সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার
-মূল : ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহত্বানী
-অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন *
(৯ম কিস্তি)
দ্বিতীয়ত: রজব মাসের প্রথম জুম‘আর রাতে অনুষ্ঠান উদযাপন করা বিদ‘আত
রজব মাসে প্রথম জুম‘আর রাতে মাহফিল করা বিদ‘আত। ইমাম আবূ বকর আত-তারতুশী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আবূ মুহাম্মাদ আল-মাক্বদিসী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁকে অবহিত করেছেন যে,
وأما صلاة رجب فلم تحدث عندنا في بيت المقدس إلا بعد سنة ثمانين وأربعمائة [৪৮০هـ] وما كنا رأيناها ولا سمعنا بها قبل ذلك.
‘রজব মাসে এ মীলাদ অনুষ্ঠান (জন্ম বার্ষিকী) বাইতুল মাক্বদিসে ৪৮০ হি. সনে শুরু হয়। ইতিপূর্বে এ মাহফিল (অনুষ্ঠন) সম্পর্কে কিছু শুনিনি, দেখিওনি’।[১]
ইমাম আবূ শামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
وأما صلاة الرغائب فالمشهور بين الناس اليوم أنها هي التي تصلى بين العشائين ليلة أول جمعة من شهر رجب.
‘ছালাতে রাগায়েব যা মাসের মাঝে বর্তমানে আছে, তা রজব মাসের প্রথম জুম‘আর রাতে মাগরিব ও এশার ছালাতের মধ্যবর্তী সময়ে পড়া হয়’।[২]
হাফেয ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
فأما الصلاة فلم يصح في شهر رجب صلاة مخصوصة، تختص به، والأحاديث المروية في صلاة الرغائب في أول ليلة جمعة من شهر رجب كذبٌ وباطل لا تصح، وهذه الصلاة بدعة عند جمهور العلماء.
‘রজব মাসের সাথে নির্দিষ্ট করে কোন ছালাত আদায় করা সঠিক নয়। রজব মাসের প্রথম জুম‘আর রাতে ছালাতে রাগায়েব সংক্রান্ত বর্ণিত সকল হাদীছ মিথ্যা ও বাতিল, বিশুদ্ধ নয়। আর জমহূর আলেমের নিকটে এ ছালাত বিদ‘আত’।[৩]
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
لم يرد في فضل شهر رجب، ولا في صيامه، ولا في صيام شيء منه معيَّن، ولا في قيام ليلة مخصوصة فيه، حديث صحيح يصلح للحجة.
‘রজব মাসের ফযীলত বা তাতে ছিয়াম পালন এবং বিশেষ কোন দিনে ছিয়াম পালন করা বা বিশেষ কোন রাতে ছালাত আদায় সম্পর্কে কোন বিশুদ্ধ হাদীছ নেই’।[৪] অতঃপর তিনি আরো বলেন,
أن الأحاديث الواردة في فضل رجب أو فضل صيامه أو صيام شيء منه على قسمين: ضعيفة، وموضوعة.
‘যে সমস্ত হাদীছে রজব মাসের ফযীলত বা তাতে ছিয়াম পালনের ফযীলত সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে, তা দু’প্রকার। (ক) যঈফ ও (খ) জাল (বানোয়াট)’।[৫] অতঃপর তিনি ছালাতে রাগায়েবের হাদীছ উল্লেখ করেন। তাতে রয়েছে,
أنه يصوم أول خميس من رجب ثم يصلي بين العشائين ليلة الجمعة اثنتي عشرة ركعة يقرأ في كل ركعة بفاتحة الكتاب مرة، و{إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ} ثلاث مرات، و{قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ} اثنتي عشرة مرة، يفصل بين كل ركعتين بتسليمة، ثم ذكر كلاماً طويلاً في صفة التسبيح والاستغفار، والسجود، والصلاة على النبي صلّى الله عليه وسلّم، ثم بيّن بأن هذا الحديث موضوع مكذوب على رسول الله صلّى الله عليه وسلّم، وبيّن أن من يصلِّيها يحتاج إلى أن يصوم، وربما كان النهار شديد الحر، فإذا صام لم يتمكن من الأكل حتى يصلي المغرب، ثم يقف في صلاته، ويقع في ذلك التسبيح الطويل، والسجود الطويل، فيتأذى غاية الأذى، وقال: "وإني لأغار لرمضان ولصلاة التراويح كيف زوحم بهذه، بل هذه عند العوام أعظم وأجل؛ فإنه يحضرها من لا يحضر الجماعات.
‘রজবের প্রথম বৃহস্পতিবার ছিয়াম পালন, এরপর জুম‘আর রাতে মাগরিব ও এশার মাঝখানে বারো রাকা‘আত ছালাত আদায়, প্রত্যেক রাকা‘আতে সূরা ফাতিহা এক বার, সূরা ক্বদর তিনবার, সূরা ইখলাছ বারো বার পড়া এবং প্রত্যেক দু’রাক‘আত পরপর সালাম ফিরানো।’ এরপর তিনি তাসবীহ, ইস্তেগফার, সিজদা, রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পর তিনি উল্লেখ করেন, এ হাদীছটি জাল এবং রাসূল (ﷺ)-এর উপর মিথ্যারোপ মাত্র। তিনি বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তি উক্ত ছালাত আদায় করতে চাইবে তাকে ছিয়াম থাকতে হবে, কখনো কখনো দিন অনেক গরম হয়, যখন সে ছিয়াম পালন করে তখন সে মাগরিব না পড়া পর্যন্ত খেতে পারে না, অতঃপর সে তার ছালাতে দাড়ায় দীর্ঘ তাসবীহ, সিজদা সহকারে, যাতে সে অত্যন্ত কষ্ট পায়। অতঃপর তিনি বলেন, আমি রামাযান ও ছালাতুত তারাবীহ নিয়ে গর্ববোধ করি, কিন্তু কিভাবে এ ছালাতে এত ভিড় হয়? অথচ এ ছালাতে সাধারণত তারাই আগ্রহী হয়, যারা নিয়মিত ছালাতের জামা‘আতে উপস্থিত হয় না’।[৬]
ইমাম ইবনু ছালাহ (রাহিমাহুল্লাহ) ছালাতে রাগায়েব সম্পর্কে বলেন,
حديثها موضوع على رسول الله ﷺ، وهي بدعة حدثت بعد أربعمائة من الهجرة.
‘ছালাতে রাগায়েব সম্পর্কে হাদীছ জাল। এটা ৪শ হিজরী পর নতুন করে আবিষ্কার করা হয়েছে’।[৭]
ইমাম আল-ইয বিন আব্দুস সালাম (রাহিমাহুল্লাহ) ৬৩৭ হিজরী সনে এক ফাতাওয়ায় লিখেন, أن صلاة الرغائب بدعة منكرة، وأن حديثها كذب على رسول الله صلّى الله عليه وسلّم ‘ছালাতে রাগায়েব বিদ‘আত ও মুনকার (নিকৃষ্ট) এবং এ সংক্রান্ত হাদীছ রাসূল (ﷺ)-এর উপর মিথ্যারোপ ছাড়া কিছুই নয়’।[৮]
পরিশেষে তিনি আবূ শামাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এ কথা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরে ছালাতে রাগায়েব বাতিল বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি উক্ত ইবাদতকে সৎ আমল বিনষ্টকারী হিসাবে উল্লেখ করে নি¤েœাক্ত বর্ণনা পেশ করেন।
(১) উপরোল্লিখিত আলোচনা হতে প্রতীয়মান হয় যে, এ ছালাত বিদ‘আত। নিশ্চয় আলেম সমাজ এবং আয়িম্মাতুল মুসলিমীন অর্থাৎ ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ, তাবে‘ তাবেঈ ও অন্যান্য আলেম যারা দ্বীনের অনেক কিতাব লিপিবদ্ধ করেছেন এবং অতি উৎসাহের সাথে মানুষদের দ্বীনের বিধি-বিধান, ফরয ও সুন্নাত শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁদের কারো থেকে এ ধরনের কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি। এ ছালাত সম্পর্কে কোন বর্ণনা তাঁদের কিতাবে লিপিবদ্ধ হয়নি এবং তাঁরা কোন মজলিসে এ ধরনের বক্তব্য দেননি। এটা অসম্ভব যে, যদি এটি রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত হত, তাহলে ওলামায়ে কেরামের নিকট অজানা থাকত না।
(২) এ ছালাত তিনটি কারণে শরী‘আত পরিপন্থী। প্রথমতঃ এই ছালাত আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীছের পরিপন্থী। নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,
لَا تَخْتَصُّوْا لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ بِقِيَامٍ مِنْ بَيْنِ اللَّيَالِىْ وَلَا تَخُصُّوْا يَوْمَ الْجُمُعَةِ بِصِيَامٍ مِنْ بَيْنِ الْأَيَّامِ إِلَّا أَنْ يَكُوْنَ فِىْ صَوْمٍ يَصُوْمُهُ أَحَدُكُمْ.
‘তোমরা রাতগুলোর মধ্যে কেবল জুমু‘আর রাতকে জাগরণের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়ো না। আর দিনগুলোর মধ্যে শুধু জুম‘আর দিনকে ছিয়ামের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়ো না। তবে যদি তোমাদের কেউ সর্বদা ছিয়াম পালন করে আর এ ছিয়ামের মধ্যে জুমু‘আর দিন এসে যায় তাহলে ভিন্ন কথা। অর্থাৎ সে ঐদিন (নফল) ছিয়াম পালন করতে পারবে’।[৯] সুতরাং এ হাদীছের ভিত্তিতে অন্যান্য রাতকে বাদ দিয়ে শুধু জুম‘আর রাতকে ছালাতের জন্য নির্দিষ্ট করা বৈধ্য নয়’।[১০] এটা রজব মাসের প্রথম জুম‘আহ ও অন্যান্য মাসের জুম‘আহকে অন্তর্ভুক্ত করে।
দ্বিতীয়তঃ রজব ও শা‘বান মাসে বিশেষ কোন ছালাত আদায় করা বিদ‘আত। এ ব্যাপারে এমন সব কথা বলা হয়, যা হাদীছে নেই। তাই এর দ্বারা রাসূল (ﷺ)-এর উপর মিথ্যারোপ করা হয়। তেমনি এ রাতে আমলের প্রতিদান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বলার মাধ্যমে আল্লাহর উপরও মিথ্যারোপ করা হয়। অথচ এ ব্যাপারে তিনি কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। সুতরাং সে সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর উপর মিথ্যারোপ করা হয়, তা মিথ্যাজ্ঞান করা, পরিহার করা, নিকৃষ্ট মনে করা এবং জনগণকে তা থেকে বিরত রাখাই হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসা একান্ত যরূরী। কেননা এগুলোর সাথে একাত্মতার সমর্থনের কারণে অনেক গোলযোগ, অকল্যাণ বা ক্ষতি সৃষ্টি হয়। তা নি¤েœ উল্লেখ করা হল:
প্রথম ক্ষতি: এ সকল ইবাদতের ফযীলত এবং পাপ মোচন সম্পর্কে যা কিছু মানুষের কানে আসে তার উপর নির্ভর করে। ফলে অধিকাংশ মানুষ দু’টি কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
(১) ফরযসমূহের ব্যাপারে শিথিলতা করে।
(২) পাপের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং এ রাত আসার অপেক্ষায় থাকে। এই ছালাত আদায় করে মনে করে যে, ইতিপূর্বে যে সমস্ত আমল ছেড়ে দিয়েছে তার পরিপূরক হয়ে যাবে এবং যে পাপে তারা লিপ্ত ছিল তা ক্ষমা হয়ে যাবে। ছালাতে রাগায়েবের ব্যাপারে হাদীছ রচনাকারীরা ধারণা করেছিল যে, ‘মানুষ অধিকহারে সৎকাজে অনুগামী’। কিন্তু বাস্তবে মানুষ অধিকহারে পাপ ও নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় ক্ষতি: নিশ্চয় বিদ‘আতী কর্মকা-, যা বিদ‘আতপন্থীরা মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে উৎসাহিত করে, যখন তারা দেখে যে, তারা যা আবিষ্কার করেছে (বিদ‘আতসমূহ) তা মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রচলন ঘটছে ও মানুষ তাতে মগ্ন হচ্ছে, তখন তারা এক বিদ‘আতকে আরেক বিদ‘আতের দিকে ঝুঁকে। পক্ষান্তরে বিদ‘আত পরিত্যাগ করাটায় বিদ‘আতী ও বিদ‘আত আবিষ্কারকারীদের জন্য তিরস্কারস্বরূপ।
তৃতীয় ক্ষতি: যখন কোন আলেম বিদ‘আতী কাজ করে তখন সাধারণ মানুষ ধারণা করে, এটাই সুন্নাত। এ ক্ষেত্রে ঐ আলেম স্বীয় কাজের মাধ্যমে রাসূল (ﷺ)-এর উপর মিথ্যারোপ করে এবং কাজটি করার স্থলাভিষিক্ত হয়ে থাকে, যার দ্বারা অধিকাংশ মানুষ বিদ‘আতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
চতুর্থ ক্ষতি: যখন কোন আলেম বিদ‘আতী ছালাত আদায় করে, তখন এটাই কারণ হয়ে যায় যে, সাধারণ মানুষ রাসূল (ﷺ)-এর উপর মিথ্যারোপ করে, এ বলে যে, ‘এটা রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতের মধ্য থেকে একটি সুন্নাত।
তৃতীয় কারণ: এ বিদ‘আতী ছালাত বিভিন্ন দিক থেকে শারঈ ছালাতের নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক। যথা:
১- এ ছালাতে সিজদার সংখ্যা, তাসবীহর সংখ্যা, প্রত্যেক রাক‘আতের নির্দিষ্ট সংখ্যায় সূরা ক্বদর ও সূরা ইখলাছ পড়ার মাধ্যমে নবী করীম (ﷺ)-এর ছালাতের সুন্নাতী পদ্ধতির বিরোধিতা করা হয়।
২- ছালাতে অন্তর বিগলিত হওয়া, একাগ্রতার সাথে ছালাত আদায় করা, আল্লাহর জন্য অন্তরকে খালি করে দেয়া ও কুরআনের অর্থের দিকে লক্ষ্য করে ছালাত আদায় করার সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক।
৩- নফল ছালাত বাড়ীতে আদায় করা সুন্নাতের পরিপন্থী। নফল ছালাত মসজিদে আদায় করার চেয়ে ঘরে একাকী আদায় করা উত্তম। তবে রামাযান মাসে তারাবীহর ছালাত জামা‘আতের সাথে মসজিদে আদায় করা উত্তম।
৪- এ বিদ‘আতী ছালাত আবিষ্কারকদের নিকট এ ছালাতের পূর্ণতা হচ্ছে- বৃহস্পতিবার ছিয়াম পালন করা। এটা দ্বারা দু’টি সুন্নাতকে বর্জন করা আবশ্যক হয়। যথা: (১) ইফতার করার সুন্নাত (২) তৃষ্ণা ও ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে অন্তরকে মুক্ত করার সুন্নাত।
৫- এ ছালাত শেষ করার পর অতিরিক্ত দু’টি সিজদা দেয়া, যার প্রকৃত কোন কারণ নেই’।[১১]
উপরে উল্লিখিত দলীল-প্রমাণ, আলেমগণের বক্তব্য এবং ভ্রান্ত হওয়ার কারণ ও ক্ষতির প্রকার ইত্যাদি আলোচনা দ্বারা জ্ঞানী ব্যক্তির বুঝ আসবে যে, ছালাতে রাগায়েব ইসলামে নতুন আবিষ্কৃত, নিকৃষ্ট বিদ‘আত।
তৃতীয়তঃ ইসরা ও মি‘রাজের রাতে মীলাদ অনুষ্ঠান উদযাপন করার বিদ‘আত
‘ইসারা ও মি‘রাজ আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনাবলীর অন্যতম যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সত্যতা, আল্লাহর কাছে তাঁর উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন হওয়া, আল্লাহর কুদরত এবং তাঁর সবকিছুর উপরে আরশে অবস্থানের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
سُبۡحٰنَ الَّذِیۡۤ اَسۡرٰی بِعَبۡدِہٖ لَیۡلًا مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَی الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِیۡ بٰرَکۡنَا حَوۡلَہٗ لِنُرِیَہٗ مِنۡ اٰیٰتِنَا ؕ اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ.
‘পবিত্র ও মহিয়ান তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত, যার চারপার্শ্বকে আমরা কল্যাণময় করেছি। তাকে আমার নিদর্শনাবলী দেখানোর জন্য, তিনি সর্বশ্রতা, সর্বদ্রষ্টা’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে অসংখ্য হাদীছে বর্ণিত আছে যে, তাঁকে নিয়ে আসমানে উঠা হয়েছিল, তাঁর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হযেছিল। এ পর্যায়ে তিনি সাত আসমান ভ্রমণ করেন, তাঁর সাথে আল্লাহ কথা বলেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেন। প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছিলেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার কাছে বারবার যেতে থাকলে ও সহজতা প্রার্থনা করতে থাকলে আল্লাহ তা‘আলা পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেন। তবে পাঁচ ওয়াক্তের বিনিময়ে পঞ্চাশ ওয়াক্তের ছওয়াব দিবেন। কেননা উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রত্যেকটি সৎ আমল দশ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। তাই আল্লাহ তা‘আলার অগণিত নে‘মতের শুকরিয়া ও প্রশংসা’।[১২]
মি‘রাজের রাতে কোন অনুষ্ঠান উদযাপন করা, শরী‘আত সমর্থিত কোন প্রকার ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট না করা কয়েকটি কারণে যরূরী। যথা:
প্রথম কারণ: কোন্ রাতে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছে, রজব মাসে না অন্য মাসে, তা নির্ধারণের ব্যাপারে কোন বিশুদ্ধ হাদীছ নেই। কারো মতে নবুওয়াত প্রাপ্তির ১৫ মাস পর, কারো মতে হিজরতের এক বছর পূর্বে রবীউছ ছানীর ২৭তম রাতে, কারো মতে নবুওয়াতের ৫ বছর পর’।[১৩] কারো মতে রবিউল আউয়ালের ২৭ তারিখে’।[১৪] ইমাম আবূ শামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
وذكر عن بعض القصاص أن الإسراء كان في رجب، وذلك عند أهل التعديل والتخريج عين الكذب.
‘আর কতিপয় ঐতিহাসিকের মতে, ইসরা বা মি‘রাজ রজব মাসে হয়েছিল, যা বিজ্ঞজনদের মতে সঠিক নয় অর্থাৎ মিথ্যা’।[১৫] ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, أَنَّ لَيْلَةَ الْإِسْرَاءِ لَا يُعْرَفُ أَيَّ لَيْلَةِ كَانَتْ ‘ইসরা (মি‘রাজ) কোন্ রাতে হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায়নি বা জানা নেই’।[১৬]
আল্লামা আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
‘যে রাতে ইসরা বা মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল তা রজব মাসে, না-কি অন্য কোন মাসে, এটা নির্ধারণের জন্য কোন বিশুদ্ধ হাদীছ নেই। আর তা নির্ধারণের জন্য বর্ণিত সকল হাদীছ মুহাদ্দিছগণের মতে বিশুদ্ধ নয়। মি‘রাজের তারিখ মানুষের মাঝ হতে ভুলিয়ে দেয়ার মধ্যে আল্লাহর অনেক হিকমত নিহিত আছে’।[১৭] আর যদি তার জন্য নির্ধারিত কোন রাত প্রমাণিত থাকত, তথাপি প্রমাণ ছাড়া তাতে বিশেষ কোন ইবাদত করা বৈধ হত না’।[১৮]
দ্বিতীয় কারণ: কোন মুমিন বা আলেম থেকে এ কথা প্রমাণিত নেই যে, তারা অন্য কোন রাতের উপর মি‘রাজের রাতের কোন বিশেষ কোন ফযীলত নির্ধারণ করেছেন। কেননা রাসূল (ﷺ), ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈগণ এ রাতে কোন ধরনের মাহফিল করতেন না, এ রাতকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করতেন না এবং এ বিষয়ে কোন আলোচনা করতেন না। যদি মাহফিল করা শরী‘আত সম্মত হত, তাহলে রাসূল (ﷺ) অবশ্যই তা উম্মতের নিকট বর্ণনা করতেন কথা বা কর্মের মাধ্যমে। আর যদি তা সংঘটিত হত, তাহলে অবশ্যই তা প্রচার-প্রসার হত এবং ছাহাবীগণ তা বর্ণনা করতেন’।[১৯]
তৃতীয় কারণ: আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য দ্বীন এবং নে‘মত পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নে‘মত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে কবুল করে নিলাম’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৩)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَمۡ لَہُمۡ شُرَکٰٓؤُا شَرَعُوۡا لَہُمۡ مِّنَ الدِّیۡنِ مَا لَمۡ یَاۡذَنۡۢ بِہِ اللّٰہُ ؕ وَ لَوۡ لَا کَلِمَۃُ الۡفَصۡلِ لَقُضِیَ بَیۡنَہُمۡ ؕ وَ اِنَّ الظّٰلِمِیۡنَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ.
‘তাদের কি এমন শরীক আছে যারা তাদের জন্য দ্বীনের বিধি-বিধান দিয়েছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? ফায়সালা সম্পর্কিত (পূর্ব) ঘোষণা দেয়া না হলে তাদের মধ্যে (তৎক্ষণাত) ফায়সালা করে দেয়া হত। যালিমদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (সূরা আশ-শূরা : ২১)।
চতুর্থ কারণ: রাসূল (ﷺ) বিদ‘আত সম্পর্কে সতর্ক করেছেন ও ঘোষণা করেছেন যে, প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা, তা প্রত্যাখ্যাত তার প্রবর্তক ও আমলকারীসহ। ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, مَنْ أَحْدَثَ فِىْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমার শরী‘আতে এমন কিছু সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[২০]
ছহীহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় রয়েছে, مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهْوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে স্বীকৃত নয় এমন কোন আমল করল, তা প্রত্যাখ্যাত’।[২১] সালাফে ছালিহীন বিদ‘আত সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। কেননা তা দ্বীনের মধ্যে অতিরঞ্জন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর অনুমতি ছাড়া কোন কিছু শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত করাটা ইহূদী-নাছারাদের ন্যায় দ্বীনের মধ্যে অতিরঞ্জনের নামান্তর’।[২২]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর।
[১]. আবূ বকর আত-তারতুশী, আল-হাওয়াদিছ ওয়াল বিদ‘ঈ, পৃ. ২৬৭, হা/২৩৮।
[২]. ইমাম আবূ শামাহ, কিতাবুল বাহিছ আলা ইনকারিল বিদ‘ঈ ওয়াল হাওয়াদিছ, পৃ. ১৩৮।
[৩]. লাতায়িফু মা‘আরিফ ফি-মালি মাওয়াছিমিল আম-মিনাল ওযায়েফ, পৃ. ২২৮।
[৪]. তিবইয়ানুল ঊজব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রজব, পৃ. ২৩।
[৫]. তিবইয়ানুল ঊজব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রজব, পৃঃ ২৩।
[৬]. তিবইয়ানুল ঊজব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রজব, পৃ. ৫৪।
[৭]. ইমাম আবূ শামাহ, কিতাবুল বায়িছ ‘আলা ইনকারিল বিদ‘ঈ ওয়াল হাওয়াদিছ, পৃ. ১৪৫।
[৮]. ইমাম আবূ শামাহ, কিতাবুল বায়িছ ‘আলা ইনকারিল বিদ‘ঈ ওয়াল হাওয়াদেছ, পৃ. ১৪৯।
[৯]. ছহীহ বুখারী, ‘ছিয়াম’ অধ্যায়, ‘জুমু‘আর দিনে ছিয়াম পালন করা’ অনুচ্ছেদ, ২য় খ-, পৃ. ৩০৩, হা/১৯৮৫; ছহীহ মুসলিম, ‘ছিয়াম’ অধ্যায়, ‘জুমু‘আর দিনে ছিয়াম পালন করা অপসন্দনীয়’ অনুচ্ছেদ, ২য় খ-, পৃ. ৮০১, হা/১১৪৪।
[১০]. ইমাম আবূ শামাহ, কিতাবুল বায়িছ আলা ইনকারিল বিদ‘ঈ ওয়াল হাওয়াদিছ, পৃ. ১৫৬।
[১১]. ইমাম আবু শামাহ, কিতাবুল বায়েস আলা ইনকারিল বিদ‘ঈ ওয়াল হাওয়াদিছ, পৃ. ১৫৩-১৯৬।
[১২]. আল্লামা আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু বায, আত-তাহযীরু মিনাল বিদ‘আ‘, পৃ. ১৬।
[১৩]. ইমাম নববী, শরহে মুসলিম, ২য় খ-, পৃ. ২৬৭-২৬৮।
[১৪]. আবূ শামাহ, কিতাবুল হাওয়াদিছ ওয়াল বিদ‘ঈ, পৃ. ২৩২।
[১৫]. আবূ শামাহ, কিতাবুল হাওয়াদিছ ওয়াল বিদ‘ঈ, পৃ. ২৩২; ইবনু হাজার আসক্বালানী, তিবইয়ানুল উজুব বিমা ওরাদা ফি শাহরি রজব, পৃ. ৯, ১৯, ৫২, ৬৪, ৬৫।
[১৬]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ফী হাদিই খায়রিল ইবাদ, ১ম খ-, পৃ. ৫৮।
[১৭]. আত-তাহযীরু মিনাল বিদ‘আ‘, পৃ. ১৬।
[১৮]. আত-তাহযীরু মিনাল বিদ‘আ‘, পৃ. ১৭।
[১৯]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ফী হাদিই খায়রিল ইবাদ, ১ম খ-, পৃ. ৫৮; ইবনু বায, আত-তাহযীরু মিনাল বিদ‘আ‘, পৃ. ১৭।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮।
[২১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮।
[২২]. ইবনু বায, আত-তাহযীরু মিনাল বিদ‘আ‘, পৃ. ১৭।
প্রসঙ্গসমূহ »:
সুন্নাত