শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৪২ পূর্বাহ্ন

মসজিদ: ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র

-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


(৬ষ্ঠ কিস্তি)

৬. মসজিদের শিষ্টাচারসমূহ

মসজিদে গমনাগমন ও সেখানে অবস্থানের জন্য ইসলামী শরী‘আতে কিছু আদব বা শিষ্টাচার অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। নিম্নে সংক্ষেপে তা উল্লেখ করা হলো:

১- নিজ ঘরে ওযূ করা এবং পরিপূর্ণরূপে ওযূ করা

‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, 

مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَلْقَى اللهَ غَدًا مُسْلِمًا فَلْيُحَافِظْ عَلَى هَؤُلَاءِ الصَّلَوَاتِ حَيْثُ يُنَادَى بِهِنَّ فَإِنَّ اللهَ شَرَعَ لِنَبِيِّكُمْ ﷺ سُنَنَ الْهُدَى وَإِنَّهُنَّ مِنْ سُنَنِ الْهُدَى وَلَوْ أَنَّكُمْ صَلَّيْتُمْ فِىْ بُيُوْتِكُمْ كَمَا يُصَلِّى هَذَا الْمُتَخَلِّفُ فِىْ بَيْتِهِ لَتَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ وَلَوْ تَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ وَمَا مِنْ رَجُلٍ يَتَطَهَّرُ فَيُحْسِنُ الطُّهُوْرَ ثُمَّ يَعْمِدُ إِلَى مَسْجِدٍ مِنْ هَذِهِ الْمَسَاجِدِ إِلَّا كَتَبَ اللهُ لَهُ بِكُلِّ خَطْوَةٍ يَخْطُوْهَا حَسَنَةً وَيَرْفَعُهُ بِهَا دَرَجَةً وَيَحُطُّ عَنْهُ بِهَا سَيِّئَةً وَلَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلَّفُ عَنْهَا إِلَّا مُنَافِقٌ مَعْلُوْمُ النِّفَاقِ وَلَقَدْ كَانَ الرَّجُلُ يُؤْتَى بِهِ يُهَادَى بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ حَتَّى يُقَامَ فِى الصَّفِّ

‘যে ব্যক্তি আগামীকাল আল্লাহর সাথে পূর্ণ মুসলিম হিসাবে সাক্ষাৎ করে সন্তুষ্ট হতে চায়, সে যেন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হয়, যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের আযান দেয়া হয়। কেননা  আল্লাহ তা‘আলা তা তোমাদের নবীর জন্য হেদায়াতের পথসমূহ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। কেননা এই ছালাতসমূহ হেদায়াতের পথসমূহের অন্যতম একটি। যদি তোমরা তোমাদের ঘরে ছালাত আদায় কর, যেভাবে মুনাফিক্বরা তাদের ঘরে ছালাত আদায় করে, তাহলে অবশ্যই তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ করলে। আর যদি তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ কর, তাহলে তোমরা অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে। যে ব্যক্তি উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করে অতঃপর ঐ মসজিদসমূহের মধ্যে কোন মসজিদের দিকে গমন করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতিটি পায়ের ধাপের বিনিময়ে একটি করে নেকী দান করবেন, তার মর্যাদা এক ধাপ উন্নত করবেন এবং তার একটি পাপ ক্ষমা করবেন। আমি আমাদের দেখেছি, জামা‘আতে ছালাত আদায় করা থেকে মুনাফিক্বরা ব্যতীত কেউ বিরত থাকত না, যাদের মুনাফিক্বী অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। কোন লোককে দু’ব্যক্তির উপর ভর করে এনে ছালাতের সারিতে দাঁড় করিয়ে দেয়া হত। [১]   

২- অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে না বসা

মসজিদ হলো পবিত্র স্থান। সুতরাং পবিত্র লোকেরাই সেখানে আসবে ও বসবে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে অপবিত্র ব্যক্তি মসজিদে আসতে পারে অথবা মসজিদের উপর দিয়ে গমন করতে পারে কিন্তু সে মসজিদে বসবে না। আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَقۡرَبُوا الصَّلٰوۃَ وَ اَنۡتُمۡ سُکٰرٰی حَتّٰی تَعۡلَمُوۡا مَا تَقُوۡلُوۡنَ وَ لَا جُنُبًا اِلَّا عَابِرِیۡ سَبِیۡلٍ حَتّٰی تَغۡتَسِلُوۡا

‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নেশার অবস্থায় ছালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা কি বলছ, তা বুঝতে পার এবং অপবিত্র অবস্থাতেও নয়, যদি তোমরা পথচারী না হও, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা গোসল কর’।[২] ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অনেক ইমাম এ আয়াত দ্বারা এ কথার উপর প্রমাণ পেশ করেন যে, গোসল ফরয হওয়া ব্যক্তির জন্য মসজিদে অবস্থান করা হারাম। তবে তার জন্য মসজিদ ত্যাগ করার জন্য অতিক্রম করা বৈধ। অনুরূপভাবে ঋতুবর্তী ও নিফাসগ্রস্ত মহিলার বিধানও একই।[৩]

৩- দুর্গন্ধ হতে দূরে থাকা

জাবির ইবনু ‘আব্দিল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, مَنْ أَكَلَ ثُومًا أَوْ بَصَلًا فَلْيَعْتَزِلْنَا - أَوْ لِيَعْتَزِلْ مَسْجِدَنَا - وَلْيَقْعُدْ فِىْ بَيْتِهِ ‘যে ব্যক্তি পেঁয়াজ বা রসুন খায়, সে যেন আমাদের থেকে অথবা আমাদের মসজিদ থেকে দূরে থাকে এবং সে যেন তার নিজ ঘরে বসে থাকে’।[৪] অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেন, فَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ تَأَذَّى مِمَّا يَتَأَذَّى مِنْهُ الْإِنْسُ ‘নিশ্চয় ফিরিশতারা ঐ সব বস্তু হতে কষ্ট পায় যে বস্তু হতে মানুষ কষ্ট পায়’।[৫] অতএব পেঁয়াজ-রসুন খাওয়া নিষেধ নয় এবং রান্না করা পেঁয়াজ-রসুন খেয়ে মসজিদে আসাও নিষেধ নয়। উল্লেখ্য, বর্তমানে যারা মাদকদ্রব্য সেবন করেন ও বিড়ি-সিগারেট পান করেন তাদের মুখ থেকেও দুর্গন্ধ বের হয়। সুতরাং অন্যকে কষ্ট দানকারী এসব হারাম থেকে বিরত থাকা অতীব জরুরী।

৪- সুন্দর কাপড় পরিধান ও সৌন্দর্য গ্রহণ করা

মসজিদের অন্যতম আদব হলো সাধ্যমত সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা এবং সৌন্দর্য গ্রহণ করা। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰبَنِیۡۤ  اٰدَمَ خُذُوۡا زِیۡنَتَکُمۡ عِنۡدَ کُلِّ مَسۡجِدٍ  وَّ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا وَ لَا  تُسۡرِفُوۡا ۚ اِنَّہٗ لَا  یُحِبُّ الۡمُسۡرِفِیۡنَ

‘হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেক ছালাতের সময় সুন্দর পোশাক পরিধান কর। তোমরা খাও ও পান কর। কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না’।[৬] ‘আব্দুল্লাহ ইবনি ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إذَا صَلّى أحَدُكُمْ فَلْيَلْبَسْ ثَوْبَيِهِ فَإِنَّ اللهَ أحَقُّ مَنْ تُزُيِّنَ لَهُ ‘তোমাদের কেউ যখন ছালাতে দাঁড়াবে সে যেন (সুন্দর) পোশাক পরিধান করে। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর থেকে সজ্জিত করার হকদার’।[৭] রাসূল (ﷺ) বলেন, إِنَّ اللهَ جَمِيْلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সুন্দর তিনি সৌন্দর্যকে পসন্দ করেন’।[৮]

৫- ঘর থেকে বের হওয়ার দু‘আ পড়া এবং ছালাতের নিয়তে ঘর থেকে বের হওয়া

মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হোক কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্য হোক ঘর থেকে বের হলে তাকে শরী‘আত নির্দেশিত দু‘আ পাঠ সুন্নাহ। এ দু‘আ পড়বে-

بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ

‘আল্লাহর নামে আরম্ভ করলাম। আল্লাহর উপরই ভরসা করলাম। আল্লাহ ছাড়া কোন শক্তি নেই এবং তিনি ছাড়া কোন বাধাদানকারী নেই’। উক্ত দু‘আ উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যখন এ কথা বলে, তখন বলা হবে,

 هُدِيتَ وَكُفِيتَ وَوُقِيتَ فَتَتَنَحَّى لَهُ الشَّيَاطِينُ فَيَقُولُ لَهُ شَيْطَانٌ آخَرُ كَيْفَ لَكَ بِرَجُلٍ قَدْ هُدِىَ وَكُفِىَ وَوُقِىَ

‘তুমি হেদায়াতপ্রাপ্ত হলে, যথেষ্ট হলে এবং বেঁচে গেলে, তখন শয়তান তার থেকে দূরে সরে গেল। তখন আরেকজন শয়তান বলবে, কেমন হবে সে ব্যক্তি যাকে হেদায়াত দেয়া হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে এবং তাকে হেফাযত করা হয়েছে’?[৯] উম্মু সালামা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বর্ণনা করেন, রাসূলূল্লাহ (ﷺ) যখন ঘর থেকে বের হতেন তখন বলতেন,

بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ اللَّهُمَّ إِنَّا نَعُوْذُ بِكَ مِنْ أَنْ نَزِلَّ أَوْ نَضِلَّ أَوْ نَظْلِمَ أَوْ نُظْلَمَ أَوْ نَجْهَلَ أَوْ يُجْهَلَ عَلَيْنَا

‘(বের হচ্ছি) আল্লাহর নামে, আল্লাহর উপর আমি ভরসা করলাম। হে আল্লাহ! আমরা আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি পদস্খলন হতে কিংবা পথভ্রষ্টতা হতে কিংবা যুলুম করা হতে কিংবা অত্যাচারিত হওয়া হতে কিংবা অজ্ঞতাবশত কারো প্রতি মন্দ আচরণ হতে বা আমাদের প্রতি কারো অজ্ঞতা প্রসূত আচরণ হতে’।[১০]

৬- মসজিদে যাওয়ার সময় রাস্তায় এবং ছালাতে আঙ্গুল না ফোটান

মসজিদের শিষ্টাচার হিসাবে এটি একটি ব্যক্তিক্রম দিকনির্দেশনা। কেননা আঙ্গুল ফোটানো অলসতা ও অবসাদগ্রস্ততার মাধ্যম। আর এমতাবস্তায় এটা নিষেধ করার কারণ হলো ছালাত অবস্থায় যেন অলসতা কাউকে আটকাতে না পারে। উল্লেখ্য, অলসতার মাধ্যম যেখানে নিষেধ সেখানে ছালাতের ক্ষেত্রে অলসতা করার কি কোন সুযোগ আছে? কা‘ব ইবনু ‘উজরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন,

«إِذَا تَوَضَّأَ أَحَدُكُمْ فَأَحْسَنَ وُضُوْءَهُ ثُمَّ خَرَجَ عَامِدًا إِلَى الْمَسْجِدِ فَلَا يُشَبِّكَنَّ بَيْنَ أَصَابِعِهِ فَإِنَّهُ فِىْ صَلَاةٍ».

‘যখন তোমাদের কেউ সুন্দরভাবে ওযূ করে, তারপর সে মসজিদের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়, সে যেন তার আঙ্গুলগুলো না ফুটায়। কারণ, সে এখন ছালাতরত’।[১১]

৭- ধীরস্থিরতার সাথে মসজিদে গমন করা

মসজিদে যাওয়ার সময় শান্ত-সৃষ্ট, ধীরস্থিরতা এবং গাম্ভীর্যের সাথে গমন করা সুন্নাহ। অনেকে রাক‘আত পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করেন, আবার কেউ কেউ দৌড়িয়ে মসজিদে আসেন। এটা মসজিদের আদব নয়। বরং স্বাভাবিক গতিতে আসাই মসজিদের আদব, যদিও জামা‘আত শেষ হয়ে যায়। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

«إِذَا سَمِعْتُمُ الْإِقَامَةَ فَامْشُوْا إِلَى الصَّلَاةِ، وَعَلَيْكُمْ بِالسَّكِيْنَةِ وَالْوَقَارِ وَلَا تُسْرِعُوْا، فَمَا أَدْرَكْتُمْ فَصَلُّوْا وَمَا فَاتَكُمْ فَأَتِمُّوْا».


‘যখন তোমরা ইক্বামত শুনতে পাবে, তখন ছালাতের দিকে চলে আসবে, তোমাদের উচিত স্থিরতা ও গাম্ভীর্য অবলম্বন করা। তাড়াহুড়া করবে না। ইমামের সাথে যতটুকু পাও তা আদায় করবে, আর যা ছুটে যায় তা পূর্ণ করবে’।[১২] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

«إِذَا أُقِيْمَتِ الصَّلَاةُ فَلَا تَأْتُوْهَا تَسْعَوْنَ وَأْتُوْهَا تَمْشُوْنَ وَعَلَيْكُمُ السَّكِيْنَةُ فَمَا أَدْرَكْتُمْ فَصَلُّوْا وَمَا فَاتَكُمْ فَأَتِمُّوْا».

‘যখন ছালাত শুরু হয়, তখন দৌড়িয়ে ছালাতে আসবে না, বরং হেঁটে ছালাতে আসবে। ছালাতে ধীর-স্থিরভাবে যাওয়া তোমাদের জন্য অপরিহার্য। কাজেই জামা‘আতের সাথে ছালাত যতটুকু পাও আদায় কর, আর যা ছুটে গেছে, পরে তা পূর্ণ করে নাও’।[১৩]

উল্লিখিত হাদীছে শান্ত-সৃষ্ট ও নমনীয়তার সাথে ছালাতে উপস্থিত হওয়ার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে এবং দৌড়ে ছালাতে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। জুমু‘আর ছালাত হোক বা অন্য যে কোন ছালাত হোক না কেন। প্রথম তাকবীর পাক বা না পাক সর্বাবস্থায় তাড়াহুড়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

৮- সম্ভব হলে মসজিদে প্রবেশ করার পূর্বে জুতাদ্বয় পরিষ্কার করা

মসজিদে প্রবেশ করার পূর্বে জুতাদ্বয় ভালোভাবে দেখে নেবে। যদি তাতে কোন নাপাক কিছু থাকে তাহলে, তা মাটি দ্বারা মুছে নেবে। এটা শরী‘আতের নির্দেশ। আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন,

«إِذَا جَاءَ أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَلْيَنْظُرْ فَإِنْ رَأَى فِىْ نَعْلَيْهِ قَذَرًا أَوْ أَذًى فَلْيَمْسَحْهُ وَلْيُصَلِّ فِيْهِمَا».


‘যখন তোমরা মসজিদে আসবে, তোমরা তোমাদের জুতার দিকে দেখ, যদি তোমরা তাতে কোন নাপাক বা ময়লা দেখ, তা মুছে ফেল এবং জুতাসহ ছালাত আদায় কর’।[১৪] এমনকি মাটিতে মাসাহ করার দ্বারা জুতাদ্বয় পাক হয়ে যায়।[১৫]

৯- ডান পা বাড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করা এবং এ দু‘আ পড়া

এটা মসজিদের অন্যতম আদব। কেননা রাসূল (ﷺ) প্রত্যেক ভাল কাজের শুরু ডান দিক দিয়ে করতেন। এমনিভাবে মসজিদে প্রবেশের সময়ও ডান পা দিয়ে প্রবেশ করতেন। ‘আয়িশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, নবী করীম (ﷺ) নিজের সমস্ত কাজ ডানদিক হতে আরম্ভ করা পসন্দ করতেন। তাহারাত অর্জন, মাথা আঁচড়ানো এবং জুতা পরার সময়ও।[১৬] এ হাদীছের শিরোনামে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) এভাবে বলেছেন, بَابُ التَّيَمُّنِ فِىْ دُخُوْلِ الْمَسْجِدِ وَغَيْرِهِ ‘মসজিদে প্রবেশ ও অন্যান্য কাজ ডান দিক হতে শুরু করা অধ্যায়’। ছাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) (মসজিদে) প্রবেশের সময় ডান পা দিয়ে শুরু করতেন এবং বের হবার সময় প্রথম বাম পা দিয়ে শুরু করতেন।[১৭]

রাসূল (ﷺ) মসজিদে প্রবেশের সময় বেশ কয়েকটি দু‘আ পাঠ করতেন। ‘আমর ইবনুল ‘আস (ﷺ) বলেন, রাসূল (ﷺ) যখন মসজিদে প্রবেশ করতেন তখন বলতেন,

أَعُوْذُ بِاللهِ الْعَظِيْمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيْمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ

‘আমি মহান আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তান হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যিনি সর্বদা রাজত্বের এবং মর্যাদাপূর্ণ চেহারার অধিকারী’।[১৮] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করবে তখন সে যেন বলে, اَللّهُمَّ افْتَحْ لِيْ اَبْوَابَ رَحْمَتِكَ ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার জন্য আপনার রহমতের দরজাসমূহ খুলে দিন’।[১৯]

১০- সালাম দিয়ে প্রবেশ করা

মসজিদে প্রবেশের সময় সালাম দিয়ে প্রবেশ করা মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি অন্যতম আদব। কেউ সালাম দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলে ছালাতরত ব্যক্তি মুখে সালামের উত্তর না দিয়ে নিজ আঙ্গুল, হাত বা মাথা দিয়ে ইশারা করে সালামের জবাব দিতে পারেন। সুহাইব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছালাতরত অবস্থায় আমি তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আমি তাঁকে সালাম দেই। অতঃপর তিনি ইশারা করে আমাকে উত্তর দেন’। রাবী বলেন, তিনি আঙ্গুলের ইশারা দ্বারা সালামের জবাব দিলেন।[২০]

১১- তাহিইয়্যাতুল মসজিদ দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করা

ছালাতের ওয়াক্ত হলে যখন মুয়াজ্জিনের আযানের পর মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন যদি ঐ ওয়াক্ত ছালাতের সুন্নাতে রাতেবাহ থাকে তাহলে সুন্নাতে রাতেবাহ পড়বে, আর যদি সুন্নাতে রাতেবা না থাকে, তাহলে আযান ও ইকামাতের মাঝের দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করে নেবে। তাহলে আর তাহিইয়্যাতুল মসজিদ আলাদা করে পড়তে হবে না। আর যদি ছালাতের ওয়াক্ত দাখিল হওয়ার পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করে, তাহলে তাকে অবশ্যই তাহিইয়্যাতুল মসজিদ দুই ছালাত আদায় করতে হবে। আবূ কাতাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেন, إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ الْمَسْجِدَ فَلَا يَجْلِسْ حَتَّى يُصَلِّىَ رَكْعَتَيْنِ ‘যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করে, সে যেন দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করা ব্যতীত মসজিদে না বসে’।[২১]

১২- অনর্থক কথা বলা থেকে বিরত থাকা

মসজিদে অবস্থানকালে অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। কারণ মানুষ যতক্ষণ মসজিদে থাকে ততক্ষণ ছালাতের মধ্যেই থাকে। সাহল ইবনু সা‘দ আস-সা‘দী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لَا يَزَالُ الْعَبْدُ فِىْ صَلَاةٍ مَا كَانَ فِى الْمَسْجِدِ يَنْتَظِرُ الصَّلَاةَ ‘বান্দা যতক্ষণ মসজিদে ছালাতের জন্য অপেক্ষমাণ থাকে, ততক্ষণ সে ছালাতের মধ্যে বলে গণ্য হয়’।[২২] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, কেউ ছালাত আদায় করে যতক্ষণ মুছল্লায় বসে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত ফিরিশতারা তার জন্য নিম্নরূপ দু‘আ করতে থাকে, اَللَّهُمَّ اغفِرْ لَهُ اَللَّهُمَّ ارْحَمْهُ ‘হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করে দিন, হে আল্লাহ! তার প্রতি দয়া করুন’।[২৩]

১৩- মানুষকে ডিঙ্গিয়ে সামনে না যাওয়া

মসজিদে যিনি আগে আসবেন তিনিই সামনে বসবেন, যদিও তিনি মান-সম্মান ও সম্পদের দিক থেকে দুর্বল হন। কিন্তু বর্তমান সমাজে অনেকে দুনিয়ার মান-সম্মানের অধিকারী হলেও মসজিদে আসেন সবার পরে কিন্তু তিনি সবাইকে ডিঙ্গিয়ে সামনে চলে যান, এটা মসজিদের আদবের বিপরীত। হাদীছে এসেছে, আবূয্ যাহিরিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كُنَّا مَعَ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُسْرٍ صَاحِبِ النَّبِىِّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَجَاءَ رَجُلٌ يَتَخَطَّى رِقَابَ النَّاسِ فَقَالَ عَبْدُ اللهِ بْنُ بُسْرٍ جَاءَ رَجُلٌ يَتَخَطَّى رِقَابَ النَّاسِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالنَّبِىُّ يَخْطُبُ فَقَالَ لَهُ النَّبِىُّ «اجْلِسْ فَقَدْ آذَيْتَ».


‘একদা জুমু‘আহর দিনে আমরা নবী (ﷺ)-এর ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু বুসর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে লোকদের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। আব্দুল্লাহ ইবনু বুসর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, একদা জুমু‘আহর দিন এক ব্যক্তি লোকদের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। নবী (ﷺ) তখন খুত্ববাহ দিচ্ছিলেন। নবী (ﷺ) বললেন, তুমি বসো, তুমি লোকদের কষ্ট দিয়েছো’।[২৪]

১৪- মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় বাম পা সামনে বাড়াবে

কারণ, রাসূল (ﷺ) তার সাধ্য অনুযায়ী পবিত্রতা অর্জন, মাথা আঁচড়ানো, জুতা পরিধানসহ ইত্যাদি সব বিষয়ে ডান দিককে অধিক পসন্দ করেন। ইবনু ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) যখন মসজিদে প্রবেশ করতেন ডান পা দিয়ে শুরু করতেন এবং যখন বের হতেন, তখন বাম পা দিয়ে আরম্ভ করতেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, সুন্নত হল, যখন তুমি মসজিদে প্রবেশ করবে, ডান পা দিয়ে আরম্ভ করবে, আর যখন বের হবে, তখন বাম পা দিয়ে বের হবে এবং এ দু‘আ পড়বে, اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ ‘হে আল্লাহ! আপনার নিকটে আপনার অনুগ্রহ চাই’।[২৫]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র:
[১]. ইমাম মুসলিম, আস-সাহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫৩, হাদীছ নং-৬৫৪; মিশকাত, হা/১০৭২।
[২]. সূরাহ আন-নিসা : ৪৩।
[৩]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩০৮।
[৪]. ইমাম আবূ দাঊদ, আস-সুনান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৮৭, হাদীছ নং-৩৮২২।
[৫]. ইমাম মুসলিম, আস-সাহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৯৪, হাদীছ নং-৫৬৩।
[৬]. সূরাহ আল-আ‘রাফ : ৩১।
[৭]. আবুল কাসিম সুলাইমান ইবনু আহমাদ আত-তাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত, ৯ম খণ্ড (কায়রো: দারুল হারামাইন, ১৪১৫ হি.), পৃ. ১৪৪, হাদীছ নং-৯৩৬৮।
[৮]. আল-মুসতাদরাক ‘আলাস সহীহাইন, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২০১, হাদীছ নং-৭৩৬৫।
[৯]. ইমাম আবূ দাঊদ, আস-সুনান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৪৬, হাদীছ নং-৫০৯৫।
[১০]. আবূ ঈসা মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা আত-তিরমিযী, সুনান আত-তিরমিযী, ৫ম খণ্ড (বৈরূত: দারু ইহইয়াইত তুরাসিল ‘আরাবী, তাবি), পৃ. ৪৯০, হাদীছ নং-৩৪২৭।
[১১]. সুনান আত-তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৮, হাদীছ নং-৩৮৬।
[১২]. ছহীহুল বুখারী, হাদীছ নং-৬৩৬।
[১৩]. ইমাম মুসলিম, আস-সাহীহ, ১ম খণ্ড পৃ. ৪২০, হাদীছ নং-৬০২; সুনানু আবী দাঊদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১২, হাদীছ নং-৫৭২; মিশকাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫১, হাদীছ নং-৬৮৬।
[১৪]. ইমাম আবূ দাঊদ, আস-সুনান, ১ম খণ্ড পৃ. ২৩৭, হাদীছ নং-৬৫০।
[১৫]. আল-মুস্তাদরাক ‘আলাস সহীহাইন, ১ম খণ্ড পৃ. ২৭১, হাদীছ নং-৫৯০।
[১৬]. ছহীহুল বুখারী, হাদীছ নং-৪২৬।
[১৭]. প্রাগুক্ত, ‘কিতাবুস সালাত’-৮, অনুচ্ছেদ-৪৭।
[১৮]. ইমাম আবূ দাঊদ, আস-সুনান, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮০, হাদীছ নং-৪৬৬।
[১৯]. ইমাম মুসলিম, আস-সাহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৯৪, হাদীছ নং-৭১৩।
[২০]. ইমাম আবূ দাঊদ, আস-সুনান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩০৬, হাদীছ নং-৯২৫।
[২১]. ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩১১, হাদীছ নং-২২৭০৫।
[২২]. ছহীহুল বুখারী, হাদীছ নং-১৭৬।
[২৩]. প্রাগুক্ত, হাদীছ নং-৪৪৫।
[২৪]. সুনানু আবী দাঊদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬০, হাদীস নং-১১১৮।
[২৫]. ইমাম মুসলিম, আস-সাহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৯৪, হাদীছ নং-৭১৩।




প্রসঙ্গসমূহ »: মসজিদ
কর্যে হাসানাহ প্রদানের গুরুত্ব ও ফযীলত - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
বিদ‘আত পরিচিতি (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মসজিদ: ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের ঈমান বনাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ঈমান : একটি পর্যালোচনা - ড. আব্দুল্লাহিল কাফী বিন লুৎফর রহমান মাদানী
দু‘আ ও যিকর : আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৮ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আলো ও অন্ধকার (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
বিদ‘আত পরিচিতি (২৫ তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ