ইসলামের দৃষ্টিতে প্রেম ও ভালোবাসা
-আব্দুল গাফফার মাদানী*
প্রেম মানুষের অন্তরের একটি বিশেষ অবস্থার নাম, যা কারো প্রতি আবেগ, গভীর অনুভূতির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়। প্রকৃত প্রেম হল মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রেম, যা ছাড়া কোন মানুষ ঈমানদার হতে পারে না। দুনিয়ায় কেউ কাউকে ভালোবাসলে একমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালোবাসবে। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানসহ আত্মা ও রক্তের আত্মীয়দের প্রতি প্রেমও মহান আল্লাহ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, সওয়াবের আশায় কোন মুসলিম যখন তার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করে, তা তার ছাদাক্বাহ হিসাবে গণ্য হয়।[১]
কিন্তু বর্তমানে প্রেম বলতে যা প্রচলিত হয়ে গেছে, তা নিছক একটি অবৈধ সম্পর্ক। যে সম্পর্ক মানুষকে পাপের অতল সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়। এ এমন এক মরীচিকা, যা তাকে আল্লাহর রহমত থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। এই মোহ তাকে দিন দিন আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত করে শয়তানের পূজায় ব্যস্ত করে দেয়।
ইতালির পিজায় একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম প্রেম সত্যি ব্যক্তির ভাবনার পরিবর্তন ঘটায়। পিজা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডোনাটেলা মারাজ্জিতি ২০ জন সদ্য প্রেমে পড়া যুগলের ওপর একটি গবেষণা চালান। এই গবেষণায় তিনি যাদের সম্পর্কের বয়স ছয় মাসেরও কম, তাদের আহ্বান জানান। গবেষণায় তিনি দেখতে চেয়েছেন যে, সারাক্ষণ ভালোবাসার মানুষটির কথা ভাবার ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কেমন হতে পারে। গবেষণায় মারাজ্জিতি ছেলে-মেয়েদের রক্ত পরীক্ষা করে দেখেছেন সদ্য প্রেমে পড়া তরুণ-তরুণীদের ও নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির রক্তের সেরোটোনিনের পরিমাণ একই মাত্রায় রয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُلۡہِکُمۡ اَمۡوَالُکُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُکُمۡ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰہِ ۚ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। আর যারা এরূপ করে, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত’ (সূরা আল-মুনাফিকুন : ৯)।
আয়াতে যাদের ভালোবাসা জায়েয ও ইবাদত, তাদের ব্যাপারে বলা হচ্ছে যে, তারা যেন আমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। তাহলে যে সম্পর্কগুলো মহান আল্লাহ হারাম করেছেন, সেই সম্পর্ক যদি কাউকে আল্লাহর জিকির থেকে গাফেল করে দেয়, তবে তা কতটা জঘন্য হবে? আল্লাহ হেফাজত করুন।
সাইকোলজিস্ট রবার্ট স্টেনবার্গ ভালোবাসাকে তিনটি উপাদানের মধ্যে ভাগ করেছেন। সেই উপাদান তিনটিকে একটি ত্রিভুজের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। সেই তিনটি উপাদানের মধ্যে অন্যতম হল আবেগ (যৌন অথবা রোমান্টিক আকর্ষণ)। যেই আকর্ষণ মানুষকে ব্যভিচারের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا تَقۡرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّہٗ کَانَ فَاحِشَۃً ؕ وَ سَآءَ سَبِیۡلًا ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৩২)।
তাই কাউকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যেও তার সঙ্গে বিবাহপূর্ব প্রেম বা ‘লিভ টুগেদার’ নামে যে অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে, তা করার কোনো অবকাশ নেই। প্রশ্ন জাগতে পারে, অনেকের ক্ষেত্রে তা হয়ত শারীরিক সম্পর্কে না-ও গড়াতে পারে, সে ক্ষেত্রেও কি তা হারাম হবে? এর উত্তর খোঁজার জন্য এই হাদীছগুলোতে চোখ বুলানো যেতে পারে।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِنَّ اللهَ كَتَبَ عَلَى ابْنِ آدَمَ حَظَّهُ مِنَ الزِّنَا أَدْرَكَ ذَلِكَ لَا مَحَالَةَ فَزِنَا الْعَيْنِ النَّظَرُ وَزِنَا اللِّسَانِ الْمَنْطِقُ وَالنَّفْسُ تَمَنَّىْ وَتَشْتَهِىْ وَالْفَرْجُ يُصَدِّقُ ذَلِكَ كُلَّهُ وَيُكَذِّبُهُ. وَفِي رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ- قَالَ ﷺ كُتِبَ عَلَىْ ابْنِ آدَمَ نَصِيْبُهُ مِنَ الزِّنَا مُدْرِكٌ ذَلِكَ لَا محَالَةَ فَالْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظَرُ وَالْأُذُنَانِ زِنَاهُمَا الْاِسْتِمَاعُ وَاللِّسَانُ زِنَاهُ الْكَلَامُ وَالْيَدُ زِنَاهَا الْبَطْشُ وَالرِّجْلُ زِنَاهَا الْخُطَا وَالْقَلْبُ يَهْوَىْ وَيَتَمَنَّىْ وَيُصَدِّقُ ذَلِكَ الْفَرْجُ وَيُكَذِّبُهُ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা আদম সন্তানের জন্য ব্যভিচারের অংশ নির্ধারণ করে রেখেছেন। যা সে অবশ্যই লাভ করে থাকে, এতে কোন সন্দেহ নেই। চোখের যেনা দেখা, জিহ্বার যেনা কথা বলা এবং অন্তরের যেনা আকাক্সক্ষা করা ও কামনা করা। অতঃপর গুপ্তাঙ্গ সেটাকে সত্য বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।[২]
আল্লামা খাত্তাবী (রাহিমাহুল্লাহ) এ হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘দেখা ও কথা বলাকে যিনা বলার কারণ এই যে, দু’টোই হচ্ছে প্রকৃত যিনার ভূমিকা- যিনার মূল কাজের পূর্ববর্তী স্তর। কেননা দৃষ্টি হচ্ছে মনের গোপন জগতের উদ্বোধক আর জিহবা হচ্ছে বাণী বাহক, যৌনাঙ্গ হচ্ছে বাস্তবায়নের হাতিয়ার- সত্য প্রমাণকারী’।[৩]
হাফিয আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘দৃষ্টিই হয় যৌন লালসা উদ্বোধক, পয়গাম বাহক। কাজেই এ দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ মূলত যৌন অঙ্গেরই সংরক্ষণ। যে ব্যক্তি দৃষ্টিকে অবাধ, উন্মুক্ত ও সর্বগামী করে সে নিজেকে নৈতিক পতন ও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। মানুষ নৈতিকতার ক্ষেত্রে যত বিপদ ও পদস্খলনেই নিপতিত হয়, দৃষ্টিই হচ্ছে তার সর্ব কিছুর মূল কারণ। কেননা দৃষ্টি প্রথমত আকর্ষণ জাগায়, আকর্ষণ মানুষকে চিন্তা-বিভ্রমে নিমজ্জিত করে, আর এ চিন্তাই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে লালসার উত্তেজনা। এ যৌন উত্তেজনা ইচ্ছা শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে, আর ইচ্ছা ও প্রবৃত্তি শক্তিশালী হয়ে দৃঢ় সংকল্পে পরিণত হয়। এ দৃঢ় সংকল্প অধিকতর শক্তি অর্জন করে বাস্তবে ঘটনা সংঘটিত করে। বাস্তবে যখন কোন বাধাই থাকে না, তখন এ বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন না হয়ে কারো কোন উপায় থাকে না’।[৪]
দৃষ্টি চালনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ। রাসূল কারীম (ﷺ) বলেছেন, غَضُّوْا أَبْصَارَكُمْ وَاحْفَظُوْا فُرُوْجَكُمْ ‘তোমাদের দৃষ্টিকে নীচু কর এবং তোমাদের লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ করো’।[৫]
এ দু’টো যেমন আলাদা আলাদা নির্দেশ, তেমনি প্রথমটির অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে শেষেরটি অর্থাৎ দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত হলেই লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ সম্ভব। অন্যথা তাকে চরম নৈতিক অধঃপতনে নিমজ্জিত হতে হবে নিঃসন্দেহে। নবী কারীম (ﷺ) আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,يَا عَلِيُّ لَا تُتْبِعِ النَّظْرَةَ النَّظْرَةَ فَإِنَّ لَكَ الْأُولَى وَلَيْسَتْ لَكَ الْآخِرَةُ ‘হে আলী! কোন নারীর প্রতি আকস্মিক একবার দৃষ্টিপাতের পর আবার দৃষ্টিপাত করো না। কেননা তোমার জন্য প্রথমবারের অনুমতি আছে এবং দ্বিতীয়বারের অনুমতি নেই’।[৬]
উম্মে সালামা বর্ণিত এক হাদীছের ভিত্তিতে আল্লামা শাওকানী বলেছেন, يحرم على المرأة نظر الرجل كما يحرم على الرجل نظر المرأة ‘পুরুষদেরকে দেখা মেয়েদের জন্য হারাম, ঠিক যেমন হারাম পুরুষদের জন্য মেয়েদের দেখা’।[৭] এর কারণস্বরূপ তিনি লিখেছেন,
ولأن النساء أحد نوعي الآدميين فحرم عليهن النظر إلى النوع الآخر قياسا على الرجال ويحققه أن المعنى المحرم للنظر هو خوف الفتنة وهذا في المرأة أبلغ فإنها اشد شهوة وأقل عقلا فتسارع إليها الفتنة أكثر من الرجل
‘কেননা মেয়েলোক মানব জাতিরই অন্তর্ভুক্ত প্রজাতি। এজন্য পুরুষের মতই মেয়েদের জন্য তারই মত অপর প্রজাতি পুরুষদের দেখা হারাম করা হয়েছে। এ কথার যথার্থতা বোঝা যায় এ দিক দিয়েও যে, গায়র-মুহাররমের প্রতি তাকানো হারাম হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে যৌন বিপর্যয়ের ভয়। আর মেয়েদের ব্যাপারে এ ভয় অনেক বেশি। কেননা যৌন উত্তেজনা যেমন মেয়েদের বেশি, সে পরিমাণে বুদ্ধিমত্তা তাদের কম। আর পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের কারণেই অধিক যৌন বিপর্যয় ঘটে থাকে’।[৮]
অন্য হাদীছে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুই চোখের যেনা দেখা। দুই কানের যেনা শোনা। জিহ্বার যেনা কথা বলা। হাতের যেনা ধরা। পায়ের যেনা চলা এবং অন্তরের যেনা আকাক্সক্ষা করা ও কামনা করা। সবশেষে গুপ্তাঙ্গ সেটাকে সত্য অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে’।[৯]
ইসলামে যিনার নিকট যাওয়াই হারাম অর্থাৎ যেসকল জিনিস জিনার নিকটবর্তী করে দেয় তার কাছে যাওয়াই হারাম। ইসলাম মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে মনোনীত শ্রেষ্ঠ দ্বীন। কিন্তু এখনকার তথাকথিত অধুনা সমাজে তরুণ-তরুণীদের দ্বীনে ফেরার পথে সবচেয়ে বড় যে প্রতিবন্ধকতা, সেটা হল- হারাম সম্পর্ক। এমন অনেকেই আছে যারা হয়তো পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত পড়ে, রামাযানে ছিয়াম রাখে, দ্বীনের ব্যাপারেও খুব আগ্রহী। কিন্তু একটা জায়গায় এসে আটকে গেছে তাহল হারাম সম্পর্ক।
নবী-রাসূলগণের সময় থেকে এখন পর্যন্ত ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ বহির্ভূত তথাকথিত রিলেশনশিপ বা প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ হারাম। একে অপরের সঙ্গে কামনা-বাসনা সহকারে কথাবার্তা, নির্জনে দেখা-সাক্ষাৎ, ডেটিং, চ্যাটিং, স্পর্শ, হাসাহাসি, দুষ্টুমি সবই ইসলামে নিষিদ্ধ। এসব রিলেশনশিপ মূলত শয়তানের ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে নারী-পুরুষ উভয়ে যেনার দিকে ধাবিত হয়, যার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি বিনিময়েও রয়েছে সুস্পষ্ট হুকুম। এ প্রসঙ্গে কুরআনে পাকে আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেছেন। পুরুষদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন, قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِہِمۡ وَ یَحۡفَظُوۡا فُرُوۡجَہُمۡ ؕ ذٰلِکَ اَزۡکٰی لَہُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ ‘(হে রাসূল! আপনি) মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা‘আলা সে ব্যাপারে খবর রাখেন’ (সূরা আন-নূর : ৩০)। আবার নারীদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘(হে রাসূল! আপনি) ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। সাধারণত প্রকাশমান ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বুকের ওপরে ফেলে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, বাবা, শ্বশুর, ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও (এমন) বালক- যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত অন্য কারো সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। (এমনকি) তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তাওবা কর; যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (সূরা আন-নূর : ৩১)।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে যেনার নিকটবর্তী হতেও নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর যেনার কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৩২)। তবে দয়াময় আল্লাহ বৈধ উপায়ে বিয়ের মাধ্যমে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ ও জৈবিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ দিয়েছেন। সুতরাং মানুষের কর্তব্য, বিয়ের পূর্বে হারাম সম্পর্কের দিকে পা না বাড়িয়ে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিয়ে করা। কেননা হারাম রিলেশন (অবৈধ প্রেম) কাবীরা গুনাহের কারণ। সুতরাং যারা হারাম ভালোবাসায় লিপ্ত হয়েছে তাদের জন্য করণীয় হল, অনতিবিলম্বে তওবা করে এ পথ থেকে ফিরে আসা। আল্লাহ আমাদেরকে পাপাচার থেকে তওবায়ে নাসূহা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا تُوۡبُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ تَوۡبَۃً نَّصُوۡحًا ؕ عَسٰی رَبُّکُمۡ اَنۡ یُّکَفِّرَ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَ یُدۡخِلَکُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে আন্তরিক তওবা করো। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত’ (সূরা আত-তাহরীম : ৮)।
তওবায়ে নাসূহা অর্থ খাঁটি, নির্ভেজাল, একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ তওবা। অর্থাৎ এমন আন্তরিকতা ও দৃঢ় প্রত্যয় সহকারে তওবা করা যে, তওবাকারী আর কখনো জেনে-বুঝে ওই গুনাহে লিপ্ত হবে না। কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা হল, মুসলিম নারী-পুরুষ উভয়ে অবৈধ সংস্পর্শ, কথা-বার্তা ও দেখা-সাক্ষাৎ, আসক্তি ও সাজ-সজ্জা থেকে বেঁচে থাকবে। নিজেদের দ্বীন ও আত্মসম্মান রক্ষা করবে।
সুতরাং প্রিয় নবী (ﷺ)-এর সেই ছোট হাদীছটির ওপর আমল করা যরূরী, যার বাস্তবায়নে তিনি মুসলিম উম্মাহকে দিয়েছেন জান্নাতের গ্যারান্টি। তিনি বলেছেন,مَنْ يَضْمَنْ لِيْ مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি নিজের জিহ্বা ও লজ্জাস্থান হেফাযত করবে; আমি তার জান্নাতের জিম্মাদার হব’।[১০]
আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহর নারী-পুরুষ উভয়কে অবৈধ আসক্তি, সম্পর্ক, দেখা-সাক্ষাৎ, কথা-বার্তা ও যৌন লালসা থেকে মুক্ত থাকার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে, তাহলে সে যেন বিয়ে করে। কেননা বিয়ে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন ছিয়াম পালন করে। কেননা ছিয়াম হচ্ছে যৌবনকে দমন করার মাধ্যম।[১১]
হাদীছে ‘যুব সম্প্রদায়’ কাদের বলা হয়েছে, এ সম্পর্কে ইমাম নববী বলেছেন, ‘আমাদের লোকেদের মতে যুবক-যুবতী বলতে তাদেরকে বোঝানো হয়েছে যারা বালেগ [পূর্ণ বয়স্ক] হয়েছে এবং ত্রিশ বছর বয়স পার হয়ে যায়নি।
আর এ যুবক-যুবতীদের বিয়ের জন্য রাসূল (ﷺ) তাকীদ করলেন কেন, তার কারণ সম্পর্কে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তার বিশ্ববিখ্যাত বুখারীর ভাষ্য গ্রন্থ ‘উমদাতুল ক্বারী’ গ্রন্থে লিখেছেন, হাদীছে কেবল যুবক-যুবতীদের বিয়ে করতে বলার কারণ এই যে, বুড়োদের অপেক্ষা এ বয়সের লোকেদের মধ্যেই বিয়ে করার প্রবণতা ও চাহিদা অনেক বেশি দেখা যায়। যুবক-যুবতীদের বিয়ে যৌন সম্ভোগের পক্ষে খুবই স্বাদপূর্ণ হয়। মুখের গন্ধ খুবই মিষ্টি হয়, দাম্পত্য জীবন যাপন খুবই সুখকর হয়, পারস্পরিক কথাবার্তা খুব আনন্দদায়ক হয়, দেখতে খুবই সৌন্দর্যম-িত হয়, স্পর্শ খুব আরামদায়ক হয় এবং স্বামী বা স্ত্রী তার জুড়ির চরিত্রে এমন কতগুলো গুণ সৃষ্টি করতে পারে যা খুবই পসন্দনীয় হয়। আর এ বয়সের দাম্পত্য ব্যাপার প্রায়ই গোপন রাখা ভালো লাগে। যুবক বয়স যেহেতু যৌন সম্ভোগের জন্য মানুষকে উন্মুখ করে দেয়। এ কারণে তার দৃষ্টি যে কোন মেয়ের দিকে আকৃষ্ট হতে পারে এবং সে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতায় পড়ে যেতে পারে। এজন্য রাসূল (ﷺ) এ বয়সের ছেলে-মেয়েকে বিয়ে করতে তাকীদ করেছেন এবং বলেছেন, বিয়ে করলে চোখ যৌন সুখের সন্ধানে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবে না এবং বাহ্যত তার কোন ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। এ কারণে রাসূল (ﷺ) যদিও কথা শুরু করেছেন যুবক মাত্রকেই সম্বোধন করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ের এ তাকীদকে নির্দিষ্ট করেছেন কেবল এমন সব যুবক-যুবতীদের জন্য যাদের বিয়ের সামর্থ্য আছে। আর যারা বিয়ের ব্যয় বহনের সক্ষমতা রাখে না তারা ছিয়াম পালন করবে। ছিয়াম পালন তাদের যৌন উত্তেজনা দমন করবে। নবী (ﷺ) বৈবাহিক জীবনযাপনের প্রতি উৎসাহ দিয়ে বলেছেন,
النِّكَاحُ مِنْ سُنَّتِىْ فَمَنْ لَمْ يَعْمَلْ بِسُنَّتِىْ فَلَيْسَ مِنِّىْ وَتَزَوَّجُوْا فَإِنِّىْ مُكَاثِرٌ بِكُمُ الأُمَمَ وَمَنْ كَانَ ذَا طَوْلٍ فَلْيَنْكِحْ وَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَعَلَيْهِ بِالصِّيَامِ فَإِنَّ الصَّوْمَ لَهُ وِجَاءٌ
‘বিবাহ করা আমার সুন্নাত। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত অনুযায়ী আমল করবে না, সে আমার উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং তোমরা বিবাহ কর। কেননা ক্বিয়ামতের দিন আমি আমার উম্মাতের সংখ্যাধিক্য নিয়ে অন্যান্য উম্মাতের উপর গর্ব করব। যে ব্যক্তি বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিবাহ করে। আর যে ব্যক্তি বিবাহ করার সামর্থ্য না রাখে, সে যেন ছিয়াম রাখে। কেননা ছিয়াম হচ্ছে যৌন শক্তিকে নিয়ন্ত্রনকারী’।[১২]
সাহল ইবনু সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা এক মহিলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি আমার নিজেকে আপনার জন্য উপহার দিতে এসেছি (পরোক্ষ ভাষায় বিয়ের প্রস্তাব)। তখন নবী (ﷺ) তার দিকে তাকিয়ে তার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে মাথা নিচু করলেন। মহিলাটি যখন দেখল যে, নবী (ﷺ) কোন ফয়সালা দিচ্ছেন না, তখন সে বসে পড়ল। এমন সময় রাসূল (ﷺ)-এর ছাহাবীদের একজন বলল, যদি আপনার কোন প্রয়োজন না থাকে, তবে এ মহিলাটির সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দিন। তিনি বললেন, তোমার কাছে কি কিছু আছে? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আল্লাহর কসম কিছুই নেই। তিনি বললেন, তুমি তোমার পরিবারের কাছে ফিরে যাও এবং দেখ কিছু পাও কি না? এরপর লোকটি চলে গেল এবং ফিরে এসে বলল, আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি কিছুই পেলাম না। নবী (ﷺ) বললেন, দেখ, একটি লোহার আংটি হলেও! তারপর সে চলে গেল এবং ফিরে এসে বলল, আল্লাহর কসম! একটি লোহার আংটিও পেলাম না। কিন্তু এই যে আমার লুঙ্গি আছে। সাহল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, তার কোন চাদর ছিল না। অথচ লোকটি বলল, এটাই আমার পরনের লুঙ্গি; এর অর্ধেক দিতে পারি। এ কথা শুনে রাসূল (ﷺ) বললেন, তোমার লুঙ্গি দিয়ে সে কী করবে? তুমি পরিধান করলে তার গায়ে কোন কিছু থাকবে না। আর সে পরিধান করলে তোমার গায়ে কোন কিছু থাকবে না। তখন লোকটি বসে পড়ল এবং অনেকক্ষণ সে বসেছিল। তারপর উঠে গেল। রাসূল (ﷺ) তাকে ফিরে যেতে দেখে ডেকে আনলেন। যখন সে ফিরে আসল, নবী (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কতটুকু কুরআন মুখস্থ আছে? সে হিসাব করে বলল, অমুক অমুক সূরা মুখস্থ আছে। তখন নবী (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এ সকল সূরা মুখস্থ তেলাওয়াত করতে পার? সে বলল, হ্যাঁ! তখন নবী (ﷺ) বললেন, যাও তুমি যে পরিমাণ কুরআন মুখস্থ করেছ এর বিনিময়ে এ মহিলার সাথে তোমার বিবাহ দিলাম।[১৩]
ইবনু মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর হাদীছে সাধারণভাবে সকল যুবক বিয়েতে আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান উদ্ধৃত হয়েছে; এ কথা বর্ণনা করার জন্য যে, বিয়ের জন্য খরচের সামর্থ্য থাকা ও যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয়; যাতে করে স্বামী তার স্ত্রীর ভরণ-পোষণ ও বাসস্থানের ফরয দায়িত্ব পালন করতে পারে। হাদীছটি এ প্রমাণও বহন করে যে, যে ব্যক্তি বিয়ে করতে অপারগ তার জন্য ছিয়াম রাখায় মশগুল থাকার বিধান রয়েছে। কেননা ছিয়াম যৌন উত্তেজনাকে দুর্বল করে এবং শয়তানের চলাচলকে সঙ্কুচিত করে। তাই ছিয়াম হচ্ছে- চরিত্র ঠিক রাখা ও দৃষ্টিকে অবনত রাখার মাধ্যম।[১৪]
নবী (ﷺ)-এর বাণী, ‘তোমাদের মধ্যে যারা সামর্থ্য রাখ তাদের উচিত বিয়ে করে ফেলা’ এতে দলীলও রয়েছে, যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে ও বিয়ের খরচাদি বহন করার ক্ষমতা আছে, তার জন্য অবিলম্বে বিয়ে করাটাই শরী‘আতের বিধান। সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া বোর্ডের আলেমগণ বলেন, ‘বিয়ের খরচাদি বহন ও স্ত্রীর অধিকার আদায়ে সক্ষম যুবকের অবিলম্বে বিয়ে করাই রাসূলের সুন্নত’।[১৫]
হাদীছটি বিশেষ একটি ঘটনাকেন্দ্রিক এবং দরিদ্র এক ব্যক্তির বিয়ে করা ও চরিত্র রক্ষা করা সংক্রান্ত। নবী (ﷺ) তাকে ঐ নারীর সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, যে নারী নিজেকে নবী (ﷺ)-এর প্রতি উপহার হিসাবে পেশ করেছিলেন। এ হাদীছে দলীল রয়েছে যে, দরিদ্রতা সত্তাগতভাবে বিবাহকে বাধা দেয় না; যদি পাত্র দ্বীনদার হয় এবং নিজ প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাসী হয় এবং পাত্রীও সে রকম হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اَنۡکِحُوا الۡاَیَامٰی مِنۡکُمۡ وَ الصّٰلِحِیۡنَ مِنۡ عِبَادِکُمۡ وَ اِمَآئِکُمۡ ؕ اِنۡ یَّکُوۡنُوۡا فُقَرَآءَ یُغۡنِہِمُ اللّٰہُ مِنۡ فَضۡلِہٖ ؕ وَ اللّٰہُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ
‘তোমাদের মধ্যে যাদের স্বামী বা স্ত্রী নেই তাদের বিয়ের ব্যবস্থা কর, তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ ও যোগ্য তাদেরও। তারা যদি দরিদ্র হয় তাহলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ মহা দানশীল, মহাজ্ঞানী’ (সূরা আন-নূর : ৩২)।
সুতরাং আল্লাহর উপর যথাযথ তাওয়াক্কুল, চরিত্র রক্ষার আকাঙ্ক্ষা, তাঁর অনুগ্রহ প্রত্যাশা থাকলে আশা করা যায় এমন দম্পতিকে আল্লাহ সাহায্য করবেন এবং তাঁর অনুগ্রহ থেকে রিযিক দিবেন।
ইসলামের মধ্যে সবচেয়ে নিবিড় বন্ধন একটাই, সেটা হল বিয়ের বন্ধন। বিয়ের বন্ধনে প্রেম-ভালোবাসা সবই আছে। বিয়ের আগে প্রেম করাটা ইসলামে নিষিদ্ধ। এমনকি ইসলামের বিধিবিধান অনুসারে বিয়ের আগে প্রেম-ভালোবাসা হারাম। কারণ এ ধরনের সম্পর্ক একজন মুসলিমের জন্য ঈমানী, চারিত্রিক, সামাজিক ইত্যাদি দিক থেকে ক্ষতিকর। আর এ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে মহান আল্লাহ বলেন, وَ یُحِلُّ لَہُمُ الطَّیِّبٰتِ وَ یُحَرِّمُ عَلَیۡہِمُ الۡخَبٰٓئِثَ ‘তিনি তাদের জন্য হালাল করে দেন পবিত্র ও উত্তম বস্তু, আর হারাম করে দেন অপবিত্র ও ক্ষতিকর বস্তু’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৫৭)। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
ثَلَاثَةٌ حَقٌّ عَلَى اللهِ عَوْنُهُمْ الْمُكَاتَبُ الَّذِي يُرِيدُ الْأَدَاءَ وَالنَّاكِحُ الَّذِي يُرِيدُ الْعَفَافَ وَالْمُجَاهِدُ فِي سَبِيْلِ اللهِ
‘তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহ্র হক্ব। ১. ‘মুকাতাব’ যে দাস তার মুক্তিপণ আদায় করতে চায় ২. বিবাহকারী, যে চরিত্রকে রক্ষা করতে চায় এবং ৩. আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদকারী অর্থাৎ মুজাহিদ।[১৬]
ইমাম বুখারী এ হাদীছটির শিরোনাম দিয়েছেন এই বলে,باب: تزويج المعسر، لقوله تعالى: " اِنۡ یَّکُوۡنُوۡا فُقَرَآءَ یُغۡنِہِمُ اللّٰہُ مِنۡ فَضۡلِہٖ " ‘অভাবীকে বিয়ে দেয়া’। দলীল হচ্ছে, আল্লাহ্র বাণী : ‘তারা যদি দরিদ্র হয় তাহলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন’ (সূরা আন-নূর : ৩২)।
হাফেয ইবনু হাযার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তিনি যে শিরোনাম দিয়েছেন সেটার পক্ষে দলীল হিসাবে আল্লাহর বাণী : ‘তারা যদি দরিদ্র হয় তাহলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন’-এর সারকথা হচ্ছে- বর্তমানে কারো দরিদ্র অবস্থা তার কাছে বিয়ে দেয়ার পথে বাধা নয়; যেহেতু ভবিষ্যতে তার সম্পদ অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে।
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘আল্লাহ তাদেরকে বিয়ে দেয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তিনি স্বাধীন ও দাস সবাইকে বিয়ে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন এবং তাদেরকে স্বাবলম্বী করে দেয়ার ওয়াদা করেছেন’। ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘তোমরা বিয়ে করার মাধ্যমে স্বাবলম্বন সন্ধান কর’।[১৭]
শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ আয়াতে কারীমাতে আল্লাহ তা‘আলা যাদের স্বামী বা স্ত্রী নেই তাদেরকে ও সৎ, যোগ্য দাস-দাসীদের বিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন যে, এটি গরীবদের সচ্ছলতার মাধ্যম, যাতে করে পাত্রী ও পাত্রীর অভিভাবকগণ নিশ্চিন্ত হতে পারে যে, দারিদ্রতা বিয়ের পথে বাধা হওয়া অনুচিত। বরং বিয়ে রিযিক হাছিল ও স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যম’।[১৮]
এ কারণে সামর্থ্যবানকে বিয়ে করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার অর্থ এ নয় যে, সামর্থ্যহীনকে বিয়ে করতে বারণ করা; বিশেষত কেউ যদি নিজের ব্যাপারে হারামে লিপ্ত হওয়ার আশংকা করে। অনুরূপভাবে সামর্থ্যহীনকে যৌন উত্তেজনা দমিয়ে রাখা ও শান্ত করার জন্য ছিয়াম রাখার দিক-নির্দেশনা দেয়ার মধ্যেও বিয়ে করার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। হতে পারে সে এমন কাউকে পাবে যে তাকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। হতে পারে সে এমন কোন পাত্রীকে পাবে যে পাত্রী তার দ্বীনদারি ও সৎ হওয়ার কারণে তার আর্থিক অবস্থাকে মেনে নেবে। এগুলো ব্যক্তিগত ব্যাপার। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, এক প্রথা থেকে অপর প্রথাতে পার্থক্য হয়। পক্ষান্তরে, ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর হাদীছে যা উদ্ধৃত হয়েছে সেটা হচ্ছে সাধারণ একটা শিষ্টাচার এবং সামর্থ্যহীনকে ছিয়াম রাখার মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা করার পরামর্শ। আর তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বিয়ে করার কোন উপায় পায় তাতে কোন অসুবিধা নেই। বরং তাকে বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহ ও উদ্বুদ্ধ করা হবে। ঠিক এ কারণে নবী (ﷺ) বলেছেন, ‘আর যার সামর্থ্য নেই’ তার ক্ষেত্রে তিনি এ কথা বলেননি যে, ‘তার উচিত বিয়ে না করা’। বরং তিনি বলেছেন, ‘তার উচিত ছিয়াম রাখা’; যাতে করে সে গুনাহতে লিপ্ত না হয়। আর যদি কিছু কষ্ট-ক্লেশ করে হলেও সে বিয়ে করতে পারে নিঃসন্দেহে তাতে কোন অসুবিধা নেই। কারণ ছিয়ামকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে একেবারে অপারগতার ক্ষেত্রে। যদি কিছু কষ্ট করে হলেও বিয়ে করতে পারে তাহলে সেটাই ভাল। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ইসলামের সঠিক বুঝ দান করুন-আমীন!!
* মুহাদ্দিছ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০০২।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৪৩, ‘অনুমতি’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫৭, ‘তাক্বদীর’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫ ।
[৩]. মা‘আলিমুস সুনান, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২২৩।
[৪]. আল-জাওয়াব আল-কাফী, পৃ. ২০৪।
[৫]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৪০৪৬, সনদ ছহীহ।
[৬]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩০৪১; তিরমিযী, হা/২৭৭৭; আবূ দাঊদ, হা/২১৪৯; দারেমী, হা/২৭০৯, সনদ হাসান।
[৭]. নাইলুল আওত্বার, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৭৭।
[৮]. প্রাগুক্ত।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৪৩, ‘অনুমতি’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫৭, ‘তাক্বদীর’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫ ।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৭৪।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৫, ৫০৬৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪০০।
[১২]. ইবনু মাজাহ, হা/১৮৪৬, সনদ ছহীহ।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৫, ৫০৬৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪০০।
[১৪]. মাজমূঊ ফাতাওয়া বিন বায, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩২৯।
[১৫]. ফাতাওয়া লাজনাহ আদ-দায়িমা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৮।
[১৬]. তিরমিযী, হা/১৬৫৫; নাসাঈ, হা/৩১২০; ইবনু মাজাহ, হা/২৫১৮, সনদ হাসান।
[১৭]. তাফসির ইবনে কাছির, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৫১।
[১৮]. ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২১৩।