বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৭ অপরাহ্ন

প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান

 - মূল : আব্দুল আযীয ইবনু রাইস আল-রাইস

- অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক্ব বিন আব্দুল ক্বাদির*


(২য় কিস্তি)

(সম্মানিত লেখক বলেন) অতঃপর কথা হল যে, নিশ্চয় যখন কোন বিষয়ের মধ্যে সত্য-অসত্য এবং ভাল-মন্দ একত্র হয়, তখন বহু মানুষের নিকট ঐ বিষয়ের প্রকৃত বিধান অস্পষ্ট হয়ে যায় এবং তার জন্য কিছু সমর্থক ও সাহায্যকারীও তৈরি হয়ে যায়। ফলে যখন তাদের নিকট অধিকাংশ মন্দ ও বাতিলের উল্লেখ করা হয়, তখন তার মাঝে যা কিছু সত্য ও সঠিক রয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমে তারা এর বিরোধিতা করে। এই হল প্রত্যেক বিদ‘আতের, অবস্থা যার উপর কিছু লোক অটল থাকে। ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

وَمَنْ صَبَرَ مِنْ أَهْلِ الْأَهْوَاءِ عَلَى قَوْلِهِ فَذَاكَ لِمَا فِيْهِ مِنْ الْحَقِّ إذْ لَا بُدَّ فِيْ كُلِّ بِدْعَةٍ عَلَيْهَا طَائِفَةٌ كَبِيْرَةٌ مِنْ الْحَقِّ الَّذِيْ جَاءَ بِهِ الرَّسُوْلُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَيُوَافِقُ عَلَيْهِ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْحَدِيْثِ مَا يُوْجِبُ قَبُوْلَهَا إذْ الْبَاطِلُ الْمَحْضُ لَا يُقْبَلُ بِحَالِ

‘প্রবৃত্তির অনুসারীদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি তার কথার উপর অনড় থাকে- তা এই কারণে যে, তার মাঝে সত্যও রয়েছে। কারণ যে বিদ‘আতের উপর একটি বড় দল বিদ্যমান থাকে তার মাঝে এমন সত্য বিষয় থাকা যরূরী যা নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমন করেছেন এবং সুন্নাহ ও হাদীছের অনুসারীগণ তার উপর সম্মতি দিয়েছেন। ফলে তা ঐ বিদ‘আতের গ্রহণীয়তা সাব্যস্ত করে। কারণ হল সত্যের মিশ্রণ ছাড়া শুধু বাতিলকে কোন অবস্থাতেই গ্রহণ করা হয় না’।[১]

তারা সত্য-মিথ্যা এবং ভাল-মন্দকে একত্র করেছে তাদের মধ্যে একটি পরিচিত দল হল জামা‘আতুত তাবলীগ বা তাবলীগ জামা‘আত। যা হিন্দুস্থানে ১৪ শতাব্দির মধ্যভাগে মুহাম্মাদ ইলিয়াস আল-কান্ধালোভী মাধ্যমে সূচনা হয়। এই ফের্কাটি দাওয়াত ও ত্যাগে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তবে আফসোস হল যে, তাদের দাওয়াত ও প্রচেষ্টা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার ছাহাবীগণের হেদায়াতের বিপরীত। যার বর্ণনা অচিরেই আসবে ইনশাআল্লাহ।

মূল বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও প্রমাণ পেশ করার পূর্বে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করছি। আর তাহল, কোন নির্দিষ্ট দলের ব্যাপারে কথা বলা হলে তা মূলত তার মানহাজ বা কর্মপন্থা সম্পর্কে কথা বলা বুঝায়, তার সমর্থক বা সদস্য সম্পর্কে বুঝায় না।

এ কারণে কোন ব্যক্তি সম্পর্কে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার নিন্দা করা সঠিক হবে না। কারণ ইসলামের দাবীদারদের মধ্যে এমন কিছু লোক থাকতেও পারে যারা সিমালঙ্ঘনকারী, ইসলামের প্রতি পরিপূর্ণ আমলকারী নয়। অনুরূপ খ্রীষ্টান ধর্মের প্রশংসা করাও ঠিক নয়। কারণ তার ধারণা মতে খ্রীষ্টান ধর্মের দাবীদারদের মধ্য হতে এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা কঠোর পরিশ্রমী ও খ্রীষ্টান ধর্মের পূর্ণ আমলকারী। এটা কোনভাবেই সঠিক নয়। তাই সমালোচনা ও মানমূল্যায়ন হয়ে থাকে কর্মপন্থার জন্য, সমর্থক বা সদস্যের জন্য নয়। কারণ সমর্থক এক সময় থাকে, আবার অন্য সময়ে পরিবর্তনও হতে পারে। আবার কখনো তাদের ভাল বা মন্দ হওয়া বাইরের কোন বিষয়ের কারণে হয় যা কর্মপন্থার সাথে কোন সম্পর্ক থাকে না। এই কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটির জন্য সতর্ক থাকা এবং দাওয়াতী পন্থা বা অন্য কোন বিষয়ে কথা বলা ও সমালোচনার ক্ষেত্রে ইহার স্বরণ রাখা কাম্য। কেননা অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাবে, যখন আপনি সমালোচনা করবেন যে, তাবলীগ জামা‘আত ইলমের গুরুত্ব দেয় না। তখন তাদের কেউ আপনার বিরোধিতা করে বলবে যে, তাদের সাথে অমুক অমুক ব্যক্তি রয়েছে যারা ইলম শিক্ষার্থী ছাত্র। এভাবে আরো প্রতিবাদ করবে। এভাবে উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে সে তাবলীগ জামা‘আতের কর্মপন্থা ও ঐ দলের সাথে পরে যোগদানকারী সমর্থকদের মাঝে কোন পার্থক্য করবে না।

তাবলীগ জামা‘আত দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর ছাহাবীদের পদ্ধতির বিপরীতে বিদ‘আতী পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রমাণ ও বর্ণনা

১). এই দলটি তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ তথা ইবাদত একমাত্র আল্লাহ্র জন্য করতে হবে এ বিষয়ে দাওয়াত দেয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে না। অথচ এই প্রকার দাওয়াতের উদ্দেশ্যেই সমস্ত রাসূলকে প্রেরণ করা হয়েছে, সকল কিতাব অবতরণ করা হয়েছে এবং মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَقَدۡ بَعَثۡنَا فِیۡ کُلِّ اُمَّۃٍ  رَّسُوۡلًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ  وَ اجۡتَنِبُواالطَّاغُوۡتَ ‘এবং নিশ্চয় আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে (আদেশ প্রদান করার জন্য) যে, তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করবে এবং ত্বাগূতকে বর্জন করবে’ (সূরা আন-নাহল : ৩৬)। আল্লাহ আরো বলেন,وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ  اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ ‘আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি এজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে’ (সূরা আয-যারিয়াত : ৫৬)।

এই দলটি তাদের মূলনীতির মাঝে কালেমা তাইয়্যেবা (لا إله الا الله ومحمد رسول الله) উল্লেখ করলেও তারা এই কালেমা থেকে বহু দূরে রয়েছে। কারণ তারা যে তাওহীদের গুরুত্ব দেয়, যতœ নেয়, তাহল তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ। এই তাওহীদ কুরাইশ কাফেররাও স্বীকার করত। কিন্তু তাওহীদুল উলূহিয়্যাহকে বর্জন করে তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহর স্বীকৃতি তাদেরকে ইসলামে প্রবেশ করাতে পারেনি। যে তাওহীদ (তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ) প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত রাসূলকে প্রেরণ করা হয়েছে।[২]

এই দলটি যে তাওহীদুল উলূহিয়্যাহর যত্ন নেয় না তার প্রমাণ নিম্নরূপ-

(ক) হিন্দুস্থান ও সূদানে অবস্থিত তাদের মূল কেন্দ্রে বেশ কিছু কবর রয়েছে। তেমনিভাবে পাকিস্তানের রাইওয়ান্দ এলাকায় অবস্থিত তাদের মূল কেন্দ্রের পাশেও কবর রয়েছে। এই বিষয়টি একজন পরিচিত বিদ্যান শায়খ সা‘দ আল-হুসাইন উল্লেখ করেছেন। যিনি তাদের সাথে আট বছর বসবাস করে তাদেরকে উত্তমভাবে জেনেছেন।[৩]  

(খ) তাবলীগ জামা‘আতের দিকে নিজেদেরকে সম্বন্ধকারীদের আকাবির (অর্থাৎ নেতৃস্থানীয় লোকজন) শিরকী ও বিদ‘আতী আক্বীদার উপর বিদ্যমান। এরপরও তারা তাদের গুরুজন হিসাবে রয়েই গেছেন। অতএব এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, উক্ত দলটি তাওহীদুল ইবাদাহকে ইবাদত শুধুমাত্র এক আল্লাহ্র জন্য সম্পাদন করার বিষয়টিকে কোন পরোয়া করে না। উস্তাদ সাইফুর রহমান ইবনু আহমাদ আদ-দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

إن أكابر أهل التبليغ يراطون على القبور وينظرون الكشف والكرامات والفيوض الروحية من أهل القبور ويقرون بمسألة حياة النبي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وحياة الأولياء حياة دنيوية لا برزخية مثلما يقر القبوريون بنفس المعنى.

‘নিশ্চয় তাবলীগপন্থীদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ কবরসমূহের উপর প্রহরায় থাকেন এবং কবরবাসীদের থেকে আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা, অলৌকিক ঘটনা ও রূহানী প্রাচুর্য অর্জন করার জন্য অপেক্ষা করেন। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও অলীগণ কবরের জীবনে নয়, বরং দুনিয়াবী জীবনেই বেঁচে আছেন বলে তারা স্বীকার করেন। যেমনভাবে কবরপূজারীরাও এরূপই বিশ্বাস করে।[৪]

শাইখ হামূদ আত-তুয়াইজিরী (রাহিমাহুল্লাহ) সাতজন ব্যক্তির সাক্ষর সহ সাক্ষ্য উল্লেখ করেছেন যে, এই দলটির নিকট বহু কুফুর ও বিদ‘আত রয়েছে।[৫]

(গ) আপনি যখন এই দলের সদস্য-সমর্থকদের পাশে বসবেন তখন দেখবেন যে, তারা কালেমা ত্বাইয়্যেবার ব্যাখ্যা তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ সম্পর্কিত বিষয় দ্বারা করে। তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ সম্পর্কীয় বিষয় দ্বারা ব্যাখ্যা করে না। সুতরাং আপনি যাচাই করে দেখুন। আল্লাহ আপনাকে হেফাযত করুন!

এই দলটি তাওহীদের গুরুত্ব না দেয়াই নবী ও রাসূলগণের পন্থার উপর চলমান তাওহীদপন্থীদের নিকট তাদেরকে বাদ দেয়া ও বিলোপ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কারণ হতে পারে। এর কারণ হল যে, নবী ও রাসূলগণের প্রকৃত দাওয়াত ছিল শুধু মাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাকে ইবাদতে একক সাব্যস্ত করার দিকে আহ্বান করা। সুতরাং যে ব্যক্তি দাওয়াতের ক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতা করবে সে তাদের মুক্তিপ্রাপ্ত অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত নয়।

(ঘ) এই দলটি তার অনারব অনুসারীদের জন্য তাবলীগী নেছাব নামক একটি বই রচনা করেছে। যার মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে অসীলা তলব করার দিকে স্পষ্টভাবে আহ্বান রয়েছে। আর এটাকে আলেমগণ বড় শিরক; যা আমল নষ্টকারী ও ইসলাম থেকে বহিষ্কার যোগ্য কারণ হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন। তাদেরকে এই কিতাবটি রচনা করা ও তার প্রতি উৎসাহ দেয়া বরং তাকে বিলি বণ্টন করার প্রতি উৎসাহ দেয়ার মাধ্যমে তাবলীগ জামা‘আত প্রমাণ করেছে যে, এটা শুধু তাওহীদের দাওয়াতকে উপেক্ষাকারী দল হিসাবে যথেষ্ট নয়, বরং তা শিরকের দিকে আহ্বানকারী একটি দল। আল্লাহ্র নিকট আমরা নিরাপত্তা কামনা করছি।

২). এই জামা‘আত বিভিন্ন বিদ‘আতের মাঝে ডুবে গেছে। তারা অনারব ও আরবদের মাঝে যার প্রতি আস্থাবান হয় তার নিকট বিদ‘আতী ছূফী মতবাদের চার তরীকার উপর বাই‘য়াত গ্রহণ করে। তাহল চিশতিয়া, নকশাবন্দিয়া, কাদিরিয়া ও সাহরাওয়ারদিয়া।[৬] এমনিভাবে তাদের অনারব অনুসারীদের জন্য রচনাকৃত ‘তাবলীগী নিছাব’ বইটির মাঝে বহু ধংসাতাœক বিদ‘আত বিদ্যমান আছে। যেমন-

(ক) হজ্জ সম্পাদনের পর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কবর যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মদীনায় ভ্রমণ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান। যার দলীল হিসাবে একটি জাল হাদীছ উল্লেখ করে-  من حج فلم يزرني فقد جفانى ‘যে ব্যক্তি হজ্জ সম্পাদন করল অতঃপর আমার (কবর) যিয়ারত করল না, সে আমার সাথে নির্দয় আচরণ করল’। উক্ত ‘আমলটি বিদ‘আত এবং হাদীছটি জাল।[৭]

(খ) নিম্নের দু‘আর মাধ্যমে রাসূূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কবরের দিকে মুখ ফিরানোর প্রতি উৎসাহ প্রদান। يا رسول الله أسئلك الشقاعة ‘হে আল্লাহর রাসূূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি আপনার নিকট শাফা‘আত প্রার্থনা করছি’।

(গ) আবূবকর ও ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর প্রতি সালামের পদ্ধতি যেমন (তারা বলে), جئناكما نتوسل بكما إلى رسول الله ليشفع لنا ويدعو لنا ربنا ‘আমরা আপনাদের নিকট এসেছি আপনাদের দু’জনের মাধ্যমে রাসূূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট অসীলা গ্রহণ করছি। যেন তিনি আমাদের জন্য আমাদের রবের নিকট সুপারিশ ও দু‘আ করেন’।  

(ঘ) সেই বইয়ের মাঝে এ কথাও রয়েছে যে, হিজরী ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে ৯০ হাজার মুসলিমের সম্মুখে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কবর থেকে হাত বের করেছিলেন যাতে করে শায়খ আহমাদ আর-রিফায়ী সেই হাতে চুম্বুন করতে পারেন। সুবহানাল্লাহ কি আশ্চর্য! মানুষ ও সঙ্গী সাথীদের বিবেকের সাথে প্রতারণা করার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাদের মধ্য থেকে একজন সৎপথ প্রাপ্ত বিচক্ষণ ব্যক্তিও কি নেই?

(ঙ) উক্ত বইয়ের মাঝে এ কথাও রয়েছে যে, কা‘বা ঘর কতক সৎ ব্যক্তিদের নিকট তাদের নিজ বাসস্থানে চলে যায়।[৮] সুতরাং তাবলীগ জামা‘আত ‘তাবলীগী নিছাব’ কিতাবের প্রতি উৎসাহ দেয়ার মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে, তাবলীগ জামা‘আত ধংসাতাœক বিদ‘আতের দিকে আহ্বানকারী একটি দল।

৩). তাবলীগের অনুসারীগণ বিদ্যা বা জ্ঞানের গুরুত্ব দেয় না। আর তাদের দা‘ওয়াতী মূলনীতির মাঝে প্রকৃতপক্ষে যাকে বিদ্যা বলা হয় এমন বিদ্যার্জনের বিষয় উল্লেখ নেই। তাহল দলীলসহকারে শরী‘আতের বিধানসমূহ জানা ও আলেমগণের নিকট পড়াশুনা করা। তাই যথাযথ জ্ঞান (ইলম) না থাকার কারণে তারা ইবাদত কবুল হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত তথা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণ করার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেন।[৯]

হায় সুবনাল্লাহ! তাদের নিকট যদি বিদ্যাই না থাকে তাহলে তারা কোন্ জিনিসের দিকে আহ্বান করবে? আর যার কাছে সেই জিনিস নেই সে কি তা অন্যকে দান করতে পারে?  অথচ নবীগণের দা‘ওয়াত হল জ্ঞানের ভিত্তিতে দা‘ওয়াত। আল্লাহ বলেন, قُلۡ ہٰذِہٖ سَبِیۡلِیۡۤ  اَدۡعُوۡۤا  اِلَی اللّٰہِ عَلٰی بَصِیۡرَۃٍ  اَنَا  وَ مَنِ اتَّبَعَنِیۡ ‘বলুন! এটাই আমার পথ, আল্লাহ্র প্রতি মানুষকে আমি আহ্বান করি সজ্ঞানে, আমি ও আমার অনুসারীগণও’ (সূরা ইউসুফ : ১০৮)। সুতরাং তারা ইলমের ব্যাপারে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে পূর্বে উল্লেখিত বিদ‘আত ছাড়াও আরোও বহু বিদ‘আতের মাঝে নিমজ্জিত হয়েছে।[১০]

৪). এই জামা‘আতের মূলনীতির মধ্য থেকে একটি মূলনীতি হল ‘বের হওয়া’ তথা আল্লাহর দিকে আহ্বান করার জন্য সফর করা। আর এই নীতিটি প্রশংসনীয়, কাঙ্খিত যা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগেও বিদ্যমান ছিল। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাহাবীদের মধ্য থেকে অনেক জামা‘আতকে আল্লাহ্র দিকে আহ্বান করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। তিনি আবূ মূসা, আলী, মুয়ায, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) সহ আরো অনেককেই দা‘ওয়াতের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু তাদের দা‘ওয়াতের পদ্ধতি তাবলীগ জামা‘আতের বিরোধী ছিল। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুধু আলেম ছাবাহীদেরকেই পাঠাতেন। আল্লাহ্র দিকে আহ্বান করার জন্য আলেম ছাড়া অন্য কাউকে পাঠাননি। যদিও তাঁর যামানায় অন্যদেরকেও পাঠানোর যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল এবং তাতে বাধা ছিল না। তাই আলেম ছাড়া অন্যদেরকে দা‘ওয়াতী কাজে পাঠানোর হুকুম শরী‘আতের মধ্যে একটি বিদ‘আত বলে গণ্য হবে।

উক্ত বক্তব্যের সার কথা হল, আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেয়ার জন্য জাহেলদেরকে পাঠানো হল বহু বিদ‘আতের মধ্য হতে একটি বিদ‘আত। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, بَلِّغُوْا عَنِّىْ وَلَوْ آيَةً ‘আমার পক্ষ হতে যদি একটি আয়াতও জানা থাকে, তাহলে তা পৌঁছে দাও’।[১১]

এই হাদীছটি কেউ প্রমাণ হিসাবে পেশ করে যদি বলে যে, উক্ত হাদীছটি সফর ও হজ্জ উভয় অবস্থায় যে ব্যক্তি একটি আয়াতও জানে তাকেও অন্তর্ভুক্ত করে। তাহলে তার কথা সঠিক নয়। কারণ তাকে বলা হবে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যিনি হাদীছটি বলেছেন, বুঝেছেন ও তার প্রতি আমল করেছেন তিনিই সবার চাইতে শ্রেষ্ঠ। তারপরও তিনি বুঝেননি যে, উক্ত হাদীছটি আপনি যা উল্লেখ করেছেন তাকে শামিল করে। কারণ আপনি যা উল্লেখ করেছেন সেটা যদি তিনি বুঝতেন। তাহলে ছাহাবীগণের মধ্য থেকে যারা আলেম নয়, তাদেরকেও দা‘ওয়াতী কাজের জন্য প্রেরণ করতেন। প্রয়োজন থাকা ও বাধা না থাকা সত্ত্বেও যেহেতু তিনি তা করেননি, তাই প্রমাণ করে যে, উক্ত বিষয়টি হাদীছের সাধারণ অর্থের মাঝে অন্তর্ভুক্ত নয়। তারপরও তাবলীগের অনুসারীরা অন্যান্যদের মধ্য থেকে যারা জ্ঞানহীন তারা যখন দা‘ওয়াতী কাজে বের হয়, তখন তারা একটি আয়াত পড়ে বা একটি হাদীছ উল্লেখ করেই থেমে যায় না।

সতর্কতা!

জেনে রাখা দরকার যে, তাদের কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করে এইভাবে যে, যিমাম ইবনু ছা‘লাবা ও অন্যান্য প্রতিনিধিগণ যারা আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করে তাদের জাতির কাছে আহ্বানকারী হিসাবে গমন করেছেন। অথচ তারা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বেশি কিছু শিক্ষার্জন করেননি। এই প্রতিবাদকারী যা উল্লেখ করল তা পূর্বের আলোচনার বিরোধিতা করে না। বরং তাকে শক্তিশালী করে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ সকল প্রতিনিধিগণকে দা‘ওয়াত দেয়ার জন্য তাদের জাতির নিকট প্রেরণ করেননি এবং ইসলামের দিকে আহ্বান করা তাদের সফরের উদ্দেশ্যও ছিল না। বরং তাদের উদ্দেশ্যে ছিল নিজ দেশ ও জাতির কাছে ফিরে যাওয়া। আর আলোচনা চলছে ঐ ব্যক্তিকে নিয়ে, যে আল্লাহ্র দিকে আহ্বান করার উদ্দেশ্যে সফর করে। ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে আলোচনা নয়, যে ভিন্ন কোন উদ্দেশ্যে সফর করে। অতঃপর প্রসঙ্গক্রমে দা‘ওয়াতের বিষয়টি তার নিকট এসে যায়। আল্লাহই একমাত্র তাওফীক্ব দাতা।

উপকারিতা

হে পাঠক ভাই! তাবলীগ জামা‘আতের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তিনি হলেন ‘মুহাম্মাদ ইলিয়াস বিন মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল-কান্ধালোভী আদ-দেওবন্দী’ (১৩০৩-১৩৬৩ হিঃ/১৮৮৫-১৯৪৪ খৃঃ)। তিনি মাযহাবে হানাফী, আক্বীদায় আশ‘আরী মাতুরীদী এবং তরীকায় ছূফী মতবাদের ছিলেন। তিনি রশীদ আহমাদ গাংগোহী (১৮২৬-১৯০৫ খৃঃ)-র হাতে ছূফী তরীকার বাই‘আত নিয়েছিলেন। শায়খ রশীদের মৃত্যুর পর আহমাদ সাহরানপূরীর হাতে তিনি বাই‘আত নবায়ন করেছিলেন। যাকে তিনি প্রসিদ্ধ সূফী তরীকায় অন্যকে বাই‘আত দেয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ ইলিয়াস শায়খ নূর মুহাম্মাদ বাদায়ুনীর কবরের নিকট নির্জন স্থানে বসতেন এবং তিনি কুদ্দূস আল-গাংগোহীর কবরের পাশে চিশতিয়া মুরাকাবায় বসতেন। যে কুদ্দূসের উপর ওয়াহদাতুল ওজূদ (অর্থাৎ সবকিছুর মাঝে আল্লাহ্র উপস্থিতি রয়েছে মর্মে বিশ্বাস করা)-এর চিন্তাধারা বিস্তারলাভ করেছিল।[১২]  


(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* মুহাদ্দিছ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র : 
[১]. ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া (দারুল ওফাই, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬ হি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫১।
[২]. আছ-ছিফাতুস সিত্তাহ ইনদা জামা‘আতিত তাবলীগ, পৃ. ২২-২৮; আল-কাওলুল বালীগ, পৃ. ২০৫-২০৮; জামা‘আতুত তাবলীগ ফী শিবহিল ক্বাররাতিল হিনদিয়্যাতি, পৃ. ২২; ওক্বাফতু মা‘আ জামা‘আতিত তাবলীগ, পৃ. ১৭।
[৩]. হাক্বীক্বাতুত দাওয়াহ, পৃ. ৭৭-৭৮; আল-কাওলুল বালীগ, পৃ. ১২; আছ-ছিফাতুস সিত্তাহ ইনদা জামা‘আতিত তাবলীগ, পৃ. ৮১।
[৪]. আল-কাওলুল বালীগ, পৃ. ১২-১৪।
[৫]. আল-কাওলুল বালীগ, পৃ. ১৮৭-১৯০।
[৬]. আল-ক্বাওলুল বালীগ, পৃ. ৭-৯, ১৩৮, ২০৯।
[৭]. ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া (দারুল ওফা’, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬ হি.), ২৭তম খণ্ড, পৃ. ৩৫; ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, লিসানুল মীযান (মাকতাবাতুল মাত্ববূ‘আতিল ইসলামি), ৮ম খণ্ড, পৃ. ২৮৫, হা/৮১৫৫; শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২৬৫, হা/৯০৯৫; আব্দুর রহমান ইবনু হাম্মাদ, দ্বীনুল হক্ব (সঊদী আরব : ওযারাতুশ শুয়ূনিল ইসলামি ওয়াল আওক্বাফ ওয়াদ দা‘ওয়াত ওয়াল ইরশাদ, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৪২০ হি.), পৃ. ৭৩।
[৮]. হাক্বীক্বাতুত দাওয়াহ, পৃ. ৮২; আস-সিফাতুস সিত্তাহ ইনদা জামা‘আতিত তাবলীগ, পৃ. ২৫, ৪০, ৫১, ৫৯।
[৯]. জামা‘আতুত তাবলীগ ফী শিবহিল ক্বাররাতিল হিনদিয়্যাতি, পৃ. ৪৮; ওক্বাফাতু মা‘আ জামা‘আতিত তাবলীগ, পৃ. ২২, ২৯, ১৯৯।
[১০]. আস-সিফাতুস সিত্তাহ ইনদা জামা‘আতিত তাবলীগ, পৃ. ৩১, ৩৫, ৬০, ৬৩।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১; তিরমিযী, হা/২৬৬৯; মিশকাত, হা/১৯৮;।
[১২]. হাক্বীক্বাতুত দাওয়াহ, পৃ. ৭৫।




শারঈ মানদন্ডে শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের ঈমান বনাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ঈমান : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ড. আব্দুল্লাহিল কাফী বিন লুৎফর রহমান মাদানী
সন্ত্রাসবাদ : ইসলামের দিকে শ্যেনদৃষ্টি - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৫ম কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ইসলামী উত্তরাধিকার আইন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ধারা (২য় কিস্তি) - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
বাংলাদেশে সমকামিতার গতি-প্রকৃতি : ভয়াবহতা, শাস্তি ও পরিত্রাণের উপায় অনুসন্ধান - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
দু‘আ ও যিকর : আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
মীলাদুন্নবী ও আমাদের অবস্থান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ