঝ বরাবর অবস্থান করতে হবে। যেখানে সে রক্তের মধ্যে হাবুডুবু খাবে। বহু কষ্টে সাঁতরে পাড়ে উঠতে চাইলে তখন পাথরের আঘাতে মাথা চূর্ণ করা হবে। ফলে তীরে উঠার যতসব চেষ্টা ব্যর্থতায় পরিণত হবে। পরক্ষণে আবার তাকে ঠিক করে দেয়া হবে। শত চেষ্টা করে পাড়েও উঠতে পারবে না। উল্টো মাঝে মাঝে পাথর খ-ের আঘাত বোনাস হিসাবে লাভ করবে। আর সেখান থেকে ঐ ব্যক্তি মুক্তিও পাবে না। এভাবে রক্তের নদীর চুবানী চলতে থাকবে, আল্লাহ যতদিন চাইবেন।

বিত্তশালীর জমকালো আয়েশী সুখের হাতছানি অবশেষে রক্তের নদীতে গিয়ে মিশে যাবে। মাযলুম মানবতার শোষণকৃত সূদী অর্থ তাকে জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় দগ্ধিভূত করবে। তার স্বপ্ন সুখের ঘোর ভাঙবে, মালাকুল মাউতের রূহ কবযের মাধ্যমে। তখন আফসোস করা ছাড়া কী আর করার! কারণ আমলের দিন তার শেষ হয়ে গেছে, আজকের দিন হিসাবের।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র : 
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮; আবূ দাউদ, হা/১৯০৭; ইবনু মাজাহ, হা/৩০৫৫; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩৯৪৪; দারেমী, হা/১৮৫০; মিশকাত, হা/২৫৫৫।  
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৮৮২, ‘দিয়াত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৭৭৮; বায়হাক্বী, সুনানুছ ছুগরা, হা/২৯৬৪; তালখীছুল হাবীর, হা/১৬৯৬; মিশকাত, হা/১৪২।    [৩]. তিরমিযী, হা/২৮৬৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৮৩৩; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬২৩৩; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/১৮৯৫; মিশকাত, হা/৩৬৯৪, সনদ ছহীহ ।
[৪]. মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/২২৬১; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৪১০; বায়হাক্বী, হা/৫৫৩১; তাবারাণী, হা/৪৬৩; ছহীহুল জামে‘, হা/৬৭৯; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২৪০১। অত্র হাদীছের সনদকে কেউ ছহীহ বলেছেন, আবার কেউ হাসান বলেছেন।  
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/৪৩৩৯; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩০২, সনদ হাসান; মিশকাত, হা/৫১৪৩; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২৩১৬।  
[৬]. ছহীহ বুখারী, হ/১৩৮৬, ২০৮৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০১৭৭; আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৬৯৯০; আল-জামে‘ আছ-ছাগীর, হা/৫৭৭৫; মিশকাত, হা/৪৬২১; বাংলা মিশকাত, হা/৪৪১৬।  




দু‘আ ও যিকর : আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১০ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৮তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : মুহাম্মদ ইমরান বিন ইদরিস
হজ্জ ও ওমরার সঠিক পদ্ধতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ক্রোধের ভয়াবহতা ও তার শারঈ চিকিৎসা (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ব্যভিচার ও ধর্ষণ: সমাধান কোন্ পথে
বিদ‘আত পরিচিতি (১২তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (১১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৩য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
হাদীছ বর্ণনায় আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অবদান - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৮ম কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

ফেসবুক পেজ