বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ অপরাহ্ন

মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব

-মূল : শায়খ ইবরাহীম ইবনু আব্দুল্লাহ আল- মাযরূঈ
-অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ*


(৩য় কিস্তি)

মাযহাবী গোঁড়ামির উপমা

নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের প্রতি অন্ধভক্তি বিভিন্ন কায়দায় হতে পারে। সেটি হতে পারে কতিপয় ইমামকে অন্যদের উপর প্রাধান্য দেয়ার মাধ্যমে, হতে পারে অন্য মাযহাব মতাবলম্বীদেরকে নিজের মাযহাবের অন্ধানুকরণের দিকে আহ্বান করার মাধ্যমে। পাঠক সমীপে তার কিছু উপমা তুলে ধরছি।

১. হানাফী মাযহাব মতাবলম্বীদের গোঁড়ামি

(ক) মুহাম্মাদ আল-হাছফাকী আল-হানাফী[১] (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ১০৮৮ হি.) তাঁর রচিত ‘আদ-র্দুরুল মুখতার শারহু তানভীরিল আবছার’ নামক গ্রন্থের ৯ নং পৃষ্ঠায় বলেন, (ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)) তাঁর জীবনের সর্বশেষ হজ্জে কা‘বার অভ্যন্তরে দু’টি খুঁটির মধ্যস্থানে ডান পায়ের উপর ভর করে প্রথম রাক‘আতে অর্ধেক কুরআন তেলাওয়াত করেন। দ্বিতীয় রাক‘আতে বাম পায়ের উপর ভর করে অবশিষ্ট অর্ধেক কুরআন তেলাওয়াত করেন। অতঃপর সালাম ফিরিয়ে আল্লাহর নিকট কান্না করেন এবং তাঁর রবের নিকট মুনাজাতে মগ্ন হয়ে যান। তখন কা‘বার পার্শ্ব থেকে এক অদৃশ্য চিৎকারকারী বলতে থাকে, ‘হে আবূ হানীফা! তুমি আমাদেরকে যথাযথভাবে চিনতে পেরেছ। আমরা তোমাকে এবং ক্বিয়ামত অবধি তোমার মাযহাবের যত অনুসারী আসবে সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর তিনি (বইয়ের লেখক) একটি জাল হাদীছ উল্লেখ করেন,

إنَّ سَائِرَ الْأَنْبِيَاءِ يَفْتَخِرُوْنَ بِيْ وَأَنَا أَفْتَخِرُ بِأَبِيْ حَنِيْفَةَ مَنْ أَحَبَّهُ فَقَدْ أَحَبَّنِيْ وَمَنْ أَبْغَضَهُ فَقَدْ أَبْغَضَنِيْ

‘সকল নবীগণ আমাকে নিয়ে গর্ব করেন আর আমি আবূ হানীফাকে নিয়ে গর্ব করি। যে ব্যক্তি তাকে ভালোবাসল, সে আমাকেই ভালোবাসল। আর যে ব্যক্তি তাকে ঘৃণা করল, সে আমাকেই ঘৃণা করল’।[২]

অতঃপর তিনি তার আলোচনা পূর্ণ করেন। মোদ্দাকথা হল, ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) হল কুরআনের পরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সব থেকে বড় মু‘জিযা ...। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সঙ্গী-সাথী ও তাঁর সময় থেকে ঈসা (আলাইহিস সালাম) এসে যখন তাঁর মাযহাব অনুযায়ী বিচার ফয়াসালা করবেন এসময়ের মাঝের তাঁর অনুসারীদের জন্য বিধান হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন। ইবনু ‘আবেদীন তাঁর হাশিয়ায় এই বর্ণনাকে মুনকার দাবী করেছেন।[৩]

(খ) আবুল হাসান আল-কারখী আল-হানাফী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৩৪০ হি.) বলেন, ‘মূলনীতি হল, আমাদের মাযহাব পরিপন্থী প্রত্যেকটি হাদীছ সেটি হয়তো মানসূখ হওয়ার যোগ্য বা তার সমমান সম্পন্ন অন্য কোন দলীলের সাংঘর্ষিক অথবা আমাদের মাযহাব এবং সেই হাদীছের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হবে’।[৪]

(গ) ত্বাশ কুবরা খাদাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘জেনে রাখ, মুসলিমদের সর্বপ্রথম, সর্বোত্তম, সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ইমাম, তাবেঈগণের সরদার, উম্মাহর আলোকবর্তিকা এবং ইমামদের গর্ব হলেন ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)’।[৫]

২. মালেকী মাযহাবী মতাবলম্বীদের গোঁড়ামি

কাযী ইয়ায (মৃ. ৫৪৪ হি.) তাঁর রচিত ‘তারতীবুল মাদারিক’ গ্রন্থে  ‘মালেকী মাযহাবের অগ্রাধিকার, ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর তাক্বলীদ করা ওয়াজিব হওয়ার দলীল এবং অন্য ইমামগণের উপর তাঁকে প্রাধান্য দেয়া’ শিরোনামে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন।[৬] ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) মালেকী মাযহাব অনুসারীদের ব্যাপক সমালোচনা করার পর মুনযির ইবনু সাঈদের একটি কবিতা উপস্থাপন করেন,

                    عذيري من قوم يقولون كلما

                                        طلبت دليلا هكذا قال مالك

                    وان قلت قال الله ضجوا وأكثروا

                                      وقالوا جميعا أنت قرن مماحك

                    وإن قلت قد قال الرسول فقولهم

                                       أتت مالكا في ترك ذاك المسالك

‘আমার অভিযোগ তাদের প্রতি যাদের নিকট তুমি দলীল চাইলেই বলে, মালেক এমনটা বলেছেন।
যদি তুমি বল, ‘আল্লাহ বলেছেন’ তবেই তারা হৈ চৈ ও বাড়াবাড়ি শুরু করে দেয়। আর একযোগে বলে উঠে, তুমি বড্ড ঝগড়াটে সাথী।
আর যদি বল, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছন’ তারা বলে, এই রীতি বর্জনের ব্যাপারে মালেকের কাছে (দলীল) এসেছে ।

৩. শাফেঈ মাযহাব মতাবলম্বীদের গোঁড়ামি

ইমামুল হারামাইন আবুল মা‘আলী আল-জুয়াইনী (মৃ. ৪৭৮ হি.) বলেন, ‘প্রত্যেক বিবেকবান ব্যক্তির উপর শাফেঈ মাযহাব অনুসরণ করা আবশ্যক। অনুরূপভাবে সমস্ত আম-জনতা ও অজ্ঞ-নীচুশ্রেণীর ব্যক্তির উপরও শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী হওয়া আবশ্যক। যদিও তাদের উপর আবূ বকর ছিদ্দীক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং অন্যান্য ছাহাবীর অনুসরণ করা আবশ্যক নয়।[৭]

ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ক্বাফফাল[৮] (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মতে, যদি কোন হানাফী ব্যক্তি নারীকে স্পর্শ করে অথবা ছালাতে ধীরস্থীরতা বা অন্য কোন রোকন ছেড়ে দেয়। অতঃপর শাফেঈ মাযহাব মতাবলম্বী ব্যক্তির ইমামতিতে ছালাত আদায় করে তাহলে তার ছালাত বিশুদ্ধ হয়ে যাবে’। কিন্তু জমহূর আলিম এ মতের বিরোধিতা করেছেন। আর এই জমহূরের মতই সঠিক।[৯]

৪. অনুরূপভাবে হাম্বলী মাযহাব মতাবলম্বীদের গোঁড়ামি

ইবনুল জাওযী আল-হাম্বলী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৫৯৭ হি.) (আটানব্বইতম অধ্যায় : ‘সকল মাযহাব উপেক্ষা করে আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মাযহাব চয়নের কারণ) শিরোনামে অধ্যায় রচনা করে বলেন, জেনে রাখ ‘শারঈ দলীলাদি ও ফিক্বহী মূলনীতি নিরীক্ষণ করার পাশাপাশি জগদ্বিখ্যাত মুজতাহিদগণের তথ্য খতিয়ে দেখার পর বুঝতে পারলাম যে, তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক ইলম তথা জ্ঞানে সমৃদ্ধ স্বয়ং সম্পন্ন তিনিই (অর্থাৎ ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)’।[১০]

মাযহাবী গোঁড়ামির কুপ্রভাব ও অপকারিতাসমূহ

মাযহাবী গোঁড়ামির নানাবিধ ভয়াবহ কুপ্রভাব রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি তুলে ধরছি :

১. মুসলিম জাতির উপর কাফিরদের প্রভাব বিস্তার করা এবং খোদ মুসলিম সমাজে পরস্পর কলহ, বিভক্তি, গোলযোগ এবং মতবিরোধ ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল মাযহাবী গোঁড়ামি। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

وَبِلَادُ الشَّرْقِ مِنْ أَسْبَابِ تَسْلِيْطِ اللهِ التَّتَرَ عَلَيْهَا كَثْرَةُ التَّفَرُّقِ وَالْفِتَنِ بَيْنَهُمْ فِي الْمَذَاهِبِ وَغَيْرِهَا، حَتّٰى تَجِدَ الْمُنْتَسِبَ إلَى الشَّافِعِيِّ يَتَعَصَّبُ لِمَذْهَبِهِ عَلٰى مَذْهَبِ أَبِيْ حَنِيْفَةَ حَتّٰى يَخْرُجَ عَنْ الدِّيْنِ.... وَكُلُّ هٰذَا مِنْ التَّفَرُّقِ وَالْاِخْتِلَافِ الَّذِيْ نَهَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ عَنْهُ.

‘প্রাচ্যের দেশগুলোতে তাতারী দখলদারিত্বের অন্যতম কারণ হল, মুসলিম জনগোষ্টিতে বিভক্তি সৃষ্টি হওয়া এবং মাযহাব কেন্দ্রিক আত্মগোলযোগে লিপ্ত হওয়া। এমনকি শাফেঈ মাযহাবের এমনও অনুসারীর সন্ধান মিলে যে কিনা ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মাযহাবের উপর নিজের মাযহাবকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে গোঁড়ামিবশত দ্বীন ত্যাগ করেছে। অথচ এ প্রকৃতির যাবতীয় বৈরিতা এবং মতপার্থক্য থেকে মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন’।[১১]

মাযহাবী গোঁড়ামি বিভিন্ন মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যে বহু ফেতনা আর সংঘাতের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। নিম্নে কয়েকটি সূত্র উল্লেখ করা হল :

১. ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মিশরের শাসক বাদশাহ আফযাল ইবনু ছালাহ উদ্দীন তার মৃত্যুর বছর খানেক পূর্বে ৫৯৫ হিজরীতে দৃঢ় পরিকল্পনা করেন যে, তাঁর দেশ থেকে হাম্বলী মাযহাবের সকল অনুসারীকে নির্বাসিত করবেন এবং যে দেশগুলোর সাথে তার মিত্রতা রয়েছে সেগুলো থেকেও হাম্বলী মাযহাব অনুসারীদেরকে উৎখাত করে দেয়ার জন্য সেই দেশগুলোর শাসক বরাবর চিঠি প্রেরণ করবেন’।[১২] বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করুন, কেননা এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বক্তব্য।

২. শায়খ মুহাম্মাদ রশীদ রেযা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মাযহাবী গোঁড়া ব্যক্তি ইখতিলাফকে রহমত হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না। বরং তাদের প্রত্যেকেই স্বীয় মাযহাবের তাক্বলীদ করা বাধ্যতামূলক করে দেয়। পাশাপাশি সেই মাযহাবের লোকদের জন্য অন্য কারো অনুসরণ করা হারাম করে দেয় এবং তাদের একে অপরকে গালমন্দের বিষয়টি ইতিহাসের পাতাসহ অন্যান্য গ্রন্থে অতি পরিচিত একটা ব্যাপার। এমনকি ব্যাপারটি এমন ভয়ানক রূপ নিয়েছে যে, কোন ব্যক্তি তার দেশে ভিন্ন কোন মাযহাবের পক্ষপাতিত্বকারীকে দেখলে বাঁকা চোখে তাকায়’।[১৩]

তিনি আরো বলেন, ‘আমার কাছে এমনও সংবাদ এসেছে যে, কিছু ব্যক্তি একজন মুছল্লীকে তাশাহহুদের বৈঠকে আঙ্গুল উত্তোলনের কারণে তার শাহাদত অঙ্গুলি ভেঙ্গে দিয়েছে। এছাড়াও শামের ত্রিপলী নগরীতে শাফেঈ মাযহাবের তীব্রতা এতটাই উর্ধ্বমুখী হতে থাকে যে, বাধ্য হয়ে তাদের কিছু শায়খ বিচারকের দারস্থ হয়ে আবেদন করেন যে, মসজিদগুলো আমাদের এবং হানাফীদের মাঝে বণ্টন করে দিন। কারণ তাদের ফক্বীহগণের মধ্য থেকে অমুক আমাদের সাথে যিম্মিদের ন্যায় আচরণ করেন’।[১৪]

৩. মোল্লা আলী ক্বারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হানাফী মাযহাবে প্রচলিত আছে যে, কোন ব্যক্তি হানাফী মাযহাব ছেড়ে শাফেঈ মাযহাবে চলে গেলে তাকে লাঞ্ছিত করা হবে। আর এর বিপরীতটা হলে সম্মানের ভূষণ পরিধান করা হবে’।[১৫]

৪. দেমাস্কের বিচারপতি আল-হানাফী মুহাম্মাদ আল-বুলামাগূনী (মৃ. ৫০৬ হি.) বলেন, ‘আমার ক্ষমতা থাকলে শাফেঈ মাযহাবের অনুসারীদের কাছ থেকে শুল্ক (কর) আদায় করতাম’।[১৬]

মাযহাবী গোঁড়ামি মুসলিমদেরকে বিভক্ত করার পিছনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। তাদেরকে বিভিন্ন দল, উপদল ও পৃথক পৃথক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

‘সুসাব্যস্ত ইবাদতসমূহকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার কারণে এমন সব গোলযোগ জন্ম নেয় যেগুলোকে আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর রাসূল (ﷺ) এবং সমস্ত মুমিন বান্দা ঘৃণা করেন। যেমন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও মতানৈক্য করে, যা ঐক্যের পরিপন্থী। এমনকি একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করে। আবার আল্লাহর সন্তুষ্টিকে পরোয়া না করেই একে অপরকে মিত্র-অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে। এমনকি এ ব্যাপারটি একপর্যায়ে কতককে পরস্পর গালমন্দ, অভিসম্পাত এবং নিন্দার দিকে ঠেলে দেয়। আবার কাউকে কাউকে হাতের দ্বারা ও অস্ত্রের মাধ্যমে সংঘাত অবধি পৌঁছে দেয়। কারো কারো বেলায় সম্পর্ক ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়। পরিশেষে একে অপরের পিছনে ছালাত পর্যন্ত আদায় করে না। এগুলোই অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ। মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) যেগুলোকে হারাম ঘোষণা করেছেন’।[১৭]

ইয়াকূত আল-হামূবী ‘আছফাহান শহরের’ বৃত্তান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘শাফেঈ এবং হানাফী মাযহাব মতাবলম্বীদের মাত্রাতিরিক্ত উশৃঙ্খলতা ও গোঁড়ামির কারণে শহরটির প্রতিটি অঞ্চল ধ্বংসস্থলে পরিণত হয়েছিল। দু’পক্ষের সংঘাত অনবরত লেগেই থাকত। যখনই এক পক্ষ অপর পক্ষের উপর বিজয় লাভ করত, তখনই প্রতিপক্ষের শিবির দখল করে জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দিত’।[১৮]

মুহাম্মাদ সুলতান আল-মা‘ছূমী রচিত ‘হাদিয়্যাতুস সুলত্বান ইলা মুসলিমীল ইয়াবান (জাপান)’ গ্রন্থের মুকাদ্দিমায় এসেছে, ‘জাপানে বসবাসকারী মুসলিমদের পক্ষ থেকে মাযহাব পালন করা প্রসঙ্গে তাঁর বরাবর একটি প্রশ্ন প্রেরণ করা হয়। কারণ জাপানে কিছু বিধর্মী ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করলে সেখানে এক বিরাট মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। কারণ কিছু মুসলিমের বক্তব্য ছিল, তাদের হানাফী মাযহাব চয়ন করা উচিত। আবার কেউ কেউ বলছিল, তাদেরকে শাফেঈ মাযহাবই গ্রহণ করতে হবে। বিষয়টি সেই বিধর্মী জাপানীদের দৃষ্টিগোচর হলে তারা হতভম্ব হয়ে যায়। আর এ কারণটিই তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিমুখ করে দেয়’।[১৯]

সুধী পাঠক! এ ধরণের অপ্রীতিকর কিছু ঘটনার কারণে মুসলিম শিবিরে ঐক্যে ফাটল ধরে। তাদের জামা‘আত ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, প্রতিটি দেশ কপটতা আর দ্বৈরথে ছেয়ে যায়। একে অপরকে বিদ‘আতী বলে আখ্যা দেয়। প্রতিটি দল তাদের বিরোধীদেরকে ভ্রান্ত মনে করে। এমনকি একজন আরেকজনকে কাফের বলে ঘোষণা দেয় এবং পরস্পর রক্তপাতে লিপ্ত হয়। এগুলোর মাধ্যমেই মুসলিমদের চির শত্রুদের জন্য মুসলিমদের উপর চেপে বসার এবং লাঞ্ছিত করার মোক্ষম সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। এভাবেই একপর্যায়ে মাযহাবী গোঁড়ামি তার অনুসারীদেরকে মুসলিম জামা‘আত থেকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে এবং তাদের পরস্পরের মাঝে বৈরিতা আর ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* পাঁচরুখী, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ।

তথ্যসূত্র :
[১]. মূল নাম মুহাম্মাদ ইবনু ‘আলী ইবনু মুহাম্মাদ আল-হিছনী আল-হাছকাফী আল-হানাফী।
[২]. মুহাম্মাদ ইবনু ‘আলী ইবনু মুহাম্মাদ আল-হিছনী আল-হাছকাফী আল-হানাফী, আদ-দুররুল মুখতার শারহু তানভীরিল আবছার ওয়া জামিঊল বাহার, তাহক্বীক্ব : আব্দুল মুনঈম খলীল ইবরাহীম (দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৪২৩ হি.), পৃ. ১৩।
     ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এটা জাল। দ্র. ইবনু ‘আবিদীন মুহাম্মাদ আমীন ইবনু ওমর ইবনু আব্দুল আযীয ‘আবিদীন আদ-দিমাস্কী আল-হানাফী, রদ্দুল মুহতার ‘আলাদ দুররিল মুখতার, ১ম খণ্ড (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৪১২ হি.), পৃ. ৫৩; ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল হাদী আদ-দিমাস্কি, কাশফুল খাফাই ওয়া মুযীলুল ইলবাস, তাহক্বীক্ব : আব্দুল হামীদ ইবনু আহমাদ ইবনু ইউসুফ, ১ম খণ্ড (আল-মাকতাবাতুল ‘আছরিয়্যাহ, ১৪২০ হি.), পৃ. ৪১।
[৩]. রদ্দুল মুহতার ‘আলাদ দুররিল মুখতার, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৩।
[৪]. রিসালাতুল কারখী ফিল উছূলিল মাতবূ‘ মা‘আ তা’সীসিন নাযির লিদ দাবূসী, পৃ. ১১৬।
[৫]. মিফতাহুস সা‘আদাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭৩-১৭৪।
[৬]. কাযী ইয়ায, তারতীবুল মাদারিক, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৫-১০২।
[৭]. মুগিছুল খলক ফী তারজীহিল মাযহাবিল হাক্ব, পৃ. ১৬-১৭।
[৮]. আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবনু আলী ইবনু ইসমাঈল আশ-শাশী (২৯১-৩৬৫ হি./৯০৪-৯৭৬)। তিনি ‘আল-ক্বাফফাল আল-কাবীর’ নামে পরিচিত। তিনি শাফেঈ মাযহাবের একজন পরিচিত ইমাম, ফক্বীহ, মুফাসসির ও হাদীছ বর্ণনাকারী ছিলেন।
[৯]. ইমাম নববী, আল-মাজমূঊ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৮৪।
[১০]. ইমাম যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫১।
[১১]. শুধু শাফেঈ মাযহাব মতাবলম্বী নয়। বরং অন্যান্য মাযহাব মতাবলম্বীরাও মাযহাবী গোঁড়ামি করতে গিয়ে দ্বীন থেকে বের হয়ে গিয়েছে। যেমনটা ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
وَالْمُنْتَسِبَ إلَى أَبِيْ حَنِيْفَةَ يَتَعَصَّبُ لِمَذْهَبِهِ عَلَى مَذْهَبِ الشَّافِعِيِّْ وَغَيْرِهِ حَتَّى يَخْرُجَ عَنْ الدِّيْنِ، وَالْمُنْتَسِبَ إلَى أَحْمَدَ يَتَعَصَّبُ لِمَذْهَبِهِ عَلَى مَذْهَبِ هَذَا أَوْ هَذَا. وَفِيْ الْمَغْرِبِ تَجِدُ الْمُنْتَسِبَ إلَى مَالِكٍ يَتَعَصَّبُ لِمَذْهَبِهِ عَلَى هَذَا أَوْ هَذَا. وَكُلُّ هَذَا مِنْ التَّفَرُّقِ وَالِاخْتِلَافِ الَّذِيْ نَهَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ عَنْهُ.

       দ্র. ইবনু তাইমিয়্যাহ, আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা, ২২তম খণ্ড (দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৪০৮ হি.), পৃ. ২৫৪।
[১২]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ২০।
[১৩]. মুকাদ্দামাতুল মুগনী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮।
[১৪]. মুকাদ্দামাতুল মুগনী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮।
[১৫]. ইরশাদুন নুক্কাদ লিছ ছান‘আনী, পৃ. ২৯।
[১৬]. ইমাম যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫১।
[১৭]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ২২তম খণ্ড, পৃ. ২৫৬-২৬০; দ্র : বিস্তারিত ইমাম শাতেবী ‘আল-ই‘তিছাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৮।
[১৮]. মু‘জামুল বুলদান, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৩।
[১৯]. হাদিয়্যাতুত সুলতান ইলা মুসলিমীল ইয়াবান (জাপান), পৃ. ৩।




প্রসঙ্গসমূহ »: সমাজ-সংস্কার
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৯ম কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) -এর আগমন সংশয় নিরসন (৬ষ্ঠ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ঈদুল ফিতরে করণীয় ও বর্জনীয় - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
শারঈ মানদন্ডে শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক
যাকাত বণ্টনে সমস্যা ও সমাধান - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
তাক্বওয়াই মুক্তির সোপান (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুর রশীদ
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামে কথা বলার নীতি : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৫ম কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
মূর্তিপূজার ইতিহাস - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন

ফেসবুক পেজ