শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৪ অপরাহ্ন

ইসলামে রোগ ও আরোগ্য

-মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী*


(৩য় কিস্তি) 

রোগীকে দেখতে যাওয়া ও সেবা করার নির্দেশনা

অসুস্থকে দেখতে যাওয়া ও তার সেবা করা একটি মানবিক কাজ। যা ইসলামে অনেক মর্যাদাপূর্ণ কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর ছাহাবীগণ অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যেতেন, তাকে সেবা-শুশ্রুষা করতেন এবং অন্যকে সে ব্যাপারে আদেশ প্রদানও করেছেন। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ عَادَ مَرِيْضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِى اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الْجَنَّةِ مَنْزِلًا.


আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে লোক আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের আশায় কোন অসুস্থ লোককে দেখতে যায় অথবা নিজের ভাইয়ের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে যায়, একজন ঘোষক ফেরেশতা তাকে ডেকে বলতে থাকেন, কল্যাণময় হোক তোমার জীবন, কল্যাণময় হোক তোমার এই পথ চলাতেও। তুমি তো জান্নাতের মধ্যে একটি বাসস্থান নির্দিষ্ট করে নিলে।[১]

আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে যেমন সেবা-শুশ্রুষায় অংশগ্রহণ করতেন, তেমনি অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করার জন্য তাঁর উম্মতের প্রতিও নির্দেশ প্রদান করেছেন। এমনকি শুধু উৎসাহ দিয়েছেন বা ফযীলত বর্ণনা করেছেন তাই নয়; বরং আদেশও দিয়েছেন। যেমন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِىْ مُوْسَى الْأَشْعَرِىِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِىِّ قَالَ أَطْعِمُوا الْجَائِعَ وَعُوْدُوا الْمَرِيْضَ وَفُكُّوا الْعَانِىَ.

আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য খাওয়াও, রোগীর শুশ্রুষা কর এবং বন্দীকে মুক্ত কর।[২]

অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাওয়ার আশ্চর্য মর্যাদা


عَنْ ثُوَيْرٍ هُوَ ابْنُ أَبِىْ فَاخِتَةَ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ أَخَذَ عَلِىٌّ بِيَدِىْ قَالَ انْطَلِقْ بِنَا إِلَى الْحَسَنِ نَعُوْدُهُ فَوَجَدْنَا عِنْدَهُ أَبَا مُوْسَى فَقَالَ عَلِىٌّ عَلَيْهِ السَّلَامُ أَعَائِدًا جِئْتَ يَا أَبَا مُوْسَى أَمْ زَائِرًا فَقَالَ لَا بَلْ عَائِدًا فَقَالَ عَلِىٌّ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ يَقُوْلُ مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَعُوْدُ مُسْلِمًا غُدْوَةً إِلَّا صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُمْسِىَ وَإِنْ عَادَهُ عَشِيَّةً إِلَّا صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُصْبِحَ وَكَانَ لَهُ خَرِيْفٌ فِى الْجَنَّةِ

ছুওয়াইর (রাহিমাহুল্লাহ) তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আলী ইবনু আবি তালেব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমার হাত ধরে বললেন, আমার সাথে চল, অসুস্থ হুসাইনকে দেখে আসি। আমরা তাঁর নিকটে গিয়ে আবূ মূসা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে উপস্থিত দেখতে পেলাম। ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আবূ মূসা! আপনি কি রোগী দেখতে এসেছেন? না এমনি বেড়াতে এসেছেন? তিনি বললেন, না আমি রোগী দেখতে এসেছি। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি। তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কোন ব্যক্তি তার অসুস্থ মুসলিম ভাইকে দেখতে গেলে সে না বসা পর্যন্ত জান্নাতের খেজুর আহরণ করতে থাকে। অতঃপর সে বসলে রহমত তাকে ঢেকে ফেলে। সে ভোরবেলা তাকে দেখতে গেলে সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত দু‘আ করতে থাকে। সে সন্ধ্যাবেলা তাকে দেখতে গেলে সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য দু‘আ করতে থাকে।[৩] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,

لَمَّا أُصِيْبَ سَعْدُ بْنُ مُعَاذٍ يَوْمَ الْخَنْدَقِ رَمَاهُ رَجُلٌ فِى الْأَكْحَلِ فَضَرَبَ عَلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ خَيْمَةً فِى الْمَسْجِدِ فَيَعُوْدُهُ مِنْ قَرِيْبٍ

‘খন্দকের যুদ্ধের দিন এক ব্যক্তির নিক্ষিপ্ত তীরে সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আঘাতপ্রাপ্ত হলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার জন্য মসজিদের ভেতর একটি তাঁবু টানালেন। যেন তিনি কাছ থেকে তাকে বারবার দেখতে পারেন’।[৪] এমনকি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কারো চোখে ব্যথাজনিত রোগে ভুগলেও তাকে দেখতে যেতেন।[৫]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ دَخَلَ عَلَى رَجُلٍ يَعُوْدُهُ فَقَالَ لَا بَأْسَ طَهُوْرٌ إِنْ شَاءَ اللهُ. فَقَالَ كَلَّا بَلْ حُمَّى تَفُوْرُ عَلَى شَيْخٍ كَبِيْرٍ كَيْمَا تُزِيْرَهُ الْقُبُوْرَ قَالَ النَّبِىُّ ﷺ فَنَعَمْ إِذًا

ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক রোগীকে দেখার জন্য তার কাছে প্রবেশ করলেন। তখন তিনি বলেন, لَا بَأْسَ طَهُوْرٌ إِنْ شَاءَ اللهُ ‘কোন ক্ষতি নেই, ইনশাআল্লাহ গুনাহ থেকে তুমি পবিত্রতা লাভ করবে’। রোগী বলে উঠল কখনো না; বরং এটি এমন জ্বর, যা এক অতি বৃদ্ধের শরীরে টগবগ করে ফুটছে যেন তাকে কবরে পৌঁছবে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, তবে তাই।[৬] সুবহানাল্লাহ! রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখতে গেলেন একজন সাধারণ বেদুঈনকে।

عَنْ رُبَيِّعَ بِنْتِ مُعَوِّذٍ ابْنِ عَفْرَاءَ قَالَتْ كُنَّا نَغْزُوْ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ نَسْقِى الْقَوْمَ وَنَخْدُمُهُمْ وَنَرُدُّ الْقَتْلَى وَالْجَرْحَى إِلَى الْمَدِيْنَةِ

রুবায়ঈ বিনতে মু‘আওয়ায ইবনু আফরা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিতাম। তখন আমরা লোকজনকে পানি পান করাতাম, তাদের সেবা-শুশ্রুষা করতাম এবং নিহত ও আহতদের মদীনায় নিয়ে যেতাম।[৭] অন্য হাদীছ এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ كَانَ إِذَا أَتَى مَرِيْضًا أَوْ أُتِىَ بِهِ قَالَ أَذْهِبِ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ اشْفِ وَأَنْتَ الشَّافِىْ لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا.


আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিয়ম ছিল, তিনি যখন কোন রোগীর কাছে আসতেন কিংবা তাঁর নিকট যখন কোন রোগীকে আনা হত, তখন তিনি ডান হাত দ্বারা স্পর্শ করে বলতেন,

أَذْهِبِ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ اشْفِ وَأَنْتَ الشَّافِيْ لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا

‘কষ্ট দূর করে দিন। হে মানুষের রব! আরোগ্য দান করুন, আপনিই একমাত্র আরোগ্যদানকারী। আপনার আরোগ্য ছাড়া অন্য কোন আরোগ্য নেই। এমন আরোগ্য দান করুন যা সামান্যতম রোগকেও অবশিষ্ট রাখে না।[৮]

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ম করেছিলেন যে, মানুষ তার শরীরের কোথাও অসুস্থতা অনুভব করলে অথবা তাতে কোন ফোঁড়া বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাকলে- রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর আঙ্গুল দ্বারা এ রকম করতেন- (ধরন বুঝানোর জন্য) বর্ণনাকার সুফইয়ান (রাহিমাহুল্লাহ) তার বৃদ্ধাঙ্গুলিটি যমীনে রাখলেন- অতঃপর তা তুলে নিলেন এবং সে সময় এ দু‘আ পড়তেন

بِاسْمِ اللّٰهِ تُرْبَةُ أَرْضِنَا بِرِيْقَةِ بَعْضِنَا لِيُشْفَى بِهِ سَقِيْمُنَا بِإِذْنِ رَبِّنَا


‘আল্লাহর নামে- আমাদের যমীনের ধূলামাটি আমাদের কারো মুখের লালার সঙ্গে মিলিয়ে- আমাদের পালনকর্তার আদেশে তা দিয়ে আমাদের অসুস্থ ব্যক্তির আরোগ্য লাভের উদ্দেশে মালিশ করছি। তবে ইবনু আবূ শায়বাহ (রাহিমাহুল্লাহ) তার বর্ণনাতে বলেছেন- يُشْفَى 'শিফা দান করা হয়’ এবং যুহায়র (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, لِيُشْفَى ‘আমাদের রোগীর সুস্থতা লাভের উদ্দেশ্যে’।[৯] অন্য একটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عُثْمَانَ بْنِ أَبِى الْعَاصِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّهُ شَكَى إِلَى رَسُوْلِ اللهِ وَجَعًا يَّجِدُهُ فِىْ جَسَدِهِ فَقَالَ لَهُ رَسُوْلُ اللهِ ضَعْ يَدَكَ عَلَى الَّذِىْ يَأْلَمُ مِنْ جَسَدِكَ وَقُلْ بِسْمِ اللهِ ثَلَثًا وَّقُلْ سَبْعَ مَرَّاتٍ أَعُوْذُ بِعِزَّةِ اللهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّمَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ قَالَ فَفَعَلْتُ فَاَذْهَبَ اللهُ مَا كَانَ بِىْ


ওছমান ইবনু আবুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, একবার তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট একটি ব্যথার অভিযোগ করলেন, যা তিনি তাঁর শরীরে অনুভব করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বললেন, তুমি তোমার শরীরের যে স্থানে ব্যথা হচ্ছে সে স্থানে তোমার হাত রাখ এবং তিনবার বল, ‘বিসমিল্লাহ’, আর সাতবার বল,

أَعُوْذُ بِعِزَّةِ اللّٰهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّمَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ


উচ্চারণ : আঊযু বিঈয্যাতিল্লাহি ওয়া কুদরাতিহি মিং শাররি মা আজিদু ওয়া উহাযিরু। অনুবাদ : ‘আমি আল্লাহর প্রতাপ ও তাঁর ক্ষমতার আশ্রয় চাচ্ছি, যা আমি অনুভব করছি ও আশঙ্কা করছি তার মন্দ হতে’। ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি তা করলাম। ফলে আল্লাহ আমার শরীরে যা ছিল তা দূর করে দিলেন।[১০] অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জীবনে অসংখ্যবার অনেক ছাহাবীকে দেখতে গিয়েছেন, যা উপরের হাদীছগুলো প্রমাণ করে।

একজন মুসলিম ব্যক্তি জনৈক খ্রিষ্টান রোগীকে দেখতে গেলেন। তাকে প্রথমে বললেন, আমি কি আপনাকে একটু কুরআন পড়ে শোনাব? তিনি বললেন, আমি ক্ষুধার্ত কোন খাবার দেবেন? মুসলিম ব্যক্তি তাড়াহুড়ো করে কোথায় থেকে খাবার নিয়ে অতি যতেœ খাওয়ালেন। খাওয়া শেষে বললেন, আমি কি আপনাকে কিছু কুরআন পড়ে শোনাব? লোকটি বলল, আমাকে পানি পান করাবেন? আমি খুবই তৃষ্ণার্ত। মুসলিম লোকটি তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে পানি নিয়ে এসে নিজ হাতে তাকে পান করালেন। পানি পান শেষে একই কথা- আমি কি আপনাকে কিছু কুরআন পড়ে শোনাব? এবার অসুস্থ খ্রিষ্টান প-িত বললেন, আপনার চেহারায় তো আমি কুরআন দেখতে পাচ্ছি- আপনি যেভাবে স্বহস্তে অতিযতেœ সমাদর করলেন তাতেই আমি বুঝেছি আপনি মুসলিম আমি মুগ্ধ।[১১]

সেবা না করা ব্যক্তির সাথে আল্লাহর কথোপকথন

ছোটবেলায় আমরা এ কবিতা পড়িনি এমন ছাত্র খুব কমই আছে। মানব জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ই আছে অথচ এই নফল কাজ ‘রোগীর সেবা’ না করার জন্য মহান আরশের অধিপতি আমাদের সৃষ্টিকর্তা বিচার দিবসের মালিক আল্লাহ সরাসরি বান্দার সাথে কথা বলবেন। তাও আবার অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে। কবি আব্দুল কাদির এর লিখা ‘মানুষের সেবা’ নামক কবিতায় তিনি লিখেছেন-

‘হাশরের দিন বলিবেন খোদা- হে আদম সন্তান
তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান।
মানুষ বলিবে- তুমি প্রভু করতার,
আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার?
বলিবেন খোদা- দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে,
তারি শুশ্রুষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে’।

কবি তার ভাষায় কবিতা লিখলেও সেটা যে সরাসরি হাদীছেরই অনুবাদ তা হয়তো অনেকেই বুঝিনি। হাদীছটি নিম্নে উল্লেখ করা হল-

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ r إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُوْلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِيْ قَالَ يَا رَبِّ كَيْفَ أَعُوْدُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ؟ قَالَ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِيْ فُلَانًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ؟ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَّهُ لَوَجَدْتَّنِيْ عِنْدَهُ؟ 

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম তুমি আমাকে দেখতে আসনি। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি কিভাবে আপনাকে দেখতে আসতাম অথচ আপনি জগৎসমূহের প্রতিপালক! আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল কিন্তু তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে, তাহলে অবশ্যই আমাকে তার নিকট পেতে?[১২]

হাদীছটি যেদিন লিখছি ঠিক সেদিনেরই একটি ঘটনা আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোতে ‘অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসায় রিক্সা চালিয়ে ১১০ কিলোমিটার’ মর্মে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উক্ত প্রতিবেদনে একটি বিষয় সবার নিকট স্পষ্ট হয় যে, সে পাশের মানুষের তেমন সহযোগিতা পায়নি বিধায় তাকে নিজের ব্যাটারী চালিত রিক্সা নিয়ে ঠাকুরগাঁ থেকে ১১০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজে নিয়ে এসে ভর্তি করায়। তার কাছে ছিল মাত্র ২০০ টাকা। ফ্রির কথা সে ভাবেনি। প্রথমে চিকিৎসার জন্য অন্যের কাছে কিছু টাকা ধার চেয়েছিল এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাবে তাই। কেউ সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেনি। আর আসবেই বা কেন? কোন ধনী ব্যক্তি বা মেম্বার-চেয়ারম্যান ধার চাইলে অনায়াসেই তাকে দেবে। কারণ তাদের তো ধার পরিশোধ করার যথেষ্ট সোর্স আছে। কিন্তু তারেক ইসলামের কাছে তো সে সম্ভাবনা নেই। ঠিক এমন ব্যক্তিদেরই ক্বিয়ামত দিবসে মহান আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন কেন সেদিন তাকে চিকিৎসা কর্মে সহযোগিতা করেনি?

করোনা সন্দেহে মাকে জঙ্গলে

‘মা তুমি এ বনে এক রাত থাকো। কাল এসে তোমাকে নিয়ে যাব’ এ কথা বলে ৫০ বছর বয়সী মাকে শাল-গজারির বনে ফেলে যান এক ছেলে, দুই মেয়ে ও জামাতারা। টাঙ্গাইল সখীপুর উপজেলার গজারিয়া ২নং ইউনিয়নের মেম্বার আবুল কালাম বলেন, গতকাল রাত আটটার দিকে বনের ভেতর থেকে এক নারীর কান্নার শব্দ শুনে স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ এলাকার লোকজন ঐ নারীকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। নারীই বর্ণনা দেন কিভাবে তার ছেলে, মেয়ে এবং জামাতারা তাকে এই জঙ্গলে ফেলে যায়। পরে রাত দেড়টার পর তাকে উদ্ধার করে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাঠানো হয়।[১৩] আশ্চর্যের বিষয় হল, পরের দিন করোনা পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে জানা যায় তিনি করোনা আক্রান্ত হননি। আইইডিসিআরের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. শাহীনুর আলম এই খবর জানান।[১৪] তাই তো কলামিষ্ট শাহানা হুদা রঞ্জনা লিখেছেন, ‘একদিন হয়তো সব ঠিক হবে, কিন্তু আমরা কি সত্যিই মানুষ হবো?’

‘দি ডেইলি স্টার’ বাংলা ভার্সনে ২১ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার ‘করোনাক্রান্ত সন্দেহে যমুনার দুর্গম চরে ফেলে যাওয়া বৃদ্ধকে উদ্ধার’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে পাবনার বেড়া উপজেলায় যমুনার চরে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ৬৫ বছরের বৃদ্ধকে পড়ে থাকতে দেখে উপজেলা প্রশাসন। মানসিক রোগী হওয়ার কারণে তার নাম-ঠিকানা অথবা কীভাবে এই চরে এল তা কোনটাই জানা যায়নি। তবে এটা নিশ্চিত যে, তাকে কেউ এখানে ফেলে গেছে। কারণ পায়ে হেঁটে এখানে আসার শক্তি তার কোনভাবেই নেই। অর্থাৎ করোনার ভয়ে তাকে কেউ এখানে ফেলে গেছে। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন মাঠকর্মী গিয়ে ঐ ব্যক্তিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি করায়।

‘বৃদ্ধ মাকে রাস্তায় ফেলে আসার অভিযোগে তিন সন্তান গ্রেপ্তার’ শিরোনামে দৈনিক কালের কণ্ঠে ২৬ মে ২০২০ তারিখে সংবাদ প্রকাশ হয়। ছিরাতুননেছার তিন ছেলে আব্দুর রাজ্জাক, মোজাম্মেল ও মোয়াজ্জেমকে জয়পুরহাট পৌর এলাকার মূল্যবান সম্পদ তাদের মাঝে বণ্টন করে দেন। তারপর থেকেই বৃদ্ধাকে দেখা শোনা নিয়ে গড়িমশি শুরু হয় জগতের সুন্দর নামওয়ালা ছেলেরা। একপর্যায়ে মানবিকতার চরম অবনতি হলে তারা পবিত্র ঈদের দিন সোমবার জয়পুরহাট-আক্কেলপুর রাস্তার ধারে বৃদ্ধা মাকে ফেলে যায়। পরে স্থানীয় প্রশাসন তাকে উদ্ধার করে এবং তিন সন্তানকেও গ্রেপ্তার করে। জন্মদাতা মায়ের সন্তান হওয়ার পরও মানুষ কতটা নীচে নামতে পারে যে, পুলিশের সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলার পরও ৩ সন্তান বৃদ্ধ মায়ের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করে।

হাইরে দুনিয়া! আপনার কাছে যা আছে তার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি টাকা দেয়া হলে আপনি কী করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। যদি ছোট কোন বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে সে হয়তো বলবে গুঁড়া দুধের কোটা কিনে খাব। কেউ বলবে, আমি সুন্দর সুন্দর খেলনা ক্রয় করব। আবার কেউ হয়তো চকবিন কিনতে চাইবে। যার বাড়ি নেই সে বলবে আমি একটা বাড়ি করব। ক্ষুধার্ত বলবে পেট ভরে খাব, বিল্ডিং, বিজনেস, বিভিন্ন শখ পূরণ, ভ্রমণ ইত্যাদি উত্তর পাওয়া যাবে। ওরেগন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বশির মাহমুদ লিখেছেন, ‘দেশে গিয়ে এক ডাক্তারের কাছে রাত ৯টার সময় রোগীর দীর্ঘ সিরিয়াল দেখে আমার মনে হল এই ডাক্তার রাত ২টা পর্যন্ত হয়তো রোগী দেখবে। রোগী প্রতি ৮০০/১০০০ টাকা হলে কেনইবা দেখবে না। যত রোগী তত টাকা। সকালে ৭/৮টার দিকে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন সন্তানরা সবাই নিজ নিজ শিক্ষালয়ে/কর্মস্থলে চলে গেছে। ১০/২০ বছর পর যখন অনেক টাকা হবে তখন টাকা দিয়ে তিনি কিছু করতে চাইলেও পারবেন না, কারণ সন্তানরা সেই আদলে গড়ে উঠেনি। দুনিয়াতে রেখে যাওয়ার মত যেমন কিছুই করেননি সাথে আখেরাতের অধ্যায়ও শেষ করতে বসেছেন।[১৫]

দুনিয়ার প্রতি মানুষ এতই এগিয়েছে যে, তা চিন্তাও করা যায় না। দুনিয়ার জন্য মানুষ করতে পারে না এমন কোন কর্ম নেই। মানুষ খুন পর্যন্ত করতে পারে। এমনকি আমরা দেখেছি যে, দুনিয়ার লড়ায়ে টিকে থাকার জন্য নিজ ভাই-বোন, বাবা মাকে পর্যন্ত হত্যা করেছে। করোনা মহামারীতে যখন মানুষ বিভিন্ন স্থানে মারা যাচ্ছে তখন তারই কাছের বন্ধু বা নিকটত্মীয়রাও তার কাছে যায় না। এমনকি তাকে গোসল করানো বা দাফনে অংশগ্রহণ করাতেও তারা রাযি না। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি যে, মৃত্যুর ২/৩ ঘণ্টা পর মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাসের কোন আলামত থাকে না; বরং করোনা নামক ভাইরাসেরও মৃত্যু হয়। সেখানে স্বজনরা তার ধারে কাছেও যেতে চাই না। এমনও দেখা গেছে হাসপাতালে রোগী মরে পড়ে আছে স্বজনরা কেউ নেই। দাফন কর্ম সম্পাদনের শেষ পর্যন্ত পৌঁছালেও তার কোন সন্তান কবর পর্যন্ত আসেনি। দুঃখজনক বিষয় হল মৃত্যুর পর সেই সন্তানরাই বাবার ডেড সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য আসে। কারণ সেখানে দুনিয়াবী স্বার্থ আছে। অর্থাৎ জমি-জায়গা ভাগ-বাটাওয়ারার জন্য মৃত্যু সনদের প্রয়োজন হয়। দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ নিয়ে কয়েকটা উক্তি, যা মনে রাখা ভাল যেন দুনিয়া থেকে একটু হলেও দূরে থাকতে পারি।

টাকা দিয়ে মূল্যবান বিছানা কিনতে পারবেন - কিন্তু ঘুম নয়
টাকা দিয়ে ঘড়ি কেনা যায়- কিন্তু সময় নয়
টাকা দিয়ে বই কিনতে পারবেন - কিন্তু জ্ঞান কিনতে পারবেন না
টাকা দিয়ে ধনী হওয়া যায় - কিন্তু সম্মান পাওয়া যায় না
টাকা দিয়ে ঔষধ কেনা যায় - কিন্তু স্বাস্থ্য কেনা যায় না
টাকা দিয়ে রক্ত কেনা যায় - কিন্তু জীবন পাওয়া যায় না

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. তিরমিযী, হা/২০০৮; সনদ হাসান, ছহীহুল জামে‘, হা/৬৩৮৭।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৭৩; আবূ দাঊদ, হা/৩১০৫; মিশকাত, হা/১৫২৩।
[৩]. তিরমিযী, হা/৯৬৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৪৪২; মিশকাত, হা/১৫৫০; ছহীহুল জামে‘, হা/৫৭৬৭, সনদ ছহীহ।
[৪]. আবূ দাঊদ, হা/৩১০১, সনদ ছহীহ।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/৩১০২, সনদ ছহীহ।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৬২।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৭৯।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৭৫।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৪৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৯৪।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২০২, ‘সালাম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৪।  
[১১]. প্রফেসর এ. কে. এম. শামসুল আলম স্যারের টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত।  
[১২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৯, ‘সদাচারণ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৩।  
[১৩]. দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার।  
[১৪]. সময় সংবাদ, ১৫ এপ্রিল ২০২০ বুধবার।  
[১৫]. দৈনিক প্রথম আলো, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫।  




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ চিকিৎসা
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
রামাযানের স্বরূপ - আল-ইখলাছ ডেস্ক
বিদ‘আত পরিচিতি (২৮তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামে পর্দার বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৩য় কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ১১ রাক‘আতের নির্দেশ দিয়েছিলেন (শেষ কিস্তি) - ব্রাদার রাহুল হোসেন (রুহুল আমিন)
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২০তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আশূরায়ে মুহাররম : করণীয় ও বর্জনীয় - ইউনুস বিন আহসান
ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ (৩য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৫ম কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ

ফেসবুক পেজ