বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৯ অপরাহ্ন

বাউল মতবাদ

-গোলাম রহমান*


[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

তৃতীয় উপাদান : মানব দেহের গৌরব
দেহকে আশ্রয় করেই পল্লবিত হয়েছে বাউল সন্যাসীদের সাধনা। তাদের বিশ্বাস মতে, বিশ্বজাহানের সবই এ স্থুল মনুষ্য দেহে বিরাজমান। গাবে বলা হয়েছে,

যাহা আছে ভাণ্ডে, তাহা ব্রাহ্মাণ্ডে।

বৈষ্ণব মহাজন চণ্ডিদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে নাই’ তারা এই বাণীর পূর্ণ অনুসারী। তাদের মতে, এ দেহের সাধনাই সর্ব সাধনা, শ্রেষ্ঠ সাধনা।[১] কারণ,

উপাসনা নাই গো তার,
দেহের সাধনা সর্ব সার,
তীর্থ ব্রত যার জন্য
এ দেহে তার সব মিলে।

মোটকথা এ দেহকে জেনে-চিনে দেহের সাধনা করতে পারলেই প্রকৃত মুক্তি এবং এ দেহেই পরম স্রষ্টাকে লাভ করতে হবে। কারণ আল্লাহ-রাসূল বলতে এ মানবদেহ, বেহেশত-দোযখ বলতে এ মানবদেহ, আসমান-যমীন, আগুন-পানি, গ্রহ-নক্ষত্র, বজ্রপাত ও ভগবান বলতে এ মানবদেহই। এক কথায় এ দেহের মধ্যেই মক্কা-মদীনা, কাশী বৃন্দাবন। তাই মানব দেহের পূজা অর্চনাই হল বাউলদের শ্রেষ্ট সাধনা। সকল সাধন-ভজনের মূলেই আছে এই হরণ-পূরণের খেলা, স্বয়ং স্রষ্টাই এর প্রধান খেলোয়াড়। আর এই দেহ ভুবনই তার খেলার ময়দান।[২]

চতুর্থ উপাদান : মনের মানুষ
দেহ মধ্যস্থিত আত্মাকে বাউলগণ মনের মানুষ বলে অবহিত করেছে। এ আত্মাকে তারা মনের মানুষ, অধর মানুষ, ভাবের মানুষ, সোনার মানুষ, মন মনুয়া, সাঁই প্রভৃতি নামে অবহিত করেছে। এ মানব দেহেই যে সব মানুষ আছে সে সব সম্পর্কে বাউল গুরু লালন বলেন,

এই মানুষে সেই মানুষ আছে,
কত মণি ঋষি চার যুগ ধরে বেড়াচ্ছে খুঁজে

অথবা,

মিলন হবে কত দিনে,
আমার মনের মানুষের সনে।[৩]

-লালন শাহ

মনের মানুষ এ দেহের মাধ্যমে এক অপূর্ব লীলা করছে। তিনি কখনো পিতা, কখনো মাতা, কখনো ভ্রাতা, কখনো ভগ্নি বা স্বামী-স্ত্রী রূপে বিচিত্র রস আস্বাদন করছে। কখনো ভগবান রূপে, কখনো বান্দা বা সৃষ্টি রূপে, কখনো চোর, কখনো পুলিশ বা বিচারক রূপে নিজেকে প্রকাশ করে অনন্ত খেলায় মেতে উটেছে। বহুল প্রচারিত গানটি তার প্রমাণ বহন করে-

তুমি হাকিম হইয়া হুকুম করো, পুলিশ হইয়া ধরো।
সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো।

এক কথায় তার লীলা বুঝা বড় দায়। বাউল মতে, মানুষই যে স্বয়ং ঈশ্বর বা স্রষ্টা বা পরমাত্মা তাতে কোন সন্দেহ নেই। মনের মানুষ অটল বিন্দু রূপে; ব্রহ্মরূপে মনিরূপে বা সর্বোচ্চ নিভৃত ঘরে বাস করে। কখনও বা এ মানুষ নীড়ে বিরাজ করে। তার চলাচলের স্থান দ্বি-দল, দশম দলে মনিপুর চক্রে ষোড়শ দলে বা বিশুদ্ধ চক্রে। এরপর এ মানুষ যগেশ্বরী শক্তি সাথে যোগল রূপে দোদুল দোলায় দোলায়িত হয় এবং এক কাক্সিক্ষত শুভলগ্নে চতুর্দশ পদ্মে আবির্ভুত হয়ে সাধকের মন তুষ্ট করে। এখানে নিহার দিয়ে পলকহীন সূত্রে অপেক্ষা করতে হয় এবং এখানেই (ত্রিবেনীতে) সে অটল মানুষের সাক্ষাৎ মিলে। (ইড়া পিঙ্গলা ও সুষম্মা নারীর মিলন স্থলকে ত্রিবেনীর ঘাট বলা হয়) এ দেহের মধ্যেই যে পরমাত্মার সিংহাসন। এ ধারণাই বাউলগণ বা বাউল সাধকগণ পেয়েছে ছূফী দর্শন, উপনিষদ, হিন্দু ও বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রভাবে তাতে সন্দেহ নেই।[৪]

পঞ্চম উপাদান : রূপ-স্বরূপ তত্ত্ব
বাউলদের দেহকে কেন্দ্র করে যে সাধনা, তার মূল রহস্যই হল রূপ থেকে স্বরূপে পাড়ি জমানো। রূপ বলতে প্রকৃত বা নারী এবং স্বরূপ বলতে পুরুষ বা নরকে অবহিত করা হয়েছে। রূপের সাধন করার মধ্যদিয়ে অটল রূপ বা স্বরূপের সাক্ষাৎ সম্ভব। রূপ-স্বরূপের মিলনের মাধ্যমে রতিকে ঊর্ধ্ব গতি করে সেই স্বরূপের দর্শন লাভ করতে হবে। যেমন বাউল রূপ চাঁদ বলেন,

আমার মন সাজ প্রকৃতি (নারী)
প্রকৃতির স্বভাব ধর সাধনা করো,
উর্ধ্ব হবে দেহের গতি।[৫]

বাউলদের সাধনা
বাউলদের সাধনা বড় বিচিত্র। বড় নোংরা সাধনা। ধর্ম যাদের নিকটে একেবারেই তুচ্ছ, আর অজ্ঞ, মূর্খ ও উন্মাদ একজন গুরুই যাদের পূজ্য, তাদের সাধনা আর কতটুকুই আদর্শপূর্ণ হবে? ঊনবিংশ শতাব্দীতে যৌন-যৌগিক প্রক্রিয়া এবং এরূপ আরো গর্হিত ক্রিয়াকলাপ এই সম্প্রদায়ের মধ্যে অসংখ্য সাধারণ প্রথায় পরিণত হয়। দলে দলে অশিক্ষিত ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী ও মুক্ত জীবন লাভের আশায় ‘বাউল’ বনে যায়। তাদের কু-কীর্তির ফলে সমাজ জীবন বিষাক্ত হয়ে উঠে।[৬]

বাউলেরা তাদের বাউলতন্ত্র গোপন রাখতে চান একান্তভাবে। বিভিন্ন ধর্ম থেকে আসা মানুষেরাই এই বাউলতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ইহুদি, খৃষ্টান ও ইসলাম ধর্মের মতো কোন নবী বা অবতারকে তারা মেনে চলেন না। বিভিন্ন স্থানে নানা নেতা গজিয়ে ওঠেন আর তার নামেই তার ভক্তরা নিজেদের নামকরণ করে থাকেন। ফলে বাউল সম্প্রদায় বহু নামে পরিচিত। যেমন অধ্যাপক ডক্টর সুধীর চক্রবর্তীর মতে, ‘বাউল, নেড়া, দরবেশ, সাঞি, আউল, সাধিবনীপন্থী, সহজিয়া, খুশি বিশ্বাসী, রাধাশ্যামী, রাম সাধনিয়া, জগবন্ধু-ভজনিয়া, দাদুপন্থী, রৈদাসী, সেনপ্রন্থী, রামসুনেহী, মীরাবাঈ, বিত্থল ভক্ত, কর্তাভোজা, স্পষ্টদায়িক বা রূপকবিরাজী, রামবল্লভী, সাহেবধনী, বলরামী, হজরতজী, গোবরাই, পাগলনাথী, তিলকদাসী, দর্পনারায়ণী, বড়ি, অতিবড়ি, রাধাবল্লভী, সখীভাবুকী, চরণদাসী, হরিশ্চন্দ্রী, সধ্নপন্থী, মাধবী, চুহড়পন্থী, পুরাপন্থী, বৈরাগী, নাগা, আখড়া, দুয়ারা, কামধেন্বী, মুকুটধারী, সংযোগী, বারসাসম্প্রদায়িকা ভাট, মহাপুরুষীয় ধর্মসম্প্রদায়ী, জগমোহিনী, হরিবোলা, রাত ভিখারী, উৎকলী, বিন্দুধারী, অনন্তকুলী, সৎকুলী, যোগী, গুরুদাসী বৈষ্ণব, খণ্ডিত বৈষ্ণব, করণ বৈষ্ণব, গোপ বৈষ্ণব, নিহঙ্গ বৈষ্ণব, কালিন্দী বৈষ্ণব, চামার বৈষ্ণব, হরিব্যাসী, রামপ্রসাদী বড়গল, নস্করী, চতুর্ভূজী, হারারী, বাণশয়ী, পঞ্চধুনী, বৈষ্ণব তপস্বী, আগরী, মার্গী, পল্টুদাসী, আপাপন্থী, সৎনামী, দরিয়াদাসী, বুনিয়াদাসী, আহমদপন্থী, বীজমার্গী, অবধুতী, তিঙ্গল, মানভাবী কিশোরী ভজনী, কুলিগায়েল, টহলিয়া বা নেমো বৈষ্ণব, জোন্নী, শাঙন্মী, নরেশপন্থী, দশামার্গী, পাঙ্গুল, বেউরদাসী, ফকীরদাসী, কুম্ভপাতিয়া, খোজা গৌরবাদী, বামে কৌপীনে, কপীন্দ্র পরিবার, কৌপীন ছাড়া চোরাধারী, কবীরপন্থী, খাকী, মুলুকদাসী’ ইত্যাদি।[৭]

বাউল লালন শাহ কখনো কুরআন ও হাদীছের ধার ধারেননি। ছালাত-ছিয়ামে বিশ্বাসীও ছিলেন না। তিনি তার শিষ্যদের কেবল একতারা ও গান শিক্ষা দিয়েছেন। সারাজীবন তিনি সাধনসঙ্গিণী নিয়ে থেকেছেন, যা সরাসরি ব্যভিচার। লালন তার ভাববাদী কথাবার্তায় প্রচলিত সব ধর্মকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করেছেন।[৮]

আধুনিক বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও ভাষাবিদ কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন সভাপতি এক সময়ের একনিষ্ঠ লালনভক্ত অধ্যাপক আবু জাফর লালন সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে তার দু’একটি বক্তব্য তুলে ধরা হল, লালন তার কিছু গানে সাম্যের কথা বললেও তার গানের একটি বিরাট অংশ খুবই গর্হিত ও বিকৃত যৌনাচারের রূপক স্বরূপ। তার মতে, লালন আসলে গানের নামে সূফীতত্ত্ব ও মরমিয়া আধ্যাত্মিকতার নামে পর্ণোগ্রাফির দক্ষ কুশলী উপস্থাপক ছিলেন। গুপ্ততত্ত্বের ছদ্মাবরণে লালন দেহতত্ত্বের নামে এক কদর্য যৌনাচারের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, বাউলদের এক অংশ এখন লাউয়ের খোল নিয়ে গেরুয়া পরিধান করে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়। অধ্যাপক আবু জাফরের মতে ‘লালন একটি চিরস্থায়ী ফিতনা’।[৯]

বলা চলে মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতিতে পৌত্তলিকতা ও বিধর্মী ভাবধারার অনুপ্রবেশ যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা পরিপূর্ণ করে দেয় এই শ্রেণীর ভণ্ড পীর-ফকীরদের দল। ধর্মের নামে এরা বৈষ্ণব বামাচারী তান্ত্রিকদের অনুকরণে যৌন অনাচারের আমদানী করে। আউল, বাউল, কর্তাভোজা, সহজিয়া প্রভৃতি হচ্ছে হিন্দু বৈষ্ণব ও চৈতন্য সম্প্রদায়ের মুসলিম সংস্করণ, যাতে করে সাধারণ অজ্ঞ মুসলিমদেরকে বিপথগামী করা যায়। এদের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় সর্বাপেক্ষা জঘন্য ও যৌন প্রবণ। মদ্যপান, নারী-পুরুষে অবাধ মিলন এদের সকল সম্প্রদায়েরই সাধন পদ্ধতির মধ্যে অনিবার্যরূপে শামিল। তবে বাউলরা তান্ত্রিক বামাচারীদের ন্যায় অবাধ সংগমকে যৌন পূজা বা প্রকৃতি পূজা রূপে জ্ঞান করে।

বাউলদের মত-বিশ্বাস
মাওলানা আকরাম খাঁ বলেন, তৃতীয় যুগ তথা পতন যুগের শেষ দশকগুলোর সমাপ্তির দিকে উপরে বর্ণিত কলুষিত পরিবেশের প্রভাবে বাংলার মুসলিম সমাজ নৈতিক অধঃপতন ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার এক অতি শোচনীয় স্তরে নেমে যায়। এই অধঃপতনের নজীর হিসাবে আমরা এখানে মুসলিম মারফতী ফকীর বা নেড়ার, অর্থাৎ মরমিবাদী ভিক্ষুকদের কয়েকটি মত-বিশ্বাস ও সাধন পদ্ধতি উল্লেখ করছি। এই সমস্ত ফকীরদের দল বিভিন্ন সম্প্রদায়-উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। যা আউল, বাউল, কর্তাভোজা ও সহজিয়া ইত্যাদি হিন্দু বৈষ্ণব অথবা চৈতন্য সম্প্রদায়ের মুসলিম সংস্করণ ব্যতীত কিছু ছিল না।

(এক) তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মদ্যপান ব্যতীত আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত করা সম্ভব নয়। সুতরাং আধ্যাত্মিক সাধনাও এটা ব্যতীত সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি মদ্যপান ও গাঁজা ইত্যাদি সেবন করে, সে অনতিকালের মধ্যেই মারেফতে এলাহী বা আল্লাহ্র জ্ঞান লাভে সক্ষম হয়। আল্লাহ্র সান্নিধ্য হতে দূরে রাখার জন্যই শয়তান মানুষকে মদ্যপানে নিষেধ করে। এই শয়তানের প্ররোচনায়-ই মুসলিম শাস্ত্রবিদ বা শরিয়তী আলেমগণ মদ্যপান এবং অন্যান্য নেশা সেবনকে পাপ বলে ফতোয়া দিতে শুরু করেছিলেন।
সুধী পাঠক! এই বিশ্বাসের সাথে তান্ত্রিকদের পঞ্চতন্ত্রের একটি তত্ত্বের কিরূপ মিল আছে, তা অবশ্যই লক্ষ্য করবেন।

(দুই) বাউলগণ যৌন সঙ্গমকে যৌন পূজা বা প্রকৃতিরূপে জ্ঞান করে। তথাকথিত এই প্রকৃতি পূজায় ‘চারিচন্দ্র ভেদ’ নামে তাদের একটি অনুষ্ঠান রয়েছে।
বাউলগণ একে ভক্তি ও উপাসনার একটি অতি পবিত্র অনুষ্ঠান বলে বিবেচনা করলেও সাধারণ মানুষের কাছে এটা অতি বীভৎস ও পৈশাচিক বলে মনে হবে। তারা বলে যে, মানুষ এই চারিচন্দ্র বা মানবদেহের নির্যাস; যথা- রক্ত, বীর্য, মল ও মূত্র পিতার অ-কোষ ও মাতার গর্ভ হতে লাভ করে থাকে। সুতরাং চারিচন্দ্র বাহিরে নিক্ষেপ না করে পুনরায় দেহে গ্রহণ ও রক্ষা করা কর্তব্য। মুসলিম বাউল বা নেড়ার ফকীরগণ এই ‘চারিচন্দ্র ভেদে’র ন্যায় ‘পঞ্চরস সাধন’ও করে থাকে। এদের নিজেস্ব উদ্ভট ও নোংরা ভাষায় এই পঞ্চরসের নাম হচ্ছে-কালো, সাদা, লাল, হলুদ ও মুর্শিদ বা গুরুর বাক্য চারটি মদ্য, শুক্র, রজঃ ও মলের অর্থজ্ঞাপক। স্বীয় স্ত্রী অথবা পরস্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গম করে এই ‘রস সাধন’, ‘রতি সাধন’, ‘লাল সাধন’ ও ‘গুটি সাধন’ করতে হবে। তান্ত্রিকদের অন্ধ অনুকরণে এর এক স্বরবিশিষ্ট বহু অনুনাসিক তন্ত্রমন্ত্র রচনা করেছে। অন্যান্য প্রকারের তন্ত্রমন্ত্রও এদের যথেষ্ট রয়েছে। তাদের পৈশাচিক সাধন পদ্ধতির বিভিন্ন পর্যায়ে এই সমস্ত তন্ত্রমন্ত্র উচ্চারণ করা হয়। এই সমস্ত সাধনের প্রকৃতি এত কদর্য ও অশ্লীল যে, আমরা এখানে তার কোন একটির উদাহরণ পর্যন্ত উল্লেখ করতে লজ্জাবোধ করছি।

(তিন) কুরআন মাজীদের বিভিন্ন শব্দ ও মূল তত্ত্বের যে ব্যাখ্যা এই সমস্ত শয়তান নেড়া-ফকীরদের দল দিয়েছে, তাও অদ্ভুত। ‘হাওযে কাওছার’ বলতে তারা জান্নাতী সঞ্জীবনী সুধার পরিবর্তে স্ত্রীলোকের রজঃ বা ঋতুস্রাব বুঝে। যে পূজা পদ্ধতিতে এই ঘৃণ্য ফকীরের দল বীর্য পান করে, তার সূচনায় ‘বীজ মে আল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ বীর্যে অবস্থান করেন, এই অর্থে তারা ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করে থাকে। তাদের মনের মদিনায় কুরআনের বিশুদ্ধ ১০ পারা সদা জীবন্ত অবস্থায় বিদ্যমান। এই জন্যই শরীয়তী কুরআনের কৃত্রিম ৩০ পারা তারা অনুসরণ করে না। তাদের এই শয়তানী মতবাদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামের নিষেধ ও হারামসমূহকে পুণ্যকর্মরূপে মেনে চলা এবং ফরয বা আদেশসমূহকে পাপরূপে প্রত্যাখ্যান করা।

(চার) এই মুসলিম ভিক্ষোপজীবি নেড়ার-ফকীর দলের পুরোহিত বা পীরেরা শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক গোপীদের বস্ত্র হরণের অনুরূপ এক অভিনয় অনুষ্ঠান করে থাকে। যখন পীর তার মুরীদানের গ্রামে তশরিফ আনেন, তখন গ্রামের সকল যুবতী ও কুমারী উত্তম বসনে সজ্জিত হয়ে বৃন্দাবনের গোপীদের অনুকরণে একটি গৃহকক্ষে পীরের সাথে মিলিত হয়। নাটকের প্রথম অংশে এই সকল স্ত্রীলোক নৃত্য গীত শুরু করে। নিন্মে এই সখীসঙ্গীতের গদ্যরূপ প্রদান করা হল,

‘ও দিদি যদি শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাসিতে চাও
আর আত্মপ্রতারণা না করিয়া শ্রীঘ্র আস
দেখ, প্রেমের দেবতা আসিয়াছে
আঁখি তোল, তাহার প্রতি তাকাও
গুরু আসিয়াছে তোমাদের উদ্ধারের জন্য
এমন গুরু কোথাও আর পাইবে না,
হ্যাঁ, গুরুর যাহাতে সুখ
তাহা করিতে লজ্জা করিও না।”

গানটি গীত হবার পর এই সমস্ত নারী তাদের গাত্রবরণ খুলে ফেলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে পড়ে এবং ঘুরে ঘুরে আনন্দের নৃত্য করতে থাকে। পীর এখানে কৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং শ্রীকৃষ্ণ যখন গোপীদের বস্ত্রহরণ করে বৃক্ষে আরোহণ করেছিলেন, তিনিও তদ্রুপ এই সমস্ত উলঙ্গ নারীর পরিত্যক্ত বস্ত্র তুলে গৃহের একটা উঁচু তাকে রেখে দেন। এই পীর কৃষ্ণের যেহেতু বাঁশি নেই, তাই তিনি নিম্নোক্তভাবে মুখে গান গেয়েই এসব উলঙ্গ রমনীদেরকে যৌনভাবে উত্তেজিত করে তুলেন,
‘হে যুবতীগণ! তোমাদের মোক্ষের পথ ভক্তকুলের পুরোহিতকে অর্ঘ্য স্বরূপ দেহদান কর’।
বলাই বাহুল্য, কোনরূপ সঙ্কোচবোধ না করে পীরের যৌন লালসা পরিতৃপ্ত করাই এদের প্রধান ধর্মীয় কর্তব্য। আর এই যৌন আবেগপূর্ণ পরিবেশে পীরের সাথে এদের যথেষ্ট যৌন মিলনে কোনরূপ বাধা থাকবে না, তা সহজেই অনুমেয়।

(পাঁচ) এই নেড়া-ফকীরদের আউল, অথবা আওলে আওলিয়া সম্প্রদায় সম্পর্কে বলা হয় যে, তারা তাদের বিবাহিত স্ত্রীদের সাথে সীমাবদ্ধ যৌন সঙ্গমকে নিগূঢ় আধ্যাত্মিক সাধনায় সিদ্ধি লাভের পক্ষে যথেষ্ট মনে করে না। তাদের যৌন লালসার পূর্ণ পরিতৃপ্তির জন্য প্রকাশ্য ও গোপনে যত অধিক সংখ্যক বারাঙ্গানা (বেশ্যা) অথবা কুলনারীর সঙ্গে তাদের ইচ্ছা, ততজনের সঙ্গে যৌন সঙ্গমকে তাদের এই নিগূঢ় সাধন পদ্ধতিতে প্রয়োজন হয়। অতএব তাদের স্ত্রীদের সাথে অন্য কোন পুরুষকে যৌন মিলনে লিপ্ত হতে দেখলে তারা কোনরূপ অসন্তোষ অথবা ঈর্ষাবোধ করে না। অন্যদিকে নারী-পুরুষ উভয় পক্ষ হতে এই ধরনের যৌন মিলনে কোনরূপ ঈর্ষার প্রশ্রয় না দেয়াকে তারা আত্মশুদ্ধি ও আত্মিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য বিবেচনা করে।

(ছয়) এই ভিক্ষাপজীবি ফকীরগণের ‘ইচ্ছা পূরণ ভজন’ নামে এক বিশেষ প্রকারের গোপন সাধন-রীতি রয়েছে। এর প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে- এতে কোন পুরুষ বা নারী তার নিজেদের বা দলের অন্য কারও সাথে যৌন আকাক্সক্ষা পরিতৃপ্ত করতে ইতস্ততঃ বা কোনরূপ লজ্জাবোধ করবে না। এই উদ্দেশ্যে হতভাগ্য এই ফকীর দলের নারী-পুরুষ সকল ভক্ত ‘আখড়া’ নামে একটি বিচ্ছিন্ন স্থানে আসে মিলিত হয়ে নানা দ্রব্য সেবন করে এবং যাকে যার ইচ্ছা তার সাথে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে তাদের নিগূঢ় সাধনা চালিয়ে যায়। যদি দলের কোন নারী বা পুরুষ অন্য কোন পুরুষ বা নারীর সাথে যৌন কামনা চরিতার্থ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে, তা হলে তাকে মহাপাপী বলে অভিযুক্ত করা হয়। তান্ত্রিকদের মাতঙ্গী সম্প্রদায়ের ‘মাতরমপি ন তাজেৎ’ সূত্রের ন্যায় এই মুসলিম ফকীরের দলও নিম্নোক্ত সূত্র উদ্ভাবন করে-
‘যখন তুমি তোমার পিতার মস্তিস্কে ছিলে, তখন যে নারীকে তুমি ‘মা’ বলিয়া সম্মোধন করছ, সেই নারীর স্বামী ছিলে’।
‘একাধারে মাতা ও পত্নীর দৃষ্টান্ত হর[১০]- পার্বতীর মধ্যে প্রত্যক্ষ কর। যদিও হর পার্বতীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন, পরে পার্বতীর স্বামী হন। আদম তার নিজ কন্যা বিশ্বজননী হাওয়াকে অপহরণ করেন (এবং তাঁহাকে তাঁহার পত্নীরূপে গ্রহণ করেন)। আস্তাগফিরুল্লাহ। যখন কৃষ্ণ ষোল সহস্র গোপিনীর সহিত প্রেমলীলা করেন, তখন নারী গঙ্গা স্বরূপিনী এবং পুরুষ তাহাতে স্নানার্থী তীর্থযাত্রী। যখন তারা সঙ্গমে মিলিত হয়, তখন তারা এক ও অভিন্ন। গঙ্গা স্নানে কারো ইতস্ততঃ করার কারণ নেই’।[১১]

পর্যালোচনা
মানুষ অবৈধ যৌন সংগমে ভীত-সন্ত্রস্ত হয় এবং পাপের ভয়ে লজ্জা ও সংকোচ অনুভব করে। কিন্তু ধর্মের নামে স্বয়ং কেউ যদি ঘোষণা করে যে, এ কাজ পাপের নয়, পুণ্যের; তাহলে মানুষ এ পথে আকৃষ্ট হবে না কেন? একশ্রেণীর লম্পট পাপাচারী লোক ধর্মের নামে এভাবেই অজ্ঞ ও মুর্খ মানুষদেরকে ফাঁদে ফেলে প্রতারিত ও বিপদগামী করছে।[১২]

উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, বাউল কপোল-কল্পিত ও প্রতারণামূলক এমন একটি সম্প্রদায়, যা মানুষকে অসভ্য, বর্বর, রুচিহীন নরপশুতে পরিণত করে। হিন্দু-মুসলিম একাকার করে এরা ইসলামকে চরমভাবে বিকৃত করেছে। তাওহীদকে ধ্বংস করে শিরক প্রতিষ্ঠাই ছিল এ মতবাদের মৌলিক কাজ। অতএব এদের এই সমস্ত জঘন্য আক্বীদা-বিশ্বাস ও নোংরা কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের যেমন বিরত রাখতে হবে তেমনি এই ভণ্ডামির বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে তুলতে হবে। ইসলামে এই সমস্ত ভণ্ডামীর স্থান নেই। বরং ইসলামী বিধান মতে এই যৌন নোংরামির জন্য সরকারীভাবে রজম করে নির্মূল করা উচিত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন।


* খত্বীব ও ইমাম, কেন্দ্রীয় আহলেহাদীছ জামে মাসজিদ, শুকলপট্টি, নাটোর।

তথ্যসূত্র :
[১]. ড. আব্দুর রশিদ, সুফী দর্শন (ঢাকা : প্রোগ্রেসিভ বুক কর্ণার), পৃ. ১১০; বাউল ধর্ম ও সূফীবাদ, পৃ. ১৯।
[২]. বাউল ধর্ম ও সূফীবাদ, পৃ. ১৯।
[৩]. আবূ তাহের বর্ধমানী, উল্টা বুঝিল রাম, সাধু সাবধান, পৃ. ৬৪; বাউল ধর্ম ও সূফীবাদ, পৃ. ১৯।
[৪]. ড. আব্দুর রশিদ, সূফী দর্শন, পৃ. ১১৩; বাউল ধর্ম ও সূফীবাদ, পৃ. ১৯-২০।
[৫]. বাউল ধর্ম ও সূফীবাদ, পৃ. ২০।
[৬]. বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৮।
[৭]. অধ্যাপক শ্রী সনৎকুমার মিত্র সম্পাদিত, কর্তাভজা ধর্মমত ও ইতিহাস, (১৩৮৩ সাল), পৃ. ২০-২১।
[৮]. ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৪৪বর্ষ, ১ম সংখ্যা, পৃ. ২৩১।
[৯]. ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৪৪ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, পৃ. ২৩৩।
[১০]. হিন্দু দেবতা শিব, বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ. ১১৯৩।
[১১]. মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস, (ঢাকা, ২০০২ ইং), পৃ. ১৩১-১৩৪।
[১২]. আব্বাস আলী খান, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস বই দ্র.।




ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) -এর আগমন সংশয় নিরসন (৭ম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইয়ামানের কুখ্যাত জঙ্গীগোষ্ঠী হুতী শী‘আদের মুখোশ উন্মোচন - শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
যুলমের পরিচয় ও পরিণাম - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (১৭তম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১১তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
বাউল মতবাদ - গোলাম রহমান
নফল ছালাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ - ড. মেসবাহুল ইসলাম

ফেসবুক পেজ