ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ
-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
(২য় কিস্তি)
প্রচলিত তাবলীগ
১৯২১ সালে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ‘মেওয়াত’ এলাকায় ‘ফিরোযপুর নিমক’ গ্রামে মাওলানা ইলিয়াস (১৩০৩-১৩৬৩হি./১৮৮৫-১৯৪৪ খৃ.) তাবলীগ জামায়াত প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত ফের্কার মূল গ্রন্থ ‘তাবলীগী নেছাব’, যা ‘ফাযায়েলে আমল’ বলে পরিচিত। এর লেখক হলেন ইলিয়াস ছাহেবের জামাই, ভাতিজা এবং ছাত্র মাওলানা যাকারিয়া (১৩১৭-১৪০২হি./১৮৯৮-১৯৮২)। উক্ত গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ মোতাবেক ১৩৯৫ হিজরীতে।[১]
ইলিয়াস ছাহেবের নির্দেশক্রমে তার জামাই ও ভাতিজা মাযাহিরুল উলূম সাহারানপুর মাদরাসার শায়খুল হাদীছ মাওলানা যাকারিয়া ‘ফাযায়েলে আমল’ বা তাবলীগী নিছাব নামে দুই খণ্ডে সমাপ্ত একটি কিতাব রচনা করেন। সেগুলো পার্ট পার্ট করা হয়েছে। যেমন মূল উর্দূ বইয়ের ধারাবাহিকতা হল : ১. হেকায়েতে ছাহাবা ২. ফাযায়েলে নামায। ৩. ফাযায়েলে তাবলীগ। ৪. ফাযায়েলে যিকর। ৫. ফাযায়েলে কুরআন। ৬. ফাযায়েলে রামাযান। ৭. ফাযায়েলে দরূদ। ৮. ফাযায়েলে ছাদাক্বাত ১ম অংশ। ৯. ফাযায়েলে ছাদাক্বাত ২য় অংশ। ১০. ফাযায়েলে হজ্জ। ১ থেকে ৭ অংশ নিয়ে ‘ফাযায়েলে আমল’ নামে প্রথম খণ্ড। আর বাকী অংশ নিয়ে ‘তাবলীগী নিছাব’ ২য় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।[২] উল্লেখ্য যে, বাংলা অনুবাদে শ্রেণী বিন্যাস একটু পরিবর্তন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন অংশ নিয়ে পৃথক পৃথক বই ছাপানো হয়েছে। যেমন- ফাযায়েলে দরূদ, ফাযায়েলে হজ্জ।
এছাড়া মাওলানা ইলিয়াস (রাহিমাহুল্লাহ)-এর পুত্র মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ কান্ধলভী (১৯১৭-১৯৬৫) প্রণীত এবং মুহাম্মাদ সা‘দ কর্তৃক উর্দূ অনুদিত ‘মুন্তাখাব হাদীস’ বইটিও তাদের অনুসরণীয়। এটি প্রথম ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়। তারা দেওবন্দী আলেমদের মতবাদকে সর্বাধিক মূল্যায়ন করে। উক্ত কিতাব ছাড়াও মাওলানা আশরাফ আলীর রচিত ‘বেহেশতী যেওর’, ‘নিয়ামুল কুরআন’ ও ‘মক্বছূদুল মুমিনীন’কে অনুসরণ করে থাকে।
মাওলানা ইলিয়াস ১৯৪৪ সালের ১২ জুলাই মারা যান। ফলে তার পুত্র মাওলানা ইউসুফ কান্দালভীকে আমীরের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং তার মাথায় তার পিতার পাগড়ী পরিয়ে দেয়া হয়। ১৯৬৫ সালে ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকার ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৬৫ সালের ২রা এপ্রিল তারিখে মারা যান। তার জানাযা পড়ান মাওলানা যাকারিয়া। অতঃপর মাওলানা যাকারিয়া ছাহেবের জামাই মাওলানা ইনআমুল হাসান কান্ধলভী (১৯১৮-১৯৯৫)-কে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশে এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৪৪ সালে। বাগেরহাট যেলার অধিবাসী মাওলানা আব্দুল আযীযের মাধ্যমে এর সূচনা হয়।[৩] আর বার্ষিক ইজতেমার সূচনা হয় ১৯৪৬ সালে। ঢাকা কাকরাইল মসজিদে এর উদ্বোধন হয়। ১৯৪৮ সালে বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে। অতঃপর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৮ সালে। লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগাড় গ্রামের মাঠে বার্ষিক ইজতেমার আয়োজন করা হয়। অতঃপর ১৯৬৭ সাল থেকে তুরাগ নদীর তীরে প্রতি বছর কথিত ‘বিশ্ব ইজতেমা’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সাবেক ডি আই টি বর্তমানে ‘রাজউক’-এর ১২৫ একর জমি ইজতেমার মাঠ হিসাবে ব্যবহার করা হত। অবশ্য ১৯৬৭ সালেই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাবলীগ জামায়াতকে এই মাঠ ব্যবহারের মৌখিক অনুমতি দেয়। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ইজতেমা কর্তৃপক্ষকে তিন শতাধিক একর জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত দেন।[৪]
কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মানদণ্ডে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত
অসংখ্য মানুষ না বুঝেই ইলিয়াসী তাবলীগের সাথে জড়িত হয়েছে। তাদের আক্বীদা, আমল ও রীতি-নীতি লালন করছে, যেগুলো কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সাথে সাংঘর্ষিক। উক্ত ভ্রান্ত মতবাদ থেকে মুক্ত করার জন্য আলোচনা করা আবশ্যক। তাই নি¤েœ আমরা ইলিয়াসী তাবলীগের কতিপয় কার্যক্রম ও আক্বীদা উল্লেখ করব ও পর্যালোচনা করব।
(১) তাবলীগ জামায়াতের ভিত্তি
মূলত মাওলানা ইলিয়াস ছাহেবের স্বপ্নের উপর ভিত্তি করেই উক্ত জামায়াতের সূচনা হয়েছে। যেমন তিনি তার সাক্ষাৎকারে বলেন,
آز كل خواب ميں مجہ بر علوم صحيحہ كا القا ہو تا ہى اس لئ كوشش كرو كہ مجهى نيند زيادة آئى (خشكى كى وجہ سى نيند كم ہونى لكى تهى تو ميں نى حاكيم صاحب اور داكر كى مشوره سى سر ميں تيل مالش كرائى جس سى نيند ميں ترقى ہو كئى) آب نى فرمايا كہ اس تبليغ كا طريقة بهى مجہ بر خواب ميں منكشف ہوا-
‘আজকাল আমার উপরে স্বপ্নে ছহীহ ইলম সমূহ অবতীর্ণ হচ্ছে। এ জন্য চেষ্টা করছি যেন আমার বেশী বেশী ঘুম আসে। (আনন্দের কারণে যখন ঘুম কম হতে লাগল, তখন ডাক্তার ও কবিরাজের পরামর্শক্রমে আমি মাথায় তেল মালিশ করলাম। ফলে ঘুমে ডুবে গেলাম)। তিনি বলেন, তাবলীগের এই তরীকাও আমার উপর স্বপ্নে প্রকাশ পেয়েছে’।[৫]
পর্যালোচনা : ইসলামের মানদণ্ড বা সংবিধান হল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ, যা নাযিল হয়েছে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর। তিনি শেষ নবী। ক্বিয়ামত পর্যন্ত আর কোন কিতাব নাযিল হবে না এবং কোন নবীও আসবেন না। কোন নীতি-রীতি পদ্ধতি নাযিল হবে না। রাসূল (ﷺ)-এর মৃত্যু বরণের মাধ্যমে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে। তাবলীগের পদ্ধতি নাযিল হয়েছে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। কিন্তু ইলিয়াস ছাহেব যা দাবী করেছেন, তা মূলত স্বপ্নে পাওয়া উদ্ভট ধর্ম। ইসলাম স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত পবিত্র জীবন বিধান। ইলিয়াসী তাবলীগের মত মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত কোন বানানো ধর্ম নয়। তাই রাসূল (ﷺ) প্রদত্ত দাওয়াতের পদ্ধতিই কেবল অনুসরণযোগ্য। ইসলামে স্বপ্নে প্রাপ্ত মিথ্যা ধারণার কোন মূল্য নেই।
(২) চিল্লা প্রথা
এক চিল্লা বা চল্লিশ দিন। তিন চিল্লা বা বছরে চার মাস। বছর চিল্লা বা একটি বছর পুরোটাই চিল্লার মাঝে ব্যয় করা। জীবন চিল্লা অর্থাৎ সারা জীবনের জন্য চিল্লায় বেরিয়ে যাওয়া। এছাড়া তিন দিন, সাত দিন এবং দশ দিনের জন্য বের হওয়া।[৬]
পর্যালোচনা : পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে উক্ত চিল্লা প্রথার কোন অস্তিত্ব নেই। ৪০ দিনকে লক্ষ্য করে মূলত ‘চিল্লা’ শব্দের ব্যবহার। কথিত আছে যে, চল্লিশ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করার জন্য চল্লিশ দিনকে নির্ধারণ করা হয়েছে।[৭] হাদীছটি গ্রহণযোগ্য হলেও সন্ন্যাসী বা বৈরাগী হয়ে বাড়ী থেকে বের হয়ে গিয়ে উক্ত হাদীছের উপর আমল করতে হবে এ ধরনের কোন সুযোগ ইসলামে নেই। ছাহাবায়ে কেরাম সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তারা কি কখনো উক্ত হাদীছের উপর আমল করার জন্য চিল্লায় বের হয়েছেন? সুতরাং নতুন নিয়ম আবিষ্কার করে ইসলামের মধ্যে বৈরাগ্যবাদ আমদানি করার কোন সুযোগ নেই। দ্বিতীয়তঃ এটা ছালাতর সাথে সম্পৃক্ত, দাওয়াতের সাথে নয়। কল্পিত ব্যাখ্যা দিয়ে কেন চিল্লাপ্রথা চালু করা হল?
উল্লেখ্য, ‘যে ব্যক্তি মসজিদে নববীতে ৪০ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করবে, সে জাহান্নামের আগুন, শাস্তি এবং মুনাফিকের আলামত থেকে মুক্তি পাবে’ মর্মে সমাজে যে হাদীছ প্রচলিত আছে, তা মুনকার বা ছহীহ হাদীছের বিরোধী।[৮] এর সনদে নাবীত্ব ইবনু ওমর নামে একজন দুর্বল রাবী আছে।[৯] তাই উক্ত হাদীছ আমল করা যাবে না। যারা হজ্জ বা ওমরা করতে যান তাদেরকে মদীনায় গিয়ে উক্ত হাদীছের উপর আমল করতে দেখা যায়। এই অভ্যাস অবশ্যই বর্জনীয়।
(৩) গাশত করা
গাশত ফার্সী শব্দ। এর অর্থ ঘোরা-ফেরা, ভ্রমণ করা বা টহল দেয়া। গাশত প্রধানত দুই প্রকার। খুছূছী গাশত বা বিশেষভাবে গমন করা। আর উমূমী গাশত বা ব্যাপকভাবে জামায়াতবদ্ধ হয়ে বের হওয়া। এর আরো কতিপয় প্রকার রয়েছে। যেমন- তা‘রূপী গাশত বা পরিচিতি মূলক, তাশকীলী গাশত বা পরিকল্পনা মূলক এবং তা‘লীমী গাশত বা শিক্ষা মূলক।
পর্যালোচনা : এটা ইলিয়াস ছাহেবের নিজস্ব থিওরি। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এর কোন অস্তিত্ব নেই। আল্লাহ্র পথে দাওয়াত দেয়া ফরয দায়িত্ব তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তা রাসূল (ﷺ)-এর দেখানো রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী হতে হবে। তাই উক্ত কাল্পনিক পদ্ধতি থেকে দূরে থাকতে হবে।
(৪) কাশফ
এর অর্থ অন্তর্দৃষ্টি বা অদৃশ্যের খবর জানা। তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বিশ্বাস করে যে, অলী ও বুযুর্গ ব্যক্তিরা অদৃশ্যের কথা বলতে পারেন। তাদের বইয়ের বহু স্থানে এই কাশফের কথা লেখা আছে। যেমন- আবু ইয়াজিদ কুরতুবী বলেন, আমি শুনেছি, যে ব্যক্তি সত্তর হাযার বার ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ পড়বে, সে জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি পাবে। আমি একদা আমার ও আমার স্ত্রীর জন্য সত্তর হাযার বার পড়ে আখেরাতের সম্বল করে রাখলাম। একদা এক যুবক তার কাশফে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখতে পেল। কিন্তু এর সত্যতার ব্যাপারে আমার কিছুটা সন্দেহ ছিল। একবার সে আমাদের সাথে খাচ্ছিল। হঠাৎ সে চিৎকার দিল এবং তার শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। সে বলল, আমার মা জাহান্নামে জ্বলছে। আমি তাকে দেখতে পেয়েছি। আবু ইয়াযীদ বলেন, আমি তার অস্থিরতা লক্ষ্য করলাম। তখন আমি ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’-এর একটি নেছাব তার মায়ের জন্য বখশিয়া দিলাম। এটা আমি গোপনেই করেছিলাম। এটা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জানা ছিল না। কিন্তু ঐ যুবক তৎক্ষণাৎ বলতে লাগল, চাচা! আমার মা দোযখের আগুন হতে রক্ষা পেয়েছেন। আবু ইয়াযীদ বলেন, এই ঘটনা হতে আমার দু’টি ফায়দা হল : একটি- সত্তর হাযার বার কালেমা ত্বাইয়েবা পড়ার বরকত। আর দ্বিতীয়তটি হল, যুবকের ঘটনার সত্যতা।[১০]
পর্যালোচনা : এটা পরিষ্কার শিরকী আক্বীদা। কারণ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ গায়েব বা অদৃশ্যের খবর রাখেন না। মহান আল্লাহ বলেন,
قُلۡ لَّا یَعۡلَمُ مَنۡ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ الۡغَیۡبَ اِلَّا اللّٰہُ وَ مَا یَشۡعُرُوۡنَ اَیَّانَ یُبۡعَثُوۡنَ
‘আপনি বলুন, আল্লাহ ছাড়া আসমান ও যমীনের কেউই গায়েবের জ্ঞান রাখে না এবং তারা এটাও বুঝে না যে তারা কখন পুনরুত্থিত হবে’ (সূরা আন-নামল : ৬৫)। আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছেন,
قُلۡ لَّاۤ اَمۡلِکُ لِنَفۡسِیۡ نَفۡعًا وَّ لَا ضَرًّا اِلَّا مَا شَآءَ اللّٰہُ ؕ وَ لَوۡ کُنۡتُ اَعۡلَمُ الۡغَیۡبَ لَاسۡتَکۡثَرۡتُ مِنَ الۡخَیۡرِۚۖۛ وَ مَا مَسَّنِیَ السُّوۡٓءُ ۚۛ اِنۡ اَنَا اِلَّا نَذِیۡرٌ وَّ بَشِیۡرٌ لِّقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ
‘আপনি বলুন! আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দ লাভ-ক্ষতি বিষয়ে আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি গায়েব সম্পর্কে জানতাম তবে আমি অনেক কল্যাণ লাভ করতে পারতাম। আর কোন অকল্যাণ আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আমি শুধু মু‘মিন সম্প্রদায়ের জন্য একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৮৮)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَ لِلّٰہِ غَیۡبُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اِلَیۡہِ یُرۡجَعُ الۡاَمۡرُ کُلُّہٗ فَاعۡبُدۡہُ وَ تَوَکَّلۡ عَلَیۡہِ وَ مَا رَبُّکَ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ
‘আকাশ ও যমীনের অদৃশ্য জ্ঞান আল্লাহ্রই এবং তাঁরই কাছে সব কিছু প্রত্যাবর্তিত হবে। সুতরাং তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর উপর নির্ভর কর। আর তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালক অনবহিত নন’ (সূরা হূদ : ১২৩)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,
وَ عِنۡدَہٗ مَفَاتِحُ الۡغَیۡبِ لَا یَعۡلَمُہَاۤ اِلَّا ہُوَ وَ یَعۡلَمُ مَا فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ وَ مَا تَسۡقُطُ مِنۡ وَّرَقَۃٍ اِلَّا یَعۡلَمُہَا وَ لَا حَبَّۃٍ فِیۡ ظُلُمٰتِ الۡاَرۡضِ وَ لَا رَطۡبٍ وَّ لَا یَابِسٍ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ مُّبِیۡنٍ
‘গায়েব বা অদৃশ্যের চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে; তিনি ছাড়া আর কেউই গায়েব জানে না। স্থল ও জলভাগের সব কিছুই তিনি অবগত রয়েছেন, তাঁর অবগতি ব্যতীত বৃক্ষ হতে একটি পাতাও ঝরেনা এবং ভূ-পৃষ্ঠের অন্ধকারের মধ্যে একটি দানাও পড়ে না, এমনি ভাবে কোন সরস ও নিরস বস্তুও পতিত হয় না। সমস্ত বস্তুই সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে’ (সূরা আল-আন‘আম : ৫৯)।
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ... مَنْ حَدَّثَكَ أَنَّهُ يَعْلَمُ الْغَيْبَ فَقَدْ كَذَبَ
‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,... যে ব্যক্তি তোমাকে বলবে যে, রাসূল (ﷺ)গায়েব জানেন তাহলে সে মিথ্যা বলবে।[১১]
অতএব আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গায়েব জানতে পারে এই আক্বীদা পোষণ করা ‘শিরকে আকবার’ বা বড় শিরক। এর পরিণাম ইসলাম থেকে বহিষ্কার আর তওবা ছাড়া মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নাম। তাছাড়া কালেমা বখশানোর উক্ত ঘটনাকে তথাকথিত ছূফীরাই হাদীছ বলে সমাজে বাজারজাত করেছে। অথচ এটি একটি ডাহা মিথ্যা কাহিনী। কারণ ‘সত্তর হাযার বার কালেমা ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করে মৃত ব্যক্তির নামে বখশিয়ে দিলে সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে এটা বানোয়াট কথা। ইবনু তাইমিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি.) এ সম্পর্কে বলেন, ‘এটি ছহীহ বা যঈফ কোন সনদে বর্ণিত হয়নি’।[১২] দ্বিতীয়তঃ কাশফ তথা গায়েবের খবর যুবক কিভাবে জানল? দুনিয়াতে থাকা অবস্থায় জান্নাত ও জাহান্নামের অবস্থা সে কিভাবে বুঝতে পারল? নবী-রাসূলগণ ব্যতীত কোন ছাহাবীও কি উক্ত মর্যাদার অধিকারী হতে পেরেছিলেন? এটা যে জাজ্বল্য মিথ্যা কাহিনী, তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই।
(৫) ছয় উছূল
(ক) কালেমা (খ) নামায (গ) ইলম ও যিকির (ঘ) ইকরামুল মুসলিমীন (ঙ) তাছহীহে নিয়ত এবং (চ) তাবলীগ। উল্লেখ্য যে, তাবলীগ জামায়াতের সূচনালগ্নে এর সংখ্যা ছিল ষাট।[১৩]
পর্যালোচনা : উক্ত ছয় উছূল তাবলীগের না তাবলীগ জামায়াতের তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে এটা ইসলামী তাবলীগের নয়। কারণ ইসলামী শরী‘আতে এ ধরনের কোন দাওয়াতী উছূলের অস্তিত্ব নেই। তাবলীগ জামায়াত যেহেতু পৃথক একটি মতবাদ বা ধমর্, তাই মাওলানা ইলিয়াস ছাহেব তার জন্য পৃথক মূলনীতি আবিষ্কার করেছেন। আর আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এবং রাসূল (ﷺ) কর্তৃক প্রদর্শিত ইসলামের মূল স্তম্ভ পাঁচটি এবং ঈমানের মূলনীতি ছয়টি। এটাই মুসলিমদের জন্য অনুসরণীয়। তাই ইলিয়াসী মূলনীতির অনুসরণ করা যাবে না।
(৬) ‘বিশ্ব ইজতেমা’ ও ‘আখেরী মুনাজাত’
উক্ত দু’টি পর্ব তাদের মূল আকর্ষণ। বড় ইজতেমা হোক বা ছোট ইজতেমা হোক সবশেষে দলবদ্ধভাবে হাত তুলে মুনাজাত করে শেষ করা হয়। বিশেষ করে দীর্ঘ দিন যাবৎ বাংলাদেশে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে যে ইজতেমা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়, সেই ইজতেমায় ‘আখেরী মুনাজাত’ পর্বটি প্রাধান্য পায়। দেশে জ্ঞানী-গুণী ছাড়াও সরকারী আমলাসহ প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত উপস্থিত থাকেন শুধু মুনাজাতের আকর্ষণে।
পর্যালোচনা : ‘আখেরী মুনাজাত’ নামে শরী‘আতে কোন পরিভাষা নেই। ইজতেমা, সম্মেলন, সমাবেশ শেষ করে সকলে মিলে হাত তুলে কথিত মুনাজাত করতে হবে তারও কোন প্রমাণ ইসলামে নেই। এটি বিদ‘আতী আমল। বিশেষ করে ‘আখেরী মুনাজাত’ সবচেয়ে বড় বিদ‘আত। তাই একে ‘আখেরী বিদ‘আত’ বলাই শ্রেয়।
জানা আবশ্যক যে, রাসূল (ﷺ)-এর যুগ থেকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মহা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় আরাফার মাঠে। তাহলে টঙ্গীর মাঠের সম্মেলনকে ‘বিশ্ব ইজতেমা’ বলা যায় কিভাবে? দ্বিতীয়তঃ আরাফার মাঠে যোহর ছালাতের পূর্বে ইমাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করে থাকেন এবং অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী দু‘আ করেন। অতঃপর যোহর ও আছর ছালাত এক আযানে দুই ইক্বামতে পৃথক পৃথকভাবে দুই দুই রাক‘আত করে ক্বছর ছালাত আদায় করেন।[১৪] কিন্তু সেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে কোন মুনাজাত করা হয় না। অথচ আরাফার মাঠ হল দু‘আ কবুলের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। রাসূল (ﷺ) বলেন, خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ ‘উত্তম দু‘আ হল আরাফার দিনের দু‘আ’।[১৫] অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيْهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّهُ لَيَدْنُو ثُمَّ يُبَاهِىْ بِهِمُ الْمَلاَئِكَةَ فَيَقُوْلُ مَا أَرَادَ هَؤُلاَءِ
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা আরাফার দিন ব্যতীত আর কোন দিনে এত মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন না। তিনি তাদের অতি নিকটবর্তী হন এবং তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের নিকট গর্ব প্রকাশ করেন এবং বলেন, তারা কী চাচ্ছে?[১৬] অন্য হাদীছে এসেছে, আল্লাহ নিম্ন আকাশে নেমে আসেন ও ফেরেশতাদেরকে বলেন, اِشْهَدُوْا أَنِّيْ قَدْ غَفَرْتُ لَهُمْ ذُنُوْبَهُمْ وَإِنْ كَانَ عَدَدَ قَطْرِ السَّمَاءِ وَرَمْلِ عَاِلجٍ ‘তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাদের যাবতীয় পাপ ক্ষমা করে দিলাম, যদিও তা আকাশের বৃষ্টির ফোটা সমতুল্য হয় এবং তরঙ্গের বালিকোণার মতও হয়’।[১৭]
সুধী পাঠক! আরাফার মাঠের মত ফযীলতপূর্ণ জায়গায় যদি আখেরী মুনাজাত না হয়, তবে আর কোন্ স্থানে এই মুনাজাত জায়েয হতে পারে? এরপরেও কি মুনাজাত পাগল বিদ‘আতীদের হুঁশ ফিরবে?
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
তথ্যসূত্র :
[১]. ড. মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন, ইসলামী দাওয়াহ ও তাবলীগ জামায়াত : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, জানুয়ারী ২০০৬), পৃ. ৭৭।
[২]. ফাযায়েলে আমল বই দ্র.।
[৩]. ইসলামী দাওয়াহ ও তাবলীগ জামায়াত : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পৃ. ৯৯।
[৪]. ইসলামী দাওয়াহ ও তাবলীগ জামায়াত : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পৃ. ১৪৪-১৪৫।
[৫]. মাওলানা মুহাম্মাদ মানযূর নুমানী, মালফূযাতে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস (লাক্ষ্ণৌ : আল-ফুরকান বুক ডিপু, ২০১০), পৃ. ৫১, অনুচ্ছেদ-৫০।
[৬]. ইসলামী দাওয়াহ ও তাবলীগ জামায়াত, পৃ. ১২৪-১২৫; গৃহীত : কাকরাইল মসজিদে সংরক্ষিত ১৩ নং নথি।
[৭]. তিরমিযী, হা/২৪১; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৯৭৯; মিশকাত, হা/১১৪৪। عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ مَنْ صَلَّى لِلهِ أَرْبَعِيْنَ يَوْمًا فِىْ جَمَاعَةٍ يُدْرِكُ التَّكْبِيْرَةَ الْأُوْلَى كُتِبَ لَهُ بَرَاءَتَانِ بَرَاءَةٌ مِنَ النَّارِ وَبَرَاءَةٌ مِنَ النِّفَاق
[৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১২১২৩; তাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৫৪৪৪।
[৯]. সিলসিলা যঈফাহ, হা/৩৬৪।
[১০]. ফাযায়েলে যিকির (বাংলা), পৃ. ৪৪১; (উর্দূ), পৃ. ৩৮৭।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩৮০।
[১২]. মাজমূউল ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়াহ, ২৪ তম খণ্ড, পৃ. ৩২৩। سُئِلَ عَمَّنْ هَلَّلَ سَبْعِيْنَ أَلْفَ مَرَّةٍ وَأَهْدَاهُ لِلْمَيِّتِ يَكُوْنُ بَرَاءَةً لِلْمَيِّتِ مِنْ النَّارِ حَدِيْثٌ صَحِيحٌ؟ أَمْ لَا؟ وَإِذَا هَلَّلَ الْإِنْسَانُ وَأَهْدَاهُ إلَى الْمَيِّتِ يَصِلُ إلَيْهِ ثَوَابُهُ أَمْ لَا؟. فَأَجَابَ : إذَا هَلَّلَ الْإِنْسَانُ هَكَذَا : سَبْعُوْنَ أَلْفًا أَوْ أَقَلَّ أَوْ أَكْثَرَ وَأُهْدِيَتْ إلَيْهِ نَفَعَهُ اللهُ بِذَلِكَ وَلَيْسَ هَذَا حَدِيْثًا صَحِيْحًا وَلَا ضَعِيْفًا وَاَللهُ أَعْلَمُ
[১৩]. মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া আখতার, তাবলীগ জামায়াত : ঈমানী আন্দোলনের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (ঢাকা : অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ফেব্রুয়ারী ২০০৬), পৃ. ৬১; গৃহীত : মাওলানা ওবায়দুল্লাহ, তাবলীগ জামায়াতের প্রাথমিক ইতিহাস, পৃ. ৬।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/১০৮১, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৭ (ইফাবা হা/১০২০, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৭৯); ছহীহ বুখারী, হা/১৬৬২, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২৫, (ইফাবা হা/১৫৫৬), ‘হজ্জ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮৯; মিশকাত, হা/২৬১৭, পৃ. ২৩০, ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘আরাফা ও মুযদালিফা থেকে প্রত্যাবর্তন’ অনুচ্ছেদ।
[১৫]. তিরমিযী, হা/৩৫৮৫।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৩৫৪; মিশকাত, হা/২৫৯৪।
[১৭]. ছহীহ ইবনে হিব্বান, তাহক্বীক্ব আলাবানী, হা/১৮৮৪, সনদ হাসান; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১১৫৫।
প্রসঙ্গসমূহ »:
দাওয়াত