পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমের শ্রেষ্ঠত্ব
মূল : ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ)
অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান*
(২য় কিস্তি)
হুমাইদ বিন যানজুওয়াইহ (রাহিমাহুল্লাহ) নু‘আইম ইবনু আবূ হিন্দ থেকে আরো বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘তোমরা জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা কর, যার দ্বারা তোমরা জলে এবং স্থলে সঠিক পথের সন্ধান পাবে, অতঃপর এতটুকুতেই বিরত থাক। তোমরা নিজেদের বংশধারার ব্যাপারে জ্ঞানার্জন কর, যাতে করে তোমাদের বংশীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতে পার। তোমরা সে সকল মহিলাদের পরিচয় সম্পর্কে জান, যাদেরকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে এবং যাদেরকে হারাম করা হয়েছে। তারপর থেমে যাও’।[১]
মিস‘আর (রাহিমাহুল্লাহ) মুহাম্মাদ ইবনু উবাইদুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, تَعَلَّمُوْا النُّجُوْمَ مَا تَعْرِفُوْنَ بِهِ الْقِبْلَةَ وَ الطَّرِيْقَ ‘তোমরা জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা কর, যার দ্বারা তোমরা ক্বিবলা এবং পথের সন্ধান জানতে পার’।[২] ইমাম নাখঈ (রাহিমাহুল্লাহ) পথের দিশা পাওয়ার জন্য কোন ব্যক্তির জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা করাকে দোষের কিছু মনে করতেন না।[৩]
ইমাম আহমাদ ও ইসহাক (রাহিমাহুল্লাহ) চাঁদের কক্ষপথ সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন। হারব (রাহিমাহুল্লাহ) তাদের থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। তবে ইসহাক্ব (রাহিমাহুল্লাহ) একটু অতিরিক্ত বলেছেন যে, ঐ সকল নক্ষত্ররাজির নাম সম্পর্কে জানা যাবে, যার দ্বারা পথের সন্ধান পাওয়া যায়।[৪]
ক্বাতাদাহ (রাহিমাহুল্লাহ) চাঁদের কক্ষপথ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করাকে অপসন্দ করতেন। ইবনু ‘উয়াইনাও এ ব্যাপারে অনুমতি দেননি। হারব (রাহিমাহুল্লাহ) তাদের থেকে এমনটিই বর্ণনা করেছেন।[৫]
তবে এই মতামতগুলো ‘তারকারাজির প্রভাব’ শাস্ত্রের উপর প্রযোজ্য হবে, নক্ষত্রের মাধ্যমে দিক নির্ণয়’ শাস্ত্রের উপর নয়। কেননা তারকারাজির প্রভাব শাস্ত্রের সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা হারাম। এক্ষেত্রে একটি মারফু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, যাতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,مَنِ اقْتَبَسَ عِلْمًا مِنَ النُّجُوْمِ اقْتَبَسَ شُعْبَةً مِنَ السِّحْرِ زَادَ مَا زَادَ ‘যে ব্যক্তি জ্যোতিষীর জ্ঞান শিক্ষা করল, সে যাদু বিদ্যার একটা শাখা শিক্ষা করল। তা যতো বৃদ্ধি পাবে, যাদু বিদ্যাও ততো বাড়বে’। ইমাম আবূ দাঊদ (রাহিমাহুল্লাহ) ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে মারফু সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন’।[৬] অনুরূপভাবে তিনি ক্বাবীছার হাদীছটিও বর্ণনা করেছেন, যাতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, الْعِيَافَةُ وَالطِّيَرَةُ وَالطَّرْقُ مِنَ الْجِبْتِ ‘পাখীর সাহায্যে ভাল-মন্দ নির্ণয় করা, কোন কিছুকে অশুভ লক্ষণ ভাবা এবং মাটিতে রেখা টেনে শুভ-অশুভ লক্ষণ নির্ণয় করা কুফুরী’।[৭]
الْعِيَافَةُ হচ্ছে- ‘পাখি উড়িয়ে শুভ-অশুভ লক্ষণ নির্ণয় করা। আর الطَّرْقُহল- মাটিতে রেখা টেনে শুভ-অশুভ লক্ষণ নির্ণয় করা। অতএব তারকারাজির প্রভাব শাস্ত্রের উপর জ্ঞানার্জন করা বাতিলের অন্তর্ভুক্ত ও হারাম এবং তা অনুযায়ী আমল করা তারকারাজীর নৈকট্য লাভের ন্যায়; আর এগুলোর নৈকট্য অর্জন করা কফুরী।
ক্বিবলা ও পথ-ঘাট চেনার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে প্রয়োজানুযায়ী জ্ঞানার্জন করা জমহুর আলেমদের নিকট জায়েয, তবে এর চেয়ে বেশি জানার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ এগুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে গেলে এমন বিষয় থেকে ব্যস্ত করে ফেলবে, যা জানা তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কখনো কখনো এ ব্যাপারে সূক্ষ্ম জ্ঞানার্জন বিভিন্ন শহরে মুসলিম যুদ্ধাদের ব্যাপারে খারাপ ধারণার সৃষ্টি করে, যা অতীতে এবং বর্তমানেও অনেক আহলে ইলমদের ব্যাপারে ঘটেছে। আবার কখনো কখনো বিভিন্ন এলাকায় ছাহাবা ও তাবেঈদের ছালাতের ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপারে ভুল আক্বীদার দিকে ধাবিত করে, আর এগুলো বাতিলের অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) রাশিচক্রের দ্বারা দিকনির্দেশনা নেয়াকে অপসন্দ করতেন। তিনি বলেন, হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,مَا بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ قِبْلَةٌ ‘পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যবর্তী স্থানে কিবলা অবস্থিত’।[৮]
রাশিচক্র বা তারকারাজির দ্বারা দিক নির্দেশনার ব্যাপারে কিছুই বর্ণিত হয়নি। ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) কা’ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নক্ষত্রসমূহ ঘুরা সম্পর্কিত মতামতকে অস্বীকার করেছেন। ইমাম মালেক ও অন্যরাও মতটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ‘বিভিন্ন শহরে ছায়ার ভিন্নতা ঘটে’ জ্যোতির্বিদদের এই মতটিকেও ইমাম আহমাদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ বিষয়টিকে তাদের অস্বীকার করার কারণ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ বিষয়ে কিছুই বলেননি, যদিও জ্যোতির্বিদরা দৃঢ়তার সাথে বলে থাকে। কখনো কখনো এসব বিষয়ে লিপ্ত থাকাটা ব্যাপক ফাসাদের দিকে ধাবিত করে।
‘শেষ তৃতীয়াংশে মহান আল্লাহ প্রথম আসমানে অবতরণ করেন’[৯] মর্মে বর্ণিত হাদীছটির ব্যাপারে কিছু জ্যোতির্বিদ আপত্তি করে বলেছে যে, শহরের ভিন্নতার কারণে রাতের শেষ তৃতীয়াংশও ভিন্ন হয়, তাই নির্দিষ্ট সময়ে অবতরণ করা সম্ভব নয়!
অথচ ইসলামে এ ধরনের আপত্তি খুবই মারাত্মক। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তার সুপথপ্রাপ্ত খলীফাগণ কারো কাছ থেকে এ ধরনের আপত্তি শুনলে তার সাথে বিতর্কে না জড়িয়ে তাকে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করতেন এবং তাকে মুনাফিক্ব ও মিথ্যাবাদীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করতেন।
এমনিভাবে কুলজিশাস্ত্রেও[১০] জ্ঞানার্জনের বিস্তৃত ক্ষেত্র রয়েছে, যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার কোন প্রয়োজন নেই। ইতিপূর্বে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও অন্যদের থেকে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। তবে ছাহাবা ও তাবেঈদের একটি দল কুলজিশাস্ত্র সম্পর্কে জানতেন এবং এ বিষয়ে তারা গুরুত্বারোপও করতেন।
এমনিভাবে আরবি ভাষাতত্ত্ব ও ব্যাকরণশাস্ত্রেও জ্ঞানার্জনের বিস্তৃত ক্ষেত্র রয়েছে, যা অর্জন করতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ ইলম শিক্ষা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং উপকারী ইলম হতে বঞ্চিত হতে হবে। ক্বাসেম বিন মুখাইমারা ইলমে নাহুকে অপসন্দ করতেন এবং তিনি বলতেন, أَوَّلُهُ شُغْلٌ وَ آخِرُهُ بَغْيٌ ‘এর শুরুটা হল ব্যস্ততা আর শেষটা হল বাড়াবাড়ি’।[১১] এর দ্বারা তিনি নাহু বিষয়ে অতিরিক্ত জ্ঞানার্জনকে উদ্দেশ্য করেছেন।
এজন্যই ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) ভাষাতত্ত্ব ও দুর্লব ভাষাকে অপসন্দ করেছেন। এ ব্যাপারে আবূ উবাইদের অতিরিক্ত পা-িত্যকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, এসব বিষয় তাকে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইলম অর্জন থেকে বিরত রাখবে।[১২] তাই বলা হয়, বাক্যের মধ্যে আরবী ভাষার অবস্থান, খাবারের মধ্যে লবনের অবস্থানের ন্যায়। অর্থাৎ আরবী ভাষা ততটুকু জানতে হবে, যা দ্বারা বাক্য বিশুদ্ধ হয়। যেমন খাবার সুস্বাদু হওয়ার জন্য প্রয়োজন মত লবণ দিতে হয়। আর অতিরিক্ত হলে তা খাবারের স্বাদ নষ্ট করে দেয় ।
এমনিভাবে অংকশাস্ত্রও ততটুকু জানতে হবে, যার দ্বারা ফারায়েয, অছীয়ত এবং উত্তরাধিকারীদের মাঝে সম্পদ বণ্টনের হিসাব জানা যায়। তাছাড়া এর বাহিরে যা আছে তা কোন উপকারের নয়, বরং তা তো মস্তিস্কের অনুশীলন এবং মস্তিস্ককে মসৃণকরণ মাত্র; যা জানার কোন প্রয়োজন নেই। বরং সেগুলো অর্জন করতে গেলে তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ ইলম আহরণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
ছাহাবীদের পরবর্তী যুগে যেসব ইলম আবিস্কৃত হয়েছে এবং কিছু লোক সে বিষয়ে পা-িত্য অর্জন করে সেগুলোকে ইলম বলে আখ্যায়িত করেছে এবং যারা তা অর্জন করেনি তাদেরকে মূর্খ মনে করেছে, এ সবকিছুই বিদ‘আত। আর এর সবই নিষিদ্ধ নব আবিষ্কৃত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
নব আবিষ্কৃত ইলম
১). মু‘তাযিলারা ক্বদরের ক্ষেত্রে নতুন নতুন কিছু কথা বলেছে এবং আল্লাহর ক্ষেত্রে উপমা পেশ করেছে। অথচ ক্বদরের ব্যাপারে খোঁজাখুঁজি করতে নিষেধ করা হয়েছে। ছহীহ ইবনু হিব্বান এবং হাকেমে ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لَا يَزَالُ أَمْرُ هَذِهِ الْأُمَّةِ مُوَافِيًا وَمُقَارِبًا مَا لَمْ يَتَكَلَّمُوْا فِيْ الْوِلْدَانِ وَ الْقَدْرِ.
‘এ উম্মতের বিষয়াদি সর্বদায় পূর্ণাঙ্গ ও মধ্যম হিসাবে থাকবে, যতক্ষণ না তারা শিশু[১৩] ও তাক্বদীরের ব্যাপারে সমালোচনা না করবে’।[১৪]
কখনো কখনো মাওকূফ হিসাবেও বর্ণিত হয়েছে, আবার কেউ মাওকূফকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।[১৫] ইমাম বায়হাক্বী ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে মারফু‘ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,إِذَا ذُكِرَ أَصْحَابِيْ فَأَمْسِكُوْا وَإِذَا ذُكِرَتِ النُّجُوْمُ فَأَمْسِكُوْا ‘যখন আমার ছাহাবীদের ব্যাপারে আলোচনা করা হবে তখন তোমরা চুপ থাকবে, তারকারাজির ব্যাপারে আলোচনা করা হলেও তোমরা চুপ থাকবে’।[১৬] হাদীছটি বহু সনদে বর্ণিত হয়েছে, তবে কোন সনদই সমালোচনা মুক্ত নয়।[১৭]
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি মাইমুন ইবনু মিহরানকে বলেন, ‘তুমি তারকারাজি পর্যক্ষেণ করা থেকে বেঁচে থাকবে, কেননা তা পৌরহিত্যের (গণকের পেশা) দিকে আহ্বান করে। তুমি ক্বদরের ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা তা নাস্তিক্যতার দিকে আহবান করে। তুমি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ছাহাবীদেরকে গালি দেয়া থেকে বিরত থাকবে, অন্যথায় আল্লাহ তোমার চেহারাকে উপুর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।[১৮] আবূ নু‘আইম হাদীছটি মারফু‘ সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তবে মারফু‘ হওয়ার দাবিটি সঠিক নয়।
ক্বদরের ব্যাপারে বাদানুবাদ করা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ
১). আল্লাহর কিতাবের কতকাংশকে কতকাংশের বিরুদ্ধে পেশ করা। তাক্বদীরকে স্বীকারকারীরা একটি আয়াত দ্বারা দলীল পেশ করে, আবার তার অস্বীকারকারীরা অন্য আয়াত দ্বারা দলীল দিয়ে থাকে, আর এভাবেই কুরআনের ক্ষেত্রে বাদানুবাদ সৃষ্টি হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে এমন ঘটনা ঘটেছে মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায় এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতে রাগান্বিত হয়ে তা থেকে নিষেধ করেছিলেন।[১৯]
২). বিবেক দ্বারা ক্বদরকে সাব্যস্ত অথবা অস্বীকার করা নিয়ে বাদানুবাদে নিমগ্ন হয়ে যাওয়া, যেমন ক্বাদরিয়ারা[২০] বলে, ‘যদি তিনি তাক্বদীর নির্ধারন করে রাখেন আর পরবর্তীতে বিচার করে শাস্তি দেন, তাহলে তো তিনি যালিম হয়ে যাবেন। আর তাদের বিরোধিতাকারীরা[২১] বলে, আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে তাদের কাজের উপর বাধ্য করেন। এ রকম আরো নানা রকম কথা তারা বলে থাকে।
৩). তাক্বদীরের গোপন বিষয়ে অনুসন্ধান করা। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং অন্যান্য সালাফগণ তাক্বদীদের গোপন বিষয় নিয়ে খোঁজাখুঁজি করা থেকে নিষেধ করেছেন। কারণ বান্দা কখনো তাক্বদীদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে পারে না।
আরো কিছু নব আবিস্কৃত বিষয়
মু‘তাযিলা ও তাদের অনুসারীরা আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী নিয়ে যুক্তির মাধ্যমে নতুন যে সমালোচনার অবতারণা করেছে, তা তাক্বদীরের ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকেও জঘন্য। কেননা তাক্বদীরের ব্যাপারে কথা বলা হল তার কার্যাবলীর ক্ষেত্রে কথা বলা, কিন্তু এটা তো তাঁর সত্তা ও গুণাবলী নিয়ে কথা বলা।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* অধ্যয়নরত, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা মুনাওয়ারাহ, সঊদী আরব।
[১]. প্রথমাংশটুকু উল্লেখিত শব্দে হারব আল-কিরমানী তার ‘মাসায়েল’ গ্রন্থের ৫৯৫ পৃষ্ঠায় নু‘আইম ইবনু আবূ হিন্দ আল-আশজায়ীর সূত্রে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন, তবে নু‘আইম ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে শুনেননি; মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, ৫ম খ-, পৃ. ২৪০, হা/২৫৬৪৯; ইবনু আব্দুল বার, জামেঈ বায়ানিল ইলম ও ফাযলিহ, ২য় খ-, পৃ. ৭৯১, হা/১৪৭৪, শব্দাবলি হল- تَعَلَّمُوْا مِنَ ا لنِّجُوْمِ مَا تَهْتَدُوْنَ بِهِ فِيْ ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ثُمَّ اَمْسِكُوْا ‘তোমরা জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা কর, যার দ্বারা তোমরা অন্ধকারে জলে-স্থলে সঠিক পথের সন্ধান পাবে, অতঃপর এতটুকুতেই বিরত থাক’। আবু নাদরাহ আল-মুরযির ইবনু মালেক সূত্রে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন। তবে আবূ নাদরা ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে শুনেননি।-দ্র. হান্নাদ বিন সারিই, আয-যুহুদ, ২য় খ-, পৃ. ৪৮। শব্দাবলি হল-تَعَلَّمُوْا مِنَ النِّجُوْمِ مَا تَهْتَدُوْنَ بِهَا وَ تَعَلَّمُوْا مِنَ الْأَنْسَابِ مَا تُوَاصِلُوْنَ بِهَا ‘তোমরা জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা কর, যার দ্বারা তোমরা সঠিক পথের সন্ধান পাবে, তোমর বংশধারার ব্যাপারে জ্ঞানার্জন কর, যাতে করে তোমরা বংশীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতে পার’।
ওমর বিন আল-ক্বা‘ক্বা‘য়ে আদ-দবয়ী সূত্রে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন। অথচ সে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাক্ষাৎ পাননি। মোটকথা হল সানাদের বিচ্ছিন্নতার কারণে আছারটি বিশুদ্ধ নয়।
[২]. হারব আল-কিরমানী, মাসায়েল, পৃ. ৫৯৫, হা/১৩০৭; মুহাম্মাদ ইবনু উবাইদুল্লাহ সূত্রে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে, তবে বিচ্ছিন্নতার কারনে সনদ যঈফ। মুহাম্মাদ ইবনু উবাইদুল্লাহর কুনিয়াত হল আবূ আউন আস-সাক্বাফী, তিনি ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে হাদীছ শুনেননি।-দ্র. তাহযীবুল কামাল, ২৬তম খ-, পৃ. ৩৮।
[৩]. ইবনু আবী শায়বা, মুসান্নাফ, হা/২৫৬৪৭; হারব আল-কিরমানী, মাসায়েল, পৃ. ৫৯৫; মানসুর ইবনু আল-মু‘তামীর সূত্রে ইবরাহীম আন-নাখঈ থেকে। এ আছারটি ছহীহ।
[৪]. হারব আল-কিরমানী, মাসায়েল, পৃ. ৫৯৫; ইবনু তাইমিয়াহ, শারহুল উমদাহ, পৃ. ৫৫৩।
[৫]. হারব আল-কিরমানী, মাসায়েল, পৃ. ৫৯৫। ক্বাতাদাহ্র আছারটি উত্তম।
[৬]. আবূ দাউদ, হা/৩৯০৫; ইবনু মাজাহ, হা/৩৭২৬, সনদটিকে যারা ছহীহ বলেছেন; ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা, মাজমুউল ফাতাওয়া, ৩৫তম খ-, পৃ. ১৯৩; ইরাক্কী, তাখরীজুল ইহয়া, ৪র্থ খ-, পৃ. ১৪৪; আহমাদ শাকের, তাহক্বীকে মুসনাদে আহমাদ, ৪র্থ খ-, পৃ. ৩০২।
[৭]. আবূ দাউদ, হা/৩৯০৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৯১৫; সনদ যঈফ; যঈফুল জামে‘, হা/৩৯০০।
الطيرة দ্বারা উদ্দেশ্য হল- পক্ষীকুলকে উড়িয়ে তার নাম, আওয়াজ ও চলাচলের মাধ্যমে অশুভ লক্ষণ নির্ণয় করা। যেমন ঈগলকে শাস্তি লক্ষণের প্রতীক এবং কাককে একাকিত্বের প্রতীক মনে করা হয়।
[৮]. তিরমিযী, হা/৩৪৪; ইবনু মাজাহু হা/১০১১, হাদীছটি আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, হাদীছটির সনদ হাসান ছহীহ; ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ)ও তার সাথে একমত পোষন করেছেন, নাইলুল আওতার, ২য় খ-, পৃ. ১৭৯; শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)ও ছহীহ বলেছেন, ইরওয়া, পৃ. ২৯২।
[৯]. লেখক আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীছটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ يَقُوْلُ مَنْ يَدْعُوْنِيْ فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِيْ فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِيْ فَأَغْفِرَ لَهُ. ‘মহামহিম আল্লাহ তাআ‘লা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটতম আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন; কে আছে এমন যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে এমন যে আমার নিকট চাইবে, আমি তাকে তা দিব। কে আছে এমন যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দিব (ছহীহ বুখারী হা/ ১১৪৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৫৮)।
[১০]. কুলজিশাস্ত্র হল মানুষের বংশানুক্রমিক ইতিহাস। কুলজি শব্দটি সংস্কৃত ‘কুলপঞ্জি’ শব্দ থেকে উদ্ভব; দ্র. ইউকিপিডিয়া।
[১১]. খতিব বাগদাদী, ইক্বতিযাউল ইলমিল আমাল, পৃ. ৯১, হা/১৫০; ইবনু আসাকীর, তারীখে দামেস্ক, ২৪তম খ-, পৃ. ২৬৭, সনদে ওয়ালীদ বিন মুসলিম আছে, যে অনেক তাদলীস এবং তাসবিয়্যাকারী ছিলেন। তিনি ‘আন-‘আন করেও বর্ণনা করেন, তিনি সুস্পষ্ট ভাবে হাদীছ বর্ণনা করতে পারতেন না।
[১২]. শারহু ইলালিত তিরমিযী, ১ম খ-, পৃ. ৩৪৬।
[১৩]. ইবনু হিব্বান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, শিশু দ্বারা মুশরিকদের ছোট ছোট বাচ্চা এবং আখিরাতে তাদের অবস্থান কোথায় হবে তা উদ্দেশ্য। হায়ছামী, মাওয়ারীদুয যাম‘আন, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৬৪।
[১৪]. ইবনু হিব্বান তার ছহীহায় مُوَائِمًا أَوْ مُقَارِبًاশব্দে বর্ণনা করেছেন, ছহীহ ইবনু হিব্বান, ১৫তম খ-, পৃ. ১১৮, হা/৬৭২৪; হাকেম মুসতাদরাকে مُؤَامِرًا أَوْ مُقَارِبًا শব্দে বর্ণিত হয়েছে, মুসতাদরাক হাকেম, ১ম খ-, পৃ. ৮৮, হা/৯৩; ত্বাবারানী আওসাত্বেمُتَقَارِبًا أَوْ مُوَاتِيًا শব্দে বর্ণিত হয়েছে, ত্বাবারানী আওসাত্ব, ৪র্থ খ-, পৃ. ২৪১, হা/৪০, ৮৬; হাকেম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, বুখারী-মুসলিমের শর্তে ছহীহ এবং আমি তার কোন ইল্লত সম্পর্কে অবগত নয়। ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ)ও তার সাথে একমত পোষন করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মারফু করার বিষয়ে অন্তরে একটু খটকা আছে, তাহযীবুস সুনান, ১২তম খ-, পৃ. ৪৯০; শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৫১৫।
[১৫]. ফিরইয়াবী, ক্বদর, পৃ. ২৯১; ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে মাওকুফ হিসাবে, সনদ ছহীহ।
[১৬]. ইমাম বায়হাক্বী, আল-ক্বাজা ওয়াল ক্বাদার, পৃ. ২৯১; মিস‘আর আ‘মাশ আবূ ওয়েলের সূত্রে ইবনু মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে মারফু হিসাবে বর্ণনা করেন এবং তিনি বলেন, মিস‘আর ইবনু আব্দুল মালিক এই সনদে একাকি বর্ণনা করেছেন। ইবনু মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা), জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু), এবং ছাওবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে, তবে সবকটি সনদই যঈফ।
[১৭]. ইমাম ত্বাবারাণী, কাবীর, ১০ম খ-, পৃ. ১৯৮; আবূ নু‘আইম, হিলয়া, ৪র্থ খ-, পৃ. ১০৮; বায়হাক্বীর উল্লিখিত সূত্রে, আল-খারাইতী ‘মাসাবিল আখলাক’, হা/৭৪০; আল-লালিকায়ী, শারহু উসুলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ্, ১ম খ-, পৃ. ১৪২; আবূ কুহযামের সনদে আবূ ক্বিলাবা সূত্রে ইবনু মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে মারফু হিসাবে, তবে সনদে ইনক্বিতা আছে। শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) তার সনদকে ছহীহ বলেছেন, ‘ছহীহাহ’ হা/৩৪।
[১৮]. আল-লালাকায়ী, শারহু উসুলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ, ৪র্থ খ-, পৃ. ৭০০, মাইমুন ইবনু মিহরান সূত্রে, তিনি বলেন, ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আমাকে বললেন, সনদে নু‘আইম ইবনু হাম্মাদ আছে, যিনি সত্যবাদী; তবে অনেক ভুল করতেন, যেমনটি হাফেজ ইবনু হাজার বলেছেন, আত-তাক্বরীব, পৃ. ৫৬৪; ইবনুল মুক্বরী, মু‘জাম, সাঈদ বিন জোবায়ের সূত্রে ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে, পৃ. ২৫০।
[১৯]. লেখক সেই হাদীছের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যা আমর বিন শু‘আইব তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, خَرَجَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى أَصْحَابِهِ وَهُمْ يَخْتَصِمُوْنَ فِيْ الْقَدْرِ. فَكَأَنَّمَا يُفْقَأُ فِيْ وَجْهِهِ حَبُّ الرُّمَّانِ مِنَ الْغَضَبِ. فَقَالَ بِهَذَا أُمِرْتُمْ أَوْ لِهَذَا خُلِقْتُمْ ؟ تَضْرِبُوْنَ الْقُرْآنَ بَعْضَهُ بِبَعْضٍ. بِهَذَا هَلَكَتِ الْأُمَمُ قَبْلَكُمْ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা ছাহাবীদের নিকট বের হয়ে এলেন। এমতাবস্থায় তারা তাক্বদীর সম্পর্কে বাদানুবাদ করছিলেন। ফলে রাগে তার চেহারা এমন লাল বর্ণ ধারণ করল, যেন ডালিমের দানা তাঁর মুখম-লে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। অত:পর তিনি বললেন, ‘তোমাদেরকে কি এ কাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে অথবা এর জন্য কি তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে? তোমরাও কুরআনের কতকাংশকে কতকাংশের বিরুদ্ধে পেশ করছ, অথচ একারণেই তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতরা ধ্বংস হয়েছে’। দ্র. ইবনু মাজাহ, হা/৮৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৬৬৮, সনদ হাসান।
[২০]. এরা তাক্বদীরকে অস্বীকারকারী সম্প্রদায়। তারা বলে, সবকিছুই তাৎক্ষণিক সৃষ্টি হয়, আর আল্লাহ তা‘আলা সবকিছুর অবস্থা জানেন না তবে ঘটার পরেই কেবল জানেন! আল্লাহ তা‘আলা তাদের ধারণা থেকে অনেক উঁচু ও মহান।
[২১]. এরা হল জাবারিয়্যাহ। যারা বলে, আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে তাদের কাজের উপর বাধ্য করেছেন। এক্ষেত্রে বান্দার কোন স্বাধীনতা ও ইচ্ছা নেই, সবকিছুর কর্তাতো কেবল আল্লাহ তা‘আলাই।