সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ১০:০০ অপরাহ্ন

মসজিদ : ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র

-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


মসজিদ ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র এবং পবিত্রতম স্থান। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মসজিদ একাধারে ইবাদাত-বন্দেগীর স্থান, সামাজিক ও ধর্মীয় মিলনায়তন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বিচার ও সম্প্রীতি লেন-দেনের মাধ্যম, নেতৃত্ব ও আনুগত্যের সূতিকাগার। এটি মুসলিমদের মিলন মেলা, যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ এক কাতারে দাঁড়ানোর মাধ্যমে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধের উন্মেষ ঘটে, সালাম, কুশল ও শ্রদ্ধা বিনিময় হয়। বৈষম্য দূরীভুত হয়। এতে পারস্পরিক আন্তরিকতা, স্নেহ ও ভালোবাসা জন্মায়। তাই মানুষের মধ্যে সাম্য ও একতা সৃষ্টিতে আমাদের সমাজে মসজিদের ভূমিকা অনন্য। সমাজে মানুষের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভালোবাসা ও সম্প্রীতি স্থাপনে এবং সমৃদ্ধ ও সুশীল সমাজ গঠনে মসজিদের ভূমিকা অপরিসীম। মসজিদ নির্মাণের বিনিময়ে পুরস্কার সরূপ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জান্নাতে ঘর নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছেন।[১]

মসজিদ হচ্ছে ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনের কেন্দ্র। এখান থেকেই ইলম ও আমল, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং ইসলামী দাওয়াতও জিহাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। কেননা পরিবারের পরেই ইসলাম সমাজের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট হচ্ছে মসজিদ। এটাকে মুসলিম সমাজের সামষ্টিক কেন্দ্রও বলা যেতে পারে। মসজিদ থেকেই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে দিক নির্দেশনা নিতে হবে। তাই মসজিদকে বহুমুখী ভূমিকা পালন করতে হয়। মসজিদকে তার আকাক্সিক্ষত ভূমিকা, পয়গাম ও কর্মসূচি খালি রাখলে তা প্রাণহীন হয়ে যাবে। ফলে গোটা সমসা ও রাষ্ট্র এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকবে। এক মসজিদে নববীই গোটা দুনিয়ায় কল্যাণ ও সমৃদ্ধির দ্বার উন্মোচন করেছিল। কিন্তু বর্তমান মুসলিম বিশ্বের কোটি কোটি মসজিদে সেই আবেদন ও প্রাণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সবই নির্জীব ও প্রভাবহীন হয়ে পড়েছে। সেগুলো আলোর খনি হওয়া সত্ত্বেও গোটা সমাজ ব্যবস্থা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। সুতরাং মসজিদগুলো যদি মসজিদে নববীর আদলে পুনরায় ভূমিকা পালন করে থাকে, তাহলে গোটা পৃথিবীতে আবারও ইসলামের কল্যাণকর প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হবে এবং জাহিলিয়াত থেকে মুক্তি পাবে। তাই বর্তমানে মসজিদের এই উচ্ছ্বসিত ভূমিকাকে পুনরায় পুনরুজ্জীবিত করা অত্যন্ত জরুরী।

মসজিদের প্রকৃতি

আরবী ভাষায় সিজদা দেয়ার স্থানকে মসজিদ (مسجد) বলা হয়। আল-কুরআনে শব্দটি মোট ১৮ বার এসেছে।[২] مسجد শব্দটির س বর্ণে সুকূণ ও  جবর্ণে যের একবচন এর বহুবচন مساجد। এর ইংরেজী প্রতিশব্দ গড়ংয়ঁব।[৩]  শব্দটি سجد يسجد থেকে বাবে نصر ينصر এর ইসমে জারফ এর সীগাহ। এর আভিধানিক অর্থ ‘সিজদার স্থান, সিজদার জায়গা, ইবাদতখানা,  فيه الذي يسجد الموضع  বা ‘যে স্থানে সিজদাহ করা হয়’।[৪] এটি স্থানবাচক শব্দ। আভিধানিক অর্থে যেখানে বান্দা আল্লাহর ইবাদতের জন্য সিজদা করে সেটাই মসজিদ। ব্যাপক অর্থে মুসলিমরা ছালাত আদায়ের জন্য যে ঘরে একত্রিত হয়। এঘরটি এমন একটি ঘর, যা পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট। ‘আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব’ প্রণেতা বলেন, الْجَبْهَة حَيْثُ يكون ندب السُّجُود ‘কপাল যেখানে সিজদার ক্ষতচিহ্ন হয়’।[৫]موضع السجود من الأرض ‘যমীনে সিজদার স্থান’।[৬] الموضعُ الذي يسجد منها وبيت الصلاة ‘যে স্থানে সিজদাহ করা হয় ও ছালাতের ঘর’।[৭] যুজাজ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, كل موضع يتعبد فيه فهو مسجِد ‘যেখানে ইবাদত করা হয় প্রত্যেক ঐ স্থানকে মসজিদ বলা হয়’।[৮] পরবর্তীতে এ শব্দের অর্থ ব্যাপকতা লাভ করে এর অর্থ হয়, ঐ ঘর যে ঘরকে মুসলিমদের ছালাত আদায় করার উদ্দেশ্যে একত্র হওয়ার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে।

শরী‘আতের পরিভাষায় মসজিদ বলা হয় জনসাধারণের ছালাত আদায়ের জন্য যে স্থানকে নির্ধারণ করা হয়েছে তাকে। আল্লামা যারকাশী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

ولـمـا كان السجود أشرف أفعال الصلاة، لقرب العبد من ربه، اشتق اسم المكان منه فقيل: مسجد، ولم يقولوا: مركع، ثم إن العُرف خصص المسجد بالمكان المهيّأ للصلوات الخمس، حتى يخرج المُصلّى المجتمع فيه للأعياد ونحوها، فلا يُعطى حكمه

‘ছালাতের কর্মসমূহের মধ্য হতে সিজদাহ আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্ম হওয়াতে ছালাত আদায়ের স্থানের নামকে সিজদাহ থেকেই নেয়া হয়েছে। এ কারণেই মসজিদকে মসজিদ বলা হয়ে থাকে, মারকা‘ مركع বলা হয় না। তারপর বর্তমানে মসজিদ শব্দটি ছালাতের জন্য নির্মিত স্থানের সাথেই খাছ। এ কারণেই লোকেরা ঈদের সময় ছালাত আদায়ের জন্য একসঙ্গে একত্র হয়; কিন্তু তাকে মসজিদ বলে না’।[৯] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, المكان الذي أعد للصلاة فيه على الدوام ‘স্থায়ীভাবে যে স্থানকে ছালাত আদায় করার জন্য নির্ধারণ করা হয়’।[১০]

‘ফিক্বহ বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে মসজিদ হল, اَلْبُيُوْتُ الْمَبْنِيَّةُ لِلصَّلَاةِ فِيْهَا لِلِه فَهِيَ خَالِصَةٌ لَهُ سُبْحَانَهُ وَلِعِبَادَتِهِ، ‘এমন ঘর, যা একমাত্র ছালাতের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। আর এটা একমাত্র আল্লাহর ও তাঁর ইবাদতের জন্যই নির্দিষ্ট’।[১১]

আর শারঈভাবে মৌলিক মসজিদ হল, যমীনের প্রত্যেক ঐ স্থান যেখানে একমাত্র আল্লাহর জন্য সিজদাহ করা হয়। এটি আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) ও তাঁর উম্মতের জন্য একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে মহানবী (ﷺ) বলেছেন, حَيْثُمَا أَدْرَكَتْكَ الصَّلَاةُ فَصَلِّ، وَالْأَرْضُ لَكَ مَسْجِدٌ ‘যেখানেই তোমার ছালাতের সময় হবে, সেখানেই তুমি ছালাত আদায় করে নিবে। কারণ গোটা পৃথিবী তোমার জন্য মসজিদ বা সিজদার স্থান’।[১২] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেন, وَجُعِلَتْ لِىَ الْأَرْضُ طَيِّبَةً طَهُوْرًا وَمَسْجِدًا ‘আমার জন্য গোটা পৃথিবী পবিত্র ও মসজিদ করা হয়েছে’।[১৩]

ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘শরী‘আত যে সমস্ত স্থানে ছালাত আদায় করার অনুমোদন দিয়েছে কেবল সেখানেই ছালাত আদায় করা বৈধ। তবে শরী‘আত কর্তৃক যে সমস্ত স্থানে ছালাত পড়া নিষিদ্ধ যেমন, কবরস্থান, অপবিত্র জায়গা, রাস্তায়, গোসলখানায় ইত্যাদি স্থান ব্যতীত সকল স্থানে ছালাত পড়া বৈধ’।[১৪]

সুতরাং ব্যবহারিক ও বাস্তবতার দৃষ্টিতে মসজিদ বলতে বুঝায়, যেখানে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার জন্য যে ঘর নির্মাণ করা হয়। এছাড়া পৃথিবীর সকল স্থানের মালিক হলেন আল্লাহ। সুতরাং আল্লাহর জন্য তাঁর বান্দা বা যমীনের যে কোন পবিত্রতম স্থানে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে। আর ওযূর জন্য কোন পানি না পেলে অথবা পানি ব্যবহারে অক্ষম হলে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে পবিত্র হতে পারবে (সূরাহ আন-নিসা: ৪৮)।

১. শরী‘আতে মসজিদের অবস্থান

ইসলামে মসজিদের অবস্থান ও মর্যাদা খুবই মহান ও তাৎপর্যপূর্ণ। এটি প্রতিটি মুমিনের জন্য একটি জীবন্ত প্রতিষ্ঠান। মুমিনের জীবনের সর্বক্ষেত্রে এর গভীর প্রভাব রয়েছে। মসজিদ শুধু ইবাদত-বন্দেগির জন্য নয়, এটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বটে। দুনিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট স্থান হলো মসজিদ। ইসলামের যাবতীয় শিক্ষা ও সামাজিক বিষয়াদী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করার স্থান হচ্ছে মসজিদ। এছাড়া মসজিদ মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও মুক্তির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও বটে। কেননা মুসলিম জীবনের গোটা জিন্দেগী মসজিদকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়ে থাকে। মসজিদের স্থাপত্য নির্মাণ ও তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে অপরিসীম মর্যাদা ও পুরস্কারের ব্যবস্থা। তাই মদীনায় গিয়ে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) প্রথমেই মসজিদ নির্মাণের কাজটি করেছিলেন। মসজিদে নববীতে জামা‘আতে ছালাত আদায় করা, মুসলিমদের মিলিত হওয়া এবং মিলিত হওয়ার কেন্দ্র। এতদ্ব্যতীত এটি ছিল শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, বিচার ব্যবস্থা এবং ফাতাওয়া জারি করা, মুসলিমদের বিভিন্ন বিষয়াবলী অধ্যয়ন করা এবং তাদের দ্বীনি বিষয়ে শিক্ষিত করার অনন্য স্থান। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فِیۡ  بُیُوۡتٍ اَذِنَ اللّٰہُ  اَنۡ تُرۡفَعَ وَ یُذۡکَرَ فِیۡہَا اسۡمُہٗ ۙ یُسَبِّحُ لَہٗ  فِیۡہَا بِالۡغُدُوِّ وَ الۡاٰصَالِ

‘সেসব গৃহে যাকে সমুন্নত করতে এবং যাতে তাঁর নামে যিকির করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে’ (সূরাহ আন-নূর: ৩৬)। উক্ত আয়াতে فِیۡ  بُیُوۡتٍ বলতে মসজিদকে বুঝানো হয়েছে।[১৫] হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, أَحَبُّ الْبِلَادِ إِلَى اللهِ مَسَاجِدُهَا وَأَبْغَضُ الْبِلَادِ إِلَى اللهِ أَسْوَاقُهَا ‘আল্লাহর নিকট স্থানসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রিয় স্থান হল মসজিদসমূহ এবং সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য স্থান হল বাজারসমূহ’।[১৬] এক্ষণে নিম্নে ইসলামী শরী‘আতে মসজিদের অবস্থানের স্বরূপ পর্যালোচনা করা হল:

১- মসজিদ আল্লাহর ঘর

মসজিদ আল্লাহ তা‘আলার ঘরসমূহের মধ্যে একটি ঘর। তিনি পৃথিবীতে মানুষের জন্য বায়তুল হারামকে সর্বপ্রথম মসজিদ হিসাবে তৈরি করেছেন, তাঁকে সম্মানিত করেছেন এবং তাঁর দ্বীনকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّ اَوَّلَ بَیۡتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیۡ بِبَکَّۃَ مُبٰرَکًا  وَّ ہُدًی  لِّلۡعٰلَمِیۡنَ ‘নিশ্চয় সর্বপ্রথম গৃহ, যা মানবমণ্ডলীর জন্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা ঐ ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত; ওটা বরকতময় এবং বিশ্ববাসীর জন্য পথ-প্রদর্শক’ (সূরাহ আলি ‘ইমরান: ৯৬)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, নিশ্চয় তিনি মানুষের জন্য অর্থাৎ গোটা মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম ঘর নির্মাণ করেছেন, যেখানে তারা ইবাদত করবে, কুরবানী দিবে, তাওয়াফ করবে, তার দিকে ফিরে ছালাত আদায় করবে এবং সেখানে ই‘তিকাফ তথা অবস্থান করবে। ‘তা ঐ ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত’ অর্থাৎ কা‘বা, যা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) নির্মাণ করেছিলেন’।[১৭]

পৃথিবীতে সর্বপ্রাচীন ঘর হলো আল-মাসজিদুল হারাম। যাকে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের কিবলা হিসাবে নির্বাচন করেছেন। আর তার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা সকল ধর্মকে পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন এবং কেউ এই ইসলাম ব্যতীত কোন দ্বীনকে গ্রহণ করে না। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قَدۡ نَرٰی تَقَلُّبَ وَجۡہِکَ فِی السَّمَآءِ ۚ فَلَنُوَلِّیَنَّکَ قِبۡلَۃً  تَرۡضٰہَا  ۪  فَوَلِّ وَجۡہَکَ شَطۡرَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ؕ  وَ حَیۡثُ مَا کُنۡتُمۡ   فَوَلُّوۡا  وُجُوۡہَکُمۡ شَطۡرَہٗ ؕ وَ  اِنَّ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ لَیَعۡلَمُوۡنَ اَنَّہُ  الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّہِمۡ ؕ وَ مَا اللّٰہُ بِغَافِلٍ عَمَّا یَعۡمَلُوۡنَ

‘নিশ্চয় আমরা আকাশের দিকে আপনার মুখমণ্ডল উত্তোলন প্রত্যক্ষ করছি। তাই আমরা আপনাকে ঐ কিবলাহ মুখীই করবো যা আপনি কামনা করছেন; অতএব আপনি মসজিদে হারামের দিকে (কা‘বার দিকে) আপনার মুখমণ্ডল ফিরিয়ে নিন এবং আপনারা যেখানে আছেন আপনাদের মুখ সে দিকেই প্রত্যাবর্তিত করুন; এবং আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তারা অবশ্যই অবগত আছে যে, নিশ্চয় এটা তাদের প্রতিপালকেন নিকট হতে সত্য এবং তারা যা করছে তদ্বিষয়ে আল্লাহ অমনোযোগী নন’ (সূরাহ আল-বাক্বারাহ: ১৪৪)।

আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর মধ্যে এই মসজিদকে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ করেছেন। সর্বোত্তম উম্মত তথা উম্মতে মুহাম্মাদী ও উত্তম দ্বীন তথা ইসলামের অনুসারীদের জন্য ক্বিবলা করেছেন। মুসলিমগণ প্রত্যেক মসজিদে ছালাতের সময় এই মসজিদের দিকে তাদের মুখমণ্ডল ফিরায়। এটা সকল মসজিদের জন্য সমন্ধিত যেমন সকল মুছল্লীদের জন্য ইমাম সমন্ধিত। এখানেই শরী‘আতে মসজিদের অবস্থান ও আল্লাহর নিকট তার মর্যাদা সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। আল্লাহ তা‘আলা সকল মসজিদকে সম্মানিত করেছেন, তা নির্মাণের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। সেখানে ছালাত আদায় করা ও তাঁর যিকির করার কেন্দ্রস্থল হিসাবে গণ্য করেছেন। শাহাদাতাইনের পরে ইবাতের রুকনসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেখানে ইবাদত-বন্দেগী করা। আর এটিই হলো তাঁর দাসত্ব ও স্মরণের মূলভিত্তি। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

فِیۡ  بُیُوۡتٍ اَذِنَ اللّٰہُ  اَنۡ تُرۡفَعَ وَ یُذۡکَرَ فِیۡہَا اسۡمُہٗ ۙ یُسَبِّحُ لَہٗ  فِیۡہَا بِالۡغُدُوِّ وَ الۡاٰصَالِ- رِجَالٌ ۙ لَّا تُلۡہِیۡہِمۡ تِجَارَۃٌ  وَّ لَا بَیۡعٌ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰہِ وَ  اِقَامِ الصَّلٰوۃِ  وَ  اِیۡتَآءِ الزَّکٰوۃِ ۪ۙ یَخَافُوۡنَ یَوۡمًا تَتَقَلَّبُ فِیۡہِ الۡقُلُوۡبُ وَ الۡاَبۡصَارُ

‘সেসব গৃহে যাকে সমুন্নত করতে এবং যাতে তাঁর নাম যিকির করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, সে সব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর যিকির হতে এবং ছালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান হতে বিরত রাখতে পারে না, তারা ভয় করে সে দিনকে যে দিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে’ (সূরাহ আন-নূর: ৩৬-৩৭)।

আল্লাহ তা‘আলা সবকিছুর মালিক। মসজিদের মালিকানাও তাঁর দিকে সম্বন্ধযুক্ত। তিনি ছাড়া এর মালিক কেউ নয়। যেমন ইবাদত তথা দাসত্ব হবে কেবল আল্লাহ জন্য অন্য কাউকে তাঁর সাথে শরীক করা জায়েয নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اَنَّ  الۡمَسٰجِدَ لِلّٰہِ  فَلَا تَدۡعُوۡا مَعَ اللّٰہِ  اَحَدًا ‘এবং নিশ্চয় মসজিদ তথা সিজদার স্থানসমূহ (সমস্ত ইবাদত) আল্লাহরই জন্য। সুতরাং আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে ডেক না’ (সূরাহ আল-জিন্ন: ১৮)। উক্ত আয়াতে الۡمَسٰجِدَ দ্বারা أماكن الصلاة ‘ছালাতের স্থানসমূহ’-কে বুঝানো হয়েছে।[১৮] ক্বাতাদা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইহুদী-খ্রিস্টানরা যখন তাদের গীর্জায় প্রবেশ করত তখন সেখানে তারা ক্রয়-বিক্রয় করত এবং আল্লাহর সাথে শিরক করত। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী (ﷺ)-কে মসজিদে প্রবেশ করে খুলূছিয়্যাতের সাথে ইবাদত করার নির্দেশ প্রদান  করেন’।[১৯]

অতএব প্রমাণিত হল যে, মসজিদগুলো আল্লাহরই ঘর। সুতরাং তিনি সেসবের মধ্যে যা ইচ্ছা আইন প্রণয়ন করেন, সেটা তাদের নির্মাণের সাথে সম্পর্কযুক্ত অথবা সেগুলো কিভাবে নির্মিত হয়েছে তা হোক কিংবা যা তিনি বাধ্যতামূলক করেছেন তা হোক। কোন্টা জায়েয, কোন্টা অপসন্দনীয়, আর কোন্টা হারাম। তাই মানুষের মধ্যে কারোরই আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত মসজিদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। তাই যে কেউ তাতে হস্তক্ষেপ করে যা আল্লাহর অনুমতি দেননি, সে তার সীমালঙ্ঘন করেছে। এখানেই বায়তুল হারাম মসজিদ ও যে সকল মসজিদ নবী-রাসূলগণ ও তাদের অনুসারী মুমিন বান্দারা নির্মাণ করেছেন, আল্লাহর নিকট সকল মসজিদের অবস্থান প্রস্ফুটিত হয়।  আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اِذۡ یَرۡفَعُ  اِبۡرٰہٖمُ  الۡقَوَاعِدَ مِنَ الۡبَیۡتِ وَ اِسۡمٰعِیۡلُ ؕ رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ  - رَبَّنَا وَ اجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَیۡنِ لَکَ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِنَاۤ اُمَّۃً مُّسۡلِمَۃً  لَّکَ ۪ وَ اَرِنَا مَنَاسِکَنَا وَ تُبۡ عَلَیۡنَا ۚ اِنَّکَ اَنۡتَ التَّوَّابُ الرَّحِیۡمُ

‘যখন ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ও ইসমা‘ঈল (আলাইহিস সালাম) কা‘বার ভিত্তি উত্তোলন করছিলেন, (তখন বলেন,) হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ হতে এটা গ্রহণ করুন, নিশ্চয় আপনি মহা শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী। হে আমাদের প্রভু! আমাদের উভয়কে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধরদের মধ্য হতেও আপনার অনুগত একদল লোক সৃষ্টি করুন, আর আমাদেরকে ইবাদতের আহকাম বলে দিন এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হোন, নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, করুণাময়’ (সূরাহ আল-বাক্বারাহ: ১২৭-১২৮)। পৃথিবীর অন্য সকল মসজিদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّمَا یَعۡمُرُ مَسٰجِدَ اللّٰہِ مَنۡ اٰمَنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ اَقَامَ الصَّلٰوۃَ  وَ اٰتَی الزَّکٰوۃَ وَ لَمۡ یَخۡشَ اِلَّا اللّٰہَ فَعَسٰۤی اُولٰٓئِکَ اَنۡ یَّکُوۡنُوۡا مِنَ الۡمُہۡتَدِیۡنَ

‘হ্যাঁ, আল্লাহর মসজিদগুলো আবাদ তারাই করবে, যারা আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়ন করে এবং ছালাত আদায় করে ও যাকাত প্রদান করে, আর আল্লাহ ছাড়া কাউকেও ভয় করে না, বস্তুত এ সকল লোক সম্বন্ধে আশা যে, তারা হেদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (সূরাহ আত-তাওবাহ: ১৮)।

আল্লাহ তা‘আলা  ওয়াদা করেছেন যে, যে ব্যক্তি পৃথিবীতে আল্লাহর ঘর তথা আল্লাহর জন্য মসজিদ বানাবে তিনি তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন। যেমন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, ‘উছমান ইবনু ‘আফফান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, مَنْ بَنَى مَسْجِدًا لِلهِ بَنَى اللهُ لَهُ فِى الْجَنَّةِ مِثْلَهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একটি মসজিদ তৈরি করব আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ একটি ঘর তৈরি করবেন’।[২০]

ফিরিশতাগণের সাক্ষ্যের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট মসজিদের অবস্থান ফুটে উঠে। এজন্য মসজিদকে যাবতীয় অপবিত্রতা, খারাবী, নোংরা-আবর্জনা থেকে পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ প্রদান করেছেন। কেননা তার মাধ্যমে যেন ফিরিশতাগণ ও ছালাত আদায়কারী সেখানে কষ্ট না পায়। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে,

عَنْ جَابِرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ نَهَى رَسُوْلُ اللهِ عَنْ أَكْلِ الْبَصَلِ وَالْكُرَّاثِ. فَغَلَبَتْنَا الْحَاجَةُ فَأَكَلْنَا مِنْهَا فَقَالَ «مَنْ أَكَلَ مِنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ الْمُنْتِنَةِ فَلاَ يَقْرَبَنَّ مَسْجِدَنَا فَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ تَأَذَّى مِمَّا يَتَأَذَّى مِنْهُ الإِنْسُ».


জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) পিঁয়াজ ও রসুন খেতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু কোন এক সময় প্রয়োজনের তাকীদে বাধ্য হয়ে তা খেলে তিনি বললেন, কেউ এসব দুর্গন্ধযুক্ত গাছ খেলে সে যেন আমাদের মসজিদের নিকটে না আসে। কেননা মানুষ যেসব জিনিসে কষ্ট পায় ফিরিশতাগণও সেসব জিনিসে কষ্ট পায়।[২১]

অতএব মসজিদসমূহ আল্লাহ তা‘আলার ঘর। সেখানে আল্লাহর কর্তৃক অনুমোদন ব্যতীত কোন কাজ করা যাবে না। আর আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা ঈমানদার তারাই কেবল মসজিদের প্রকৃত বাসিন্দা ও সংরক্ষণকারী।

২- মসজিদ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্তম্ভ

ইসলামে মসজিদের মর্যাদা এই বিষয়টি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হল এই মসজিদ। রাসূল (ﷺ) যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিলেন, তখন ‘কুবা’ নামক এলাকায় বনী ‘আমর ইবনে ‘আওফের আশেপাশে পৌঁছানোর পর তিনি মসজিদ নির্মাণ শুরু না করা পর্যন্ত সেখানে বসতি স্থাপন করেননি। কুবা মসজিদ, যা মদীনায় নির্মিত প্রথম মসজিদ এবং সাধারণ জনগণের জন্যও নির্মিত প্রথম মসজিদ। বিশ্ব ইতিহাসে এই মসজিদটি ‘তাক্বওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ’ হিসাবে স্বীকৃত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَمَسۡجِدٌ اُسِّسَ عَلَی التَّقۡوٰی مِنۡ اَوَّلِ  یَوۡمٍ اَحَقُّ  اَنۡ تَقُوۡمَ فِیۡہِ ؕ فِیۡہِ  رِجَالٌ یُّحِبُّوۡنَ اَنۡ یَّتَطَہَّرُوۡا ؕ وَ اللّٰہُ یُحِبُّ الۡمُطَّہِّرِیۡنَ

‘অবশ্য যে মসজিদের ভিত্তি পথম দিন হতেই তাক্বওয়ার উপর স্থাপিত হয়েছে তা এর উপযোগী যে, আপনি তাতে (ছালাতের জন্য) দাঁড়াবেন; সেখানে এমন সব লোক রয়েছে যারা উত্তমরূপে পবিত্র হওয়াকে পসন্দ করে, আর আল্লাহ উত্তমরূপে পবিত্রতা সম্পাদনকারীদেরকে পসন্দ করেন’ (সূরা আত-তাওবাহ: ১০৮)।

এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মসজিদ। যার প্রথম উদ্যোগী ছিলেন ‘আম্মার ইবনু ইয়াসির (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। তিনিই রাসূল (ﷺ)-কে এদিকে ইঙ্গিত দেন। অতঃপর পাথরসমূহ জমা করেন। তারপর প্রথমে রাসূল (ﷺ) কিবলার দিকে একটি পাথর রাখেন। অতঃপর আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একটি রাখেন। অতঃপর বাকী কাজ ‘আম্মারের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়।[২২] একইভাবে, যখন তিনি শহরের কেন্দ্রস্থলে (তখন ইয়াছরিব নামে পরিচিত) তার হাঁটা অব্যাহত রেখেছিলেন, তখন তিনি প্রথমে যে কাজটি করেছিলেন তা হল তার মসজিদ নির্মাণের জন্য জমি বরাদ্দ করা এবং তারপর এটি নির্মাণ শুরু করা। যে মসজিদটি বিশ্বের দরবারে ‘মসজিদে নববী’ নামে সমধিক পরিচিত। যা আজ অবধি মাথা উঁচু করে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত যার রক্ষণাবেক্ষণে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা অদৃশ্য শক্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। নিম্নের হাদীছটি এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে।

আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) মদীনায় পৌঁছে প্রথমে মদীনার উচ্চ এলাকায় অবস্থিত বনূ ‘আমর ইব্‌নু ‘আওফ নামক গোত্রে উপনীত হন। তাদের সঙ্গে নবী (ﷺ) চৌদ্দ দিন (অপর বর্ণনায় চব্বিশ দিন) অবস্থান করেন। অতঃপর তিনি বনূ নাজ্জারকে ডেকে পাঠালেন। তারা কাঁধে তলোয়ার ঝুলিয়ে উপস্থিত হলো। আমি যেন এখনো সে দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি যে, নবী (ﷺ) ছিলেন তাঁর বাহনের উপর, আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সে বাহনেই তাঁর পেছনে আর বনূ নাজ্জারের দল তাঁর আশেপাশে।

অবশেষে তিনি আবূ আইয়ূব আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঘরের সাহানে অবতরণ করলেন। নবী (ﷺ) যেখানেই ছালাতের ওয়াক্ত হয় সেখানেই ছালাত আদায় করতে পসন্দ করতেন এবং তিনি ছাগল ভেড়ার খোঁয়াড়েও ছালাত আদায় করতেন। এখন তিনি মসজিদ তৈরি করার নির্দেশ দেন। তিনি বনূ নাজ্জারকে ডেকে বললেন, হে বনূ নাজ্জার! তোমরা আমার কাছ হতে তোমাদের এই বাগিচার মূল্য নির্ধারণ কর। তারা বলল, না, আল্লাহ্র কসম, আমরা এর দাম নেব না। এর দাম আমরা একমাত্র আল্লাহর নিকটই আশা করি। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি তোমাদের বলছি, এখানে মুশরিকদের কবর এবং ভগ্নাবশেষ ছিল। আর ছিল খেজুর গাছ। নবী (ﷺ)-এর নির্দেশে মুশরিকদের কবর খুঁড়ে ফেলা হলো। অতঃপর ভগ্নাবশেষ সমতল করে রাখা হলো, খেজুর গাছগুলো কেটে ফেলা হলো অতঃপর মসজিদের কিবলায় সারিবদ্ধ করে রাখা হলো এবং তার দুই পাশে পাথর বসানো হলো। ছাহাবীগণ পাথর তুলতে তুলতে ছন্দোবদ্ধ কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। আর নবী (ﷺ)ও তাঁদের সাথে ছিলেন। তিনি তখন বলছিলেন,

أَللَّهُمَّ لَاخَيْرَإِلَّاخَيْرُالْاَخِرَة + فَاغْفِرْ لِلْاَنْصَارِ وَالْمُهَاجِرَةِ

‘হে আল্লাহ! আখিরাতের কল্যাণ ব্যতীত (প্রকৃত) আর কোন কল্যাণ নেই। আপনি আনছার ও মুহাজিরগণকে ক্ষমা করুন’।[২৩]

মদীনায় প্রথম আগমন করে মসজিদ নির্মাণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যে ব্যাপক আগ্রহ ও তার বাস্তবায়ন ইসলামে মসজিদের মর্যাদা এবং এর গুরুত্বের প্রমাণ বহন করে। মসজিদের মর্যাদা আরও বেশি যে বিষয়টি প্রমাণ করে তা হল, রাসূল (ﷺ) মসজিদ নির্মাণ করে সেখানে যেমন ছালাত আদায় করতেন, তেমিন সমগ্র রাজ্যের নানাবিধ নীতির সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য কার্যাবলীও সম্পাদন করতেন।

তিনি মসজিদে ইবাদত ও সেখানে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমকে কখনো পৃথকভাবে মূল্যায়ন করতেন না। বরং একইভাবে বিবেচনা করতেন। আর এটা করতেন তাঁর উম্মতকে এ বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য যে, নিশ্চয় দ্বীন পৃথিবীতে প্রত্যেক কল্যাণ প্রতিষ্ঠাকে অন্তর্ভুক্ত করে; শুধু ইবাদতের সকল প্রকারের মধ্যে যেগুলো তিনি আদায় করতে বলেছেন সেগুলোকে নির্দিষ্ট করেননি। সুতরাং মুহাম্মাদ (ﷺ) ইবাদত-বন্দেগীর পাশাপাশি মু‘আমালাতের সকল কার্যক্রম মসজিদেই সম্পাদন করতেন। এমনকি মসজিদে রাষ্ট্রের কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য তিনি একটি জায়গা বরাদ্দ করেছিলেন। আর তিনি তাঁর রবের আদেশেই এমনটি করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এটিই তার প্রথম ভিত্তি। অতঃপর মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় রুকন হল: সেখানে তিনি মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। যারা এই মসজিদে ইবাদত, বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ, জিহাদ সহ অন্যান্য বিষয়ের জন্য একত্রিত হতেন। এছাড়া এখানেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইহুদী-খ্রিস্টানদের সাথে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন।[২৪] সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অন্যতম স্তম্ভ যে মসজিদ সে বিষয়টি উক্ত আলোচনায় প্রস্ফুটিত হয়েছে।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযীদ আল-কাযবিনী, সুনান ইব্নে মাজাহ, ১ম খণ্ড (বৈরূত: দারুল ফিকর, তাবি), পৃ. ২৪৪, হাদীছ নং ৭৩৮।
[২]. ড. সাঈদ ইবন ওয়াহাফ আল-কাহতানী, আল-মাসাজিদু ফী যুয়িল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ (প্রকাশনা স্থান, সংস্থা, সাল ও তারিখ বিহীন), পৃ. ৮-৯।
[৩]. ঐধহং ডবযৎ, অ উরপঃরড়হধৎু ড়ভ সড়ফবৎহ ডৎরঃঃবহ অৎধনরপ (ঘবি ণড়ৎশ: ঝঢ়ড়শবহ খধহমঁধমব ঝবৎারপবং, ওহপ, ১৯৭৬), ৩৯৭.
[৪]. মুহাম্মাদ রাওয়াস কাল‘আজী, মু‘জামু লুগাতুল ফুকাহা (বৈরূত: দারুন নাফায়েস, ২য় সংস্করণ, ১৯৮৮ খ্রি.), পৃ. ৪২৮; ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আল-মু‘জামুল ওয়াফী (ঢাকা: রিয়াদ প্রকাশনী, ১ম সংস্করণ, জানুয়ারী, ২০০৫ খৃ.), পৃ. ৯৫২।
[৫]. ইবরাহীম মুস্তফা, আহমাদ যায়্য়াত, হামিদ আব্দুল কাদের, মুহাম্মাদ আন-নাজ্জার, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত, ১ম খণ্ড (আল কাহিরাহ: দারুদ দা‘ওয়াহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৮ খ্রি.), পৃ. ৪১৬।
[৬]. নাশওয়ান বিন সাঈদ আল-হুমাইরী আল-ইয়ামনী, শামসুল উলুম ওয়াদাউ কালামিল আরাব মিনাল কুলূম, ৫ম খণ্ড (বৈরূত: দারুল ফিকর, লেবানন, ১ম প্রকাশ ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), পৃ. ২৯৭৪।
[৭]. মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান আল-মাজদাদী আল-বারকাতী, আত-তারিফাত আল-ফিকহিয়্যাহ (পাকিস্থান: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ ১৪২৪ হি./২০০৩ খ্রি.), পৃ. ২০৪।
[৮]. মুহাম্মাদ ইবন মুকাররম ইবনু মানযূর আল-আফরীকী, লিসানুল ‘আরব, ৩য় খণ্ড (বৈরূত : দারুল সাদর, ১ম সংস্করণ, তাবি), পৃ. ২০৪।
[৯]. আবূ আব্দুল্লাহ বদরুদ্দীন আয-যারকাশী (মৃত ৭৯৪ হি.), ‘ইলামুস সাজিদ বি আহকামিল মাসাজিদ, ১ম খণ্ড (রিয়াদ: আল-মাজলিসুল ‘আলা লিশ-শুউন আল-ইসলামিয়্যাহ, ৪র্থ প্রকাশ ১৪১৬ হি./১৯৯৬ খ্রি.), পৃ. ২৮।
[১০]. মুহাম্মাদ রাওয়াস কাল‘আজী, মু‘জামু লুগাতুল ফুকাহা (বৈরূত: দারুন নাফায়েস, ২য় সংস্করণ, ১৯৮৮ খৃ.), পৃ. ৪২৮।
[১১]. সম্পাদান পরিষদ, আল-মাউসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ আল-কুয়েতিয়্যাহ, ৩৭শ খণ্ড (কুয়েত: ওয়াযারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ূনিল ইসলামিয়্যাহ, ২য় প্রকাশ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ১৯৪।
[১২]. মুহাম্মাদ ইবন ইসমা‘ঈল আবূ ‘আব্দিল্লাহ আল-বুখারী আল-জু‘ফী, আস-সাহীহ, ৪র্থ খণ্ড (দারু ত্বাওকুন নাজাত, ১ম সংস্করণ, ১৪২২ হি.), পৃ. ১৬২, হাদীছ -৩৪২৫।
[১৩]. মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আবুল হুসাইন আল-কুশাইরী আন-নিশাপুরী, আস-সাহীহ, ১ম খণ্ড (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, তাবি), পৃ. ৩৭০, হাদীছ নং-৫২১।
[১৪]. আবূ যাকারিয়া ইহইয়া বিন শারফ বিন মাররী আন-নববী, শারহুন নববী ‘আলা সহীহ মুসলিম, ৫ম খণ্ড (বৈরূত: দারু ইহইয়্যাউত তুরাস আল-‘আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৩৯২ হি.), পৃ. ৫।
[১৫]. ‘আব্দুর রহমান ইবনু নাসির আস-সা‘দী, তাইসীরুল কারীরিমর রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./২০০০ খ্রি.), পৃ. ৬৩।
[১৬]. ইমাম মুসলিম, আস-সাহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৬৪, হাদীছ নং-৬৭১।
[১৭]. আবুল ফিদা ইসমা‘ঈল ইবনু কাছীর আদ-দিমাস্কী, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ২য় খণ্ড (বৈরূত : দারু তাইয়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), পৃ. ৭৭।
[১৮]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৮৯০।
[১৯]. মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আবূ জা‘ফর আত-তাবারী, জামি‘ঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ২৩শ খণ্ড (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./২০০০ খ্রি.), পৃ. ৬৬৫।
[২০]. ইমাম মুসলিম, আস-সাহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৮, হাদীছ নং-৫৩৩।
[২১]. প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৯৪, হাদীছ নং-৫৬৩।
[২২]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) (রাজশাহী: হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১ম প্রকাশ, মার্চ ২০১৫ খ্রি.), পৃ. ২১৯।
[২৩]. ছহীহুল বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৫, হাদীছ নং-৪১৮; সুলাইমান ইবনুল আশ‘আছ আবূ দাঊদ আস-সিজিস্তানী আল-আযদী, আস-সুনান, ১ম খণ্ড (বৈরূত: দারুল ফিকর, তা.বি), পৃ. ১৭৭, হাদীছ নং-৪৫৩।
[২৪]. মুহাম্মাদ ইবনু আবূ বকর শামসুদ্দীন ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ ফী হাদয়ি খায়রিল ‘ইবাদ, ৩য় খণ্ড (বৈরূত: মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৭শ সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), পৃ. ৫৬-৫৯।




প্রসঙ্গসমূহ »: মসজিদ
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক
দুর্নীতি হ্রাসে শিক্ষার ভূমিকা - মোঃ শফিকুল ইসলাম
সালাফী মানহাজের বৈশিষ্ট্য (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (১১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি (৫ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
বিদ‘আত পরিচিতি (১৮তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
দলাদলির কুপ্রভাব : উত্তরণের উপায় - শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৫ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
হজ্জের শিক্ষা ও হজ্জ পরবর্তী করণীয় - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ

ফেসবুক পেজ