রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ১১:৪০ অপরাহ্ন

ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান

-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন


(৩য় কিস্তি)

 
(৩) মানব রচিত জাহেলী মতবাদের আগ্রাসন

পাশ্চাত্যভিত্তিক জাহিলী মতবাদগুলো ইসলামী পুনর্জাগরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। দর্শনগুলো মুসলিম সমাজকে এমনভাবে গ্রাস করেছে, যা থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন। মানুষের মাঝে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে যে, এই মতবাদগুলো ছাড়া পৃথিবীর অগ্রগতি সম্ভব নয়। অথচ আজ পর্যন্ত উক্ত প্রত্যাশার কিছুই পূরণ হয়নি। ভবিষ্যতে হওয়ার কোন সম্ভাবনাও নেই। কারণ ধর্মহীন এই জাহিলী মতবাদগুলো বহু পূর্বেই তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছ। এ জন্য পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ড. আল্লামা ইকবাল বলেন, বর্তমান যুগের সমালোচনামূলক দর্শন, প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের পারদর্শিতা মানুষের যে অবস্থা সৃষ্টি করেছে, তা বড়ই জঘন্য ব্যাপার। এর প্রাকৃতিক দর্শন এই যোগ্যতা দিয়েছে যে,  প্রকৃতির শক্তিসমূহকে কাজে লাগাতে পারে, কিন্তু তা করেছে তার ঈমান ও বিশ্বাসের ধনকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরে। বর্তমানে বুদ্ধিমত্তার উৎকর্ষের দ্বারা মানুষের আত্মা মৃত্যুবরণ করেছে। অর্থাৎ মানুষ নিজের বিবেক ও অন্তর হতে নিরাশ হয়ে গেছে। চিন্তা ভাবনার দিক দিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, তার অস্তিত্ব তার সত্তার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। রাজনৈতিক দিক দিয়ে দেখলে দেখা যায়, একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। তার এমন ক্ষমতাও নেই যে, সে নিজের আত্মম্ভরিতা এবং ধন-দৌলতের সীমাহীন ক্ষুধার উপর জয়ী হতে পারে।[১]

পক্ষান্তরে ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা। মানুষের স্রষ্টা হিসাবে তিনিই ভাল জানেন তাদের কল্যাণ কোথায় নিহিত রয়েছে। তাই বিশ্ববাসীকে কল্যাণের বার্তা একমাত্র ইসলামই দিতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)। আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন হল ইসলাম (সূরা আলে ইমরান : ১৯)। ইসলাম ব্যতীত কেউ অন্য কোন ধর্ম, দর্শন, থিওরি মেনে চললে তা গ্রহণযোগ্য হবে না (সূরা আলে ইমরান : ৮৫)। দ্বিতীয়তঃ কেউ জীবনের কোন অংশে ইসলামকে অনুসরণ করবে, আর কোন অংশে অন্য মতবাদের অনুসরণ করবে তাও চলবে না (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৮৫)। কারণ এটা মুনাফেকী। শুধু ইসলামেরই অনুসরণ করতে হবে। তাই ইসলামের সাথে কোন মতবাদের সংমিশ্রণ চলবে না। বর্তমান বিশ্বে যে সমস্ত বস্তুবাদী মতবাদ দৃশ্যমান, সেগুলোর উৎপত্তি ও স্থায়িত্ব কতটুকু এবং ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক দিকগুলো কী কী তা অবগত হওয়া দরকার। কারণ ইসলামী পুনর্জাগরণের পরিবেশ তৈরির জন্য এটা অত্যন্ত যরূরী। নিম্নে সংক্ষেপে কয়েকটি মতবাদের অবস্থা বর্ণনা করা হল-

(ক) জাতীয়তাবাদ (Nationalism)

গবেষকদের দৃষ্টিতে ফরাসী বিপ্লবের কিছু পূর্বে অর্থাৎ ১৭৮৯ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটে। ১৭৮৯ থেকে ১৯১৪ খ্রি. পর্যন্ত এর দ্বিতীয় যুগ।[২] মানবতা বিধ্বংসী এই মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন ইটালির মুসোলীনি এবং জার্মানির ফ্যাসিবাদের উদ্যোক্তা রক্ত পিপাসু হিটলার। এর মৌলিক উপাদান ৬টি। (১) বংশ (২) অঞ্চল, (৩) ভাষা, (৪) বর্ণ, (৫) অর্থনৈতিক ঐক্য এবং (৬) শাসনতান্ত্রিক ঐক্য।[৩]  উক্ত ছয়টি উপাদানের মধ্যে ধর্মকে স্থান দেয়া হয়নি। জাতীয়তাবাদ ধর্মকে নস্যাৎ করার প্রথম কোন বিজাতীয় মতবাদ। একই স্বার্থ ও ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে একটি জাতি বলে। আর ‘জাতি’ ভিত্তিক মতবাদকে ‘জাতীয়তাবাদ’ বলে। অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে বলা হয়েছে,

"Nationalism is the desire by a group of people who share the same race, culture, language etc. to form an independent country."

অর্থাৎ ‘জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একই ভাষা, সংস্কৃতি, জাতি, গোষ্ঠী ইত্যাদির অংশীদার একদল মানুষের একটি স্বাধীন দেশ গঠনের আকাঙ্ক্ষা’।[৪] কার্ল্টন হেইস (Carleton Hayes) বলেন, জাতীয়তার সাংস্কৃতিক ভিত্তি হল, একই ভাষা এবং একই ঐতিহ্য। যখন এগুলো কোন শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে আবেগ তাড়িত দেশত্ববোধে পরিণত হয়, তখনই জন্ম নেয় জাতীয়তাবাদ।[৫]

পর্যালোচনা

জাতীয়তাবাদ জাতি ও গোত্র ভিত্তিক ধর্ম বিরোধী সংকীর্ণ মতবাদ। কতিপয় খ্রীস্টান দার্শনিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই মতবাদ পশুত্বের জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করে। এটা মূলত জাহেলী যুগে প্রচলিত গোত্র ও গোষ্ঠী ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার আধুনিক সংস্করণ। অথচ আল্লাহ তা‘আলা জাহেলী সভ্যতার দিকে ফিরে যেতে নিষেধ করেছেন (সূরা আল-মায়িদাহ : ৫০)। রাসূল (ﷺ) যাবতীয় জাহেলী কর্মকাণ্ডকে কবর দিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসনের সূচনা করেছেন।[৬] তাই এই জাহেলী মতবাদ অনুসরণযোগ্য নয়। যে সকল মুসলিম ব্যক্তি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী, তারা ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসাবে বিশ্বাস করে না। তারা যতক্ষণ এই শিরকী মতবাদকে বর্জন না করতে পারবে, ততক্ষণ আল্লাহর হেদায়াত লাভ করতে পারবে না (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫৬)। জানা উচিত যে, ইসলামকে উৎখাত করা এবং মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে গ্রাস করার জন্যই এ সমস্ত দর্শনের উদ্ভব হয়েছে। কারণ এই থিওরির মাধ্যমেই সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা শুরু করে পশ্চিমা বিশ্ব। তাই আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে কার্ল্টন হেইস বলেছেন, ‘ফরাসী বিপ্লবের পর যদিও জাতীয়তার ভিত্তিতে ইউরোপীয় মানচিত্র নতুন করে আঁকতে এবং সমন্বিত জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল, তথাপি ইউরোপীয় কোন রাষ্ট্রই একক জাতীয়তা গ্রহণ করেনি।.. জাতীয়তাবাদ শুধু বহিঃবিশ্বেই নয়, বরং ইউরোপের (এবং আমেরিকার) মধ্যেও সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠল’।[৭]

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism)

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মবিরোধী একটি প্রাচীন মতবাদ। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের সফিস্টদের চিন্তাধারায় প্রথম পরিলক্ষিত হয়। যেমন সক্রেটিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯-৩৯৯)-এর দর্শনে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কারণ রোমান ও গ্রীস সমাজ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। তবে তার পরিচিতি ও উপাদান পরিলক্ষিত হয় না। মূলকথা হল, ফরাসী বিপ্লবের পরে রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক করার মাধ্যমে আধুনিক যুগে পশ্চিম ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের আবির্ভাব হয়। এভাবে ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে বিশেষ মতবাদ হিসাবে রূপ দেন এর মূল প্রবক্তা ব্রিটেনের জর্জ জেকব হোলিয়ক (১৮১৭-১৯০৪ খৃ.)। তিনি ধর্ম ও আল্লাহর বিশ্বাসকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে উক্ত মতবাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেমে পড়েন। তার সহযোগী ছিলেন চার্লস ব্রেডলাফ (১৮৩৩-১৮৯১), ডি. ডব্লিও ফুটের (১৮১৮-১৮৮৩), থমাস কপার প্রমুখ। মূলত ১৮৩২ থেকে ১৮৬৪ সালের মাঝামাঝিতে এই মতবাদের সূচনা হয়।


Secularism ল্যাটিন শব্দ Secularis থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ বৈষয়িক (Worldly), অস্থায়ী (Temporal) ইত্যাদি। এর অর্থ হল ইহলৌকিক, ইহজাগতিক, পরজীবন বিমুখ। তাই এর অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নয়, বরং ধর্মহীনতাবাদ, বৈষয়িকতাবাদ। কারণ মানুষকে ধর্মহীন করাই এর মূল উদ্দেশ্য।[৮] The Oxford Study Dictionary-এর অর্থ করা হয়েছে, Not involving or belonging to religion. (ধর্মের সাথে সম্পর্কহীনতা, ধর্মহীনতা ইত্যাদি।)

অক্সফোর্ড এডভান্সড লার্নারস ডিকশনারীতে বলা হয়েছে, "Secularism is the belief that religion should not be involved in the organisation of society, education." ‘সমাজ, সংগঠন, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে ধর্ম সংশ্লিষ্ট হতে পারে না এমন বিশ্বাসই হল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’। অন্যত্র বলা হয়েছে,

Secularism : A system of social teaching or organisation which allows no part for the religion or the church.  এটি এমন একটি সামাজিক শিক্ষা অথবা এমন একটি সংগঠন, যেখানে ধর্ম বা চার্চের কোন প্রবেশাধিকার নেই’।[৯] অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে বলা হয়েছে, "Secularism means the doctrine that morality should be based solely on regard to the Well being of mankind in the present life to the exclusion of all consideration drawn from belief in God or in future state." ‘ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে এমন এক মতবাদ, যা মনে করে আল্লাহ বা পরকালের প্রতি বিশ্বাস নির্ভর সমস্ত বিবেচনা থেকে মুক্ত থেকে মানব জাতির কল্যাণ ‘চিন্তার’ উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে’।

Encyclopedia of Britannica-তে Secularism-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, "Any movement in society directed away from the worldliness to life on earth..."  ‘এটি এমন একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম, যা মানুষকে আখেরাত থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল পার্থিব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করায়’।[১০]

Encyclopaedia Britannic-তে ‘সেকিউলারিজম’-এর সংজ্ঞায় তারাই বলেছেন, "A movement in society directed away from other worldliness to this worldliness. In the medieval period there was a strong tendency for religious persons to despise human affairs and to meditate on God  and the after life."  অর্থাৎ ‘এটি এমন একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম, যা মানুষকে পরকাল থেকে মুখ ফিরিয়ে শুধু দুনিয়াবী জীবনের প্রতি নির্দেশ করে। যা মধ্যযুগে (শেষের দিকে) ধার্মিক ব্যক্তির স্বীয় কর্মের প্রতি এবং ঈশ্বর ও পরকালে বিশ্বাসী ব্যক্তির প্রতি তাচ্ছিল্যের প্রবণতা তীব্রভাবে সূচনা করে’।[১১]  

উক্ত মতবাদের মূল শ্লোগান হল, "Religion should not be allowed to come into politics. It is merely a matter between man and god." অর্থাৎ ‘ধর্মকে রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশাধিকার দেওয়া উচিত নয়। এটি মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যকার একটি (আধ্যাত্মিক) বিষয় মাত্র’।[১২] উক্ত মতবাদের উপাদান তিনটি। যেমন-

"Secularism is a code of duty pertaining to life founded on considerations purely human and intended mainly for those who find theology indefinite or inadequate, unreliable or unbelievable. Its essential principles are three : the improvement of this life by material means. That science is the available providence of men. That it is good to do good whether there is other good or not, the good of present life is good and it is good to seek that good."

অর্থাৎ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল মানুষের ইহলৌকিক দায়িত্ব সংক্রান্ত গুণাবলী এবং যারা ধর্মতত্ত্বকে অপূর্ণ, অস্পষ্ট, আস্থা স্থাপনের অযোগ্য এবং অবিশ্বাস মনে করে ধর্মনিরপেক্ষতা তাদের জন্য। এর মূল উপাদান তিনটি : এক. ইহলৌকিক জীবনের উন্নয়ন কেবল বস্তুর মাধ্যমেই হওয়া সম্ভব। দুই. বিজ্ঞানই মানুষের জন্য একটি প্রাপ্তিসাধ্য ইশ্বর। তিন. যেকোন ভাল কাজই ভাল, অন্য কোন ভাল থাকুক বা না থাকুক। বর্তমান জীবনের জন্য যা ভাল তার সন্ধানই শ্রেয়’।[১৩]

পর্যালোচনা

খ্রীস্টান পোপদের ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে উক্ত মতবাদের সূচনা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা একটি কুফরী মতবাদ। এর মৌলিক উদ্দেশ্য হল- মানুষকে ধর্মহীন করা। প্রথমতঃ পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনের বিশাল গো-  থেকে ধর্মকে উৎখাত করে কেবল ধর্মীয় জীবনে বন্দী করা। অতঃপর ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে কটূক্তি করে এবং তার অনুশাসনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ব্যক্তি জীবন থেকেও ধর্মের মূলোৎপাটন করা। উক্ত সংজ্ঞাগুলো থেকে এটাই প্রমাণিত হয়। বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। অথচ এটিও একটি ধর্ম, যা আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। যারা এর নীতি-পদ্ধতির অনুসরণ করে, নিঃসন্দেহে তারা এর অনুসারী। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ হল কী করে?

এই ধর্মহীন মতবাদ মানুষের ধর্মীয় জীবন ও বৈষয়িক জীবন বলে যিন্দেগীকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছে এবং বৈষয়িক জীবনকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। স্বার্থের কারণে মুসলিম জীবনকে উক্ত দুই শ্রেণীতে ভাগ করা শরী‘আত সম্মত নয়। আল্লাহ বলেন,

اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡفُرُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ رُسُلِہٖ وَ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یُّفَرِّقُوۡا بَیۡنَ اللّٰہِ وَ رُسُلِہٖ وَ یَقُوۡلُوۡنَ نُؤۡمِنُ بِبَعۡضٍ وَّ نَکۡفُرُ بِبَعۡضٍ ۙ وَّ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یَّتَّخِذُوۡا بَیۡنَ ذٰلِکَ  سَبِیۡلًا- اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ حَقًّا ۚ وَ اَعۡتَدۡنَا لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابًا مُّہِیۡنًا

‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও রাসূলগণের সাথে কুফুরী করে, তাদের মাঝে পার্থক্য করার ইচ্ছা করে এবং যারা বলে, আমরা শরী‘আতের কিছু বিষয়ের প্রতি ঈমান আনব, আর কিছু বিষয়কে অস্বীকার করব, এছাড়া যারা মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করতে চায়, তারাই প্রকৃত কাফের। আর আমরা কাফেরদের জন্য অপমানজনক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি’ (সূরা আন-নিসা : ১৫০-১৫১)।

তাই একজন মুসলিম ব্যক্তি এই মতবাদকে গ্রহণ করতে পারে না। ইসলামের মূল উদ্দেশ্য মানুষকে প্রকৃত দ্বীনদার বানানো। আর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল উদ্দেশ্য মানুষকে ধর্মহীন দুনিয়াদার বানানো। আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন মানুষকে দ্বীনী অনুশাসনের মাধ্যমে আল্লাহর গোলামে পরিণত করে। পক্ষান্তরে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে মানবরূপী পশুতে পরিণত করে। তাছাড়া ইসলামের ভিত্তি হল আল্লাহ প্রদত্ত অহি। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ভিত্তি হল মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত নাস্তিক্যবাদ। এটি উচ্ছৃঙ্খল ও বল্গাহীন জীবনের নাম। ইসলাম মানুষের সার্বিক জীবনের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কেবল ব্যক্তিগত ব্যাপার।

(গ) সাম্যবাদ (Communism)

১৮৪৮ সালে কার্লমার্কস (১৮১৮-১৮৮৩ খ্রি.) ও এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৬ খ্রি.) সমাজতন্ত্রের ইশতেহার প্রকাশ করে এর সূচনা করেন। তারা শ্রেণীসংগ্রাম ও বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সর্বহারা মানুষের মুক্তি কামনা করেন। তারা মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে হরণ করতে চেয়েছেন সমূলে। যেমন কার্লমার্কস স্রষ্টাকে অস্বীকার করে বলেছেন,  "It is not religion that creates man but man who creates religion. Religion is the groan of the down frodden creature. It is the opium..... the idea of God must be destroyed." ‘ধর্ম মানুষকে সৃষ্টি করেনি, বরং মানুষই ধর্ম সৃষ্টি করেছে। ধর্ম নিপীড়িত মানবগোষ্ঠীর মূর্ত আর্তনাদ। এটা আফিম... সুতরাং আল্লাহর কল্পনা মানুষের মন থেকে উৎখাত করতে হবে’। তার সহচর এঙ্গেলস বলেন, "The first world of Religions is a lie." অর্থাৎ ‘ধর্মের প্রথম শব্দটাই মিথ্যা’ (স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস)।[১৪]   

পর্যালোচনা

এটি আল্লাহদ্রোহী মতবাদ। যারা এই মতবাদের বিশ্বাসী তারা কার্লমার্কসের মত আল্লাহকে বিশ্বাস করে না। যারা আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে, তাদের বিরুদ্ধে এই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচলিত হয়। তাই কার্লমার্কস ধর্ম সম্পর্কে বিকৃত তথ্য উল্লেখ করেছেন। মূলত দ্বীন বা ইসলামের স্রষ্টা হলেন আল্লাহ। আর প্রত্যেক মানুষই ইসলাম ধর্মের উপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী, খ্রীস্টান কিংবা অগ্নিপূজক বানায়।[১৫] অর্থাৎ ধর্মহীন করে দেয়। তাছাড়া এটা চরমপন্থী মতবাদ। সকল মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানবতার উপর অত্যাচার করা হয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ১৯১৭ সালে লেলিন রাশিয়ায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও তা ছিল লক্ষাধিক মানুষের রক্তে রঞ্জিত শাসন ব্যবস্থা। অনুরূপ মাওসেতুং চীনে মডারেট সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও ২ কোটি মানুষকে হত্যা করেছেন।[১৬]

অতএব কোন মুসলিম ব্যক্তি তো নয়ই, কোন অমুসলিম ব্যক্তিও উক্ত মতবাদের অনুসারী হতে পারে না। অনেক মুসলিম ব্যক্তি উক্ত দর্শনের পক্ষে প্রচারণা চালান। অথচ তাদের অনেকেই এই মতবাদের গোড়ার কথা মোটে জানেন না।

(ঘ) গণতন্ত্র (Democracy)

ইংরেজী Democracy শব্দের অর্থ ‘গণতন্ত্র’। গ্রীক শব্দমূল Demos ও Kratia থেকে এর উৎপত্তি। এর সাধারণ অর্থ জনগণের শাসন। অতীতে ও মধ্যযুগে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে এ অর্থেই গণতন্ত্র শব্দটি ব্যবহৃত হত। আধুনিক যুগে এটি কেবল সরকার ব্যবস্থাই নয়, বরং একটি সমাজ ব্যবস্থাকে বুঝায়। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় এটি একটি শাসনব্যবস্থা। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গের এক জনসভায় ‘গণতন্ত্র’-এর আধুনিক সংজ্ঞা দেন এভাবে- "Democracy is the government of the people by the people and for the people." অর্থাৎ ‘গণতন্ত্র এমন একটি সরকার ব্যবস্থা, যা মানুষের উপর মানুষের দ্বারা পরিচালিত মানুষের প্রভুত্বভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা বুঝায়’।[১৭]

পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সি.এফ.স্ট্রং বলেন, "Democracy implies that government which shall rest on active consent of the governed." অর্থাৎ ‘শাসিত জনগণের সক্রিয় সম্মতির উপর যে সরকার প্রতিষ্ঠিত, তাকেই গণতন্ত্র বলা যায়’। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) তাঁর 'Modern Democracies' গ্রন্থে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র এমন এক প্রকার শাসন ব্যবস্থা, যেখানে ক্ষমতা বিশেষ কোন ব্যক্তি বা শ্রেণীসমূহের হাতে না থেকে সমাজের সমস্ত সদস্যের উপর ন্যস্ত থাকে।[১৮] অধ্যাপক সিলী (Prof. Selley) বলেন, "Democracy is a form of government in which every one has a share in it."  অর্থাৎ ‘যে সরকার ব্যবস্থায় সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকে তাকে গণতন্ত্র বলে’।[১৯]   

পর্যালোচনা

গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও তার বাস্তব অবস্থার কারণে একে ইসলাম সমর্থন করে না। কারণ মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ। মানুষ কিভাবে জীবন যাপন করবে সে সম্পর্কে আল্লাহ আইন ও বিধান দিয়েছেন। তাই মানুষকে সেই বিধান অনুযায়ীই জীবন পরিচালনা করতে হবে। গণতন্ত্র যেহেতু সম্পূর্ণ মানব রচিত আইনের পৃষ্ঠপোষক, তাই ইসলামের পাল্লায় একে মাপার কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের কি এমন কিছু শরীক আছে, যারা তাদের জন্য আইন প্রণয়ন করে, যে বিষয়ে আল্লাহ অনুমতি দেননি? (ক্বিয়ামতের) ফায়ছালার ঘোষণা না থাকলে তাদের বিষয়ে ফায়ছালা হয়েই যেত। নিশ্চয় সীমালংঘনকারীদের জন্য কঠোর  শাস্তি বিদ্যমান’ (সূরা আশ-শূরা : ২১)। আল্লাহ বলেন,

مَا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِہٖۤ  اِلَّاۤ  اَسۡمَآءً سَمَّیۡتُمُوۡہَاۤ  اَنۡتُمۡ وَ اٰبَآؤُکُمۡ مَّاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ  بِہَا مِنۡ سُلۡطٰنٍ ؕ اِنِ الۡحُکۡمُ  اِلَّا لِلّٰہِ ؕ اَمَرَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِیَّاہُ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ  وَ لٰکِنَّ  اَکۡثَرَ  النَّاسِ لَا  یَعۡلَمُوۡنَ

‘আল্লাহকে ছেড়ে তোমরা শুধু কিছু নামের ইবাদত করছ, যেগুলো তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা রেখেছ। সেগুলোর প্রমাণ আল্লাহ পাঠাননি। মূলত বিধান দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করবে, আর অন্য কারো ইবাদত করবে না। এটাই সরল দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (সূরা ইউসুফ : ৪০ ও ৬৭; সূরা আল-আন‘আম : ৫৭)। তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নাযিল হয়েছে তা-ই অনুসরণ করতে হবে। এর বাইরে কোন পণ্ডিত বা মনীষীর থিওরির অনুসরণ চলবে না। আল্লাহ বলেন, اِتَّبِعُوۡا مَاۤ  اُنۡزِلَ  اِلَیۡکُمۡ  مِّنۡ  رَّبِّکُمۡ  وَ لَا تَتَّبِعُوۡا مِنۡ دُوۡنِہٖۤ  اَوۡلِیَآءَ ؕ قَلِیۡلًا مَّا  تَذَکَّرُوۡنَ ‘তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট যা অবতীর্ণ হয়েছে, তোমরা কেবল তারই অনুসরণ কর। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ কর না। তোমরা খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাক’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

وَ اَنِ احۡکُمۡ بَیۡنَہُمۡ  بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ  وَ لَا تَتَّبِعۡ اَہۡوَآءَہُمۡ وَ احۡذَرۡہُمۡ اَنۡ یَّفۡتِنُوۡکَ عَنۡۢ بَعۡضِ مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ اِلَیۡکَ

‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার দ্বারা আপনি তাদের মাঝে মীমাংসা করুন। আর আপনি তাদের দর্শনের আনুগত্য করবেন না। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন, তারা যেন আপনাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া কোন বিধান থেকে বিভ্রান্ত করতে না পারে’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৯)।

অতএব মানব রচিত দর্শনের অনুসরণ করা যাবে না। গণতন্ত্র মানব রচিত জীবন বিধান। পক্ষান্তরে ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান। আল্লাহর বান্দা ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম অনুসরণ করতে পারে না। গণতন্ত্রের শ্লোগান হল, সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। কিন্তু কুরআনের ঘোষণা হল, সকল ক্ষমতার উৎস আল্লাহ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৬৫)। গণতন্ত্র মানুষের রচিত আইন দ্বারা দেশ শাসন করে। আর ইসলাম আল্লাহর আইন দ্বারা দেশ শাসন করে। এছাড়া গণতন্ত্র ক্ষণস্থায়ী, এর বিধান ও নীতি পরিবর্তনশীল। কিন্তু ইসলামের বিধান চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনশীল। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এর কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন হবে না। গণতন্ত্রে সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড একশ্রেণীর মানুষ। ইসলামে হক্ব ও বাতিলের মানদণ্ড আল্লাহ। গণতন্ত্রে অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত। কিন্তু ইসলামে সংখ্যার কোন মূল্য নেই; বরং সত্যই চূড়ান্ত। কারণ অধিকাংশ মানুষ বাতিলপন্থী (সূরা আল-আম্বিয়া : ২৪; আল- আন‘আম : ১১৬)।

যারা গণতন্ত্রের স্রষ্টা তাদের অনেকেই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, যখন তার কুফল প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। গণতন্ত্র একদিকে ধর্ম ও আখেরাত থেকে বিমুখ করে, অন্যদিকে ধনীদের মাধ্যমে সাধারণ জনতাকে শোষণ করে। এটা দুর্বৃত্তের স্বৈরতন্ত্র। ফরাসী দার্শনিক জ্য জ্যাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) বলেন,

"In the strict sense of the term, there has never been a true democracy, and there never will be. It is contrary to the natural order that the greater number should govern and the smaller number be governed." 

‘সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে বলতে হয়, কোথাও প্রকৃত গণতন্ত্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না এবং কখনো পাওয়া যাবেও না। কারণ এটা প্রাকৃতিক রীতিবিরুদ্ধ। এর নীতি হল, সংখ্যাগরিষ্ঠকে শাসন করতে হবে আর সংখ্যালঘুকে শাসিত হতে হবে’।[২০]  

মূলত আলোচিত উক্ত মতবাদগুলোর নিজস্ব কোন স্থায়িত্ব নেই। মতবাদ হিসাবে পরিচিত হওয়ার দেড় থেকে দুইশ’ বছরের মাথায় এগুলোর মুখ থুবড়ে পড়েছে। স্বৈরশাসন, সাম্রাজ্যবাদী কৌশল ও বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের পাহারায় এগুলো কেবল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়। এই দর্শনগুলোর পৃষ্ঠপোষক বৃটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, চীন, জার্মানি, ভারত প্রভৃতি রাষ্ট্র হলেও কোন দেশেই এর কার্যকর ভূমিকা নেই। কিন্তু ইসলাম দীর্ঘকাল ব্যাপী পৃথিবী পরিচালনা করেছে পরম গৌরবের সাথে। যার ঐতিহ্য ও অবদানকে জ্ঞানীরা এখনো স্মরণ করেন। তাই একমাত্র ইসলামই অনুসরণযোগ্য।

বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন ও মতবাদের নামে যা চালু আছে তা মূলত বস্তুবাদ। তাই এগুলোর মাঝে নৈতিক উন্নয়নের কোন মেডিসিন নেই। তাই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে যত উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে নৈতিক অবক্ষয় তত বেশী হয়েছে। যেমন মুহাম্মাদ আসাদ তার Islam at the cross-road গ্রন্থে বলেন,

"No doubt, there are still may individuals in the west who feel and think in a religious way and make the most desperate efforts to reconcile their beliefs with the spirit of their civilisation, but they are exceptions only. The average occidental-be he a Democrat or Fascist, a Capitalist or a Bolshevik, a manual worker or an intellectual-knows only one positive 'religion', and that is the worship of material progress, the belief that is no oter goal in life than to make life continually easier or, as the current expression goes, 'independent of nature'. The temples of this 'religion' are the gigantic factories, cinemas, chemical laboratories, dancing halls, hydro-electric works; and its priests are bankers, engineers, film-stars, captains of industry, finance magnates. The unavoidable result of this craving after power and pleasure in the creation of hostile groups armed to the teeth and determined to destroy one another whenever and wherever their respective interests come to a clash. And on the cultural side the result is the question of practical utility alone, and whose highest criterion of good and evil is the material success."

‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে, পশ্চিমা দেশগুলোতে এখনো এমন বহু লোক আছে, যারা ধর্মীয় ধারায় অনুভব করেন, চিন্তা করেন এবং প্রাণপণ চেষ্টা করেন তাদের ধর্ম-বিশ্বাস ও সভ্যতার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে। তারা হচ্ছেন ব্যতিক্রম মাত্র। কিন্তু গণতন্ত্রী অথবা ফ্যাসিস্ট, পুঁজিবাদী অথবা সমাজতন্ত্রী বলশেভিক, দিন মজুর অথবা বুদ্ধিজীবী-ইউরোপের যেকোন সাধারণ ও মধ্যম শ্রেণীর মানুষ একটি মাত্র ধর্মকেই চেনে ও জানে আর তা হল বস্তুবাদী অগ্রগতির পূজা। তার বিশ্বাস হল, জীবনকে ক্রমাগত মুক্ত, বাধাহীন ও সহজতর করে তোলা ব্যতিরেকে জীবনের আর কোন লক্ষ্য নেই বা প্রচলিত কথায়- প্রকৃতি নিরপেক্ষ হওয়াই ধর্ম। বিরাট বিরাট কারখানা, সিনেমা, রাসায়নিক গবেষণাগার, নাচঘর তথা নৃত্য-কলা ভবন, পানি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে এই ধর্মের মন্দির আর তার পুরোহিত হল ব্যাংকার, ইঞ্জিনিয়ার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পপতি ও অর্থবিত্তের অধিকারী কৃতবিদ্য পুরুষ। ক্ষমতা ও আনন্দের এই নেশার অপরিহার্য পরিণাম হয়েছে এই যে, যেখানে সেখানে স্বার্থের সশস্ত্র দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এর ফল হয়েছে, এমন এক ধরনের মানুষের সৃষ্টি যাদের নীতি-বোধ নিছক উপযোগবাদের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ। আর এর ভাল-মন্দের মাপকাঠি হচ্ছে একমাত্র বস্তুবাদী সাফল্য ও কামিয়াবী’।[২১]  

অতএব প্রাচীন ও আধুনিক যত মতবাদ আছে সবগুলোকে উপেক্ষা করে নৈতিক ও জাতীয় উন্নয়নের একমাত্র প্রতীক সর্বশেষ নাযিলকৃত জীবনাদর্শ ইসলামের দিকে ফিরে আসতে হবে।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

তথ্যসূত্র :
[১]. সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী, অনুবাদ : মাওলানা ওবাইদুল হক, মুসলিম বিশ্বে ইসলামী আদর্শ ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জুন ২০০৪ খৃ.), পৃ. ৯৪।    
[২]. Hans Kohn, The Idea of Nationalism (New York : McMillan, 1948 AD), p. 16.  
[৩]. মাসিক আত-তাহরীক, ৩য় বর্ষ (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০০ খৃ.), ৪র্থ ও ৫ম যুগ্ম সংখ্যা, পৃ. ৪-৫।  
[৪]. Oxford Advenced Learner's Dictionary, sixth edition, edited by Sally Wehmeier; phonetics editor Michael Ashby; Oxford UNIVERSITY PRESS.
[৫]. C. J. Hayes, Nationalism : A Religion (New York : Mcmillan, 1960 AD), p. 6.; ড. তাহির আমিন, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ (ঢাকা : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট, জুলাই ২০০৮ খৃ.), পৃ. ৩২।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৩৫৫, হা/১২১৮, ‘হজ্জ’ অধ্যায়।
[৭]. C. J. Hayes, Nationalism : A Religion, p. 6.; ড. তাহির আমিন, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ, পৃ. ৩২।
[৮]. পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি, পৃ. ২১।
[৯]. Longman Dictionary of contemporary English compiled by Randolph Quirk, Paul Protector, Editor in Chief, March 1978.
[১০]. Encyclopedia of Britannica, 15th Edn. 2002 AD.Vol-X. p. 594.   
[১১]. Encyclopadia Britannica, 9/19.   
[১২]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তিনটি মতবাদ (ঢাকা : পাহলেয়ান প্রেস, জানুয়ারী ১৯৮৭ খৃ.), পৃ. ১৮।
[১৩]. English Secularism, P. 35; ইসলামী রাজনীতি সংকলন, পৃ. ৫২-৫৩।
[১৪]. আল্লামা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কোরাইশী, আল-ইসলাম বনাব কমিউনিজম (ঢাকা : আল-হাদীছ প্রিন্টিং, আগস্ট ২০০০ খৃ.), পৃ, ১২।
[১৫]. সূরা আর-রূম : ৩০; ছহীহ বুখারী, পৃ. ১৭৩, হা/১৩৮৫, ‘জানাযা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭৯।
[১৬]. ডা. যাকির নায়েক, লেকচার সমগ্র, পৃ. ৬০৫।
[১৭]. সৈয়দ মকসুদ আলী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ৩য় সংস্করণ, জুন ১৯৮৩ খৃ.), পৃ. ২৮৫। 
[১৮]. দ্বীপক কুমার আঢ্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান (ঢাকা : দিকদর্শন প্রকাশনী, ডিসেম্বর ২০১১ খৃ.), পৃ. ২১৯।   
[১৯]. মোঃ মকসুদুর রহমান, রাষ্ট্রীয় সংগঠনের রূপরেখা (রাজশাহী : ইমপিরিয়াল বুকস, জানুয়ারী ১৯৯১ খৃ.), পৃ. ৭৬।   
[২০]. ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৪৪তম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, পৃ. ২৩৬।  
[২১]. Muhammad Asad,  ISLAM AT THE CROSSROADS (GIBRALTAR : DAR AL-ANDALUS, 1982 AD), 44.




চোগলখোরী করা ও তার পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
বিদ‘আত পরিচিতি (১১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সর্বশ্রেষ্ঠ আমল - হাফেয আবূ তাহের বিন মজিবুর রহমান
জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার আবশ্যকতা - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (১৩তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
শিক্ষাদানে নববী পদ্ধতি ও কৌশল - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য (২য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
মূর্তিপূজার ইতিহাস - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন

ফেসবুক পেজ