ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা
-মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান*
ভূমিকা
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা পূরণে ইসলামের ভূমিকা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ। শরীর ও মন সুস্থ থাকার নামই স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে মহান আল্লাহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করেছেন। মানুষ সুস্থ অবস্থায় স্বাস্থ্য সম্পর্কে তেমন সচেতন হয় না, গুরুত্ব দেয় না। অসুস্থ হলে দিশেহারা হয়ে যায়। এ জন্য মহান আল্লাহ প্রদত্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নে‘মত দুধ, মধু, পানি, কালোজিরা, খেজুর, ফল-মূল, শাক-সবজি এবং মসলা জাতীয় দ্রব্য ও ঔষধী গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ ও উপকারিতা জেনে সুস্থ থাকার জন্য আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। আল্লাহ প্রদত্ত এ নে‘মতগুলো কখনও আমাদের প্রতারিত করবে না।
কুরআন-সুন্নাহ ও বিজ্ঞানের আলোকে চিকিৎসা
ইসলাম বাস্তবমুখী পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন বিধান। মানব জাতির এমন কোন সমস্যা নেই যে ইসলাম তার সমাধান দেয়নি। মানুষ শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে ইসলাম তার জন্য দিয়েছে বৈজ্ঞানিক সমাধান। আর সেটা হল- মহান আল্লাহ প্রদত্ত অফুরন্ত নে‘মত ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ, গোশত, ডিম ও দুধ ইত্যাদি। যার পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা ভালভাবে অবগত হয়ে নিজের চিকিৎসা সাধ্যমত নিজে নিজে করা। সর্বদা এ ভরসা রাখা যে, আল্লাহ তা‘আলাই রোগ নিরাময়ের একমাত্র মালিক। একবিংশ শতাব্দীর চরম উন্নতির যুগেও অনেক রোগের এখনও প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে কোন রোগই দুরারোগ্য নয়। একমাত্র শেফাদানকারী আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি রোগের প্রতিষেধক সৃষ্টি করেছেন। তাই কোনভাবে আরোগ্য থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। প্রত্যেক রোগের জন্য ঔষধ রয়েছে। সুতরাং সঠিক ঔষধ যখন রোগের জন্য ব্যবহৃত হবে তখন আল্লাহর হুকুমে রোগী রোগমুক্ত হবে ইনশা-আল্লাহ।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের আলোকে চিকিৎসা
সকল রোগের মহৌষধ আল-কুরআন। মানব মনের সকল প্রকার অসুস্থতা, কলুষ-কালিমা, অশুভ চিন্তা, শঠতা, ধৃষ্টতা, অবাধ্যতা, বর্বরতা, কৃপণতা, অসভ্যতা ও পাশবিকতা ইত্যাদি সকল বিষয়ের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক রোগের প্রতিষেধক মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(১)
وَ نُنَزِّلُ مِنَ الۡقُرۡاٰنِ مَا ہُوَ شِفَآءٌ وَّ رَحۡمَۃٌ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ
‘আমরা এমন কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যা ঈমানদারদের জন্য শেফা বা রোগমুক্তি ও রহমত স্বরূপ’ (সূরা বানী ঈসরঈল : ৮২)। তাইতো কুরআনকে রোগ নিরাময়ের ‘ব্যবস্থাপত্র’ বলা হয়।
(২)
اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ- خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ عَلَقٍ- اِقۡرَاۡ وَ رَبُّکَ الۡاَکۡرَمُ – الَّذِیۡ عَلَّمَ بِالۡقَلَمِ – عَلَّمَ الۡاِنۡسَانَ مَا لَمۡ یَعۡلَمۡ
‘(হে নবী!) আপনি পড়ুন, আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে। পাঠ করুন এবং আপনার প্রভু মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না’ (সূরা আল-‘আলাক্ব : ১-৫)। অতএব সকল ব্যাপারে জ্ঞানার্জন করতে হবে।
(৩)
وَ لَنَبۡلُوَنَّکُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ
‘অবশ্যই আমরা তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, জান ও মালের ক্ষতি এবং ফল-ফসলাদির বিনষ্টের মাধ্যমে। আর সুসংবাদ ধৈর্যশীলদের জন্য’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৫৬)।
(৪) বারবার সূরা ফাতিহা পড়ে ফুঁক দিলে সাপের বিষ নেমে যায়।[১] সাপ অথবা বিষাক্ত পোকা-বিচ্ছুর কামড়ে সূরা ফাতিহা পড়ে মুখের থুথু রোগীর ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিতে হবে। এভাবে বারবার পড়তে থাকলে ও থুথু লাগাতে থাকলে বিষ নেমে যাবে ইনশাআল্লাহ।[২]
(৫) ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) বলেন, وَ اِذَا مَرِضۡتُ فَہُوَ یَشۡفِیۡنِ ‘রোগাক্রান্ত হলে আল্লাহ আমাকে রোগমুক্ত করেন’ (সূরা আশ-শু‘আরা : ৮০)। অতএব যে কোন রোগ বা অসুস্থতার জন্য মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।
(৬) চিকিৎসার ব্যাপারে ইসলাম ৩টি পথ অবলম্বন করেছে। যেমন- (ক) স্বাস্থ্যের হেফাযত করা (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৪)। (খ) রোগব্যাধি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা (সূরা আন-নিসা : ৪৩)। (গ) রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা করা (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৬)।
(৭) আল-কুরআনে সৃষ্টিতত্ত্ব ও চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কিত আয়াত আছে প্রায় ৩৬০টি। শুধু চিকিৎসা বিষয়ক আয়াতের সংখ্যাই প্রায় ২৪১ টি।[৩] উল্লেখ্য যে, পবিত্র কুরআনের যেকোন অংশ পড়ে ফুঁক দেয়া যাবে। কেননা কুরআনকে আল্লাহ তা‘আলা ‘শিফা’ বা আরোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন (সূরা বানী ইসরাইল : ৮২)।
ছহীহ হাদীছের আলোকে চিকিৎসা
দ্বীন, শরীর, জ্ঞান, সম্পদ ও সম্মান হেফাযতের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর মানুষের দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা ব্যতীত শরীর ও জ্ঞানের হিফাযত সম্ভব নয়। দেহ মন ভাল না থাকলে ইবাদত সহ জীবনের সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বাস্থ্যকে মহান আল্লাহর এক ‘শ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন,
(১)
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم نِعْمَتَانِ مَغْبُوْنٌ فِيْهِمَا كَثِيْرٌ مِنَ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, দু’টি নে‘মতের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ ধোঁকার মধ্যে রয়েছে। তাহল সুস্থতা ও অবসর’।[৪]
(২)
عَنْ عَمْرِو بْنِ مَيْمُوْنٍ الْأَوْدِيِّ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لِرَجُلٍ وَهُوَ يَعِظُهُ اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ
আমর ইবনু মায়মূন আল-আওদী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ স্বরূপ বলেন, পাঁচটি বস্তুর পূর্বে পাঁচটি বস্তুকে গণীমত মনে করবে। যথা : তোমার বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে, পীড়িত হওয়ার পূর্বে সুস্বাস্থ্যকে, দারিদ্র্যতার পূর্বে সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে এবং মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে।[৫]
(৩)
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا عَنِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَا تَزُوْلُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيْمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيْمَا أَبْلَاهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيْمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ
ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আদম সন্তানকে স্ব স্ব স্থান থেকে এক কদমও নড়াতে দেয়া হবে না। যথা, সে তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে, যৌবনকাল কোথায় ব্যয় করেছে, ধন-সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে, কোন্ পথে তা ব্যয় করেছে এবং সে দ্বীনের কতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে এবং অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী সে আমল করেছে কিনা।[৬]
(৪) عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم خَمْسٌ مِنَ الْفِطْرَةِ قَصُّ الشَّارِبِ وَنَتْفُ الْإِبْطِ وَتَقْلِيْمُ الْأَظْفَارِ وَالْاِسْتِحْدَادُ وَالْخِتَانُ
(৪) আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ৫টি ফিতরাত বা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। যথা : গোঁফ ছোট করা, বগলের লোম পরিষ্কার করা, নখ কাটা, গোপন স্থানের লোম পরিষ্কার করা এবং খাতনা করা।[৭]
(৫)
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ الشِّفَاءُ فِىْ ثَلَاثَةٍ شَرْبَةِ عَسَلٍ وَشَرْطَةِ مِحْجَمٍ وَكَيَّةِ نَارٍ وَأَنْهَى أُمَّتِىْ عَنِ الْكَىِّ
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তিনটি জিনিসের মধ্যে রোগমুক্তি আছে। যথা মধুপানে, শিঙ্গা লাগানোতে এবং আগুন দিয়ে দাগ লাগানোতে। তবে আমি আমার উম্মতকে আগুন দিয়ে দাগ লাগানো নিষেধ করেছি।[৮]
(৬)
عَنْ سَلَمَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللهِ بْنِ مِحْصَنٍ الْخَطْمِىِّ عَنْ أَبِيْهِ وَكَانَتْ لَهُ صُحْبَةٌ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمْ آمِنًا فِىْ سِرْبِهِ مُعَافًى فِىْ جَسَدِهِ عِنْدَهُ قُوْتُ يَوْمِهِ فَكَأَنَّمَا حِيْزَتْ لَهُ الدُّنْيَا
সালামা ইবনু ওবায়দুল্লাহ ইবনু মিহছান আল-খাত্বমী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, যিনি আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ছাহাবী ছিলেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় ভোর করল যে, সে শরীর সুস্থ ও নিরাপদ এবং তার নিকট সারাদিনের খাবার সঞ্চিত রয়েছে। তাহলে তার জন্য গোটা দুনিয়া যোগাড় করে দেয়া হয়েছে।[৯]
(৭)
عَنْ مُعَاذَ بْنَ رِفَاعَةَ أَخْبَرَهُ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ قَامَ أَبُوْ بَكْرٍ الصِّدِّيْقُ عَلَى الْمِنْبَرِ ثُمَّ بَكَى فَقَالَ قَامَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَامَ الْأَوَّلِ عَلَى الْمِنْبَرِ ثُمَّ بَكَى فَقَالَ سَلُوا اللهَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فَإِنَّ أَحَدًا لَمْ يُعْطَ بَعْدَ الْيَقِيْنِ خَيْرًا مِنَ الْعَافِيَةِ
মু‘আয ইবনু রিফা‘আহ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করে বলেন, আবু বকর ছিদ্দীক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মিম্বরের উপরে দাঁড়ালেন অতঃপর কাঁদলেন। তখন তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতের প্রথম বছরে মিম্বারে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলেন এবং বলেছিলেন, তোমরা আল্লাহর নিকট থেকে ক্ষমা ও সুস্বাস্থ্য প্রার্থনা কর। কেননা ঈমানরূপী দৌলতের পর কাউকে স্বাস্থ্যের চেয়ে উত্তম আর কোন দৌলত দেয়া হয়নি।[১০]
(৮) জনৈক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন, أَلْقِ عَنْكَ شَعْرَ الْكُفْرِ وَاخْتَتِنْ ‘তুমি কুফরীর চুল ফেলে দাও, খাৎনা কর’।[১১] খাৎনা করা মানুষের ফিতরাত বা স্বভাবজাত ৫টি বিষয়ের অন্যতম।[১২] খাৎনার মধ্যে প্রভূত স্বাস্থ্যগত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ বিষয়ে সকল স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী একমত। এজন্যই তো আল্লাহর হুকুমে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ৮০ বছর বয়সে খাৎনা করেছিলেন।[১৩]
(৯) আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
بَيْنَا رَجُلٌ يَمْشِىْ فَاشْتَدَّ عَلَيْهِ الْعَطَشُ فَنَزَلَ بِئْرًا فَشَرِبَ مِنْهَا ثُمَّ خَرَجَ فَإِذَا هُوَ بِكَلْبٍ يَلْهَثُ يَأْكُلُ الثَّرَى مِنَ الْعَطَشِ فَقَالَ لَقَدْ بَلَغَ هَذَا مِثْلُ الَّذِىْ بَلَغَ بِىْ فَمَلَأ خُفَّهُ ثُمَّ أَمْسَكَهُ بِفِيْهِ ثُمَّ رَقِىَ فَسَقَى الْكَلْبَ فَشَكَرَ اللهُ لَهُ فَغَفَرَ لَهُ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَإِنَّ لَنَا فِى الْبَهَائِمِ أَجْرًا قَالَ فِىْ كُلِّ كَبِدٍ رَطْبَةٍ أَجْرٌ
‘একজন লোক রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তার ভীষণ পিপাসা লাগল। সে কূপে নেমে পানি পান করল। এরপর সে বের হয়ে দেখতে পেল যে, একটা কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং পিপাসায় কাতর হয়ে মাটি চাটছে। সে ভাবল, কুকুরটারও আমার মত পিপাসা লেগেছে। সে কূপের মধ্যে নামল এবং নিজের মোজা ভরে পানি নিয়ে মুখ দিয়ে সেটি ধরে উপরে উঠে এসে কুকুরটিকে পানি পান করাল। আল্লাহ তা‘আলা তার আমল কবুল করলেন এবং আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! চতুষ্পদ জন্তুর উপকার করলেও কি আমাদের ছওয়াব হবে? তিনি বললেন, প্রত্যেক প্রাণীর উপকার করাতেই পূণ্য রয়েছে’।[১৪] অন্যত্র তিনি বলেন,
بَيْنَمَا كَلْبٌ يُطِيْفُ بِرَكِيَّةٍ كَادَ يَقْتُلُهُ الْعَطَشُ إِذْ رَأَتْهُ بَغِىٌّ مِنْ بَغَايَا بَنِىْ إِسْرَائِيْلَ فَنَزَعَتْ مُوْقَهَا فَسَقَتْهُ فَغُفِرَ لَهَا بِهِ
‘একবার একটি কুকুর এক কূপের চতুর্দিকে ঘুরছিল এবং অত্যন্ত পিপাসার কারণে সে মৃত্যুর কাছে পৌঁছেছিল। তখন বানী ইসরাঈলের ব্যভিচারিণীদের একজন কুকুরটির অবস্থা লক্ষ্য করল এবং তার পায়ের মোজা দিয়ে পানি সংগ্রহ করে কুকুরটিকে পান করাল। এ কাজের বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন’।[১৫] এ সমস্ত হাদীছের আলোকে হাঁস, মুরগী, গরু-ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বেড়াল ইত্যাদি গৃহপালিত প্রাণীর খাবার ও চিকিৎসা করা ভাল কাজ।
(১০) জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لِكُلِّ دَاءٍ دَوَاءٌ فَإِذَا أُصِيْبَ دَوَاءُ الدَّاءِ بَرَأَ بِإِذْنِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘প্রত্যেক রোগের ঔষধ রয়েছে। যখন সেটা পৌঁছে যায়, তখন সে আল্লাহর হুকুমে রোগ মুক্ত হয়’।[১৬]
(১১) জিনের আছর হলে কুরআন-হাদীছ দ্বারা ঝাড়ফুঁক করে চিকিৎসা নেয়া যাবে।[১৭] এছাড়া আরও কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। যেমন- (১) ‘আঊযুবিল্লা-হি মিনাশ শাইত্ব-নির রজীম’ পাঠ করা।[১৮] (২) পবিত্র কুরআনের শেষ দু’টি সূরা নাস ও ফালাক্ব পড়ে ঝাড়-ফুঁক করা।[১৯] (৩) আয়াতুল কুরসী পাঠ করা।[২০] (৪) সূরা বাক্বারাহ তেলাওয়াত করা যায়।[২১] (৫) সূরা বাক্বারাহর শেষ দু’টি আয়াত বেশী বেশী পাঠ করা যায়।[২২] তবে তাবীয, সূতা-নাড়া ও কড়ি, গাছ-গাছড়া ঝুলানো, দরজা-জানালায় কাগজ লিখে বন্ধ করে দেয়া, সীমানায় অথবা যে কোন স্থানে খুঁটি বা লোহা পোঁতাও শিরক। শিরকী কালেমা বা কথা অথবা মন্ত্র দ্বারা ঝাড়ফুঁক করাও শিরক।[২৩]
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* চাঁদপুর, খুলনা।।
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০০৭।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২২০১।
[৩]. অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ুম, দৈনিক ইত্তেফাক, ৩১ ভাদ্র, ১৪০৭।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১২, ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়; তিরমিযী, হা/২৩০৪; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৭০; মিশকাত, হা/৫১৫৫।
[৫]. হাকিম, হা/৭৮৪৬; মিশকাত হা/৫১৭৪; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/১০৭৭।
[৬]. তিরমিযী, হা/২৪১৭; মিশকাত হা/৫১৯৭; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯৪৬।
[৭]. নাসাঈ, হা/৫২২৫; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘ হা/৩২৫০।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৮১ ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়-৭৬, ‘নিরাময় আছে তিনটি জিনিসে’ অনুচ্ছেদ-৩।
[৯]. তিরমিযী, হা/২৩৪৬; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৪১; মিশকাত, হা/৫১৯১; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৩১৮।
[১০]. তিরমিযী, হা/৩৫৫৮; মিশকাত, হা/২৪৮৯, সনদ ছহীহ।
[১১]. আবূ দাঊদ, হা/৩৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৪৭০; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৯৭৭।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৮৯১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৭; মিশকাত, হা/৪৪২০।
[১৩]. اخْتَتَنَ إِبْرَاهِيْمُ عَلَيْهِ السَّلَامُ وَهْوَ ابْنُ ثَمَانِيْنَ سَنَةً بِالْقَدُّوْمِ- ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৫৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৭০; মিশকাত, হা/৫৭০৩।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২৩৬৩; মিশকাত, হা/১৯০২।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৬৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২২৪৫।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২০৪; মিশকাত, হা/৪৫১৫।
[১৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৩৬ ‘সূরা ফাতিহার দ্বারা ফুঁক দেয়া’ অনুচ্ছেদ-৩৩, ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়-৭৬।
[১৮]. সূরা আল-আ‘রাফ : ২০০; ছহীহ বুখারী, হা/৬১১৫; ইবনু হিব্বান, হা/৫৬৯২; মিশকাত, হা/২৪১৮।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৩৮ ‘কুরআন পড়ে অথবা সূরা নাস ও ফালাক্ব পড়ে ফুঁক দেয়া’ অনুচ্ছেদ-৩২, ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়-৭৬; তিরমিযী, হা/২০৫৮, সনদ ছহীহ।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/২৩১১।
[২১]. لَا تَجْعَلُوْا بُيُوْتَكُمْ مَقَابِرَ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِىْ تُقْرَأُ فِيْهِ سُوْرَةُ الْبَقَرَةِ -ছহীহ মুসলিম, হা/৭৮০; তিরমিযী, হা/২৮৭৭; মিশকাত, হা/২১১৯ ।
[২২]. তিরমিযী, হা/২৮৮২; দারেমী, হা/৩৪৫০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৯১১; মিশকাত, হা/২১৪৫; সনদ ছহীহ, ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৪৬৭।
[২৩]. আবু দাউদ, হা/৩৮৮৩; ইবনু মাজাহ, হা/৩৫৩০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৬১৫; মিশকাত, হা/৪৫৫২; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহা হা/৪৯২।