বিদ‘আত পরিচিতি
-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*
(৮ম কিস্তি)
দ্বিতীয় দলীল
আব্দুর রহমান ইবনু আব্দুল ক্বারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রামাযান মাসে নিয়মিত তারাবীহ ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায়ের সুবন্দোবস্ত হতে দেখে ওমর ফারূক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ ‘কী সুন্দর নতুন সৃষ্টি![১]
সুধী পাঠক! উক্ত হাদীছ পেশ করে বিদ‘আতীরা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, সকল বিদ‘আই ভ্রষ্ট নয় বরং কিছু কিছু বিদ‘আত প্রশংসিত। যেমন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তারাবীহর ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায়ের দৃশ্য দেখে তাকে ‘সুন্দর বিদ‘আত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া দাবী করা হয় যে, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তারাবীহর ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করার পদ্ধতি নতুন করে চালু করেছিলেন। সুতরাং কিছু বিদ‘আত যদি প্রশংসতি না-ই হবে, তাহলে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কেন ‘সুন্দর বিদ‘আত’ বললেন? তদুপরি খলীফাদের নির্দেশনা ও আমলও তো শরী‘আতের দলীল হিসাবে সাব্যস্ত।[২]
জবাব
উক্ত হাদীছে বিদ‘আতে হাসানার কোন দলীল নেই এবং দলীল দেয়ারও কোন সুযোগ নেই। কেননা ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বক্তব্য نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ ‘কী সুন্দর নতুন সৃষ্টি!’ বাক্যে الْبِدْعَةُ শব্দটি শারঈ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি বরং শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনটি শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অনেকেই ধারণা করে যে, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বক্তব্যে বিদ‘আতে হাসানার দলীল রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ‘বিদ‘আত’ শব্দটি আভিধানিক তথা শাব্দিক অর্থে ব্যবহার করেছেন শারঈ অর্থে নয়। আর ‘বিদ‘আত’-এর শাব্দিক অর্থ হল- এমন কাজ করা, যার পূর্বে কোন দৃষ্টান্ত ছিল না। আর শারঈ অর্থ হল- এমন আমল করা যে ব্যাপারে শরী‘আতের কোন সুস্পষ্ট দলীল নেই’।[৩]
ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) (৭৩৬-৭৯৫ হি.) বলেন, ‘সালাফদের বক্তব্য অনুযায়ী উক্ত হাদীছে শাব্দিক বিদ‘আত বুঝানো হয়েছে শারঈ বিদ‘আত নয়’।[৪]
এছাড়া ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নতুন করে জামা‘আত চালু করেননি। তিনি কেবল আগে থেকে চলে আসা খ- খ- জামা‘আতকে এক জামা‘আতে পরিণত করে শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যবর্ধন করেছিলেন। সুতরাং তিনি নতুন করে জামা‘আতের সূচনা করেছেন এ কথা সঠিক নয়। নিম্নের হাদীছ থেকে সেটাই প্রমাণিত হয়-
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَبْدِ الْقَارِيِّ أَنَّهُ قَالَ خَرَجْتُ مَعَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ لَيْلَةً فِي رَمَضَانَ إِلَى الْمَسْجِدِ فَإِذَا النَّاسُ أَوْزَاعٌ مُتَفَرِّقُوْنَ يُصَلِّي الرَّجُلُ لِنَفْسِهِ وَيُصَلِّي الرَّجُلُ فَيُصَلِّي بِصَلَاتِهِ الرَّهْطُ فَقَالَ عُمَرُ إِنِّيْ أَرَى لَوْ جَمَعْتُ هَؤُلَاءِ عَلَى قَارِئٍ وَاحِدٍ لَكَانَ أَمْثَلَ ثُمَّ عَزَمَ فَجَمَعَهُمْ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ ثُمَّ خَرَجْتُ مَعَهُ لَيْلَةً أُخْرَى وَالنَّاسُ يُصَلُّوْنَ بِصَلَاةِ قَارِئِهِمْ قَالَ عُمَرُ نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ وَالَّتِي يَنَامُوْنَ عَنْهَا أَفْضَلُ مِنَ الَّتِيْ يَقُوْمُوْنَ يُرِيْدُ آخِرَ اللَّيْلِ وَكَانَ النَّاسُ يَقُوْمُوْنَ أَوَّلَهُ.
আব্দুর রহমান ইবনু আব্দুল ক্বারী বলেন, রামাযানের কোন এক রাত্রে আমি ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে মসজিদের দিকে বের হলাম। তখন লোকেরা পৃথক পৃথক হয়ে বিচ্ছিন্ন ছিল। কেউ একাকী ছালাত পড়ছিল, আবার কেউ ছালাত পড়ছিল আর তার ছালাতের সাথে একদল লোক ছালাত আদায় করছিল। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমি যদি তাদেরকে একজন ক্বারীর পিছনে একত্রিত করি তাহলে তা ভালো হবে। অতঃপর ইচ্ছা করলেন এবং উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে লোকদেরকে একত্রিত করলেন। তারপর অন্য এক রাত্রে তাঁর সাথে আমি বের হলাম। তখন লোকেরা একজনের পিছনে ছালাত আদায় করছিল। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, কী সুন্দর নতুন সৃষ্টি! তবে তারা যা পড়ছে তার চেয়ে উত্তম সেটাই যার জন্য তারা ঘুমাত অর্থাৎ শেষ রাত্রের ছালাত। তবে লোকেরা প্রথমাংশেই পড়ত।[৫]
সুধী পাঠক! ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) জামা‘আতে তারাবীহ ছালাতের সূচনাকারী নন। বরং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ই এর সূচনাকারী। তিনি কেবল সেটাই পুনরায় চালু করেছিলেন। আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সংক্ষিপ্ত খেলাফতকালে এবং ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রথমার্ধে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অস্থিরতা ও সমস্যার কারণে উক্ত জামা‘আত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অতঃপর পরিস্থিতি শান্ত হলে পূর্ণাঙ্গ জামা‘আত চালু হয়।[৬]
তৃতীয় দলীল
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
فَما رَأَى الْمُسْلِمُوْنَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنٌ وَمَا رَأَوْا سَيِّئًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ سَيِّئٌ.
‘মুসলিমগণ যা উত্তম মনে করে, তা আল্লাহ তা‘আলার নিকটেও উত্তম। আর মুসলিমগণ যা খারাপ মনে করে, তা আল্লাহ তা‘আলার নিকটেও খারাপ’।[৭] অতএব প্রত্যেক নতুন উদ্ভাবিত বিষয় বিদ‘আত নয় বরং কিছু ভালো বিদ‘আত রয়েছে আবার কিছু মন্দ বিদ‘আত রয়েছে।
জবাব
উক্ত দলীল বিদ‘আতে হাসানার পক্ষে দলীল হিসাবে উপস্থাপন করা মোটেও সমীচীন নয়। তবে যারা গোড়া বিদ‘আতী, কেবল তাদের পক্ষেই এ আছারটিকে বিদ‘আতে হাসানার পক্ষের দলীল হিসাবে পেশ করা সম্ভব। কেননা যে সকল ছাহাবী বিদ‘আত প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তন্মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) অন্যতম ছিলেন। যেমন তিনি বলেন,
اِتَّبِعُوْا وَلَا تَبْتَدِعُوْا فَقَدْ كُفِيْتُمْ كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ.
‘তোমরা (সুন্নাতের) অনুসরণ কর, বিদ‘আতের অনুসরণ কর না; সুন্নাতের অনুসরণই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। কেননা প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্ট’।[৮]
সুধী পাঠক! দু’টি কারণে এ বর্ণনাটি বিদ‘আতে হাসানার ব্যাপারে দলীল হিসাবে পেশ করা ঠিক নয়। যেমন,
প্রথমতঃ বর্ণনাটি মাওকূফ অর্থাৎ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর উক্তি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উক্তি নয়। আর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ ‘প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্ট’-এর মত শক্তিশালী মারফূ‘ হাদীছের বিপরীতে মাওকূফ হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ করা বৈধ নয়।[৯] সুতরাং উক্ত আছারে বিদ‘আতে হাসানার কোন দলীল নেই।
দ্বিতীয়তঃ উক্ত বর্ণনায় ‘সকল বিদ‘আত ভ্রষ্ট নয় বরং কিছু কিছু বিদ‘আত উত্তম’ প্রমাণ করার কোন সুযোগ নেই। কেননা পেশকৃত আছারের মধ্যকার اَلْمُسْلِمُوْنَ এর ال টি জাতিবাচক নয় অর্থাৎ اَلْمُسْلِمُوْنَ দ্বারা গোটা মুসলিম জাতি উদ্দেশ্য নয়। বরং اَلْمُسْلِمُوْنَ শব্দটি ال দ্বারা দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। একটি অর্থ হল- اَلْمُسْلِمُوْنَ এর ال টি عهد (নির্দিষ্টতাসূচক) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎاَلْمُسْلِمُوْنَ দ্বারা সুনির্দিষ্ট কতিপয় মুসলিমকেই বুঝানো উদ্দেশ্য। তাই اَلْمُسْلِمُوْنَ দ্বারা معهود বা সুনির্দিষ্ট মুসলিমগণ তথা কেবল ছাহাবীগণই উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় অর্থটি হল- ال টি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সকল মুসলিমকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তাই সে হিসাবে اَلْمُسْلِمُوْنَ দ্বারা সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ মুজতাহিদগণ উদ্দেশ্য। অতএব ছাহাবায়ে কেরাম ও ন্যায়নিষ্ঠ মুজতাহিদগণ যা ভালো মনে করেন তা আল্লাহ তা‘আলা ভাল মনে করেন। আর তারা যা খারাপ মনে করেন আল্লাহ তা‘আলার নিকটেও সেটা খারাপ হিসাবে বিবেচিত হবে।[১০] আর এটা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, ছাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষিত خير القرون ‘নন্দিত যুগ’-এর অধিবাসী হওয়ায় তাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য। সাথে সাথে যুগের পরম্পরায় তাদের অনুসারী সালাফগণও তাদের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করেই জীবন অতিবাহিত করেছেন। সেহেতু বর্তমানেও তাদের বুঝ হৃদয়ঙ্গম করেই শরী‘আত অনুসরণ করতে হবে।
অতএব আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর উক্ত বক্তব্য দ্বারা বিদ‘আতে হাসানার কোন দলীল নেই। যা উপরের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে। তবে ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
المحدثات من الأمور ضربان. أحدهما: ما أحدث يخالف كتاباً أو سنة أو أثراً أو إجماعاً. فهذه البدعة الضلالة. والثانية: ما أحدث من الخير لا خلاف فيه لواحد من هذا. وهذه محدثة غير مذمومة.
‘নতুন উদ্ভাবিত বিষয় দু’প্রকার। একটি হল- আল-কুরআন, সুন্নাহ, আছার ও ইজমা‘র পরিপন্থী যেকোন নতুন উদ্ভাবিত বিষয়। এ জাতীয় বিষয়গুলো ‘বিদ‘আতুয যালালাহ’ বা ভ্রষ্ট বিদ‘আত। অপরটি হল- আল-কুরআন, সুন্নাহ, আছার ও ইজমা‘র পরিপন্থী নয়, এমন যে কোন নতুন উদ্ভাবিত কল্যাণমূলক বিষয়। এ জাতীয় বিষয়গুলো নিন্দনীয় নয়’।[১১] যেমন, কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলন, মাইকে আযান প্রদান, ইসলামী সম্মেলন ও জালসার আয়োজন করা ইত্যাদি। ইবনুল জাওযী (৫৮০-৬৫৬ খ্রি.) বলেন,
البدعة عبارة عن فعل لم يكن فابتدع والأغلب في المبتدعات أنها تصادم الشريعة بالمخالفة وتوجب التعاطي عليها بزيادة أو نقصان فان ابتدع شيء لا يخالف الشريعة ولا يوجب التعاطي عليها فقد كان جمهور السلف يكرهونه وكانوا ينفرون من كل مبتدع وإن كان جائزا حفظا للأصل وهو الاتباع.
‘বিদ‘আত বলতে যেকোন নতুন উদ্ভাবিত বিষয়কে বোঝানো হয়। অধিকাংশ বিদ‘আতই শরী‘আত পরিপন্থী এবং তা নিয়মিত পালন করা হলে শরী‘আতে সংযোজন-বিয়োজনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শরী‘আতের পরিপন্থী নয়- এ ধরনের নতুন কিছু উদ্ভাবন করা এবং যদি নিয়মিত পালনও করা হয়; তথাপি সালাফে ছালেহীন সুন্নাতের অনুসরণকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরার উদ্দেশ্যে এগুলোকে খারাপ জানতেন এবং তাঁরা প্রত্যেক বিদ‘আতীকে ঘৃণা করতেন, যদিও কাজটি মূলগতভাবে জায়েয হত’। একটু পরে তিনি আরো বলেন,
وقد جرت محدثات لا تصادم الشريعة ولا يتعاطى عليها فلم يروا بفعلها بأسا.
‘তবে যদি শরী‘আতের সাথে সাংঘর্ষিক নয়-এমন অনেক বিদ‘আতও রয়েছে, তা যদি নিয়মিত পালন করা না হয়, তাহলে তারা তা করতে অসুবিধা মনে করতেন না’।[১২]
সুতরাং শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানাহ বলতে কিছুই নেই বরং প্রত্যেক নতুন উদ্ভাবিত এমন বিষয়, যা শরী‘আতের কোন দলীল দ্বারা সাব্যস্ত নয়, তাই ভ্রষ্ট বিদ‘আত হিসাবে পরিগণিত।
মূলনীতি-৩ : সকল বিদ‘আতই হারাম, এতে মাকরূহ বলে কিছু নেই
জনসাধারণের মাঝে হারাম বা নিষিদ্ধের বিষয়টি স্পষ্ট কিন্তু মাকরূহ নিয়ে যথেষ্ট ধুম্রজাল রয়েছে। এজন্য সর্বাগ্রে ‘মাকরূহ’-এর পরিচয় জানা যরূরী। مكروه শব্দটি আরবীكره থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। যার অর্থ অপসন্দ করা। ইসমে মাফঊলের শব্দ مكروه, যার অর্থ অপসন্দীয়।[১৩] পারিভাষিক অর্থ- هو الذي لا يأثم فاعله ويثاب تاركه ‘যে কাজ করলে পাপ নেই এবং ছেড়ে দিলে ছাওয়াব আছে তাকে মাকরূহ বলে’।[১৪] অতএব যেটা হারাম সেটা মাকরূহ নয় আবার যেটা মাকরূহ সেটা হারাম বা নিষিদ্ধ নয়।
উক্ত মূলনীতির আলোকে বলা যায় যে, বিদ‘আতের ক্ষেত্রে মাকরূহ বলে কিছু নেই। কেননা মাকরূহ কাজ কখনো হারাম হয় না। অথচ সকল বিদ‘আতই হারাম। অতএব বিদ‘আত মাকরূহ নয় বরং হারাম। ইমাম মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) (১৩৩২-১৪২০ হি./১৯১৪-১৯৯৯ খ্রি.) বলেন,
ولكن يجب أن نعلم أن أصغر بدعة يأتي الرجل بها في الدين هي محرمة بعد تبين كونها بدعة فليس في البدع كما يتوهم البعض ما هو في رتبة المكروه فقط.
‘বরং আমাদের উপর জানা ওয়াজিব যে, বিদ‘আত স্পষ্ট হওয়ার পরেও যদি কোন ব্যক্তি দ্বীনের মধ্যে ছোট কোন বিদ‘আতও নিয়ে আসে তবুও সেটা হারাম হবে। যদিও অনেকেই ধারণা করে যে, এটা বিদ‘আত নয় কেবল মাকরূহ পর্যায়ের’।[১৫]
উল্লেখ্য, ‘ই‘তিছাম’ প্রণেতা ইমাম শাত্বেবী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ১৩৮৮ হি.) বিদ‘আতকে ‘হারাম’ ও ‘মাকরূহ’ নামে দুই প্রকারে বিভক্ত করেছেন।[১৬] তবে এখানে ইমাম শাত্বেবী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ‘মাকরূহ’[১৭] দ্বারা উদ্দেশ্য হল- মাকরূহে তাহরীমী, যা হারাম সাব্যস্ত করে; মাকরূহে তানযীহী নয়। যেমনটি তিনি বলেন,
إذا تقرر أن البدع ليست في الذم ولا في النهي على رتبة واحدة وأن منها ما هو مكروه كما أن منها ما هو محرم، فوصف الضلالة لازم لها، وشامل لأنواعها، لما ثبت من قوله صلى الله عليه وسلم: "كل بدعة ضلالة" .
‘নিশ্চয় বিদ‘আত নিন্দিত, নিষিদ্ধ ও মাকরূহ প্রভৃতি যে কোন একটি শ্রেণীর উপর স্থায়ী নয় যেমন হারামের উপর স্থায়ী। কেননা বিদ‘আতের ব্যাপারে ভ্রষ্টতার গুণটা অপরিহার্য এবং তার সকল প্রকারই ভ্রষ্টতার মধ্যে শামিল। যেমনটি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ ‘প্রত্যেক বিদ‘আত ভ্রষ্ট’ দ্বারা স্পষ্ট হয়’।[১৮]
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/২০১০; মিশকাত, হা/১৩০১।
[২]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৮৪; মিশকাত, হা/১৬৫; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৭৩৫।
[৩]. শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়্যাহ, তাহক্বীক্ব : ড. নাছির আব্দুল করীম আল-আক্বল, ইক্বতিযাউছ ছিরাতিল মুস্তাক্বীম লি মুখালিফাতি আছহাবিল জাহীম (রিয়াদ : মাকতাবাতুর রুশদ, তা.বি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৫।
[৪]. আবুল ফারজ আব্দুর রহমান ইবনু আহমাদ ইবনু রজব আল-হাম্বালী, জামিঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৮ হি.), পৃ. ২৬৬।
[৫]. ছহীহ বুখারী হা/২০১০; মিশকাত হা/১৩০১; আহমাদ ইবনু আলী ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শারহু ছহীহিল বুখারী (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, ১৩৭৯ হি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২৫৩।
[৬]. আবুল হাসান ওবাইদুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ আব্দুস সালাম আল-মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাছাবীহ (রিয়াদ : দারুল ক্বাবাস, ১ম সংস্করণ, ১৪৩৮ হি./২০১৭ খ্রি.), ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৩-৩৩৮।
[৭]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৬০০; মুসতাদরাকু ‘আলাছ ছহীহাইন, হা/৪৪৬৫।
[৮]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৮৭৭০; দারেমী, হা/২০৫।
[৯]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, সিলসিলাতু আহাদীছিয যঈফাহ ওয়াল মাওযূ‘আহ (রিয়াদ : দারুল মা‘আরিফাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১২ হি./১৯৯২ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭।
[১০]. মিন উছূলিল ফিক্বহি ‘আলা মানহাজি আহলিল হাদীছ, পৃ. ১৯৮-১৯৯; সিলসিলাতু আহাদীছিয যঈফাহ ওয়াল মাওযূ‘আহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭-১৮।
[১১]. আহমাদ ইবনু আলী ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শারহু ছহীহিল বুখারী, ১৩তম খণ্ড (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, ১৩৭৯ হি.), পৃ. ২৫৩; আবূ বকর আহমাদ ইবনু হুসাইন আল-বাইহাক্বী, মানাকিবুশ শাফেঈ, ১ম খণ্ড (কায়রো : মাকতাবাতু দারিত তুরাছ, ১ম সংস্করণ, ১৩৯০ হি./১৯৭০ খ্রি.), পৃ. ৪৬৯।
[১২]. জামালুদ্দীন আবুল ফারজ ‘আব্দুর রহমান ইবনু ‘আলী ইবনু মুহাম্মাদ আল-জাওযী, তালবীসু ইবলীস (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১ম সংস্করণ, ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.), পৃ. ১৭-১৮।
[১৩]. ইবরাহীম মুছত্বাফা ও তার সাথীবৃন্দ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (দারুদ দা‘ওয়াহ, তা.বি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৮৫।
[১৪]. মিন উছূলিল ফিক্বহি ‘আলা মানহাজি আহলিল হাদীছ, পৃ. ১৯৯।
[১৫]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, হাজ্জাতুন নাবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৫ম সংস্করণ, ১৩৯৯ হি.), পৃ. ১০১।
[১৬]. আবূ ইসহাক্ব আশ-শাত্বেবী, আল-ই‘তিছাম (মিশর : আল-মাকতাবাতুজ তিজারিয়াতিল কুবরা, তা.বি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৬-৩৭।
[১৭]. মাকরূহ দু’প্রকার। যথা : মাকরূহে তাহরীমী ও মাকরূহ তানযীহী। মাকরূহে তাহরীমী হল- এটা ওয়াজিবের বিপরীত। এটা অস্বীকার করলে কাফির হবে না; তবে ফাসিক হবে। কোন ব্যক্তি যদি বিনা ওযরে মাকরূহ তাহরীমী কাজ করে, তাহলে সে ফাসিক বলে গণ্য হবে এবং আখিরাতেও আযাবের উপযুক্ত হবে। আর মাকরূহ তানযীহী হল- এটা হচ্ছে ঐ সকল কাজ, যা না করলে সওয়াব আছে কিন্তু করলে গোনাহ নেই। দ্রষ্টব্য : মিন উছূলিল ফিক্বহ ‘আলা মানহাজি আহলিল হাদীছ, পৃ. ১৫৯-১৬৫।
[১৮]. আল-ই‘তিছাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৯।