শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩৯ পূর্বাহ্ন

ইখলাছই পরকালের জীবনতরী

-আব্দুল গাফফার মাদানী*


(শেষ কিস্তি)
[ফেব্রুয়ারী’২৪-এর পর থেকে]



ইখলাছ পরিপন্থী বিষয়াবলী

প্রথমত: রিয়া ও সুম‘আহ

রিয়া : মানুষের প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে কোন ইবাদত প্রকাশ করা।[১] ইমাম গাজ্জালী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রিয়া হল ভালো কর্ম প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে মর্যাদা অন্বেষণ করার নাম’।[২]     

সুম‘আহ : কোন কাজ মানুষকে শুনানোর উদ্দেশ্যে করার নাম সুম‘আহ। যেমন: পার্শ্ববর্তী লোকদের শুনানোর জন্য কুরআন তেলাওয়াত করা।[৩]

এ ব্যাপারে ঈয্য ইবনু আব্দুস সালাম (রাহিমাহুল্লাহ) (৫৭৭-৬৬০ হি.) বলেন, শুনানোর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যে ব্যক্তি তার এই কাজ দেখে সে অন্যদের নিকট গিয়ে তার এ কাজের কথা বলে, যা অন্যরা জানত না। এমন আশা পোষণ করাই হল সুম‘আহ। আর এ শুনানোটা দুই ধরনের হতে পারে। যথা-

(ক) সত্যবাদী লোকদেরকে শুনানো : সেটা হচ্ছে কোন ভালো কাজ একমাত্র আল্লাহর জন্য করা। অতঃপর সে তা প্রকাশ করে এবং মানুষকে শুনায়, যেন তাকে তারা সম্মান, মর্যাদা ও উপকার করে এবং তাকে কষ্ট না দেয়।

(খ) মিথ্যাবাদী লোকদের শুনানো : যেমন- আমি ছালাত আদায় করেছি অথচ সে ছালাত আদায় করেনি। আমি যাকাত প্রদান করেছি অথচ সে যাকাত প্রদান করেনি। আমি ছিয়াম রেখেছি অথচ সে ছিয়াম রাখিনি। আমি হজ্জ করেছি অথচ সে হজ্জ করিনি। আমি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছি অথচ সে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করিনি।[৪]

কুরআন ও হাদীছে রিয়া ও সুম‘আহ সম্পর্কে অনেক ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। যেমন রাসূল (ﷺ)-এর বাণী,

أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِي مِنَ الْمَسِيْحِ الدَّجَّالِ‏ قَالَ قُلْنَا بَلَى  فَقَالَ ‏الشِّرْكُ الْخَفِيُّ أَنْ يَقُوْمَ الرَّجُلُ يُصَلِّي فَيُزَيِّنُ صَلَاتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ ‏.‏

‘আমি কি তোমাদের এমন বিষয় অবহিত করব না, যা আমার নিকট তোমাদের জন্য মাসীহ দাজ্জালের চেয়েও ভয়ংকর? রাবী বলেন, আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই। তখন তিনি বলেন, তা হল গোপন শিরক। আর তা হলো- কোন মানুষের ছালাত আদায় করতে দাঁড়ানো অতঃপর লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সুন্দরভাবে ছালাত আদায় করা’।[৫] অন্যত্র তিনি বলেন, مَنْ سَمَّعَ النَّاسَ بِعَمَلِهِ سَمَّعَ اللهُ بِهِ سَامِعَ خَلْقِهِ وَصَغَّرَهُ وَحَقَّرَهُ ‘যে ব্যক্তি মানুষকে শুনানোর জন্য আমল করে, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে ক্বিয়ামতের দিন তার উক্ত আমলের ব্যাপারে শুনিয়ে দিবেন। আর তাকে তুচ্ছ ও নগণ্য করে দেবেন’।[৬] তিনি আরো বলেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهِ وَمَنْ يُرَائِي يُرَائِي اللهُ بِه ‘যে ব্যক্তি লোক শুনানোর উদ্দেশ্যে ইবাদত করবে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার লোক শুনানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লোক-দেখানো ইবাদত করবে আল্লাহ এর বিনিময়ে তার লোক দেখানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দিবেন’।[৭]

ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, মানুষের প্রথম কর্তব্য হল- তার প্রত্যেক কাজ কেবল আল্লাহর জন্য হওয়া। তার উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ যে বিষয়ে আদেশ করেছেন সেগুলো পূর্ণ বাস্তবায়ন করা। আর যদি উক্ত কাজ কোন পদমর্যাদা বা অন্যের সম্মান কমানোর জন্য করে থাকে, তাহলে সে কাজ আল্লাহ কবুল করবেন না। অনুরূপভাবে যদি সে রিয়া বা সুম‘আহ-এর উদ্দেশ্যে করে, তাহলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।[৮]

আর ইখলাছের পথ হচ্ছে, বান্দা তার ঈমানকে গভীর করবে এবং বিনয়ের সাথে তার প্রভুর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে। সাথে সাথে দুনিয়া বিমুখ হবে ও দুনিয়াকে তুচ্ছ বলে জানবে। দুনিয়া ও আখেরাতে রিয়া ও সুম‘আহ এর পরিণতি সম্পর্কে অবগত হবে।[৯]

দ্বিতীয়ত : আত্ম অহমিকা (আত্মগর্ব)

আত্ম অহমিকা ইছলাছ বিনষ্টের অন্যতম কারণ, যা অন্তরে লুকায়িত থাকে। মানুষ আত্ম অহমিকার দ্বারা ধোঁকায় পতিত হয়, যা তাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করে। রাসূল (ﷺ)-এর বাণী সেদিকেই ইঙ্গিত বহন করে, ثَلَاثٌ مُهْلِكَاتٌ شُحٌّ مُطَاعٌ وَهَوًى مُتَّبَعٌ وَإِعْجَابُ الْمَرْءِ بِنَفْسِهِ ‘তিনটি ধ্বংসাত্মক বিষয় রয়েছে- অধিক কৃপণতা, মনপ্রবৃত্তিন অনুসরণ, আত্ম-গর্ব প্রকাশ করা’।[১০] অন্যত্র তিনি বলেন,

بَيْنَمَا رَجُلٌ يَمْشِى فِى حُلَّةٍ تُعْجِبُهُ نَفْسُهُ مُرَجِّلٌ جُمَّتَهُ إِذْ خَسَفَ اللَّهُ بِهِ فَهْوَ يَتَجَلَّلُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ

‘একদা একব্যক্তি একজোড়া কাপড় পরিধান করে ও লম্বা চুল পরিপাটি করে আত্ম-গৌরবের সাথে পথ চলছিল। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাকে মাটিতে ধসিয়ে দিলেন। সে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মাটির নিম্নদেশে ঢুকতেই থাকবে’।[১১]

উপরিউক্ত হাদীছগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নিঃসন্দেহে আত্ম অহমিকা একটি ধ্বংসাত্মক বস্তু। কেননা যার মাঝে এ বদ স্বভাব রয়েছে সে তার আমলকে অনেক বড় মনে করে, এটা দ্বারা সে আল্লাহকে খোঁটা দেয় এবং সে আল্লাহর নে‘আমতকে ভুলে যায়। যখন সে আত্মগর্ব করে, তখন সে তার বিপদের কথা ভুলে যায়। যে ব্যক্তি আমলের বিপদ থেকে দূরে থাকতে পারে না তার অধিকাংশ প্রচেষ্টাই বৃথা। তাছাড়া আমল যদি নিষ্কলুষ না হয়, তাহলে সে আমল কোনই উপকারে আসবে না।

মাসরূক্ব (রহ) (মৃত ৬২ হিঃ) বলেন, মানুষের জ্ঞানী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে আল্লাহকে ভয় করবে। আর মূর্খ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার ইলমকে নিয়ে গর্ব করবে।[১২] মহান আল্লাহ বলেন, لَا تُبۡطِلُوۡا صَدَقٰتِکُمۡ بِالۡمَنِّ وَ الۡاَذٰی ‘হে মুমিনগণ! দানের কথা বলে বেড়িয়ে এবং কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের দানকে নিষ্ফল করো না’ (আল-বাক্বারাহ: ২৬৪)।

ইমাম গাজ্জালী (রাহিমাহুল্লাহ) (৪৫০-৫০৫ হি.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘ছাদাক্বাহকে বড় মনে করাই হচ্ছে খোঁটা দেয়া আর আমলকে বড় মনে করাই হচ্ছে অহংকার। অতএব প্রতীয়মান হয় যে, গর্ব ও অহংকার অতি নিন্দিত’।[১৩]

তৃতীয়ত : প্রবৃত্তির অনুসরণ করা

কুপ্রবৃত্তি হল- যে কর্মের দিকে মানুষ নিজ খেয়াল-খুশি অনুযায়ী ধাবিত হয়।[১৪] আর কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করা ইখলাছ পরিপন্থী কাজ সমূহের অন্যতম। অর্থাৎ মনের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী যা খুশি করা, যাকে নাফসে আম্মারাহ বলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَرَءَیۡتَ مَنِ اتَّخَذَ اِلٰـہَہٗ ہَوٰىہُ ؕ اَفَاَنۡتَ تَکُوۡنُ  عَلَیۡہِ   وَکِیۡلًا - اَمۡ  تَحۡسَبُ اَنَّ  اَکۡثَرَہُمۡ  یَسۡمَعُوۡنَ  اَوۡ یَعۡقِلُوۡنَ ؕ اِنۡ  ہُمۡ   اِلَّا  کَالۡاَنۡعَامِ  بَلۡ ہُمۡ اَضَلُّ  سَبِیۡلًا

‘তুমি কি দেখ না তাকে, যে তার কামনা বাসনাকে উপাস্য রূপে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে? তুমি কি মনে কর যে, তাদের অধিকাংশ শোনে ও বুঝে? তারাতো পশুর মতো; বরং তার চেয়েও নিৃকষ্ট’ (আল-ফুরক্বান: ৪৩-৪৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

اَفَرَءَیۡتَ مَنِ اتَّخَذَ  اِلٰـہَہٗ  ہَوٰىہُ وَ اَضَلَّہُ  اللّٰہُ  عَلٰی  عِلۡمٍ  وَّ خَتَمَ عَلٰی سَمۡعِہٖ وَ قَلۡبِہٖ وَ جَعَلَ عَلٰی بَصَرِہٖ  غِشٰوَۃً ؕ فَمَنۡ یَّہۡدِیۡہِ  مِنۡۢ  بَعۡدِ اللّٰہِ ؕ اَفَلَا  تَذَکَّرُوۡنَ

‘তুমি কি লক্ষ্য করছ তাকে, যে তার খেয়াল-খুশীকে নিজের মা‘বূদ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে শুনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তার কান ও অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তার চক্ষুর উপর রেখেছেন আবরণ। অতএব কে তাকে পথ নির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?’ (আল-জাছিয়াহ: ২৩)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

فَاِنۡ لَّمۡ یَسۡتَجِیۡبُوۡا لَکَ فَاعۡلَمۡ  اَنَّمَا یَتَّبِعُوۡنَ  اَہۡوَآءَہُمۡ ؕ وَ مَنۡ اَضَلُّ  مِمَّنِ اتَّبَعَ ہَوٰىہُ بِغَیۡرِ ہُدًی مِّنَ اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ  لَا  یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ

‘অতঃপর তারা যদি তোমার আহ্বানে সাড়া না দেয়, তাহলে জানবে যে, তারা শুধু নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আল্লাহর পথ-নির্দেশ অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে সে অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে? আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না’ (আল-ক্বাছাছ: ৫০)।

অতএব কুপ্রবৃত্তি অতি নিকৃষ্ট ব্যাধি, যা অন্তরের সাথে মিশে থাকে।[১৫] প্রবৃত্তি মানুষকে অন্ধ ও বধির করে দেয়। সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রাপ্য ভুলে যায় এবং তাঁদের সন্তুষ্টিতে সে সন্তুষ্ট হয় না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যে বিষয়ে রাগান্বিত হন সে ঐ বিষয়ে রাগান্বিত হয় না; বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে সে তার প্রবৃত্তির উপর সন্তুষ্ট থাকে এবং কোন বস্তু তার প্রবৃত্তির অনুযায়ী না হলে রাগান্বিত হয়।[১৬]

অথচ এমনটি হওয়া সরাসরি ইখলাছের বিপরীত। কেননা মুখলিছ ব্যক্তি সম্পূর্ণ আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  وَ نَہَی النَّفۡسَ عَنِ  الۡہَوٰی‘আর সে তার আত্মাকে মনোবৃত্তি হতে বিরত রাখল’ (আন-নাযিয়াত: ৪০)। সে তার প্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকে, যা আল্লাহর আনুগত্য থেকে তাকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।[১৭] অতএব প্রবৃত্তির অনুসরণ করা ইখলাছ পরিপন্থী ও আমল বিনষ্টকারী কাজ।

প্রবৃত্তির অনুসারী ব্যক্তি যখন কোন সৎ আমল করে, তখন তা আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে করে না। তাই নিঃসন্দেহে তার আমল অগ্রহণযোগ্য। কেননা সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। এ প্রসঙ্গে ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তুমি ঐ ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যে সত্যের অনুসরণ করে যখন সত্যটা তার প্রবৃত্তির অনুযায়ী হয়। এমনকি সে সত্যের বিরোধিতা করে, যখন সত্যটা তার প্রবৃত্তির অনুপাতে না হয়। সুতরাং তুমি যখন এমন মন-মানসিকতা নিয়ে সত্যের অনুসরণ করবে, তখন তুমি ছওয়াবের অধিকারী হবে না। তোমার প্রবৃত্তির কারণে যা তুমি পরিত্যাগ করেছ তার জন্য তোমাকে সাজা ভোগ করতে হবে। কেননা উভয় ক্ষেত্রে তুমি তোমার প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছ’।[১৮] শাত্বেবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, প্রবৃত্তির অনুসরণ করা নিন্দনীয় যদিও সেটা ভালো কর্মের আওতাভুক্ত হয়। কেননা সেটা শরী‘আত বিরোধী বস্তুসমূহের অন্যতম। এর প্রবণতা যতই বৃদ্ধি পাবে ততই তার পরিণাম ভয়াবহ হবে।[১৯]

পক্ষান্তরে প্রবৃত্তির বিরূধীতা করা অনেক কঠিন কাজ। যার কারণে প্রবৃত্তি তার অনুসারীদেরকে এমন চরম শিখরে পৌঁছে দেয়, যা অন্য কিছু পারে না। এক্ষেত্রে আল্লাহ প্রেমিকদের অবস্থা সাক্ষী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আহলে কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে। এরপরেও তারা তাদের পূর্বের অবস্থার উপর অটুট ছিল, এমনকি তারা তাদের ধন-সম্পদ ও আত্মা বিলিয়ে দিতে রাযী হয়েছিল। কিন্তু প্রবৃত্তির বিরোধিতা করতে রাযী হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে বলেন,

اَفَرَءَیۡتَ مَنِ اتَّخَذَ  اِلٰـہَہٗ  ہَوٰىہُ وَ اَضَلَّہُ  اللّٰہُ  عَلٰی  عِلۡمٍ  وَّ خَتَمَ عَلٰی سَمۡعِہٖ وَ قَلۡبِہٖ وَ جَعَلَ عَلٰی بَصَرِہٖ  غِشٰوَۃً ؕ فَمَنۡ یَّہۡدِیۡہِ  مِنۡۢ  بَعۡدِ اللّٰہِ ؕ اَفَلَا  تَذَکَّرُوۡنَ

‘তুমি কি লক্ষ্য করেছ তাকে, যে তার খেয়াল-খুশীকে নিজের মা‘বূদ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে শুনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তার কান ও অন্তর মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তার চক্ষুর উপর রেখেছেন আবরণ। অতএব কে তাকে পথ নির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?  (আল-জাছয়াহ: ২৩)।

সুধী পাঠক! আল্লাহ তা‘আলা শরী‘আত প্রণয়ন করেছেন মানব জাতিকে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বের করার জন্য, যাতে করে সে এক আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হতে পারে।[২০] শাত্বেবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, শরী‘আত প্রণয়ন করার শারঈ উদ্দেশ্য হল- মানব জাতিকে প্রবৃত্তির আহ্বান থেকে বের করা, যাতে করে সে এক আল্লাহর চয়নকৃত বান্দা হিসাবে পরিগণিত হয়। যেমনভাবে সে নিরুপায়ের সময় আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকে।[২১]

অতএব ইখলাছ প্রত্যাশী ব্যক্তির উচিত তার ইচ্ছাকে প্রবল করা, রবের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় করা এবং আত্মাকে প্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখা, যাতে করে তার ঠিকানা হয় জান্নাত।[২২]

হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) (২১-১১০ হি.) বলেন, সর্বোত্তম জিহাদ হল প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ।[২৩] ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) (৫০৮-৫৯৭ হি.) বলেন, (বান্দার) উচিত হল- সমস্ত আমল একমাত্র আল্লাহর জন্য করা, তাহলে তিনি তোমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন এবং সকল ধরণের কল্যাণ অর্জন করতে পারবে, প্রবৃত্তির অনুসরণ ও মাখলূক্বকে সন্তুষ্ট করার জন্য আল্লাহ থেকে দূরে সরে যাওয়ার বিপদ থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে।[২৪]

চতুর্থত : আমলের ক্ষেত্রে মানুষের প্রশংসা

সর্বদা ইখলাছ পরায়ণ ব্যক্তি তার সৎ আমলের প্রসিদ্ধতা ও যা প্রকাশ হওয়া শরী‘আতসিদ্ধ নয় তা প্রকাশ পাওয়া অপছন্দ করে। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, প্রসিদ্ধতা অর্জনের জন্য কোন কিছু প্রকাশ কর না। তোমার ব্যক্তিত্বকে আলোচনার পাত্র হিসাবে উপস্থাপন করো না। তুমি যা জান তা গোপন করে রাখ, চুপ থাক; নিরাপদে থাকবে। সৎ ব্যক্তিরা আনন্দিত হয় এবং পাপিরা রাগান্বিত হয়।[২৫] ইবনু মুহাইরেয (রাহিমাহুল্লাহ) বলতেন, اللهم إني أسألك تكرا خاملا ‘হে আল্লাহ আমি আপনার নিকট অজ্ঞতা খ্যাতি কামনা করছি’।[২৬] পক্ষান্তরে যদি মুখলিছ ব্যক্তির অনিচ্ছায় তার আমলের প্রশংসা করা হয়, তাহলে ভাল আমল এমনিতে প্রকাশ পায়। এটা তার জন্য শুভ সংবাদ। তাছাড়া এমনটি হওয়া তার জন্য কোন ক্ষতির বিষয় নয় এবং সে ইখলাছের গণ্ডি থেকেও বেরিয়ে যাবে না।[২৭]

এ ক্ষেত্রে আবু যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিম্নের হাদীছটি প্রণিধানযোগ্য:

عَنْ اَبِيْ ذَرٍّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ  قَالَ قِيْلَ لِرَسُوْلِ اللهِ ﷺ اَرَاَيْتَ الرَّجُلَ يَعْمَلُ الْعَمَلَ مِنَ الْخَيْرِ وَيحْمَدُهُ النَّاسُ عَلَيْهِ؟ قَالَ تَلْكَ عَاجِلٌ بُشْرَى الْمُؤْمِنِ

আবু যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করা হল- আপনি ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে কী মন্তব্য করেন, যে সৎ আমল করে আর মানুষ উক্ত আমলের প্রশংসা করে? তিনি বললেন, তা মুমিনের খুশির সংবাদ।[২৮]

এই ব্যাপারে মাক্বদিসের একটি চমৎকার বিশ্লেষণ রয়েছে, একদা তিনি বলেন, যদি বলা হয়, ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে তুমি কী মনে কর, যে ব্যক্তির ভাল কর্ম অন্য কেউ জানতে পারলে সে আনন্দিত হয় না; এমনটি হওয়া সম্পূর্ণরূপে কি নিন্দনীয়? তিনি বলেন, সাধারণত আনন্দ দুই প্রকার। এক : প্রশংসনীয়, দুই : নিন্দনীয়।

প্রশংসনীয় আনন্দের উদ্দেশ্য হল- শুধু আল্লাহর জন্য আমল করে তা গোপন করা, অন্যকে জানতে না দেয়া। তদুপরি মানুষ যদি জেনে যায়, তাহলে সে যেন মনে করে যে, আল্লাহ তাদেরকে তার এই অবস্থা সম্পর্কে অবগত করিয়েছেন। অতঃপর সে যেন আল্লাহর এই কাজের প্রতি আনন্দিত হয়। কেননা এটা শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে তার প্রতি দয়া ও সহনুভূতি ছাড়া আর কিছুই নয়। পক্ষান্তরে আনন্দটা যদি মানুষ তার আমল অবগত হওয়ার কারণে হয়, মানুষ জানতে পারলে তাকে সম্মান, মর্যাদা ও প্রশংসা করবে, সাথে সাথে মানুষের নিকট তার একটা অবস্থান তৈরি হবে এমনটি আশা পোষণ করলে সেটি অপছন্দীয় বা নিন্দনীয়।[২৯]

পঞ্চমত : রিয়ার আশঙ্কায় আমল পরিত্যাগ করা

রিয়ার আশঙ্কায় আমল পরিত্যাগ করা শয়তানের কুমন্ত্রণা মাত্র এবং তার ফাঁদসমূহের একটি ফাঁদ। ইবনু হাযম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রিয়া নিন্দার ক্ষেত্রে শয়তানের ফাঁদ রয়েছে। তা হচ্ছে- অনেক ভাল আমলকারী তার আমল থেকে বিরত থাকে রিয়ার ধারণা থেকে বাঁচার জন্য।[৩০] তবে মানুষ যদি এই ধারণা পোষণ করে তার আমল থেকে বিরত থাকে এবং শয়তান যদি তা জানতে পারে, তাহলে সে তার প্রত্যেকটি আমলের ক্ষেত্রে রিয়ার কুমন্ত্রণা উপস্থাপন করবে, যাতে সে সর্বপ্রকার ভাল আমল ছেড়ে দেয়।[৩১]

বান্দার উচিত হবে নির্দ্বিধায় ভাল আমল সম্পাদন করে যাওয়া। কেননা ইহা শয়তানের নিকট খুবই যন্ত্রণাদায়ক। ইবনু তায়মিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, কারো যদি শরী‘আতসম্মত অযীফা থাকে যেমন ছালাতুয যুহা কিংবা তাহাজ্জুদ ইত্যাদি, তাহলে সে যেখানেই থাকুক না কেন তার অযীফা পালন করে নিবে। মানুষের লজ্জায় সে যেন তার অযীফা পরিত্যাগ না করে। তিনি আরো বলেন, রিয়ার ভয়ে শরী‘আত সম্মত অযীফা থেকে বিরত থাকা যাবে না, বরং উক্ত আমল ইখলাছের সাথে সম্পন্ন করার নির্দেশ করতে হবে।[৩২]

এ ব্যাপারে সালাফগণ অনেক সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। ফুযাইল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, রিয়ার আশঙ্কায় আমল ত্যাগ করা আর মানুষের কারণে আমল করা শিরক। আর ইখলাছের কারণে আল্লাহ তোমাকে উক্ত দু’টি খারাপ কাজ থেকে নিরাপত্তা দান করেন।[৩৩]

ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৩১-৬৭৬ হি.) বলেন, উপরোক্ত কথাটুকুর অর্থ এই যে, যে ব্যক্তি কোন ভাল আমল করার ইচ্ছা পোষণ করল অতঃপর মানুষের দেখার আশঙ্কায় সে তা পরিত্যাগ করল, তা হল দর্শনস্থল। কেননা সে মানুষের কারণে আমল ছেড়ে দিল। তবে যদি নির্জনে পড়ার জন্য ছেড়ে থাকে তাহলে তা মুস্তাহাব। আর যদি ফরয ছালাত বা ওয়াজিব যাকাত বা এমন আলেম, যার অনুসরণ করা হয়, তাহলে এক্ষেত্রে ইবাদত প্রকাশ করা উত্তম’।[৩৪] আল্লাহ তা‘আলা যাকে সৎ নিয়তে ভাল আমল করার তাওফীক্ব দান করেছেন, তার উচিত হল- ইখলাছের উপর অটুট থাকার জন্য প্রাণপনে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং তার বিপরীত বস্তু থেকে বিরত থাকা। কেননা মুহূর্তের মধ্যে নিয়ত পরিবর্তন হয়ে থাকে। তাই সুলায়মান ইবনু দাঊদ আল-হাশেমী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, কখনো আমি একটি হাদীছ বর্ণনা করি এক নিয়তে, হাদীছের কিছু অংশ বর্ণনা করতে না করতেই আমার নিয়ত পরিবর্তন হয়ে যায়। অতএব একই হাদীছের জন্য অনেক নিয়তের প্রয়োজন হয়।[৩৫]

বান্দার জন্য রিয়ার ভয়ে আমল বন্ধ করা সমীচীন হবে না। নাখঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ছালাতরত অবস্থায় যদি তোমার নিকট শয়তান এসে বলে, ‘তুমি রিয়াকারী’ তখন তুমি তোমার ছালাতকে আরোও দীর্ঘ করবে।[৩৬]

ষষ্ঠত : সৎ ব্যক্তিদের সাথী হওয়া ও আমলের প্রতি অগ্রগামী হওয়া :

মানুষ যখন ব্যক্তিদের মাঝে অবস্থান করে, তখন সে উচ্চাভিলাষ অনুভব করে। এজন্য সে কল্যাণের কাজে অগ্রগামী ও আনুগত্যের কাজে উদ্যমী হয়। সে যখন তাদের ছালাত দীর্ঘ করতে দেখে, তখন সেও তাদের ছালাত দীর্ঘ করে। আর যখন তারা ছাদাক্বাহ করে, তখন সেও তাদের সাথে ছাদাক্বাহ করে। সে তাদেরকে না দেখলে তার আগ্রহ বেশি তৎপর হতো না। অতঃপর মনে করে এমনটি করা রিয়ার অন্তর্ভুক্ত, যা ইখলাছের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। অথচ বিষয়টি এমন নয়। এর ইঙ্গিত বহন করে হানযালা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিম্নোক্ত হাদীছ। যেমন-

فَانْطَلَقْتُ أَنَا وَأَبُوْ بَكْرٍ حَتَّى دَخَلْنَا عَلَى رَسُوْلِ اللهِ ﷺ قُلْتُ نَافَقَ حَنْظَلَةُ يَا رَسُوْلَ اللهِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ وَمَا ذَاكَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ نَكُوْنُ عِنْدَكَ تُذَكِّرُنَا بِالنَّارِ وَالْجَنَّةِ حَتَّى كَأَنَّا رَأْىَ عَيْنٍ فَإِذَا خَرَجْنَا مِنْ عِنْدِكَ عَافَسْنَا الْأَزْوَاجَ وَالْأَوْلْادَ وَالضَّيْعَاتِ نَسِيْنَا كَثِيْرًا فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ إِنْ لَوْ تَدُوْمُوْنَ عَلَى مَا تَكُوْنُوْنَ عِنْدِىْ وَفِى الذِّكْرِ لَصَافَحَتْكُمُ الْمَلاَئِكَةُ عَلَى فُرُشِكُمْ وَفِى طُرُقِكُمْ وَلَكِنْ يَا حَنْظَلَةُ سَاعَةً وَسَاعَةً  ثَلاَثَ مَرَّاتٍ

‘আমি ও আবূ বকর গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে হাজির হলাম। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! হানযালাহ মুনাফিক্ব হয়ে গেছে। রাসূল (ﷺ) বললেন, সে কী কথা! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা যখন আপনার নিকটে থাকি, তখন আপনি আমাদেরকে জান্নাত-জাহান্নামের কথা এমনভাবে শুনান যেন আমরা তা প্রত্যক্ষভাবে দেখছি। অতঃপর আমরা যখন আপনার নিকট থেকে বের হয়ে যাই এবং স্ত্রী সন্তান-সন্ততি ও কারবারে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তখন অনেক কথা ভুলে যাই। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে। যদি তোমরা সর্বদা এই অবস্থায় থাকতে, যে অবস্থাতে তোমরা আমার নিকটে থাক এবং সর্বদা আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকতে, তাহলে ফেরেশতাগণ তোমাদের বিছানায় ও তোমাদের পথে তোমাদের সঙ্গে মুছাফাহা করতেন। কিন্তু হে হানযালা! কিছু সময় ইবাদতের জন্য ও কিছু সময় সাংসারিক কাজের জন্য। তিনি একথা তিনবার বললেন।[৩৭]

সপ্তমত : নিয়তের মধ্যে শরীক করা

নিয়তের মধ্যে শরীক করার দু’টি রূপ রয়েছে। যথা

প্রথমরূপ : বান্দা একটি আমলের মাধ্যমে একাধিক নৈকট্যের ইচ্ছা পোষণ করে। ইহা স্বতন্ত্রভাবে জায়েয; যখন প্রত্যেকটি নৈকট্য নির্দিষ্ট ইবাদত হিসাবে উদ্দিষ্ট হবে। যেমন কেউ যদি যোহর ও আছরের চার রাক‘আত বিশিষ্ট ছালাত একই সাথে পড়ার নিয়ত করে, তাহলে তা সর্বসম্মতিক্রমে বিশুদ্ধ হবে না। পক্ষান্তরে কতিপয় ইবাদতের ক্ষেত্রে শরী‘আতে ব্যতিক্রম নির্দেশনা এসেছে। যেমন একই গোসলে জুম‘আহ ও জানাবাতের নিয়ত করা। একই ছালাতে তাহিইয়াতুল মসজিদ ও সুন্নাতের নিয়ত করা। নিকটবর্তী আত্মীয়দের ছাদাক্বাহ করে ছাদাক্বার অসীলার নিয়ত করা। একই ত্বাওয়াফের মাধ্যমে ত্বাওয়াফে কুদূম ও ওমরার নিয়ত করা। কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ করা ও ভুলে না যাওয়ার নিয়ত করা। অনুরূপভাবে অন্যান্য বৈধ আমলসমূহের মধ্যে শরীকী সম্পাদনের নিয়ত করা।[৩৮]

আর ইখলাছের সাথে করলে তা অসঙ্গতিপূর্ণ হয় না। বরং বান্দা যখনই তার নিয়ত বৃদ্ধি করে, তখন তার ছওয়াবও বৃদ্ধি হতে থাকে। ইমাম গাজ্জালী (রাহিমাহুল্লাহ) (৪৫০-৫০৫ হি.) বলেন, তুমি তোমার সমস্ত আমলের ক্ষেত্রে নিয়ত বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা কর, যাতে করে একটি আমলে অনেক নিয়ত করতে পার।[৩৯]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৯১-৭৫১ হি.) বলেন, একই ইবাদতের মধ্যে অনেক ইবাদতের অনুপ্রবেশ ঘটানো একটি ভাল বিষয়। ইহা শুধু সত্যের সন্ধানী, সুদক্ষ ও উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিরা ব্যতীত আর কেউ জানে না। একই ইবাদতের মাধ্যমে একাধিক ইবাদতের ছওয়াব অর্জনে সফলতা বয়ে আনে। আর ইহা শুধু আল্লাহর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে দান করেন।[৪০]

সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যখন একই জাতের দু’টি আমল একত্রিত হয়, যা একটি অপরটির সাথে জড়িত সে ক্ষেত্রে দু’টির জন্য একটি আমলই যথেষ্ট। এটা বান্দার প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত নে‘আমত। কেননা একটি আমল একাধিক আমলের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাচ্ছে। যেমন কেউ সুন্নাতে রাতেবার সময় মসজিদে প্রবেশ করল। অতঃপর সে সুন্নাতে রাতেবা এবং তাহিইয়াতুল মসজিদের নিয়তে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করল। তাহলে সে দু’টির ফযীলত ও মর্যাদা পেয়ে যাবে। অনুরূপভাবে যদি কেউ সুন্নাতুল ওয়াজিব বা তাহিইয়াতুল মসজিদ বা ছালাতুল ইস্তেখারা বা অন্যান্য ছালাত একত্রিত করে পড়ে, তাহলে একই সাথে সবগুলোর ছওয়াব পেয়ে যাবে।[৪১]

দ্বিতীয়রূপ : বান্দা একই আমলের মধ্যে নৈকট্য ও মুবাহ কাজের নিয়ত করা, যেমন- ওযূ করা পবিত্রতা ও পরিষ্কার করার নিয়তে বা অঙ্গ-প্রতঙ্গ শিতল করার জন্য। ছিয়াম রাখা নৈকট্য ও আগ্রহের কারণে, হজ্জ করা ব্যবসার উদ্দেশ্যে। এরূপ নিয়তে শরীক করলে সেটা ইখলাছের ক্ষেত্রে নিন্দনীয় নয়। কেননা এরূপ নিয়তের ক্ষেত্রে সৃষ্টির সম্মানের অনুপ্রবেশ ঘটানো, বরং সেটা কল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্রে শরীক করা মাত্র। তবে সেটা কোন কিছু পাওয়া বা সম্মানের উদ্দেশ্যে করা উচিত হবে না। ইহা ব্যতীত ইবাদতের মধ্যে নিষিদ্ধ নয়। তবে কিছু গুনাহ বা ইবাদত বাতিল হওয়ার কোন সুযোগ নেই।[৪২]

মূলত তা আমল নষ্ট করে না এবং ইখলাছের ক্ষেত্রেও নিন্দনীয় নয়, যার উপর রাসূল (ﷺ)-এর বাণী প্রমাণ বহন করে,

يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ

‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের বিবাহ করা কর্তব্য। কেননা তা চক্ষু অবনত রাখা ও লজ্জাস্থান রক্ষার ক্ষেত্রে অধিকতর সহায়ক। তবে তোমাদের মধ্যে যার বিবাহের সামর্থ্য নেই তার উচিত ছিয়াম পালন করা। কেননা ছিয়াম তার যৌন প্রবৃত্তিকে অবদমিত করে’।[৪৩] উল্লেখ্য যে, রাসূল (ﷺ) বিয়ের কতিপয় উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যদি এ ধরনের উদ্দেশ্য ইবাদতের ক্ষেত্রে নিন্দনীয় হত, তাহলে তিনি যুবকদেরকে এভাবে নির্দেশ দিতেন না।

عَنْ أَبِي قِلَابَةَ قَالَ جَاءَنَا مَالِكُ بْنُ الحُوَيْرِثِ فِيْ مَسْجِدِنَا هَذَا فَقَالَ إِنِّيْ لَأُصَلِّي بِكُمْ وَمَا أُرِيْدُ الصَّلَاةَ أُصَلِّي كَيْفَ رَأَيْتُ النَّبِيَّ يُصَلِّي

আবূ ক্বিলাবা (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার মালিক ইবনু হুয়ায়রিছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাদের এ মসজিদে এলেন। তিনি বললেন, আমি অবশ্যই তোমাদের নিয়ে ছালাত আদায় করব। বস্তুত আমার উদ্দেশ্য ছালাত আদায় করা নয়, বরং রাসূল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে যেভাবে ছালাত আদায় করতে দেখেছি, তা তোমাদের দেখানোই আমার উদ্দেশ্য।[৪৪]

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) (৭৭৩-৮৫২ হি.) বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য ছালাত আদায় করা নয়’ হাদীছের এ অংশে আপত্তি তোলা হয়েছে যে, ‘নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্য ছাড়াও ছালাত আদায় করা যায়; যা শুদ্ধ নয়’।

এ আপত্তির উত্তর হলো, মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছালাতের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের ইচ্ছাকে নফী করেন নি। বরং নির্দিষ্ট ছালাতের ওয়াক্ত ছাড়াই অন্য সময়ে জামা‘আতবদ্ধভাবে ছালাত আদায় করার কারণ বর্ণনা করতে চেয়েছেন। যেন তিনি বলতে চেয়েছেন যে, নির্দিষ্ট কোন ছালাতের ওয়াক্ত হওয়ার কারণে আমি এ কাজ করি নি; বরং আমি অন্যদের শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্য এরূপ করেছি।[৪৫]

অষ্টমত : রিয়ার সাথে আমলের অবস্থাসমূহ

এক. হয়তোবা সেটা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য; তার মধ্যে কোন প্রকার রিয়া ও সুম‘আহ থাকে না। অতঃপর তা মর্যাদা বৃদ্ধি ও ছওয়াব অর্জনের কারণ হিসাবে পরিগণিত হয়।

দুই. হয়তোবা শুধু রিয়ার জন্য; কর্তা তার আমলের মাধ্যমে শুধু মানুষের নিকট সম্মান ও মর্যাদা কামনা করে। এরূপ আমল মুনাফিকদের আমলের অন্তর্ভুক্ত, যা কখনো মুমিন ব্যক্তির পক্ষ থেকে হওয়া সমুচীন নয়।

তিন. হয়তোবা তার আমল করার পিছনে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানুষের প্রশংসা পাওয়ার কামনা উদ্দেশ্য ছিল। বিশুদ্ধ মতানুযায়ী তা বাতিল বলে গণ্য হবে এবং এরূপ আমলকারী আল্লাহর নিকট শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূল (ﷺ)-এর বাণী,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ فَمَنْ عَمِلَ لِي عَمَلًا أَشْرَكَ فِيْهِ غَيْرِي فَأَنَا مِنْهُ بَرِيءٌ وَهُوَ لِلَّذِي أَشْرَكَ

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, মহামহিম আল্লাহ বলেছেন, আমি মুশরিকদের শিরক হতে মুক্ত। যে ব্যক্তি আমার জন্য কোন কাজ করল এবং তাতে আমি ব্যতীত অন্য কিছুকে শরীক করাল, আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। সে কাজ তার জন্য যাকে সে শরীক করেছে।[৪৬]

ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) (৭৩৬-৭৯৫ হি.) বলেন, আমল কখনো আল্লাহর জন্য হয় এবং তাতে রিয়াও অংশীদার থাকে। যদি এই অংশীদারিত্বটা মূল ইবাদতের ক্ষেত্রে হয়, তাহলে সেই আমল বাতিল ও নষ্ট হয়ে যায়।[৪৭]

চার. হয়তোবা মূলত আমলটা শুধু আল্লাহর জন্য করে কিন্তু তার মধ্যে হঠাৎ করে রিয়া আপতিত হয়, সাথে সাথে সে প্রতিহত করার চেষ্টা করে, তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে তা কোন ক্ষতি করবে না। আর যদি সে শিথিলতা অবলম্বন করে, তাহলে আমল নষ্ট হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে সালাফদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। তবে বাহ্যিকভাবে তা বাতিল হয়ে যায়। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ

‘আমি শরীকদের শিরক হতে মুক্ত। যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যাতে আমার সাথে অন্যকে অংশীদার করল, তাহলে আমি তাকে ও তার অংশীদারকে পরিত্যাগ করলাম’।[৪৮]

পাঁচ. হয়তোবা মূলত আমলটা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য করে। কিন্তু তার মধ্যে হঠাৎ করে ইখলাছ এসে পড়ে অতঃপর যদি ইবাদতটা নিরবচ্ছিন্ন হয়, তাহলে শেষাংশে ছহীহ হওয়া সত্ত্বেও প্রথমাংশ বিশুদ্ধ হবে না। উপরোক্ত হাদীছ অনুযায়ী আমল বাতিল বলে গণ্য হবে।[৪৯]

যে বিষয়গুলো ইখলাছ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে

১. মুকাল্লাফ ব্যক্তি দৃঢ়ভাবে এ কথা মনে করবে যে, সে শুধুমাত্র আল্লাহর একজন গোলাম বা দাস। কোন বিনিময় ও প্রতিদান ছাড়াই তার মুনিবের চাহিদা অনুযায়ী আমল করতে সে বাধ্য।

২. বান্দা তার প্রতি তার রবের অনুগ্রহ ও তাওফীক্ব প্রত্যক্ষ করবে যে, সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে তার যোগ্যতার কারণে নয়। আর প্রত্যেক কল্যাণকর কর্ম তার রবের অনুগ্রহেই সম্পাদন করে থাকে।

৩. বান্দার সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, আল্লাহ তার অন্তরকে সংশোধন করা ও ইখলাছপন্থী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আর লৌকিকতা প্রত্যাশী সাধারণত আল্লাহর তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত হবে।

৪. আল্লাহর ক্রোধ থেকে বেঁচে থাকা। বিশেষ করে যখন সে লৌকিকতার সম্মুখীন হবে, তখন সে তার অন্তরের ব্যাপারে সজাগ থাকবে।

৫. মানুষের গোপনে বেশি বেশি আমল করা ও অন্যের নিকট তা প্রকাশ না করা। যেমন তাহাজ্জুদের ছালাত, গোপন ছাদাক্বাহ ও নির্জনে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা ইত্যাদি।

৬. আল্লাহর মর্যাদা ও বড়ত্ব প্রকাশ করা এবং তাঁর তাওহীদ ও গুণবাচক নামসমূহের শিক্ষা অর্জন করা এবং সেগুলোর মাধ্যমে তাঁর ইবাদত করা ও সম্মান প্রদর্শন করা।

৭. মৃত্যু ও তার ভয়াবহতার কথা বেশি বেশি স্মরণ করা।

৮. লৌকিকতার শাস্তি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা।

৯. কুরআন নিয়ে গবেষণা করা।

১০. আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতির সাথে প্রার্থনা করা।

১১. সকল প্রকার শিরক থেকে শঙ্কিত হয়ে বিরত থাকা।

১২. মানুষের কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা।

১৩. সৎ আমলের প্রতি অভ্যস্ত হওয়া, যাতে করে তা জীবনের একটি অংশে পরিণত হয়, যা কখনো জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।

১৪. অন্তরকে উপদেশ ও শারঈ যিকিরের মাধ্যমে অভ্যস্ত করা।

১৫. মানুষের প্রতি আল্লাহর মহান নে‘আমত ও শুকরিয়ার কথা স্মরণ করা এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে তাঁর স্বীকৃতি জ্ঞাপন করা।

১৬. লৌকিকতার কাফ্ফারা হিসাবে দু‘আ পাঠ করা। যেমনটি রাসূল (ﷺ) পাঠ করতেন। তিনি বলতেন, اللَّهُمَّ إِنَّا نَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ نُشْرِكَ بِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهُ وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا نَعْلَمُ ‘হে আল্লাহ! আমরা আপনার নিকট স্বজ্ঞাত শিরক থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং অজ্ঞাত শিরক থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি’।[৫০]

ইখলাছ সম্পর্কে সালাফে ছালিহীনের বাণী

(ক) যখনই বান্দার ইখলাছ প্রবল হয়, তখনই তার ইবাদত পূর্ণতা লাভ করে।[৫১]
(খ) বান্দা তার প্রভুর এককত্ব ও একনিষ্ঠতা অনুপাতে শাফা‘আতের যোগ্যতা অর্জন করবে।[৫২]
(গ) পরকালমুখী ব্যতীত ইখলাছ অর্জন হয় না, তাক্বওয়া ব্যতীত পরকালমুখিতা অর্জন হয় না আর আদেশ-নিষেধের অনুসরণ ব্যতীত তাক্বওয়া অর্জন হয় না।[৫৩]
(ঘ) যখন তুমি তোমার গোপনীয়তা ভাল করতে সক্ষম হবে, তখন আল্লাহ তোমার বাহ্যিক বস্তুগুলো ঠিক করে দিবেন।[৫৪]
(ঙ) ইখলাছ হল নিষ্কৃতির পথ, ইসলাম হল শান্তির যানবহন আর ঈমান হল নিরাপত্তার ছাপ।[৫৫]
(চ) ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-এর ইখলাছের প্রবলতা বাদশাহর স্ত্রীর সৌন্দর্য ও তাঁকে তার ভালবাসার চাইতেও অধিক সুদৃঢ় ছিল।[৫৬]
(ছ) ইসলামের পূর্ণতা অনুপাতে ছওয়াব দ্বিগুণ হয় আর ঐ আমলের মধ্যে ইখলাছের পূর্ণতা অনুযায়ী আমল পূর্ণতা লাভ করে।[৫৭]
(জ) ইখলাছ জাহান্নামে প্রবেশের কারণগুলো দূর করে দেয়। অতঃপর লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু এর কথক যদি জাহান্নামে প্রবেশ করে, তাহলে অবশ্যই সে তা ইখলাছের সাথে বলেনি, যার ফলে তার উপর জাহান্নাম হারাম হবে।[৫৮]
(ঝ) ইখলাছ বিহীন আমল যদি উপকারে আসত, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদেরকে তিরষ্কার করতেন না।[৫৯]
(ঞ) বান্দার ইচ্ছা, আগ্রহ ও নিয়ত অনুপাতে তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওফীক্ব ও সাহায্য এসে থাকে।[৬০]
(ট) বান্দা যদি একমাত্র আল্লাহর জন্য তাওহীদ ও তার ইখলাছকে পরিপূর্ণ করে। সাথে সাথে তার সকল শর্তাবলী অন্তর, জিহ্বা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে, তাহলে তার অতীতের পাপ মার্জনা করতে ওয়াজিব করে দেয়।[৬১]
(ঠ) অন্তর দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে পতিত হয়ে থাকে, তবে যখন তার দ্বীন সম্পূর্ণ আল্লাহর জন্য হয়, তখন এরূপ হয় না।[৬২]
(ড) মুখলিছ ব্যক্তি আল্লাহর জন্য যে ইবাদত করে, শুধু সে-ই তার ইবাদতের গুণাগুণ অনুধাবন করে থাকে। আর তার নিকট আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করা অধিকতর প্রিয় বস্তু।[৬৩]
(ঢ) আগুন ও পানির ন্যায় কোন ব্যক্তির অন্তরে ইখলাছ ও প্রশংসার প্রত্যাশা একত্রিত হতে পারে না।[৬৪]
(ন) ইখলাছ এবং তাওহীদ অন্তরের মাঝে একটি গাছের ন্যায়। তার শাখা হচ্ছে আমলসমূহ। তার ফল হচ্ছে পার্থিব জীবনে সুখী জীবন-যাপন এবং পরকালে সুখ-সাচ্ছন্দে স্থায়ী বসবাস। যেমনভাবে জান্নাতের ফল যা কখনো শেষ হবে না ও নিষিদ্ধ হবে না তেমনিভাবে পার্থিব জীবনে ইখলাছ ও তাওহীদের ফলাফল।[৬৫]
(প) সর্বাধিক উপকারী আমল হলো যা ইখলাছের সাথে মানুষের দৃষ্টিগোচরের বাইরে করা হয়।[৬৬]

পরিশেষ

প্রকৃত পক্ষে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওফীক্ব প্রাপ্ত, যে তার সর্বপ্রকার কর্মে আল্লাহর সন্তুষ্টি বা রেযামন্দী কামনা করে এবং তা হুবহু আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর পদ্ধতি অনুপাতে সাধ্যানুযায়ী সম্পাদন করার চেষ্টা করা। পরিশেষে মহান আল্লাহর নিকট আমাদের আবেদন এই যে, তিনি যেন আমাদের সকলকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে প্রত্যেকটি আমল ও কথা ইখলাছ অনুযায়ী করার তাওফীক্ব দান করেন-আমীন!!

وصلى الله على نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين


*  শিক্ষক, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।

[১]. ফাৎহুল বারী, ১১শ খণ্ড, পৃ. ৩৪৪।
[২]. ইহইয়া ঊলূমুদ্দীন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৯৭।
[৩]. ওমর সুলায়মান আল-আশকার, আল-ইখলাছ, পৃ. ৯৫।
[৪]. ইয্য ইবনু আব্দুস সালাম, ক্বাওয়াইদুল আহকাম ফী মাছালিহিল আনাম (কায়রো : মাকতাবাতুল কুল্লিয়াহ আল-আযহারিয়া, ১৪১৪ হি./১৯৯১ খ্রি.), পৃ. ১০৭।
[৫]. ইবনু মাজাহ হা/৪২০৪।
[৬]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৫০৯, সনদ ছহীহ।
[৭]. ছহীহ বুখারী হা/৬৪৯৯।
[৮]. মিনহাজুস সুন্নাহ ৫/২৫৪ পৃঃ।
[৯]. আল-ইখলাছ, পৃঃ ৯৮।
[১০]. ত্বাবারাণী, আল-আওসাত্ব, হা/৫৪৫২; বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, হা/৭৩১; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৮০২; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫৩, সনদ হাসান।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/ ৫৭৮৯।
[১২]. আদ-দুররুল মানছূর লি সুয়ূত্বী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৭০।
[১৩]. ইহইয়া ঊলূমুদ্দীন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৭০।
[১৪]. জামমুল হাওয়া লি ইবনে জাওযী, পৃ. ১২।
[১৫]. আস-সুন্নাহ লি আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদ, পৃ. ১০৫।
[১৬]. আদ-র্দুরুল মানছূর লিস সুয়ূত্বী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৬০।
[১৭]. আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী, তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৮৪২; আল-ইখলাছ লিল আশকার, পৃ. ৭৩।
[১৮]. শারহুল আক্বীদাতিত ত্বাহাবিয়ইয়াহ লি ইবনু আবুল ইয্য, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৯০।
[১৯]. ইমাম শাত্বেবী, আল-মু‘আফাক্বাত, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৯।
[২০]. আল-মু‘আফাক্বাত, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৬৪।
[২১]. আল-মু‘আফাক্বাত, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৯।
[২২]. আল-ইখলাছ লিল আশক্বার, পৃ. ৭৩-৮৯।
[২৩]. আদাবুদ দুনিয়া লিল মাওয়ার্দী, পৃ. ৪১।
[২৪]. সাইয়েদুল খাত্বির লি ইবনিল জাওযী, পৃ. ৪৫১।
[২৫]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩৪৩।
[২৬]. প্রাগুক্ত।
[২৭]. বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৪; শারহু মুসলিম লিল নাববী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৯০।
[২৮]. বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৪; শারহু মুসলিম লিল নববী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৯০।
[২৯]. মুখতাছার মিনহাজুল কাসেদীন, পৃ. ২২০।
[৩০]. আবুু মুহাম্মাদ আলী ইবনু আহমাদ ইবনু সাঈদ ইবনু হাযম আন্দালুসী, আল-আখলাকু ওয়াস সিয়ারু ফী মাদাওয়াতিন নুফূস (বৈরূত : দারুল আফাক্বিল জাদীদাহ, ২য় সংস্করণ ১৩৯৯ হি./১৯৭৯ খ্রি.), পৃ. ১৬ ।
[৩১]. আল-ইখলাছ লিল আশকার, পৃ. ১২২।
[৩২]. শায়খুল ইসলাম আহমাদ ইবনে তায়মিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২৩শ খণ্ড, পৃ. ১৭৪।
[৩৩]. সিয়ারু আ‘লামুন নুবালা, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪২৭।
[৩৪]. ইমাম নববী, শারহুল আরবাঈন, পৃ. ১১।
[৩৫]. সিয়ারু আ‘লামুন নুবালা, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৬২৫।
[৩৬]. মুখতাছারু মিনহাজুল ক্বাসেদীন লি ইবনে কুদামা, পৃ. ২৪৫।
[৩৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৫০।
[৩৮]. মাকাসেদুল মুকাল্লেফীন, লিল আশকার, পৃ. ২৫৫; ড. আল খাশলান, আত-তাদাখুল বাইনাল আহকাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৮।
[৩৯]. আল-মাদখাল লি ইবনে হাজ্জ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩।
[৪০]. আল জাওয়াবুল কাফী লি ইবনুল কায়্যিম, পৃ. ১৬৫।
[৪১]. আল-ক্বাওয়ায়ে ওয়াল উসূলুল জামি‘আহ লিস সা‘দী, পৃ. ৯৬ ।
[৪২]. আবুল আব্বাস শিহাবুদ্দীন আহমাদ ইবনু ইদরীস আল-ক্বারাফী, আনওয়ারুল বুরূক ফী আনওয়াউল ফুরূক্ব (আলিমুল কুতুব, তাবি), ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৩।
[৪৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৬৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪০০।
[৪৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৭৭, ৮২৪; আবূ দাউদ, হা/৮৪২; বায়হাক্বী-সুনানুল কুবরা, হা/২৭৫৯।
[৪৫]. ফাৎহুল বারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯২ (১৬৩)।
[৪৬]. ইবনু মাজাহ, হা/৪২০২।
[৪৭]. জামেঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম লি ইবনে রজব, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৯।
[৪৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৮৫।
[৪৯]. ‘ইলামুল মুওয়াক্বিইন লি ইবনে ক্বাইয়িম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬১।
[৫০]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৬২২; সনদ হাসান, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৬।
[৫১]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১০ম খণ্ড, পৃ. ১৯৮।
[৫২]. ইবনু তায়মিয়্যাহ, আস-সারেমুল মুনকী, পৃ. ৩৯০।
[৫৩]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৪।
[৫৪]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৭৭।
[৫৫]. মিফতাহু দারুস সা‘আদা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৪।
[৫৬]. মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়্যাহ, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৬০২।
[৫৭]. ইবনু রজব, জামেঊল ঊলূম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩১৬।
[৫৮]. মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়্যাহ, ১০ম খণ্ড, পৃ. ২৬১।
[৫৯]. আল-ফাওয়ায়েদ লি ইবনে ক্বাইয়িম, পৃ. ৬৫।
[৬০]. আল-ফাওয়ায়েদ লি ইবনে ক্বাইয়িম, পৃ. ১৮১।
[৬১]. জামেঊল ঊলূম লি ইবনে রজব, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪১৭।
[৬২]. মাজমূঊল ফাতাওয়া লি ইবনে তায়মিয়্যাহ, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৫৪৫।
[৬৩]. ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ১০ম খণ্ড, পৃ. ২১৫।
[৬৪]. আল-ফাওয়ায়েদ, পৃ. ২৬৭।
[৬৫]. আলÑফাওয়ায়েদ, পৃ. ২৯২।
[৬৬]. আলÑফাওয়ায়েদ, পৃ. ৮৯।




প্রসঙ্গসমূহ »: আত্মশুদ্ধি
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (৫ম কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
হজ্জের শিক্ষা ও হজ্জ পরবর্তী করণীয় - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা - সাজ্জাদ সালাদীন
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ (৩য় কিস্তি) - ড. মেসবাহুল ইসলাম
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৮ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
দলাদলির কুপ্রভাব : উত্তরণের উপায় (শেষ কিস্তি) - শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) -এর আগমন সংশয় নিরসন (৭ম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১১তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ফাযায়েলে কুরআন (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১০ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
বিদ‘আত পরিচিতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সুন্নাতের রূপরেখা (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন

ফেসবুক পেজ