ফাযায়েলে কুরআন
-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*
(৬ষ্ঠ কিস্তি)
আল-কুরআনের মর্যাদা
আল-কুরআন মহান আল্লাহর কথা। যা তিনি অহী করেছেন শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং ছাহাবীগণ সেই অহীকে মুখস্থ, কণ্ঠস্থ এবং লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে সংরক্ষণ ও সংকলন করে গ্রন্থাবদ্ধ করেছেন। এ কুরআন মানব জীবনের চূড়ান্ত সংবিধান, সকল দিক ও বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ, মুক্তি এবং নিরাপত্তার মানদণ্ড। আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের মাধ্যম, সকল আসমানী কিতাবের সত্যায়ন ও সারাংশ, সকল জ্ঞানের ঝর্ণাধারা, হেদায়াতের সমষ্টি, রহমত এবং বরকতের ভাণ্ডার, এমন নূর যা দ্বারা পথভ্রষ্টতার সকল অন্ধকার দূর হয়ে যায়। মানুষকে সংশোধন এবং প্রশিক্ষণের এমন এক ব্যবস্থা, যা মানুষের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য আচরণকে পবিত্র করে। এতে রোগাক্রান্ত মনের আরোগ্য রয়েছে। যে ব্যক্তি এই কুরআনকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরবে, সে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যে কুরআনের বিধান অনুযায়ী আমল করবে, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করবে।
অথচ বর্তমানে তা শুধু তেলাওয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেকেই ধারণা করে যে, কুরআন শুধু মুখস্থ ও (ছালাত ও ছালাতের বাইরে) তেলাওয়াতের জন্যই। আবার একদল কুরআনকে খতম, নকশা ও বকশানোর জন্যই নির্ধারণ করেছে। কিন্তু আল-কুরআন যে মানবজাতির জন্ম থেকে মৃত পর্যন্ত সকল কিছুর জন্য অবতীর্ণ এবং সর্বশ্রেষ্ট পথ নির্দেশ, তা আমরা ভুলতে বসেছি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اِنَّ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنَ یَہۡدِیۡ لِلَّتِیۡ ہِیَ اَقۡوَمُ ‘এ কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ পথ নির্দেশ করে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ نَزَّلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ تِبۡیَانًا لِّکُلِّ شَیۡءٍ وَّ ہُدًی وَّ رَحۡمَۃً وَّ بُشۡرٰی لِلۡمُسۡلِمِیۡنَ ‘আমরা মুসলিমদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ, পথ নির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদ স্বরূপ আপনার উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছি’ (সূরা আন-নাহল : ৮৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ہٰذَا بَیَانٌ لِّلنَّاسِ وَہُدًی وَّمَوۡعِظَۃٌ لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ‘এটা মানবম-লীর জন্য স্পষ্ট বিবরণ এবং মুত্তাক্বীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও উপদেশ’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৩৮)। নিম্নে আল-কুরআনের মর্যাদা ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হল।
১). আল্লাহ তা‘আলার কালাম
কুরআনের অন্যতম মাহাত্ম্য হল যে, কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম। আল্লাহ তা‘আলা তা বলেছেন, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তা শুনেছেন এবং আল্লাহর নির্দেশে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তা নিয়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকট অবতীর্ণ হয়েছেন। শেষনবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর নিকট থেকে শুনেছেন এবং স্মৃতিস্থ করেছেন। প্রকৃত সত্য হল, ধরন ও প্রকৃতির দিক থেকে ‘কথা বলা’ আল্লাহর সত্তাগত বা যাতী গুণ এবং প্রত্যেক কথার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি কার্যগত গুণ।[১] কেননা আল্লাহ তা‘আলা যখন ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা শ্রুত বাক্য দ্বারা কথা বলেন।[২] যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ لَمَّا جَآءَ مُوۡسٰی لِمِیۡقَاتِنَا وَ کَلَّمَہٗ رَبُّہٗ قَالَ رَبِّ اَرِنِیۡۤ اَنۡظُرۡ اِلَیۡکَ قَالَ لَنۡ تَرٰىنِیۡ ‘অতঃপর মূসা যখন আমাদের নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হল এবং তার রব তাঁর সাথে কথা বললেন, তখন সে আবেদন জানাল, হে আমার প্রভু! আমাকে আপনার দর্শন দিন, আমি আপনাকে দেখব। তিনি বললেন, তুমি আমাকে দেখতে পাবে না’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৪৩)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ کَلَّمَ اللّٰہُ مُوۡسٰی تَکۡلِیۡمًا ‘আল্লাহ মূসার সাথে কথা বলেছেন ঠিক যেমনভাবে কথা বলা হয়’ (সূরা আন-নিসা : ১৬৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ مَا کَانَ لِبَشَرٍ اَنۡ یُّکَلِّمَہُ اللّٰہُ اِلَّا وَحۡیًا اَوۡ مِنۡ وَّرَآیِٔ حِجَابٍ اَوۡ یُرۡسِلَ رَسُوۡلًا فَیُوۡحِیَ بِاِذۡنِہٖ مَا یَشَآءُ
‘কোন মানুষের এ মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন, অহির মাধ্যম, পর্দার আড়াল অথবা কোন দূত পাঠানো ছাড়া। তারপর আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে তিনি যা চান তাই অহী করেন’ (সূরা আশ-শূরা : ৫১)।[৩]
আল-কুরআন তাঁর কথা ও অবতীর্ণ বাণী, এতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি স্বয়ং এ বাণীর প্রবক্তা। এ বাণী তাঁর ছিফাত বা গুণ। আর তাঁর সত্তাগত গুণের কোন কিছুই সৃষ্ট নয়; তৈরিকৃত নয় এবং অনিত্য নয়।[৪] যেমনটি কোন কোন বিদ‘আতপন্থীরা মনে করে থাকে।[৫] তাবেঈ বিদ্যান আমর ইবনু দীনার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
أدركت الناس منذ سبعين سنة يقولون الله الخالق وما سواه مخلوق إلا القرآن فإنه كلام الله غير مخلوق
‘আমি ৭০ বছর থেকে লোকদেরকে পেয়েছি, তাঁরা বলতেন, আল্লাহই স্রষ্টা। তিনি ছাড়া সব সৃষ্ট। আর কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম (বাণী)’।[৬] ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল-কুরআন সৃষ্ট নয়। আর এটার প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীছ। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللهُ الْقَلَمَ فَقَالَ اكْتُبْ ‘আল্লাহ তা‘আলা প্রথম যে বস্তু সৃষ্টি করেছেন, তা হল ‘কলম’। অতঃপর তিনি বললেন, লেখ’।[৭] কলম আল্লাহর নির্দেশে তাঁর কালামকে লিপিবদ্ধ করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّمَا قَوۡلُنَا لِشَیۡءٍ اِذَاۤ اَرَدۡنٰہُ اَنۡ نَّقُوۡلَ لَہٗ کُنۡ فَیَکُوۡنُ ‘আমরা কোন কিছু ইচ্ছা করলে সে বিষয়ে আমাদের কথা শুধু এই যে, আমরা বলি, ‘হও’ ফলে তা হয়ে যায়’ (সূরা আন-নাহল : ৪০)। অতএব আল্লাহর কথা তাঁর সৃষ্টির পূর্বেই, তা সৃষ্ট নয়’।[৮] সুফিইয়ান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, إن كل شيء مخلوق والقرآن ليس بمخلوق ‘নিশ্চয় প্রত্যেক জিনিস সৃষ্ট। কিন্তু কুরআন সৃষ্ট না’।[৯] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ قَدۡ کَانَ فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمۡ یَسۡمَعُوۡنَ کَلٰمَ اللّٰہِ ثُمَّ یُحَرِّفُوۡنَہٗ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا عَقَلُوۡہُ وَ ہُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ
‘অথচ তাদের একদল আল্লাহর বাণী শ্রবণ করে, তারপর তারা তা অনুধাবন করার পর বিকৃত করে, অথচ তারা জানে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৭৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اِنۡ اَحَدٌ مِّنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ اسۡتَجَارَکَ فَاَجِرۡہُ حَتّٰی یَسۡمَعَ کَلٰمَ اللّٰہِ
‘আর মুশরিকদের মধ্যে কেউ আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করলে আপনি তাকে আশ্রয় দিন; যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়’ (সূরা আত-তাওবাহ : ৬)।
আল্লাহ তা‘আলার কথা ন্যায়সঙ্গত। সত্যতা, ন্যায়, সমতা ও ইনসাফের দিক দিয়ে পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ। তাঁর কথার কোন পরিবর্তনকারী নেই। বহু হতভাগা মানুষ তাঁর বাণীতে সন্দেহ পোষণ করে পরিবর্তন করতে চায় এবং প্রচার করতে বাধা দেয়। অথচ তাঁর কথা পরিবর্তন করার অধিকার কারো নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
سَیَقُوۡلُ الۡمُخَلَّفُوۡنَ اِذَا انۡطَلَقۡتُمۡ اِلٰی مَغَانِمَ لِتَاۡخُذُوۡہَا ذَرُوۡنَا نَتَّبِعۡکُمۡ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یُّبَدِّلُوۡا کَلٰمَ اللّٰہِ قُلۡ لَّنۡ تَتَّبِعُوۡنَا کَذٰلِکُمۡ قَالَ اللّٰہُ مِنۡ قَبۡلُ
‘তোমরা যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহের জন্য যাবে তখন যারা পিছনে রয়ে গিয়েছিল, তারা অবশ্যই বলবে, আমাদেরকে তোমাদের অনুসরণ করতে দাও। তারা আল্লাহর বাণী পরিবর্তন করতে চায়। বলুন! তোমরা কিছুতেই আমাদের অনুসরণ করবে না। আল্লাহ আগেই এরূপ ঘোষণা করেছেন’ (সূরা আল-ফাতহ : ১৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اتۡلُ مَاۤ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ مِنۡ کِتَابِ رَبِّکَ لَا مُبَدِّلَ لِکَلِمٰتِہٖ
‘হে নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার রবের কিতাবের মধ্যে থেকে যা কিছু আপনার উপর অহী করা হয়েছে তা আপনি পাঠ করে শুনিয়ে দিন। তাঁর কথা পরিবর্তন করার অধিকার কারো নেই’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ২৭)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ تَمَّتۡ کَلِمَتُ رَبِّکَ صِدۡقًا وَّ عَدۡلًا لَا مُبَدِّلَ لِکَلِمٰتِہٖ وَ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ
‘সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার প্রতিপালকের বাণী সম্পূর্ণ এবং তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (সূরা আল-আন‘আম : ১১৫)।
নবুওতের শুরুর দিকে কুরাইশরা অহী তথা আল্লাহর কথা প্রচার করতে বাঁধা দিত। এ কারণে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হজ্জের মৌসুমে লোকদের নিকট উপস্থিত হয়ে বলতেন,أَلَا رَجُلٌ يَحْمِلُنِىْ إِلَى قَوْمِهِ فَإِنَّ قُرَيْشًا قَدْ مَنَعُوْنِىْ أَنْ أُبَلِّغَ كَلاَمَ رَبِّىْ ‘এমন লোক কি কেউ নেই, যে আমাকে সঙ্গে নিয়ে তার গোত্রের কাছে যাবে। যেহেতু কুরাইশ গোত্রের লোকেরা আমাকে আমার প্রতিপালকের বাণী প্রচার করতে বাধা দান করেছে’।[১০]
তাঁর বাণী চিরন্তন সত্য। তাঁর বাণীতে কোন অবাস্তব, অসত্য কথা নেই। তিনি হলেন অধিক সত্যবাদী এবং তাঁর প্রতিশ্রুতিও সত্য। আল-কুরআনে বিবৃত সকল বিবরণ, আদেশ-নিষেধ এবং বিধি-বিধান সত্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ سَنُدۡخِلُہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ اَبَدًا ؕ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقًّا ؕ وَ مَنۡ اَصۡدَقُ مِنَ اللّٰہِ قِیۡلًا
‘যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশাধিকার দান করব; যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। আর কে আছে আল্লাহ অপেক্ষা অধিক সত্যবাদী?’ (সূরা আন-নিসা : ১২২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ؕ لَیَجۡمَعَنَّکُمۡ اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ لَا رَیۡبَ فِیۡہِ ؕ وَ مَنۡ اَصۡدَقُ مِنَ اللّٰہِ حَدِیۡثًا
‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই। নিশ্চয় তিনি তোমাদেরকে শেষ বিচারের দিন একত্র করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর কথায় আল্লাহ অপেক্ষা অধিক সত্যবাদী কে আছে? (সূরা আন-নিসা : ৮৭)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلۡ صَدَقَ اللّٰہُ ۟ فَاتَّبِعُوۡا مِلَّۃَ اِبۡرٰہِیۡمَ حَنِیۡفًا ؕ وَ مَا کَانَ مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ
‘বলুন! আল্লাহ সত্য বলেছেন। সুতরাং তোমরা একনিষ্ঠ ইবরাহীমের দ্বীনের অনুসরণ কর এবং সে অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৯৫)।
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুত্ববার শুরুতে বলতেন,إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘নিশ্চয় সবচেয়ে সত্য বাণী হল আল্লাহর কিতাব এবং সবেচেয়ে শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হেদায়াত’।[১১]
তাঁর কথা অতুলনীয়, অপ্রতিদ্বন্দী, সবচেয়ে সুন্দর এবং সর্বোত্তম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَللّٰہُ نَزَّلَ اَحۡسَنَ الۡحَدِیۡثِ کِتٰبًا مُّتَشَابِہًا مَّثَانِیَ ٭ۖ تَقۡشَعِرُّ مِنۡہُ جُلُوۡدُ الَّذِیۡنَ یَخۡشَوۡنَ رَبَّہُمۡ ۚ ثُمَّ تَلِیۡنُ جُلُوۡدُہُمۡ وَ قُلُوۡبُہُمۡ اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰہِ ؕ ذٰلِکَ ہُدَی اللّٰہِ یَہۡدِیۡ بِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰہُ فَمَا لَہٗ مِنۡ ہَادٍ
‘আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সম্বলিত এমন এক গ্রন্থ, যাতে পারস্পরিক সাদৃশ্যপূর্ণ একই কথা নানাভাবে বার বার বলা হয়েছে। এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের চামড়ার (লোম) খাড়া হয়, অতঃপর তাদের দেহ-মন আল্লাহর স্মরণের প্রতি নরম হয়ে যায়। এটিই আল্লাহর পথনির্দেশ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দিয়ে পথপ্রদর্শন করেন। আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই’ (সূরা আয-যুমার : ২৩)।
জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাতে তাশাহুদের পর বলতেন,أَحَسَنُ الْكَلَامِ كَلَامُ اللهِ وَأَحَسَنُ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘সর্বোত্তম কথা আল্লাহর কথা এবং সর্বোত্তম পথ মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পথ’।[১২] জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুত্ববাতে বলতেন,فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘নিশ্চয় সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হেদায়াত মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হেদায়াত’।[১৩] আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলতেন,إِنَّ أَحْسَنَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘নিশ্চয় সর্বোত্তম কথা আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হেদায়াত মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হেদায়াত’।[১৪]
অতএব কুরআনের বাণী কোন ফেরেশতার বাণী নয়। বরং আল্লাহ তা‘আলা সম্মানিত ফেরেশতা জিবরীলের মাধ্যমে শেষনবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর অবতীর্ণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اِنَّہٗ لَتَنۡزِیۡلُ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ - نَزَلَ بِہِ الرُّوۡحُ الۡاَمِیۡنُ - عَلٰی قَلۡبِکَ لِتَکُوۡنَ مِنَ الۡمُنۡذِرِیۡنَ - بِلِسَانٍ عَرَبِیٍّ مُّبِیۡنٍ
‘নিশ্চয় ওটা (আল-কুরআন) জগৎসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হতে অবতারিত। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) এটা নিয়ে অবতরণ করেছেন। আপনার হৃদয়ে, যাতে আপনি সতর্ককারী হতে পারেন। অবতীর্ণ করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়’ (সূরা আশ-শুআ‘রা : ১৯২-১৯৫)।
কুরআন কোন শয়তান, যাদুকর, কবি বা গণকের বাণী নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَا ہُوَ بِقَوۡلِ شَیۡطٰنٍ رَّجِیۡمٍ ‘এ কুরআন বিতাড়িত শয়তানের কথা নয়’ (সূরা আত-তাকভীর : ২৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَّ مَا ہُوَ بِقَوۡلِ شَاعِرٍ قَلِیۡلًا مَّا تُؤۡمِنُوۡنَ - وَ لَا بِقَوۡلِ کَاہِنٍ قَلِیۡلًا مَّا تَذَکَّرُوۡنَ
‘নিশ্চয় এ কুরআন এক সম্মানিত রাসূলের বাণী। আর এটা কোন কবির কথা নয়; তোমরা খুব অল্পই ঈমান পোষণ করে থাক, এটা কোন গণকের কথাও নয়, তোমরা অল্পই উপদেশ গ্রহণ কর। এটা সৃষ্টিকুলের রবের কাছ থেকে নাযিলকৃত’ (সূরা আল-হাক্বক্বাহ : ৪১-৪২)।
তাছাড়া এ কুরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কল্পনাপ্রসূত রচনা নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ مَا کَانَ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنُ اَنۡ یُّفۡتَرٰی مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ
‘এ কুরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কল্পনাপ্রসূত রচনা নয়’ (সূরা ইউনুস : ৩৭)।
এমনকি নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ থেকেও কল্পনাপ্রসূত রচনা নয়। বরং তিনি যদি নিজের নামে রচনা করে চালানোর চেষ্টা করতেন, তবে অবশ্যই আল্লাহ তাঁর জীবন-ধমনী কেটে ফেলতেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ لَوۡ تَقَوَّلَ عَلَیۡنَا بَعۡضَ الۡاَقَاوِیۡلِ - لَاَخَذۡنَا مِنۡہُ بِالۡیَمِیۡنِ - ثُمَّ لَقَطَعۡنَا مِنۡہُ الۡوَتِیۡنَ - فَمَا مِنۡکُمۡ مِّنۡ اَحَدٍ عَنۡہُ حٰجِزِیۡنَ
‘তিনি যদি আমাদের নামে কোন কথা রচনা করে চালাতে চেষ্টা করতেন, তবে অবশ্যই আমরা তাঁকে পাকড়াও করতাম ডান হাত দিয়ে, তারপর অবশ্যই আমরা কেটে দিতাম তাঁর হৃদপিণ্ডের শিরা, অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউই নেই, যে তাঁকে রক্ষা করতে পারে’ (সূরা আল-হাক্বক্বাহ : ৪৪-৪৭)।
অতএব কুরআন হল আল্লাহর কথা, যা সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ। আর এটা তাঁরই পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এবং এটা মজবুত এবং সুদৃঢ়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
کِتٰبٌ اُحۡکِمَتۡ اٰیٰتُہٗ ثُمَّ فُصِّلَتۡ مِنۡ لَّدُنۡ حَکِیۡمٍ خَبِیۡرٍ
‘এ (কুরআন) এমন গ্রন্থ, যার আয়াতগুলো মজবুত (সুবিন্যস্ত) করা হয়েছে, অতঃপর বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞাতা (আল্লাহর) পক্ষ থেকে’ (সূরা হূদ : ১)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
بَلۡ ہُوَ قُرۡاٰنٌ مَّجِیۡدٌ - فِیۡ لَوۡحٍ مَّحۡفُوۡظٍ
‘বরং এটা গৌরবান্বিত কুরআন। সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ’ (সূরা আল-বুরূজ : ২১-২২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اِنَّہٗ لَتَنۡزِیۡلُ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
‘নিশ্চয় ওটা (আল-কুরআন) জগৎসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হতে অবতারিত’ (সূরা আশ-শুআ‘রা : ১৯২)।
মুমিন হল সেই ব্যক্তি, যে আল-কুরআনকে ‘আল্লাহর কথা’ বলে বিশ্বাস করে। আর যে ব্যক্তি এ বিশ্বাসের বিপরীত করবে; অর্থাৎ আল্লাহর কথাকে বিভিন্নভাবে অপব্যাখ্যা করবে, সে অবশ্যই কুফুরীতে লিপ্ত হবে। আর ঐ ব্যক্তির পরিণাম ভয়াবহ হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ثُمَّ عَبَسَ وَ بَسَرَ - ثُمَّ اَدۡبَرَ وَ اسۡتَکۡبَرَ - فَقَالَ اِنۡ ہٰذَاۤ اِلَّا سِحۡرٌ یُّؤۡثَرُ - اِنۡ ہٰذَاۤ اِلَّا قَوۡلُ الۡبَشَرِ - سَاُصۡلِیۡہِ سَقَرَ
‘অতঃপর সে ভ্রুকুঞ্চিত ও মুখ বিকৃত করল। অতঃপর সে পিছনে ফিরল এবং দম্ভ প্রকাশ করল। এবং বলল, এটা চিরাচরিত যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এটা তো মানুষেরই কথা। আমি তাকে সাকারে (জাহান্নামে) নিক্ষেপ করব’ (সূরা আল-মুদ্দাছ্ছির : ২২-২৬)।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. আল্লাহ তা‘আলার গুণসমূহ তাঁর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার দিক থেকে তিন প্রকার। ১. সত্তাগত গুণ। যে গুণে তিনি সবসময় গুণান্বিত। যেমন তাঁর চেহারা, হাত, পা, আঙ্গুল, চোখ। অনুরূপ তাঁর ক্ষমতা, জ্ঞান, জীবন, শোনা, দেখা ইত্যাদি। ২. কর্মগত গুণ। তা যখন ইচ্ছা তখন তিনি প্রকাশ করেন। যেমন তিনি রহমত করেন, রাগ করেন, হাসেন, খুশি হন ইত্যাদি। ৩. সত্তাগত ও কর্মগত গুণ। যেমন, আল্লাহ তা‘আলার ইরাদা বা ইচ্ছা করা। অনুরূপ তার কথা বলা। তিনি কথা বলেন, এটি তাঁর সত্তাগত ও কর্মগত গুণ। মৌলিকভাবে এগুলো সত্তাগত গুণ কিন্তু তাঁর কিছু কিছু তিনি যখন ইচ্ছা তখন করেন, এটাকে বলা হয়, (قديمُ النّوع حادثُ الآحاد) কাদীমুন নূও‘ ওয়া হাদিছুল আহাদ। অর্থাৎ সবসময়েই তিনি এ গুণের অধিকারী, পূর্বেও কথা বলেছেন, তারপর একক বাক্যসমূহ যখন ইচ্ছা তখন তা দিয়ে কথা বলেন। আল্লাহ তা‘আলার কুরআন নিয়ে কথার বিষয়টি পূর্বেকার নবী-রাসূলগণের পরে সম্পন্ন হয়েছে। তাছাড়া অবশ্যই আল্লাহর আরও অনেক বাণী রয়েছে, সেগুলোর একক প্রকারসমূহ অবশ্যই পরে যখন ইচ্ছা তখন বলেছেন এবং বলবেন। তিনি তাঁর বান্দাদের সাথে যখন ইচ্ছা তখন কথা বলেন, আবার আখেরাতেও কথা বলবেন (সহীহ হাদীস বিশ্বকোষ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৫৮)।
[২]. আল্লাহ তা‘আলা কথা বলেন, দুনিয়াতেও কথা বলেছেন ও বলেন এবং আখেরাতের জীবনেও তিনি কারও কারও সাথে কথা বলেছেন ও বলবেন। দুনিয়াতে তাঁর সে কথা বান্দার কাছে পৌঁছানোর বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। তা মৌলিকভাবে তিন প্রকার। যথা :
(এক) অহী প্রেরণের মাধ্যমে। এটা আবার দু’ প্রকার। ১. জাগ্রত অবস্থায় অন্তরে প্রেরণের মাধ্যমে। ২. ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নে দেখানোর মাধ্যমে।
(দুই) পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলার মাধ্যমে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে সিনাই পর্বতের কাছে পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলেছেন। অনুরূপ গাছের উপর আলো ফেলার মাধ্যমে তাঁর সাথে কথা বলেছেন। তদ্রুপ মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও মি‘রাজের রাতে তাঁর সাথে পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলেছেন।
(তিন) ফেরেশতা পাঠানোর মাধ্যমে কথা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে। এটা আবার কয়েক প্রকার। ১. কখনও জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তার আপন আকৃতিতে আসতেন। ২. কখনও জিবরীল (আলাইহিস সালাম) মানুষের আকৃতিতে আসতেন। ৩. কখনও জিবরীল (আলাইহিস সালাম) ঘন্টাধ্বনীর মত রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসতেন।
আখেরাতে আল্লাহ তা‘আলার সাথে তাঁর বান্দাদের কথা দু’ভাবে হবে। ১. পর্দার অন্তরাল থেকে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদেকে দেখা দিবেন না (সূরা আল-মুতাফফিফীন : ১৫)। ২. সরাসরি : আল্লাহ তা‘আলা পর্দা ছাড়াই জান্নাতীদের সাথে সরাসরি কথা বলবেন (সূরা ইউনুস : ২৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮১)।
[৩]. মহান আল্লাহর বাণী : (اِلَّا وَحۡیًا) ‘অহীর মাধ্যম ব্যতীত’ এ অহী দ্বারা মহান আল্লাহ নবী-রাসূলগণের অন্তরে জাগ্রত অবস্থায় যা প্রেরণ করেন তা যেমন অন্তর্ভুক্ত করে, তেমনি তাদের অন্তরে ঘুমন্ত অবস্থায় আল্লাহ যা তাদেরকে স্বপ্নে দেখান, তাও অন্তর্ভুক্ত করে। মহান আল্লাহর বাণী : (اَوۡ مِنۡ وَّرَآیِٔ حِجَابٍ) ‘অথবা পর্দার আড়াল থেকে’, তিনি মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলেছেন। অত্র আয়াতে বা অন্যান্য জায়গায় বর্ণিত পর্দার আড়াল সৃষ্টিকুলের জন্য; সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর জন্য নয় (সহীহ হাদীস বিশ্বকোষ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৫৮)।
[৪]. অনিত্য ও নিত্য বা অনাদি : আরবী ‘কাদীম’ শব্দটির দু’টি অর্থ হতে পারে। (এক) অনাদি বা নিত্য। এ অর্থে কুরআনকে অনাদি বলা যাবে না (ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১২তম খ-, পৃ. ৫৬৬-৫৬৭)। কারণ কুরআন কারীম নিয়ে আল্লাহ তা‘আলা কথা বলেছেন অনেক পরে, আগে নয়। তবে অনাদি কাল থেকেই তিনি কথা বলার গুণে গুণান্বিত ছিলেন। সেটা কুরআন কারীমের ক্ষেত্রে নয়, অনুরূপ তাওরাত ও ইঞ্জীলের ক্ষেত্রেও নয়। (দুই) যা সৃষ্ট নয়। এ অর্থে বলতেই হবে কুরআন সৃষ্ট নয়। সালাফে ছালেহীন সৃষ্ট নয় বুঝানোর জন্য আল-কুরআনকে ‘কাদীম’ বলতেন না।
‘হাদেছ’ এর দু’টি অর্থ হতে পারে। (এক) নতুন তথা যা পূর্বের পরে নতুন করে এসেছে। যেমন, ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ওপর ছহীফাসমূহ নাযিল হওয়ার পর তাওরাত ও ইঞ্জীল নাযিল করা হচ্ছে নতুন নাযিল করা ও নতুন কথা বলা। অনুরূপ মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর কুরআন নাযিল করার অর্থ হচ্ছে নতুন কিছু নাযিল করা, নতুন কুরআন নাযিল করা, এমন নতুন বাক্য যা মূসা (আলাইহিস সালাম) ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর ওপর নাযিল করা কালাম নয়। এ অর্থে কুরআনকে আল্লাহ তা‘আলা নিজেই নতুন বলেছেন (সূরা আল-আম্বিয়া : ০২, সূরা আশ-শু‘আরা : ০৫)। (দুই) নতুন সৃষ্ট। যেমন, কোন সৃষ্টিকে অপর সৃষ্টি থেকে বের করা, অস্তিত্বে আনয়ন করা। এ অর্থে আল্লাহর গুণসমূহকে ‘হাদেছ’ বা সৃষ্ট বলা যাবে না (সহীহ হাদীস বিশ্বকোষ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৫৮)।
[৫]. (ক) ওয়ালীদ ইবনু মুগীরা : ওয়ালীদ ইবনু মুগীরা মাখযূমী, সে কুরাইশদের নেতা ছিল। সেই প্রথম ব্যক্তি যে বলেছিল, কুরআন মানুষের কথা। যার পরিপেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করেন (দ্রষ্টব্য; সূরা আল-মুদ্দাছ্ছিরের ১১ নং আয়াত হতে ২৬ আয়াত পর্যন্ত তাফসীর; আবূ সাঈদ আদ-দারেমী, আর-রদ্দু ‘আলাল জাহমিয়্যাহ (কুয়েত : দারু ইবনিল আছীর, ২য় সংস্করণ, ১৯৯৫ হি.), পৃ. ১৮৪)।
(খ) জাহমিয়্যাহ : তারা বলে, আল্লাহর কালাম (কুরআন) সৃষ্ট (দ্র. : আর-রদ্দু ‘আলাল জাহমিয়্যাহ, পৃ. ১৮৪)।
(গ) মু‘তাযিলা : তারা বলে, আল্লাহর কালাম (কুরআন) নতুন এবং সৃষ্ট (واتفقوا على أن كلامه محدث مخلوق; দ্র. : আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪২)।
(ঘ) আশ‘আরী : তারা আল্লাহর কথাকে অস্বীকার করে। আল্লাহ তা‘আলা শব্দ এবং হরফের মাধ্যমে কথা বলেন। কিন্তু তারা বলে, ‘আল্লাহর কথা তাঁর নফসের সাথে স্থায়ী। শব্দ এবং হরফ নয়। আল্লাহ তা‘আলা শব্দ সৃষ্টি করেছেন, নফসের স্থায়ী কথা পার করে দেয়ার জন্য। তারা বলে, ‘কুরআন সৃষ্ট (দ্র. : মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছায়মীন, আল-ক্বাওলুল মুফীদ ‘আলা কিতাবিত তাওহীদ (সঊদী আরব : দারু ইবনুল জাওযী, ২য় সংস্করণ, ১৪২৪ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৬)। তারা বলে, আল্লাহর কথা বাস্তব নয়। বরং সেটা আল্লাহর কথার প্রকাশভঙ্গি (দ্র. : ছালেহ আল-উছায়মীন, ইতহাফুল খুল্লান ওয়াল জামা‘আত বিশারহি আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭)। আল্লাহর কথা তাঁর ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু আশ‘আরীরা বলে, আল্লাহ তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কথা বলেন না। বরং তাঁর কথা হল তাঁর অন্তরের সাথে স্থায়ী। যা চিরন্তন এবং চিরস্থায়ী। যেমন জ্ঞান, ক্ষমতা, শ্রবণ এবং দৃষ্টি চিরস্থায়ী। তারা বলে, আল্লাহর যে কথা মূসা (আলাইহিস সালাম) ও মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুনেছেন এবং জিবরীল (আলাইহিস সালাম) যা নিয়ে রাসূলের নিকট আগমন করেছেন, এগুলো সবই সৃষ্ট এবং আল্লাহর চিরন্তন এবং চিরস্থায়ী কথার তা‘বীর বা ব্যাখ্যা (দ্র. : আল-ক্বাওলুল মুফীদ ‘আলা কিতাবিত তাওহীদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩০৯)। তারা বলে, আল্লাহর কথা সৃষ্ট (أن كلام الله مخلوق ; দ্র. : আল-ক্বাওলুল মুফীদ ‘আলা কিতাবিত তাওহীদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩০৯)। তার মধ্যে কোন আদেশ বা নিষেধ নেই। কোন খবর নেই এবং কোন অনুসন্ধান নেই। তাওরাত, ইনজীল এবং কুরআন এগুলো বাস্তবে আল্লাহর কথা নয়। বরং এগুলো সৃষ্ট। এগুলো রূপক অর্থে আল্লাহর কথা। কেননা এগুলো আল্লাহর স্থায়ী কথার নির্দেশক বা প্রমাণ (দ্র. : মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান আল-খুমাইস, ই‘তিক্বাদু আহলিস সুন্নাহ শারহি আছহাবুল হাদীছ (সঊদী আরব : ওযারাতুশ শুয়ূনিল ইসলামী ওয়াল আওক্বাফি ওয়াত দাও‘আতি ওয়াল ইরশাদ, ১৪১৯ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৭)।
(ঙ) মাতুরীদী : তারা আল্লাহর কথা বলাকে অস্বীকার করে। তারা যুক্তি পেশ করে যে, যদি আল্লাহ কথা বলে, তাহলে আল্লাহর কথা বলার জন্য জিহ্বা, মুখ, ঠোট, দাঁতের প্রয়োজন। এ কারণে তারা আল্লাহর কথা বলাকে অপব্যাখ্যা করে। তারা বলে, আল্লাহর কালাম আল্লাহ সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত বা আল্লাহ সত্তার সাথে যুক্ত। আল্লাহর কালামের ব্যাপারে মাতুরীদী এবং মু‘তাযিলাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এ কারণে তারা আল্লাহর কথা শ্রবণ করাকে অস্বীকার করে (দ্র. : আদা’ঊ মাতুরিদিয়াতি লিল আক্বীদাতিস সালাফিয়্যা আল-মাতুরিদিয়্যা- আল-মাতুরিদিয়া ওয়া মাওক্বিফুহুম মিন তাওহীদিল আসমা’ই ওয়াছ ছিফাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১৭-৫১৮)। তারা বলে, আল্লাহর কথা শুনতে পাওয়া যায় না। মাতুরিদীরা আল্লাহর কথাকে এভাবে ব্যাখ্যা করে যে, আল্লাহর কথার অর্থ হল অবহিত করা বা জ্ঞাত করা। যেমনভাবে তিনি আমাদেরকে তাঁর কুদরত ও রুবূবিয়্যাহ সম্পর্কে অবহিত করেছেন। আর এটা জ্ঞাত বিষয় যে, أن قدرة الله تعالي وربوبيته من المعلومات لا من المسموعات ‘আল্লাহর কুদরাত ও রুবূবিয়্যাহ জ্ঞাত বিষয়সমূহ। শ্রবণযোগ্য বিষয় নয়’ (প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৬৪)।
পর্যালোচনা : কুরআন আল্লাহর কালাম; এটা আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্ট বস্তুর মত নয়। কুরআন আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে এবং আল্লাহর নিকট ফিরে যাবে। এটাই ছাহাবী, তাবেঈ, সালাফে ছালেহীন এবং সম্মানিত ইমামগণের অভিমত। সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হল- আল-কুরআন আল্লাহর কালাম।
[৬]. মুহাম্মাদ ছিদ্দীক হাসান খান ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহাব, ক্বাৎফুছ ছামার ফী বায়ানি আক্বীদাতি আহলিল আছার (সঊদীআরব : ওযারাতুশ শুয়ূনিল ইসলামিয়্যা ওয়াল আওক্বাফ ওয়াদ দা‘ওয়াত ওয়াল ইরশাদ, ১৪২১ হি.), পৃ. ৭৭; আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ আয-যাহাবী, আল-ঊলুয়্যু লিল ‘আলিয়্যিল গাফ্ফার (রিয়াদ : মাকতাবাতু আযওয়াইস সালাফ, ১৯৯৫ খ্রি.), পৃ. ১৫৬।
[৭]. তিরমিযী, হা/২১৫৫ ও ৩৩১৯, ‘তাক্বদীর’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৭, সনদ ছহীহ।
[৮]. আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ আল-গানীমান, শারহু কিতাবিত তাওহীদ মিন ছহীহিল বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৯।
[৯]. প্রাগুক্ত।
[১০]. আবূ দাঊদ, হা/৪৭৩৪; তিরমিযী, হা/২৯২৫; ইবনু মাজাহ, হা/২০১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫২২৯; দারেমী, হা/৩৩৫৪, সনদ ছহীহ।
[১১]. নাসাঈ, হা/১৫৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৩৭৩; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/১৭৮৫, সনদ ছহীহ।
[১২]. নাসাঈ, হা/১৩১১।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫০২৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/১০; মিশকাত, হা/১৪১।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৯৮, ৭২৭৭।