কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আলো ও অন্ধকার
-মূল : ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহত্বানী
-অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন*
(২য় কিস্তি)
দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
اَوۡ کَصَیِّبٍ مِّنَ السَّمَآءِ فِیۡہِ ظُلُمٰتٌ وَّ رَعۡدٌ وَّ بَرۡقٌ ۚ یَجۡعَلُوۡنَ اَصَابِعَہُمۡ فِیۡۤ اٰذَانِہِمۡ مِّنَ الصَّوَاعِقِ حَذَرَ الۡمَوۡتِ ؕ وَ اللّٰہُ مُحِیۡطٌۢ بِالۡکٰفِرِیۡنَ-یَکَادُ الۡبَرۡقُ یَخۡطَفُ اَبۡصَارَہُمۡ ؕ کُلَّمَاۤ اَضَآءَ لَہُمۡ مَّشَوۡا فِیۡہِ ٭ۙ وَ اِذَاۤ اَظۡلَمَ عَلَیۡہِمۡ قَامُوۡا ؕ وَ لَوۡ شَآءَ اللّٰہُ لَذَہَبَ بِسَمۡعِہِمۡ وَ اَبۡصَارِہِمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ
‘অথবা আকাশ হতে বারি বর্ষণের ন্যায় যাতে অন্ধকার, গর্জন ও বিদ্যুৎ রয়েছে, তারা বজ্রধ্বনিবশতঃ মৃত্যুর ভয়ে তাদের কর্ণসমূহে নিজেদের অঙ্গুলী গুজে দেয়, এবং আল্লাহ অবিশ^াসীদের পরিবেষ্টকারী’। অচিরে বিদ্যুৎ তাদের দৃষ্টিহরণ করবে, যখন তাদের প্রতি আলোক প্রদীপ্ত হয় তখন তারা চলতে থাকে এবং যখন তাদের উপর অন্ধকার আসন্ন হয়, তখন তারা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এবং যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন-নিশ্চয়ই তাদের শ্রবণশক্তি ও তাদের দৃষ্টিশক্তিহরণ করতে পারেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান’ (সূরা বাক্বারাহ : ১৯-২০)।
এটি আরেকটি উদাহরণ; যেটা আল্লাহ মুনাফিক্বদের জন্য দিয়েছেন। অর্থাৎ, তুমি চাইলে তাদের উদাহরণ অগ্নিপ্রজ্জ্বলনকারীর সাথে দিতে পার। আবার চাইলে আকাশ হতে যমীনে বৃষ্টিবর্ষণকারী মেঘের সাথেও দিতে পারো। এখানে أو অব্যয়টি واو এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ وَ کَصَیِّبٍ مِّنَ السَّمَآءِ فِیۡہِ ظُلُمٰتٌ ‘আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণকারী মেঘের মত; যাতে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার অন্ধকার। মেঘ, রাত্রি, বৃষ্টি ইত্যাদির অন্ধকার। وَّ رَعۡدٌ ‘মেঘের গর্জন’। وَّ بَرۡقٌ ‘বিদ্যুৎ চমকানো-বিজলী’। کُلَّمَاۤ اَضَآءَ لَہُمۡ مَّشَوۡا فِیۡہِ ‘যখন তাদের প্রতি আলোক প্রদীপ্ত হয় তখন তারা চলতে থাকে’।
وَ اِذَاۤ اَظۡلَمَ عَلَیۡہِمۡ قَامُوۡا ‘আর যখন তাদের উপর অন্ধকার আচ্ছন্ন হয় তখন তারা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে’।[১]
আল্লাহ তা‘আলা তাদের কুফর এবং নিফাক্বির সাদৃশ্য দিয়েছেন একটি দলের সাথে; যারা ঘনকালো নিশিতে একটি নির্জন মরু প্রান্তরে তাঁবু সেটে আছে। তাদেরকে পেয়ে বসেছে অন্ধকারে ভরপুর বৃষ্টি। অবস্থা এমন যে, অন্ধকারের কারণে পথচারী ব্যক্তি হাঁটতে পারছে না। ভীতিকর বজ্রধ্বনির কারণে তারা তাদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে আছে। বিদ্যুৎচমকের কারণে তাদের দৃষ্টিশক্তি চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিজলীর অতিরিক্ত আলোর কারণে তাদের চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ এ উদাহরণটিই পেশ করেছেন এবং কুরআনের সাথে কাফির, মুনাফিক্বদের আচরণ তুলে ধরেছেন।
অতএব, এখানে المطر বৃষ্টি দ্বারা উদ্দেশ্য কুরআন। কারণ, কুরআন হলো অন্তরের প্রাণ। যেভাবে বৃষ্টি হলো শরীরের প্রাণ। الظلمات অন্ধকারসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য কুফর ও শিরক। কুরআন এ থেকে সতর্ক করেছে। الرعد এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, যার মাধ্যমে শাস্তি হতে সতর্ক করা হয় এবং জাহান্নামের স্মরণ। আর البرق হলো, যাতে রয়েছে হেদায়াতের বর্ণনা, ওয়াদা, জান্নাতের স্মরণ ইত্যাদি। কুরআন পাঠের সময় মুনাফিক্বরা তাদের কান বন্ধ করে থাকে; যাতে অন্তর সেদিকে ঝুঁকে না পড়ে। কেননা, ঈমান তাদের নিকট কুফরির মত। অথচ কুফরী হলো মৃত্যুর ন্যায়। یَکَادُ الۡبَرۡقُ یَخۡطَفُ اَبۡصَارَہُمۡ ‘বিদ্যুৎচমক তাদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার উপক্রম হয়’ অর্থাৎ বজ্রতে তাদের দৃষ্টিশক্তি বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়’।[২]
আল্লামা সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) এ আয়াতের তাফসীর উল্লেখ করে বলেন, ‘এ হচ্ছে মুনাফিক্বদের অবস্থা। তারা যখন কুরআনের আদেশ-নিষেধ, ভয়, শাস্তি ইত্যাদির কথা শুনে, তারা তাদের কানে আঙ্গুল গুঁজে দেয়। কুরআনের বিধি-নিষেধ, ওয়াদা-শাস্তি ইত্যাদি কথা হতে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কুরআনের শাস্তির কথা শুনে তারা ভয় পেয়ে যায়। কুরআনের ওয়াদা-অঙ্গীকার তাদেরকে অস্থির করে তুলে। তখন তারা তাদের সকল প্রচেষ্ট ব্যয় করে কুরআন হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর সেটাকে অপসন্দ করে, বিরক্তিকর মনে করে। যেমন অপসন্দ ও বিরক্তিকর মনে করে মেঘমালার আওয়াজকে। মৃত্যুর ভয়ে কানে আঙ্গুল ঢুকায়। তবে এ ব্যক্তি এই পরিস্থিতি হতে পরিত্রাণ পাবে কোথায়? আল্লাহ তা‘আলা তো তাঁর জ্ঞান, শক্তি দিয়ে তাদের ঘেরাও করে আছেন। তাঁর হাত ছাড়া হয় না, তাঁকে অক্ষমও করতে পারে না। বরং আল্লাহ তাদের সকলকর্ম সংরক্ষণ করে রাখেন। এরই ভিত্তিতে তাদেরকে পরিপূর্ণ বদলা দিবেন। বধিরতা, বোবাত্ব, অন্ধত্ব দিয়ে তাদের পরীক্ষা করার অর্থই হচ্ছে তারা ঈমানের পথ হতে বাধাগ্রস্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَوۡ شَآءَ اللّٰہُ لَذَہَبَ بِسَمۡعِہِمۡ وَ اَبۡصَارِہِمۡ ‘এবং যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তাহলে নিশ্চয় তাদের শ্রবণশক্তি ও তাদের দৃষ্টিশক্তি হরণ করতে পারেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২০)। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়প্রবণতা, এখানে তাদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে এবং দুনিয়ার শাস্তি হতে সতর্ক করা হচ্ছে। যাতে তারা সাবধান হয়, অপরাধ ও মুনাফিক্বী হতে বেঁচে থাকে। ِنَّ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ‘নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২০)। তাকে কোন কিছু অক্ষম করতে পারে না। তিনি কোন কিছু ইচ্ছা করলে, তাকে কেউ বাধা দিতে পারে না’।[৩]
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) মুনাফিক্বদের আগুন জ্বালানোর সাথে দৃষ্টান্ত দেয়ার কথা উল্লেখ করে যৌত্তিক আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন,
ثم ذكر حالهم بالنسبة إلى المثل المائي فشبههم بأصحاب صيب وهو المطر الذي يصوب أي ينزل من السماء فيه ظلمات ورعد وبرق فلضعف بصائرهم وعقولهم اشتدت عليهم زواجر القرآن ووعيده وتهديده وأوامره ونواهيه وخطابه الذي يشبه الصواعق فحالهم كحال من أصابه مطر فيه ظلمة ورعد وبرق فلضعفه وخوفه جعل أصبعيه في أذنيه خشية من صاعقة تصيبه
‘পানির দৃষ্টান্তে আল্লাহ তাদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। তিনি তাদের সাদৃশ্য রূপায়ন করেছেন বৃষ্টি বর্ষণকারী মেঘের সাথে, যা আকাশ হতে বর্ষিত হয়। তাদের রয়েছে বিভিন্ন রকমের অন্ধকার, বজ্র ও বিদ্যুৎচমক। এগুলোর মাধ্যমে তাদের দৃষ্টিশক্তি এবং উপলব্ধি শক্তি কমযোর হয়ে যাওয়ার কারণে কুরআনের বিধি-বিধান, আদেশ-নিষেধ, ওয়াদা-অঙ্গীকার তাদের কাছে কঠিন মনে হয়। কুরআনের ডাক তাদের কাছে বিকট আওয়াজের মত প্রবল মনে হয়। এদের অবস্থা ঐ ব্যক্তির মত যাকে ঐ বৃষ্টি পেয়ে বসেছে; যাতে রয়েছে অন্ধকার, বিজলী ও বজ্রধ্বনি। বৃষ্টি তাকে গ্রাস করবে এই ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে সে তার দুই আঙ্গুল কানে গুঁজেছে’।[৪]
তৃতীয়তঃ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَللّٰہُ وَلِیُّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ۙ یُخۡرِجُہُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ۬ؕ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَوۡلِیٰٓـُٔہُمُ الطَّاغُوۡتُ ۙ یُخۡرِجُوۡنَہُمۡ مِّنَ النُّوۡرِ اِلَی الظُّلُمٰتِ ؕ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ
‘আল্লাহই মুমিনদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে নিয়ে যান; আর যারা অবিশ্বাস করেছে ত্বাগূত তাদের পৃষ্ঠপোষক, সে তাদেরকে আলো হতে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী ওখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ; ২৫৭)।
সুধী পাঠক! নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের সাহায্যকারী। তিনি তাদেরকে তাওফীক্ব ও সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি তাদেরকে কুফর, শিরক ও বিপদ হতে বের করেন। ঈমান, তাওহীদ ও হেদায়াত নামক আলোর পথের সন্ধান দেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্ধকারকে কুফরির সাথে তুলনা করেছেন। কারণ, অন্ধকার কোন কিছু জানা হতে ব্যক্তিকে আড়াল করে দেয়। অনুরূপ কুফরি, ব্যক্তিকে ঈমানের সঠিক বাস্তবতা, সঠিকভাবে ঈমান পাওয়ার মাধ্যম জানা হতে দূরে ঠেলে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনিই ঈমানের পথ, শরী‘আত, শরী‘আতের বিধি-বিধান ইত্যাদির দিশা দেন। তাদেরকে হেদায়াত দেন। অন্তরচক্ষুর নিগূঢ় অন্ধকার ও কুফরির দিকে আহ্বান জানায় এমনসব সংশয় নিরসন করার মত প্রমাণ তাদের নাগালে এনে দেন। আর যারা আল্লাহর একত্বকে অস্বীকার করে, তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করে (الطَّاغُوتُ) ‘ত্বাগূত’। আর ত্বাগূত হলো: আল্লাহ ব্যতীত তারা যেসমস্ত প্রতিমা ও শরীকের ইবাদত করে থাকে। এ সমস্ত ত্বাগূতেরা তাদেরকে ঈমানের আলো হতে কুফরির অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। অন্তদৃষ্টিকে বিনষ্ট করে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি করে। তারা ঈমানের আলো, তার সঠিক বাস্তবতা, তার প্রমাণ, ঈমানের পথ দেখার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতার জন্ম দেয়’।[৫]
চতুর্থতঃ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ قَدۡ جَآءَکُمۡ بُرۡہَانٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکُمۡ نُوۡرًا مُّبِیۡنًا- فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰہِ وَ اعۡتَصَمُوۡا بِہٖ فَسَیُدۡخِلُہُمۡ فِیۡ رَحۡمَۃٍ مِّنۡہُ وَ فَضۡلٍ ۙ وَّ یَہۡدِیۡہِمۡ اِلَیۡہِ صِرَاطًا مُّسۡتَقِیۡمًا
‘হে লোক সকল! তোমাদের রবের সান্নিধ্য হতে তোমাদের নিকট প্রত্যক্ষ প্রমাণ এসেছে এবং আমরা তোমাদের প্রতি সমুজ্জ্বল জ্যোতি নাযিল করেছি’। অতঃপর যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে এবং তাঁকে সুদৃঢ়রূপে ধারণ করেছে, ফলত তিনি তাদেরকে স্বীয় করুণা ও কল্যাণের দিকে প্রবিষ্ট করাবেন এবং স্বীয় সরল পথ প্রদর্শন করবেন’ (সূরা নিসা: ১৭৪-১৭৫)।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, ‘মানবজাতির নিকটে এসেছে একটি প্রমাণপঞ্জী; যা সমস্ত ওযর-আপত্তির নিরসন করে, সমস্ত সংশয় বিদূরিত করে। তিনি হলেন মুহাম্মাদ (ﷺ)। তাঁকে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের ওযর, সংশয় নিরসনের দলীল হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। তাঁর সাথে নাযিল করেছেন সুস্পষ্ট আলো ‘আল-কুরআনুল কারীম’। যে কুরআনের আলোতে আলোকিত হয়, আলোর পথে চলতে সাহায্য করে এবং এটি তাকে স্পষ্ট দলীল, হেদায়াতের পথ ও আযাব হতে নাজাতের পন্থা বলে দেয়’।[৬]
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলগণের উপর যেসব কিতাব নাযিল করেছেন তাতে নূর তথা আলো নিহিত রেখেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنَا التَّوۡرٰىۃَ فِیۡہَا ہُدًی وَّ نُوۡرٌ ‘আমরা তাওরাত নাযিল করেছিলাম, যাতে হেদায়াত এবং আলো ছিল’ (সূরা আল-মায়েদাহ: ৪৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ مَنۡ اَنۡزَلَ الۡکِتٰبَ الَّذِیۡ جَآءَ بِہٖ مُوۡسٰی نُوۡرًا وَّ ہُدًی لِّلنَّاسِ ‘(হে নবী!) আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, মানুষের হেদায়াত ও আলোকবর্তিকা রূপে যে কিতাব মূসা এনেছিল তা কে নাযিল করেছেন?’ (সূরা আল-আন‘আম: ৯১)। আল্লাহ তা‘আলা ঈসা ব সম্পর্কে বলেন, وَ اٰتَیۡنٰہُ الۡاِنۡجِیۡلَ فِیۡہِ ہُدًی وَّ نُوۡرٌ ‘এবং আমরা তাকে দিয়েছিলাম ইনজীল, এতে ছিল হেদায়াত ও আলো’ (সূরা আল-মায়েদাহ: ৪৬)। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীম নাযিল করার মাধ্যমে এ সমস্ত নূর তথা আলোর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। কেননা এ কুরআনই মহা আলো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ مُہَیۡمِنًا عَلَیۡہِ فَاحۡکُمۡ بَیۡنَہُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ ‘আর আমি এই কিতাবকে আপনার প্রতি নাযিল করেছি যা নিজেও সত্যতা গুণে বিভূষিত এবং এর পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেরও সত্যায়নকারী এবং ঐ সব কিতাবের বিষয় বস্তুর সংরক্ষকও। অতএব আপনি তাদের পারস্পরিক বিষয়ে আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব অনুযায়ী মীমাংসা করুন’ (সূরা আল-মায়েদাহ: ৪৮)।
পঞ্চমতঃ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قَدۡ جَآءَکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ نُوۡرٌ وَّ کِتٰبٌ مُّبِیۡنٌ ‘তোমাদের কাছে আল্লাহর নিকট থেকে এক আলোকময় বস্তু এসেছে এবং তা একটি স্পষ্ট কিতাব (কুরআন)’ (সূরা আল-মায়েদাহ, ৫/১৫)। অর্থাৎ মুহাম্মাদ (ﷺ) নূর তথা আলোসহ প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর আলোর মাধ্যমে সত্যকে আলোকিত করেছেন। ইসলামকে বিজয় দান করেছেন, শিরককে মিটিয়ে দিয়েছেন। তিনি এমন আলো; যার থেকে আলোকিত হওয়া যায়, সত্যের পথ দেখা যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ شَاہِدًا وَّ مُبَشِّرًا وَّ نَذِیۡرًا-وَّ دَاعِیًا اِلَی اللّٰہِ بِاِذۡنِہٖ وَ سِرَاجًا مُّنِیۡرًا
‘হে নবী! আমরাতো আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী হিসাবে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে’। আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী রূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে’ (সূরা আল-আহযাব, ৩৩/৪৫-৪৬)। নবী করীম (ﷺ) যে সত্যকে আলোকিত করেছেন তার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে, তিনি ইয়াহুদীদে অনেক বিষয় উন্মোচন করে দিয়েছিলেন, যা তারা গোপন করত। আল্লাহ তা‘আলার বাণী, وَّ کِتٰبٌ مُّبِیۡنٌ ‘এবং তা একটি স্পষ্ট কিতাব (কুরআন)’। অর্থাৎ এমন কিতাব যাতে আল্লাহর তাওহীদ (এককত্ত্ব), তাঁর করা হালাল-হারাম, তাঁর দ্বীনের শরী‘আত সম্পর্কিত বিতর্কিত ও মতভেদপূর্ণ বিষয়ের সমাধান রয়েছে। এটা তো সেই কুরআন, যা আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর নাযিল করেছেন। তা মানুষের দ্বীনি প্রয়োজনীয় বিষয়াদি সু-স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দেয়। যাতে তারা হক-বাতিলের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে। (বাতিল হতে পৃথক করে হককে জানতে পারে)’।[৭] এছাড়া আল্লাহ তা‘আলা বাণী,
یَّہۡدِیۡ بِہِ اللّٰہُ مَنِ اتَّبَعَ رِضۡوَانَہٗ سُبُلَ السَّلٰمِ وَ یُخۡرِجُہُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ بِاِذۡنِہٖ وَ یَہۡدِیۡہِمۡ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ
‘তা দ্বারা আল্লাহ এরূপ লোকদেরকে শান্তির পথসমূহ বলে দেন, যারা তাঁর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে এবং তিনি তাদেরকে নিজ তাওফীক্বে (ও করুণায়) কুফরীর অন্ধকার থেকে বের করে ঈমানের আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং তাদেরকে সরল-সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত রাখেন’ (সূরা আল-মায়েদাহ: ১৬)।
উক্ত আয়াতের سُبُلَ السَّلٰمِ ‘সুবুলূস সালাম তথা শান্তির পথসমূহ; ‘আর সালাম’ হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ। আল্লাহর পথ তো সেটাই যেটা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য শরী‘আত করেছেন। সে দিকে তাদেরকে আহ্বান করেছেন। যেটা নিয়ে তাঁর রাসূলগণ প্রেরিত হয়েছেন। সেটা হল; একমাত্র ইসলাম। যা ব্যতীত কোন আমলই কবুল করা হয় না। ইসলাম মানুষকে অন্ধকার হতে আলোর পথের দিশা দেয়। অর্থাৎ শিরক-কুফরির অন্ধকার হতে ইসলামের আলোর দিশা দেয়’।[৮]
আল্লামা সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ظلمات الكفر والبدعة والمعصية، والجهل والغفلة، إلى نور الإيمان والسنة والطاعة والعلم، والذكر’ ‘তথা ظلمات ‘অন্ধকারসমূহ হল; কুফর, বিদ‘আত, পাপচারিতা, অজ্ঞতা ও হক হতে উদাসীনতা। نور আলো হল; ঈমান, সুন্নাত, আনুগত্য, ইসলাম ও যিকির’।[৯]
ষষ্ঠতঃ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ جَعَلَ الظُّلُمٰتِ وَ النُّوۡرَ ۬ؕ ثُمَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِرَبِّہِمۡ یَعۡدِلُوۡنَ
‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন আলো ও অন্ধকার; এ সত্ত্বেও যারা কাফির হয়েছে তারা অপর কিছুকে তাদের রবের সমকক্ষ নিরূপণ করেছে’ (সূরা আল-আন‘আম: ১)। ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, ‘এই আয়াত الظُّلُمٰتِ ‘অন্ধকার’ এবং النُّوۡرَ ‘আলো’ দ্বারা কী উদ্দেশ্য, এ নিয়ে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। সুদ্দী, ক্বাতাদাহ ও অধিকাংশ মুফাসসির বলেন, এখানে الظُّلُمٰتِ দ্বারা নিঝুম কালো রাত্রি উদ্দেশ্য। আর النُّوۡرَ দ্বারা দিনের আলো উদ্দেশ্য। হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, কুফর ও ঈমান। আমি কুরতুবী মনে করি; সবগুলোই উদ্দেশ্য’।[১০] আল্লামা সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
فحمد نفسه على خلقه السماوات والأرض، الدالة على كمال قدرته، وسعة علمه ورحمته، وعموم حكمته،وانفراده بالخلق والتدبير، وعلى جعله الظلمات والنور، وذلك شامل للحسي من ذلك، كالليل والنهار، والشمس والقمر. والمعنوي، كظلمات الجهل، والشك، والشرك، والمعصية، والغفلة، ونور العلم والإيمان، واليقين، والطاعة، وهذا كله، يدل دلالة قاطعة أنه تعالى، هو المستحق للعبادة، وإخلاص الدين له.
‘আল্লাহ তা‘আলা আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করে নিজের প্রশংসা করেন। যা তাঁর পূর্ণ সক্ষমতা, একক সৃষ্টিকারী, পরিচালনাকারী, অন্ধকারসমূহ ও আলো সৃষ্টি করার প্রমাণ বহন করে। এটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিসকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেমন: রাত, দিন, সূর্য,চন্দ্র। আভ্যন্তরীণ বিষয়কেও অন্তর্ভুক্ত করে। যেমন; অন্ধকার হল, অজ্ঞতা, সংশয়, শিরক, পাপ, ইবাদতে অমনযোগিতা। আলো হল: ইলম, ঈমান, বিশ্বাস, আনুগত্য। এ সবগুলোই অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, কেবল আল্লাহ তা‘আলাই ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। একনিষ্ঠ দ্বীন কেবল তাঁর জন্যই’।[১১]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর।
তথ্যসূত্র :
[১]. ইমাম ত্বাবারী, জামি‘ঊল বায়ান ‘আন তা’বীলিল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৩-৩৬২; ইমাম কুরতুবী, জামি‘ঊল আহকামিল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৩-২৪২; তাফসীরে বাগাবী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৩-৫৪; তাফসীরে কুরআনির আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৩; সা‘দী, তাইসীরুল কারীমির রাহমান ফী তাফসীরিল কালামিল মান্নান, পৃ. ২৭।
[২]. তাফসীরে বাগাবী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৪।
[৩]. তাইসীরুল কারীমির রাহমান ফী তাফসীরিল কালামিল মান্নান, পৃ. ২৭।
[৪]. আমছালিল কুরআন, পৃ. ১৮ (২/৩); ইজতিমাঊল জুয়ূশিল ইসলামিয়াহ ‘আলা গাযওয়াল মু‘তালা ওয়া জাহমিয়াহ, ২খণ্ড, পৃ. ৬৮।
[৫]. ইমাম ত্বাবারী, জামি‘ঊল বায়ান ‘আন তা’বীলিল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৮; ইমাম কুরতুবী, জামি‘ঊল আহকামিল কুরআন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৮২।
[৬]. ইমাম ত্বাবারী, জামি‘ঊল বায়ান ‘আন তা’বীলিল কুরআন, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৪২৭; তাফসীরে কুরআনির আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৬০।
[৭]. জামি‘ঊল বায়ান ‘আন তা’বীলিল কুরআন [তাফসীরে ত্বাবারী], ১০ম খণ্ড, পৃ. ১৪৩।
[৮]. জামি‘ঊল বায়ান ‘আন তা’বীলিল করআন [তাফসীরে ত্বাবারী], ১০ম খণ্ড, পৃ. ১৪৫।
[৯]. তাইসীরুল কারীমির রাহমান ফী তাফসীরিল কালামিল মান্নান, পৃ. ১৮৮ (পৃ. ২২৬)।
[১০]. আল-জামি‘ লি আহকামিল কুরআন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩৬১।
[১১]. তাইসীরুল কারীমির রাহমান ফী তাফসীরিল কালামিল মান্নান, পৃ. ২১২ (পৃ. ২৫০)।
প্রসঙ্গসমূহ »:
সুন্নাত