সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৬:১৯ অপরাহ্ন

ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব

-মুহাম্মাদ আবূ সাঈদ*


(৩য় কিস্তি)

৪). আত্মীয়তা বৃদ্ধি ও তা সংরক্ষণের ফযীলত

নারী ও পুরুষের মাঝে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে উভয় পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়। শ্বশুরকূলের যত আত্মীয় থাকে সবাই তখন আত্মীয়ের মধ্যে গণ্য হয়। যাদের সাথে সৎ ব্যবহার করা এবং সম্পর্ক অটুট রাখা প্রত্যেক মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব। অপ্রাপ্ত বয়স্কের বিবাহ প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, বাল্য বিবাহের প্রচলন ইসলামের অভ্যুদয়ের আগেও ছিল, পরেও আছে; কিন্তু এর মানে এটা ছিল না যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সাথে সাথে শুরু হত। মূলত এর মাধ্যমে দু’টি সমাজ ও পরিবারের মধ্যে বড় মিল ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি হয়ে থাকে।[১]

ইসলামে আত্মীয়তার বন্ধন সংরক্ষণের ফযীলত সম্পর্কে অনেক নিদর্শন বর্ণিত হয়েছে। যেমন, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার এমন কতিপয় আত্মীয়-স্বজন আছে, তাদের সাথে আমি সদাচরণ করি, কিন্তু তারা আমার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করি, অথচ তারা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে। আমি তাদের ব্যবহারে ধৈর্যধারণ করি, কিন্তু তারা আমার সাথে মূর্খতা প্রদর্শন করে। তখন উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,

لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمُ الْمَلَّ وَلَا يَزَالُ مَعَكَ مِنَ اللهِ ظَهِيْرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ

‘তুমি যেরূপ বললে, যদি তুমি এরূপ আচরণই করে থাক, তবে তুমি তাদের মুখের উপর যেন গরম ছাই নিক্ষেপ করেছ। আর যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি এই নীতির উপর অটল থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তোমার সাথে একজন সাহায্যকারী থাকবেন, যিনি তাদের ক্ষতিকে প্রতিরোধ করবেন’।[২] আত্মীয়তা রক্ষা করা ব্যক্তির স্বীয় জীবিকা বৃদ্ধি এবং দীর্ঘায়ু জীবন লাভ করার অন্যতম মাধ্যম।[৩] এমনকি পরিবার-পরিজনের সাথে ভালবাসা বৃদ্ধির মাধ্যমও এটা।[৪] আত্মীয়তার ফযীলত এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, যদি কোন ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।[৫] ইসলামী শরী‘আতে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর পার্থিব ও পরকালীন শাস্তির হুমকি দেয়া হয়েছে।[৬] এজন্য আত্মীয় যদি যালিম কিংবা মুশরিকও হয়, তাহলে সে আত্মীয়তা রক্ষা করতে হবে এবং তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে হবে।[৭]

৫). যৌবনের পবিত্রতা রক্ষা

যেসব ব্যবস্থা পৃথিবীতে মানব জাতিকে সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তার মধ্যে বিবাহ ব্যবস্থা অন্যতম। মানুষের জীবনকে পবিত্র, শান্তিপূর্ণ, আনন্দময়, স্থিতি ও উন্নত তথা সর্বজনীন সুন্দর করার জন্য বিবাহ ব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজনীয়। বিবাহ হচ্ছে বৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পন্থা। আল্লাহ তা‘আলা প্রেরিত জীবন ব্যবস্থায় নর-নারীর মধ্যে প্রেমময় বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আদেশ দেবার মূল কারণ হল- মানব সম্প্রদায় যেন প্রকৃত প্রশান্তি লাভ করতে পারে। এজন্য বিবাহ বন্ধন হল প্রশান্তি লাভের নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। পৃথিবীতে সকল ধর্মে সকল জাতিতেই বিবাহ প্রথার উল্লেখ আছে। আর ইসলাম এই ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। তাই বিবাহের মূল উদ্দেশ্য হল দম্পত্তির শান্তিলাভ, আত্মসংরক্ষণ এবং সৌন্দর্য বর্ধন। বিবাহের উদ্দেশ্য কেবল কাম-বৃত্তি চরিতার্থ করা নয়। বরং স্বামী স্ত্রী পরস্পরকে মন্দকাজ ও কুৎসা থেকে রক্ষা করা। এজন্য প্রত্যেক নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যৌন স্পৃহা পরিতৃপ্তির জন্য আল্লাহ তা‘আলা সুষ্ঠু ও পবিত্র পথ বিবাহকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া যত পথ রয়েছে কিংবা মানুষ ব্যবহার করছে সবই স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ।[৮] তাই নারী-পুরুষের নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে সাবধান ও সতর্ক করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা বিবাহের পথ পেশ করেছেন এবং বিবাহ ছাড়া অন্যান্য সব পথকেই সীমালঙ্ঘন বলে ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ  لِفُرُوۡجِہِمۡ حٰفِظُوۡنَ  - اِلَّا عَلٰۤی اَزۡوَاجِہِمۡ اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُہُمۡ فَاِنَّہُمۡ غَیۡرُ   مَلُوۡمِیۡنَ  - فَمَنِ ابۡتَغٰی وَرَآءَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡعٰدُوۡنَ

‘আর সফলকাম হবে সে সব মুমিন, যারা তাদের যৌনস্থানকে পূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করে। তারা নিষ্কলংকের সাথে যৌন সম্ভোগ করে কেবল তাদের বিবাহ করা স্ত্রীদের সঙ্গে কিংবা ক্রীতদাসীদের সঙ্গে। আর যারা এ নির্দিষ্ট ছাড়া অন্য পথে যৌনাঙ্গের ব্যবহার করবে, তারা নিশ্চয় সীমালঙ্ঘনকারী’ (সূরা আল-মুমিনূন : ৫-৭)।

বিবাহ যৌন অঙ্গকে হারাম পথে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখে। বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক অপবিত্র, হারাম ও কাবীরা গুনাহ। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, لا أعلم بعد القتل ذنبا أعظم من الزنى ‘নরহত্যার পর যিনা-ব্যভিচার অপেক্ষা বড় আর কিছু আছে বলে আমার জানা নেই’।[৯] হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আল্লাহর নিকটে কোন্ গুনাহটি সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ডাকা। অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। লোকটি বলল, তারপর কোন্টি? তিনি বললেন, তোমার সন্তানকে হত্যা করা এই ভয়ে যে, সে তোমার সাথে খাবে। সে বলল, তারপর কোন্টি? তিনি বললেন, তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। উক্ত কথার সত্যায়ন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ الَّذِیۡنَ لَا یَدۡعُوۡنَ مَعَ اللّٰہِ  اِلٰـہًا اٰخَرَ  وَ لَا یَقۡتُلُوۡنَ النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰہُ  اِلَّا بِالۡحَقِّ وَ لَا یَزۡنُوۡنَ  وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ  ذٰلِکَ  یَلۡقَ  اَثَامًا

‘এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে আহ্বান করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। তবে যারা একাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৬৮)।[১০] অন্যত্র যৌন অঙ্গের হেফাযত করা, জায়েয পথে তার ব্যবহার করা এবং অন্য পথে তার ব্যবহার না করা সম্পর্কে ব্যাপক তাকীদ প্রদান করা হয়েছে এবং তার জন্য অনেক নেকীর ব্যবস্থা রয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে (সূরা আল-আহযাব : ৩৫)।

যৌবনের পবিত্রতা রক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান উপায় হল বিবাহ। আল্লাহ তা‘আলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যে ব্যক্তি নিজের যৌবনের পবিত্রতা রক্ষার জন্য বিবাহ করবে তার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ গ্রহণ করে থাকেন। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

ثَلَاثَةٌ حَقٌّ عَلَى اللهِ عَوْنُهُمُ الْمُجَاهِدُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَالْمُكَاتَبُ الَّذِى يُرِيْدُ الأَدَاءَ وَالنَّاكِحُ الَّذِى يُرِيْدُ الْعَفَافَ

‘তিন ব্যক্তি এমন, যাদেরকে সাহায্য করা আল্লাহর হক্ব। (১) আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদ (২) মুকাতাব দাস, যে মুক্তিপণ আদায়ের ইচ্ছা পোষণ করে (৩) বিবাহকারী, যে (বিবাহের মাধ্যমে) পবিত্রতার ইচ্ছা পোষণ করে।[১১] সুতরাং বিবাহ অবাধ যৌনাচার ও ব্যভিচার থেকে রক্ষা করে। চক্ষু ও মনের পবিত্রতা রক্ষা করে। তাই একজন মুসলিমের সার্বিক জীবন পবিত্র করতে বিবাহ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। 

বিবাহ যে মানুষের যৌবনের পবিত্রতা রক্ষা করে সে কথা উল্লেখ করে নারী-পুরুষ উভয়কে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে; এটা তাদের জন্য পবিত্রতম; তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ অবহিত। ঈমান আনয়নকারী নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে; তারা যেন তার মধ্যে যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ব্যতীত তাদের অলংকার বা সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, তাদের ঘাড় ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় (ওড়না বা চাদর) দ্বারা আবৃত্ত করে, তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, (পিতামহ-মাতামহ) শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নীপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনা রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো নিকট তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে না হাঁটে, হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (সূরা আন-নূর : ৩০-৩১)।

হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার দু’চোয়ালের মধ্যবর্তী বস্তু এবং দু’পায়ের মধ্যবর্তী বস্তুর যিম্মাদার হবে আমি তার জন্য জান্নাতের যিম্মাদার হব’।[১২]

উক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, যৌবনের পবিত্রতায় বিবাহের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে যে সমস্ত বর্বর পুরুষ বা নারী যৌবনের এই সমস্ত উন্মাদনা করে বেড়ায়, কয়েক বছর পর তারা এমনভাবে অকেজো হয়ে যায়, তাদের স্ত্রী থাকে না। অন্যদিকে ব্যভিচারে আসক্ত নারীদের প্রতিও এক পর্যায়ে তাদের স্বামীর দৃষ্টি থাকে না কিংবা তাদের পরবর্তীতে কেউ বিবাহও করে না। বরং যৌবিক ভাবে তারাই সুখী, যারা যৌবনের হেফাযত করতে পেরেছে এবং যৌবনের পবিত্রতা রক্ষা করতে পেরেছে। এজন্য যৌবনকালের ইবাদত আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ ইবাদত।

৬). যেনা-ব্যভিচার ও অবৈধ সম্পর্কের প্রতিরোধ

বর্তমানে যিনা-ব্যভিচার ও অবৈধ সম্পর্ক ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনাসমূহের মধ্যে অন্যতম। যিনা-ব্যভিচারের ঘটনাগুলো হরহামেশা ঘটে চলেছে। পর্যাপ্ত শাস্তির বিধান থাকলেও এর প্রয়োগ তেমন চোখে পড়ে না। ইসলামী শরী‘আতে যিনা বা ব্যভিচার ঘৃণ্যতম অপরাধ। মূলত বিবাহের পূর্বে যৌনক্রিয়া অর্থাৎ অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর মাঝে যে যৌনক্রিয়া সংঘটিত হয় এবং বিবাহের পরের যৌনক্রিয়া অর্থাৎ বিবাহিত পুরুষ ও নারীর মাঝে সংঘটিত যৌনক্রিয়া, যারা একে ওপরের সঙ্গে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ নয়। এগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন ভাবে যৌনকর্মের মাধ্যমে যিনা হয়ে থাকে। যেমন : ১. পরকীয়া- বিবাহিতদের অবৈবাহিক যৌন সম্পর্ক। ২. পতিতাবৃত্তি- অর্থ বা অন্য যেকোন কিছুর বিনিময়ে যৌনসঙ্গম। ৩. সমকামিতা- সমলিঙ্গীয়দের যৌন সম্পর্ক। ৪. অজাচার- পরিবারের সদস্য বা রক্তের সম্পর্ক আছে এমন কারো সঙ্গে যৌনসঙ্গম। ৪. পশুকামিতা- পশুর সঙ্গে যৌনসঙ্গম। . ধর্ষণ- জোরপূর্বক যে যৌনসম্পর্ক করা হয় ইত্যাদি। এছাড়াও চুম্বন, বিভিন্ন অঙ্গে স্পর্শ ও আলিঙ্গন, স্পর্শকাতর আদর, হস্তমৈথুন, মুখমৈথুন ইত্যাদি যেকোন ধরনের যৌনক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যিনার পরোক্ষ প্রকরণ হিসাবে ধরা হয়। অথচ উপরিউক্ত অবৈধ উপায়ে যৌন চাহিদা পূরণের সকল দরজা বন্ধ হয়ে যায়, যখন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও প্রাপ্তা বয়স্কা নারীর মাঝে বিবাহ হয়। এজন্যই তো মহান আল্লাহ বলেন,

وَ اُحِلَّ لَکُمۡ مَّا وَرَآءَ ذٰلِکُمۡ اَنۡ تَبۡتَغُوۡا بِاَمۡوَالِکُمۡ مُّحۡصِنِیۡنَ غَیۡرَ مُسٰفِحِیۡنَ  فَمَا اسۡتَمۡتَعۡتُمۡ بِہٖ مِنۡہُنَّ فَاٰتُوۡہُنَّ اُجُوۡرَہُنَّ فَرِیۡضَۃً

‘এতদ্ব্যতীত তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে যে, তোমরা স্বীয় ধন-সম্পদের দ্বারা ব্যভিচারের উদ্দেশ্য ব্যতীত বিবাহবদ্ধ করার জন্য তাদের অনুসন্ধান কর, অনন্তর তাদের দ্বারা যে ফলভোগ করেছ, তজ্জন্য তাদেরকে তাদের নির্ধারিত পাওনা প্রদান কর’ (সূরা আন-নিসা : ২৪)।

উক্ত আয়াতে বিবাহকে নৈতিক চরিত্রের এক দুর্জয় দূর্গ বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে অবাধ যৌনচর্চার মত চরিত্রহীনতার কাজ থেকে নিজকে বাঁচানো যায় এবং সমাজকে এর কুফল থেকে রক্ষা করা যায়। মূলত বিবাহর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর নৈতিক চরিত্রের দূর্গকে দুর্জয় করতে হবে এবং অবাধ যৌন চর্চা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে।[১৩] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

فَانۡکِحُوۡہُنَّ بِاِذۡنِ اَہۡلِہِنَّ وَ اٰتُوۡہُنَّ اُجُوۡرَہُنَّ بِالۡمَعۡرُوۡفِ مُحۡصَنٰتٍ غَیۡرَ مُسٰفِحٰتٍ وَّ لَا مُتَّخِذٰتِ اَخۡدَانٍ

‘তোমরা মেয়েদের অভিভাবকের অনুমতিক্রমে তাদের বিবাহ কর এবং যথাযথভাবে তাদের মোহর প্রদান কর, যেন তারা বিবাহের দূর্গে সুরক্ষিত হয়ে থাকতে পারে এবং অবাধ যৌনচর্চা ও গোপন বন্ধুত্বে লিপ্ত হয়ে না পড়ে’ (সূরা আন-নিসা : ২৫)। অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বিবাহের সামাজিক গুরুত্ব আলোকপাত করেছেন। কেননা বিবাহের মাধ্যমে পরিবারকে নৈতিক দূর্গের দুর্জয় রচনা করা হয়, সমাজ থেকে যিনা-ব্যভিচার বন্ধ হয়ে যায়, গোপন বন্ধুত্ব তথা অবৈধ সম্পর্ক করে যৌন স্বাদ আস্বাদন করার সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যায়।

প্রখ্যাত পণ্ডিত মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘পূর্বোক্ত আয়াতে পুরুষদের নৈতিক পবিত্রতা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। আর পরের আয়াতে সাধারণভাবে সকল শ্রেণীর মেয়েদের নৈতিক চরিত্র রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে এবং এ দু’টো আয়াতেই পরিবারের দুর্জয় দূর্গ রচনার উপর গুরুত্বরোপ করা হয়েছে। তাই নারী-পুরুষের বিবাহের মাধ্যমেই পরস্পর মিলিত হবে। তাহলেই উভয়ের চরিত্র  ও সতীত্ব পূর্ণ মাত্রায় রক্ষা পাবে। মোটকথা নৈতিক চরিত্র সংরক্ষণ, যৌবনের পবিত্রতা অর্জন, সতীত্বের হেফাযতকরণ, যিনা-ব্যভিচার বন্ধকরণ, অবৈধ সম্পর্কের বিলোপ সাধন হচ্ছে বিবাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক’।[১৪]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* দাওরায়ে হাদীছ, আলাদীপুর, নওগাঁ; এম. এ, আল-হাদীছ এ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া।

তথ্যসূত্র :
[১]. ড. জামাল আল-বাদাবী, ইসলামী শিক্ষা সিরিজ, অনুবাদ : ডা. আবু খালদুন আল মাহমুদ ও ড. শারমিন ইসলাম মাহমুদ (ঢাকা : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট, ৪র্থ প্রকাশ, অক্টোবর ২০১২), পৃ. ৩৭০।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৮; মিশকাত, হা/৪৯২৪।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৪০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৭; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৩৯; মিশকাত, হা/৪৯১৮।
[৪]. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৮, সনদ হাসান।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৬; আবূ দাউদ, হা/১৬৯৬; আল-মু‘জামুল আওসাত, হা/৩৫৩৭; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৬৪।
[৬]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৪১৪; মিশকাত, হা/৪৯৩২; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৫৫; সুনানুল বাইহাকী আল-কুবরা, হা/২০৮৭১; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৬৭, সনদ ছহীহ।
[৭]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৬৭০; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩৭৪; সুনানুল বাইহাকী আল-কুবরা, হা/২১১০২; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৬৯,৭১; মিশকাত, হা/৩৩৮৪, সনদ ছহীহ।
[৮]. মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃ. ৫৭।
[৯]. ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু সালেম ইবনু জূবান, মানারুস সাবীল ফী শারহিদ দলীল, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৬৫।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৮৬১; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৬।
[১১]­. তিরমিযী, হা/১৬৬৫৫; আস-সুনান আল-কুবরা, হা/৪৩২৮, সনদ হাসান।
[১২]­. ছহীহ বুখারী, হা/৬১০৯; মিশকাত, হা/৪৮১২।
[১৩]­. পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃ. ৯১।
[১৪]­. পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃ. ৯১-৯২।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ
হাদীছ বর্ণনায় আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অবদান - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
বিদ‘আত পরিচিতি (৯ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
রামাযান : কুরআন নাযিলের মাস - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (৬ষ্ঠ কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ১১ রাক‘আতের নির্দেশ দিয়েছিলেন - ব্রাদার রাহুল হোসেন (রুহুল আমিন)
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (১০ম কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৪র্থ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৫ম কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
সালাম প্রদানের গুরুত্ব ও মর্যাদা - মুহাম্মাদ আরিফ হুসাইন
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৩য় কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ফাযায়েলে কুরআন (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ