সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা
-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর*
(শেষ কিস্তি)
সূদী জঞ্জাল থেকে পরিত্রাণের উপায়
সূদপ্রথা সমাজ জীবনে মরণঘাতী অর্থনৈতিক ভাইরাস। এই ভাইরাস সমাজ থেকে দূর করতে না পারলে, এক সময় পুরো জাতিকে গ্রাস করে ফেলবে। ধনী-গরীব, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই এর বিষাক্ত ছোবলের নির্মম শিকারে পরিণত হবে। এই সমস্যা নির্মূল করার চিকিৎসা কুরআন ও ছহীহ হাদীছে দেয়া হয়েছে। যার বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূদের মূল শিকড় উপড়ে ফেলেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে সূদপ্রথার কোন চিহ্ন পর্যন্ত অবশিষ্ট রাখেননি। ফলে তৎকালীন সমাজটি হয়েছিল শান্তি-সমৃদ্ধির রোল মডেল। সারা বিশ্ব ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েছিল ঐ সুশীতল আদর্শের দিকে। যেই যুগকে ইসলামের ইতিহাসে ‘সোনালী যুগ’ বা ‘স্বর্ণ যুগ’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। সেই পরীক্ষিত নীতি ও আদর্শের বাস্তবায়ন করে আমরা সমাজ থেকে সূদপ্রথাকে চির বিদায় জানাতে পারি। এ ক্ষেত্রে সূদী নিষ্পেষণ থেকে পরিত্রাণের উপায়গুলো জানা দরকার।
(ক) সামাজিক কর্মসূচি
সূদপ্রথা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমরা সামাজিকভাবে কিছু কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে পারি। এ ক্ষেত্রে সরকারকে মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। আর জনগণকে আন্তরিকভাবে তা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় তা নির্মূল করা সম্ভব। সামাজিক কর্মসূচিগুলো হল-
১). জনসচেতনতা সৃষ্টি
সূদপ্রথার বিলোপ সাধনের জন্য গণসচেতনতার বিকল্প নেই। সূদের সামাজিক শোষণ ও অর্থনৈতিক ক্ষতিকর প্রভাব জনগণের মাঝে তুলে ধরতে হবে। সূদের সুদূরপ্রসারী ফলাফল হল সামাজিক নিঃস্বতা। যার দ্বারা ধনী আরো ধনী হয় এবং গরীব পর্যায়ক্রমে গরীব হয়। তা মানুষকে বাস্তবতার নিরিখে বোঝাতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ মুসলিম। বিধায় ইসলামী আদর্শের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা সহজ। সূদের প্রকৃত ক্ষতিকর রূপ তুলে ধরতে পারলে তা অবশ্যই ফলপ্রসু হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে সূদী কারবার স্পষ্ট হারাম। অবৈধ কর্মের শেষ পরিণতি জনগণের মাঝে তুলে ধরতে হবে। সূদের ভয়াবহতা ও পরিণামের ব্যাপারে সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করতে হবে।
প্রকৃত সত্যটা মানুষের মাঝে প্রচার-প্রসার করা ইসলামেরই বিধান। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের ভাষণের এক পর্যায়ে উপস্থিত জনতাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তিকে পৌঁছে দেয়। কেননা অনেক এমন ব্যক্তি আছে যার নিকট পরে পৌঁছে অথচ সে আসল শ্রোতা অপেক্ষা তা অধিক উপলব্ধিকারী ও রক্ষাকারী হতে পারে’।[১] বিধায় সূদের ভয়াবহতা তুলে ধরার জন্য, প্রচারের সকল পথ ও পন্থাকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা কয়েকভাগে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি।
প্রথমত : খত্বীবগণের মাধ্যমে গণসচেতনতা তৈরি করা যায়। প্রায়ই মুসলিমই জুমু‘আর ছালাতের জন্য মসজিদে যায়। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় জুমু‘আর খুত্ববাহ শুনেন। আর এ সময় মুছল্লীদের মনোযোগও থাকে অনেক বেশি। বিধায় প্রতিটি খত্বীব জুমু‘আর খুত্ববায় মাতৃভাষায় সূদ-ঘুষের ভয়াবহতা তুলে ধরবেন। এর সামাজিক ক্ষতির দিকগুলো বিশ্লেষণ করবেন। ইবাদত কবূলের শর্তগুলো বিশ্লেষণ করবেন। বৈধ রুযীর গুরুত্ব-ফযীলত ও অবৈধ রুযীর পরিণতি পর্যালোচনা করবেন। যার মাধ্যমে বহু মানুষ সচেতন হবে ইনশাআল্লাহ।
দ্বিতীয়ত : ওয়ায-মাহফিল ও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রতিটি ধর্মীয় গণজমায়েতে সূদ-ঘুষের কুপ্রভাব বিশ্লেষণ করতে হবে। শীতকালে দেশের প্রায়ই মুসলিম নারী-পুরুষ কোন না কোন ওয়ায-মাহফিলে অংশগ্রহণ করে থাকেন। তাই এই সুযোগটুকু সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। এখানে এসবের ব্যাপারে বোধগম্যভাবে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
তৃতীয়ত : ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার ও মোবাইলের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে সূদ-ঘুষের ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরতে হবে। শিক্ষামূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণসচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে গ্রুপ ডিসকাশন বা টকশো উপস্থাপন করাতে হবে। প্রকৃত সত্যটা সর্বমহলে পৌঁছে দেয়া প্রত্যেক মুসলিমেরই নৈতিক দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাণীও জানা থাকলে তা অন্যের নিকট পৌঁছে দাও’।[২] সূদ-ঘুষের নিষেধাজ্ঞা যেহেতু আল্লাহ ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে চিরন্তন বিধান, বিধায় সবার নিকট এর অবৈধতার ঘোষণা পৌঁছে দেয়া ঈমানী দায়িত্ব।
চতুর্থত : প্রিন্ট মিডিয়া তথা পত্র-পত্রিকা, দেওয়াল লিখন ও লিফলেট-পোস্টারিং-এর মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সমাজের শিক্ষিত মানুষগুলো পত্র-পত্রিকা পাঠ করে থাকেন। তারা এ সব পাঠে সচেতন হলে, তাদের দেখে অন্যরাও শিক্ষা গ্রহণ করবে। পেপার-পত্রিকায় সূদ-ঘুষের ক্ষতিকর দিকগুলো জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। কথায় আছে প্রচারেই প্রসার। এসবের ভয়াবহতা ও ক্ষতিকর দিক যতবেশি প্রচার করা হবে, তা ততদ্রুত নির্মূল করা সম্ভব হবে।
২). জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রতকরণ
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই মুসলিম। বিধায় দ্বীনকে তারা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। তাদের আখেরাতের জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রত করতে হবে। পরকালে মানুষকে প্রতিটি কর্মের সঠিক জবাব প্রদান করতে হবে। অন্যথা কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এই জবাবদিহিতার অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। যেমন একটি হাদীছে সকলকে লক্ষ্য করে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, أَلَا كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُوْلٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে’।[৩] রাষ্ট্রের প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে দায়িত্বানুভূতি জাগিয়ে তুলতে হবে। যেন সকলে শেষ জীবনে স্বীয় কর্মের হিসাব দেয়ার বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে। আর বিচারের মাঠে প্রত্যেককে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে। উত্তর না দেয়া পর্যন্ত সামনে পা বাড়ানোর সুযোগ দেয়া হবে না। তন্মধ্যে প্রত্যেককে প্রশ্ন করা হবে, وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيْمَ أَنْفَقَهُ ‘আর সম্পদ সম্পর্কে, কিভাবে তা আয় করেছে এবং কোন্ পথে তা ব্যয় করেছে’।[৪] সকলের মাঝে পরকালীন জবাবদিহিতা জাগ্রত করতে হবে। পাশাপাশি এরূপ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয়ভাবেও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা যরূরী।
৩). সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা
সূদ-ঘুষ একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যার দরুন সূদ-ঘুষকে মানুষ অন্যায় মনে করে না। সূদখোরেরা সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে চলতে দ্বিধাবোধ করে না। অধিক টাকার মালিক হওয়ায় গর্বে বুক ফুলিয়ে সমাজে চলাফেরা করে। যা দেখে অন্যরা এর প্রতি প্ররোচিত হয়। বিধায় সূদখোর, ঘুষখোর ও অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সর্বমহল থেকে তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখতে হবে। তাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যাবে না। তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। এমনকি এরূপ ব্যক্তিকে সমাজের কোন পর্যায়ে দায়িত্বশীল বানানো যাবে না। তাদেরকে জনপ্রতিনিধির আসন অলংকৃত করতে দেয়া হবে না। এরূপ অর্থনৈতিক দুর্নীতিবাজদের প্রশাসনিক কোন পদে রাখা যাবে না। সর্বোপরি এদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাহলে এসবে বিলোপ সাধন করা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।
(খ) অর্থনৈতিক কর্মসূচি
সূদ-ঘুষ থেকে পরিত্রাণের জন্য সামাজিক কর্মসূচির সাথে কতিপয় অর্থনৈতিক কর্মসূচিও যরূরী। ইসলাম স্বীকৃত বৈধ অর্থনীতি ব্যতীত তা দূর করা যাবে না। এসবের থেকে পরিত্রাণ পেতে এর বিকল্প ব্যবস্থাও রাখতে হবে। যে পদ্ধতির সুষ্ঠু ব্যবহার করে মানুষ স্বীয় প্রয়োজন মেটাতে পারবে। এরূপ কিছু অর্থনৈতিক কর্মসূচি উপস্থাপন করা হল-
১). শরী‘আহ ভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান
সূদ-ঘুষের বিলোপ সাধন করতে চাইলে শরী‘আহ ভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান আবশ্যক। যাকে আমরা আধুনিক পরিভাষায় বলতে পারি ব্যাংকিং ব্যবস্থা। আর ব্যাংকিং ব্যবস্থা নাম সর্বস্ব হলে হবে না। অথবা সূদের সাথে আপস করে পরিচালিত হলেও হবে না। তা হতে হবে পুরোপুরি ইসলামী শরী‘আহ ভিত্তিক। আর এটা বাস্তবে রূপ দিতে যা প্রয়োজন তাই করতে হবে। নতুবা সমাজ থেকে সূদ নামক অক্টোপাস থেকে জাতিকে মুক্ত করা সম্ভব হবে না। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনা করতে হবে। তা পরিচালনার জন্য থাকতে হবে একগুচ্ছ অভিজ্ঞ ও তাক্বওয়াশীল ওলামায়ে কেরাম। যারা প্রত্যেকে হবেন সমাজের জন্য আদর্শ। শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে সব পরিকল্পনা বিফলে যাবে। এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনার সংবিধান বা গঠনতন্ত্র হবে আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছ।
এই অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে সূদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। মানুষ প্রয়োজনের তাকীদে সেখান থেকে ঋণ নিতে পারবে। জনগণকে পরকালীন জবাবদিহিতার প্রেরণায় গড়ে তুলতে পারলে কেউ ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করবে না। কেউ অহেতুক কাজে ঋণও নিবে না। কেউ অন্যায় পন্থা অবলম্বন করলে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দেশের কোটি কোটি অলস টাকা ব্যাংকে খাটবে। যারা টাকা জমা রাখবে তাদেরকে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে মাস শেষে লভ্যাংশের ভাগ দিতে হবে। কোন অসৎ ও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি এসবের দায়িত্বে থাকলে সব ভেস্তে যাবে। কোন চোরায় পথে কেউ প্রবেশ করলে এবং তা দৃষ্টিগোচর হওয়ার সাথে সাথে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে সর্বনি¤œ পর্যন্ত কারো জন্য আইন শিথিল করা যাবে না। সারা দেশ থেকে উপযুক্ত ও বাছাইকৃত ব্যক্তিদের এসব দায়িত্বে নিয়োগ দিতে হবে।
২). কর্যে হাসানার ব্যবস্থাকরণ
সূদী কারবার নির্মূলের জন্য কর্যে হাসানার প্রচলন করা যরূরী। জনগণকে কর্যে হাসানাহ প্রদানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝাতে হবে। এর ইহকালীন ও পরকালীন উপকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। আবার ঋণগ্রহীতাকে দ্রুত ঋণ পরিশোধের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। অন্যথা তার ভয়াবহ পরিণামের বিষয়েও অবহিত করতে হবে। একদিকে সূদমুক্ত ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা, অপরদিকে কর্যে হাসানাহ গ্রহণের অবাধ সুযোগ থাকবে। এমনিতেই মানুষ পুঁজিবাদী চিন্তাধারার সূদকে চিরদিনের জন্য বিদায় জানাবে।
৩). যাকাতভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ
যাকাত ইসলামী অর্থনীতির মূল উপাদান। ইসলামী রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ ও স্থায়ী আয়ের উৎস। যাকাত আল্লাহ প্রদত্ত বিধান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তোমরা ছালাত প্রতিষ্ঠিত কর ও যাকাত প্রদান কর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১১০)। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বহুস্থানে যাকাত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা যাকাত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদ- সদৃশ। কোন ব্যক্তির স্বীয় পরিবারের খরচ নির্বাহের পর বছরান্তে যা উদ্বৃত্ত থাকে, তা যদি সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বাহান্ন তোলা রূপার সমমূল্যের হয়, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয। তখন তাকে উদ্বৃত্ত অংশের শতকরা আড়ায় টাকা যাকাত প্রদান করতে হবে। এজন্য যাকাতের সম্পদ ব্যয়ের জন্য আটটি খাতও নির্ধারণ করা হয়েছে।
যাকাতের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। যাকাতের খাতগুলো প্রমাণ করে, দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যেই ইসলামে যাকাতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটি ধনীদের সম্পদে গরীবদের সুনির্দিষ্ট অধিকারও বটে। যাকাত গরীবদের জন্য ধনিক শ্রেণীর কৃপা নয়। বরং আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক ধনীদের সম্পদে গরীবদের ন্যায্য অধিকার, যা ধনীরা আদায় করতে বাধ্য। আমাদের দেশে সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করা হলে দারিদ্র্য বিমোচন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কয়েক বছরের মধ্যে ফকীর-মিসকীনের সংখ্যা একেবারে কমে যাবে। ফলে কর্মহীন মানুষের কর্মের ব্যবস্থা এখাত থেকে করা হবে। দুঃস্থ ঋণের বা মধ্যবিত্তদের জন্য সূদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থাও করা যাবে। অনেক বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আর তাদের বেতনের জন্য সরকারকে নতুন করে ভাবতেও হবে না। যাকাতের খাত থেকেই তা ব্যয়িত হবে। পর্যায়ক্রমে সূদমুক্ত ঋণ প্রদানের জন্য বৃহতাকারের ফান্ডও গঠন করা সম্ভব হবে। যেখান থেকে সূদমুক্ত ঋণ প্রদান করে, সূদপ্রথাকে নির্মূল করা সহজ হবে।
৪). আড়ম্বরপূর্ণ ব্যয় পরিহার
সূদপ্রথা বিলোপের জন্য আড়ম্বপূর্ণ ব্যয় পরিহার করাও একান্ত প্রয়োজন। আড়ম্বপূর্ণ ব্যয় সূদকে জিইয়ে রাখতে পরোক্ষভাবে ইন্ধন যোগায়। ইসলামে অপচয় ঘৃণিত স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামে অপব্যয়-অপচয়কে ধিক্কার জানানো হয়েছে। অপরদিকে কৃপণতাকেও পরিহার করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। বিধায় অপব্যয় ও কৃপণতা দু’টিই ইসলামে জঘন্য কর্মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আড়ম্বরপূর্ণ ব্যয়ে অনেক অর্থের অপচয় হয়। যা দিয়ে সূদমুক্ত অর্থনীতি বাস্তবায়নের ফান্ডকে শক্তিশালী করা সম্ভব। অথচ ঐ অনুষ্ঠান বাদ দিলে কোনই ক্ষতি হবে না। বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনে এসব পরিহার করতে হবে। তাছাড়া ক্ষুদ্র বিনিয়োগের উপযুক্ত কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। মানুষকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে হবে। সর্বোপরি সূদ-ঘুষমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে, সফল একদিন হবেই। ইনশাআল্লাহ!
অতএব সকল প্রকার সূদ-ঘুষ নামক অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য কর্তব্য। আর তা থেকে বাঁচতে চাইলে দেশের সরকার ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এটা কোন একক ব্যক্তি বিশেষের কাজ নয়। জনগণ খুব আন্তরিক কিন্তু সরকার তা চায় না, তাহলে এ নোংরা প্রথা নির্মূল করা সম্ভব নয়। তেমনি সরকার তা উৎখাতের জোর পদক্ষেপ নিল কিন্তু জনগণের কোন সমর্থন-সহযোগিতা নেই, তাহলেও তা শতভাগ ফলপ্রসু হবে না। উভয়ের সম্মিলিত ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় সমাজ ও রাষ্ট্র বিধ্বংসী সূদ-ঘুষ প্রথা নির্মূল করা খুবই সম্ভব। সরকার ও জনগণ উভয়ে একত্রিত হয়ে কাজ করলে কোন স্বার্থান্বেষী চক্র-মহল বাধা দিয়ে টিকতে পারবে না। আর এরূপ ভালো কাজে এগিয়ে আসলে বাকীটা আল্লাহ তা‘আলা সহজ করে দিবেন ইনশাআল্লাহ!
উপসংহার
সূদ-ঘুষ সমাজ শোষণের এক মারণাস্ত্র। মানুষ অস্ত্রের আঘাতে তৎক্ষণাত মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। আর সূদ-ঘুষের বেড়াজালে মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অস্ত্রের চেয়ে এর আঘাত বেশি পীড়াদায়ক। কেননা এটা মানুষকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে শেষ করে। যা হৃদয় ভরা বেদনা নিয়ে তাকে যুগযুগ ধরে বেঁচে থাকতে হয়। সূদী কারবার মানুষকে দাসত্বে পরিণত করে। মানুষ মানুষের দাসত্ব করতে বাধ্য হয়। তাই সার্বিক বিশ্লেষণে সূদকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে।
পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার হাত ধরেই আধুনিক যুগে সূদের আগমন। সূদের অগ্রযাত্রার হাতছানিতে হারিয়ে যায় মার্কসবাদীরাও। যদিও মার্কসবাদীরা প্রথমে সূদপ্রথাকে ঘৃণার চোখে দেখত। কালক্রমে পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ উভয়ে সূদের সাথে নিজেদেকে গুলিয়ে ফেলে। সূদী কারবারই হয়ে দাঁড়ায় অর্থ বৃদ্ধির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়রূপে। একে অপরের উপর টেক্কা দিয়ে চলতে থাকে সূদে অর্থ বাড়ানোর কলা-কৌশল। অথচ বেশ দেরী হলেও পুঁজিবাদ ও মাকর্সবাদীরাও বুঝতে পেরেছে সূদপ্রথা মূলত সমাজ শোষণের আরেক নাম। ফলে তা পরিহারের জন্য তাদের অর্থনীতিবিদরাও কথা বলা শুরু করে।
পুঁজিবাদই পৃথিবীতে সূদী ব্যবসায়ের প্রধান সমর্থক। পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা অতীতে যাই বলুন না কেন, বর্তমানে পুরাতন সূদ তত্ত্বের (ঞযবড়ৎু ড়ভ ওহঃবৎবংঃ) ভুল বুঝতে আরম্ভ করেছেন। বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ কেইনস, প্রফেসর কাসেল, বার্টিল অহিল, লারনায় মনীষীরা আলোচনা করে প্রমাণ করেছেন, ‘টাকা জমানো সূদের উপর নির্ভরশীল’- এই তত্ত্ব ভুল। তারা আরো দেখিয়েছেন, ‘সূদ ক্রমশঃ নিচের দিকে এগিয়েছে’। অর্থাৎ আগে যেখানে শতকরা ৫০-৬০% টাকা পর্যন্ত সূদ দেয়া হত সেখানে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অনেক দেশে ০০.৫% পর্যন্ত সূদ দেয়া হয়েছে এবং এই গতিতে চললে সূদ শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছবে।[৫] এই মত ইঙ্গিত করে, ধনবৃদ্ধি ও অভাব মোচনের উদ্দেশ্যে পুঁজিকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে হলে সূদবিহীন অর্থনীতিই উত্তম।[৬]
এ তো গেল পুঁজিবাদী শিবিরের অর্থনীতিবিদদের কথা। অন্যদিকে মার্কসবাদীরা প্রমাণ করেছে- সূদ ছাড়াই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুষ্ঠুরূপে চলতে পারে। বর্তমানে রাশিয়া এই নীতি ভঙ্গ করলেও সূদবিহীন অর্থ পরিচালনা নীতিই রাশিয়া প্রথম গ্রহণ করেছিল। কারণ কমিউনিজমের রায় হল সূদও শোষণ বৈ আর কিছুই নয়। এই জন্যই বহু কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে সূদের প্রচলন নেই।[৭]
আধুনিক যুগের অর্থনীতিবিদদের ঘোর কেটেছে। তারাও মনে করেন সূদী অর্থনীতির মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সূদ-ঘুষও অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। অর্থ-সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ব্যাহ্যত হচ্ছে। অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধি ও অভাব মোচন এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। এ ক্ষেত্রে সফলতা লাভ ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে চাইলে সূদবিহীন অর্থনীতির বাস্তবায়ন যরূরী। যার বাস্তব শিক্ষা পেশ করা হয়েছে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে।
খ্যাতনামা ইংরেজ ঐতিহাসিক জিম বলেছেন, ‘কুরআনকে মুসলিম সমাজের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কীয়, জাতীয় আইন-কানুন সম্পর্কীয়, ফৌজদারী ইত্যাদি যাবতীয় দিকের সার্বিক জীবন-ব্যবস্থা বলা যায়। কুরআন জীবনের সর্বদিক ঘিরে রেখেছে, ধর্মীয় ইবাদত-উপাসনা থেকে আরম্ভ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, পারলৌকিক মুক্তি থেকে শুরু করে দৈহিক সুস্থতা, জাতি ও সমাজের সকল প্রকার অধিকার কর্তব্য থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ের যাবতীয় অধিকার, সচ্চরিত্রতা থেকে অন্যায়-অপরাধের সার্বিক আলোচনা, পার্থিব শান্তি থেকে পরকালীন শাস্তি ইত্যাদি সকল ধরনের আহকাম এই কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান’।[৮]
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান বাতলে দেয়া হয়েছে। যে আদর্শ বাস্তবায়ন করেই মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি বৈপ্লবিক আদর্শ সমাজ ক্বায়েম করেছিলেন। সূদ-ঘুষ বর্তমান সময়ে একটি জটিল সমস্যা। যা সমাজ জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। প্রতিনিয়ত মানবতাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। যার থেকে বাঁচার জন্য অধিকাংশ মানুষই আজ নিত্য-নতুন উপায় অবলম্বন করছে। বিধায় কুরআন-সুন্নাহর প্রকৃত শিক্ষা বাস্তবায়ন করে সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা নির্মূল করা বর্তমান সময়ের যৌক্তিক দাবী। আল্লাহ তা‘আলা দেশের সরকার ও জনগণকে সঠিক বুঝ দান করে তা বাস্তবায়নের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!!
* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৭৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৪৭৮; তিরমিযী, হা/২৬৫৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৫১৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬৬; দারেমী, হা/২৩০; মিশকাত, হা/২৬৫৯।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১, ১/৪৯১ পৃ.; তিরমিযী, হা/২৬৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৪৮৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬২৫৬; দারেমী, হা/৫৪২; মিশকাত, হা/১৯৮, পৃ. ৩২।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২০০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৯; আবূ দাঊদ, হা/২৯২৮; তিরমিযী, হা/১৭০৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৪৫৮৯; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৪৮৯; মিশকাত, হা/৩৬৮৫।
[৪]. তিরমিযী, হা/২৪১৬; দারেমী, হা/৫৩৭; ছহীহুল জামে‘, হা/৭২৯৯; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯৪৬; মিশকাত, হা/৫১৯৭, সনদ ছহীহ।
[৫]. বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন-ওংষধস ধহফ ঃযব ঃযবড়ৎু, অ. ও. ছঁৎবংযর, ঐবধফ ড়ভ ঃযব ঊপড়হড়সরপং, ঙংসধহরধ টহরাবৎংরঃু, চ. ১/৪৩.
[৬]. বিজ্ঞান সমাজ ধর্ম, পৃ. ২৪৬-২৪৭।
[৭]. বিজ্ঞান সমাজ ধর্ম, পৃ. ২৪৭।
[৮]. ডাঃ খন্দকার আব্দুল মান্নান, কম্পিউটার ও আল-কুরআন (ঢাকা : কুরআন হাদীছ রির্সাচ সেন্টার,১৯৯৬), পৃ. ১৪২-১৪৩।