মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০২:১৯ অপরাহ্ন

প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান

-মূল : আব্দুল আযীয ইবনু রাইস আল-রাইস
-অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক্ব বিন আব্দুল ক্বাদির*


(৭ম কিস্তি)

এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপক মূলনীতি সম্পর্কে আল-কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বহু প্রমাণ রয়েছে। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে বিদ্বানগণ কিতাবসমূহের মাঝে অধ্যায় রচনা করেছেন যে, كتاب الاعتصام بالكتاب والسنة ‘কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার অধ্যায়’ এই মুলনীতির উপর ইমাম বুখারী, ইমাম বাগাভী ও অন্যান্য বিদ্বান অধ্যায় রচনা করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরবে, সে আল্লাহভীরু ওলীদের এবং তার সফলকাম বিজয়ী দলের অন্তর্ভুক্ত হবে। ইমাম মালেক ও অন্যান্য সালাফ বলতেন, اَلسُّنَّةُ كَسَفِيْنَةِ نُوْحٍ مَنْ رَكِبَهَا نَجَا وَمَنْ تَخَلَّفَ عَنْهَا غَرِقَ ‘সুন্নাহ হল নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর নৌকার মত। যে তাতে আরোহণ করেছিল সে মুক্তি পেয়েছে এবং যে তার থেকে পিছনে ছিল সে ডুবে গেছে’।[১] ইমাম যুহরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, আমাদের পূর্বের আলেমগণ বলতেন,  اَلْاِعْتِصَامُ بِالسُّنَّةِ نَجَاةٌ ‘সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা হল মুক্তির পথ’।[২]

পূর্বের আলোচনার মাধ্যমে পরিষ্কার বুঝা গেল যে, আল্লাহ তা‘আলা যে অসীলায় পথভ্রষ্টদের হেদায়াত করেন, তাদের সঠিক পথ দেখান ও পাপীদের তওবাহ কবুল করেন, সে মাধ্যমটি অবশ্যই এই হেদায়াতের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে যা নিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পাঠিয়েছিলেন। অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর মাঝে থাকতে হবে। নয়তোবা আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যে দ্বীন বা হেদায়াত নিয়ে পাঠিয়েছেন তা যদি হেদায়াত দেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট না হয় তাহলে প্রমাণ হবে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দ্বীন অসম্পূর্ণ, যা সম্পূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন আছে। জেনে রাখা উচিত যে, সৎ ও সঠিক আমলসমূহ সম্পাদন করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াজিব বা মুস্তাহাব হিসাবে নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং নষ্ট ও ভ্রান্ত আমলসমূহ থেকে নিষেধ করেছেন। আর যদি কোন আমলের মাঝে কল্যাণ ও অকল্যাণ উভয়টিই থাকে। সে ব্যাপারে শরী‘আত প্রণেতা মহাবিজ্ঞ। সুতরাং তার অকল্যাণের চেয়ে যদি কল্যাণ বেশি হয়, তাহলে সে আমলকে শরী‘আত হিসাবে গণ্য করেছেন। আর যদি তার কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ বেশি হয়, তাহলে সে আমলকে শরী‘আত হিসাবে গণ্য করেননি। বরং তার থেকে নিষেধ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الۡقِتَالُ وَ ہُوَ کُرۡہٌ لَّکُمۡ  وَ عَسٰۤی اَنۡ تَکۡرَہُوۡا شَیۡئًا وَّ ہُوَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ  وَ عَسٰۤی اَنۡ تُحِبُّوۡا شَیۡئًا وَّ ہُوَ شَرٌّ لَّکُمۡ   وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ  وَ اَنۡتُمۡ  لَا تَعۡلَمُوۡنَ

‘জিহাদকে তোমাদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্যরূপে অবধারিত করা হয়েছে এবং এটা তোমাদের নিকট অপ্রীতিকর; বস্তুত তোমরা এমন বিষয়কে অপসন্দ করছ, যা তোমাদের পক্ষে বাস্তবিকই মঙ্গলজনক। পক্ষান্তরে তোমরা এমন বিষয়কে পসন্দ করছ, যা তোমাদের জন্য বাস্তবিকই অনিষ্টকর এবং আল্লাহই অবগত আছেন আর তোমরা অবগত নও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৬)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الۡخَمۡرِ وَ الۡمَیۡسِرِ  قُلۡ فِیۡہِمَاۤ اِثۡمٌ  کَبِیۡرٌ  وَّ مَنَافِعُ  لِلنَّاسِ وَ اِثۡمُہُمَاۤ  اَکۡبَرُ مِنۡ نَّفۡعِہِمَا

‘মাদক দ্রব্য ও জুয়া খেলা সম্বন্ধে তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে, আপনি বলুন, এ দু’টির মধ্যে গুরুতর পাপ রয়েছে এবং কোন কোন লোকের জন্য (কিছু) উপকার আছে, কিন্তু ও দু’টির লাভ অপেক্ষা পাপই গুরুতর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৯)। অকল্যাণ বেশি থাকার কারণেই আল্লাহ তা‘আলা মদ ও জুয়াকে হারাম করেছেন।

এমনিভাবে যে সকল আমলকে মানুষ আল্লাহর নৈকট্যলাভের মাধ্যম মনে করে, অথচ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেটাকে শরী‘আত হিসাবে গণ্য করেননি; তাহলে বুঝতে হবে যে, অবশ্যই ঐ আমলের অকল্যাণের চেয়ে কল্যাণ বেশি থাকত, তাহলে শরী‘আত প্রণেতা তা উপেক্ষা করতেন না। কারণ তিনি মহাভিজ্ঞ। তিনি দ্বীনের কল্যাণকর বিষয়গুলো উপেক্ষা করবেন না এবং মুমিনদের ঐ বিষয় হতে হাত ছাড়া করবেন না, যা তাদেরকে রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য লাভ করায়।

অতএব যখন বিষয়টি স্পষ্ট হল, তখন প্রশ্নকারীকে আমরা বলব যে, প্রশ্নে উল্লেখিত বিদ্বান যিনি পাপের উদ্দেশ্যে সমবেত ব্যক্তিদেরকে তওবাহ করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উল্লেখিত বিদ‘আতী পন্থা ছাড়া তার পক্ষে তা কোনভাবেই সম্ভব হয়নি। এটা প্রমাণ করে যে, উক্ত বিদ্বান পাপীদের তওবাহ করার শারঈ পন্থা সম্পর্কে অজ্ঞ বা ব্যর্থ। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণ এদের চেয়ে জঘন্য  পাপীদেরকে শারঈ পন্থায় দা‘ওয়াত দিতেন। যার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বিদ‘আতী পন্থা থেকে মুক্ত করেছিলেন।

সুতরাং বলা জায়েয নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যে শরী‘আত দিয়ে পাঠিয়েছেন, সে শরী‘আতের মাঝে পাপীদের তওবাহ করার পদ্ধতি নেই। কারণ ধারাবাহিক সূত্রে এবং যা অস্বীকার করা যায় না তা এমনভাবে জানা গেছে যে, কুফরী, ফাসেকী ও পাপাচার থেকে শারঈ পন্থায় এত বেশি মানুষ তওবাহ করেছে, যাদের সংখ্যা শুধু আল্লাহই জানেন। সে ক্ষেত্রে উল্লেখিত বিদ‘আতী সমাবেশ পন্থার প্রয়োজন হয়নি। বরং এই উম্মতের প্রথম পর্যায়ে মুহাজির ও আনছার ছাহাবীগণ এবং তাদের যারা একনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেছেন। আর তারা তাক্বওয়াবান ও আল্লাহর শ্রেষ্ঠ অলী ছিলেন। তাঁরা শারঈ পন্থায় আল্লাহর নিকট তওবাহ করেছিলেন। এই বিদ‘আতী পন্থায় নয়। অতীতে ও বর্তমানে মুসলিমদের দেশ ও গ্রামসমূহ এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে পরিপূর্ণ রয়েছে যারা এই বিদ‘আতী পন্থায় নয়, বরং শারঈ পন্থায় আল্লাহর নিকট তওবাহ করে তাক্বওয়াবান হয়েছেন এবং আল্লাহর ভালোবাসা ও তাঁর সন্তুষ্টির কাজ সম্পাদন করে থাকেন।

অতএব বলার সুযোগ নেই যে, উল্লিখিত বিদ‘আতী পদ্ধতি ছাড়া পাপীদের তওবাহ করা সম্ভব নয়। বরং এই কথা বলা যায় যে, কতক বিদ্বানের মাঝে শারঈ পন্থা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অপারগতা রয়েছে। তার নিকট কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান নেই। সে জানে না মানুষকে কিভাবে সম্বন্ধ করলে এবং তাদের কী শুনালে আল্লাহ তাদের তওবাহ কবুল করবেন। তাই তো এই বিদ্বান শারঈ পন্থা বাদ দিয়ে বিদ‘আতী পন্থার দিকে গমন করেন। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে দু’টি।
১. যদি তিনি ধার্মিক হন, তাহলে তার উদ্দেশ্য ভালো হল, তাদের নেতৃত্ব দেয়া এবং অন্যায়ভাবে তাদের সম্পদ হাতিয়ে নেয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡاَحۡبَارِ وَ الرُّہۡبَانِ  لَیَاۡکُلُوۡنَ اَمۡوَالَ النَّاسِ بِالۡبَاطِلِ وَ یَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ

‘হে মুমিনগণ! অধিকাংশ (ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের) আলেম ও ধর্মযাজকগণ মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়রূপে ভক্ষণ করে এবং আল্লাহর পথ হতে বিরত রাখে’ (সূরা আত-তওবাহ : ৩৪)।

সুতরাং কেউ শারঈ পদ্ধতি হতে বিদ‘আতের দিকে ফিরে গেলে সেটা শুধু হতে পারে অজ্ঞতা বা ব্যর্থতার কারণে অথবা কোন অসৎ উদ্দেশ্যে। অথচ সবার কাছে পরিচিত বিষয় হল- কুরআনের কণ্ঠ শ্রবণ ছিল নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আল্লাহ তা‘আলার বান্দা এবং মুমিনগণের শ্রবণ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলা নবীগণ সম্পর্কে বলেন,

اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ مِّنَ النَّبِیّٖنَ مِنۡ ذُرِّیَّۃِ  اٰدَمَ  وَ مِمَّنۡ حَمَلۡنَا مَعَ نُوۡحٍ  وَّ مِنۡ ذُرِّیَّۃِ  اِبۡرٰہِیۡمَ وَ اِسۡرَآءِیۡلَ  وَ مِمَّنۡ ہَدَیۡنَا وَ اجۡتَبَیۡنَا  اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتُ الرَّحۡمٰنِ  خَرُّوۡا  سُجَّدًا  وَّ  بُکِیًّا

‘নবীদের মধ্যে যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন যাঁরা আদম (আলাইহিস সালাম)-এর বংশধর ও যাদেরকে আমরা নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম তাদের বংশোদ্ভূত ও যাদেরকে আমরা হেদায়াত দান করেছিলাম ও মনোনীত করেছিলাম, তাদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের নিকট দয়াময়ের আয়াত আবৃত্তি করা হলে তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ত ক্রন্দনরত অবস্থায়’ (সূরা মারইয়াম : ৫৮)। আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের ব্যাপারে বলেন,

وَ  اِذَا سَمِعُوۡا مَاۤ  اُنۡزِلَ  اِلَی الرَّسُوۡلِ تَرٰۤی اَعۡیُنَہُمۡ تَفِیۡضُ مِنَ  الدَّمۡعِ مِمَّا عَرَفُوۡا مِنَ الۡحَقِّ

‘আর যখন তারা তা শ্রবণ করে, যা রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি নাযিল হয়েছে, তখন আপনি দেখতে পান যে, তাদের চোখে অশ্রু বইতে শুরু করে, এ কারণে যে, তারা সত্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছে’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৮৩)। আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞানী বান্দাদের ব্যাপারে বলেন,

اِنَّ الَّذِیۡنَ  اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ مِنۡ قَبۡلِہٖۤ اِذَا یُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ یَخِرُّوۡنَ لِلۡاَذۡقَانِ سُجَّدًا  -  وَّ یَقُوۡلُوۡنَ سُبۡحٰنَ رَبِّنَاۤ  اِنۡ کَانَ وَعۡدُ رَبِّنَا  لَمَفۡعُوۡلًا  - وَ یَخِرُّوۡنَ لِلۡاَذۡقَانِ یَبۡکُوۡنَ وَ یَزِیۡدُہُمۡ خُشُوۡعًا

‘যাদেরকে এর পূর্বে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তাদের নিকট যখন এটা পাঠ করা হয়, তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক পবিত্র, মহান! আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েই থাকে। আর তারা কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১০৭-১০৯)। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের ব্যাপারে বলেন,

اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِرَ اللّٰہُ وَجِلَتۡ قُلُوۡبُہُمۡ وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتُہٗ زَادَتۡہُمۡ  اِیۡمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّہِمۡ یَتَوَکَّلُوۡنَ  - الَّذِیۡنَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ  یُنۡفِقُوۡنَ  - اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ حَقًّا

‘নিশ্চয় মুমিনরা এইরূপ হয় যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরসমূহ ভীত হয়ে পড়ে, আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন সেই আয়াতসমূহ তাদের ঈমানকে আরও বৃদ্ধি করে দেয়, আর তারা নিজেদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে। যারা ছালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমরা যা কিছু তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে তারা খরচ করে। এরাই সত্যিকারের ঈমানদার’ (সূরা আল-আনফাল : ২-৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَللّٰہُ  نَزَّلَ  اَحۡسَنَ الۡحَدِیۡثِ کِتٰبًا مُّتَشَابِہًا  مَّثَانِیَ  تَقۡشَعِرُّ مِنۡہُ جُلُوۡدُ الَّذِیۡنَ یَخۡشَوۡنَ  رَبَّہُمۡ  ثُمَّ  تَلِیۡنُ جُلُوۡدُہُمۡ وَ قُلُوۡبُہُمۡ  اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰہِ  ذٰلِکَ ہُدَی اللّٰہِ

‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন সর্বোত্তম বাণী সম্বলিত কিতাব যা সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয়। এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের গাত্র (শিহরিত) হয়, অতঃপর তাদের দেহ-মন প্রশান্ত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে; এটাই আল্লাহর পথ নির্দেশ’ (সূরা আয-যুমার : ২৩)।

আর কুরআন শ্রবণের মাধ্যমেই আল্লাহ তা‘আলা বহু বান্দাকে হেদায়াত দান করেছেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সকল বিষয় কল্যাণময় করেছেন। এই কুরআন সহ রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পাঠানো হয়েছে এবং আনছার, মুহাজির ও তাদের পরবর্তী অনুসারীদেরকে এরই আদেশ দিয়েছেন। কুরআনের কণ্ঠ শ্রবণের লক্ষ্যে সালাফগণ একত্র হতেন। যেমন করে ছাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) যখন একত্র হতেন, তখন তাঁদের মধ্য হতে কাউকে কুরআন পাঠ করার নির্দেশ দিতেন এবং তাঁরা শ্রবণ করতেন। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আবূ মূসা আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলতেন, তুমি আমাদেরকে আমাদের রবের স্মরণ করাও। অতঃপর আবূ মূসা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কুরআন পাঠ করতেন এবং তাঁরা শ্রবণ করতেন।

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে ছহীহ সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি আবূ মূসা আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি কুরআন পাঠ করছিলেন। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ক্বিরয়াত মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন এবং বললেন যে, لَقَدْ أُوْتِيْتَ مِزْمَارًا مِنْ مَزَامِيْرِ آلِ دَاوُدَ ‘একে দাঊদ (আলাইহিস সালাম)-এর সুমধুর কণ্ঠ দান করা হয়েছে। তিনি বললেন, গতরাত্রে আমি তোমার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম। তুমি কুরআন পাঠ করছিলে তখন আমি তোমার তেলাওয়াত মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগলাম। অতঃপর সে বলল যে, আপনি আমার তেলাওয়াত শ্রবণ করছেন আমি যদি তা জানতে পারতাম তাহলে আমি আপনার জন্য তা আরো সুন্দর করে পাঠ করতাম।[৩]

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে বললেন, তুমি আমার নিকট কুরআন পাঠ কর। আমি বললাম, আপনার কাছে আমি কুরআন পাঠ করব? অথচ তা আপনারই উপর অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি বললেন, আমি অন্যের নিকট থেকে কুরআন পাঠ শোনা পসন্দ করি। তখন আমি সূরা আন-নিসা পাঠ করলাম। যখন আমি এই আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলাম-

فَکَیۡفَ اِذَا جِئۡنَا مِنۡ کُلِّ اُمَّۃٍۭ بِشَہِیۡدٍ وَّ جِئۡنَا بِکَ عَلٰی ہٰۤؤُلَآءِ شَہِیۡدًا

‘অনন্তর তখন কী দশা হবে, যখন আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায় হতে সাক্ষী আনয়ন করব এবং আপনাকেই তাদের প্রতি সাক্ষী করব? (সূরা আন-নিসা : ৪১)। তখন তিনি আমাকে বললেন, থাম! আমি লক্ষ্য করলাম তাঁর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে।[৪]

কুরআনের কণ্ঠ শ্রবণের জন্য ঐ সকল শতাব্দীর মানুষেরা একত্র হতেন, যাদের প্রশংসায় নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, خَيْرُ أُمَّتِى الْقَرْنُ الَّذِىْ بُعِثْتُ فِيْهِمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ‘সর্বোত্তম যুগ যাদের মাঝে আমি প্রেরিত হয়েছি। অতঃপর যারা তাদের সাথে সংযুক্ত হবে। অতঃপর যারা তাদের সাথে যুক্ত হবে’।[৫]

প্রথম পর্যায়ের সালাফীগণের মাঝে কুরআনের শ্রবণ ছাড়া অন্য কোন শ্রবণের আসর ছিল না, যাকে উদ্দেশ্য করে সৎ ব্যক্তিগণ একত্র হতেন। (এমনকি) হিজায, ইয়ামান, শাম, মিসর, ইরাক, খুরাসান ও পশ্চিমা দেশগুলোর কোথাও ছিল না। বরং তাদরে পরবর্তীতে বিদ‘আতী শ্রবণের আসরগুলো তৈরি হয়েছে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)  


*মুহাদ্দিছ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র : 
[১]. ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া (দারুল ওয়াফা, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), ১১তম খণ্ড, পৃ. ৬২৩; ‘আযীয ইবনু ফারহান, আল-বাছীরাতু ফিদ দা‘ওয়াতি ইলাল্লাহ (দারুল ইমাম মালিক, ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), পৃ. ৬৩।
[২]. দারেমী, হা/৯৬; মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১১তম খণ্ড, পৃ. ৬২৩; আল-বাছীরাতু ফিদ দা‘ওয়াতি ইলাল্লাহ, পৃ. ৬৩। 
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৪৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৯৩; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৭১৭৭। 
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৫৮২, ৫০৫৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৮০০; আবূ দাঊদ, হা/৩৬৬৮; তিরমিযী, হা/৩০২৫; মিশকাত, হা/২১৯৫। 
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৫১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৩৩; আবূ দাঊদ, হা/৪৬৫৭; তিরমিযী, হা/২২২২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭১২৩, হাদীছের শব্দ আবূ দাঊদের। 




বিদ‘আত পরিচিতি (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (শেষ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
রামাযানের খুঁটিনাটি - আল-ইখলাছ ডেস্ক
আশূরায়ে মুহাররম - আল-ইখলাছ ডেস্ক
আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের স্বরূপ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ফাযায়েলে কুরআন (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ