শিক্ষাদানে নববী পদ্ধতি ও কৌশল
-হাসিবুর রহমান বুখারী*
অবতরণিকা
রাসূল (ﷺ)-এর আগমনের পূর্বে মক্কা তথা সমস্ত আরব ছিল- দুষ্কর্ম, অপরাধ ও পাপে জর্জরিত। অধিকাংশ আরববাসী- জুয়া, মদ্যপান, যিনা, ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, হত্যা এবং প্রতিহিংসা পরায়ণতার মত জঘন্য, অমানবিক ও ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপে যুক্ত ছিল। এ সমস্ত অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এবং সমাজে পরিবর্তনের বিপ্লব সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ও উন্নতমানের হাতিয়ারের। এরূপ ডুবন্ত ও কদর্য সমাজকে সংস্কার, সংশোধন এবং রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন ছিল বাহুবল, জনসমর্থন এবং একটি সক্রিয় সংগঠনের। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এসবের মোকাবেলা করার জন্য সবকিছুর সমতুল্য একটি হাতিয়ার প্রদান করলেন, যার নাম হল ‘শিক্ষা’। যার মাধ্যমে নবী (ﷺ) অতি অল্প সময়ে মধ্যে সমাজ সংশোধনের একটি বিশাল বড় আন্দোলন তৈরি করেছিলেন। ২১ শে রামাযান সোমবার ক্বদরের রাত্রিতে ফেরেশতা জিবরীলের আগমন হল। হিরা গুহার মধ্যে ধ্যানমগ্ন মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বললেন, إِقْرَأْ ‘পড়’। তিনি বললেন, مَا أَنَا بِقَارِئٍ ‘আমি পড়তে জানি না’। অতঃপর তাকে বুকে চেপে ধরলেন ও বললেন, পড়। কিন্তু একই জবাব, ‘পড়তে জানি না’। এভাবে তৃতীয়বারের চাপ শেষে তিনি পড়তে শুরু করলেন,
اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ ۚ﴿۱﴾ خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ عَلَقٍ ۚ﴿۲﴾ اِقۡرَاۡ وَ رَبُّکَ الۡاَکۡرَمُ ۙ﴿۳﴾ الَّذِیۡ عَلَّمَ بِالۡقَلَمِ ۙ﴿۴﴾ عَلَّمَ الۡاِنۡسَانَ مَا لَمۡ یَعۡلَمۡ
‘(হে মুহাম্মাদ (ﷺ)!) পড়ুন, আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’। ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে’। ‘পড়ুন এবং আপনার প্রভু বড়ই দয়ালু’। ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দান করেছেন’ এবং ‘তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না’ (সূরা আল-‘আলাক্ব : ১-৫)।
এটিই হল পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মানবজাতির প্রতি মহান আল্লাহর প্রথম প্রত্যাদেশ। হে মানুষ! তুমি পড় এবং লেখাপড়ার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন কর। যে জ্ঞান তোমাকে তোমার সৃষ্টিকর্তার সন্ধান দেবে এবং তাঁর প্রেরিত বিধান অনুযায়ী তোমার জীবন পরিচালনার পথ বলে দেবে। সুতরাং বুঝা গেল যে, ইসলাম আগমনের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক খুবই পুরাতন ও সুগভীর। ইসলামী সমাজ তথা মুসলিমদের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক যতদিন গভীর ছিল, ততদিন তারা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত জাতি, সেই সময় তাদের মর্যাদা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নতি দেখে ইউরোপীয়রা ঈর্ষা করত এবং ততদিন সমাজে শান্তির বাতাবরণ প্রতিষ্ঠিত ছিল। যখনই মুসলিমদের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক শিথিল হতে শুরু করেছে, তখনই তারা নিম্নগামিতার দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছে।
রাসূল (ﷺ) ও ছাহাবায়ে কিরামের যুগে শিক্ষা ব্যবস্থা
মক্কার কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে নবী (ﷺ) এক সময় মদীনা হিজরত করেছিলেন। মদীনায় প্রবেশ করে রাসূল (ﷺ)-এর উটনী যে স্থানে প্রথম বসে পড়েছিল, সেই স্থানটিই হল পরবর্তীতে মসজিদে নববীর দরজার স্থান। স্থানটির মালিক ছিল দু’জন ইয়াতীম বালক সাহল ও সোহায়েল বিন রাফি‘ বিন ‘আমর। রাসূল (ﷺ) দশ দীনার মূল্যে স্থানটি ক্রয় করলেন।[১] অতঃপর সেখানে খেজুর গাছ ও তার পাতা দিয়ে মসজিদ তৈরি করলেন। চার বছর পর এটি কাঁচা ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়।[২]
এই মসজিদটিই ছিল ইসলামের প্রাণকেন্দ্র এবং যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত প্রথম মাদরাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আরবের ছোট-বড় এবং নারী-পুরুষ সকলেই এখানে আসতেন শিক্ষা ও সভ্যতা শিখতে। মুসাফির, শিক্ষার্থীরূপী বহিরাগত মেহমান ও অসহায় ফক্বীর-মিসকিনরা এখানে রাতের বেলায় আশ্রয় গ্রহণ করতেন। দিনের বেলায় বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন এখানে দ্বীন শিখতে ও ইবাদত করতে আসতেন। প্রয়োজনে তাঁরা মসজিদের বারান্দায় খেলাধূলা করতেন। যেমন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি রাসূলুল্লহ (ﷺ)-কে দেখলাম, তিনি আমার হুজরার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন আর হাবশী যুবকেরা তাদের অস্ত্র দ্বারা মসজিদে নববীতে তাদের যুদ্ধের কলাকৌশল দেখাচ্ছে। রাসূল (ﷺ) আমাকে তাঁর চাদর দ্বারা আড়াল করে দিচ্ছেন যাতে আমি তাদের খেলা দেখতে পারি। অতঃপর তিনি আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলেন, যতক্ষণ আমি নিজে ফিরে না আসি।[৩] এখান থেকেই ইসলামী শিক্ষা, আদর্শ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে।
উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাসনামলে বাচ্চাদের শিক্ষার জন্য মসজিদে শিক্ষক ও লেখক নিয়োগ করা হয়েছিল এবং শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়েছিল। উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শিক্ষা পদ্ধতি আজও মসজিদে নববীতে চালু আছে। প্রত্যেক ছালাতের পর শিক্ষকরা বিভিন্ন প্রকার ও বয়সের ছাত্রদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন।[৪] মক্কা থেকে আগত মুহাজিরগণ মদীনায় এসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতেন। অতঃপর মসজিদে নাবাবী নির্মাণ শেষে তার পিছনে একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। যেখানে নিরাশ্রয় মুহাজিরগণ এসে বসবাস করতেন। ‘ছুফফাহ’ অর্থ ছাপড়া। যা দিয়ে ছায়া করা হয়। এভাবে মুহাজিরগণই ছিলেন আহলে ছুফফার প্রথম দল।[৫] এছাড়া অন্যান্য স্থান হতেও অসহায় মুসলিমরা এসে এখানে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতেন।[৬] পরবর্তীতে কোন ব্যবস্থা হয়ে গেলে তারা সেখানে চলে যেতেন। এখানে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণকারীগণ ইতিহাসে ‘আহলে ছুফফাহ’ বা ‘আছহাবে ছুফফাহ’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। বিখ্যাত ছাহাবী আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এখানকার অন্যতম সদস্য ও দায়িত্বশীল ছিলেন। আছহাবে ছুফফাহর সদস্যগণ অধিকাংশ সময় ই‘তিকাফ, ইবাদত ও তিলাওয়াতে লিপ্ত থাকতেন। একে অপরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন ও লেখা-পড়া শিখাতেন। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন বিষয়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। যেমন আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে এবং হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ফিৎনা সম্পর্কিত হাদীছসমূহ বর্ণনার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন।। অতঃপর রাসূল (ﷺ)-এর জীবদ্দশাতেই দারুল আরকামে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম মাদরাসা।
ইসলামের প্রথম যুগে ছাহাবায়ে কিরাম সরাসরি রাসূল (ﷺ)-এর সান্নিধ্যে থেকে দ্বীন শিখেছেন। ক্ষুদ্র পরিসরে মদীনায় ‘ছুফফাহ’ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলেও বেশির ভাগ ছাহাবী নবী (ﷺ)-এর সংস্পর্শে থেকে ইলমে দ্বীন শিখেছেন। দূর-দূরান্তে বসবাসকারী ছাহাবায়ে কিরামগণের ইলমে দ্বীন অর্জনের একটি পদ্ধতি ছিল। তাঁরা কিছুদিন মদীনায় অবস্থান করে দ্বীন শিখতেন এবং পরে ফিরে গিয়ে নিজ গোত্রের কাছে তা প্রচার করতেন। যেমন মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা সমবয়সী একদল যুবক নবী (ﷺ)-এর নিকট হাযির হলাম। ২০ দিন ও ২০ রাত আমরা তাঁর নিকট অবস্থান করলাম। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) অত্যন্ত দয়ালু ও নরম স্বভাবের লোক ছিলেন। তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, আমরা আমাদের পরিজনের নিকট ফিরে যেতে চাই বা ফিরে যাওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে পড়েছি, তখন তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, আমরা আমাদের পিছনে কাদের রেখে এসেছি। আমরা তাঁকে জানালাম। অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের পরিজনের নিকট ফিরে যাও এবং তাদের মধ্যে বসবাস কর। আর তাদের (দ্বীন) শিক্ষা দাও এবং (সৎ কাজের) নির্দেশ দাও...’।[৭]
উল্লিখিত ছাহাবীগণ ২০ দিন নবী (ﷺ)-এর দরবারে রাত-দিন অবস্থান করে ইলম শিখেছেন। তাই ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে প্রাজ্ঞ আলিমের সাহচর্য যরূরী। আর এটাই দ্বীন শেখার পদ্ধতি। ঐ যুগে নিয়মতান্ত্রিক কোন মাদরাসা ছিল না। এমনকি কোনো কিতাবও ছিল না। তাই দ্বীন শিখার একটাই পদ্ধতি ছিল, আর তা হল, যে ব্যক্তি দ্বীন শিখতে চাইতেন, সরাসরি রাসূল (ﷺ)--এর সাহচর্যে চলে আসতেন এবং মুখ থেকে মুখে, অন্তর থেকে অন্তরে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি দেখা থেকে শেখার প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন। সুতরাং দ্বীনের গভীর ও সঠিক জ্ঞান আহরণে বিজ্ঞ আলিমের সান্নিধ্যের কোন বিকল্প নেই। মুসলিমদের বিজয়ের ধারা শুরু হলে বিজিত অঞ্চলে শিক্ষক পাঠানো হত সেখানকার লোকজনকে ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য। খুলাফায়ে রাশিদীনের যুগেও এই ধারা চলতে থাকে। যেমন আবূ মূসা আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে যখন বছরায় পাঠানো হয় তখন তার সাথে ইমরান বিন হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) গেলেন বছরার মানুষদেরকে কুরআন ও শরী‘আত শিক্ষা দিতে। উবাদাহ্ ইবনু ছামিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হিমসে লোকজনকে কুরআন শিক্ষা দিতেন। মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যান ফিলিস্তিনে। আবুদ্দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) দামেশকে গমন করে মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তারা নিয়মতান্ত্রিক দারস্ দিতেন। আবুদ্দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যখন দামেশকের শাহী মসজিদে দারস্ দিতেন তখন এত মানুষের ভীড় হত, মনে হত কোন বাদশাহ আগমন করেছেন। অধিকাংশ ছাহাবায়ে কিরাম যেখানেই অবস্থান করতেন, সেখানেই তাঁরা হাদীছের দারস্ দিতেন। যেমনঃ জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) দারস্ দিতেন মসজিদে নববীতে। হুযাইফা ইবনু ইসহাক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) দারস্ দিতেন কুফার মসজিদে। এ যুগের দারসগাহের বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ:
১. কুরআন, হাদীছ ও ফিক্বহের মধ্যেই পাঠ্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। অন্য কোন বিষয় পড়ানো হত না।
২. কোন পাঠ্যপুস্তক ছিল না। পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বলা ও শোনা নির্ভর।
৩. শিক্ষাদানের জন্য কোন বেতনভাতা আদান-প্রদান করা হত না।
৪. মসজিদগুলোই ছিল মাদরাসা। মসজিদেই দারস্ দেয়া হত। মাদরাসার আলাদা কোন অবকাঠামো ছিল না।
৫. হাদীছ অন্বেষণে সফর করা হত। স্বয়ং ছাহাবায়ে কিরাম একে অপরের কাছ থেকে হাদীছ শোনার জন্য অনেক দূর সফর করতেন।
শিক্ষাদানের নববী পদ্ধতি ও কৌশল
মানবতার মহান শিক্ষক নবী (ﷺ) হলেন বিশ্ব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। অন্যকে শিক্ষাদানের পূর্বে তিনি নিজের জীবনে সে শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করে দেখাতেন। আল্লাহ তা‘আলা যাকে মানবজাতির কাছে প্রেরণ করেছেন শিক্ষক হিসাবে। তিনি নিজেই বলেন, ‘নিশ্চয় আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি’।[৮] তার অনুপম শিক্ষানীতি ও পদ্ধতিতে মুগ্ধ ছিলেন তার পুণ্যাত্মা ছাহাবী ও শিষ্যগণ। মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘তাঁর জন্য আমার বাবা ও মা উৎসর্গিত হোক। আমি তার পূর্বে ও পরে তার চেয়ে উত্তম কোন শিক্ষক দেখিনি। আল্লাহর শপথ! তিনি কখনো কঠোরতা করেননি, কখনো প্রহার করেননি, কখনো গালমন্দ করেননি’।[৯]
সকল বিষয় নিজ থেকেই আত্মস্থ করা অসম্ভব, সেজন্য শিক্ষকের প্রয়োজন, যিনি মানুষকে অস্পষ্ট, অজ্ঞাত বিষয়ে শিক্ষা দান করবেন। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতির জন্য মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে সেই দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
کَمَاۤ اَرۡسَلۡنَا فِیۡکُمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡکُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِنَا وَ یُزَکِّیۡکُمۡ وَ یُعَلِّمُکُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُعَلِّمُکُمۡ مَّا لَمۡ تَکُوۡنُوۡا تَعۡلَمُوۡنَ
‘আমরা তোমাদের মধ্য হতে এরূপ রাসূল প্রেরণ করেছি যে তোমাদের নিকট আমার নিদর্শনাবলী পাঠ করে এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে, তোমাদেরকে গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয় এবং তোমরা যে বিষয়ে অবগত ছিলে না তা শিক্ষা দান করে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫১)।
বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হলেন নবী ও রাসূলগণ। যুগে যুগে মানুষেরা তাঁদের মাধ্যমেই প্রকৃত শিক্ষা লাভ করেছে। নবী ও রাসূলগণের মধ্যে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন মুহাম্মাদ (ﷺ)। মহান আল্লাহ্ তাঁকে সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসাবে মনোনীত করেছেন। তাঁর শিক্ষাদানের পাঠ্যসূচীও আল্লাহ পাকই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে মানুষকে আল্লাহর আয়াতসমূহ পড়ে শোনানো, তাদেরকে পবিত্র করা এবং কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া। এ মর্মে কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘তিনিই উম্মীদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে তিলাওয়াত করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত। যদিও ইতঃপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল’ (সূরা আল-জুমু‘আহ: ২)। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। নবী (ﷺ) ছাহাবীদেরকে প্রত্যেকটা বিষয়েই শিক্ষাদান করেছেন, অবস্থার আলোকে অত্যন্ত কৌশলী ভূমিকায়। তাঁর কিছু শিক্ষাদান পদ্ধতি লক্ষ্য করলেই সেসব কৌশল অনুধাবন করা সম্ভব হবে। যথা:
(১) গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বারবার স্মরণ করানো
নবী করীম (ﷺ) উপদেশ দানের ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপের জন্য প্রয়োজনে একটি কথাকে তিনবার উচ্চারণ করতেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
أَنَّهُ كَانَ إِذَا تَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَعَادَهَا ثَلَاثًا حَتَّى تُفْهَمَ عَنْهُ، وَإِذَا أَتَى عَلَى قَوْمٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ سَلَّمَ عَلَيْهِمْ ثَلَاثًا
‘তিনি যখন কোন কথা বলতেন, (প্রয়োজনে) তিনবার বলতেন, যাতে তা বুঝা যায়। আর যখন কোন দল বা সম্প্রদায়ের নিকট যেতেন এবং সালাম করতেন, তখন তাদেরকে (প্রয়োজনে) তিনবার সালাম করতেন’।[১০]
(২) উপদেশের পূর্বে ভাবাবেগপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা
ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয় আলোকপাতের পূর্বে উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলী ও পরিবেশকে আলোচনার উপযুক্ত করে প্রস্তুত করা একজন শিক্ষকের অনুকরণীয় গুণ। রাসূল (ﷺ) কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা শুরু করলে বিষয়ের গুরুত্ব-মাহাত্ম্য বুঝাতে শ্রোতার দৈহিক-মানসিক অবস্থাকে গতিশীল করে তুলতেন যাতে শ্রোতারা মনোযোগী হয়ে ওঠে। তিনি জান্নাত সংশ্লিষ্ট বিষয় আলোচনা করলে তাঁর দেহে আনন্দের স্ফুরণ দেখা যেত। জাহান্নামের বিষয় সামনে আসলে ভয়ে তাঁর চেহারার রং বদলে যেত। একইভাবে যখন কোন অন্যায় ও অবিচার সম্পর্কে বলতেন, তাঁর চেহারায় ক্রোধ প্রকাশ পেত এবং কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে যেত। রাসূল (ﷺ) যখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তব্য দিতেন, তাঁর চোখ লাল হয়ে যেত, আওয়াজ উঁচু হয়ে যেত। যেন তিনি (শত্রু) সেনা সম্পর্কে সতর্ককারী’।[১১]
(৩) বাস্তব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা
রাসূল (ﷺ) মাঝে মাঝে শিক্ষাদানের সময় যে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে সে বিষয়ে চাক্ষুষ দৃষ্টান্তের জন্য উদ্দিষ্ট বিষয় বা বস্তুটি সকলের সম্মুখে পেশ করতেন। যেমন আল্লাহর নির্দেশে যে বস্তুটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতেন সেটি হাতে উঠিয়ে শ্রোতাদের সামনে উঁচু করে ধরতেন। যার ফলে বিষয়টি শ্রোতাদের অন্তরে শক্তভাবে গেঁথে যেত। আলী ইবনু আবী তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘রাসূল (ﷺ) তাঁর বাম হাতে রেশম ও ডান হাতে স্বর্ণ ধরে দু’হাত উঁচু করে বলেন, এ দু’টি জিনিস আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম, তবে নারীদের জন্য হালাল’।[১২]
(৪) প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা
আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর দরজা ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ যে কোন বিষয়ে তাঁর কাছে প্রশ্ন করার অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠিত ছিল। আরবের বিভিন্ন প্রান্ত হতে মুসলিম, অমুসলিম, নওমুসলিম ও বেদুঈনরা তাঁর কাছে এসে জীবন ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, নবী (ﷺ) তাদেরকে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। এক বেদুঈন নবী (ﷺ)-এর নিকট এসে বললেন, আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলুন যদি আমি তা সম্পাদন করি তবে জান্নাতে প্রবেশ করবো। রাসূল (ﷺ) বললেন, ‘আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করবে না। ফরয ছালাত আদায় করবে, ফরয যাকাত প্রদান করবে, রামাযান মাসে ছিয়াম পালন করবে’। সে বলল, ‘যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ করে বলছি, আমি এর চেয়ে বেশী করবো না’। লোকটি যখন ফিরে গেল, রাসূল (ﷺ) বললেন, ‘যে ব্যক্তি কোন জান্নাতী ব্যক্তিকে দেখতে পসন্দ করে সে যেন এই ব্যক্তিকে দেখে নেয়’।[১৩]
(৫) ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে উত্তর প্রদান করা
অনেক সময় রাসূল (ﷺ) ছাহাবীদের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্নের মাধ্যমে ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করতেন। জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর জানার চেয়ে প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়ের জ্ঞানার্জন যখন বেশি গুরুত্বের দাবি রাখত তখনই তিনি এরূপ করতেন। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময়কাল জিজ্ঞেস করলে তিনি তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘তুমি তার জন্য কী প্রস্তুতি নিয়েছো? লোকটি বলল, আমি এর জন্য অনেক বেশি ছালাত, ছিয়াম এবং ছাদাক্বাহ আদায় করতে পারিনি। কিন্তু আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি। রাসূল (ﷺ) বলেন, তুমি যাকে ভালোবাস তার সাথেই তোমার ক্বিয়ামত হবে’।[১৪]
(৬) পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিক্ষাদান করা
প্রত্যেক মানুষেরই দৈনন্দিন ব্যক্তিগত কাজের জন্য একান্ত কিছু সময় বরাদ্দ থাকে। সে সময়ে দ্বীনি শিক্ষা কিংবা উপদেশ দানের জন্য নির্ধারণ করা উচিত নয়, কেননা এতে হীতে বিপরীত হয়। নবী (ﷺ) ছাহাবীদেরকে উপদেশ ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাঁদের উপযুক্ত সময় ও অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন, যাতে তাঁরা ক্লান্ত বা বিরক্ত না হন। তিনি সব সময় কিংবা সপ্তাহের প্রত্যেক দিনই উপদেশ দিতেন না, বরং ছাহাবীদের মানসিক অবস্থার দিকে খেয়াল রেখে মাঝে মাঝে উপদেশ দিতেন।
(৭) পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা
পারস্পরিক আলাপ-আলোচনায় চরম দুর্বোধ্য বিষয়ও সহজ হয়ে যায়। ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা একত্রিত হলে সেখান থেকে পরামর্শের ভিত্তিতে সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ একটি বিষয় বাছাই করা সহজ হয়ে ওঠে। রাসূল (ﷺ) ছাহাবীদের মাধ্যমে এ শিক্ষাদান পদ্বতির প্রতি উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছেন। হুনাইনের যুদ্ধের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বণ্টন নিয়ে আনছার ছাহাবায়ে কিরামের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলে রাসূল (ﷺ) তাঁদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনা করেন। বদরের যুদ্ধের বন্দিদের ব্যাপারে ছাহাবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তাছাড়া রাসূল (ﷺ) খন্দকের যুদ্ধের যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে ছাহাবীদের মতামত চাইলেন এবং সালমান ফারসী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পরামর্শে পরিখা খনন করা হয়।
(৮) উপযুক্ত পরিবেশে শিক্ষাদান করা
শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ অপরিহার্য। কোলাহলপূর্ণ বিশৃঙ্খল পরিবেশ শিক্ষার বিষয় ও শিক্ষক উভয়ের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। রাসূল (ﷺ) শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অপেক্ষা করতেন। জারির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, ‘নিশ্চয় বিদায় হজ্জের সময় রাসূল (ﷺ) তাকে বলেন, মানুষকে চুপ করতে বল। অতঃপর তিনি বলেন, আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেয়ো না ...’।[১৫]
(৯) ধীরস্থিরতার সহিত পাঠদান করা
রাসূল (ﷺ) পাঠদানের সময় থেমে থেমে কথা বলতেন। যেনো তা গ্রহণ করা শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ হয়। খুব দ্রুত কথা বলতেন না যেনো শিক্ষার্থীরা ঠিক বুঝে উঠতে না পারে আবার এতো ধীরেও বলতেন না যাতে কথার ছন্দ হারিয়ে যায়। বরং তিনি মধ্যম গতিতে থেমে থেমে পাঠ দান করতেন। আবূ বাকরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তোমরা কি জানো আজ কোন্ দিন? ...এটি কোন্ মাস? ...এটি কি জিলহজ্জ নয়? ...এটি কোন্ শহর?’[১৬]
(১০) ভাষা ও দেহভাষার সমন্বয়ে শিক্ষাদান করা
রাসূল (ﷺ) কোন বিষয়ে আলোচনা করলে, তার দেহাবয়বেও তার প্রভাব প্রতিফলিত হত। তিনি দেহ-মনের সমন্বিত ভাষায় পাঠ দান করতেন। কারণ, এতে বিষয়ের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে শ্রোতা শিক্ষার্থীগণ সঠিক ধারণা লাভে সক্ষম হয় এবং বিষয়টি তার অন্তরে গেঁথে যায়। যেমন, তিনি যখন জান্নাতের কথা বলতেন, তখন তার দেহে আনন্দের স্ফূরণ দেখা যেত। জাহান্নামের কথা বললে ভয়ে চেহারার রঙ বদলে যেত। যখন কোন অন্যায় ও অবিচার সম্পর্কে বলতেন, তার চেহারায় ক্রোধ প্রকাশ পেত এবং কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে যেত। জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘রাসূল (ﷺ) যখন বক্তব্য দিতেন- তার চোখ লাল হয়ে যেত, আওয়াজ উঁচু হত এবং ক্রোধ বৃদ্ধি পেত। যেনো তিনি (শত্রু) সেনা সম্পর্কে সতর্ককারী’।[১৭]
(১১) গল্পের ছলে মিষ্টি ভঙ্গিমায় পড়ানো
শিক্ষার প্রয়োজনে শিক্ষককে অনেক সময় গল্প, ইতিহাস বলতে হয়। রাসূল (ﷺ) পাঠদানের সময় ইতিহাস ও গল্প বলতেন। তিনি গল্প বলতেন অত্যন্ত মিষ্টি করে। এমন মিষ্টি ভঙ্গিমায় গল্প, ইতিহাস স্বপ্রাণ হয়ে উঠত। জীবন্ত হয়ে উঠত শ্রোতা-শিক্ষার্থীর সামনে। আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘দোলনায় বা মায়ের কোলে কথা বলেছে তিনজন। ঈসা ইবনু মারয়াম ন ...। আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি (মুগ্ধ হয়ে) রাসূল (ﷺ)-এর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি আমাকে শিশুদের কাজ সম্পর্কে বলছিলেন। তিনি তার মুখে আঙুল রাখলেন এবং তাতে চুমু খেলেন’।[১৮]
(১২) শিক্ষার্থীর নিকট প্রশ্ন করা
রাসূল (ﷺ) পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীদের নিকট প্রশ্ন করতেন। যেনো তারা প্রশ্ন করতে এবং তার উত্তর খুঁজতে অভ্যস্ত হয়। কেননা নিত্যনতুন প্রশ্ন শিক্ষার্থীকে নিত্যনতুন জ্ঞান অনুসন্ধানে উৎসাহী করে। মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) জিজ্ঞেস করেন, ‘হে মু‘আয! তুমি কী জানো বান্দার নিকট আল্লাহর অধিকার কী? তিনি বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূল (ﷺ) বলেন, তাঁর ইবাদত করা এবং তাঁর সঙ্গে কোন কিছুকে শরিক না করা’।[১৯]
(১৩) বিষয়বস্তুর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা
বিষয়বস্তুর গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা থাকলে শিক্ষার্থী শ্রেণী কক্ষে অনেক বেশি মনোযোগী হয়। একাগ্র হয়ে শিক্ষকের আলোচনা শোনে। রাসূল (ﷺ) পাঠদানের সময় বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ফুটিয়ে তুলতেন। আবূ সাঈদ ইবনু মু‘আল্লা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা মসজিদে নববীতে ছালাত আদায় করছিলাম, এমন সময় রাসূল (ﷺ) আমাকে ডাকেন। কিন্তু ডাকে আমি সাড়া দেইনি। পরে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি ছালাত আদায় করছিলাম। তখন তিনি বললেন, আল্লাহ কি বলেননি যে, ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা সাড়া দেবে আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে, যখন তিনি তোমাদেরকে ডাক দেন’ (সূরা আল-আনফাল : ২৪)। তারপর তিনি আমাকে বললেন, তুমি মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগেই তোমাকে আমি কুরআনের এক অতি মহান সূরা শিক্ষা দিব। তারপর তিনি আমার হাত ধরেন। এরপর যখন তিনি মসজিদ থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা করেন তখন আমি তাঁকে বললাম, আপনি কি বলেননি যে আমাকে কুরআনের অতি মহান সূরা শিক্ষা দিবেন? তিনি বললেন, اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক, এটা বারবার পঠিত সাতটি আয়াত এবং মহান কুরআন যা কেবল আমাকেই দেয়া হয়েছে’।[২০]
(১৪) আগ্রহী শিক্ষার্থী নির্বাচন করা
রাসূল (ﷺ) বিশেষ বিশেষ শিক্ষাদানের জন্য আগ্রহী শিক্ষার্থী নির্বাচন করতেন। যেনো শেখানো বিষয়টি দ্রুত ও ভালোভাবে বাস্তবায়িত হয়। আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘আমার উম্মাতের মধ্য থেকে কে পাঁচটি গুণ ধারণ করবে এবং তার ওপর আমল করবে? তিনি বলেন, আমি বলি, আমি হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তখন তিনি আমার হাত ধরলেন এবং হাতে পাঁচটি বিষয় গণনা করলেন’।[২১]
(১৫) উপমা দিয়ে বোঝানো
নবী করীম (ﷺ) অনেক সময় কোন বিষয় স্পষ্ট করার জন্য উপমা ও উদাহরণ পেশ করতেন। কেননা উপমা ও উদাহরণ দিলে যে কোন বিষয় বোঝা সহজ হয়ে যায়। সাহল ইবনু সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি ও ইয়াতীমের দায়িত্ব গ্রহণকারী জান্নাতে এমনভাবে অবস্থান করব। সাহাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) তাঁর শাহাদত ও মধ্যমা আঙ্গুলের প্রতি ইঙ্গিত করেন’।[২২]
(১৬) প্রশ্নকারী শিক্ষার্থীর প্রসংশা করা
শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের আলোচনা শুনে শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। এসব প্রশ্নের সমাধান না পেলে অনেক সময় পুরো বিষয়টিই শিক্ষার্থীর নিকট অস্পষ্ট থেকে যায়। সে পাঠের পাঠোদ্ধার করতে পারে না। আর প্রশ্নের উত্তর দিলে বিষয়টি যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি শিক্ষার্থী জ্ঞানার্জনে আরো আগ্রহী হয়। রাসূল (ﷺ) শিক্ষাদানের সময় শিক্ষার্থীর প্রশ্ন গ্রহণ করতেন এবং প্রশ্ন করার জন্য কখনো কখনো প্রশ্নকারীর প্রসংশাও করতেন। আবূ আইয়ূব আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, ‘এক ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-কে প্রশ্ন করে, আমাকে বলুন! কোন্ জিনিস আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে দিবে এবং কোন্ জিনিস জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে নিবে। নবী (ﷺ) থামলেন এবং তার ছাহাবীদের দিকে তাকালেন। অতঃপর বললেন, তাকে তাওফীক্ব দেয়া হয়েছে বা তাকে হিদায়াত দেয়া হয়েছে’।[২৩]
(১৭) আমলের মাধ্যমে শিক্ষাদান
শিক্ষার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হল, প্রাক্টিক্যাল বা প্রয়োগিক শিক্ষা। রাসূল (ﷺ) সমস্ত বিষয় নিজে আমল করে ছাহাবীদের শেখাতেন। শেখাতেন হাতে-কলমে। এজন্য আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল কুরআন। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তোমরা ছালাত আদায় কর, যেমন আমাকে আদায় করতে দেখছো’।[২৪]
(১৮) বিবেকের মুখোমুখি করা
বিবেক মানুষের বড় রক্ষক। বিবেক জাগ্রত থাকলে মানুষ নানা অপরাধ থেকে বেঁচে যায় এবং বিবেকলুপ্ত হলে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাই মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার একটি সহজ উপায় হল মানুষের বিবেক ও মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলা। রাসূল (ﷺ) বিবেক ও মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলার মাধ্যমেও মানুষকে শিক্ষাদান করেছেন। যেমন এক যুবক রাসূল (ﷺ)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে ব্যভিচারের অনুমতি দিন। তার কথা শুনে উপস্থিত লোকেরা মারমুখি হয়ে উঠল এবং তিরস্কার করল। রাসূল (ﷺ) তাকে কাছে ডেকে নিলেন এবং বললেন, তুমি কি তোমার মায়ের ব্যাপারে এমনটি পসন্দ কর? সে বলল, আল্লাহর শপথ না। আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গিত করুন। রাসূল (ﷺ) বললেন, কেউ তার মায়ের ব্যাপারে এমন পসন্দ করে না। এরপর রাসূল (ﷺ) একে একে তার সব নিকট নারী আত্মীয়ের কথা উল্লেখ করেন এবং সে না উত্তর দেয়। এভাবে রাসূল (ﷺ) তার বিবেক জাগ্রত করে তোলেন’।[২৫]
(১৯) ব্ল্যাকবোর্ড বা হোয়াইটবোর্ড ব্যবহার করা
কখনো কখনো কোন বিষয়কে স্পষ্ট করার জন্য রাসূল (ﷺ) রেখাচিত্র ও অঙ্কনের সাহায্য নিতেন। যেনো শ্রোতা ও শিক্ষার্থীর স্মৃতিতে তা রেখাপাত করে। আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন নবী (ﷺ) একটি চতুর্ভুজ আঁকলেন এবং এর মধ্যখানে একটি রেখা টানলেন, যা তাত্থেকে বের হয়ে গেল। তারপর দু’পাশ দিয়ে মধ্যের রেখার সঙ্গে ভেতরের দিকে কয়েকটা ছোট ছোট রেখা মিলালেন এবং বললেন, এ মাঝের রেখাটা হল মানুষ। আর এ চতুর্ভুজটি হল তার আয়ু, যা বেষ্টন করে আছে। আর বাইরে বেরিয়ে যাওয়া রেখাটি হলো তার আশা। আর এ ছোট ছোট রেখাগুলো বাধা-বন্ধন। যদি সে এর একটা এড়িয়ে যায়, তবে আরেকটা তাকে দংশন করে। আর আরেকটি যদি এড়িয়ে যায় তবে আরেকটি তাকে দংশন করে’।[২৬]
(২০) আশা ও ভয়ের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা
রাসূলে আকরাম (ﷺ) শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের অনাগত জীবন সম্পর্কে যেমন আশাবাদী করে তুলতেন, তেমনি তার চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেন। যেমন আনাস (ﷺ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) একটি ভাষণ দিলেন। আমি এমন ভাষণ আর শুনিনি। তিনি বলেন, আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তবে অল্প হাসতে এবং বেশি কাঁদতে’।[২৭]
(২১) ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা
রাসূল (ﷺ) ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন। আবূ মাসঊদ আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি ছালাতে (জামা‘আতে) শামিল হতে পারি না। কারণ অমুক ব্যক্তি আমাদের নিয়ে খুব দীর্ঘ ছালাত আদায় করেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি নবী (ﷺ)-কে কোন উপদেশের মাজলিসে সেদিনের তুলনায় অধিক রাগান্বিত হতে দেখিনি। (রাগত স্বরে) তিনি বললেন, হে লোক সকল! তোমরা মানুষের মধ্যে বিরক্তির সৃষ্টি কর। অতএব যে লোকদের নিয়ে ছালাত আদায় করবে সে যেন সংক্ষেপ করে। কারণ তাদের মধ্যে রোগী, দুর্বল ও কর্মব্যস্ত লোকও থাকে’।[২৮]
(২২) শাস্তিদানের মাধ্যমে সংশোধন
গুরুতর অপরাধের জন্য রাসূল (ﷺ) কখনো তার শিষ্য ও শিক্ষার্থীদের শাস্তি প্রদান করে সংশোধন করতেন। তবে রাসূল (ﷺ) অধিকাংশ সময় শারীরিক শাস্তি এড়িয়ে যেতেন। ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতেন। যেমন উপযুক্ত কারণ ব্যতীত তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় কা‘ব ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সহ কয়েকজনের সঙ্গে রাসূল (ﷺ) কথা বলা বন্ধ করে দেন। যা শারীরিক শাস্তির তুলনায় অনেক বেশি ফলপ্রসূ ছিল’।[২৯]
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে জানতে পারলাম যে, রাসূল (ﷺ) পতন্মুখ একটি জাতিকে তার কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর নেতৃত্বের আসনে কিভাবে সমাসীন করান। তার শিক্ষা ও সাফল্য শুধু ইহকালীন সাফল্য বয়ে আনেনি, বরং তার পরিব্যপ্তি ছিল পরকালীন জীবন পর্যন্ত। সুতরাং মুসলিম উম্মাহকে যদি তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে হয় এবং উভয় জগতের সাফল্য অর্জন করতে হয়, তবে অবশ্যই রাসূল (ﷺ)-এর শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। রাসূল (ﷺ)-এর ওফাতের পর তাঁর শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আলিমগণের, কেননা তাঁরাই নবীদের উত্তরসূরী। সেজন্য জাতির কর্ণধার আলিমগণ এবং অন্যান্য শিক্ষকদেরকে অনুকরণীয় আদর্শের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি বিবেকবোধ, অবস্থার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাদান করতে হবে। কখন, কোথায়, কীভাবে উপদেশবাণী প্রচার করলে ফলপ্রসূ হবে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। মুসলিম জাতির হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে এবং ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার জন্য অবশ্যই রাসূল (ﷺ)-এর শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করি, আমরা যেন স্বর্ণ যুগের শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ করে মুসলিম জাতির হারানো সভ্যতা ও সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে পারি এবং নিজেদেরকে আদর্শ শিক্ষক হিসাবে গড়ে তুলতে পারি। আল্লাহুম্মা আমীন!
* মুর্শিদাবাদ, ভারত।
তথ্যসূত্র :
[১]. সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৯৫।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৯০৬ ও ৩৫৩৪।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৪৯, ২৯০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৯২।
[৪]. উছূলুত তারবিয়্যাতিল ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ১১৮।
[৫]. আবূ দাউদ, হা/৪০০৩।
[৬]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬০৩১।
[৭]. ছহীহ বুখারী হা/৬৩১।
[৮]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৯।
[৯]. ছহীহ মুসলিম।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৫; ফাৎহুল বারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৫।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৬৭।
[১২]. আবূ দাঊদ, হা/৪০৫৭।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩১২।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৭১।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৮০।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/১৭৪১।
[১৭]. ছহীহ মুসলিম হা/৮৬৭।
[১৮]. মুসনাদে আহমদ, হা/৮০৭১।
[১৯]. ছহীহ বুখারী হা/৭৩৭৩।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪৭৪, ৪৬৪৭, ৪৭০৩, ৫০০৬।
[২১]. মুসনাদে আহমদ, হা/৮০৯৫।
[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০০৫।
[২৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২।
[২৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩১, ৮১৮।
[২৫]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২২১১।
[২৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১৭।
[২৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৬২১।
[২৮]. ছহীহ বুখারী হা/৯০, ৭০২, ৭০৪, ৬১১০, ৭১৫৯।
[২৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৬৭৭।
প্রসঙ্গসমূহ »:
শিক্ষা-সংস্কৃতি