সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:০৭ পূর্বাহ্ন

আল-কুরআনে মানব সৃষ্টির প্রক্রিয়া: উপকরণ ও সৃষ্টির স্তর বিন্যাস

- ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ*

(শেষ কিস্তি)

[ফেব্রুয়ারী’২৫-এর পর] 


মানব সৃষ্টির আবশ্যকীয় উপাদান পানির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কযুক্ত বস্তু বীর্য

মানব সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য, গুরুত্ব ও অপরিসীম তাৎপর্যের অন্তরালে মহান স্রষ্টার পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, মানব জাতির হৃদয় স্পন্দন করার প্রয়াসে, আল-কুরআনে বহু আয়াতের সমন্বয় ঘটেছে। পানির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কযুক্ত বস্তুরও (বীর্যের) বহু আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরা নাহলের তাৎপর্যপূর্ণ বাণী হল, خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ  فَاِذَا ہُوَ خَصِیۡمٌ مُّبِیۡنٌ ‘তিনি মানবকে এক ফোঁটা বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন। এতদসত্ত্বেও সে প্রকাশ্য বিতণ্ডাকারী হয়ে গেছে’ (সূরা আন-নাহল: ৪)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,  اَوَ لَمۡ یَرَ الۡاِنۡسَانُ  اَنَّا خَلَقۡنٰہُ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ  فَاِذَا ہُوَ  خَصِیۡمٌ  مُّبِیۡنٌ ‘মানুষ কি দেখে না যে, আমরা তাকে সৃষ্টি করেছি বীর্য থেকে? অতঃপর তখনই সে হয়ে গেল প্রকাশ্য বাকবিতণ্ডাকারী’ (সূরা ইয়াসীন: ৭৭)। একই মর্মার্থে পুনরায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّا خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ  اَمۡشَاجٍ ٭ۖ  نَّبۡتَلِیۡہِ  فَجَعَلۡنٰہُ سَمِیۡعًۢا بَصِیۡرًا আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্র শুক্র বিন্দু থেকে এভাবে যে, তাকে পরীক্ষা করব। অতঃপর তাকে করে দিয়েছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন’ (সূরা আদ-দাহ্র: ২)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বিস্তারিত আকারে বলেন,
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ  اِنۡ  کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّنَ الۡبَعۡثِ فَاِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ تُرَابٍ ثُمَّ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ  ثُمَّ مِنۡ عَلَقَۃٍ  ثُمَّ مِنۡ مُّضۡغَۃٍ مُّخَلَّقَۃٍ  وَّ غَیۡرِ مُخَلَّقَۃٍ  لِّنُبَیِّنَ لَکُمۡ

‘হে লোক সকল! আমরা তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি, এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট গোশতপিণ্ড থেকে তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্য’ (সূরা আল-হজ্জ: ৫)।

সুধী পাঠক! উপরের আয়াতগুলোতে শ্রেষ্ঠ মানবের মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের প্রতীক স্বরূপ তার প্রজনন প্রক্রিয়ায় রয়েছে উচ্চতর কলা-কৌশল এবং বিভিন্ন প্রকারের উপাদানের সুস্পষ্ট বিবরণ। মানব শিশু তার জন্মলগ্নে মাতৃগর্ভে ক্ষুদ্রাকৃতির এক গোশতপিণ্ডের মত দেখায়। কেন্দ্রস্থলটি মানবাকৃতির মত দেখালেও তখন আলাদা করে কিছুই বুঝা যায় না। পরে গোশতপিণ্ডটি (ভ্রুণটি) ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে বৃদ্ধি থাকে। প্রবৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়েই গঠিত হয়ে থাকে মানব শিশুর হাড়ের কাঠামো পেশ, স্নায়ুতন্ত্র, বিভিন্ন সরবরাহ যন্ত্র এবং অন্ত্রাদিও। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত এসব তথ্যচিত্র এখন সর্বজনবিদিত।

যাহোক মানব প্রজনন সংক্রান্ত পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলো অত্যন্ত সরল, সহজ ও সাধারণ ভাষায় এলোপাতাড়িভাবে বর্ণিত হয়েছে। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির ভয়াবহ বিশালতা ও কাঠিন্যতা ব্যতীত, অন্য কোন সৃষ্টির ক্ষেত্রে, মানব সৃষ্টির মত এত খুঁটি-নাটি বা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সৃষ্টিতত্ত্ব উদ্ভাসিত হয়নি। ধর্মীয় উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যেই মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বিশ্ববাসীর প্রতি অতীব সঠিক ও যুক্তিযুক্ত আধ্যাত্মিক বিষয়াদির বহু উদাহরণ উপস্থিত করা হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পর্যালোচনার জন্যই, মাহাত্ম্যপূর্ণ আয়াতগুলোর অবতারণা যা মানুষের মুক্তির প্রকৃত পথের সন্ধান দিতে সহায়ক হতে পারে। মানব সৃষ্টির নিভৃতে যে গোপনীয় গূড় রহস্য বিদ্যমান, সে বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন,

لِلّٰہِ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ یَخۡلُقُ مَا یَشَآءُ ؕیَہَبُ لِمَنۡ یَّشَآءُ  اِنَاثًا وَّ یَہَبُ  لِمَنۡ  یَّشَآءُ   الذُّکُوۡرَ

‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা‘আলারই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন’ (সূরা আশ-শূরা: ৪৯)। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহ পরম সন্তুষ্টির বাণী হচ্ছে, لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡۤ  اَحۡسَنِ تَقۡوِیۡمٍ ‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে’ (সূরা আত-ত্বীন: ৪)।

আমরা আল্লাহর সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব। জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, চিন্তা-গবেষণা, মনোযোগ-অমনোযোগ ইত্যাদি আমাদের চিরসাথী। তন্মধ্যে চিন্তা-ভাবনা, বিবেক-বিবেচনা দ্বারা সত্য ধর্ম ইসলামে প্রতিষ্ঠিত থাকাই হল আমাদের শ্রেষ্ঠ দায়িত্ব ও কর্তব্য। জীবন প্রবাহের মুহূর্তগুলোতে কারণে-অকারণে বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনায় অসংখ্য ভীড়ের উৎপত্তি হয়। অনাকাক্সিক্ষত ঐসব অশুভ তৎপরতা হতে আত্মরক্ষার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সুনির্দিষ্ট বিধানাবলী প্রদান করেছেন। তন্মধ্যে জন্ম-মৃত্যু নিয়ে গভীর চিন্তা করা উক্ত বিধানাবলীর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। অবশ্য এখানে শুধু জন্ম রহস্যের বৈচিত্রময় প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত বাণীগুলোরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যা আল্লাহর একত্ব সহ অন্যান্য সত্য বিধানে আকৃষ্ট করার উত্তম সহায়ক। মানুষ তার জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, পাণ্ডিত্য প্রতিভা, অর্থসম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি, বিবেক-বিবেচনা প্রভৃতি গুণাবলীর মাঝে নিজের জন্ম বৃত্তান্তের অনুসন্ধান করুক, অতঃপর নিজের করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক, এটাই হল প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপদেশমালা।

ভ্রুণের স্তর বিন্যাস ও বিকাশ ধারা

মাতৃগর্ভে একটি মানব শিশু পরিপূর্ণতা লাভ করে স্তরের পর স্তর অতিক্রম করে। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া যা সংগঠিত হয় দয়াময় আল্লাহর রহমতে। মাতৃগর্ভে ভ্রুণ সৃষ্টি হওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ Sperm এবং Ovum থেকে শুধু একটি Sperm এবং একটি Ovum প্রয়োজন। উভয় কোষের নিষেক হওয়া মাত্রই যে কোষটি গঠিত হয় তার নাম Zygote। জায়গোট জরায়ুতে uterus প্রতিস্থাপিত হওয়ার পর পিটুইটারি গ্রন্থি, ডিম্বাশয় এবং অমরা (Placenta) নিঃসৃত বিভিন্ন হরমোনের প্রভাবে মাত্রদেহের পরিবর্তনগুলো ক্রমান্বয়ে বিকাশ লাভ করে এবং প্রতিস্থাপিত জাইগোট ক্লিভেজ প্রক্রিয়ায় দ্রুত বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্তরের সূচনা করে। বৃটিশ ভ্রুণতত্ত্ববিদ Von Bear ১৮২৭ সালে ভ্রুণের বিকাশের স্তর Stage আবিষ্কার করেন। যা ১৪৫৭ বছর পূর্বে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। আল্লাহ তা‘আলা এই স্তর সম্পর্কে বলেন,  وَ  قَدۡ خَلَقَکُمۡ   اَطۡوَارًا ‘অথচ তিনি তোমাদেরকে বিভিন্ন রকমে সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা আন-নূহ: ১৪)।

৭ম শতাব্দীতে অবতীর্ণ আল-কুরআনে ভ্রুণ বিকাশের পর্যায়গুলো বিভিন্ন সূরায় খণ্ডিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। আবার সূরা মুমিনুনের ১২-১৫ নং আয়াতে এ স্তরগুলো ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে উপস্থাপন করেছেন, যা বিজ্ঞানসম্মতভাবে ধারাবাহিক সামঞ্জতা বিধান করে। নিম্নে আল-কুরআন ও বিজ্ঞানে বর্ণিত ভ্রুণ সৃষ্টির পর্যায়গুলো তুলে ধরা হলো-
ক্র. কুরআন ক্র. বিজ্ঞান
সুলালাহ (সার নির্যাস) Sperm (n) + Ovum (n) (প্রজনন অনু)
নুতফা (অনুবীক্ষণ যন্ত্রে দৃষ্ট প্রজনন কোষ) Zygote (নিষিক্ত কোষ)
আলাক (জমাট রক্তপিণ্ড) Blastocyst (রক্তপিণ্ড)
মুদগাহ (গোশতপিণ্ড) Somites (বহুকোষি গোশতপিণ্ড)
ইযাম (অস্থি) Skeleton (কংকাল বা অস্থিতন্ত্র)
লাহাম (গোশত পেশী) Muscles (গোশত পেশী)
রূহ (প্রাণ) Foetus (মানব শিশু)

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ سُلٰلَۃٍ  مِّنۡ طِیۡنٍ - ثُمَّ  جَعَلۡنٰہُ  نُطۡفَۃً  فِیۡ قَرَارٍ مَّکِیۡنٍ- ثُمَّ خَلَقۡنَا النُّطۡفَۃَ عَلَقَۃً  فَخَلَقۡنَا الۡعَلَقَۃَ مُضۡغَۃً فَخَلَقۡنَا الۡمُضۡغَۃَ عِظٰمًا فَکَسَوۡنَا الۡعِظٰمَ لَحۡمًا ٭ ثُمَّ اَنۡشَاۡنٰہُ خَلۡقًا اٰخَرَ ؕ فَتَبٰرَکَ اللّٰہُ  اَحۡسَنُ  الۡخٰلِقِیۡنَ

‘আমরা মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমরা তাকে শুক্রবিন্দু রূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর সেই মাংসপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুন রূপে দাড় করিয়েছি। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত কল্যাণময়’ (সূরা আল-মূমিনূন: ১২-১৪)।

১. সুলালাহ (Sperm (n) + Ovum (n) )

আল-কুরআনে প্রথম পর্যায়ে বলা হয়েছে মাটির সার নির্যাস (سلالة من طين)। অর্থাৎ মাটির সার নির্যাস থেকে মানুষ সৃষ্টির সূচনা হয়। মাটির সার নির্যাস হলো সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি। বৃক্ষরাজি এবং ক্ষেতের ফসল মূলের সাহায্যে এগুলো চুষে নেয়। তারপর বৃক্ষ ফল (তথা আম, জাম, কাঠাল, আপেল, আঙ্গুর ও কলাসহ বিভিন্ন ফলজ গাছ) দেয়। ক্ষেতে ফসল তথা ধান, গম, ভূট্টা যবসহ বিভিন্ন কিছু উৎপন্ন হয়। ফল ও ফসল মানুষ খাদ্য রূপে গ্রহণ করার পর পাকস্থলিতে ডাইজেস্ট হয়। ডাইজেস্টিভ খাদ্যের সারনির্যাস থেকে জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পুরুষের শুক্রাশয়ে testes উৎপন্ন হয় Spermatozoon এবং নারীর ডিম্বাশয়ে (Ovary) উৎপন্ন হয় Ovum। অতঃপর Spermatozoon এবং Ovum এর নিষেক থেকে সৃষ্টি হয় Zygote। জাইগোট জরায়ুতে (Uterus) স্থানান্তরিত হয়ে ভ্রুণ (embryo) গঠন করে। আর এ ভ্রুণ ক্রমান্বয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে একটি পরিপূর্ণ মানুষ সৃষ্টি হয়। সুতরাং ‘সুলালাহ’ হচ্ছে মানুষ তৈরির বেসিক উপাদান। যা থেকে মানুষ সৃষ্টির মলিকুল আহরিত হয়। অর্থাৎ পিতা-মাতার পুষ্টির প্রয়োজনে মাটির সারনির্যাস থেকে যে সব উপদান সংগৃহীত হয় সে সব উপাদান থেকে নুথফা তৈরি হয়। 

২. নুতফা (Zygote)

আরবী ‘নুতফা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অনুবীক্ষণ যন্ত্রে দৃষ্ট অতি সূক্ষ্ম প্রজনন কোষ। Sperm এবং Ovum উভয় অর্থে নুতফা শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আবার Sperm এবং Ovum এর নিষেকের ফলে গঠিত কোষ জাইগোটকেও আল-কুরআনে নুতফা বলা হয়েছে এবং ক্ষেতে নুতফা শব্দের পরে ‘আমসাজ’ শব্দটি এসেছে। জাইগোট গঠনের ২৪ ঘণ্টার পর তা বাচ্চা থলির দেয়ালে ঘেরা প্রকোষ্টে স্থান লাভ করে এবং ২টি, ৪টি, ৮টি এভাবে ক্রমান্বয়ে বিভাজন হতে থাকে। এটাকে বলা হয় Morula।

৩. আলাক (Blastocyst)

আলাক অর্থ জমাটবাধা রক্তপিণ্ড। বিজ্ঞানে রভা হয় Blastocyst। এটি দেখতে জোকের মত Leech like subtance। একটি জোক রক্ত চুষে নিয়ে যে রূপ ধারণ করে আলাক সে রকম একটি বস্তু। ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে আলাক জোক সদৃশ রূপ লাভ করে। এর মধ্যে থাকে মাথার সম্মুখভাগের উন্নত অংশ। এ পর্যায়ে হৃৎপিণ্ড অর্থাৎ Cardiovascular system বস এর উন্নয়ন ঘটে এবং ভ্রুণটি পুষ্টির জন্য তার মাতৃরক্তের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ১৫-১৬ দিনের মাথায় আলাক বাচ্চাদানির দেয়ালে ঝুলন্ত দেহবস্তুর মত ঝুলে থাকে। তাই আরবী আলাক শব্দের তিনটি অর্থ বিজ্ঞানসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ১- জমাট রক্তপিণ্ড, ২- জোক সদৃশ বস্তু এবং ৩- ঝুলন্ত দেহ বস্তু।

৪. মুদগাহ (Somites)

আরবী ‘মুদগা’ শব্দের অর্থ গোশতপিণ্ড। এটা কি বিজ্ঞানী বলা হয় Somites। ব্লাস্টোসিষ্ট এর বাহিরের স্তর ট্রফোব্লাস্ট নিঃসৃত এনজাইম এর প্রভাবে প্রাচীর কলা টিস্যু বিগলিত হলে ব্লাস্টোসিষ্ট নিমজ্জিত হয়। যার ফলে Blastocyst সুমিটেস এ পরিণত হয়। আল-কুরআনে যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে মুদগাহ। এ প্রক্রিয়া অন্তত ২৩ থেকে ৪২ দিন পর্যন্ত চলে। মুদগাহ অবস্থায় ভ্রুণকে প্রকৃতপক্ষে চর্বন বস্তুর মত (chewed like substance) দেখায়। তখন ১৩ টি খাজ কাটা গোশতপিণ্ডের ব্লক ভ্রুণের শিরদাড়ায় সাজানো থাকে যেগুলোকে বলা হয় মেসোডারমাল সেগমেন্ট mesodermal segments।

৫. ইযাম (Skeleton)

ইজাম অর্থ অস্তি বা কঙ্কাল। বিজ্ঞানে এটাকে স্কেলেটন বলা হয়। এ পর্যায়ে প্রথমে যে অস্থিগুলো দেখা দেয় সেগুলো হচ্ছে উপরিভাগের কচি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। প্রাথমিক ছয় সপ্তাহে কচি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মেসিনচিমেল টিস্যুগুলো কোমল অস্তিতে পরিণত হয়ে ভবিষ্যৎ অস্থির স্বচ্ছ মডেল গঠন করে। ছয় সপ্তাহের শেষের দিকে উপরের দিকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কঙ্কালের পূর্ণাঙ্গ কোমল মডেল প্রদর্শন করে। বারো সপ্তাহের মধ্যে ভ্রুণের একটি ক্ষুদ্র পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল গঠিত হয়। মানব কঙ্কালে মোট ৩৬০ টি জোড়া থাকে। এক স্তরে ৩৬০ টি জোড়া সমৃদ্ধ কঙ্কালতন্ত্র সম্পূর্ণ হতে ১২ সপ্তাহ সময় লাগে। মানব কঙ্কাল মোট ২০৬ টি হাড় দ্বারা গঠিত।

৬. লাহম (Muscles)

লাহম অর্থ মাংসপেশী। এটাকে বিজ্ঞানী বলা হয় মাসেলস স্টেজ। সপ্তম সপ্তাহ থেকে কঙ্কালতন্ত্র বিস্তার লাভ করে এবং অস্থিগুলো যথাযথ আকার ধারণ করে অষ্টম সপ্তাহ থেকে অস্থির চারপাশে পেশিগুলো অস্তৃত হতে থাকে। অষ্টম সপ্তাহ শেষ হলে নির্দিষ্ট পেশিতন্ত্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং মাথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ সময় নড়াচড়া করতে সক্ষম হয়।

৭. রুহ (Foetus)

এটা সর্বশেষ স্তর। এস্তরে মানব শিশু পরিপূর্ণতা লাভ করে। আরবী খালকান আখরা অর্থ ভিন্ন আকার। গর্ভে থাকার পূর্ণ সময় পরে এবং শিশু ভূমিষ্ঠ হয় অর্থাৎ আল্লাহ পাকের ইচ্ছা অনুযায়ী শিশুটি আপন অস্তিত্বে মূর্ত হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানে এই পর্যায়কে Foetus ফিটাস বলা হয়েছে। Foetus অর্থ Miniature human baby।

ভ্রুণের বিকাশজনিত বর্ণনা আল-কুরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে, যেমন-

فَاِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ تُرَابٍ ثُمَّ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ  ثُمَّ مِنۡ عَلَقَۃٍ  ثُمَّ مِنۡ مُّضۡغَۃٍ مُّخَلَّقَۃٍ  وَّ غَیۡرِ مُخَلَّقَۃٍ  لِّنُبَیِّنَ لَکُمۡ

‘আমরা তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট গোশতপিণ্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্য’ (সূরা আল-হজ্জ: ৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ تُرَابٍ ثُمَّ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ  ثُمَّ مِنۡ عَلَقَۃٍ  ثُمَّ یُخۡرِجُکُمۡ طِفۡلًا  ثُمَّ  لِتَبۡلُغُوۡۤا  اَشُدَّکُمۡ ثُمَّ لِتَکُوۡنُوۡا شُیُوۡخًا ۚ وَ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّتَوَفّٰی مِنۡ قَبۡلُ وَ لِتَبۡلُغُوۡۤا  اَجَلًا مُّسَمًّی وَّ  لَعَلَّکُمۡ  تَعۡقِلُوۡنَ

‘তিনি তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা, অতঃপর শুক্রবিন্দু দ্বারা, অতঃপর জমাট রক্ত দ্বারা, অতঃপর তোমাদেরকে বের করেন শিশুরূপে, অতঃপর তোমরা যৌবনে পদর্পণ কর, অতঃপর বার্ধক্যে উপনীত হও। তোমাদের কারও কারও এর পূর্বেই মৃত্যু ঘটে এবং তোমরা নির্ধারিত কালে পৌঁছ এবং তোমরা যাতে অনুধাবন কর’ (সূরা আল-মুমিন: ৬৭)।

আধুনিক ভ্রুণ তত্ত্ববিদগণ নিবিড়ভাবে ভ্রুণ বিকাশের পর্যায়গুলো পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করেন যে, প্রতিটি স্তর তিনটি পর্দা দ্বারা সুরক্ষিত এবং এসব আবরণী ভ্রুণকে শরীর বৃত্তীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। বিজ্ঞানে পর্দাগুলো যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তা নিম্মরূপ:

   ১. জাইগোট আবরণী: (ক) Corona radiate (খ) Uterine wall (গ) Abdominal Wall. Uterine wall.
 
   ২. ব্লাস্টোসিস্ট আবরণী:  (ক) Placental membrane  (খ) Uterine wall (গ) Acedominal  Wall.

  ৩.  ফিটাস আবরণী (ক) Aminion (খ) Chorion (গ) Tropoblast.

বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিষ্কার এই পর্দা বা আবরণী সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یَخۡلُقُکُمۡ  فِیۡ بُطُوۡنِ اُمَّہٰتِکُمۡ  خَلۡقًا مِّنۡۢ بَعۡدِ خَلۡقٍ فِیۡ ظُلُمٰتٍ ثَلٰثٍ

‘তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে পর্যায়ক্রমে একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে’ (সূরা আয-যুমার: ৬)। দেখা যাচ্ছে প্রতিটি স্তরে তিন ধরনের কুশলী আবরণী বা পর্দা রয়েছে। যেগুলো ভ্রুণকে নিরাপদ সংরক্ষণের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে। উপরিউক্ত আয়াতে বিভিন্ন স্তরে তিন প্রকার সুদৃঢ় পর্দার ধারণা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিষ্কার এবং হাজার বছর পূর্বের অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের মাঝে অনবদ্য এ মিল আল-কুরআনের অলৌকিকত্বের সাক্ষ্য বহন করে।


* সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা), সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।





প্রসঙ্গসমূহ »: কুরআনুল কারীম
বিদ‘আত পরিচিতি (২৬তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি (৫ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
সুন্নাতের রূপরেখা (শেষ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আলো ও অন্ধকার (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
উমরাহ ও হজ্জের সঠিক পদ্ধতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী শিষ্টাচার (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন

ফেসবুক পেজ